Scroll Top
19th Ave New York, NY 95822, USA

কৃষ্ণের দুঃখের বারমাস্যা

50small

অ্যাডলফ হিটলারকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের খলনায়ক হিসেবে আমরা যতটা না জানি তার চেয়েও বেশি জানি ইহুদি নিধনযজ্ঞের হোতা হিসেবে। ইহুদিদের হত্যা করার আগে হিটলার জার্মানির বেশিরভাগ পাগলাগারদের বাসিন্দাদের হত্যা করেছিলেন। এর পর হত্যা করা হয়েছিল জিপসি বা বেদেদের, অতঃপর কমিউনিস্টদের এবং অবশেষে ভিন্নমতাবলম্বী বা উদারমনা জার্মানদের। নাৎসিরা যখন পাগলদের হত্যা করছিল তখন জার্মানরা প্রতিবাদ করেনি, কারণ তারাতো পাগল নয়! এর পর যখন বেদেদের ধরা হলো, তখন তারা ভাবলো, আমরা তো বেদে নই! কমিউনিস্টদের যখন মারা হচ্ছিল ধরে ধরে, তখন তারা ভাবলো, এদের মারাই উচিত। প্রায় সব জার্মানই ইহুদিদের উপর কমবেশি নাখোশ ছিল। বড় বড় বিজ্ঞানী, নামকরা ব্যবসায়ী, বড় লেখক-কবি, সব ইহুদী। আমাদের ছেলেমেয়েরা কেন কিছু পারে না! সবাইকে মারার পর এবং যুদ্ধে একের পর পরাজয়ের খবর শোনার পর হিটলার যখন আদেশ দিলেন সব জার্মান নাগরিককে শহরের মেট্রোর সুরঙ্গে ঢুকিয়ে প্রাণঘাতী গ্যাস ছেড়ে মেরে ফেলতে, তখন জার্মানদের বাঁচানোর জন্য পাগল, বেদে, কমিউনিস্ট, ইহুদি কেউই আর বেঁচে ছিল না। জার্মানদের বাপের ভাগ্য, হিটলারের আখেরি খায়েশটা পুরো হয়নি।
একা হিটলারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। ত্রিশ ও চল্লিশে দশকে ইওরোপীয় জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইহুদিনিধনের পক্ষে ছিল। ইহুদিহত্যা বা পোড়ানোর দায়িত্বে ছিলেন আজকের জার্মানদের অনেকের দাদা-পরদাদা। সারাদিন শত শত নিরীহ ইহুদি-কমিউনিস্ট-ভিন্ন মতাবলম্বীকে গুলি করে মেরে বা পুড়িয়ে এসে সন্ধ্যায় বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে জার্মান রেডিও বা টেলিভিশনের অনুষ্ঠান উপভোগ করেছেন অতি স্বাভাবিকভাবে – এরকম অফিসার সে সময়কার জার্মানি-পোল্যান্ড-অস্ট্রিয়ায় ভুরি ভুরি ছিল।
এক সময় ইহুদিদের দুঃখের রাত পোহালো। প্রায় দুই হাজার বছর ধরে রাজ্যহারা থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে না হতেই নিজেদের জন্য একটি রাষ্ট্র উপহার পেলেন তারা: ইসরায়েল। এমন আশা মানুষ করতেই পারে যে নির্যাতনের শিকার ইহুদিরা নিজের দেশে অন্যদের নির্যাতন করবেন না, সবাইকে সমদৃষ্টিতে দেখবেন। কিন্তু সে গুড়ে বালি। ইসরায়েলের অ-ইহুদি জনগণ প্রতিমুহুর্তে এই ইহুদী রাষ্ট্রটির ধারক-বাহকদের হাতে নিগৃহীত হচ্ছেন। জন্মের পর থেকেই এই রাষ্ট্রটি দখল করে নিচ্ছে প্যালেস্টাইনের সিংহভাগ ভূমি। ইহুদিরা প্যালেস্টাইন ছেড়েছিলেন স্বেচ্ছায়, হাজার দুই বছর আগে। কিন্তু আজকের ইহুদিরা প্যালেস্টাইনীদের তাদের মাতৃভূমি ছাড়তে বাধ্য করছেন। যারা প্যালেস্টাইন ছাড়তে পারছেন ন, জেল-জুলুম-জখম-মৃত্যু তাদের নিত্যসঙ্গী।
জীনবৈশিষ্ট্য আর ভাষা – এই উভয় দিক থেকে আরব আর ইহুদিরা নিকট আত্মীয়, অনেকটা বাঙালি-বিহারি-উড়িয়াদের মতো। এখনকার ইহুদিদের গায়ের রঙ যেহেতু সাদা সেহেতু তারা ভাবেন, মুসা নবীও তাদেরই মতো শ্বেতাঙ্গই ছিলেন। অথচ ওল্ড টেস্টামেন্টে নাকি ইঙ্গিত আছে, মুসা নবীর গাত্রবর্ণ সাদা ছিল না। না থাকারই কথা, কারণ, মিশরীয় চিত্রে যেসব মানুষের চিত্র আমরা দেখতে পাই তাদের গায়ের রঙ কালো, চুল আফ্রিকানদের মতো কোকড়ানো। গ্রীক দার্শনিক হেরোডোটাসও ইহুদিদের স্বেতাঙ্গ বলেননি। আরবিদের অনেকের মাথার কুঞ্চিত কেশ দেখলে এমন ধারণা হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে কৃষ্ণ আফ্রিকানদের সাথে তাদের জীন সম্পর্ক রয়েছে।
ইথিওপিয়া, ইরিত্রিয়া, সুদান, নাইজেরিয়া এমনকি সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকায় বেশ কয়েকটি জাতিগোষ্ঠী আছে যাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ইহুদিদের মতোই। এরা ইহুদিদের মতোই শনিবারে প্রার্থনা করে, পুরুষ সন্তানদের খৎনা করায়। ভারতবর্ষের কোচিন অঞ্চলেও কিছু ইহুদি রয়েছে যাদের গায়ের রঙ ভারতীয়দের মতোই বাদামি। এরা হিব্রু-মালয়লম নামে এক মিশ্রভাষায় কথা বলেন। রাজা সলোমনের আমলে নাকি তাঁরা এখানে এসেছিলেন। ইহুদিবিদ্বেষী শাসকদের অত্যাচার অতিষ্ঠ হয়ে এদিক ওদিক পালাতে গিয়ে মুসা নবীর অনুসারীদের অন্তত দশটি গোত্র হারিয়ে গিয়েছিল। সবাই ধারণা করলেন, ভারত আর আফ্রিকার এই ইহুদি জনগোষ্ঠীগুলো সেই হারাধনের দশটি গোত্রের দুই একটি হলেও হতে পারে।
কিন্তু আজকের এই জিন প্রযুক্তির যুগে শুধু মুখে বললেই তো হবে না, দেখাতে হবে যে খাঁটি ইহুদিদের (অর্থাৎ যে ইহুদি পরিবারে অ-ইহুদি কারও সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি স্মরণকালে) জীন মানচিত্রের সাথে এই সব কৃষ্ণ ইহুদিদের জীনমানচিত্রের মিল রয়েছে। করা হলো জিন পরীক্ষা। ফলাফল দেখে সবাই তাজ্জব! কৃষ্ণ ইহুদিদের ওয়াই জিন আর তথাকথিত খাঁটি ইহুদির ওয়াই জিনের মধ্যে মিল শতকরা পঁচানব্বই ভাগ! আর যায় কোথা, কৃষ্ণ ইহুদিরা যে ইহুদি এতে সন্দেহ করার কোনো উপায়ই আর রইলো না। মুসা ছিলেন কালো, তার অনুসারীরাও কালো। জিন আর ধর্ম – এই উভয় দিক থেকে বিচার করলে কৃষ্ণাঙ্গ ইহুদিরা ষোল আনা খাঁটি ইহুদি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে কোটি কোটি শ্বেতবর্ণ ইহুদি, এরা তাহলে কারা? বহু শত বছর আফ্রিকা বা ভারতে থাকতে থাকতে সূর্যের কড়া আলোয় পুড়ে শ্বেত ইহুদিদের গায়ের রঙ কালো হয়ে গেছে – এমনটি হতেই পারে না। যেহেতু ইওরোপ আর মধ্যপ্রাচ্যের ইহুদিদের গাত্রবর্ণ সাদা, সেহেতু এরা সম্ভবত ধর্মান্তরিত ইহুদি এবং কৃষ্ণাঙ্গ ইহুদিরাই হচ্ছেন আদি ইহুদি। এ যুক্তির মোকাবেলা করতে গিয়ে এখন ইহুদি ধর্মবিদেরা বলছেন, ইহুদি কোনো জাতি নয়, এটি একটি ধর্ম। জাতি-ভাষা-বর্ণ নির্র্বিশেষে মানুষ ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করতে পারে।
ত্রিশের দশক থেকেই সারা পৃথিবী থেকে দলে দলে ইহুদিরা এসে প্যালেস্টাইনে বসতি স্থাপন করছিল। আসছিল কৃষ্ণাঙ্গ ইহুদিরাও। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর অভিবাসনের পরিমাণ বহুগুন বৃদ্ধি পেয়েছিল। আয়-উন্নতি করার সুযোগ আফ্রিকার তুলনায় ইসরাইলে বেশি। সুতরাং ইথিওপিয়াসহ আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলের ইহুদিরা দলে দলে চলে এসেছিল ইসরাইলে। ইসরাইলে কৃষ্ণাঙ্গ ইহুদির সংখ্যা বর্তমানে দেড় লাখের মতো। ইসরাইলে আসার পর অবশ্য আবার নতুন করে এদের ধর্মান্তরিত হতে হয়েছিল।
ইসরাইলে সব নাগরিকের অধিকার কাগজে-কলমে সমান হলেও বাস্তবে সমান নয়। ইওরোপ প্রত্যাগত ইহুদিদের সংখ্যা, শিক্ষা, অর্থ, ক্ষমতা সব কিছু অন্য ইহুদিদের চেয়ে বেশি। আধুনিক হিব্রু ভাষা আসলে জার্মানের উপভাষা ইদ্দিশের বাক্যকাঠামোতে প্রাচীন হিব্রু শব্দ বসিয়ে সৃষ্টি করা কৃত্রিম একটি ভাষা। ইওরোপ থেকে আসা ইহুদিরা প্রথম শ্রেণীর নাগরিক, প্যালেস্টাইনের স্থানীয় ইহুদিরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, কৃষ্ণাঙ্গ ইহুদিরা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক। যোগ্যতা থাকলেও কৃষ্ণাঙ্গদের ভালো চাকুরি দেয়া হয় না। নিম্নমানের কাজ সব করানো হয় কৃষ্ণাঙ্গ ইহুদিদের দিয়ে। বাধ্যতামূলক মিলিটারি সার্ভিস করার সময় পান থেকে চুন খসলে কৃষ্ণাঙ্গ যুবকদের কারারুদ্ধ করা হয়। কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের ভালো কোনো স্কুলে ভর্তি করা হয় না। কৃষ্ণাঙ্গ ইহুদি মহিলাদের জন্মনিয়ন্ত্রণে বাধ্য করছে ইসরাইলের প্রশাসন, অপারেশন করে তাদের জরায়ু বা ডিম্বাশয় কেটে বাদ দেয়া হয়েছে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, এরকম অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে উঠেছে। ইহুদি পুরোহিত বা রাবাইরা সময়ে সময়ে এসব ঘটনার প্রতিবাদ করে থাকেন, কিন্তু অবস্থার এখনও বিশেষ পরিবর্তন হয়নি।
গত দুই দশকে সমানাধিকারের দাবিতে ইসরাইলের রাস্তায় একাধিকবার মিছিল করেছে কৃষ্ণাঙ্গ ইহুদিরা। কয়েক বছর আগে (নভেম্বর, ২০০৬) এক পত্রিকায় দেখেছিলাম, মিছিলে অংশগ্রহণকারী ভীতসন্ত্রস্ত এক কৃষ্ণাঙ্গ ইহুদি সরকারী রাস্তায় শুয়ে চাবুকের ঘা খাচ্ছে আর দুই হাত তুলে অশ্বারোহী সাদা ইহুদি পুলিশের ঘোড়ার খুরের আঘাত থেকে নিজের কালো মাথাটি কোনোমতে বাঁচাবার চেষ্টা করছে। কৃষ্ণ ইহুদিদের প্রতিবাদ মিছিলের কারণটা ছিল এই যে ইসরাইলের অন্য সব নাগরিকের মতো কালো ইহুদিরাও লেবানন যুদ্ধে আহত ইসরাইলি সেনা সদস্যদের জন্যে রক্তদান করেছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সে রক্ত ব্যবহার না করে নষ্ট করে ফেলেছিল। কৃষ্ণাঙ্গ ইহুদিদের অভিযোগ: তাদের গাত্রবর্ণ কালো বলেই রক্তটা সরকার ব্যবহার করেনি। সরকারী কর্মকর্তাদের বেসরকারী অজুহাত: ইহুদি হোক আর যাই হোক, যে কোনো আফ্রিকানের রক্তে এইডসের জীবানু থাকা বিচিত্র কিছু নয়।
২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে এক কৃষ্ণাঙ্গ ইহুদি সৈন্যকে বেধরক পিটিয়েছে কয়েকজন ইহুদি পুলিশ। এ রকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে এবং দোষ চাপানো হয় কৃষ্ণাঙ্গদের উপর। এবারকার ঘটনাটা সিসিটিভি ক্যামেরায় রেকর্ড হয়ে গিয়েছিল বলে বোঝা গেছে যে বিনা প্ররোচনায় পেটানো হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্যটিকে। এই ঘটনার প্রতিবাদে কৃষ্ণাঙ্গরা মিছিল করেছে জেরুজালেমে। মিছিল নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশকে জলকামান ও সাউন্ড-গ্রেনেড ব্যবহার করতে হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বাধ্য হয়ে এই ঘটনার নিন্দা করেছেন। অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে।
একই ঘটনা ঘটছে ইংল্যা-ের (এবং আমি নিশ্চিত অন্য অনেক দেশের) দক্ষিণ এশীয় অধ্যুষিত এলাকায়। বেশির ভাগ প্রবাসী বাংলাদেশীর ভাষায় কোনো আফ্রিকান বংশোদ্ভূত ব্যক্তি শ্রেফ এক ‘কালাইয়া’, সেই ব্যক্তির ধর্ম বা সামাজিক অবস্থান যাই হোক না কেন! কোনো ধর্মান্তরিত কালাইয়া যখন বাঙালি বা পাকিস্তানি সংখ্যাগরিষ্ট এলাকার কোনো ধর্মস্থানে গিয়ে স্থানীয়দের সাথে মিশতে চায়, তখন তাদের নাকি অপমান করা হয়, মারধোর করা হয়, এমনকি তাদের দিকে পাথর ছুঁড়ে মারার অভিযোগও শোনা গেছে। লন্ডনে ধর্মান্তরিত এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক এক পাকিস্তানি মেয়ের প্রেমে পড়েছিল। ঐ মেয়ের ভাই নাকি সেই ‘কালে’-কে ছুরি মেরে খুন করার ভয় দেখিয়েছিল। ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছিল সেই যুবক। যেসব দক্ষিণ এশীয় মেয়ে ধর্মান্তরিত কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করেছে তাদেরকে নাকি তাদের বাবা-মা বলেছে: ‘আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে বিয়ে হলে তোমার সন্তানের গায়ের রঙ কি হবে ভেবে দেখেছো একবার?’ (তথ্যসূত্র: বিবিসির প্রতিবেদন, ১৭ই নভেম্বর, ২০১২ প্রভাতী)। যত দোষ কৃষ্ণ ঘোষ! কৃষ্ণ, তুমি ইহুদিই হও বা অন্য যে ধর্মেরই হও, দুঃখ আর অপমান তোমার পিছু নেবে আরও বহুদিন। ছোটবেলায় শোনা স্বর্গীয় শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব আর শেফালী ঘোষের দ্বৈতকণ্ঠে গাওয়া চট্টগ্রামের একটি আঞ্চলিক গানের কলি দিয়ে কৃষ্ণের দুঃখের বারমাস্যা শেষ করি: ‘ওরে কালাচাঁন, তোর কি সুন্দর মুখখান! আয়না ধরি নিজের মুখখান কেনে ন চালি!’

শিশির ভট্টাচার্য্য, অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Comments (11)

Leave a comment