“What one thinks or believes does not matter. What really matters
is the matter of the fact and/or the fact of the matter.”(শিশির ভট্টাচার্য্য, কথাকলি, পৃষ্ঠা: ১৩৬)
১. সূত্রপাত
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে (প্রধানত) ফেব্রুয়ারি মাসের পহেলা তারিখ থেকে শুরু করে কমবেশি একুশ তারিখ পর্যন্ত পত্র-পত্রিকার প্রবন্ধে, বিটিভিতে বা বাইরের আলোচনাসভাগুলোতে বাংলা ভাষার একাধিক সমস্যার কথা বলা হয়ে আসছে। এই সমস্যাগুলোর জন্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পক্ষকে দায়ী করা হয়েছে এবং সমস্যাগুলোর সমাধানের কিছু দিকনির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। বর্তমান প্রবন্ধে এই সমস্যাগুলোর স্বরূপ বিশ্লেষণ করে অমূলক সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে প্রকৃত সমস্যা নিরুপণ করার পর দেখানো হবে এই সমস্যাগুলোর দায় প্রকৃতপক্ষে কার উপর বর্তায়। অবশেষে অবাস্তব, অপেশাদার ও অকার্যকর সমাধানগুলোর দুবর্লতা তুলে ধরে বাংলা ভাষার প্রকৃত সমস্যাগুলোর বাস্তবসম্মত, পেশাদারী ও কার্যকর সমাধানের প্রস্তাব করা হবে।
বাংলা ভাষার সমস্যা নিয়ে আলোচনার যে ধারা গত কয়েক দশক ধরে চলে আসছে তাতে দুটি পর্যায় লক্ষ্য করা যেতে পারে। বাংলা ভাষার বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনার শুরু [সম্ভবত] বিংশ শতকের সত্তরের দশকের মাঝামাঝি কোনো এক বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। তখন থেকে শুরু করে একবিংশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত বাংলাভাষার প্রধান যে সমস্যাটির কথা বিভিন্ন আলোচনায় উঠে আসতো সেটি হচ্ছে: সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা সম্ভব হয়নি। ‘সর্বস্তর’ বলতে বোঝানো হতো প্রধানত তিনটি ক্ষেত্রকে: ১) প্রশাসন, ২) উচ্চ আদালত এবং ৩) উচ্চশিক্ষা। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলিত না হওয়ার জন্যে দোষ দেয়া হতো [নন্দঘোষ] সরকারকেই। গত কয়েক দশকে বিভিন্ন সরকার অবশ্য বাংলা প্রচলনে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। এখন সরকারি কাজকর্মে বাংলা ব্যবহৃত হয়, নি¤œ আদালতেও বাংলা ভাষায় কাজকর্ম চলে। সব গাড়ির নাম্বার-প্লেট বাংলায় লেখা হয়।
একবিংশ শতকের প্রথম দশকের শেষদিকে ফেব্রুয়ারি মাসগুলোতে বাংলা ভাষার নতুন এক সমস্যার কথা বলা হতে লাগলো: ‘ভাষাদূষণ’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ২০১২ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি তারিখে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ‘ভাষাদূষণ নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী’ শিরোনামে এক প্রবন্ধ লিখেছিলেন যাতে ভাষাদূষণের স্বরূপ এবং পরিণাম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা ছিল। মুখ্যত এই প্রবন্ধে প্রতিফলিত মতামতের উপর ভিত্তি করেই আমাদের আলোচনা অগ্রসর হবে।
প্রবন্ধটি গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে এই প্রবন্ধের বরাত দিয়ে বাংলাভাষার ‘করুণ অবস্থা’ নিরসনকল্পে ১৯শে ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব রকিবুদ্দিন আহমেদ। আদালত তাঁর আবেদন আমলে নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয় ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের উপর রুল জারি করেছিলেন (এ ব্যাপারে বর্তমান প্রবন্ধের ভাটিতে বিস্তারিত আলোচনা আছে)। আদালতের রায়ে এবং বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বেশির ভাগ প্রবন্ধে অধ্যাপক ইসলামের মতটিই প্রতিফলিত হয়েছে। বাংলাদেশের সিংহভাগ বুদ্ধিজীবীই হয়তো অধ্যাপক ইসলাম বা আদালতের সঙ্গে একমত হবেন। সুতরাং বাংলা ভাষার দূষণ সম্পর্কে অধ্যাপক ইসলাম বা আদালতের অবস্থানটিই ‘অচিহ্নিত’ (Unmarked) বা সর্বজনগ্রাহ্য অবস্থান। তবে ইন্টারনেটে প্রকাশিত একাধিক লেখালেখি ও ব্লগে এর বিপরীত একটি ‘চিহ্নিত’ (Marked) বা সংখ্যালঘু অবস্থানও দুর্লভ নয়। বর্তমান প্রবন্ধে এই দ্বিতীয় চিহ্নিত অবস্থানটির পক্ষেই প্রধানত সওয়াল করা হবে। এ প্রবন্ধে আমরা দেখাবো, বাংলা ভাষার দূষণ আসলে রজ্জুতে সর্প দর্শনের মতোই একটি মতিভ্রম। দূষণ নিয়ে হৈচৈ আসলে বাংলা ভাষার প্রকৃত সমস্যাকে আড়াল করে এর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি করছে এবং পরিণামে বাংলাভাষী জনগণের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে শ্লথ করে দিচ্ছে।
২. বাংলা ভাষার দূষণ ও এর পরিণাম
২.১. ভাষাদূষণের স্বরূপ
অধ্যাপক ইসলাম মনে করেন, ইদানিংকালের বাংলা ভাষা ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর মতোই ভয়ঙ্করভাবে দূষিত। তাঁর মতে এই ভাষাদূষণ হচ্ছে প্রধানত দুটি ক্ষেত্রে:
ক. উচ্চারণে: নতুন প্রজন্মের একটি অংশ ইংরেজি ঢঙে এবং অন্য একটি অংশ আঞ্চলিক ঢঙে বাংলা শব্দ বা বাক্য উচ্চারণ করছে। লক্ষ্য করা যেতে পারে যে ১নং উদাহরণে কম্পিত ‘র’ গুলো সব তাড়িত ‘ড়’ হয়ে গেছে, সংবৃত ‘এ’-গুলো হয়ে গেছে বিবৃত ‘এ্যা’। ২নং উদাহরণে ‘টিচার’ না বলে ছাত্রীটি বলছে ‘টিসার’ (ঘৃষ্ট-স্পৃষ্ট ‘চ’ এর পরিবর্তে ঘৃষ্ট ‘স’)।
১. “কোনো এক এফ এম রেডিও অনুষ্ঠানের জনৈক মহিলা সঞ্চালকের ঈষৎ নাকী, ইংরেজি-গন্ধী ঘোষণা ছিল অনেকটা এরকম: ‘আঁমি আঁছি ফুঁর্তিতে, আজকে আঁমাড় ব্যাডাড় (Better) অনেক প্ল্যাঁনজও আঁছে। বন্ধুড়া আপনাড়া আপনাদ্যাড় ফেইভাড়িট সঙ এর নাম এ্যাস.এম.এ্যাস. কড়তে থাকুন… ” (শিশির ভট্টাচার্য্য, ‘বাংলা ভাষার তথাকথিত অবক্ষয় বনাম অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা’, যোগাযোগ, ২০১৩)
২. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী বলেছে: ‘আমাদের টিসার হঠাৎ ক্লাস পসপোন করে দিছে। সে তো একটা নোটিশ দিলে পারত।’ অন্য এক ভর্তিচ্ছু ছাত্র শিক্ষককে জিগ্যেস করেছে ‘মামা, ডিনের অফিসটা কুনহানে?’(সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ‘ভাষাদূষণ নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী’, দৈনিক প্রথম আলো, ১২/০২/২০১২)
খ. শব্দব্যবহারে: বাংলা বলার সময় বাংলা শব্দের পরিবর্তে তারা ইংরেজি, হিন্দি ও আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করছে। ১, ৩ ও ৪নং উদাহরণে ইংরেজি শব্দের বাড়াবাড়ি ব্যবহার লক্ষ্যনীয়। ২নং উদাহরণে ক্রিয়া ‘পারতেন’ না বলে ছাত্রীটি বলছে ‘পারত’। ছাত্রটি প্রশ্নবাচক সর্বনাম ‘কোথায়’ এর পরিবর্তে ব্যবহার করছে ‘কুনহানে’। ৫নং উদাহরণে অধিকার-বাচক বিশেষণ ‘তার’ হয়ে গেছে ‘হ্যার’।
৩. “একটি এফ এম রেডিও থেকে এক আর জে বলছে: ‘ফ্রেন্ডসরা, এই অফার কিন্তু ভ্যালিড টিল ফর্টিনথ। সো মনে রেখো। লাইক ইটস আ ফাটাফাটি ইভেন্ট। সো সেন্ড করো…’” (সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, পূর্বোক্ত)
৪.“এক উদ্বিঘœ স্টক-মার্কেট বিশেষজ্ঞ একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে বললেন: ‘স্টক মার্কেট ক্রাইসিসের রিজনগুলো ইনভেস্টিগেট করতে হবে। যেসব বিগ এ্যাক্টর ও প্লেয়ার ব্যাকগ্রাউন্ডে রোল প্লে করছে, যাদের নাম ইব্রাহিম সাহেব তাঁর রিপোর্টে রিভিল করেছেন, তাদের প্রপার পানিশমেন্ট দিতে হবে।” (সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, পূর্বোক্ত)
৫. কোন এক টিভি নাটক বা সিরিয়ালের কাল্পনিক সংলাপ: তুমি কইতাছিলা, হ্যার সাথে তোমার মিট করাটা খুব দরকার। কথাটা তুমি হ্যারে ফোন করে বলতে পারতা, তা না কইরা, আসতে ইচ্ছা হইল, ওমনি বলা নাই কওয়া নাই, হুট কইরা হ্যার বাসায় ইন করবা! (শিশির ভট্টাচার্য্য, পূর্বোক্ত)
আঞ্চলিক উচ্চারণের জন্যে অধ্যাপক ইসলাম দায়ী করেছেন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও পরিবারগুলোকে। অধ্যাপক ইসলামের মতে, ২নং উদাহরণে ছাত্র ও ছাত্রীটির বিকৃত ভাষাব্যবহারে
“বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার দৈন্য এবং পরিবারগুলোর অমনোযোগিতার একটা ছবি ভেসে ওঠে। এর মানে হচ্ছে, বিদ্যালয় এবং পরিবার নতুন প্রজন্মকে সঠিক উচ্চারণে প্রমিত ভাষা ব্যবহার শেখাতে ব্যর্থ হচ্ছে।” (সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, পূর্বোক্ত)
বাংলা ভাষার ইংরেজি শব্দ মিশ্রণের জন্যে অধ্যাপক ইসলাম প্রধানত দোষ দিয়েছেন পণ্য সংস্কৃতিকে যার বাহক ও প্রচারক হচ্ছে এফ এম রেডিও।
“এফ এম রেডিও পণ্য সংস্কৃতির বাহক ও প্রচারক এবং এদের উদ্দিষ্ট সেই তরুণ সমাজ যারা এখনই পণ্যসংস্কৃতির শিকার না হলেও শিকার হওয়ার রাস্তায় আছে। এফ এম সংস্কৃতির উদ্দেশ্য হচ্ছে এই সমাজকে তার ভাষা ভুলিয়ে দিয়ে এমন একটা শূন্যতার সৃষ্টি করা যেখানে পণ্যের চমক প্রতিফলিত হবে ভাষার চমক বা স্মার্টনেসে এবং সে ভাষাটি যে নিজের করে নেবে। এফ এম সংস্কৃতির বাইরে যে স্মার্টনেস দেখাচ্ছে তা এর পণ্য বিক্রির প্রয়োজনে। আজ আমরা এই সংস্কৃতি লুফে নিচ্ছি, বাংলাকে বিকৃত করছি এবং বলছি এতে দোষের কী? এটাতো তরুণদেরই ভাষা।” (সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, পূর্বোক্ত)
এছাড়া ভাষাব্যবহারে শিক্ষিত মানুষের অসাবধানতা বা অপরিণামদর্শিতার কথাও বলেছেন অধ্যাপক ইসলাম। তিনি মনে করেন, ৪নং উদাহরণে ব্যবহৃত ইংরেজি শব্দগুলোর প্রতিটির সুন্দর ও প্রচলিত বাংলা রয়েছে। কিন্তু বক্তা সম্ভবত ‘ফ্যাশনেবল’ হতে গিয়ে সেগুলো ব্যবহার না করে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছেন।
“বাংলা শব্দগুলো ব্যবহার না করতে করতে তিনি হয়তো ভুলে গেছেন। অথবা ইংরেজি শব্দগুলো তৈরি হয়েই থাকে, জিবের ডগায় চলে আসে বাংলা শব্দগুলোকে ঠেলেঠুলে। বিশেষজ্ঞ অন্য যেসব বিশেষজ্ঞ বা অ-বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলেন, তাঁরাও এ রকম ইংরেজিশাসিত বাংলায় কথা বলেন, ফলে এই ভাষাটিই তার মুখের ভাষা হয়ে গেছে। তরুণেরা যেমন একে অন্যের দেখে ইংরেজি শব্দনির্ভর অদ্ভুত উচ্চারণের বাংলা বলে, তেমনি বয়স্করাও ইংরেজির সাহায্য নেন। হয়তো অনেকে এই চটজলদি পাঁচমিশালি ভাষাকে স্মার্ট বিবেচনা করেন, কে জানে।” (সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, পূর্বোক্ত)
২.২. ভাষাদূষণের অব্যশ্যম্ভাবী পরিণাম
অধ্যাপক ইসলাম মনে করেন, ভাষাদূষণের কারণে কথ্য ও লিখিত বাংলা ভাষার সৌন্দর্য ও এর কাঠামোর স্বাভাবিক গতিশীলতা হারিয়ে যাবে। বাংলা ভাষার ‘সঙ্করায়ন’ এর স্বাভাবিক প্রকাশশক্তিকে দুর্বল করবে, বাংলাভাষীদের চিন্তাকে অস্বচ্ছ করে তুলবে।
‘বাংলা ভাষার যে বিকৃতি এখন চলছে তা এই ভাষাকে পরাধীন ও নির্জীব করবে এবং এর ভিতরের সৃষ্টিকল্পনা তিরোহিত করবে। ভাষা যখন তার সৌন্দর্য এবং কাঠামোর গতিশীলতা হারায় অন্য ভাষার অভিধান (রাস্তার ভাষার অভিধানসহ) ছাড়া এক পা চলতে পারে না এবং চললেও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এই ভাষায় কি দর্শনের গূঢ় চিন্তাগুলো প্রকাশ করা যায়? না আমাদের সমাজ নিরীক্ষা বা বিজ্ঞানের বিষয়গুলো? কেউ কেউ হয়তো বলবেন, এই মার খাওয়া ভাষাতো মুখের ভাষা, এ তো লিখিত নয়, তাহলে এত ভাবনা কেন? এর উত্তরে বলা যায়, যে জাতির মুখের ভাষা এখন মার খাওয়া শংকর শ্রেণীর, সে জাতির লেখার ভাষাও দুর্বল হয়ে পড়ে, কারণ এর ব্যবহারকারীদের চিন্তাও অস্বচ্ছ হয়ে পড়ে।… এই পরিবর্তন বাংলার কাঠামোকেই দুর্বল করছে, ক্ষতিগ্রস্ত করছে এর চরিত্রকে, এর স্বাভাবিক প্রকাশকে।” (সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, পূর্বোক্ত)
অধ্যাপক ইসলাম মনে করেন, ভাষাদূষণ বাঙালির পরাজয়ের প্রমাণ। এই পরাজয়ের ফলে বাংলা ভাষার প্রকৃতি আমূল বদলে যাবে।
“এ গ্রহণ যেন বশ্যতা স্বীকারের মতো, নিজের দুর্বলতা এবং অক্ষমতা থেকে যার উৎপত্তি এবং এর মূলে রয়েছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা, আমাদের পরিবারগুলোর উদাসীনতা, সংস্কৃতির পিছু হটা ও দৃশ্য মাধ্যমের প্রাবল্য এবং টেলিভিশনের বিস্তার। এ এমন এক সংকট যা থেকে পরিত্রাণ না পেলে বাংলা ভাষা এক সময় ওই বাংহিংলিশ ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে যাবে।” (সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, পূর্বোক্ত)
লক্ষ্যনীয় যে, অধ্যাপক ইসলাম শুদ্ধতাবাদী নন। তিনি জানেন যে ভাষা কোনো একশৈলিক ভাস্কর্য নয়, এর বহু রূপ থাকে। ভাষায় শব্দমিশ্রণের অবশ্যম্ভাবীতা সম্পর্কেও তিনি ওয়াকেবহাল।
“শুদ্ধবাদীরা শঙ্কিত হন, বাংলাভাষা তার রূপ হারিয়ে কোন শংকর ভাষায় রূপ নেয়, তা ভেবে। অন্যদিকে শুদ্ধবাদীদের অবস্থানকে যাঁরা রক্ষণশীল এবং পরিবর্তন-বিরোধী বলে চিহ্নিত করে, তাঁরা বলেন, এত ভাবভাবীর কী আছে, ভাষা চলবে নদীর মতো, এর ব্যবহারে-প্রয়োগে পরিবর্তন আসবে ভাষা ব্যবহারকারীদের প্রকাশের প্রয়োজনেই। দুই পক্ষের ভাবনাতেই সত্য আছেÑ বাংলা ভাষা যে সত্যি সত্যি একটা মিশ্র ভাষা হয়ে যাচ্ছে, এবং এর নানা স্থানচ্যুতি ঘটছে, এ কথাটা অস্বীকার করার উপায় নেই। আবার শুদ্ধতার চিন্তায় ভাষার নিজস্ব বাঁক ফেরা, নতুন নতুন শব্দ ও পদ গ্রহণ এবং পুরোনো অনেক শব্দ ও পদ বর্জন এবং সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতি-সংস্কৃতির বৃহত্তর ডিসকোর্স বা আখ্যানের প্রকাশগুলোকে তুলে ধরতে এর নানা পালাবদলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়াতেও যুক্তি নেই।… বাংলা ভাষার ইংরেজির উদার অনুপ্রবেশ আজকের নয়, এবং শুধু ইংরেজি নয়, বাংলা ভাষা ১০ হাজারের মতো আরবি-ফার্সি শব্দও নিয়েছে। এ রকম শব্দ নেওয়ার চর্চা সব ভাষাতেই আছে। ইংরেজি নিয়েছে লাতিন, ফরাসি এমনকি হিন্দি-উর্দু থেকে, ফরাসি নিয়েছে ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষা থেকে। এই গ্রহণপ্রক্রিয়া ভাষার হয়ে ওঠার একটি উপাদান” (সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, পূর্বোক্ত)
কিন্তু অধ্যাপক ইসলাম মনে করেন, কোনো ভাষায় সব ধরনের ‘গ্রহণ’ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এমনভাবে শব্দগ্রহণ করা যাবে না যেখানে ভাষার মৌল চরিত্রই বদলে যায় অথবা ভাষা বিপর্যস্ত হয়ে মিশ্র ভাষায় রূপ নেয়।
“বাংলা ভাষায় এখন ‘কিন্তু’র জায়গায় ‘বাট’ এসে গেছে। ‘কাজেই’ না বলে আমরা বলি ‘সো’ এবং ‘যেমন’ না বলে বলি ‘লাইক’। বাংলা ভাষায় টেবিল-চেয়ার পুরোনো কর্জ; যেমন ফটোকপি, মোবাইল, মডেম, নতুন কর্জ, এগুলো নতুন নতুন পণ্য ও সেবা, বিজ্ঞানের নানা উপাদান। প্রযুক্তি বা খাদ্যবস্তু ইত্যাদির ভিনদেশি নাম বা বর্ণনাসূচক। এগুলো আমরা তৈরি করিনি, কাজেই যে দেশে তৈরি হয়েছে, সে দেশে যে নামে ছিল, সে নামেই আমরা তাদের ডাকতে পারি। পিৎজাকে আমরা পিৎজা বলেই অভিহিত করব। বার্গারকে বার্গার। ফ্যাক্সকে আমরা আর কী বলব ফ্যাক্স ছাড়া? কিন্তু ফ্যাক্সযোগে আমরা যদি কোনো চিঠি পাঠাই, তাহলে সেই প্রক্রিয়া বর্ণনা করার জন্য বাংলায় যে যথেষ্ট শব্দ আছে, বাক্য বানানোর রীতি আছে, সেগুলো কেন ব্যবহার বা অনুসরণ করব? কেন বলব ফ্যাক্সটা সেন্ট করো? বন্ধুরা না বলে ফ্রেন্ডস কেন বলব? বিপর্যয় না বলে ক্রাইসিস বলব কোন যুক্তিতে?… ‘বাংলা বিকৃতির যে তিনটি উদাহরণ আমি দিয়েছি, সেগুলোর দিকে তাকালে আমরা সহজেই বুঝতে পারব, এগুলো টেবিল-মোবাইল-পিৎজার মতো সহজ অবধারিত গ্রহণ প্রক্রিয়ার অংশ নয়, বরং অনেক বেশি পরিব্যাপ্ত পরিবর্তনের কিছু নমুনা।… ভাষা একটি জাতির প্রাণ এর অনেক রূপ আছে: আঞ্চলিক, প্রমিত, প্রতিদিনের ব্যবহারের। কিন্তু এর একটা রূপ যদি হয় একেবারে জগাখিচুরি, মিশ্র, বিকৃত, মার খাওয়া এবং তরুণদের যদি ব্যাপকহারে গ্রহণ করতে হয় তখন একটা উদ্বেগ তৈরি হয় বটে।” (সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, পূর্বোক্ত)
অধ্যাপক ইসলাম মনে করেন, ইংরেজি ঢঙে বাংলা বলা বা বাংলায় অপ্রয়োজনে ইংরেজি শব্দ মেশানোর ব্যাপারটি ভাষার স্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়, এটিকে চর্চা করে আয়ত্ব করতে হয়েছে এবং বিশেষ একটি গোষ্ঠী এই চর্চাকে উৎসাহিত করছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে।
“আর জে মেয়েটি নিশ্চয় তাকে যেমন বলা হয়েছে তেমনটা করছে, সে বরং চেষ্টা করছে তার কথাগুলো প্রাণবন্ত করে উপস্থাপনা করতে। সমস্যগুলো তাই ব্যক্তির থেকেও বেশি চর্চার। … আর জে মেয়েটি একটি সম্প্রতি প্রবর্তিত চর্চার পুনরাবৃত্ত করছে এবং করতে করতে এটিকে দিকে এক ধাপ এগিয়ে নিচ্ছে।… ” (সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, পূর্বোক্ত)
অধ্যাপক ইসলাম মনে করেন, মানুষ ইচ্ছা করলেই অকারণ শব্দমিশ্রণ এড়াতে পারে।
“চীনে দেখেছি, একটাও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার না করে অনর্গল কথা বলছে লোকজন। এক ইংরেজি জানা চীনা তরুণকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আসলেই কি সে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছে না, নাকি ইংরেজি শব্দ চীনা উচ্চারণে ইংরেজিত্ব হারিয়েছে। সে হেসে বলেছিল, চীনা ভাষা এতই সমৃদ্ধ যে কদাচিৎ বিদেশি ভাষার আমদানি প্রয়োজন হয়। তথ্যপ্রযুক্তির নতুন নতুন শব্দ-পদকে তারা চেষ্টা করে চৈনিক প্রতিশব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে। তরুণটির ভাষ্য অনুযায়ী এর রকম নতুন শব্দের চীনা প্রতিশব্দ যারা তৈরি করে এবং ব্যবহার করে তাদেরকে সবাই সমীহের চোখে দেখে। অর্থাৎ তারাই স্মার্ট। এ রকম স্মার্ট হওয়ার জন্য কি না কে জানে, ইংরেজি বিভাগে আমাদের এক চীনা ছাত্রী যখন বাংলা বলে, চেষ্টা করে সুন্দর বাংলায় বলতে। যতটা সম্ভব বাংলা শব্দ ব্যবহার করতে।” (সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, পূর্বোক্ত)
অধ্যাপক ইসলামের কল্পনায় প্রতিটি ভাষাকে এক একটি নদী যেগুলো মানবভাষা সমুদ্রে মিলিত হয়েছে। বাংলা ভাষারূপ নদী যদি দূষিত হয় তবে সাগররূপ মানব ভাষাও দূষিত হবে বৈকি।
“দূষিত নদী যখন সমুদ্রে গিয়ে পড়ে সমুদ্রওতো বিপদগ্রস্ত হয়, তাহলে বাংলা ভাষার দূষিত নদী মানব ভাষাসমগ্রের সমুদ্রে পড়ে কী অবদান রাখছে তার স্রোত আর চরিত্র গঠনে, কে জানে। এই দূষিত নদীকে সেই ভাষা সমগ্রসমুদ্র খুব সমীহের চোখে দেখবে, তা বলা যাবে না।” (সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, পূর্বোক্ত)
৩. রজ্জুতে সর্পভ্রম! বাংলা ভাষার কোনো দূষণ কি আদৌ হচ্ছে?
আলোচনা শুরু করার আগে ঠিক করা যাক, ‘বাংলা ভাষা’ বলতে আমরা কী বুঝবো? ‘ভাষা’ বলতেইবা আমরা কী বুঝবো? বর্তমান পৃথিবীতে ‘ভাষা’ কথাটির অন্ততপক্ষে দু’টি আলাদা অর্থ রয়েছে: ১. সর্বজনবোধ্য মান উপভাষা (ঝঃধহফধৎফ ফরধষবপঃ), এবং ২. সবগুলো উপভাষার সমষ্টি। বাংলাদেশ রাষ্ট্র, ভারতের বিহার, আসাম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ− এই চারটি প্রদেশ এবং বার্মার আরাকান অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে সর্বজনবোধ্য যে মান বা প্রমিত উপভাষাটি আছে যাকে সাধারণভাবে ‘মান চলিত বাংলা’ বা ‘প্রমিত বাংলা’ বলা হয় সেটিকে ‘বাংলা’ বলা যেতে পারে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, সিলেট, মেদিনীপুর, বীরভূম… অঞ্চলে প্রচলিত কিছু ইন্দো-আর্য্য উপভাষার সমষ্টিকেও ‘বাংলা ভাষা’ বলা যেতে পারে। এদিক থেকে দেখলে ‘ভাষা’ হচ্ছে একটি বিমূর্ত সত্তা এবং উপভাষাগুলো হচ্ছে এক একটি মূর্ত রূপ। চট্টগ্রামি, ঢাকাইয়া, সিলেটি, বীরভূমের ভাষা এ সবই হচ্ছে এক একটি উপভাষা। প্রমিত বাংলাও একটি উপভাষা বৈ নয়। তবে এটি প্রমিত বা মান উপভাষা হবার কারণে সাধারণ জনগণ এই উপভাষাটিকেই বাংলা ভাষা বলে ধরে নেন এবং বাকি উপভাষাগুলোকে সম্ভবত প্রমিত বাংলারই বিকৃত রূপ বলে মনে করেন।
বাংলা ভাষার দূষণ নিয়ে যে বিশেষজ্ঞরা কথা বলে আসছেন তারা ‘বাংলা’ শব্দের এই দ্ব্যর্থবোধকতার সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকেবহাল বলে মনে হয় না। যেহেতু বাংলার অন্য কোনো উপভাষার দূষণ নিয়ে অধ্যাপক ইসলাম বা অন্য কারও কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না, সেহেতু আমরা ধরে নিচ্ছি, এঁদের কাছে ‘বাংলা’ মানে একান্তই ‘প্রমিত বাংলা’।
৩.১. বাংলাভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক কাঠামের পরিবর্তন প্রসঙ্গে
কমপক্ষে দু’টি উচ্চারণভঙ্গী প্রমিত বাংলার বিকৃতি ঘটাচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়: ১. ইংরেজি উচ্চারণ ভঙ্গি ও ২. আঞ্চলিক উচ্চারণভঙ্গি। এফ. এম. রেডিওর সঞ্চালক, (উচ্চ) মধ্যবিত্ত পরিবারের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়া ছেলেমেয়েদের কথায় ইংরেজি উচ্চারণভঙ্গী লক্ষ্য করা যেতে পারে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ লোকের প্রমিত ভাষা ব্যবহারে আঞ্চলিক উচ্চারণভঙ্গি লক্ষ্য করা যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই দুই উচ্চারণভঙ্গীর কারণে প্রমিত বাংলার উচ্চারণভঙ্গী বদলে যাবার কোনো সম্ভাবনা আদৌ আছে কিনা।
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে আমাদের জানতে হবে, কমবেশি ত্রিশ কোটি বাংলাভাষীর মধ্যে কত কোটি মানুষের মাতৃভাষা প্রমিত বাংলা? বেশির ভাগ বাঙালি প্রমিত বাংলা বুঝতে পারেÑ এটা যদি ধরেও নিই, সবাই নিশ্চয়ই প্রমিত বাংলা বলতে সক্ষম নন। কত কোটি মানুষ প্রমিত বাংলা আদৌ বলতে পারেন? কত কোটি মানুষ কোনো বিশেষ টান ছাড়া প্রমিত বাংলা বলতে পারেন? কত কোটি মানুষ শিক্ষিত? শিক্ষিত বাঙালিরা ছাড়া অন্যরা কি প্রমিত বাংলা বলতে পারেন? এই পরিসংখ্যানগুলো না পেলে নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না, প্রমিত বাংলার উচ্চারণ আদৌ কোনো ঝুঁকির মধ্যে আছে কিনা।
৩.১.১. ইংরেজি ঢঙে বাংলাবাচনের বিপদ প্রসঙ্গে
তরুণসমাজের যে অংশ ইংরেজি-ঢঙে প্রমিত বাংলা বলেন তাদের প্রায় সবাইকে দীর্ঘদিন ইংরেজি ভাষা শেখানো হয়েছে। এদের সিংহভাগ ইংরেজি মাধ্যমেই লেখাপড়া করেছেন। কোটি কোটি বাংলাভাষীর ‘সাগরে’ এ ধরনের তরুণ-তরুণীর সংখ্যা এখনও ‘গোস্পদতুল্য’। উভয় বঙ্গ মিলিয়ে প্রায় ত্রিশ কোটি বাংলাভাষীর মধ্যে কত কোটি লোক ইংরেজি বলতে পারেন যে ইংরেজি ঢঙে প্রমিত বাংলা বলা শুরু করবেন? কোনো ভাষা একটা বিশেষ উচ্চারণের দিকে মোড় নিতে হলে, সেই ভাষাভাষী জনসাধারণের একটা বড় অংশ সেই উচ্চারণে সেই ভাষা বলা শুরু করতে হবে। ইংরেজির ধ্বনিতত্ত্বের প্রভাবে বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের পরিবর্তন একান্তই কষ্টকল্পনা, কারণ সংখ্যাল্পতার কারণে ইংরেজি-ঢঙে বাংলা বলা লোকেরা প্রমিত বাংলা ভাষার উচ্চারণের কোনো পরিবর্তনই করতে পারবে না।
শুদ্ধ, আঞ্চলিকতার গন্ধহীন, ‘নিকষিত হেম’ প্রমিত বাংলা যাদের মাতৃভাষা, ইংরেজি-ঢঙে কথা বলা লোকদের প্রভাবে তাদের ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক কাঠামো পরিবর্তিত হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। কোনো ভাষাগোষ্ঠীর (ব্যক্তির কথা আলাদা) ধ্বনিতাত্ত্বিক কাঠামো একবার গঠিত হয়ে গেলে সাধারণত স্বল্প সময়কালে সে কাঠামোর আর পরিবর্তন হয় না। ঠিক একই কারণে যারা আঞ্চলিক টানে প্রমিত বাংলা বলেন, তাদের ধ্বনিতাত্ত্বিক কাঠামোর উপরও ইংরেজি-ঢঙে কথা বলা লোকদের প্রভাব পড়ার কথা নয়।
আমরা লক্ষ্য করতে পারি যে ভাষাদূষণের জন্যে সাধারণত এফ. এম. রেডিওকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। যত দোষ এফ. এম. ঘোষ! কিন্তু শুধু এফ. এম. রেডিওর পক্ষে কি ত্রিশ কোটি লোকের প্রমিত ভাষা বদলে দেয়া সম্ভব? ইংরেজি ও ফরাসিভাষী অঞ্চলে শত শত এফ. এম. রেডিও আছে [বিশেষত আফ্রিকান বংশোদ্ভূত লোকদের] যেগুলোর সম্প্রচারে বিশেষ উচ্চারণে তথাকথিত ‘দো-আঁশলা’ ইংরেজি-ফরাসি বলা হয়। গত পঞ্চাশ বছরে এই বেতারকেন্দ্রগুলো ইংরেজি বা ফরাসির প্রমিত বা অপ্রমিত কোনো উপভাষার উচ্চারণে কোনো প্রকার প্রভাবই ফেলতে পারেনি।
এফ. এম. রেডিও শুনে তরুণ-তরুণীদের ধ্বনিতত্ত্ব বদলে যাচ্ছে এটাও কষ্টকল্পনা। আসলে এফ. এম. রেডিওগুলো অনুষ্ঠান সম্প্রচারের জন্য সেই ভাষাই বেছে নিয়েছে যে ভাষায় তাদের সম্ভাব্য খদ্দের-শ্রোতারা কথা বলে থাকে। একই মন্তব্য বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত মোস্তফা সারোয়ার ফারুকী এবং তার ভাইবেরাদর কর্তৃক পরিচালিত ইংরেজি-আঞ্চলিক শব্দমিশ্রিত ভাষার নাটক-সিরিয়ালগুলো সম্পর্কেও প্রযোজ্য (উদাহরণ-৫)। এই নাটক-সিরিয়ালগুলোকেও বাংলা ভাষা দূষণের জন্যে দায়ী করা হয়। কোনো রেডিও, টিভি-নাটক-সিরিয়ালে ব্যবহৃত ভাষা প্রমিত ভাষায় স্থায়ী পরিবর্তন নিয়ে আসবেÑ এ দাবি ভাষাবিজ্ঞানসম্মত নয়। নাগরিক সাধারণ মানুষ সচরাচর যে ভাষায় কথা বলে রেডিও-টিভি-নাটক-সিরিয়াল সে ভাষাই ব্যবহার করে থাকে, কারণ এর বিনিয়োগকারীরা সাধারণ মানুষের কাছে একদিকে তাদের নিজেদের অনুষ্ঠান-পণ্য ও অন্যদিকে বাজারের অন্যান্য পণ্যের বিজ্ঞাপন পৌঁছে দিতে চায়। বিপননটা এখানে মুখ্য। সরকারি মাল দরিয়ায় ঢালা যেতে পারে, কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ যেখানে আছে সেখানে বিপননের আবশ্যিকতা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সাধারণ মানুষ সাধারণত বলে না, এমন কোনো কৃত্রিম ভাষা যদি ব্যবহৃত হয় কোনো রেডিও বা টিভি অনুষ্ঠানে তবে সে অনুষ্ঠানের দর্শকপ্রিয়তা কমে গিয়ে বিজ্ঞাপিত পণ্যের বিক্রি কমে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে।
৩.১.২. আঞ্চলিক উচ্চারণে প্রমিত বাংলাবাচনের বিপদ প্রসঙ্গে
৩.১.২.১. আঞ্চলিক উচ্চারণ কেন বিপদের কারণ নয়?
বাংলাদেশের এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন যখন প্রমিত বাংলায় কথা বলে তখন তাদের উচ্চারণে নিজ নিজ মাতৃভাষার ধ্বনিতত্ত্বের প্রভাব লক্ষ্য করা যেতে পারে। এরা সম্মিলিতভাবে সংখ্যায় অনেক, কিন্তু এদের একক কোনো উচ্চারণভঙ্গী নেই। আঞ্চলিক উচ্চারণ একটি নয়, একাধিক (চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, ঢাকা, চাঁপাই-নবাবগঞ্জ, কুষ্ঠিয়া, বীরভূম, মেদিনীপুর…) প্রতিটি অঞ্চলের বিশেষ উচ্চারণভঙ্গীতে যত সংখ্যক লোক প্রমিত বাংলা বলে থাকে তাদের সংখ্যা এত বেশি নয় যে তাদের উচ্চারণের প্রভাবে প্রমিত বাংলার ধ্বনিতত্ত্ব পরিবর্তিত হয়ে যাবে। আমরা যদি ইংরেজি ঢঙে বলা তথাকথিত বাংরেজি বা ডিজুস বাংলাকেও বাংলার নতুন একটা উপভাষা বলে ধরে নিই তাহলে এটা থেকেও বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই, কারণ বক্তা-স্বল্পতার কারণে কোনো উপভাষার পক্ষেই প্রমিত বাংলার ধ্বনিতত্ত্বে কোনো প্রকার স্থায়ী পরিবর্তন আনা কার্যত অসম্ভব।
তবে এটা ঠিক যে উপভাষাগুলোর উচ্চারণরীতির সম্মিলিত প্রভাবে প্রমিত বাংলার উচ্চারণরীতি বদলাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও বদলাতে থাকবে। কিন্তু এই পরিবর্তনের স্বরূপ কী হবে তা কখনই সঠিকভাবে বলা সম্ভব হবে না। তবে কয়েক শ বছর পরে মৃত প্রমিত বাংলা ভাষার শব্দের বানানের সাথে সেই শব্দগুলোর তখনকার হালনাগাদ উচ্চারণের তুলনা করে উপরোক্ত পরিবর্তনের স্বরূপ আংশিকভাবে বোঝা গেলেও যেতে পারে।
৩.১.২.২. প্রমিত ভাষার উচ্চারণে আঞ্চলিক প্রভাব কেন স্বাভাবিক ও অপরিহার্য?
বাংলাদেশের সব শিশুকে প্রমিত উচ্চারণে বাংলা শেখানো কি সম্ভব? এর উত্তর পেতে হলে বুঝতে হবে, শিশুরা কেমন করে উচ্চারণ শেখে? জন্মের কয়েক ঘন্টা পর থেকেই শিশুর শ্রবণযন্ত্রের কাজ শুরু হয়− আশপাশের লোকজনের কথা শুনে শিশু বিভিন্ন স্বর ও ব্যঞ্জনধ্বনির সাথে পরিচিত হতে শুরু করে। মাতৃভাষার ধ্বনিতত্ত্বের ভিত্তিস্থাপন শুরু হয়ে যায় তখনই। এর পর কথা বলা শেখা পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য উচ্চারণক্ষমতা শিশুরা অর্জন করে শ্রেফ অন্যদের কথা শুনে শুনে। একটি বাঙালি শিশুকে যদি জন্মের পর বছর সাতেক চীনে রাখা হয় তবে সে ‘শুদ্ধ’ উচ্চারণে চীনা ভাষা বলবে। এর পর যদি সে বাংলা ভাষা বলতে শেখে তবে তার বাংলা উচ্চারণ বাংলাদেশে থাকা শিশুদের মতো ‘শুদ্ধ’ হবে না। সুতরাং সব শিশুকে যদি প্রমিত উচ্চারণ শেখাতে হয় তবে সব শিশুর চারপাশের সব লোককে প্রমিত উচ্চারণ করতে বাধ্য করতে হবে। এটা কখনই সম্ভব নয়। যেহেতু বেশির ভাগ শিশুর আশেপাশের বেশির ভাগ লোকজনের ভাষা প্রমিত নয়, সেহেতু বেশির ভাগ শিশুর উচ্চারণও প্রমিত হবে না, এটাই স্বাভাবিক।
উপভাষার প্রভাবে প্রমিত ভাষার পরিবর্তন অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ব্যাপার এবং বাংলা ভাষার বিবর্তনের স্বার্থেই এ পরিবর্তনটি ঘটা জরুরি। রোমান সা¤্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীরা নিজ নিজ আঞ্চলিক উচ্চারণে ল্যাটিন বলতো এবং/বা তাদের নিজস্ব [আদিবাসী] ভাষায় ব্যাপকহারে বিকৃত ল্যাটিন শব্দ ব্যবহার করতো। ফরাসি, স্পেনিশ, ইতালিয়ান ইত্যাদি ভাষার উদ্ভব হওয়ার এটা অন্যতম কারণ হতে পারে। উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত প্রাকৃত ভাষাগুলোতে ‘একই শব্দের’ বিভিন্ন প্রাকৃত উচ্চারণ ছিল। একাধিক আঞ্চলিক উচ্চারণেও সংস্কৃত বলা হতো। খ্রীষ্টপূর্বযুগের বিভিন্ন আঞ্চলিক/আদিবাসী ভাষাতেও বিকৃত উচ্চারণে সংস্কৃত শব্দ ব্যবহৃত হতো। এই ঘটনাগুলো বাংলা, হিন্দি, মারাঠি ইত্যাদি ভাষার উদ্ভব হওয়ার অন্যতম কারণ। আজ প্রমিত বাংলা আছে এবং চট্টগ্রামি, সিলেটি ইত্যাদি তথাকথিত উপভাষাও আছে। উপভাষাগুলোতে একই ‘বাংলা’ শব্দ বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়, প্রমিত বাংলা থেকে ব্যাপকহারে শব্দঋণও নেয়া হয়। প্রমিত বাংলাতেও ব্যবহৃত হয় অন্যান্য উপভাষার শব্দ। আদিবাসী ভাষাগুলোতেও ব্যাপকহারে ঢুকছে প্রমিত/অপ্রমিত উপভাষার শব্দ। সব উপভাষায়/আদিবাসী ভাষায় ঢুকছে ইংরেজি বা হিন্দি শব্দ। উপমহাদেশের ভাষা-পরিস্থিতি সবসময় অনেকটা এ রকমই ছিল বলে দাবি করা যেতে পারে। কেউ যদি কোনো প্রমিত বাংলা শব্দের উচ্চারণের সাথে শব্দটির সংস্কৃত রূপের উচ্চারণের তুলনা করেন, তবে প্রমিত বাংলা উচ্চারণটিকে বিকৃত মনে হবার কথা। একইভাবে বেশির ভাগ ফরাসি শব্দকে ল্যাটিন শব্দের বিকৃত রূপ মনে হতে পারে। বাংলা ভাষার বিকৃতি দূর করতে তৎসম-তদ্ভব শব্দগুলো সংস্কৃতের মতো করে উচ্চারণ করতে হয়!
প্রাকৃতিক ধ্বনিতত্ত্বের (Natural Phonology) দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিটি তথাকথিত অশুদ্ধ উচ্চারণ স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক উচ্চারণ। মানুষ স্বাভাবিকভাবে যা উচ্চারণ করতে পারে তাই সে করে। কিছু শুদ্ধ উচ্চারণও স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিকভাবে হয়ে থাকে। কিছু তথাকথিত শুদ্ধ উচ্চারণ মানুষকে প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে শিখতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, ‘বাঘের’ শব্দে বাংলাভাষী মহাপ্রাণ ‘ঘ’ উচ্চারণ করে, কিন্তু ‘বাঘ’ বলার সময় বলে ‘বাগ’, কারণ অক্ষরের উপধায় বা অন্তে মহাপ্রাণতা বজায় রাখা দুষ্কর, অস্বাভাবিক। এ কারণেই জার্মান ভাষায় অক্ষরের উপধায় ‘গ’-গুলো ‘ক’ হয়ে যায় এবং বাংলাভাষী শিশুরা কথা বলতে শেখার শুরুতে সাধারণত ‘বাক’ বলে। অনেক অভ্যাস করে একটা বিশেষ বয়সে এসব শিশুরা উপধায় ঘোষতা বজায় রেখে ‘বাগ’, ‘রাগ’ ইত্যাদি শব্দ সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে শেখে। জার্মান শিশুদের কিছুই শিখতে হয় না। তারা প্রকৃতির নিয়ম মেনে উপধায় ‘ক’ উচ্চারণ করে।
প্রথম অর্জিত ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব দ্বিতীয় ভাষার ধ্বনিতত্ত্বকে অবশ্যই প্রভাবিত করে। এ কারণেই আমরা যখন ইংরেজি বলি তখন আমাদের ইংরেজিতে বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। একই ভাবে একজন চট্টগ্রামীভাষী বা সিলেটীভাষী যখন প্রমিত বাংলা বলেন, তার কথাতেও তার মাতৃ-উপভাষার টান থেকে যায়। কোন মানবসন্তান নিজের প্রথম অর্জিত ভাষার শব্দ-বাক্য অশুদ্ধ উচ্চারণ করে না। যখনি দেখা যাকে কোনো ব্যক্তি কোনো ভাষা ঠিক মতো উচ্চারণ করে উঠতে পারছে না তখনি ধরে নিতে হবে যে ভাষাটি তার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অর্জিত ভাষা, মাতৃভাষা নয়।
৩.১.২.৩. শুদ্ধতার ধারণা একটি কুসংস্কার
প্রায়ই অভিযোগ করা হয় যে হালের তরুণেরা শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা বলছে না। মনে রাখা দরকার যে ‘শুদ্ধ’ ও ‘অশুদ্ধ’ ভাষাবিজ্ঞানে নিষিদ্ধ দু’টি শব্দ। বলতে হবে: ‘গ্রহণযোগ্য’ আর ‘গ্রহণ-অযোগ্য’ (বা ‘অগ্রহণযোগ্য’)। এই গ্রহণযোগ্যতার একটি মাপকাঠি আছে এবং তাতে বিভিন্ন দাগকাটা আছে: ১. গ্রহণযোগ্য, ২. মোটামুটি গ্রহণযোগ্য, ৩. প্রায় গ্রহণ-অযোগ্য, ৪. কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয় ইত্যাদি। মাতৃভাষা বলার সময় মানুষ অবশ্যই গ্রহণযোগ্য উচ্চারণ করে। মানুষ যখন দ্বিতীয় ভাষা ব্যবহার করে তখন তার উচ্চারণের গ্রহণযোগ্যতা স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়, কারণ প্রথম অর্জিত ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব¡ (Phonology) দ্বিতীয় ভাষার ধ্বনিতত্ত্বকে প্রভাবিত করে। এটাই স্বাভাবিক, কারণ ধ্বনিতত্ত্বকে অতিক্রম করার ক্ষমতা প্রকৃতি বেশির ভাগ মানুষকে দেয়নি। সুতরাং যখনি দেখা যাবে, কেউ কোনো উপভাষার শব্দ বা বাক্যের ‘শুদ্ধ’ উচ্চারণ করতে পারছে না, তখনি ধরে নিতে হবে ভাষাটি তার মাতৃভাষা নয়, দ্বিতীয়/তৃতীয় অর্জিত ভাষা। যারা প্রমিত উচ্চারণে প্রমিত বাংলা বলতে পারেন না, প্রমিত বাংলা তাদের মাতৃভাষা নয় বলেই পারেন না।
যে কোনো সমাজে বেশির ভাগ লোক গ্রহণযোগ্য উচ্চারণ করেন। ‘গ্রহণযোগ্য’ মানে এ রকম: ‘তোমার উচ্চারণটা ঠিক আমার মতো নয়, কিন্তু আমি মেনে নিচ্ছি।’ এই মেনে নেওয়া দিয়েই মানুষে মানুষে যোগাযোগের কাজ সাড়ে পনেরো আনা চলে যায়। উচ্চারণ অভিধান টায়ে টায়ে অনুসরণ করে সদা সর্বদা প্রমিত উচ্চারণ করে উঠতে পারেন এমন লোকের সংখ্যা যে কোনো সমাজে হাতে গোনা। এটা অনেকটা সার্কাসে শারিরীক কসরৎ করা বা গান গাওয়ার মতো, সবাই যেমন ভালো গাইতে পারে না, সার্কাসে খেলা দেখাতে পারে না, হাতে গোনা দুই একজন পারে, তেমনি কোনো সমাজের সব সদস্য প্রমিত উচ্চারণ শিখে উঠতে পারে না। বিশেষ ব্যক্তি সযতেœ অভ্যাস করে কোনো বিশেষ উচ্চারণ রপ্ত করতে পারে। কোনো গোষ্ঠীর পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়, ভাষার ইতিহাসে তেমন নজির নেই।
পৃথিবীর বেশিরভাগ সমাজে (প্রধানত) মিডিয়ার প্রভাবে বিশেষ একটি উচ্চারণরীতির প্রতি মানুষের পক্ষপাতিত্ব সৃষ্টি হয়। সমাজের বেশিরভাগ লোক এই কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হওয়ার কারণে শুদ্ধ উচ্চারণ করা ব্যক্তিদের বেতার-টিভিতে ঘোষকের কাজ পেতে সুবিধা হয়। কিন্তু সবাইতো আর বেতার-দূরদর্শনে কাজ করবে না যে সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে শুদ্ধ উচ্চারণ শিখতে হবে। দেশে আরও ঢের কাজ আছে যেগুলো প্রমিত উচ্চারণ ছাড়াও চমৎকার চলতে পারে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপিতা শেখ মুজিব কোনো প্রমিত উচ্চারণে ৭ই মার্চের ভাষণ দেননি। মার্কিন প্রেসিডেন্টদের মধ্যে কতজন প্রমিত উচ্চারণে ইংরেজি বলেন? বুশ, ক্লিনটন আর ওবামার উচ্চারণরীতি যদি আলাদা হয়ে থাকে তবে এদের মধ্যে কোনো একজন প্রমিত ইংরেজি উচ্চারণ করছেন না, কিন্তু তাতে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনে তাঁর কোনো অসুবিধা হয়নি বা হচ্ছে না।
৩.১.২.৪. শুদ্ধতার বিপদ
যদি কোনো অলৌকিক উপায়ে সব বাংলাভাষীকে শুদ্ধ বা প্রমিত উচ্চারণে অভ্যস্ত করে ফেলা সম্ভবও হয় তবে তাতেও একটি বিপদের আশঙ্কাও আছে। সমাজের সব স্তরের লোক যদি শুদ্ধ উচ্চারণে অভ্যস্ত হয়েই যায় তবে সবার প্রমিত উচ্চারণের প্রভাবে উপভাষাগুলোর ধ্বনিতত্ত্ব বদলে যাবে। তখন উপভাষাগুলোর উচ্চারণশুদ্ধতা রক্ষা করার জন্যে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে? উপভাষাগুলোর অস্তিত্বকে সঙ্কটে ফেলে প্রমিত ভাষার বাড়বাড়ন্ত হলে আখেরে প্রমিত ভাষাই বিপদে পড়তে পারে। ফ্রান্সের মতো দেশে গত কয়েক শতক ধরে সরকারিভাবে এই ভুল ভাষানীতি অনুসরণ করার কারণে বহু উপভাষার মৃত্যু হয়েছে।
পৃথিবীর অনেক দেশেই মানুষ তথাকথিত শুদ্ধ উচ্চারণের (কু)সংস্কারমুক্ত হয়ে বুঝতে পারছে যে যা সবাই পারে না তা কিছুটা হলেও কৃত্রিম, অস্বাভাবিক। তাছাড়া প্রমিত উচ্চারণ সব ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়। পল্লীগীতি বা লালনগীতি গাইবার সময় প্রমিত নয়, আঞ্চলিক উচ্চারণই শুনতে ভালো লাগে। শুদ্ধ উচ্চারণ বিপদেরও কারণ হতে পারে। এমন অনেক দেশ আছে যেখানে রাজনীতিবিদের প্রমিত উচ্চারণের বদভ্যাস তার ক্যারিয়ারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ফ্রান্স ও কানাডার কুইবেকে রাজনীতিবিদেরা যদি নির্বাচনী প্রচারণায় নিজ নিজ অঞ্চলের উচ্চারণবিধি প্রয়োগ করে বক্তৃতা না দেন তবে তাকে ভূমিপুত্র হিসেবে গণ্য নাও করা হতে পারে এবং নির্বাচনে তিনি হেরে যেতে পারেন।
৩.১.২.৫. উচ্চারণ-শুদ্ধতার নির্দিষ্ট একটি মানদ- নেই
শুদ্ধতার মানদ- কালের প্রবাহে বদলায়, ভৌগোলিকভাবেও বদলায়। আজ যে উচ্চারণরীতি শুদ্ধ হিসেবে স্বীকৃত, কাল সেটাই অশুদ্ধ বলে পরিগণিত হতে পারে। কুইবেকের ফরাসি উচ্চারণ ছিল আজ থেকে তিন/চারশো বছর আগের প্রমিত ফরাসি উচ্চারণ। এখন সেই উচ্চারণ করলে প্যারিসের রেডিও-টিভিতে কাজ পেতে অসুবিধা হয়। আবার সেই একই উচ্চারণ করলে কুইবেকের রেডিও-টিভিতে কাজ পেতে কোনো অসুবিধা হয় না, বরং সুবিধা হয়। কুইবেকে যা প্রমিত উচ্চারণ ফরাসিদেশে তা আঞ্চলিক উচ্চারণ। এখন এই দুই ফরাসি উচ্চারণরীতির মধ্যে কোনটিকে শুদ্ধ আর কোনটিকে অশুদ্ধ বলা হবে?
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাজারে একাধিক প্রমিত উচ্চারণ অভিধান রয়েছে, যার মানে হচ্ছে এই যে মান বা প্রমিত (Standard) উচ্চারণ কি হওয়া উচিত তা নিয়ে উভয় বাংলার উচ্চারণবিদদের মধ্যে দ্বিমত আছে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে ‘শুদ্ধ’ উচ্চারণে যারা বাংলা বলেন তাঁদের উচ্চারণরীতি অনেকটা এক হলেও পুরোপুরি এক নয়। তাই যদি না হবে তবে কোনো বু্িদ্ধজীবীর বক্তব্য শোনামাত্র আমরা কিভাবে বুঝি তিনি এপার, নাকি ওপার বাংলার? এছাড়া, পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ সব বাংলার শুদ্ধ উচ্চারণকারীরা একই উচ্চারণরীতি অনুসরণ করেন− এমন দাবি ধোপে টিকবে না। পৃথিবীর যে কোনো ভাষায় একাধিক প্রমিত উচ্চারণরীতি আছে, বাংলাও এর ব্যতিক্রম নয়।
যদি একাধিক প্রমিত উচ্চারণরীতি থাকে তবে এর মধ্যে একটি অন্যটির তুলনায় বেশি শুদ্ধ। যারা সেই রীতি অনুসরণ করে উচ্চারণ করছেন না, তারা নিশ্চয়ই তুলনামূলকভাবে অশুদ্ধ উচ্চারণ করছেন। কোন প্রমিত উচ্চারণটি বেশি শুদ্ধ, পশ্চিমবঙ্গেরটা, নাকি বাংলাদেশেরটা। এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর না জেনে যিনি প্রমিত উচ্চারণ শিখতে সময় ও অর্থ ব্যয় করছেন, তিনি কোনো ভুল করছেন না তো?
৩.১.৩. ইংরেজি আর আঞ্চলিক শব্দ মিশিয়ে বাংলাবাচনের বিপদ প্রসঙ্গে
৩.১.৩.১. শব্দমিশ্রণ অপরিহার্য এবং অবশ্যম্ভাবী
পৃথিবীর যে কোনো ভাষায় দ্যোতিত (Signified) বা ভাবের সংখ্যা দ্যোতক (Signifier) এর চেয়ে বহু হাজার গুন বেশি। সুতরাং যে কোনো ভাষাকে নতুন শব্দ ঋণ নিতে হয়। বাংলা এককালে ঋণ নিয়েছে সংস্কৃত, ফারসি থেকে, এখন ব্যাপক হারে ঋণ নিচ্ছে ইংরেজি থেকে। এর কারণ: ১. বাঙালিদের একাংশ বাংলা-ইংরেজি দ্বিভাষী এবং ২. ইংরেজি বর্তমান জগতের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা এবং লিঙ্গুয়া একাডেমিকা। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক কারণে ইংরেজি উত্তমর্ণ (Superstrat) ভাষা এবং বাংলা অধমর্ণ (Substrat) ভাষা। বাংলা ইংরেজি থেকে নেবে, এটাই স্বাভাবিক। একইভাবে চাকমা বা গারো ইত্যাদি ভাষা বাংলা থেকে শব্দ নেয়, বাংলা এই ভাষাগুলো থেকে শব্দ নেয় না।
ভাষামিশ্রণ উদ্বেগের কারণ হওয়া উচিত নয়, বরং মিশ্রণ না হলেই ভাষার স্বাস্থ্যহীনতা নিয়ে উদ্বিঘœ হওয়া উচিত। ভাষামিশ্রণ ভাষার প্রকাশশক্তিকে দুর্বল করে না, বরং সবল করে। ভাষার বিবর্তন বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান আছে এমন কোনো ব্যক্তি ভাষার কোনো প্রকার মিশ্রণকে দূষণ বলতে পারেন না। একটা ভাষা অন্য ভাষা থেকে শব্দ নেবেই। কতটা নিতে পারলো, নিয়ে কতটা নিজের মতো করে ব্যবহার করতে পারলো সেখানেই ভাষার শক্তি। মানব ভাষাগুলো একে অপরের কাছ থেকে শব্দ ও ব্যাকরণ ঋণ নিয়েই গত ত্রিশ হাজার বছর টিকে আছে। ইতিমধ্যেই অনেক লেখকের বাক্যবিন্যাসে (উদাহরণ ৬ ও ৭) লেখ্য ইংরেজির প্রভাব লক্ষ্য করা যেতে পারে।
৬. “এফ এম রেডিও একটি মাত্র ব্যতিক্রম বাদে, এখন একটি সম্মিলিত ‘স্মার্ট’ সংস্কৃতি চালু করেছে, যেখানে ইংরেজি শব্দ–তা রাস্তার হোক, অভদ্রজনোচিত হোক–যত ইচ্ছা লাগাতে হবে।” (সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, পূর্বোক্ত)
৭. “তবে সান্তনা- যদি তাকে সান্ত¦না হিসেবে নেন বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক রূপবদলের প্রবল সমর্থকেরা- হলো এই যে এ রকম দূষণে পড়েছে এই উপমহাদেশের অন্য কটি ভাষাও।” (সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, পূর্বোক্ত)
কোনো সমাজে কোনো বিশেষ পণ্য বা ধারণা যদি অন্য কোনো সমাজ থেকে আসে তবে সেই পণ্য বা ধারণার নামও সেই সমাজের ভাষা থেকেই আসাটা স্বাভাবিক। যেহেতু বাঙালি সমাজের একাংশের কমবেশি ইংরেজি জ্ঞান আছে সেহেতু দ্বিভাষীরা বাংলা বলার সময় ইংরেজি শব্দ কমবেশি ব্যবহার করবেই। করাটাই স্বাভাবিক। না করাটা অস্বাভাবিক। আজকালকার ছেলেমেয়েদের ভাষাকে যতই খিচুড়ি ভাষা বলে অবজ্ঞা করুন গুণীজনেরা, নিজেদের কথা ‘রেকর্ড করলে’ তাঁরা দেখবেন কারণে অকারণে কত শত ইংরেজি শব্দ তাঁরা নিজেরাও ব্যবহার করছেন বাংলা বলার সময়। একটিও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার না করে স্বতষ্ফূর্তভাবে মিনিট পাঁচেক বাংলা বলে সেটি রেকর্ড করে দেখুন কি রকম কৃত্রিম শোনায় সেই বাংলা। এতো গেলো শব্দকোষের ব্যাপার। উচ্চারণের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটে। কোনো বাংলাভাষী দিনরাত সর্বক্ষণ একশ ভাগ প্রমিত উচ্চারণে প্রমিত ভাষা বলে না, বলতে পারে না।
অধ্যাপক ইসলামসহ অন্য অনেকেই মনে করেন, ভাষাদূষণ বাংলা ভাষার অস্তিত্ব বিপন্ন করবে। অধ্যাপক ইসলাম বাংলাভাষার সঙ্করায়ন নিয়ে উদ্বিঘœ। হায়! শুধু বাংলা নয়, যে কোনো মানব ভাষাই সঙ্কর ভাষা এবং জীবিত সব ভাষা প্রতিনিয়ত সঙ্করায়নের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। শুধু সংস্কৃত বা ল্যাটিনের মতো মৃত ভাষারই শঙ্করায়ন থেমে গেছে চিরদিনের মতো। থাইল্যান্ড, চীন, মালয়েশিয়া, কোরিয়া… সব দেশের প্রমিত ভাষায় ইংরেজি শব্দ ঢুকছে। যারা আরবি পত্রপত্রিকা পড়ে থাকেন তারা খেয়াল করে দেখবেন, আরবি ভাষাতে কত শত বিদেশি শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। জাপানি ভাষায় গত কয়েক শ’ বছরে ব্যাপকভাবে ইংরেজি থেকে শব্দঋণ নেয়া হয়েছে এবং এই ঋণগ্রহণ এখনও সমানে চলছে। কিন্তু জাপানের বুদ্ধিজীবীরা শব্দঋণ গ্রহণের এই ব্যাপারটাকে জাপানি ভাষা-ধ্বংসের আলামত হিসেবে নয়, বরং জাপানি ভাষার ক্ষমতা হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। শব্দমিশ্রণ মানেই ভাষার বিকৃতি নয়। আর একটা ভাষা পাঁচ-দশ-বিশ বছরে বদলায় না। কোনো ভাষার শব্দকোষ ও ধ্বনিতত্ত্বে দর্শনীয় স্থায়ী পরিবর্তন আসতে কয়েক শতাব্দী লেগে যায়।
“নদী দূষণ ভাষা দূষণ লেখাটা আমি পড়েছি। এটা শুধু বাংলার সমস্যা নয়, মারাঠি, তামিল সব জায়গাতেই এই অবস্থা চলছে। এটা হচ্ছে বিশেষ এক শ্রেণীর ভাষা ব্যবহারের লক্ষণ। এই শ্রেণীটা ইংরেজি ব্যবহার করে। পারঙ্গম না হলেও ব্যবহার করতে চায়। ভাষাগুলো শক্তির ভিত্তিতে সাজানো। যাদের শক্তি বেশি সেই ভাষাটা আমাদের আকর্ষণ করে বেশি।… এই ক্ষমতার জন্যই আমরা ইংরেজি ভাষাটা অবান্তরভাবে ব্যবহার করি। এই অ্যাকচুয়ালি, আসলের জায়গায় প্র্যাকটিক্যালি এসব আমরা শুধু শুধু ব্যবহার করি। শহর-গ্রাম সকল নাগরিকের মধ্যে এই মূল্যবোধটা তৈরি হতে হবে, সে যা করছে ঠিক করছে না। ভুল করছে। সবার ভেতরে এই চেতনাটা আসা দরকার। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম খুব ভালো কাজ করেছে এই প্রবন্ধটা লিখে।” (পবিত্র সরকারের সাক্ষাৎকার, কথা প্রকাশ, মে, ২০১২)
পবিত্র সরকার বা সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মনে করেন, মানুষ ইচ্ছা করলে ভাষামিশ্রণ এড়াতে পারে। হ্যাঁ ব্যক্তি সচেতন হলে পারে বৈকি, কিন্তু সে কতক্ষণের জন্যে? মানুষ কি কথা বলার সময় মূল্যবোধের নিরিখে প্রতিটি শব্দকে বিচার করে তার পর ব্যবহার করে নাকি স্বাভাবিকভাবে জিবের ডগায় যে শব্দ আসে সেটাই বাক্যে ব্যবহার করে? মানসিকভাবে সুস্থ কারও পক্ষে কি সারাক্ষণ উৎস বিচার করে শব্দ ব্যবহার করা সম্ভব? মানুষ বাংলা বলার সময় ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছে মনের অজান্তে, স্বাভাবিকভাবে, ইংরেজি বলাটা ‘ফ্যাশনেবল’ মনে করছে বলে নয়। অধ্যাপক ইসলাম মনে করেন, বিশেষ একটি গোষ্ঠী কোনো বিশেষ স্বার্থ হাসিল করা জন্যে বাংলা ভাষার দূষণ কার্যক্রম চালু রেখেছে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পক্ষে ভাষায় কোনো প্রকার স্থায়ী পরিবর্তন আনা কার্যত অসম্ভব। কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর পক্ষে সচেতনভাবে, মূল্যবোধের নিরিখে প্রতিটি শব্দকে বিচার করে শব্দকোষে প্রবেশাধিকার দেয়া সম্ভব নয়। সুতরাং পরিবারগুলো ইচ্ছে করে উচ্চারণ ও শব্দব্যবহারের প্রতি উদাসীন থাকছে না, উদাসীন থাকতে তারা বাধ্য হচ্ছে। ভাষার স্বাভাবিক পরিবর্তন রুখবার ক্ষমতা পরিবার, রাষ্ট্র, আদালত, বুদ্ধিজীবীদের কারও নেই।
৩.১.৩.২. সঙ্করায়ন দূষণ নয়, নতুন ভাষার সূতিকাগার
যে কোনো ভাষার সৃষ্টি ও ক্রমবিকাশ অনেকটা দই পাতার মতো। পুরোনো দই এর সঙ্গে নিত্যনতুন দুধ মিশে যেমন দইয়ের কলেবর বাড়ে তেমনি ভাষাকেও প্রতিনিয়ত মৃত বা জীবিত কোন ভাষা থেকে প্রাণরস সংগ্রহ করতে হয়। পৃথিবীর কোনো জীবিত ভাষাই অন্য ভাষার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া ছাড়া গড়ে ওঠে না। কোনো ভাষা সেই ভাষা থেকেই ঋণ নেবে যে ভাষার সাথে তার কমবেশি মেলামেশা আছে। গত দুই শতকে বাংলা প্রচুর সংস্কৃত শব্দ নতুনভাবে ঋণ হিসেবে নিয়েছে। নতুনভাবে বলছি এ কারণে যে ষষ্ঠ বা সপ্তম শতকে বাংলা ভাষার সূচনাকাল অর্থাৎ চর্যাপদের যুগেও বাংলা শব্দকোষের অনেকখানি জুড়ে ছিল সংস্কৃত তদ্ভব শব্দ। ধরা যাক, আগে ছিল তদ্ভব শব্দ ‘চাঁদ’, ‘হাত’। বাংলায় বৌদ্ধযুগের অবসান থেকে শুরু করে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের যুগ পর্যন্ত নতুন ভাবে ঋণ নেয়া হলো এ শব্দগুলোরই পূর্বপুরুষ তৎসম শব্দ ‘চন্দ্র’ আর ‘হস্ত’-কে। এখন নতুন কোনো ধারণার জন্যে নতুন কোনো শব্দের প্রয়োজন হওয়ামাত্র বাংলা সে শব্দটি সংস্কৃত থেকে নিয়ে নেয় বা সংস্কৃত শব্দে বাংলা রূপতত্ত্ব প্রয়োগ করে নতুন শব্দ বানিয়ে নেয়। ‘শ্রবণমাণ’, ‘অবহেলাময়’, ‘স্বেচ্ছামৃত্যু’, ‘দৈবচয়ণ’… এই নতুন সংস্কৃতমূল শব্দগুলো কিছু দিন ধরে গণমাধ্যমে শোনা যাচ্ছে। ‘গণমাধ্যম’ও কোন একসময় নতুন শব্দ ছিল।
ভাষার উৎপত্তি থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এক ভাষার শব্দ অন্য ভাষায় ব্যবহৃত হয়েছে। এটা যদি ভাষার বিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়ম না হতো তবে এত ল্যাটিন শব্দ ফরাসিতে ঢুকতে পারতো না, বাংলায় ব্যবহৃত হতো না এত এত সংস্কৃত শব্দ। ১০৬৬ সালে নর্মান বিজয়ের পর দ্বাদশ থেকে পঞ্চদশ, প্রায় চার শতাব্দী ধরে ফরাসি ছিল ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রভাষা। এই চার শতকে এত ফরাসি শব্দ ইংরেজিতে ঢুকেছিল যে আজ ফরাসি শব্দ ব্যবহার না করে এক পরিচ্ছেদ ইংরেজিও লেখা যাবে কিনা সন্দেহ। ইদানিং আবার ফরাসি জাতীয় বেতার সম্প্রচারেই ইংরেজি শব্দের ছড়াছড়ি, যা কয়েক দশক আগেও খুবই নিন্দনীয় ও অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল।
মানুষ যুগ যুগ ধরে জগাখিচুরি ভাষা ব্যবহার করে আসছে বলেই ভাষার শব্দকোষ, ধ্বনিতাত্ত্বিক কাঠামো ও বাক্যকাঠামোর বিবর্তন হচ্ছে। খিচুরি ভাষা নতুন ভাষার সূতিকাগার। বাংলাসহ সব মানব ভাষাই এক ধরণের খিচুড়ি ভাষা থেকে জন্ম নিয়েছে। খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহ¯্রাব্দের শেষের দিকে বৈদিক যুগের উপভাষাগুলোর সাথে ভারতবর্ষের বিভিন্ন আর্য্য-উপনিবেশের প্রচলিত ভাষার মিশ্রণে যে জগাখিচুরি ভাষার সৃষ্টি হয়েছিল তা থেকেই খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম সহ¯্রাব্দের মাঝামাঝি সংস্কৃত যুগে বিভিন্ন প্রাকৃতের উৎপত্তি হয়েছিল। এই সব প্রাকৃতের সাথে নতুনতর আর্য্য-উপনিবেশের ভাষার জগাখিচুরি থেকে সৃষ্টি হয়েছিল বিভিন্ন অপভ্রংশ। অপভ্রংশগুলো বিবর্তিত হয়ে খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ শতকের দিকে আধুনিক ভারতীয় ভাষা: বাংলা, হিন্দি, মারাঠি ইত্যাদির প্রাচীন রূপ সৃষ্টি হয়। পাঠান-তুর্কি শাসনের ফলশ্রুতিতে দ্বাদশ শতক থেকে ভারতীয় ভাষাগুলোতে ব্যাপকভাবে আরবি-ফার্সি-তুর্কি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটে যার ফলে সৃষ্টি হয় নতুন কিছু মধ্যযুগীয় জগাখিচুরিগুলো যেগুলো থেকে আধুনিক বাংলা, আধুনিক হিন্দির সৃষ্টি।
৩.১.৩.৩. প্রমিত শব্দকোষ নিয়ত পরিবর্তনশীল
প্রমিত শব্দকোষ স্থির কিছু নয়। স্থির নয় প্রমিত ভাষাও। কোন উপভাষাটি নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলের প্রমিত ভাষারূপে ব্যবহৃত হবে সেটা চিরদিনের জন্য স্থির হয়ে যায় না। যে উপভাষাটি এখন প্রমিত, এমন দিন আসতে পারে যেদিন সেটি হয়তো আর প্রমিত থাকবে না। কালের প্রবাহে রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ফলশ্রতিতে নতুন কোনো উপভাষা প্রমিত হিসেবে গৃহীত হবে। নতুন কোনো জায়গায় বাংলাদেশের রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হলে সেই জায়গার শব্দকোষ ও ব্যাকরণ প্রতিযোগিতা করবে আজকের প্রমিত উপভাষার শব্দকোষ ও ব্যাকরণের সঙ্গে। এ কারণেই ঢাকার প্রমিত বাংলা এবং কলিকাতার প্রমিত বাংলার মধ্যে কিছুটা হলেও তফাৎ আছে উচ্চারণে ও শব্দ ব্যবহারে। ঢাকায় শিক্ষিত লোক হরহামেশাই ‘করিনি’ এবং ‘খেয়েছি’ এর স্থলে যথাক্রমে ‘করি নাই’, ‘খাইছি’ বলে। সবাই ব্যবহার করতে করতে এগুলো এক সময় ‘করিনি’ এবং ‘খেয়েছি’ রূপকে নির্বাসিত করতে পারে। তখন ‘করিনি’ এবং ‘খেয়েছি’ শুনলে মনে হবে বক্তা অনর্থক ‘আঁতলামী’ করছে।
এই মুহূর্তে বলা যাবে না ‘দিছে’ নাকি ‘দিয়েছে’ এই দুই উচ্চারণের কোনটি জুড়ে বসবে অদূর ভবিষ্যতের প্রমিত বাংলায়। কোন শব্দটা তখন ব্যবহৃত হবে: ‘কুনহানে’ নাকি ‘কোথায়’? ইংরেজি কৃতঋণ অব্যয় ‘এগজাক্টলি’ কি [হিন্দি] কৃতঋণ অব্যয় ‘আসলে’ কে প্রতিস্থাপিত করবে? ‘এবং’, ‘আর’, ‘ও’ এই তিন সংযোজক অব্যয়ের মধ্যে কোনটি দীর্ঘজীবী হবে? নাকি ‘এন্ড’ এসে এদের সবাইকে বিদায় করবে, যেমন একদিন সংস্কৃত ‘এবং’ ও হিন্দি ‘আর’ এসে বিদায় করেছিল ‘খাঁটি’ বাংলা কোনো সংযোজক অব্যয়কে যার চেহারা পর্যন্ত আমরা আজ চিনি না।
দূষণ হোক বা না হোক, বাংলা ভাষা কি চিরজীবী হবে? যে প্রমিত ভাষার পবিত্রতা রক্ষার জন্য আজ এত হাহুতাশ সে ভাষাও এক দিন মরবে। চর্যাপদের যুগের ভাষার মৃত্যু হয়েছে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষার মৃত্যু হয়েছে, আজকের বাংলা ভাষারও মৃত্যু হবে। কোনো মানবভাষার কোনো একটি রূপ পাঁচশো বা খুব বেশি হলে হাজার বছরের বেশি বোধগম্য থাকে না। এর মানে হচ্ছে, যে কোনো জীবিত ভাষার আয়ুষ্কাল সর্বোচ্চ এক হাজার বছর। সংস্কৃত বা ল্যাটিনের মতো কিছু ভাষা অবশ্য তাদের লিখিত রূপে মমি হয়ে বহু হাজার বছর বেঁচে থাকে।
৩.১.৩.৪. শব্দমিশ্রণ মানে ভাষার পরাজয় নয়
অধ্যাপক ইসলাম বলেছেন, শব্দমিশ্রণের কারণে বাংলা ভাষায় পরাধীন, মার খাওয়া, নির্জিব হয়ে গেছে। মানুষ পরাধীন, মার খাওয়া, নির্জিব হতে পারে, কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো ভাষা এই সব বিপদের শিকার হয়েছে বলে জানা যায় না। সৃষ্টিকল্পনা ভাষায় থাকে না, থাকে মানুষের মনে এবং মানুষ সেই কল্পনা ভাষায় প্রকাশ করে। কোনো ভাষায় তথাকথিত বিদেশি শব্দ ব্যবহৃত হলেই যদি সেটি তার সৌন্দর্য হারায় তবে ইংরেজির কোনো সৌন্দর্যই থাকার কথা নয়, কারণ এর সিংহভাগ শব্দ ফরাসি। বাংরেজি উপভাষায় যদি ইংরেজি শব্দের বাহুল্য থাকে, যদি ইংরেজি ভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা করা যায় তবে বাংরেজি উপভাষাতেও যে কোনো বিষয় প্রকাশ করতে কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়। মানুষ কখনই সচেতনভাবে নির্বিচারে শব্দঋণ গ্রহণ করে না। ভাষাসংযোগের অমোঘ নিয়মে এক ভাষার শব্দ অন্য ভাষায় চলে আসে। এছাড়া, অন্য ভাষা থেকে শব্দগ্রহণের অর্থ যদি ‘পরাজয়’ হয়, তবে বাঙালি এর আগেও একাধিকবার পরাজিত হয়েছে, সংস্কৃতের কাছে, ফারসির কাছে। প্রকৃতপক্ষে শব্দঋণগ্রহণ মানেই সংস্কৃতির পিছু হটা নয়, সংস্কৃতির সামনে এগিয়ে যাওয়া।
৩.১.৩.৫. প্রান্তভাষার ব্যাকরণ মেনেই উৎসভাষার শব্দ প্রান্তভাষায় প্রবেশ করে
সমাজে নতুন আসা বস্তু ও ধারণার নামকরণের ক্ষেত্রে সাধারণত দুটি উপায় অবলম্বন করা হয়: ১. উৎস ভাষায় (Source language) পণ্যটির যে নাম আছে প্রান্তভাষায় (language) তার ভাবানুবাদ (Loan translation বা Calque) করা হয়; অথবা ২. উৎস ভাষায় নামটিই সরাসরি নিয়ে নেওয়া হয়। ‘দূরালাপনী’ বা ‘মুঠোফোন হচ্ছে যথাক্রমে ইংরেজি ‘টেলিফোন’ ও ‘হ্যান্ডফোন’ (সম্ভবত) শব্দের ভাবানুবাদ, আর ‘টেলিফোন’ হচ্ছে সরাসরি ইংরেজি থেকে ঋণকৃত শব্দ।
শব্দঋণ যেনতেনভাবে গ্রহণ করা হয় না, এরও নিয়ম আছে। বাংলা ব্যাকরণের নিয়ম মেনেই বেতার সম্প্রচারে বা পত্রপত্রিকাগুলোতে বাংলা বাক্যে ইংরেজি শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্যাকরণের নিয়ম মানতে আমরা বাধ্য যদি আসলেই তা নিয়ম হয়ে থাকে। ইংরেজি থেকে বাংলায় বিশেষ্য, বিশেষণ আর অব্যয় ঋণ নেয়া হচ্ছে। ‘হিরারিঙ-এইড’ আর ‘শ্রবণ-সহায়ক যন্ত্র’ এই দুই শব্দই চলছে। ‘নেগলিজেন্স’ বা ‘নেগলিজেন্সি’ বলা হচ্ছে কিন্তু ‘*হিয়ারিঙ-মান’, ‘*নেগলিজেন্সময়’… ধরণের শব্দ পত্রপত্রিকা বা বেতার সম্প্রচারে ব্যবহৃত হচ্ছে না। বাঙলাভাষীরা বলছে: ‘লিঙ্গুইস্টিকস খুব ডিফিকাল্ট সাবজেক্ট’, ‘লেখাপড়াটা রিসেন্টলি এক্সপেনসিভ হয়ে গেছে’। কেউ কিন্তু বলছে না ‘*ও অনেক টাকা সেইভস’, বা ‘*আমি ওকে ম্যানেজ কুড নট’। অর্থাৎ আনকোড়া সমাপিকা ক্রিয়াপদ ধার নেওয়া হচ্ছে না ইংরেজি থেকে, ইংরেজি নাম বা ক্রিয়া শব্দের সাথে বাংলা বাহক ক্রিয়া যোগ করে নতুন মিশ্র ক্রিয়াপদ গঠন করা হচ্ছে। উদাহরণ: ‘ব্রাশ করা’, ‘কপি করা’, ‘সেভ করা’, ‘শেভ করা’, ‘ম্যানেজ করা’ ইত্যাদি (এই ক্রিয়াপদগুলো ব্যাবহার করে না এমন কোন বাংলাভাষী কি আছে?) বিবিসি’র খবরে (১/১০/০৯) শুনেছি ‘পুনর্ব্যাট’ (ক্রিকেটে আবার ব্যাট করা) শব্দটি। ইদানিং দৈনিক পত্রিকাগুলোতে বাংলা ‘দোষ দেয়া’ ক্রিয়াপদের স্থলে ব্যবহৃত হয় হিন্দি ক্রিয়াপদ ‘দুষণা’: ‘পুলিশ দুষলো পত্রিকাকে’ (প্রথম আলো, ২৯/১০/০৯) বা ‘ছাত্রলীগের বর্তমান নেতারা পুরনোদের দুষলেন’ (সমকাল ৭/২/১০)। পশ্চিম বঙ্গের দৈনিকগুলোর প্রভাবে হিন্দি ক্রিয়াবিশেষণ ‘ফের’ ধীরে ধীরে বাংলা ক্রিয়াবিশেষণ ‘আবার’-কে প্রতিস্থাপিত করছে।
এমনও হতে পারে যে প্রান্ত ভাষার বিশেষ ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের কারণে উৎস ভাষার শব্দ সরাসরি ঋণ নেওয়া যায় না। বাংলা আর জাপানি প্রায় একই নিয়মে ইংরেজি থেকে শব্দ ঋণ নিচ্ছে, কারণ বাংলা আর জাপানি ভাষার মধ্যে ব্যাকরণগত মিল রয়েছে। বাংলা বা জাপানি ভাষায় ইংরেজি শব্দ ঋণ নিতে ধ্বনিতাত্ত্বিক দিক থেকে কোনো অসুবিধা নেই বলেই এত এত ইংরেজি শব্দ বাংলা ও জাপানি শব্দকোষে প্রবেশ করছে। চীনা ভাষার বিশেষ ধ্বনিতাত্ত্বিক কাঠামোর কারণে চীনা ভাষায় সাধারণত অন্য ভাষার শব্দ অনুবাদ করে নেয়া হয়। চীনা ভাষায় সংবৃত অক্ষর (যেমন পান, কাক) নেই বললেই চলে। সুতরাং ‘মোডেম’ বা ‘মাউস’ চীনা ভাষায় উচ্চারণ করা বেশ কঠিন। চীনা ভাষায় বেশির ভাগ শব্দ একাক্ষর (Monosyllabic) বলে ‘টেলিভিশন’ এর মতো বহু-অক্ষর-বিশিষ্ট শব্দ সরাসরি ধার করা কঠিন। চীনা ভাষায় ইংরেজি শব্দ সরাসরি ব্যবহৃত না হবার কারণ, চীনা জাতীয়তাবাদ নয়, চীনা ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব। এর পরেও চীনা ভাষায় বহু ইংরেজি শব্দ ইতিমধ্যে ঢুকে পড়েছে। ইংরেজি-চীনা শব্দমিশ্রণ বিষয়ক বহু প্রবন্ধ আন্তর্জালে পাওয়া যাবে।
কোনো ভাষায় অন্য ভাষার শব্দ ঢুকলে কোনো ক্ষতি হয় না, কারণ শব্দ ঢোকে সেই ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্বের নিয়ম মেনে। ভাষামিশ্রণ উদ্বেগজনক কোনো সঙ্কট হলে, ইংরেজি বহু আগেই ফরাসি শব্দের বন্যার তোড়ে হারিয়ে যেতো। ইংরেজি ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্ব ইংরেজির ইংরেজিত্ব বজায় রেখেছে আবার ফরাসি শব্দ দিয়ে তাকে সমৃদ্ধও করেছে। বাংলার ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হবার কোনো কারণ নেই। কোনো ইংরেজি বা অন্য ভাষার শব্দ বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের নিয়ম মেনে পরিবর্তিত না হয়ে বাংলা শব্দকোষে স্থায়ী আসন নিতে পারবে না। ইংরেজি chair, table এবং বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত ‘চেয়ার’, ‘টেবিল’ শব্দের উচ্চারণের তুলনা করলেই এটা বোঝা যাবে। ‘চেয়ার’ এবং ‘ টেবিল’ বঙ্গীকৃত হয়ে এতটাই বাংলা শব্দে পরিণত হয়েছে যে কোনো ইংরেজিভাষী এগুলো শুনলে বিনা আয়াসে বুঝতে পারবেন কিনা সন্দেহ।
কোনো ভাষায় অন্য ভাষার শব্দ ঢুকলে কোনো ক্ষতি হয় না, কারণ শব্দ ঢোকে সেই ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্বের নিয়ম মেনে। ভাষামিশ্রণ উদ্বেগজনক কোনো সঙ্কট হলে, ইংরেজি বহু আগেই ফরাসি শব্দের বন্যার তোড়ে হারিয়ে যেতো। ইংরেজি ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্ব ইংরেজির ইংরেজিত্ব বজায় রেখেছে আবার ফরাসি শব্দ দিয়ে তাকে সমৃদ্ধও করেছে। বাংলার ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হবার কোনো কারণ নেই। কোনো ইংরেজি বা অন্য ভাষার শব্দ বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের নিয়ম মেনে পরিবর্তিত না হয়ে বাংলা শব্দকোষে স্থায়ী আসন নিতে পারবে না। ইংরেজি chair, table এবং বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত ‘চেয়ার’, ‘টেবিল’ শব্দের উচ্চারণের তুলনা করলেই এটা বোঝা যাবে। ‘চেয়ার’ এবং ‘ টেবিল’ বঙ্গীকৃত হয়ে এতটাই বাংলা শব্দে পরিণত হয়েছে যে কোনো ইংরেজিভাষী এগুলো শুনলে বিনা আয়াসে বুঝতে পারবেন কিনা সন্দেহ।
৩.১.৩.৬. শব্দের সুঋণ ও কুঋণ প্রসঙ্গে
অধ্যাপক ইসলাম দুই ধরনের শব্দঋণের মধ্যে পার্থক্য করেছেন। কিছু শব্দঋণ স্বাভাবিক কিছু অস্বাভাবিক। তাঁর কাছে বাংলা বাক্যে ইংরেজি অব্যয় ‘বাট’ বা ‘সো’ অস্বাভাবিক ঋণ, দূষণের আকর। পিৎজা-মোবাইল-মাউস তাঁর মতে স্বাভাবিক ঋণ। প্রশ্ন হচ্ছে, কোন ঋণটি স্বাভাবিক আর কোনটি অস্বাভাবিক সেটা বিচারের উপায় কি? অধ্যাপক ইসলাম হয়তো ভাবছেন, নামশব্দ নেয়াটা স্বাভাবিক, অব্যয় নেয়াটা অস্বাভাবিক। কিন্তু ‘তথাপি’, ‘কিন্তু’, ‘এবং’, ‘কদাপি’, ‘যদ্যপি’ ইত্যাদি অব্যয়ওতো কোনো একদিন দ্বিভাষীদের মাধ্যমে সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছিল। অধ্যাপক ইসলাম সে আমলে উপস্থিত থাকলে এসব ঋণ নিয়েও শঙ্কিত হতেন। যারা বলবেন, সংস্কৃত শব্দে বাংলা ভাষার স্বাভাবিক অধিকার আছে, কারণ সংস্কৃত এক সময় উপমহাদেশের লিঙ্গুয়া একাডেমিকা ছিল, তাদের আমি বলবো যে ইংরেজি শব্দেও বাংলা অধিকার ইতিমধ্যে জন্মে গেছে এবং সে অধিকারও কালক্রমে স্বাভাবিক হয়ে উঠবে, কারণ এখন ইংরেজি একাধারে উপমহাদেশের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা এবং লিঙ্গুয়া একাডেমিকা।
ব্যক্তিবিশেষ সুঋণ ও কুঋণের মধ্যে পার্থক্য করার কথা নয়, কারণ মানুষ সচেতনভাবে ঋণশব্দ ব্যবহার করে না। সমাজের দ্বিভাষী ব্যাক্তিদের ভাষায় অবচেতনভাবে ‘ভাষামিশ্রণ’ শুরু হয় এবং কালক্রমে তা সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে যায়। সুতরাং কোনো সমাজে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটি বড় অংশ যদি কমবেশি দ্বিভাষী হয় তবে সেখানে ভাষামিশ্রণ অবশ্যম্ভাবী। পৃথিবীর সব দেশে এটা হচ্ছে, মানব জাতির ইতিহাসে এমনটাই সব সময় হয়ে এসেছে। বাঙালিদের নিকট পূর্বপুরুষদের একাংশ ফার্সি ভাষা জানতো বলেই বাংলা শব্দকোষে এত ফার্সি শব্দ স্থান পেয়েছে। বাঙালিদের দূর পূর্বপুরুষদের একাংশ সংস্কৃত ভাষা জানতো বলেই বাংলায় এত সংস্কৃত শব্দ ব্যবহৃত হয়। সমাজে দ্বিভাষিকতার অস্তিত্ব থাকার কারণে ব্যাপক শব্দমিশ্রণের ঘটনা বাংলা ভাষায় ইতিহাসে একাধিক বার ঘটেছে। তাই যদি না হয় তবে ‘হাওয়া’, ‘সিন্দুক’, ‘বই’, ‘কলম’, ‘কাগজ’… বাংলা শব্দকোষের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেলো কীভাবে? ফারসি ‘লাল’ কীভাবে সংস্কৃত তদ্ভব শব্দ ‘রাতা’-কে বিদায় করেছে? আরবি ‘হাওয়া’ সংস্কৃত তৎসম ‘বায়ু’ আর তদ্ভব ‘বাতাস’ এর সাথে কীভাবে সহাবস্থান করছে। ‘বিয়েশাদি’ শব্দে সংস্কৃত তদ্ভব শব্দ ‘বিয়ে’ ফার্সি শব্দ ‘সাদি’’র সাথে চমৎকার ‘লিভ টুগেদার’ করছে কেমন করে?
৩.১.৩.৭. বাংরেজি বা ডিজুস বাংলা বাংলার নতুন একটি উপভাষা
বাংরেজি বা ডিজুস বাংলাকে বাংলারই একটি নির্মিয়মান উপভাষা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। চট্টগ্রামি বাংলা ও সিলেটি বাংলার শব্দকোষ ও ধ্বনিতত্ত্ব আলাদা। বাংরেজি উপভাষার শব্দকোষ ও ধ্বনিতত্ত্বও প্রমিত বাংলা বা চট্টগ্রামি বাংলার তুলনায় আলাদা। যারা মনে করেন, উপভাষা হতে হলে কোনো একটি ভাষারীতিকে কোনো বিশেষ ভৌগোলিক অঞ্চলে ব্যবহৃত হতে হবে, তাদের ধারণা ভুল। কোনো ছড়ানো-ছিটানো গোষ্ঠীরও একটি উপভাষা থাকতে পারে। বাংলাদেশের সব শহরের তরুণ প্রজন্ম যদি বাংরেজি বা ডিজুস বাংলা বলে তবে সেটাই তাদের উপভাষা। পৃথিবীর সব দেশে নাগরিক তরুণেরা নিজেদের মধ্যে এমন এক বিশেষ উচ্চারণে কথা বলে যা অন্যদের কাছে অদ্ভুত ঠেকে। বাংরেজি ভাষার কোনেমতেই প্রমিত বাংলাকে বিকৃত করছে না, তারা তাদের নিজেদের উপভাষায় কথা বলছে, এই মাত্র। তারা কোনো প্রমিতভাষীকে তাদের ব্যবহৃত উপভাষায় কথা বলতে বাধ্য করছে না।
কোনো একটি গোষ্ঠীর পক্ষে সচেতনভাবে কোনো উপভাষা সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। তবে বিশেষ আর্থসামাজিক-ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে বিশেষ উচ্চারণ ও শব্দকোষসহ কোনো উপভাষা সৃষ্টি হতে পারে নিজে থেকেই। মোগল আমলে হিন্দুস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা সৈনিকদের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ছিল উর্দু। হিন্দুস্তানি ভাষার ব্যাকরণ-কাঠামোর উপর আরবি-ফার্সি শব্দ ব্যবহৃত হয়ে সৃষ্টি হয়েছিল এই ভাষা। বলা হয়ে থাকে যে ‘উর্দি’ শব্দ থেকেই নাকি ভাষাটির নাম ‘উর্দু’। একই ভাবে বাংরেজি উপভাষাও হয়তো সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের বিশেষ আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-ভাষিক পরিস্থিতিতে। এই উপভাষা যদি একবিংশ শতকের শুরুতে সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে এর জন্যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শিক্ষানীতি দায়ী। উপরোক্ত সময়ের সরকারগুলো ইংরেজি মাধ্যম প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় এবং ইংরেজি মাধ্যম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়েছে। এর ফলে এক দশকের মধ্যে এমন একটি প্রজন্ম তৈরি হয়েছে যারা ইংরেজিতেই চিন্তা করতে শিখেছে। কোনো ভাষায় কেউ যদি শিক্ষা পায় তবে অভ্যাসবশত সে ভাষা তার চিন্তারও ভাষা হয়ে যায় কারণ শব্দ হচ্ছে ভাবের বাহন। কোনো ভাব যদি মানুষ প্রকাশ করতে চায় তবে সে ভাবের সাথে যে শব্দ ব্যবহার করতে তাকে শেখানো হয়েছে সেই শব্দই সে ব্যবহার করবে।
ইংরেজি-শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা ইচ্ছে করে, স্মার্টনেস দেখানোর জন্য বাংলা বলা সময় ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছে না। তারা মনের ভাবগুলো সে বাংলায় প্রকাশ করতেই শেখেনি, রাষ্ট্রই তাকে না শেখার সুযোগ দিয়েছে। বেশিরভাগ ইংরেজি শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ অবশ্যই আছে, কিন্তু সে শব্দ আছে বাংলা শব্দকোষে, তরুণদের প্রত্যেকের ব্যক্তি শব্দকোষে নয়। ব্যাঙ্কে টাকা থাকলেই তা ব্যক্তির পকেটে থাকবে এমন কোনো কথা নেই।
৪. ভাষাদূষণ বন্ধে আদালতের ভূমিকা প্রসঙ্গে
বর্তমান আলোচনার উজানে বলা হয়েছে, ১৯শে ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব রকিবুদ্দিন আহমেদ অধ্যাপক ইসলামের প্রবন্ধের বরাত দিয়ে বাংলা ভাষার দূষণ রোধকল্পে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ বেলা সোয়া এগারোটার দিকে বাংলা ভাষার পবিত্রতা রক্ষা ও দূষণ রোধে একটি রুল জারি করেছিলেন। সংস্কৃতি সচিব, তথ্য সচিব, বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক, টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বি আর টি সির চেয়ারম্যান, সব বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রধান কর্মকর্তা, রেডিও টুডে, রেডিও এ বি সি ও রেডিও ফুর্তির প্রধান কর্মকর্তাকে ১০ দিন অর্থাৎ ২৯শে ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখের মধ্যে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
বিকৃত উচ্চারণ, ভিন্ন ভাষার সুরে বাংলা উচ্চারণ, সঠিক শব্দ চয়ন না করা এবং বাংলা ভাষার অবক্ষয় রোধে বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে প্রধান করে একটি কমিটি করারও আদেশ দিয়েছিল আদালত। এসব বিষয়ে কী কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে সে বিষয়ে ২০শে মার্চের মধ্যে আদালতে একটি প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল সেই কমিটিকে। কমিটিতে কে কে থাকবেন তা নির্ধারণে চূড়ান্ত ক্ষমতা দেয়া হয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে। তবে আদালত সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, কবি নির্মলেন্দু গুন, রফিক আজাদ ও সৈয়দ সামসুল হকের নাম প্রস্তাব করেছিল। সংস্কৃতিসচিবকে এক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতা দিতে বলা হয়েছিল। আদালত বলেন যে কমিটি প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের কাছে প্রয়োজনীয় পরামর্শের জন্য অনুরোধ করতে পারে।
আদালতে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, এডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু, এডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন, অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল এম কে রহমান, মুরাদ রাজা ও ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর এ বিষয়ের উপর বক্তব্য রেখেছিলেন। মামলার শুনানিতে আগামীতে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার রফিক উল হক, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার আকতার ইমাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের ডিন অধ্যাপক সদরুল আমিন, লেখক সৈয়দ শামসুল হক ও সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে এমিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দেন। আদালতে ভবিষ্যতে এঁদের বক্তব্য শোনা হবে বলে জানানো হয়েছিল।
উচ্চ আদালতের নির্দেশ মোতাবেক ২০১২ সালের ২২শে জুলাই উপরোক্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল এবং কমিটি ৯ দফা সুপারিশও দিয়েছিল। ২০১৪ সালে একটি স্থায়ী কমিটি গঠিত হয়েছিল যার সদস্য হিসেবে আছেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (আইন ও শৃঙ্খলা), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ, বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, এ্যাসোসিয়েশন ও টিভি চ্যানেলস ওনার্স (এটকো), বেসরকারি বেতার কেন্দ্রসমূহ, এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন করে প্রতিনিধি। এ কমিটির কার্যপরিধির মধ্যে রয়েছে ১) সরকারি ও বেসরকারি ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যম তথা সব টেলিভিশন চ্যানেল ও বেতারে সংবাদ, অনুষ্ঠান ও উপস্থাপনায় বাংলার সঙ্গে অহেতুক অন্য ভাষার মিশ্রণ পরিহার করা; ২) ভাষাকে বিকৃত না করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সমন্বয় করা; ৩) এ বিষয়ে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল ও বেতার থেকে প্রাপ্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা; ৪) এসব মাধ্যমকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান এবং প্রয়োজনীয় জরুরি বিষয় ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনা; ৫) বাংলাদেশের সব টেলিভিশন চ্যানেল ও বেতারসহ বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্রভাষার ব্যবহার বন্ধ করা। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ, অগ্রগতি পরিবীক্ষণ ও এ বিষয়ে অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় সাধন এবং বাংলা ভাষার দূষণ, বিকৃত উচ্চারণ, বিদেশি ভাষার সুরে বাংলা উচ্চারণ রোধের বিষয়ে হাইকোর্টের আদেশের আলোকে সমুদয় ব্যবস্থা গ্রহণ করাও কমিটির কাজের আওতায় থাকবে।
কিছু দিন পরে এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও জাহাঙ্গীর হোসেন Ñ এই দুই জন বিচারপতির প্রত্যেককে অন্য কোনো গুরুদায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। বাংলা ভাষার দূষণ সমস্যার বিচারবিভাগীয় সমাধান এর বেশি আর এগোয়নি। [দূষণ প্রতিরোধকল্পে গঠিত] স্থায়ী কমিটি বাংলাভাষার দূষণরোধ করার জন্যে কী কী ব্যবস্থা নিয়েছেন তাও জানা যায়নি। এই হচ্ছে মোটামুটিভাবে হালনাগাদ পরিস্থিতি।
৪.১. বাংলাভাষার দূষণ রোধ করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আদালতের মত
বিজ্ঞ আদালত রকিব উদ্দিন আহমেদের আবেদনে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন, কারণ আদালতের আদেশে বলা হয়েছে তিনি ‘স্বেচ্ছা-প্রণোদিত হয়ে বাংলা ভাষার দূষণ প্রক্রিয়ায় ব্যথিত হয়ে, চিন্তিত হয়ে, এটা রোধকল্পে আদালতের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।’ আদালত অবশ্য বাংলা ভাষার দূষণ সম্পর্কে আগে থেকেই কমবেশি ওয়াকেবহাল ছিলে।
“আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বলেন, ‘কিছুদিন আগে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মেয়ের মুখে যে বাংলা শুনলাম, তাতে কষ্ট পেতে হয়। কারণ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বাংলা ভাষার পথপ্রদর্শক। অথচ তাঁর মেয়ে একটি টক শোতে বাংলিশ ধারায় কথা বলছিলেন।’” (নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের কণ্ঠ, ১৭/০২/২০১২)
বিজ্ঞ আদালত মনে করেন, বাংলাভাষাকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে, কারণ:
ক. বাঙালি জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করা প্রয়োজন।
খ. এই ভাষা বঙ্গবন্ধুর ভাষা, রবীন্দ্রনাথের ভাষা, শরৎচন্দ্রের ভাষা, জীবনানন্দের ভাষা, আলাওলের ভাষা, সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষা, লালনের ভাষা, হাসন রাজার ভাষা, শাহ আবদুল করিমের ভাষা, জসীমউদ্দীনের ভাষা ও কায়কোবাদের ভাষা।
গ. বাংলা কেবল বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার ভাষা নয়, এটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি ভাষা।
ঘ. যে ভাষার জন্য রফিক-জব্বার শহীদ হয়েছেন, সেই ভাষা দিবস আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
ঙ. এই ভাষায় রবীন্দ্রনাথ প্রথম এশীয় হিসেবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এই ভাষা চর্চার কারণে আজ লন্ডনে শেক্সপিয়র জাদুঘরে তাঁর ভাস্কর্য স্থান পেয়েছে।
চ. পৃথিবীর দেশে দেশে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, লালন ও হাসন রাজার ওপর গবেষণা করা হচ্ছে।
ছ. বিশ্বের নানা দেশ থেকে ভাষাবিশেষজ্ঞরা এ দেশে এসে এই ভাষার প্রাচুর্য অনুসন্ধান করছেন।
জ. এই ভাষায় বঙ্গবন্ধু প্রথম জাতিসঙ্ঘে ভাষণ দিয়েছিলেন, যা সে সময় বিশ্ব নেতাদের মুগ্ধ করেছিল।
ঝ. পৃথিবীতে বাংলাই একমাত্র ভাষা যার জন্য মানুষ রক্ত দিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকম দৃষ্টান্ত আর দ্বিতীয়টি হয়নি।
ঞ. ধর্মান্ধতার বশবর্তী হয়ে যারা বাংলা ভাষার ওপর আক্রমণ করেছে, যারা মনে করত পারশিয়ান বা উর্দু হবে এ দেশের ভাষা, তাদের সেই চেষ্টা এখনো চলছে। তাদের অগ্রযাত্রা আমরা চলতে দিতে পারি না। এই বিকৃতিকরণের প্রক্রিয়া আজ থেকে শুরু হয়নি। এক সময় খুবই প্রগতিশীল কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাও এ দেশে সংশোধন হয়েছে। সৌভাগ্যবশত সেই শক্তি ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরাজিত হয়। তবে ভাষাবিকৃতির চেষ্টা এখনও থামেনি।
ট. বাংলা ভাষায় মিল্টন-শেক্সপিয়ার-কিটসের মতো কেউ না থাকলেও আমাদের ভাষা কম সমৃদ্ধ নয়। শরৎবাবুর নাটক সারা ভারতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে যদিও তিনি বাংলা ভাষায়ই লিখেছিলেন।
ঠ. বাংলা ভাষা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, এটাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার দাবি উঠেছে। হয়তো একদিন আমরা তার বাস্তবায়নও দেখতে পাব।
ড. বাংলা ভাষা এতটাই সমৃদ্ধ যে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে, এবং এই ইংরেজি অনুবাদ বাংলা গীতাঞ্জলির ধারে কাছেও যেতে পারেনি।
ঢ. দিন দিন একটি ভাষার উৎকর্ষ সাধন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা না হয়ে বরং বিভিন্নভাবে এখন পদচ্যুতি ঘটছে।
৪.২. বাংলাভাষার দূষণ রোধ করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কিছ সম্পূরক মত:
ক. বাংলা পরিপূর্ণ ভাষা, কারণ এই ভাষার ১) নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে এবং ২) এই ভাষায় যে কোনো ভাব প্রকাশ করা যায়।
খ. মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেছিলেন:
‘সাধারণ মানুষের যে ভাষা সে ভাষার যথোপযুক্ত ব্যবহার মানবাধিকারের পর্যায়ে পড়ে। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে এ দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। সেই স্বাধীনতাকে রক্ষার স্বার্থেই ভাষাকে রক্ষা করতে হবে। ভাষার প্রতি যতœবান হতে হবে।’ (নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের কণ্ঠ, ১৭/২/২০১২)
গ. বাংলা একটি বিবর্তিত ভাষা, আয়োজন করে গড়ে তোলা কোনো ভাষা নয়।
“আমাদের ভাষা হিন্দি বা উর্দুর মতো আয়োজন করে গড়ে তোলা হয়নিÑ বহুকাল ধরে ভাষাবিবর্তনের ফলে গড়ে উঠেছে আজকের বাংলা।” (সৌমিত্র শেখর, ভাষার লড়াই, সমকাল, ফেব্রুয়ারি ২০১২)
৪.৩. বাংলাভাষার দূষণ রোধ করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আদালতের মত ও সম্পূরক মতের বিরুদ্ধ সওয়াল
প্রথমত, বর্তমান প্রবন্ধের উজানে তৃতীয় অধ্যায়ে সবিস্তারে দেখানো হয়েছে, ইংরেজি শব্দমিশ্রণ ও উচ্চারণভেদ ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা ভাষার দূষণের প্রমাণ হতে পারে না। দূষণ যদি নাই হয়ে থাকে তবে দূষণ রোধ করারও প্রশ্ন আসে না।
দ্বিতীয়ত, বাংলাভাষাকে রক্ষার প্রয়োজনীয়তার সমর্থনে বিজ্ঞ আদালতে যে যুক্তিগুলো প্রদর্শিত হয়েছে সেগুলো ধোপে টেকার মতো নয়। বাঙালি জাতি বাংলা ভাষা বলে বটে, কিন্তু জাতির অস্তিত্বের জন্য ভাষা অপরিহার্য কোন শর্ত নয়। একই জাতি ভিন্ন দুটি ভাষা বলতে পারে। একই মনিপুরি জাতির একটি অংশ বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরি ভাষা বলে আর অন্য একটি অংশ মেইতেই মনিপুরি ভাষা বলে। বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ বা লালনের বড় মহান কোনো কবি-সাহিত্যিক না থাকলে কি ভাষাটিকে রক্ষা করার প্রয়োজন নেই? বাংলা যদি নিছকই একটি আঞ্চলিক ভাষা হয়, জাতিসঙ্ঘের ভাষা না হয়, গীতাঞ্জলীর ইংরেজি অনুবাদ যদি মূল গীতাঞ্জলীর চেয়ে অনেক উন্নতও হয়, বিদেশের কোনো গবেষক যদি বাংলা ভাষার প্রাচুর্য নিয়ে গবেষণা না করেন, বাংলা ভাষার কোনো কবি-সাহিত্যিক যদি নোবেল পুরস্কার নাও পেয়ে থাকেন, তবে কি ভাষাটিকে রক্ষা করার প্রয়োজন নেই? যে সব ভাষার জন্যে কেউ প্রাণ দেননি সেগুলো দূষিত হলে কি কোনো সমস্যা নেই? এ যুক্তি মেনে নিলে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ধনী ভাষাগুলোকেই শুধু সুরক্ষা দেয়া হবে, তুলনামূলকভাবে দরিদ্র ভাষাগুলোর বাঁচার অধিকার গ্রাহ্য হবে না।
তৃতীয়ত, আদালত যে প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর রুল জারি করেছে (তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, এফ. এম. রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদি) সেগুলোর তালিকার দিকে তাকালে বোঝা যায় যে আদালত মনে করে, গণমাধ্যমই ভাষাদূষণের অন্যতম হোতা। আমাদের প্রশ্ন: ভাষা কি শুধু গণমাধ্যমে থাকে? ভাষা থাকে প্রধানত মানুষের মুখে। গণমাধ্যমে ‘খেয়েছি’, ‘যাইনি’ ব্যবহৃত হলেই কি সাধারণ মানুষ ‘খেয়েছি’, ‘যাইনি’ বলা শুরু করে দেবে? এছাড়া মানুষ স্বাভাবিকভাবে কথা বলার সময় কোন ভঙ্গিতে কথা বলবে, কোন শব্দ ব্যবহার করবে তা আদালত ঠিক করে দিতে পারে কিনা বা ঠিক করে দিলেও তা মানা সম্ভব হবে কিনা সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। আর আদালত যদি ইংরেজিতে তার কার্যক্রম চালানোর এখতিয়ার রাখে তবে গণমাধ্যম কেন বাংলা বলার সময় ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতে পারবে না সে প্রশ্নও অবান্তর নয়।
বাংলাভাষাকে দূষণমুক্ত করার সম্পূরক যুক্তিগুলোও একেবারেই জোরালো নয়। আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে দেখিয়েছি, হিন্দি-উর্দু-বাংলা-ইংরেজি… সব ভাষাই বিবর্তনের ফলে সৃষ্টি হয়, আয়োজন করে আর যাই হোক ভাষা সৃষ্টি করা যায় না। বর্ণমালা থাকাটাও ভাষার জন্যে অপরিহার্য কোনো শর্ত নয়। ৬,০০০ মানব ভাষার মধ্যে শত তিনেক ভাষা মাত্র লিখিত হয়। যেগুলো লিখিত হয় সেগুলোর বেশিরভাগেরই নিজস্ব বর্ণমালা নেই। ইংরেজি-ফরাসি-জার্মানের নিজস্ব বর্ণমালা নেই, কোরিয়ান বা গ্রীকের আছে। জাপানির আছে তিন তিনটি বর্ণমালা। এর মানে কি এই যে কোরিয়ান বা গ্রীকের তুলনায় ইংরেজি-ফরাসি অসম্পূর্ণ ভাষা বা জাপানি অন্য সব ভাষার তুলনায় অনেক বেশি সম্পূর্ণ?
পত্রপত্রিকার মৌসুমী লেখালেখিতে প্রায়ই বলা হয়ে থাকে বাংলা একটি উন্নতমানের ভাষা। এটি নিছকই একটি বালসুলভ মন্তব্য। কোনো ভাষাই অন্য ভাষার চেয়ে বেশি উন্নত বা কম উন্নত নয়। যে কোনো জাতি তার নিজের ভাষা ব্যবহার করে ভাবপ্রকাশের সব কাজ চমৎকার চালিয়ে নিতে পারে। সমস্যা হয় যখন বাইরের জগৎ থেকে বা ভেতরের কোনো ভাষাভাষীর মনে নতুন কোনো ভাব আসে। তখন শব্দ ঋণ নিতে হয় বা নতুন শব্দ বানিয়ে নিতে হয়। মানসিকভাবে সুস্থ কোনো মানুষ তার ভাষার অনুপযুক্ত ব্যবহার করে না। ভাষা নিজের মতো করে ব্যবহার করার অধিকারই আসলে মানবাধিকার। আমার ভাষা আমি বলব, যেভাবে খুশি সেভাবে বলব। তুমি না বুঝলে, আমাকে জিগ্যেস করো, আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলবো। কিন্তু আমি ঠিক তোমার মতো করে আমার কথা বলতে বাধ্য নই! ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়!’ মানুষের স্বতষ্ফূর্ত ভাষা ব্যবহারকে বাধা দিলেই প্রকৃতপক্ষে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়।
৫. বাংলা ভাষার তথাকথিত দূষণের দায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আরও যাদের উপর বর্তায়
পত্রপত্রিকায়, ইন্টারনেটের ব্লগে আরও প্রায় বারোটি প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠীকে বাংলা ভাষার দূষণের জন্য দায়ী করা হয়েছে। নিচে একে একে এদের অপরাধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হবে।
৫.১. হিন্দি চ্যানেল: প্রথম অপরাধ: হিন্দি চ্যানেলগুলোর চটকদার অনুষ্ঠান (প্রধানত হিন্দিতে তর্জমাকৃত জাপানি কার্টুন ডোরেমন) দেখে দেখে শিশুরা হিন্দি বলা শিখে যাচ্ছে যদিও শুদ্ধ করে ইংরেজি বলতে-লিখতে পারছে না (হিন্দি শুদ্ধ করে বলছে কিনা সে প্রশ্ন অবশ্য কেউ করছে না)।
“হিন্দি ঘরে-ঘরে ঢুকে গেছে। ইংরেজি-বাংলা মিলিয়ে বা বিকৃত বাংলায় কথা বলাটা ফ্যাশন হয়ে গেছে। বিত্তবানেরা ইংরেজি শিখছে। আমাদের শিশুদের উপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। তাদের তিনটি ভাষা (বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দি) শিখতে হচ্ছে। এই মনস্তাত্ত্বিক চাপের ফল ভালো হবে না।” (এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী…)
“রাজধানীর ঢাকার বেশ কয়েকটি স্কুল ঘুরে দেখা চিত্র আসলেই উদ্বেগজনক। চার থেকে ১০ বছরের শিশুরা পুরোদস্তুর হিন্দিতে কথা বলতে পারে। এটি হয়েছে তাদের প্রিয় কার্টুন ডোরেমন দেখে। বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমের অন্তত ছয়টি স্কুল ঘুরে এ চিত্র মিলেছে। হিন্দি হয়ে যাচ্ছে শিশুর দ্বিতীয় ভাষা। বাংলাদেশের চার থেকে ১২ বছর বয়সী এবং তারও উপরের দিকের শিশুরা খুব সাবলীলভাবেই হিন্দিতে ডোরেমন কার্টুনের গান গাইতে পারে। শুধু গানই নয়, শহর ও মফস্বলের অনেক শিশুই হিন্দিতে কথা বলতে পারে সাবলীলভাবে।” (মুহম্মদ ওয়ালিউর রহমান, ‘‘বাংলা’র বাংলাদেশে অবাধে হিন্দি ভাষার প্রচলন হচ্ছে কীভাবে?…’, দৈনিক আল ইহসান, ১২/০২/২০১৩)
দ্বিতীয় অপরাধ: বাংলাদেশের শিশু তথা সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশি জনগণ বিজাতীয় হিন্দু সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে, দেশীয় ইসলামী সংস্কৃতি শিখছে না বা ভুলে যাচ্ছে। মানুষের ভাষায় ঢুকে যাচ্ছে হিন্দুয়ানী।
“হিন্দি সিরিয়ালগুলো শুরু এবং শেষ হয় আবহসঙ্গীতে শঙ্খধ্বনি, মন্দিরের ঘণ্টাবাদ্য এবং ব্যাকগ্রাউ-ে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানো দ্বারা।…এর ফলে মূর্তিপূজার প্রতি, শিরকের প্রতি মুসলমানদের যে সহজাত ঘৃণা থাকা উচিত তা এখন উধাও হয়ে গিয়েছে।… আমাদের দেশের মেয়েদের কথা এবং পোষাক ভারতের মালাউন নারীদের মতো হয়ে যাচ্ছে।…” (মুহম্মদ ওয়ালিউর রহমান, ‘‘বাংলা’র বাংলাদেশে অবাধে হিন্দি ভাষার প্রচলন হচ্ছে কীভাবে?…’, দৈনিক আল ইহসান, ১২/০২/২০১৩)
৫.২. বিশেষ কিছু নাট্যকার এবং নাটক-প্রযোজক-পরিচালক: এই নাট্যকারেরা তাদের চরিত্রের মুখে ইংরেজি এবং আঞ্চলিক ঢঙে উচ্চারিত, ইংরেজি শব্দ-মিশ্রিত বিকৃত ভাষা বসিয়ে দিচ্ছেন (উদাহরণ ৫)। পরিচালক-প্রযোজকেরা সেই সব নাটক চিত্রায়নের ব্যবস্থা করছেন।
৫.৩. বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল: প্রথম অপরাধ: এরা উপরোক্ত নাটকগুলো প্রচার করছে। দ্বিতীয় অপরাধ: বাংলা শব্দের পরিবর্তে এরা অনুষ্ঠানের নামকরণে ‘টক শো’, ‘মিউজিক শো’, ‘নিউজ আপডেট’, ‘নাইট শো’, ‘মেগা সিরিয়াল’, ‘প্রাইম নিউজ’, ‘হেলথ লাইন’ ইত্যাদি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছে। (সূত্র: দৈনিক ডেসটিনি, বাংলা ভাষার প্রয়োগে নৈরাজ্য, ২৮/১২/২০১২)। তৃতীয় অপরাধ: অনুষ্ঠান সঞ্চালকেরা বাংলিশ ভাষায় কথা বলছে।
৫.৪. বেসরকারি এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করা হচ্ছে ইংরেজিতে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা পড়ানোই হচ্ছে না। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনকি খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (হায়! এই প্রতিষ্ঠান ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার!) অনেক বিভাগে ইংরেজিতেই পাঠদান করা হচ্ছে। বাংলায় পাঠদানের সময় প্রমিত বাংলা বলেন না এমন শিক্ষকও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরল নয়।
“আমাদের উচ্চশিক্ষার যে জায়গায় মাতৃভাষার প্রয়োগ নেই বললেই চলে তা হচ্ছে প্রকৌশল, কৃষি, চিকিৎসা প্রভৃতি। সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা ভাষার কিছুটা হলেও প্রবেশাধিকার রয়েছে। অথচ প্রকৌশল, কৃষি বা চিকিৎসা এমন কোন শাস্ত্র নয়, যা বাংলা মাধ্যমে শিক্ষাদান অসম্ভব। আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র কখনো বাংলাকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা সেখানে করেনি। বিগত এক দশকে যে অর্ধশত ব্যক্তিমালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের অনুমোদন নিয়ে শিক্ষা-ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো পর্যায়ে কি বাংলা ভাষার প্রয়োগ আছে?” (সৌরভ সিকদার, ‘আমার একুশ-বাংলা ভাষা-উচ্চশিক্ষায় প্রয়োগ ও সমস্যা’, ৭/০৫/২০১২)
৫.৫. কিছু সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী: প্রথম অপরাধ: এঁরা আনন্দবাজার পত্রিকার বানানরীতি চালু করার অসৎ উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলা শব্দের বানান এমনভাবে লিখছেন যার ফলে শুদ্ধ আর অশুদ্ধ বানানের মধ্যে পার্থক্য করা মুস্কিল হয়ে পড়েছে।
“সংবাদপত্রের পাতায় চোখ বুলালেই এর ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত চোখে পড়বে। ক্ষীণ শব্দকে কোন ক্ষিন লেখা হবে, চীনকে কেন চিন লেখা হবে, এর কোনো সদুত্তর ও যুক্তি নেই। আনন্দবাজারের বানান রীতিকে সালাম করে এটা ওটা যুক্তি খাড়া করে বাংলা বানান রীতিতে এই বিকৃতি বেশ সাফল্যের সঙ্গেই এরই মধ্যে সাধন করা হয়েছে। (বদরুদ্দীন উমর,‘ভাষা নিয়ে ছিনিমিনি খেলার মহোৎসব’, যুগান্তর, ৭/০৩/২০১৪)
দ্বিতীয় অপরাধ: এরা বাংলা শব্দকে ভুল অর্থে ব্যবহার করে। বাংলাদেশের আদালতের রায়েও এই অপরাধের কথা উল্লেখিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ‘শ্রমিকেরা তাঁহাদের দাবিতে সোচ্চার হওয়া ব্যাপক অশান্তি হইল এবং মালিকপক্ষ পদক্ষেপ লওয়ায় শ্রমিক নেতা তাঁর বক্তব্য রাখিলেন।’Ñ এই বাক্যটির মধ্যে নাকি আনন্দবাজারের সম্পাদকের মতে ‘চারটি ভুল রহিয়াছে’।
“সোচ্চার শব্দটির অর্থ ‘পাখির সশব্দ মলত্যাগ’; ‘প্রভূত’ বোঝাইতে ‘ব্যাপক’ শব্দটি ব্যবহার করা চলে না; পদক্ষেপ ‘লওয়া’ সম্ভব নহে, তাহা করা যায়; এবং বক্তব্য ‘রাখা’ যায় না, তাহা পেশ করতে হয়। এই ভুলগুলি, এবং এই রূপ আরও অনেক ভুল বাংলাভাষার এমনই গভীরে প্রবিষ্ট হইয়াছে যে সেগুলিকে ভুল বলিয়া চিহ্নিত করাই দুষ্কর হইতেছে। ইহাও দূষণ। মারাত্মক দূষণ। ভাষার নদী এখন বহুবিধ দূষণে আক্রান্ত। অবিলম্বে সংস্কার আরম্ভ না হইলে দুঃখিনি বাংলা ভাষা আরও বিপন্ন হইবে।” (আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয়,রবিবার, ১৯শে ফেব্রুয়ারি, ২০১২)
‘প্রেক্ষিত’ ও ‘ফলশ্রুতি’ শব্দ দুটোর ভুল অর্থে ব্যবহার এত ব্যাপক যে, নামি-দামি লেখকদের সিংহভাগ এই আক্রমণ থেকে মুক্ত নন। প্রেক্ষণ অর্থাৎ দর্শন বা দৃষ্টি থেকে প্রেক্ষিত, যার আভিধানিক অর্থ- দর্শন করা হয়েছে এমন, যা পরিপ্রেক্ষিত বা পটভূমি অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তেমনি আরেকটি শব্দ ‘ফলশ্রুতি’, যা ফলাফল অর্থে ব্যবহৃত। অথচ শব্দটির মূল অর্থ পূণ্যকর্মের ফল বর্ণনা এবং তা শ্রবণ। অন্যদিকে, এন্তার ব্যবহার ‘চিন্তা-চেতনা’, ‘মন-মানসিকতা’র মতো শব্দের বিভ্রান্তিকর ব্যবহার। (আহমেদ রফিক, ২৩শে ফেব্রুয়ারি, ২০১২)
দ্বিতীয় অপরাধ: এরা নিজেদের লেখালেখিতে বিশেষ কিছু ‘পৌত্তলিকতাগন্ধী’ শব্দ ব্যবহার করে সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম জনগণের ধর্মীয় সংস্কৃতির উপর হামলা করছে। উদাহরণস্বরূপ (নি¤েœাক্ত লেখকের মতে) ‘শনি’, ‘ধোয়া তুলসীপাতা’, ‘উপাচার্য’, ‘আপামর’, ‘জয়ন্তী’, ‘তিলোত্তমা’, ‘¯œাতক’, ‘সতি’, ‘সতীর্থ’ ইত্যাদি শব্দ কোনো না কোনোভাবে হিন্দু ধর্মের সাথে সম্পর্কিত।
“শত শত বছর থেকে বাংলায় প্রচলিত আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দকে উৎখাত করে পশ্চিমবঙ্গের ‘আনন্দবাজার’, ‘দেশ’ প্রভৃতির অনুকরণে সংস্কৃত প্রতিশব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে।…আমাদের প্রতিবেশী পৌত্তলিক সম্প্রদায় থেকে ধার করে এনে আমাদের সাহিত্যে এমন সব শব্দ চালু করা হচ্ছে যেগুলো অনেক ক্ষেত্রে আমাদের ঈমান-আকিদা ও ধ্যান-ধারণার সাথেও সাংঘর্ষিক। … বেদী হচ্ছে পৌত্তলিকতার একটি নিদর্শন এবং মিনার হচ্ছে এমন একটি স্থান যেখান থেকে তাওহীদ বা আল্লাহর একত্বের বাণী প্রচার করা হয়।… শহীদ মিনারের চত্বরকে বেদী বলে সচেতনভাবে এটাই বোঝাতে চান যে, মিনারগুলো প্রতীমার সমতূল্য আর একুশে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠান পূজা-পার্বণের মতো একটি কাজ… লক্ষèী হলেন হিন্দুদের দেবতা।… অনেকেই বিনা দ্বিধায় বলছে, লক্ষèী ছেলে, লক্ষèী মেয়ে … বাংলার শব্দভা-ারে কি এমন কোনো শব্দ নেই যা লক্ষèীর বদলে ব্যবহার করা যায়?…হিন্দু-মুসলিম সবাই অনিষ্টকর কিছু দেখলেই বলে থাকেন, শনি লেগেছে… মনে রাখা দরকার, ইসলামে কোনো ধরনের কুসংস্কারের স্থান নেই। (মুরতাহিন বিলাহ জাসি, ‘বাংলা ভাষায় পৌত্তলিকতার অনুপ্রবেশ’, মাসিক আলকাউসার, এপ্রিল ২০১৪)
৫.৬. কয়েকটি পত্রিকা: প্রথম অপরাধ: এরা বাংলা ব্যাকরণকে বিকৃত করছে। যেমন, ১লা বৈশাখ, ২১শে ফেব্রুয়ারি বা ৭ই মার্চ না লিখে এরা হিন্দির অনুকরণে যথাক্রমে ১ বৈশাখ, ২১ ফেব্রুয়ারি এবং ৭ মার্চ লিখছে (উল্লেখ্য যে এই বিকৃতি শুরু করেছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথ)। এই প্রবণতা লেখার ভাষা থেকে ইতিমধ্যে মুখের ভাষায় চলে এসেছে। দ্বিতীয় অপরাধ: বাংলা শব্দের প্রচলিত বানান বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের বানানে বাংলা শব্দগুলো লেখা হচ্ছে (যেমন, ‘কৃষক’ এর পরিবর্তে ‘ক্রিশক’; ‘ক্রিকেট’ এর পরিবর্তে ‘কৃকেট’)।
৫.৭. বাংলা একাডেমি: পুরোনো প্রতিষ্ঠিত বানান বাতিল করে আনন্দবাজার পত্রিকার বানানবিধির আলোকে নতুন বানান চাপিয়ে দিয়ে বাংলা একাডেমি ভাষা-ব্যবহারকারীদের বিশেষ বানান সম্পর্কে দ্বিধাগ্রস্ত করছে যার ফলে তারা বুঝতে পারছেন না কোনটি ‘শুদ্ধ’ এবং কোনটি ‘অশুদ্ধ’ বানান।
“তারা প্রমিত বাংলা নামে যে বাংলা বানানরীতি চালু করছে সেখানেই এ সর্বনাশের ভিত্তি তৈরি করা হয়েছে। বাংলা একাডেমীর প্রথম ডিরেক্টর বাংলা একাডেমীর নাম এভাবে লিখলেও সম্প্রতি বিগত সরকারের আমলে জাতীয় সংসদে প্রস্তাব পাস করে সেটা পরিবর্তন করে করা হয়েছে বাংলা একডেমি। এটা নাকি এক নিয়ম অনুযায়ী করা হয়েছে। নিয়মটি হল, সব বিদেশী ভাষার বানানে কার-ী এর পরিবর্তে -িকার লিখতে হবে!! বাংলা ভাষার কোন বানান রীতি অনুযায়ী এ কাজ করা হয়েছে তার হদিস অবশ্য আমাদের জানা নেই। আসলে প্রমিত বাংলা নামে যা করা হয়েছে সেটা আনন্দবাজার পত্রিকার বানান রীতির একটা হেরফের ছাড়া আর কিছু নয়। … ণ, -ী (দীর্ঘ ঈ) ইত্যাদি প্রায় বর্জন করে বাংলা বানান রীতিতে যে বিপ্লব তারা সাধান করেছেন তার কোনো ব্যাকরণগত বা ঐতিহ্যিক ভিত্তি নেই। উপরন্তু এই উভয়কেই অগ্রাহ্য করে যা করা হচ্ছে তাতে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে যাতে বাংলায় অশুদ্ধ বানান বলে আর কিছুই থাকবে না কিছু দিন পর। যার যা ইচ্ছা সে সেই বানান লিখবে।” (বদরুদ্দীন উমর,‘ভাষা নিয়ে ছিনিমিনি খেলার মহোৎসব’, যুগান্তর, ৭/০৩/২০১৪)
৫.৮. শিক্ষামন্ত্রণালয় তথা সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা: প্রথম অপরাধ: ২০০২ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষার মূল ধারার (এনসিটিভি যে ধারার শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক জোগান দেয়) মধ্যেই সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চবিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ে ইংরেজি মাধ্যম চালু করার অনুমতি দেবার ফলে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার ব্যবহার সঙ্কুচিত হয়েছে।
“বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪২ বছর পর, এমনকি এর অনেক আগে থেকেই, বাংলা ভাষার ব্যবহার শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে পরিত্যক্ত হতে হতে এখন এক বিপজ্জনক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। … ঢাকা এবং দেশের অন্যত্র এখন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সংখ্যা বিপুল এবং এ সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সক্ষম পরিবারের লোকজন দিন দিন বর্ধিত সংখ্যায় বাংলা মাধ্যম স্কুল বাদ দিয়ে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতেই নিজেদের ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন। এ ধরনের পরিবারে বাংলা না জানাকে মনে করা হয় এক গৌরবের ব্যাপার। চাকরিবাকরি ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইংরেজি জানা লোকরাই সুবিধা ও প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এর জন্য ইংরেজি মাধ্যম কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের ভিড় বাড়ছে।… বাংলা শিক্ষার মাধ্যম হওয়া সত্বেও বাংলায় বিভিন্ন বিষয়ে বইয়ের ব্যবস্থা না থাকায়… বাংলা মাধ্যমে পড়া ছাত্রদের শিক্ষার মানও কমে এসেছে।” (বদরুদ্দীন উমর,‘ভাষা নিয়ে ছিনিমিনি খেলার মহোৎসব’, যুগান্তর, ৭/০৩/২০১৪)
“ইংলিশ ভার্সন নিয়ে যে উৎসাহ দেখা যাচ্ছে, তা চলতে থাকলে বাংলা ভাষা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা থাকবে না।… যারা ইংলিশ ভার্সনে পড়বে তারাই ভবিষ্যতে রাজনীতি, প্রশাসন, রাষ্ট্রীয় সব ব্যবস্থা ও আন্তরাষ্ট্রীক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করবে। বাংলা মাধ্যম থেকে যারা বের হবে তাদের কর্মক্ষেত্র সঙ্কুচিত হতে হতে একদিন আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।… পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন দ্রুত ইংরেজি মাধ্যমে চলে যাচ্ছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুরু থেকেই চলছে কেবল ইংরেজি মাধ্যম। ৭৮টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র দুটিতে বাংলা বিভাগ আছে। সেগুলোতে পড়ানো হয় কেবল সাহিত্য। জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোনো বিষয়েই বাংলা মাধ্যম নেই।… বর্তমানে যে প্রক্রিয়া চলছে তাতে বাংলাদেশে বাংলাভাষার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। পশ্চিমবঙ্গে, আগরতলায় এবং ভারতের আরও কিছু বাংলাভাষী এলাকায় বাংলার কোনো ভবিষ্যৎ আছে কি? মাতৃভাষারূপে বাংলা অবশ্যই থাকবে, কিন্তু রাষ্ট্রভাষারূপে বাংলা বাংলাদেশে থাকবে না। জাতিসংঘ কেবল মাতৃভাষা রক্ষা করতে চায়: দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্রভাষা রক্ষা করতে চায় না, ইংরেজি চাপিয়ে দিতে চায়।” (আবুল কাসেম ফজলুল হক, বাংলা মাধ্যম ও ইংলিশ ভার্সন, আলোকিত বাংলাদেশ, ১০/০৯/২০১৪)
দ্বিতীয় অপরাধ: অধ্যাপক ইসলাম যেমনটি বলেছিলেন, স্কুল ও কলেজ প্রমিত বাংলা শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও আঞ্চলিক ঢঙে বাংলা বলছে (উদাহরণ ২ এবং ৭)।
৫.৯. বাংলাদেশের সংসদ: বাংলাদেশের সংসদে প্রমিত বাংলার চর্চা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। অধিকাংশ সদস্যের বাংলা উচ্চারণে আঞ্চলিকতা লক্ষ্য করা যেতে পারে। কিছুদিন আগে এক সংসদ সদস্যার বক্তৃতায় ‘চুদুর-বুদুর’ শব্দটির ব্যবহার সংসদে ব্যবহৃত ভাষায় আঞ্চলিক শব্দমিশ্রণের অন্যতম প্রমাণ। কোনো এক মন্ত্রীর ‘আই এ্যাম একদম ফেড আপ’ বাক্যটি প্রমাণ করে যে ভাষামিশ্রণের কবল থেকে মন্ত্রীরাও মুক্ত হতে পারছেন না।
“বিরোধী দলের (বি এন পি’র) সংসদ সদস্য (সংরক্ষিত) ফেনীর রেহানা আখতার সংসদে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিতেই হবে। তিনি বলেন ‘তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে চুদুরবুদুর চইলতো না।… সরকারি দলের হুইপ, আ স ম ফিরোজসহ সরকারি দলের সংসদ সদস্যগণতো অগ্নিশর্মা, তারা হৈ চৈ শুরু করে দিলেন। বললেন ‘চুদুরবুদুর’ শব্দটি ‘অশ্লীল’।” (সূত্র:…)
৫.১০. বেশিরভাগ বাঙালি: কোনো কোনো লেখকের মতে, সিংহভাগ বাঙালি বাংলাভাষার দূষণে অংশ নিচ্ছে।
“আমরা চাই না শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলতে, শুদ্ধ বানানে লিখতে, নির্ভুল শব্দ ব্যবহারে পরিচ্ছন্ন ভাষারীতি গড়ে তুলতে।…মাতৃভাষার প্রতি আমাদের মমত্বহীন অবহেলা যে কতটা ব্যাপক, তার প্রমাণ মেলে রাস্তার দুপাশে বিজ্ঞাপন-সাইনবোর্ড-বিলবোর্ডগুলোর দিকে নজর ফেরালে। সেখানে দেখা যাবে বিচিত্র বানানের শব্দাবলি, যা কোন নিয়মকানুনের ধার ধারে না। এক ‘সরণি’ শব্দেরই বানানে কত রকমফের (স্মরণী, শরনি, সরনী ইত্যাদি)।… বানানে বানানে ভুলের মিছিল; এবং তা টিভি চ্যানেলেও দেখা যায়।” (সূত্র:…)
৫.১১. বাংলাদেশ সরকার: সরকারি প্রতিষ্ঠানেই মানা হয় না প্রমিত বানানরীতি। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি এক পরিপত্রে সরকারি কাজে সর্বত্র বাংলা একাডেমীর প্রমিত বানানরীতি অনুসরণ করার জন্যে অনুরোধ করেছে। এই বানানরীতির ২.০১ ধারা অনুসারে ‘সকল অ-তৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশী, বিদেশী, মিশ্র শব্দে কেবল ই এবং উ এবং এদের কার চিহ্ন ি এবং ু ব্যবহৃত হবে। এমনকি স্ত্রীবাচক ও জাতিবাচক ইত্যাদি শব্দের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। অথচ বাংলাদেশের মেশিন রিডেবল বা যন্ত্রপাঠযোগ্য পাসপোর্টে ‘বেশী’, ‘বাংলাদেশী’, ‘বসবাসকারী’, ‘লেনদেনকারী’ এই কয়েকটি অ-তৎসম শব্দে দীর্ঘ ঈ-কার ব্যবহৃত হয়েছে যেগুলো প্রমিত বানানরীতি অনুসারে ভুল বলে গণ্য হওয়া উচিত। বাংলা একাডেমীর বানানরীতি অনুসারে এসব শব্দের শুদ্ধ বানান হবে যথাক্রমে: বেশি, বাংলাদেশি, বসবাসকারি, লেনদেনকারি। এছাড়া এই পাসপোর্টে কিছু মুদ্রণগত অসঙ্গতিও রয়েছে। পাসপোর্টের সামনের পুস্তানীতে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতে ‘তোমায়’, ‘তোমার’, ‘তোর’ এই তিনটি শব্দ এবং ও পিছনের পুস্তানীর বাংলাদেশের সংসদ ভবনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় ‘শ্রেষ্ঠ’ শব্দটিতে যথাক্রমে ও-কার ও এ-কারে ভুল করে অনুমাত্রা দেয়া হয়েছে। জাতীয় সঙ্গীতের একই চরণে ‘তোমার আকাশ’-এ ও-কারে অনুমাত্রা আছে কিন্তু ‘তোমার বাতাস’ ও ও-কারে অনুমাত্রা নেই।
“বাংলা একাডেমী, এনসিটিবি ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন মিলিয়ে সরকারিভাবে আছে তিন রকমের বানানরীতি। অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের বানানরীতিও ওই তিন প্রতিষ্ঠান মানে না। সরকারি অফিস ভবনের সাইনবোর্ডের বানানে কর্মকর্তাদের খেয়াল-খুশি মতো যথেচ্ছাচার চলছে। প্রজ্ঞাপন, বিজ্ঞপ্তি লেখা হচ্ছে সাধু ও চলিত ভাষার ‘দূষণীয়’ মিশ্রণে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকাশনাগুলোতে ফাউন্ডেশনের নিজস্ব বানানরীতি অনুসরণ করা হয়।” (সরকারি প্রতিষ্ঠানেই মানা হয় না প্রমিত বানানরীতি, দৈনিক ডেসটিনি, ২৮/০২/২০১২)
দ্বিতীয় অপরাধ: সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামকরণ হয় ইংরেজিতে: NCTB, BGB, Teletalk ইত্যাদি।
৫.১২. এন.জি.ও. ও সিভিল সোসাইটি: এরা বিশ্বায়নে বিশ্বাস করে এবং জাতীয়তাবাদ ও জাতি-রাষ্ট্রের উপযোগিতা স্বীকার করে না। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হলে বাঙালি জাতীয়তার বিকাশ ঘটবে বলে এরা বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতি নয়।
“মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীরা সা¤্রাজ্যবাদেরই নতুন নাম দিয়েছে বিশ্বায়ন। ওয়াশিংটনকেন্দ্রিক মুক্তবাজার অর্থনীতি, অবাধ প্রতিযোগিতাবাদ ও নিওলিবারেলিজম তাদের অবলম্বন। সে ধারার অন্ধ অনুসারী হয়ে বাংলাদেশ চলছে। তারই ফলে কিছু লোকের মনে ইংলিশ ভার্সনের ধারণা জেগেছে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে তা কার্যকর করে ফেলা হয়েছে।” (আবুল কাসেম ফজলুল হক, ‘বাংলা মাধ্যম ও ইংলিশ ভার্সন’, ১০/০৯/২০১৪)
পত্রপত্রিকা ও আন্তর্জালে প্রকাশিত বিভিন্ন লেখকের লেখা থেকে আমরা দেখলাম যে কমবেশি বারোটি পক্ষ বাংলাভাষার তথাকথিত দূষণের দায় এড়াতে পারেন না। তবে এদের মধ্যে কারা নিছক দূষণের শিকার এবং কারা প্রকৃতপক্ষে দূষণের জন্যে দায়ী – সে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
৬. দূষণ বন্ধে করণীয় সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত মতামতের বিশ্লেষণ
৬.১. এফ এম রেডিওর সম্প্রচারে ইংরেজি ঢঙে এবং ইংরেজি শব্দ মিশিয়ে বাংলা বলা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। টেলিভিশনের নাটক-সিরিয়ালে শুদ্ধ, প্রমিত বাংলা ব্যবহার করতে হবে।
এক সাক্ষাৎকারে কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেছেন: “এফএম রেডিওগুলোতে যেভাবে কথা বলা হচ্ছে সেটা একেবারেই বন্ধ করতে হবে। কারণ, বাংলাভাষী কোনো অঞ্চলেই এর প্রয়োগ নেই।” কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই যে এফ এম রেডিওতে নিকষিত শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বললেও ইংরেজি ঢঙে বাংলা বলা বা বাংলায় ইংরেজি শব্দমিশ্রণ বন্ধ হবে না। এফ এম রেডিও শুনে মানুষ ভাষা শেখে না, খদ্দের-শ্রোতা যে ভাষায় কথা বলে এফ এম রেডিও সেই ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার করে তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায় মুনাফার স্বার্থে।
ভবিষ্যতের প্রজন্ম আরও বেশি করে ইংরেজি এবং হিন্দিভাষী হয়ে উঠবে এবং স্বাভাবিকভাবেই তারা আরও বেশি ইংরেজি-হিন্দি শব্দ মেশাবে তাদের বাংলায়। ভাষা-সংযোগ হলে এই ঘটনা ঘটবেই ঘটবে, কারও পছন্দ হোক বা না হোক। প্রমিত বাংলায় ইংরেজি শব্দের মিশ্রণ পছন্দ করেন না এমন শেষ বুদ্ধিজীবীটিও পৃথিবী থেকে বিদায় নেবেন, ধরা যাক, ২০৫০ সালের আগেই। ইতিমধ্যে ইংরেজি শব্দগুলোকে বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব এমনভাবে বদলে নেবে (হাওয়া, চেয়ার, নাট-বল্টুর মতো) যে সাধারণ মানুষ কথা বলার সময় খেয়ালই করবে না কোনো এককালে এই শব্দগুলো ইংরেজি থেকে এসেছিল।
ব্যক্তিমালিকানার টিভি যদি শুধু সিলেটি ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে তবে তাতে রাষ্ট্রের কী বলার থাকতে পারে? নোয়াখালীর কোনো একজন নাট্যকার যদি বরিশালে বোধগম্য হতে না চান তাতেই বা রাষ্ট্র বাধ সাধবে কেন। একইভাবে কোনো বেসরকারি বেতারকেন্দ্র যদি বিশেষ একটি উপভাষা বাংরেজিতে অনুষ্ঠান প্রচার করে তবে তাতে বাধা দেয়া হবে কোন যুক্তিতে? আদালত বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেখানে বাংলা ব্যবহারই করছে না সেখানে এফ এম রেডিও অন্তত বাংলায় অনুষ্ঠান প্রচার করছে, সে বাংলা কারও কারও কাছে যতই শ্রবণকটু হোক না। এছাড়া ভাষার সুশ্রাব্যতা বা শ্রবণকটুত্ব একটি আপেক্ষিক অনুভূতি। যা একজনের কাছে শ্রবণকটু তাই আরেক জনের কাছে শ্রবণমধুর মনে হতে পারে।
৬.২. হিন্দি চ্যানেলের অনুমোদন বন্ধ করতে হবে (শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামানের কমিটি প্রদত্ত প্রতিবেদনে এই সুপারিশ ছিল বলে জানা গেছে)।
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে উত্তর ভারত কমবেশি প্রভাবিত করে আসছে পূর্বভারত সহ উপমহাদেশের বাকি অংশকে। পাঞ্জাবি-বুরখা-কুর্তা-নান-পাগড়ি-বিরিয়ানি-তন্দুরি-গান-ভগবান… সব আমরা উত্তর ভারত থেকে নিয়েছি বা উত্তর ভারতের মাধ্যমে পেয়েছি। টিভি-ইন্টারনেটের বদৌলতে দিন দিন আরও সর্বব্যাপী হবে উত্তর ভারতের প্রভাব। এই প্রভাব পুরোপুরি কাটানো যাবে না তবে স্থানীয় সংস্কৃতির অধিকতর চর্চা করে একে সহনশীল পর্যায়ে রাখা যেতে পারে। যাই হোক, স্থায়ীভাবে হিন্দি চ্যানেল বন্ধ করা বাঙালি জাতির জন্য বিরিয়ানি খাওয়া নিষিদ্ধ করার মতোই অসম্ভব। চ্যানেল বন্ধ করে দিলে হিন্দি অনুষ্ঠান দেখার অন্য অনেক উপায় মানুষ খুঁজে নেবে। বাংলাদেশে কোনো চ্যানেলে নীলছবি দেখানো হয় না বলেই বাংলাদেশের মানুষ নীলছবি দেখা থেকে বিরত আছে এমনটা ভেবে নেয়াটা শিশুতোষ হবে।
যাঁরা বলছেন, শিশুরা হিন্দি চ্যানেল দেখে হিন্দি শিখে যাচ্ছে, তাদের উৎকণ্ঠার কারণ কি বোঝা মুস্কিল। নিছক টেলিভিশন দেখে নতুন একটি ভাষা হিন্দি শিখলে সমস্যা কি? একটি ভাষা শিখলে আর একটি ভাষার ক্ষতি হবে এমন আশঙ্কা অমূলক। শৈশব আর বাল্যকাল হচ্ছে ভাষা শেখার আসল বয়স। এছাড়া হিন্দি শেখার কিছু সুবিধাও আছে। হিন্দি আর আর উর্দু একই ভাষা এবং ফিল্মি হিন্দি ধীরে ধীরে উর্দুতে পরিণত হচ্ছে। জনসংখ্যার অতিবৃদ্ধির কারণে বাঙালি জাতি ধীরে ধীরে সারা উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। হিন্দি-উর্দু জানলে উপমহাদেশের অন্য দুটি দেশে কাজ পেতে, সেখানে গিয়ে সেখানকার জনগণের সাথে মিশে যেতে সুবিধা হবে। ভারত-পাকিস্তানের এমন কম অঞ্চলই আছে যেখানে ইতিমধ্যেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশী নাগরিক কর্মরত নেই। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়বে বই কমবে না। ভবিষ্যতের ভারতবর্ষে যে দুটি ভাষা পরস্পর মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা আছে সে দুটি হচ্ছে হিন্দি ও বাংলা। এই প্রতিযোগিতায় হিন্দি যে বিষয়টিতে বাংলার তুলনায় পিছিয়ে থাকবে সেটি হচ্ছে, হিন্দি সব হিন্দিভাষীর মাতৃভাষা নয়। সুতরাং হিন্দি শিখে নিলে আখেরে বাঙালির লাভ ছাড়া ক্ষতির কোনো সম্ভাবনা নেই।
বলিউডের কল্যানে বাঙালিসহ উপমহাদেশের প্রায় সব জাতির বিনোদনের ভাষায় পরিণত হয়েছে হিন্দি। যারা হিন্দি বুঝবেন না তার বিনোদনের একটি সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। কর্তৃপক্ষ হিন্দিতে ডাব করা জাপানি ডোরেমন বাদ দিতে পারে, কিন্তু বিনিময়ে কোন বিনোদন দেবে শিশুদের? ডোরেমনের বিকল্প কি বাঙালির হাতে আছে? আর চ্যানেলে বন্ধ হলেই কি ডোরেমন দেখা বন্ধ হবে? মানসম্পন্ন বাংলা অনুষ্ঠান তৈরি করা হলে মানুষ হয়তো আপনিই হিন্দি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিত। হিন্দি ছবিকে গত শতকের ষাটের দশক থেকে বাংলাদেশের হলে চলতে না দেওয়াতে বাংলা ছবির উন্নতি হয়নি, বরং বাংলাদেশের সিনেমা হলগুলোই একে একে বন্ধ হয়েছে। অন্যদিকে হিন্দি ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ভারতের অনেক প্রাদেশিক সিনেমাশিল্প টিকে আছে শুধু নয়, বরং সেগুলোর অনুকরণীয় উত্তরণ ঘটেছে। পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক সিনেমার মানের সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সিনেমার মানের তুলনা করলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।
৬.৩. আঞ্চলিক ভাষা ও প্রমিত ভাষার মিশ্রণ রোধ করতে হবে।
“ভাষার বিকৃতি রোধ করার জন্য প্রমিত বাংলার পাশাপাশি আঞ্চলিক ভাষার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আঞ্চলিক ভাষার নাম করে বিচ্ছিন্ন শব্দের ব্যবহারের মাধ্যমে ভাষাকে বিকৃত করা চলবে না। আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে। … রাস্তার পাশে ভুল বানানে যেভাবে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী সংস্থার বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করা হচ্ছে, এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েও ভাষার বিকৃতি ঘটছে। এ ক্ষেত্রে সরকারিভাবে এখনই ভাষাবিকৃতি রোধে একটা সেল গঠন করা উচিত। যারা এসব বিজ্ঞাপনী সংস্থাকে শুদ্ধ বানানে বিজ্ঞাপন প্রদর্শনের অনুমতি প্রদান করবে এবং বিভিন্ন মাধ্যমে ভাষার শুদ্ধ ব্যবহার নিশ্চিত করবে।” (এক সাক্ষাৎকারে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন)
গণতন্ত্র যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন হয় তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ব্যবহৃত ভাষাই প্রমিত ভাষা হওয়া উচিত ছিল। তথাকথিত শুদ্ধ বা প্রমিত বাংলা কখনই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা নয়। প্রমিত বাংলা হচ্ছে সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণী কর্তৃক ব্যবহৃত একটি উপভাষা যা তারা আপামর জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দিতে চায় সর্বজনীন যোগাযোগের সুবিধার অজুহাতে। ইংরেজি-আঞ্চলিক শব্দ মিশ্রিত যে উপভাষায় সাধারণ মানুষ কথা বলে (যদি বলে) সংখ্যার বিচারে সেটাই কি প্রমিত হওয়া উচিত নয়? ইংরেজি-আঞ্চলিক শব্দ বিবর্জিত (যদি আসলেই এর অস্তিত্ব থাকে) যে উপভাষাটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটি অংশ ব্যবহার করে বলে দাবি করা হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠতার নিরিখে বিচার করলে সেটা প্রমিতত্ব খারিজ হয়ে যায়।
আঞ্চলিক ভাষার শব্দ ব্যবহার করলেই প্রমিত ভাষা কেন বিকৃত হয়ে যাবে? ৭ই মার্চের ভাষণে ‘দিবার পারবা না’, ‘আমার রক্তের উপর পাড়া দিয়ে’ ইত্যাদি আঞ্চলিক শব্দবন্ধ ব্যবহার করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপিতা শেখ মুজিবও তাহলে প্রমিত বাংলাকে বিকৃত করেছিলেন। আঞ্চলিক ভাষাকে সম্মান করার অর্থ কী? প্রমিত ভাষাতো আঞ্চলিক ভাষার মতোই একটি উপভাষা। প্রমিত ভাষার শব্দতো আঞ্চলিক ভাষায় হরহামেশাই ব্যবহৃত হয়। কেন বিভিন্ন উপভাষার মধ্যে শব্দের আদান-প্রদান আইন করে বন্ধ করতে হবে? প্রমিত ভাষা যেহেতু একটি সর্বজনীন উপভাষা সেহেতু এ উপভাষায় অন্য উপভাষায় থেকে শব্দ ঢোকাটাইতো স্বাভাবিক। একজন চট্টগ্রামি-ভাষী যদি কথা বলার সময় কোনো বিশেষ বাংলা শব্দ খুঁজে না পায় তবে কি সে চট্টগ্রামি শব্দ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকবে? কথা বলাটা জরুরি, নাকি শব্দ ব্যবহারের শুদ্ধতাটা জরুরি?
ভাষাসেল গঠন করা যেতে পারে, ভাষাপুলিশেরও নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন সংস্থা যেখানে বানানের ব্যাপারে একমত হতে পারছে না, সরকার নিজেই যেখানে প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করছে ইংরেজিতে (বিজিবি, টেলিটক…) সেখানে বানান-বিকৃতি বা ভাষাদূষণ রোধে সেল গঠন করে কি হবে? ভাষাপুলিশ যে উৎকোচ নিয়ে সাইনবোর্ডে ভুল বানান দেখেও না দেখার ভান করবে না তারই বা কি নিশ্চয়তা আছে?
৬.৪. প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রমিত উচ্চারণ-প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
শিক্ষার্থীরা মান বাংলায় কথা বলতে না পারার জন্যে অনেকে শিক্ষকদের দায়ি করে বলেন যে বাংলাদেশে প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আঞ্চলিক ভাষায় অংক, ভূগোল, ইতিহাস পড়ান, এমনকি বাংলা ব্যাকরণও। অভিযোগ সত্য। আমার শ্রদ্ধেয় স্কুলশিক্ষকেরা প্রায় সবাই বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে চট্টগ্রাম/নোয়াখালি অঞ্চলের উচ্চারণে এবং অনেক সময় চট্টগ্রামি উপভাষাতেই পাঠ দান করতেন। কিন্তু এতে আমার জ্ঞানার্জনে কোনো অসুবিধা হয়নি। পৃথিবীর সব দেশে এ রীতি প্রচলিত আছে। জাপানে কান্তো (টোকিও) অঞ্চলে প্রচলিত উচ্চারণকে প্রমিত বলে ধরা হয়, কিন্তু কানসাই (ওসাকা) অঞ্চলের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সেই প্রমিত উচ্চারণ ব্যবহার করেন না, পড়ানোর কাজে তাদের নিজস্ব কানসাই উচ্চারণই ব্যবহার করেন। কানাডার কুইবেকের শিক্ষায়তনগুলোতে প্যারিসের প্রমিত ফরাসিতে পড়ানো হয় না। এতে করে এসব দেশের ছাত্রদের অঙ্ক, সাহিত্য, ব্যাকরণ বা ভাষাজ্ঞানের কোনো ঘাটতি হবার কথা কখনও শোনা যায়নি।
শিক্ষকদের উচ্চারণ-প্রশিক্ষণের প্রকল্প বাস্তবসম্মত নয়, কারণ কোনো মানুষের ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক কাঠামো একবার স্থির হয়ে গেলে প্রশিক্ষণ দিলেও সে কাঠামোর খুব বেশি পরিবর্তন হবে না। ট্রেনিং দিয়ে দুই একজনের উচ্চারণ বদলে দেয়া হয়তো যাবে, কিন্তু বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ শিক্ষকের উচ্চারণ বদলানো যাবে Ñ এটা কষ্ট কল্পনা।
৬.৫. শব্দের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
যারা ভুল অর্থে শব্দপ্রয়োগ নিয়ে অভিযোগ করেন তারা মনে করেন, শব্দের অর্থের পরিবর্তন হয় না বা শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থই চিরকাল বজায় থাকা উচিত। এদের দাবি একেবারেই ভাষাবিজ্ঞানসম্মত নয়। ‘উদার’ শব্দের মূল অর্থ ছিল ‘যার বড় উদর আছে’ অর্থাৎ ‘ঘোড়া’। এখন এর অর্থ ‘যার বড় মন আছে’। ‘সোচ্চার’ শব্দের অর্থ ‘পাখির সশব্দ মলত্যাগ’ হয়তো ছিল কোনো এক কালে। এখন শব্দটি নতুন একটি অর্থে ব্যবহৃত হয় বলে সেটাকে সেই শব্দের অপব্যবহার বলা যায় না। যারা শব্দব্যবহারে পুনরোক্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তারা হয়তো জানেন না যে পুনরোক্তি ভাষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বাংলায় আমরা বলি ‘উপরে উঠছে’ বা ‘নিচে নামছে’। ফরাসি ভাষায় এমন ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করা হয় এই বলে যে নিচে ওঠা যায় না বা উপরে নামা যায় না। পুনরোক্তি দোষের শিকার খোদ রবীন্দ্রনাথ। ‘অশ্রু’ মানেই চোখের জল। সুতরাং ‘অশ্রুজল’ বলা উচিত নয়, অথচ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘তারি লাগি যত ফেলেছি অশ্রুজল’। ভাষা পুনরোক্তি অনুমোদন করে বলেই রবীন্দ্রনাথ এ রকম লিখতে পেরেছিলেন।
৬.৬. উচ্চশিক্ষায় বাংলাকে আবশ্যিক করা দরকার
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মনে করেন, উচ্চশিক্ষার সর্বস্তরে ১০০ নম্বরের হলেও বাংলা ভাষাকে আবশ্যিক করা খুবই প্রয়োজন। (সূত্র: সাব্বির নেওয়াজ, ‘উচ্চশিক্ষায় বাংলার কদর নেই’, http://azker 24.com/permalink/13799.html) এর মানে হচ্ছে, অধ্যাপক ইসলাম মেনে নিচ্ছেন, বাংলাকে উচ্চ শিক্ষার ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সম্ভাবনা দূর অস্ত। আপাতত ‘বিনা যুদ্ধে স্যচ্যগ্র মেদিনী’ পেলেই তিনি খুশি। শুধু ১০০ নম্বরের একটি পেপার পড়িয়ে যে ছাত্রদের বাংলা শেখানো যাবে না, সে সন্দেহ করা যেতেই পারে। জাপানে বা থাইল্যান্ডে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম বাধ্যতামূলকভাবে জাপানি বা থাই। বাংলা ভাষাকেও যদি বাধ্যতামূলকভাবে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম করা যায় তাহলে ছাত্ররা বাংলায় সড়গড় হলেও হতে পারে। সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রমিত বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে বাধ্য করার ক্ষমতা যদি রাষ্ট্র বা সরকারের না থাকে তবে বাংলার জন্যে সব কান্নাই কার্যত মায়াকান্নায় পরিণত হবে।
৬.৭. আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
প্রবাদ আছে: আপনি আচরি ধর্ম পরকে শিখাবে। সবার কী করা উচিত সে ব্যাপারে বিধান দেয় যে আদালত সেই আদালতই যদি বাংলা ভাষা ব্যবহার না করে তবে জনগণেরই বা সে ভাষা ব্যবহার করার এমন কি দায় পড়েছে? মহামান্য আদালত ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা ভাষা রক্ষায় যে রুলটি দিয়েছেন সেটিও দিয়েছেন ইংরেজি ভাষায়। সংবিধানে যদিও বলা হয়েছে ‘প্রজাতন্ত্রের ভাষা বাংলা’ তবুও ‘বিচার বিভাগ প্রজাতন্ত্রের উর্দ্ধে কিনা’Ñ এ প্রশ্ন তুলে ইংরেজি ভাষাতেই উচ্চ আদালতের কাজকর্ম চলছে। অথচ ১৯৮৭ সালের বাংলা প্রচলন আইনে পরিষ্কার বলা হয়েছে, আদালতকে অবশ্যই বাংলায় কার্যক্রম চালাতে হবে।
বাংলা প্রচলন আইন ১৯৮৭
৩ (১) এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারী অফিস, আদালত, আধা-সরকারী, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে।
(২) ৩(১) উপধারায় উল্লেখিত কোন কর্মস্থলে যদি কোন ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন তাহা হইলে উহা বেআইনী ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।
(৩) যদি কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী এই আইন অমান্য করেন তাহা হইলে উক্ত কার্যের জন্যে তিনি সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপীল বিধির অধীনে অসদাচরণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে এবং তাহার বিরুদ্ধে সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপীল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।
ভূত নিজেই যদি সরিষা পকেটে নিয়ে ঘুড়ে বেড়ায় তবে ভুত তাড়াতে সরিষার কার্যকারীতা নিয়ে সন্দেহ করাই যায়। আদালত নিজে যদি উপরোক্ত আইন মেনে সব কার্যক্রমে প্রমিত বাংলা ভাষা ব্যবহার করে তবে বাংলাভাষার শব্দকোষ ও ব্যাকরণ উভয়ই সমৃদ্ধ হবে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য একটি ধাপ হচ্ছে আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা।
৬.৮. প্রমিত বাংলায় বিশেষ ধর্মের শব্দ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
সব ধর্মের, সব পেশার, সব অঞ্চলের লোকই যেহেতু প্রমিত বাংলা ব্যবহার করে থাকে সেহেতু সব ধর্মের, পেশার ও অঞ্চলের শব্দ এসে প্রমিত বাংলা শব্দকোষে স্থান করে নেয়। শব্দকোষ নিয়ত পরিবর্তনশীল। কোনো কোনো শব্দ উচ্চারণগত ও অর্থগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘকাল শব্দকোষে থেকে যায়, অনেক শব্দ অকালে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। এভাবেই ‘জগাখিচুরি’, ‘লক্ষ্মী ছেলে’, ‘শনির দশা’, ‘গোবর-গনেশ’, ‘ক-অক্ষর গোমাংস’, ‘ইনশাল্লাহ’, ‘গোঁয়ার-গোবিন্দ’ ইত্যাদি শব্দবন্ধ হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সব বাংলাভাষীর শব্দকোষে স্থান পেয়েছে। ভূতে বিশ্বাস করে না এমন ব্যক্তিরও ‘সরিষায় ভূত’ বলতে বাধে না। খাঁটি হিন্দুও ‘বিসমিল্লায় গলদ’ বলতে পারে। কোনো ব্যক্তিবিশেষের কোনো বিশেষ শব্দে ‘অ্যালার্জি’ থাকতে পারে। কোনো রাজাকারের ছেলে বা নাতি ‘রাজাকার’ শব্দটি ব্যবহার করতে অস্বস্তিতে ভুগতে পারেন, কিন্তু পুরো ভাষাগোষ্ঠির উপর এইসব ব্যক্তিগত অস্বস্তি চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা সাধারণত সফল হয় না। আতাতুর্কের তুরস্কে আরবি শব্দ এবং হিটলারের জার্মানিতে ফরাসি শব্দ বাদ দেবার প্রবল সরকারি চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবশিত হয়েছিল। বিশেষ ধর্মের শব্দ হওয়ার অজুহাতে কোনো কোনো শব্দ প্রতিস্থাপিত করার বৃথা চেষ্টা পাকিস্তানী আমলে হয়েছিল। বিজ্ঞ আদালতও তাঁর রায়ে এ ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন:
“এ বিকৃতকরণের প্রক্রিয়া আজ থেকে শুরু হয়নি। এক সময় কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাও এ দেশে সংশোধিত হয়েছে। তিনি লিখেছিলেন, ‘সজীব করিব মহাশ্মশান। তাকে বদলে করা হয় ‘সজীব করিব কবরস্থান’। (নিজস্ব প্রতিবেদক, ‘বেতার-দূরদর্শনে বাংলাকে বিকৃত করা যাবে না’, প্রথম আলো, ১৭/০২/২০১২)
৬.৯. বানানের অরাজকতা বন্ধ করতে হবে।
কোনো শব্দের বানান নির্ধারণের ক্ষেত্রে দুটি নিয়ামক আছে: উচ্চারণ ও ঐতিহ্য। হালনাগাদ উচ্চারণ অনুসারে বানান নির্ধারণ করা যেতে পারে বা শব্দের ইতিহাস অনুসারে বানান নির্ধারণ করা যেতে পারে। পৃথিবীর সব ভাষায় এই দুই নিয়ামকই কমবেশি অনুসরণ করা হয়। বানান নিয়ে যারা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন ভাষা ও ব্যাকরণ সম্পর্কে তাদের সম্যক জ্ঞান এবং কা-জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। কিছু বানানকে ১৯৩৬ সালের বানান সংস্কারকেরা শ্রেফ ভুল ধারনার বশবর্তী হয়ে বাতিল করেছিলেন। রেফ এর পর ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব না হবার অজুহাতে বাতিল হয়েছিল ‘সূর্য্য’, ‘উপাচার্য্য’ ইত্যাদি বানান। পরে সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় বুঝতে পারেন, এই সব শব্দে আছে য আর য় এই দুটি ব্যঞ্জন এবং যাকে য-ফলা বলা হচ্ছে সেটি আসলে য়-ফলা। এই সব শুদ্ধ বানানকে আর ফিরিয়ে আনা হয়নি। ‘লক্ষ্য’ এবং ‘লক্ষ’ শব্দকে এক বানানে লিখে দুটি শব্দকে অনর্থক সমলিপি (Homograph) শব্দে পরিণত করা হয়েছে। সব সংস্কার কমিটির প্রস্তাবেই পাইকারিভাবে দীর্ঘ ই-কার, মূর্ধণ্য ণ, ষ্ট ইত্যাদিকে বাদ দেবার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাবে। ভাষা ও ব্যাকরণে সম্যক পেশাদারি জ্ঞানের অভাবই বাংলা বানান সংস্কারে এই সব তুঘলকী সিদ্ধান্তের কারণ।
বানানে বিকল্প থাকবেই: বাংলা, বাঙ্গলা, বাঙলা। এক শব্দের একটি মাত্র বানান থাকতেই হবে ভাষার জন্যে এটা কোনো আবশ্যকীয় শর্ত নয়। যে কোনো লিখিত ভাষায় অল্প কিছু বানানে বিকল্প থাকে এবং সেই বিকল্প অনুমোদন করা উচিত তিনটি কারণে: ১) যারা পুরোনো বানানে অভ্যস্ত তাদের উপর হঠাৎ করে নতুন বানান চাপিয়ে দিলে সে বানানে অভ্যস্ত হতে তাদের সময় লাগে; ২) নতুন বানান না লেখার কারণে তাদের গুরুতর আর্থিক ক্ষতি হতে পারে (ধরা যাক, তারা কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হতে পারেন); ৩) ব্যাকরণ ও ভাষা অনেক ক্ষেত্রেই বিকল্প অনুমোদন করে, সুতরাং কিছু বানানে বিকল্প থাকলে ক্ষতি নেই; ৪) একাধিক বিকল্প বানানের মধ্যে একটি বানানই সাধারণত কালের প্রবাহে টিকে থাকে।
৬.১০. বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ লোক সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, ধর্ম, বিচারকার্য, রাজনীতি ও উৎপাদনকর্ম সহ যাবতীয় দৈনন্দিন কার্যক্রমে প্রমিত ভাষা ব্যবহার করতে সক্ষম হওয়ার মতো শিক্ষিত হওয়া দরকার।
প্রমিত ভাষায় সবার শিক্ষিত হওয়ার অপরিহার্যতা বিষয়ে বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। কিন্তু যাঁরা প্রমিত বাংলা বলতে সক্ষম তাঁরা কি প্রমিত ভাষা তাদের পেশাগত জীবনে ব্যবহার করেন? যদি না করেন, তবে ৯০ শতাংশ লোক প্রমিত বাংলা শিখে ফেলবে তখন তারাও যে প্রমিত বাংলা ভাষাই ব্যবহার করবে তার নিশ্চয়তা কোথায়?
৬.১১. পত্রপত্রিকায় বাংলা ভাষার ব্যাকরণ বিকৃতি বন্ধ করতে হবে।
ইংরেজি ও হিন্দির অনুকরণে ১ বৈশাখ, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ ইত্যাদি লেখা বন্ধ করা উচিত, কারণ বাংলায় তারিখ শব্দ লেখার একটি রূপতাত্ত্বিক নিয়ম রয়েছে: পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ। বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের নিয়ম অনুসারে বাংলা শব্দ উচ্চারণ না করা যদি বাংলা ভাষার দূষণ হয়ে থাকে তবে বাংলা রূপতত্ত্বের নিয়ম অনুসারে বাংলা শব্দ গঠন না করাটাকেও ভাষাদূষণ বলে গণ্য করা উচিত। এ ধরনের বিকৃতি ভাষাব্যবহারে দ্বিধাগ্রস্ততার সৃষ্টি করে, ২১ ফেব্রুয়ারি হবে নাকি ২১শে ফেব্রুয়ারি হবে, ৭ মার্চ হবে নাকি ৭ই মার্চ?
৭. বাংলা ভাষার প্রকৃত সমস্যা
বাংলা ভাষার আসল সমস্যা দুটি। প্রথম সমস্যাটি নিয়ে সত্তরের দশক থেকেই আহাজারি চলছে: সর্বস্তরে এই ভাষার প্রয়োগ নেই। সর্বস্তরে প্রমিত বাংলা প্রয়োগ করতে গেলে বিচারবিভাগ, শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশাসনে এর প্রয়োগ দিয়ে শুরু করতে হবে। এর পর ছড়িয়ে দিতে হবে অন্য সব জায়গায় যেখানে যেখানে বাংলার উপস্থিতি নেই। ভাষার জীবন ও স্বাস্থ্য নির্ভর করে বিচিত্র পেশার ও শ্রেণীর মানুষের মুখে এর বিচিত্র ব্যবহারে। দূষণের ধারণা অমূলক, কিন্তু দূষণ বলে যদি কিছু থাকেও ভাষার সর্বব্যাপী ব্যবহার শুরু হলে সে দূষণ সমস্যার সমাধান আপনিই হয়ে যাবে। অধ্যাপক ইসলাম তাঁর লেখায় বাংলা ভাষাকে ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর সাথে তুলনা করেছেন। বর্ষার স্রোতধারা যখন বুড়িগঙ্গায় এসে মিশে তখন এ নদীর দূষণ কমে যায়। যত বিচিত্র ব্যবহার হবে তত বৈচিত্র্য আসবে প্রমিত বাংলার ব্যাকরণে এবং শব্দকোষে। যত কম ব্যবহার হবে ততই স্বাস্থ্যহীন হয়ে পড়বে, দূষিত হবে প্রমিত বাংলা। আইন করে নদীদূষণের মতো ভাষার দূষণও বন্ধ করা যায় না, জনসচেতনতা লাগবে।
বাংলা ভাষার দ্বিতীয় সমস্যা, ভাষাটির অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠাহীনতা। কোনো ভাষার তিন ধরনের প্রতিষ্ঠার করার কথা ভাবা যেতে পারে: ১. সামাজিক প্রতিষ্ঠা, ২. রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা ও ৩. অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা। হিন্দু প-িতেরা এক সময় বাংলাভাষা চর্চাকে কমবেশি নিরুৎসাহিত করেছিলেন। মুসলমান আলেমরাও বাংলা ভাষায় ইসলাম ধর্মের গ্রন্থ রচনাকে নিরুৎসাহিত করতেন। এর মানে হচ্ছে এই যে, এমন এক সময় ছিল যখন বাংলা ভাষার সামাজিক প্রতিষ্ঠা ছিল না। বিংশ শতকের মধ্যভাগেই বাংলার সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জিত হয়ে গিয়েছিল।
সুলতানী/মুঘল ও ইংরেজ আমলে বাংলার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা ছিল না, কারণ ফার্সি আর ইংরেজিই ছিল যথাক্রমে তামাম হিন্দুস্তান এবং ব্রিটিশ ভারতের দাপ্তরিক ভাষা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল মূলত বাংলাভাষার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা অর্জনের আন্দোলন, কারণ বাংলা ভাষার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা পাবার সম্ভাবনা সমূলে উৎপাটন করার অপচেষ্টা করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা। বাংলাদেশের সংবিধানে লেখা আছে: ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। এর অর্থ হচ্ছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বাংলাভাষাকে রাজনৈতিক স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ১৯৮৭ সালের বাংলা ভাষা প্রচলন আইনেও এই স্বীকৃতি প্রতিফলিত হয়েছে।
কিন্তু বাংলা ভাষার অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা অর্জন এখনও বাকি আছে। অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোনো ভাষা দীর্ঘদিন সসম্মানে টিকে থাকতে পারে না, এমনকি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার অভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠাও কালক্রমে হারিয়ে যেতে পারে। কিভাবে বাংলাকে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা দেয়া যেতে পারে? পৃথিবীর অন্য অনেক ভাষার মতোই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাভাষাকে ইংরেজি ভাষার সাথে প্রতিযোগিতা করতে হয়। দীর্ঘ দিন ভারতবর্ষের দাপ্তরিক ভাষা ও আন্তর্জাতিক ভাষা হওয়ার সুবাদে ইংরেজি অবশ্যই বাংলার তুলনায় কুলীনতর ভাষা হিসেবে গণ্য হয় এবং স্বাভাবিকভাবেই বাংলার (এবং মারাঠি, হিন্দিসহ আরও অনেক দক্ষিণ এশীয় ভাষার) প্রাপ্য অর্থনৈতিক সুবিধাগুলো ইংরেজিই সব নিয়ে নেয়।
৮. কী করিতে হইবে?
বাঙালিরা যদি এই পরিস্থিতির পরিবর্তন চায় তবে তাদের একটি ভাষানীতি ঠিক করতে হবে এবং একটি ভাষা আইন প্রণয়ন করতে হবে। ভাষানীতি, ভাষা-আইন বা ভাষাপরিকল্পনায় কোনো একটি দেশে এক বা একাধিক ভাষা-ব্যবহারের প্রকৃতি ও সীমা নির্ধারণ করা হয়। উদাহরণ: ১. শিক্ষার মাধ্যম কি হবে, বাংলা নাকি ইংরেজি? ২. গারো বা খাসিয়া ভাষায় উচ্চশিক্ষা দেয়া হবে কিনা। ৩. ককবরোক ভাষায় আদালতের কাজ চালানো হবে কিনা ইত্যাদি। ভাষা আইন ও এর সঠিক প্রয়োগ সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিশেষ ভাষার আইনসঙ্গত ব্যবহার নিশ্চিত করে। উদাহরণ: ১. আদালতের রায় বাংলায় দেয়ার কথা যদি আইনে উল্লেখ থাকে তবে সেই নির্দেশ পালিত না হওয়ার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে কি ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে; ২.সাইনবোর্ডে দোকানের নাম বাংলায় না লেখার জন্য কি শাস্তি দেয়া হবে ইত্যাদি।
এমনভাবে বাংলা ভাষা-আইন প্রণয়ন করতে হবে যাতে তা সহজে প্রয়োগযোগ্য হয়। কানাডার কুইবেক প্রদেশের মতো একটি উচ্চক্ষমতা ও কা-জ্ঞান সম্পন্ন (দ্বিতীয়টাই বেশি দরকার) ভাষা-কমিশন গঠন করে ভাষা-আইনের প্রয়োগ শুরু করা যেতে পারে। ভাষা কমিশনের অন্যতম কাজ হবে ভবিষ্যতে সমাজে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা। যেমন ধরুন, কম্পিউটার, মোবাইল ইত্যাদি যন্ত্রের প্রোগ্রাম, চলচ্চিত্র, ভিডিও গেম, কোনো পণ্যের বিবরণ/ব্যবহারবিধি ইত্যাদি ফরাসি বা জাপানি ভাষায় তর্জমা না হলে ফরাসি বা জাপানি বাজারে ঢুকতে পারে না। বাংলাদেশেও এ ব্যাপারটাকে আইনী ভিত্তি দেয়া যেতে পারে এবং এতে করে বহু সংখ্যক অনুবাদকের কর্মসংস্থান করাও সম্ভব হবে।
সঠিক ভাষানীতির সঙ্গে জাতির অর্থনৈতিক উন্নয়ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত, কারণ বিশেষ ভাষাজ্ঞান থাকা বা না থাকার উপর ব্যক্তি ও সমাজের অর্থনৈতিক উন্নতি নির্ভর করে। প্রস্তাবিত ভাষা আইনে এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে বাংলা ভাষার জ্ঞান নিয়েই বেশিরভাগ বাংলাভাষী দেশের যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করতে পারে। এটা অভূতপূর্ব কিছু নয়, বেশিরভাগ জাপানি বা ফরাসিভাষী অন্য কোনো ভাষা না জেনেও ফ্রান্স বা জাপানের ভৌগোলিক সীমারেখার ভিতরে (এমনকি এর বাইরেও) অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করতে পারে। জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে ভাষিক সুবিধা দেয়াই হচ্ছে ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র গঠন তথা কোনো মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা বা অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার অন্যতম উদ্দেশ্য।
যে কোনো ভাষা হচ্ছে একটি সম্পদ, একটি পণ্য। পৃথিবীব্যাপী প্রচুর চাহিদার কারণে ইংরেজি ভাষা নামক পণ্যটি বিক্রি করে বহু দিন ধরে টুপাইস কামাচ্ছে ইংল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শুধু টোফেল ও আই.ই.এল.টি.এস. পরীক্ষার ফি থেকেই বিপুল পরিমাণ ডলার/পাউন্ড প্রতি মাসে উন্নয়নশীল বিশ্বের গরীবগুর্বোর পকেট থেকে উন্নত বিশ্বের ইংরেজিওয়ালাদের পকেটে গিয়ে ঢুকছে। বাংলা ভাষা অবশ্যই ইংরেজির মতো চড়া দামে বিক্রি হবে না (এতে অবাক হবার কিছু নেই, ‘বাংলা’ কোনো কিছুই যেমন, বাংলা সাবান, বাংলা বাড়ি, বাংলা সন, বাংলা ভাই, বাংলা মদ… খুব একটা দাম পায় না!), কিন্তু বাঙালিরা নিজেরা যদি তাদের সম্পদ বা পণ্যের মূল্য নির্ধারণ না করে তবে তাদের প্রতিযোগীরা এসে সে কাজটা করে দেবে না নিশ্চয়ই।
দুই একটি উদাহরণ দেয়া যাক। চেক বা শ্লোভাক প্রজাতন্ত্রের ক্ষুদ্র বাজারে ঢুকতেও মাইক্রোসফট বাধ্য হয় তাদের উইন্ডোজ প্রোগ্রাম চেক বা শ্লোভাক ভাষায় অনুবাদ করতে, অথচ বাংলা অঞ্চলে চলে উইন্ডোজের ইংরেজি ভার্সন। এর মানে হচ্ছে, এই পণ্যটির বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে বাংলা অঞ্চলেই বাংলা ভাষা অর্থনৈতিকভাবে ইংরেজির কাছে পরাজিত হয়েছে। এই পরাজয় এড়াতে আমরা বাংলাভাষীরা কোনো ব্যবস্থাই নিইনি, না বাংলাদেশে, না পশ্চিমবঙ্গে। ভুলে গেলে চলবে না যে ভাষাভাষীর সংখ্যার বিচারে বাংলা পৃথিবীর পঞ্চম বা ষষ্ঠ ভাষা। কোটি কোটি জনসংখ্যা নিয়ে বাংলাভাষী অঞ্চল একটি সুবৃহৎ বাজার এবং এই বাজারের সুবিধা যেই নিতে আসুক তাকে বাংলাভাষা ব্যবহারে বাধ্য করতে হবে। এতে মাইক্রোসফটের লোকসান হবার কথা নয়, কারণ বাংলাভাষীদের ক্রয়ক্ষমতা কম হলেও চেক বা ডাচভাষীদের তুলনায় সংখ্যায় তারা বহু গুন বেশি। চেক প্রজাতন্ত্রের বাজারে যদি ২০০ ডলার মূল্যে কোনো প্রোগ্রাম এক লক্ষ কপি বিক্রি হয় দুই কোটি ডলারে তবে বাংলা অঞ্চলের বাজারে ২০ ডলার মূল্যে একই প্রোগ্রামের দশ লক্ষ কপি দুই কোটি ডলারে বিক্রি হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।
বাংলা ভাষায় শব্দঋণের ইতিহাস ও বাংলা ব্যাকরণের প্রবণতার কথা মাথায় রেখে আমাদের প্রস্তাবিত ভাষা কমিশনকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সরাসরি ঋণগ্রহণ ও ভাবানুবাদ ঋণ− এই দুইয়ের মধ্যে কোনটি অধিক বাস্তবসম্মত হবে। যদিও এটা ঠিক যে বাংলায় ভাবানুদিত শব্দগুলো খুব একটা চলেনি, সরাসরি ঋণকৃত শব্দগুলোই প্রচলিত হয়েছে (উদাহরণ, হাইড্রোজেন/উদজান, অফিসার/কর্মাধ্যক্ষ ইত্যাদি) তবুও নতুন বস্তু আসার সঙ্গে সঙ্গে যদি বাংলা ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব ও রূপতত্ত্বের নিয়ম মেনে সে সব বস্তুর জন্যে নতুন বাংলা নাম দেয়া যায় এবং বিজ্ঞাপন ইত্যাদিতে সেই সব নামের ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় তবে (রবীন্দ্রনাথের ভাষায়) ‘পা-কাটা নতুন জুতোর মতো’ ব্যবহার করতে করতেই এক সময় এসব নতুন, উটকো শব্দকে স্বাভাবিক বলে মনে হবে। ভাষা কমিশনকে সন্তান জন্মের সঙ্গে সঙ্গে নাম দিতে হবে, অর্থাৎ বাংলা নাম ছাড়া কোনো পণ্য যেন বাজারে না আসে। এর ফলে প্রমিত বাংলার শব্দকোষ বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে এবং (হয়তো) বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব ও রূপতত্ত্বের নিয়মগুলো সম্পর্কেও সাধারণ মানুষ সচেতন হয়ে উঠবে। উল্লেখ্য যে ফরাসি ভাষায় ‘কমপিউটার’, ‘মোবাইল’ ইত্যাদি পণ্যের জন্যে আলাদা ফরাসি শব্দ সৃষ্টি করা হয়েছিল এই পণ্যগুলো বাজারে প্রবেশের প্রায় সাথে সাথেই। সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা মিডিয়ায় এ শব্দগুলো ব্যবহার করা শুরু করেছিলেন এবং কালক্রমে শব্দগুলো চালু হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশেও এটা করা যেতে পারতো।
বাংলা ভাষাকে যারা অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চান তারা আপাতত নিচের চার দফা কর্মসূচি নিয়ে এগোতে পারেন। কানাডার কুইবেক প্রদেশের পার্লামেন্টে ১৯৭৪ পাস হওয়া ফরাসি ভাষা আইন ১০১ এর আলোকে এই চার দফা রচিত হয়েছে (অন্ত্যটীকা দ্রষ্টব্য):
১. যে কোনো পণ্য বা সেবার বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে;
২. সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মাধ্যম হবে শুধুই প্রমিত বাংলা। তবে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই ইংরেজি (এবং সম্ভব হলে আরবি, চীনা, জার্মান, ফরাসি ইত্যাদি ভাষা) শেখানোর ব্যবস্থা থাকবে (এর ফলে বিদেশমুখী জনগণের ভাষাপ্রশিক্ষণ ও ভাষাশিক্ষকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে);
৩. ১৯৮৭ সালের বাংলা প্রচলন আইন কার্যকর করতে হবে। যাবতীয় অফিস ও আদালতের কাজের ভাষা হবে বাধ্যতামূলকভাবে প্রমিত বাংলা। কোনো অফিস বা আদালতে বাংলা ভাষায় সেবা পাওয়ার অধিকার যে কেউ দাবি করতে পারবে;
৪. অর্থনৈতিক সুবিধার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে সর্বস্তরে বাংলাভাষা প্রচলনের দাবির সপক্ষে জনমত গঠন করতে হবে।
উপরের চার দফা কর্মসূচী ঠিকঠাকমতো বাস্তবায়িত করতে পারলেই বাংলাভাষার অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা অর্জনের কাজ অনেকটাই এগিয়ে যাবে। তবে বাংলা ভাষা আইন প্রণেতা ও এর প্রয়োগকারীদের আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পরিম-লে ইংরেজির অপরিহার্যতার কথা ভুলে গেলে চলবে না। তাদের মনে রাখতে হবে যে ইংরেজি বা পৃথিবীর যে অন্য কোনো ভাষার সাথে বাংলার অবশ্যই কমবেশি প্রতিযোগিতা আছে, কিন্তু কোনো বিরোধ নেই। বাঙালি জাতি ও বাংলাভাষার অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই প্রমিত বাংলা ও প্রমিত ইংরেজি− অন্তত এই দুটি উপভাষা বেশির ভাগ বাংলাভাষীকে যথাসম্ভব ভালোভাবে শিখতে হবে।
প্রস্তাবিত ভাষা আইনের অন্যতম লক্ষ্য হবে ইংরেজিসহ অন্য যে কোনো ভাষার সাথে প্রতিযোগিতায় বাংলা ভাষার (অর্থাৎ বাংলাভাষীদের) অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষা করা। ভাষা আইন প্রণয়নের সময় এ কথাটাও মাথায় রাখতে হবে যে জনগণের সদিচ্ছা ছাড়া শুধু আইন করে কোনো কাজ হবে না। পৃথিবীতে অন্তত দু’টি দেশে ভাষা-আইন করেও মুখের ভাষাকে দেশের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সরকারি প্রচেষ্টা সফল হয়নি শুধুমাত্র জনগণের সদিচ্ছার অভাবে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে আয়ারল্যান্ডের ভাষা ‘গায়েলিক’ আর অন্যটি হচ্ছে পেরুর ভাষা ‘কেচুয়া’। অন্যদিকে ইসরায়েলে মৃত ভাষা হিব্রুকে কমবেশি পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ও সামাজিক সদিচ্ছার কারণে। কানাডার কুইবেকে ভাষা আইন প্রণয়ণ করে মাত্র ত্রিশ বৎসর কাল সেই আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করার মাধ্যমে ফরাসি ভাষাকে কানডার অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়েছে।
৯. উপসংহার
আমরা উপরে দেখিয়েছি, ভাষাদূষণের ধারণা মূলত একটি কুসংস্কার। শব্দমিশ্রণ ভাষার দূষণ নয়, বরং সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ। একাধিক ভঙ্গীতে বাংলাও বলা কোনো দূষণ হতে পারে না, কারণ ভাষায় উচ্চারণ-বৈচিত্র্য থাকাটাই স্বাভাবিক। এর প্রমাণ, বাংলাভাষী অঞ্চলে প্রমিত উচ্চারণও এক নয়, একাধিক। সব মিলিয়ে বাংলা ভাষা কোনো প্রকার অসুখে ভুগছে না। বাংলা ভাষার স্বাস্থ্য আপাতত চমৎকার।
ইংরেজি শব্দ মিশ্রণ বা ইংরেজি ঢঙে বাংলা বলা যদি দূষণের প্রমাণ হয়, তবে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শিক্ষানীতিই সেই দূষণের জন্যে দায়ী। তরুণ প্রজন্ম যদি ইংরেজিতে শিক্ষাগ্রহণ করে তবে ইংরেজি তার চিন্তার ভাষায় পরিণত হয় এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে ইংরেজি শব্দ চলে আসে তাদের ব্যবহৃত বাংলায়। এটি খুবই স্বাভাবিক একটি প্রবণতা। ইংরেজিকে যদি তরুণ প্রজন্মের প্রথম ভাষায় পরিণত করা হয় তবে ইংরেজি ধ্বনিতত্বের প্রভাবে তারা ট্যাঁশ বা দোআঁশলা বাংলা বলবেÑ এটাও অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা প্রবণতা। এই উচ্চারণ যদি কর্তৃপক্ষের না-পছন্দ হয় তবে বাংলা ভাষাকে শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম করে তুলতে হবে। ইংরেজিকে বিদেশি ভাষা হিসেবে শেখাতে হবে।
প্রমিত বাংলার আপাত সুস্বাস্থ্য এর দীর্ঘ জীবনের গ্যারান্টি নয়। আজ হোক, কাল হোক, প্রমিত বাংলা উপভাষাটির মৃত্যু হবে। তবে একে দীর্ঘজীবী করতে হলে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণকে দুটি কাজ করতে হবে: ১. এই উপভাষার ব্যবহার বাড়াতে হবে এবং ২. এ উপভাষার ব্যবহারকে লাভজনক ও বাধ্যতামূলক করে তুলতে হবে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের সাথে এর অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার সম্পর্ক আছে, এই উভয়ের সাথে সম্পর্ক আছে প্রমিত বাংলার দীর্ঘজীবীতার। প্রমিত বাংলা ভাষার অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা আর বাংলাভাষীর অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সুতরাং, সাধু সাবধান এবং শুভস্য শীঘ্রম!
টীকা: কুইবেক প্রদেশের ফরাসি ভাষা আইন:
কুইবেক ফরাসি ভাষা আইনে একটি রাষ্ট্রীয় ভাষা কমিশনের কথা বলা হয়েছে। এই কমিশনের প্রধানের নাম ‘লেফটেন্যান্ট জেনারেল’ এবং তিনি কানাডার গর্ভর্ণর জেনারেল (রাষ্ট্রপতির সমপর্যায়ের) কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন। এ ছাড়া ভাষা কমিশনে অন্যান্য আরও সদস্য রয়েছেন এবং কমিশনের একটি বড়সড় কর্মিবাহিনীও আছে। ভাষা কমিশন বা এর সদস্যরা এক গভর্নর জেনারেল ছাড়া আর কারও কাছে তাঁদের কাজের জন্যে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়, এমনকি কুইবেক প্রাদেশিক সরকারের কাছেও নয়। নিচে এই আইনের কযেকটি ধারার বাংলা অনুবাদ দেয়া হলো।
ক. ফরাসি ভাষা জাতীয় ঐতিহ্য এবং একে রক্ষা করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। এ ভাষাকে প্রাধান্য দেয়া, এর বিকাশ ও মান রক্ষার জন্যে যা যা করা দরকার তা করতে কুইবেক সরকার বাধ্য। ফরাসি ভাষা কুইবেকের প্রশাসনিক ভাষা। প্রশাসনিক কাজকর্মে অবশ্যই ফরাসি ভাষা ব্যবহৃত হতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও এর যাবতীয় কর্মকর্তা জনগণ অন্যান্য কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগের কাজে ফরাসি ভাষা ব্যবহার করবেন। সব ধরনের সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হবে ফরাসি। যাবতীয় সরকারি ও প্রশাসনিক নথিপত্র ফরাসি ভাষায় লিখিত হতে হবে। প্রয়োজনে সাথে ইংরেজি অনুবাদ থাকতে পারে কিন্তু আইনে উল্লেখিত ব্যতিক্রমধর্মী কিছু ক্ষেত্র ছাড়া সাধারণভাবে ফরাসি ভাষায় লিখিত নথিই মূল নথি বলে গণ্য হবে। যেসব পৌরসভা ও শিক্ষায়তনে বেশির ভাগ কর্মচারী ইংরেজিভাষী সেখানে ফরাসি ও ইংরেজি উভয় ভাষা আভ্যন্তরীণ যোগাযোগের ভাষা হিসেবে গণ্য হবে।
খ. ফরাসি ভাষার জ্ঞান নেই এমন কেউ গণপ্রশাসনে নিযুক্ত হতে পারবেন না, অন্য পদে বদলি হবেন না বা পদোন্নতিও পাবেন না। ফরাসি ভাষায় এই জ্ঞান গভর্ণর জেনারেল কর্র্তৃক নির্ধারিত মানসম্মত হতে হবে। উপরোক্ত মানসম্মত ফরাসি ভাষা বলতে পারেন না এমন ব্যক্তিকে কোনো প্রকার লাইসেন্স দেওয়ার অধিকার কোন সংস্থার নেই। তবে প্রয়োজন হলে ফরাসি না জানা ব্যক্তিকে অনুর্ধ এক বছরের জন্যে লাইসেন্স দেয়া যেতে পারে কিন্তু এই লাইসেন্স নবায়ন করতে গভর্ণর জেনারেলের অনুমতি লাগবে।
গ. যাবতীয় চুক্তিপত্রের ভাষা হবে ফরাসি। তবে বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের সাথে করা চুক্তিগুলো ফরাসি ও সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষায় রচিত হতে পারে। জনপ্রশাসন ও যাবতীয় পেশামূলক সংস্থা (কর্পোরেশন) ফরাসি ভাষায় তাদের সর্বপ্রকার সেবা প্রদানের জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। যাবতীয় প্রচার-পুস্তিকা, বিজ্ঞাপন ও বিজ্ঞপ্তির ভাষা হবে ফরাসি, তবে সাথে ইংরেজি অনুবাদ থাকতে পারে। আদালতের অন্যতম ভাষা হবে ফরাসি। যদি কোনো মামলার রায় একান্তই ইংরেজিতে দেয়া হয় তবে আইন মন্ত্রণালয়কে সেই রায় ফরাসিতে অনুবাদের ব্যবস্থা করতে হবে। কুইবেকের কোনো আইনের ব্যাখ্যায় ফরাসি ও ইংরেজি বয়ানে গড়মিল দেখা দিলে ফরাসি বয়ান প্রাধান্য পাবে।
ঘ. কাজের জগতের ভাষা হবে ফরাসি। মালিকেরা তাদের কর্মচারীদের সাথে যাবতীয় যোগাযোগ ফরাসি ভাষায় করবেন। যাবতীয় কাগজপত্র (ডকুমেন্ট) ফরাসি ভাষায় লেখা হবে। অবশ্য কর্মচারীদের একাংশ যদি ইংরেজিভাষী হয় তবে সাথে ইংরেজি অনুবাদ থাকতে পারে। যেসব প্রতিষ্ঠানে ফরাসিভাষী কর্মচারীর সংখ্যা কম সেসব প্রতিষ্ঠানকে তাদের কর্মচারীদের ফরাসি ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে লেফটেন্যান্ট জেনারেলের পক্ষ থেকে এমন একটি সনদপত্র দেয়া হবে যাতে লেখা থাকবে সেই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের ফরাসি জ্ঞান কেমন, প্রতিষ্ঠানে ফরাসি ভাষার উপস্থিতি কতটা, বিভিন্ন নথিপত্র, প্রচার-পুস্তিকা, বিলবই, রসিদবই ইত্যাদিতে ফরাসি ভাষা কি পরিমাণ ব্যবহৃত হচ্ছে ইত্যাদি। কর্তৃপক্ষ যে কোনো সময় যে কোনো প্রতিষ্ঠানে গিয়ে এই সনদ আছে কিনা যাচাই করে দেখতে পারেন। যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের এই সনদ নেই তারা কোনো রকম সরকারি সহায়তা, ভর্তুকি বা আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যত রকম সুযোগ-সুবিধা পাবার কথা তার কিছুই পাবেন না।
ঙ. ব্যবসা জগতের ভাষাও হবে ফরাসি। ব্যবসায়-প্রশাসন, ব্যবসায়ের নাম, সাইনবোর্ড, ব্যবসায়ের যাবতীয় চুক্তিপত্রে ফরাসি ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক। কোনো ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের নাম যদি ফরাসিতে লেখা না হয় তবে প্রতিষ্ঠানটিকে লাইসেন্স দেয়া হবে না। অন্য কোনো আইনের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ না হলে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের নাম যে কোনো ভাষায় রাখা যেতে পারে, তবে নামটি অবশ্যই ফরাসি ভাষায় এবং ফরাসি/রোমান হরফে লেখা থাকতে হবে। চুক্তিপত্র, বিভিন্ন দলিল-রসিদ বা সাইনবোর্ডে ফরাসি নামটি দৃশ্যমান হতে হবে অথবা কোনোমতেই ইংরেজিতে (বা অন্য কোন ভাষায়) লেখা নামের তুলনায় কম দৃশ্যমান হওয়া চলবে না। পণ্যের উপরে লাগানো যাবতীয় লেবেল ফরাসি ভাষায় লেখা হতে হবে। যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান ৩১শে জুলাই ১৯৭৪ তারিখের পূর্বে তাদের নিয়ন সাইনবোর্ড লাগিয়েছেন তাদেরকে পাঁচ বৎসরের মধ্যে এই সাইনবোর্ড ভাষা আইন ১০১ অনুসারে বদলে নিতে হবে।
চ. শিক্ষা কমিশন কর্তৃক পরিচালিত যাবতীয় শিক্ষায়তনে ফরাসি ভাষায় পাঠদান করতে হবে। এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা ফরাসি ভাষায় শিক্ষা গ্রহণের জন্যে উপযুক্ত ফরাসি-জ্ঞানের অধিকারী হয়। কোনো বিদ্যালয়েই পূর্ব অনুমতি ছাড়া ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাদান শুরু করা যাবে না বা ইংরেজিতে শিক্ষাদানের সময় বাড়ানো বা কমানো যাবে না। যেসব বিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষায় পাঠ দান করা হয় সেসব বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা ফরাসি লিখতে, পড়তে ও বলতে পারেন। তবে আদিবাসী ইন্ডিয়ান ও ইনুইটদের তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান করা যাবে।
ছ. এই সব আইন অমান্যকারীকে ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রথম অপরাধের জন্যে কমপক্ষে ২৫ ডলার ও সর্বোচ্চ ৫০০ ডলার এবং প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫০ ডলার ও সর্বোচ্চ ১০০০ ডলার জরিমানার বিধান রাখা হলো। পরবর্তি দুই বৎসরের মধ্যে একই অপরাধের জন্যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩০০০ ডলার ও প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৫০০০ ডলার জরিমানার বিধান রাখা হলো।
উপরের তর্জমায় ‘কুইবেক’ শব্দের জায়গায় ‘বাংলাদেশ’ এবং ‘ফরাসি’ শব্দের জায়গায় ‘বাংলা’ বসিয়ে নিলে ও অন্যান্য ছোটখাটো পরিবর্তন-পরিবর্ধন করলে বাংলাদেশের জন্যে একটি খসড়া ভাষা আইন তৈরি হয়ে যাবে।
Propecia
Alli In Stock Uk
ivermectin tractor supply
cialis and cocane
Gogetpills
Levitra En La Farmacia buy cialis online using paypal
Cialis Con Priligy
খুব ভালো লাগলো পড়ে। আমি পশ্চিমবঙ্গে থাকি, আমাদের এখানেও এভাবে কাজ করতে হবে।
plaquenil corona
Amoxicillin Chewables
online generic cialis
Prix Cialis Pharmacie Quebec
Youngblood, Dawn Stewart, Carol J will propecia work on hairline