লেখক: মোহাম্মদ আজম; পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৫১২, প্রকাশক: আদর্শ; মূল্য: ৮০০ টাকা।
বইটি ‘উপনিবেশ আমলে লেখ্য-বাংলার রূপ ও রূপান্তরের প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষাচিন্তা’ শীর্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পি.এইচ.ডি অভিসন্ধর্ভের মুদ্রিত রূপ। ৮টি অধ্যায় আছে এই বইয়ে। প্রথম অধ্যায় হচ্ছে ভূমিকা। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আছে বাংলায় ব্রিটিশ উপনিবেশায়নের প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা। তৃতীয় অধ্যায়ের বিষয়বস্তু বাংলা ভাষার বিবর্তনের উপর উপরোক্ত উপনিবেশায়নের প্রভাব। চতুর্থ অধ্যায়ে উনিশ শতকে বাংলা গদ্য ও বাংলা ভাষাচর্চার একাধিক ধারার বর্ণনা আছে। বাংলা ভাষা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা আসলে কী ছিল সেটা বলা হয়েছে পঞ্চম অধ্যায়ে। বাংলা ভাষা বর্ণনার সূত্র ও প্রণালি-পদ্ধতি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মতামত ষষ্ঠ অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয়। সপ্তম অধ্যায়ে স্থান পেয়েছে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, বানান ইত্যাদি সম্পর্কে শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রমূখ তথাকথিত ‘নব্য ব্যাকরণবিদ’ এবং রবীন্দ্রনাথের মতামত। অষ্টম অধ্যায়ে বাংলা ভাষা, বানান ও ব্যাকরণসংক্রান্ত একাধিক বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মতামতের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
‘What you think or believe does not matter, what really matters, is the matter of the fact and the fact of the matter’ (শিশির ভট্টাচার্য্য, কথাকলি, ২০১৩: ১৩৬)
‘উপনিবেশায়ন’ বলতে কী বোঝায়? মোহাম্মদ বলেছেন (পৃষ্ঠা:১৬):
‘উপনিবেশ হলো দখলকৃত ভূমি ও সম্পদ। দখলে আনা ভূমি, সম্পদ ও জনগোষ্ঠীর উপর সার্বিক আধিপত্য বিস্তারের প্রক্রিয়াই উপনিবেশায়ন।’ (পৃষ্ঠা:১৫) ইংরেজদের আগে আর্য্য-তুর্ক-পাঠান-মোগল বাংলা অঞ্চলের দখল নিয়েছে বটে, কিন্তু ইংরেজের উপনিবেশ ছিল একেবারেই ভিন্নরকম একটি সমাজ-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তি ‘কেবল সম্পদ আর পণ্য লুটে নেয়নি, উপনিবেশিত রাষ্ট্রের পুরো অর্থনৈতিক সম্পর্ককেও বদলে দিয়েছে। দাস ও চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক আর কাঁচামাল গেছে কেন্দ্রে, উপনিবেশগুলো হয়ে উঠেছে উপনিবেশের এক একটি বাজার…কেন্দ্রই হয়েছে মুনাফার ভাগিদার।’
লেখক তাঁর পুস্তকে রেফারেন্স দেবার ক্ষেত্রে যে রীতি অনুসরণ করেছেন তাতে তাঁকে ‘আজম’ না বলে ‘মোহাম্মদ’ নামে ডাকতে হয়। বাংলায় লিখেছেন এমন লেখকদের পারিবারিক নাম ব্যবহার না করে নামের পূর্বাংশ ব্যবহার করেছেন তিনি: ‘চট্টোপাধ্যায়’ নয়, ‘বঙ্কিম’; ‘ঠাকুর’ নয়, ‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘দেবেন্দ্রনাথ’ ইত্যাদি। ইংরেজিতে লিখেছেন এমন লেখকদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন পারিবারিক নাম: David নয়, Arnold; ‘আশীষ’ নয়, ‘নন্দী’; ‘কাজী আবদুল’ নয়, ‘মান্নান’ ইত্যাদি। যাই হোক, ‘সুজনে সুজশ গায় কুযশ ঢাকিয়া!’ লেখককে আমরা ‘আজম’ নামেই ডাকবো, ঔপনিবেশিকতার কাছে মাথা আভূমি নত হয়ে যাবার ঝুঁকি নিয়েই না হয় ডাকবো।
আজমের গবেষণার মূল বিষয়বস্তু অবশ্য উপনিবেশায়ন নয়, ভাষার উপনিবেশায়ন। তিনি বলেছেন, উপনিবেশায়নের ফলে ভাষার ক্ষেত্রে তিন ধরনের পরিবর্তন ঘটে থাকে:
১. স্থানীয় ভাষা ব্যবহারিক জগৎ থেকে সম্পূর্ণ নির্বাসিত হয়ে যায়;
২. বিদ্যমান ভাষাকাঠামোর আমূল পরিবতন ঘটে;
৩. উপনিবেশিতের ভাষাকে হটিয়ে দিয়ে তার স্থান দখল করে উপনিবেশকের ভাষা।
বাংলার ক্ষেত্রে কী হয়েছে? আজমের মতে:
১.বাংলার ভাষাকাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে। বাংলা গদ্যের রূপ বদলে গেছে। হঠাৎ করে বাংলা গদ্যে অপ্রয়োজনে, জোর করে প্রচূর সংস্কৃত শব্দ আমদানি করা হয়েছে। সংস্কৃত শব্দমুক্ত এবং আরবি-ফারসি শব্দযুক্ত প্রচলিত, সর্বসাধারণবোধ্য সরল গদ্যরীতিকে গ্রহণ না করে একটি কৃত্রিম রীতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। আজমের দাবি, ঔপনিবেশিক প্রভুর ইঙ্গিতে সংস্কৃত প-িতেরা এই অপকর্মটি করেছেন। এটি অপকর্ম, কারণ এর ফলে বাংলা গদ্য তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ও গতি হারিয়ে ফেলেছিল এবং জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
২. অবশেষে বাংলাকে হটিয়ে দিয়ে তার স্থান দখল করেছিল ইংরেজি।
অষ্টাদশ শতক থেকে শুরু হয়ে ও ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত বাংলা ভাষার উপনিবেশায়ন চলেছে। ঊনবিংশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে বাংলা গদ্যের উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ার বিরোধিতার প্রক্রিয়ার শুরু। আজমের মতে, বিরোধিতাকারীদের মধ্যে প্রধানতম ব্যক্তি হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮৮৫ থেকে শুরু করে ১৯৪১ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বিভিন্ন রচনায় তিনি বাংলা ভাষার উপনিবেশায়নের বিরোধিতা করেছেন। কী ছিল তাঁর দাবি?
১. উচ্চশিক্ষা থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত হোক,
২. বাংলা ব্যাকরণকে সংস্কৃতের প্রভাবমুক্ত হোক,
৩. প্রকৃত (বা প্রাকৃত) বাংলা ব্যাকরণ রচিত হোক এবং
৪. বাংলা বানান বাংলা ভাষার উচ্চারনানুগ হোক।
এবার আমরা আজমের দাবিগুলো বিশ্লেষণ করে দেখবো। কাকে বলে ‘বাংলা ভাষা’? মান/চলিত বাংলা, নাকি বাংলা অঞ্চলে ব্যবহৃত সবগুলো উপভাষার সমষ্ঠি? আজমের গবেষণার বিষয়বস্তু কি বাংলা ভাষার উপনিবেশায়ন, নাকি নিছকই বাংলা গদ্যরীতির উপনিবেশায়ন? আজম বলেছেন (পৃষ্ঠা ৩০) ‘ঔপনিবেশিক শাসনের প্রত্যক্ষতায় গড়ে ওঠা বাস্তবতা বাংলাভাষা, বিশেষত বাংলা গদ্যের, পরিবর্তিত রূপের গড়ন ও চর্চার ধরনে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্টা করেছে’ তার বিশ্লেষণ করেছেন তিনি আলোচ্য গ্রন্থে। আজম জানিয়েছেন, লিখনরীতি তাঁর অভিসন্ধর্ভের বিষয়বস্তু নয়। সাহিত্য-বহির্ভূত রচনার ভাষা, শিক্ষা ও অফিস-আদালতে নিত্য-ব্যবহার্য ভাষা লিখিত আকারে যেভাবে গঠিত ও ব্যবহৃত হয়, তাই মূল বিবেচ্য। অর্থাৎ ‘মান বা প্রমিত বাংলা থেকে লেখ্য বাংলাকে আলাদা ধরা হয়নি এই অভিসন্ধর্ভে।
আমাদের আপত্তি: কথ্য মান বাংলা আর লেখ্য বাংলা দুটি আলাদা ‘উপভাষা’। এ দুটিকে এক করে দেখাটা ভাষাতত্ত্ব অনুমোদন করে না। অনুমোদন না করার পেছনে যথেষ্ট যুক্তি ও কারণ রয়েছে এবং সেই কারণ আর যুক্তিগুলো এতই সুপ্রতিষ্ঠিত যে ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় সেগুলোর উল্লেখ করাটা পর্যন্ত বাহুল্যের পর্যায়ে পড়ে।
উপনিবেশায়ন যে হয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলা ভাষার যে পরিবর্তনের কথা আজম বলছেন, তা কি আদৌ ঘটেছিল? যদি ঘটে থাকে, তবে তার জন্যে কি উপনিবেশায়ন দায়ী? স্মরণ করা যেতে পারে যে, ইংরেজি ভাষায় যখন প্রথম গদ্যসাহিত্য রচিত হয় তখন সেই গদ্য ছিল ফরাসি ও ল্যাটিন শব্দবহুল। ফরাসি ভাষায় যখন যখন প্রথম গদ্যসাহিত্য রচিত হয় সে সাহিত্য ছিল ল্যাটিন শব্দবহুল। ল্যাটিন ভাষায় যখন গদ্যসাহিত্য রচিত হয় তখন সে সাহিত্যে প্রচুর গ্রীক শব্দ ছিল। এর কারণ কি? ইংরেজি ভাষার কথাই ধরা যাক।
১. প্রথম দিকের ইংরেজি সাহিত্য যারা রচনা করতেন তারা ফরাসি ভাষায় সুপ-িত ছিলেন;
২. ইংরেজি ভাষায় গদ্য রচনার কোনো মডেল তাদের সামনে ছিল না, বা থাকলেও সে মডেলকে তারা গ্রহণযোগ্য মনে করতেন না, বা সে মডেলের উপর তাদের কোনোপ্রকার দখল ছিল না। যেসব ‘উচ্চভাব’ তাঁরা ইংরেজি ভাষায় প্রকাশ করতে চাইতেন তার উপযুক্ত শব্দ ইংরেজি ভাষায় ছিল না। পদে পদে তাদের ফরাসির দ্বারস্থ হতে হতো;
৩. তাঁদের পাঠকেরা যথেষ্ট পরিমাণে ফরাসি ভাষা জানতেন। সুতরাং ফরাসি-ইংরেজি পড়ফব-সরীরহম করলে কোনো সমস্যা হতো না;
৪. এই সব লেখকদের মধ্যে যাঁরা ল্যাটিনে প-িত ছিলেন, অর্থাৎ যাঁরা ত্রিভাষি ছিলেন, তারা আবার ইতিমধ্যে চালু হওয়া ফরাসি doute, dette ইত্যাদি ‘তৎসম’ শব্দের বানানকে ল্যাটিন বানানরীতি অনুসরণ করে ‘শুদ্ধ করে’ লিখেছিলেন: doubt, debt। উচ্চারণ নয়, শব্দের ব্যুৎপত্তি বা ইতিহাসের দিকেই তাদের নজর ছিল।
অনরূপ ঘটনা পৃথিবীর সর্বত্র ঘটেছে, যুগে যুগে, ঔপনিবেশিকতার উপস্থিতিতে বা অনুপস্থিতিতে। সব পরিস্থিতিতেই যদি দুয়ে দুয়ে চার হয়, তবে কোনো বিশেষ পরিস্থিতি নিশ্চয়ই সেই যোগফলের নিয়ামক নয়। দ্বিভাষী/ত্রিভাষী ব্যক্তিদের মাধ্যমে এক ভাষার শব্দ অন্য ভাষায় প্রবেশ করে। দ্বিভাষী ব্যক্তিদের শ্রোতারাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দ্বিভাষী হয়ে থাকেন। কেউ যখন বলে: আমি ফড়ঁনঃ ভববষ করছি, সে নিশ্চিত যে তার শ্রোতা ফড়ঁনঃ ও ভববষ এই দুই ইংরেজি শব্দের অর্থ জানে। যে ইংরেজি মিশিয়ে বাংলা বলছে সে সচেতনভাবে কাজটা করছে না, বাধ্য হয়ে করছে, অসচেতনভাবে। লেখার ক্ষেত্রেও এমনটা হয়ে থাকে। এমন একটা সময় ছিল যখন রুশ ভদ্রলোকেরা রুশ ভাষাকে চাকরবাকরের ভাষা মনে করতেন। তাঁরা লিখতেন ফরাসি ভাষায়। যদিওবা কখনও রুশ ভাষায় লিখতে বাধ্য হতেন, তাদের রচনায় প্রচুর ফরাসি শব্দ থাকতো।
সুতরাং বাংলায় যখন গদ্যসাহিত্য রচিত হয় তখন তাতে প্রচুর পরিমাণে সংস্কৃত শব্দইতো থাকারই কথা। প-িতেরা কমবেশি সংস্কৃত জানতেন। যে প-িতেরা ‘পরীক্ষা’ শব্দটি ব্যবহার করে অভ্যস্ত, তাঁরা ‘ইমতেহান’ ব্যবহার করবেন কেন? তখনকার দিনের শিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রেই টোলে/স্কুলে অল্পবিস্তর সংস্কৃত শিখে আসতেন। এরাই ছিল নতুন গদ্যের পাঠক। শ্রোতা সংস্কৃত শব্দ বুঝবে জেনেই প-িতেরা সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করতেন, হয়ত বাধ্য হয়েই করতেন, কারণ তাঁরা সংস্কৃতই শুধু জানতেন।
তবে প-িতদের লেখা সব গদ্য সংস্কৃত শব্দবহুল ছিল না। সংস্কৃত শব্দবিরল গদ্যও তাঁরা লিখতেন। উদাহরণের অভাব নেই।
‘…কেনেডি সাহেবের নিকটে দুই বৎসর হইল হাজির আছি ২৫ নবম্বর শনিবার নিরপরাধে আমাকে অনেক ঘুষা ও থাবড়া এমন মারিয়াছেন যে আমি দুই দিবস শয্যাগত ছিলাম…’ (১৮১০ সালের ২৮শে নভেম্বর তারিখে লিখিত প-িত আনন্দচন্দ্র শর্মার দরখাস্ত)
‘… সম্প্রতি শুনিলাম সাহেবান কালেজ কৌশল আমার প্রতি নিগ্রহ করিয়া আমাকে কালেজের বাহির করিতে চাহেন অতএব ধর্ম্মাবতারদের নিকট নিবেদন এইক্ষণে আমার বয়স ৫৭ বৎসর হইল আর কোনই কর্ম্ম করিবার ক্ষমতা নাই ধনোপার্জ্জনের যে বয়স তাহা এই কালেজে যাপন করিয়াছি ধনসঞ্চয় কিছু করিতে পারি নাই এক্ষণে আমাকে কালেজের বাহির করিলে আমি এবং আমার স্ত্রী-পুত্রাদি পরিজনলোক সকলে অন্নাভাবে মরিব…‘ (১৮২২ সালের ২রা সেপ্টেম্বর তারিখে রামকুমার শিরোমণি কর্তৃক লিখিত পত্র)
কিন্তু প্রতিবেশ অনুসারে সংস্কৃত শব্দ ব্যবহৃত হতো বইকি:
…দেখিলেন ঐ সরোবরের নির্মল সলিলে হংসবক চক্রবাক সারস প্রভৃতি নানাবিধ জলচর কেলি করিতেছে; মধুকরেরা, অন্ধ হইয়া গুন ২ ধ্বনি করত, ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতেছে; তীরস্থিত তরুগণ অভিনব পল্লব, ফল, কুসুমসমূহে সুশোভিত রহিয়াছে;… (১৮৪৭ সালে প্রকাশিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’)
‘কাপালিক কহিলো, ‘তিষ্ঠ’।…পরিশেষে কাপালিক গত্রোত্থান করিয়া নবকুমারকে পূর্ববৎ সংস্কৃতে কহিলেন, ‘মামনুসর।’
ইহা নিশ্চিত বলা যাইতে পারে যে অন্য সময়ে নবকুমার কদাপি ইহার সঙ্গী হইতেন না। কিন্তু এক্ষণে ক্ষুধাতৃষ্ণায় প্রাণ ওষ্ঠাগত। অতএব কহিলেন, ‘প্রভুর যেমন আজ্ঞা। কিন্তু আমি ক্ষুধাতৃষ্ণায় বড় কাতর। কোথায় গেলে আহার্য সামগ্রী পাইব অনুমতি করুন।’ (বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকু-লা’)
অথচ সেই বঙ্কিমই লিখেছেন:
…জনসন বলিল, ‘অপেক্ষা কেন, লাথি মার, ভারতবর্ষীয় কবাট ইংরেজি লাথিতে টিকিবে না।…
পরে জনসন লাথি মারিল। কবাট ভাঙিয়া পড়িয়া গেলো।
‘এইরূপে ব্রিটিশ পদাঘাতে সকল ভারতবর্ষ ভাঙ্গিয়া পড়–ক।’ বলিয়া ইংরেজেরা গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সিপাহিগণ প্রবেশ করিল।’ (আলস্যের কারণে উদ্ধৃতি রেফারেন্সবিহীন রাখিলাম। রাত্রি গভীরা। নিদ্রাদেবী হস্তপ্রসারণ করিয়া মৎমস্তক ক্রোড়ে উত্তোলনে ‘উন্মুখা’। হে পাঠক! বঙ্কিম রচনাবলী খুলিয়া পৃষ্ঠাসংখ্যা দেখিয়া লইতে আজ্ঞা হয়!)
‘তুমি বসন্তের কোকিল, বেশ লোক। যখন ফুল ফুটে, দক্ষিণ বাতাস বহে, এ সংসার তোমার সুখের স্পর্শে শিহরিয়া উঠে, তখন তুমি আসিয়া রসিকতা আরম্ভ কর। আর যখন দারুন শীতে জীবলোকে থরহরি কম্প লাগে, তখন কোথায় থাক, বাপু? যখন শ্রাবণের ধারায় আমার চালাঘরে নদী বহে, যখন বৃষ্টির চোটে কাক চিল ভিজিয়া গোমায় হয়, তখন তোমার মাজা মাজা কালো কালো দুলালি ধরণের শরীরখানি কোথায় থাকে? তুমি বসন্তের কোকিল, শীত বর্ষার কেহ নও।’ (কমলাকান্তের দপ্তর, ১৮৭৫)
‘শর্মিষ্ঠা আমাকে কূপে নিক্ষেপ করলে পর আমি অনেকক্ষণ পর্যন্ত অজ্ঞানাবস্থায় পতিত ছিলেম, পরে কিঞ্চিৎ চেতন পেয়ে দেখলেম যে, চতুর্দিক কেবল অন্ধকারময়।’ (‘শর্মিষ্ঠা’, মাইকেল মধুসূদন দত্ত)
‘চৈতন। নব আর কালী যে আজ দেরী র্কছে, এর কারণ কি?
বলাই। আমি তা কেমন করে বল্বো? ওহে, ওদের কথা ছেড়ে দেও, ওরা সকল কর্মেই লীড নিতে চায়, আর ভাবে, আমরা না হলে বুঝি আর কোন কর্মই হবে না।’ (‘একেই কি বলে সভ্যতা’, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ১৮৬০)
‘বাপু, দেশ ছেড়ে যাওয়া কি মুখের কথা? আমার এখানে সাত পুরুষ বাস। স্বর্গীয় কর্তারা যে জমাজমি করে গিয়াছেন তাহাতে কখন পরের চাকরি স্বীকার করিতে হয়নি।’ (‘নীলদর্পণ’ দীনবন্ধু মিত্র, ১৮৬০)
আরবি-ফার্সি শব্দবহুল অন্য যে গদ্যরীতিটি প-িতেরা অনুসরণ করেননি তার উদাহরণ:
‘খামীন্দের নামদরম্যান থাকীতে কোন পরয়া নাই মাল ইঙ্গরেজের নহে এই ধোকাতে খরিদার বন্ধ করিয়াছে ইহ ধমকে আমী ডরাই না সাহেবেলোকের ছায়া আমার সিরপর থাকীতে কোন চীন্তা নাই মুরসীদাবাদের লিখন আইল মাল খালাষ হইবেক ইহা নিবেদন করিলাম ইতি…’ (১৭২৭ সালের একটি পত্রের অংশবিশেষ)
Facts of the matter বলছে, আলালী (আলালের ঘরের দুলাল), হুতোমী (হুতোম প্যাঁচার নকশা), আরবি-ফার্সি শব্দবহুল ‘মুসলমানী’ সংস্কৃত শব্দবহুল ‘প-িতি’ রীতি ছাড়াও অন্য গদ্যরীতি সাহিত্যে ব্যবহৃত হচ্ছিল। সংস্কৃতবহুলতা সার্বজনীন কোনোা রীতি ছিল না। আমরা লক্ষ্য করতে পারি যে, সংস্কৃত শব্দবহুল ও সংস্কৃত শব্দবিরল Ñ এই উভয় প্রকারের রচনাতেই লেখকেরা পারঙ্গম ছিলেন। নিজের পছন্দ ও রূচিমতো, প্রতিবেশ অনুসারে যে কোনো একটি রীতি বেছে নিতে পারতেন লেখকেরা এবং তাঁরা তা নিয়েছেনও। এঁদের অনেকের লেখার শুধু ক্রিয়াপদ এদিক ওদিক করে দিলেই সেগুলোকে আধুনিক চলিত রীতি বলে চালিয়ে দেয়া যেতে পারে।
অং ধ সধঃঃবৎ ড়ভ ভধপঃ, রবীন্দ্রনাথের জন্মের (১৮৬১) আগেই চলিত বাংলা গদ্যরীতি হিসেবে কমবেশি প্রতিষ্ঠিত। বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী ও অন্যান্যরা এই তৈরি গদ্যরীতি ব্যবহার করেছেন মাত্র। শুধু তাই নয়, আজম দেখিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের নিজের রচনাও প্রায়শ সংস্কৃতভারাক্রান্ত হয়েছে। নিচের উদ্ধৃতিটি কবির মহাপ্রয়াণের মাত্র কয়েক বছর আগের রচনা থেকে নেয়া। লক্ষ্য করা যেতে পারে যে রচনাটি ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক।
‘ইতিহাসের যে বিপুল পরিবর্তনের শাখা-প্রশাখার মধ্য দিয়ে আদিযাত্রীরা চলে এসেছে তারই প্রভাবে সেই শ্বেতকায় পিঙ্গলকেশ বিপুলশক্তি আরণ্যকদের সঙ্গে এই শ্যামলবর্ণ ক্ষীণ-আয়ু শহরবাসী ইংরেজরাজত্বের প্রজার সাদৃশ্য ধূসর হয়েছে কালের ধূলিক্ষেপে।…’ (‘বাংলাভাষা পরিচয়’, ১৯৩৮)
‘অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হইতেছে’, প-িত বা উপনিবেবেশাক্রান্ত লেখকদের হাতে বাংলা ভাষার ব্যাকরণের দর্শনীয় কোনো পরিবর্তনই হয়নি। অষ্টাদশ শতক থেকে অদ্যাবধি বাংলার রূপতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব এক। এই রূপতত্ত্ব ইংরেজির নয়, সংস্কৃতের নয়, একান্তই বাংলার। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জটিল ভাব প্রকাশের জন্যে জটিল/যৌগিক বাক্য রচিত হয়েছে ইংরেজির আদলে। আজও তা হয়ে থাকে, আজমও করেছেন, আপনি-আমিও করে থাকি। কিন্তু তার পরিমাণ খুব বেশি নয়। কোনো ভাষার বাক্যবিন্যাস/অন্বয় বা সিন্টাক্স ব্যাকরণের অপেক্ষাকৃত স্থির একটি এলাকা, কয়েক শত বা অনেক সময় হাজার বছরেও তা বদলায় না। পরিবর্তন যদি কিছু হয়ে থাকে বাংলা ভাষায়, তবে তা হয়েছে শব্দব্যবহারে। কিন্তু শব্দকোষ ভাষা নয়, ব্যাকরণই ভাষা। শব্দকোষ যদি ভাষা হয়, তবে ফরাসি ও ল্যাটিন শব্দজর্জর ইংরেজি ভাষাকে ফরাসিই বলতে হয়। ফরাসি ও ল্যাটিন শব্দের ব্যাপক উপস্থিতি সত্তেও ইংরেজি ভাষা ইংরেজিই থেকে গেছে এর রূপতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব ও ধ্বনিতত্ত্ব একান্তভাবে ‘ইংরেজি’ হবার কারণে।
সুতরাং বাংলা ভাষা আদৌ উপনিবেশায়নের শিকার হয়েছে কিনা, বা কোনো ভাষার উপনিবেশায়ন আদৌ হতে পারে কিনা সে ব্যাপারে আমরা নিঃসন্দেহ হতে পারছি না। ভাষার উপনিবেশায়ন যদি না হয়ে থাকে, তবে বি-উপনিবেশায়ন হবারও প্রশ্ন আসে না। আর একটা কথা, কোনো বিশেষ ব্যক্তি (তিনি যদি রবীন্দ্রনাথও হয়ে থাকেন, তবুও) বা গোষ্ঠীর ভাষাচর্চার ফলে কোনো ভাষার ব্যাকরণ বা শব্দকোষে দর্শনীয় কোনো পরিবর্তন আদৌ আসতে পারে কিনা সে ব্যাপারেও ভাষাবিজ্ঞানীদের ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে।
ভাষার সৃষ্টি ও বিকাশ হচ্ছে দই পাতার মতো, পুরোনো শব্দকোষ ও ব্যাকরণের দইয়ের সঙ্গে নতুন শব্দের দুধ যুক্ত হয়ে দইয়ের কলেবর বাড়ে। দুধ যে কারণেই যুক্ত হোক, তাতে ভাষার বা ব্যাকরণের কিছুই আসে যায় না। ভাষা হচ্ছে সাগরের মতো, যা যা সাগরে এসে পড়ে সাগর তার সব নেয় না, যা দরকার নেই তা বেলাভূমির দিয়ে ঠেলে দেয়। উদাহরণ: মাইকেলের কাব্যরীতি, কমলকুমার মজুমদারের গদ্যরীতি পরবর্তিকালে আর অনুসৃত হয়নি।
আচ্ছা, তর্কের খাতিরে না হয় ধরেই নিলাম, বাংলা ভাষার বি-উপনিবেশায়ন হয়েছে। সেই বি-উপনিবেশায়নে রবীন্দ্রনাথের যে ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন আজম সে প্রসঙ্গেও তো আমাদের কিছু বলতে হবে। রবীন্দ্রনাথ মাতৃভাষাকে শিক্ষা ও রাষ্ট্রীয় কর্মকা-ের বাহন করতে চান। ভালো কথা। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে মাতৃভাষায় (গারো, খাসিয়া, চাঁটগাঁইয়া…) শিক্ষা দেয়া অসম্ভব না হলেও সহজ নয়। ‘মাতৃভাষা’ মানে কী? লেখার ভাষা সাধারণত কারও মাতৃভাষা হয় না। মাতৃভাষা বলে যদি কিছু থাকে, তবে তা শিখতে হয় না, নিজে থেকেই অর্জিত হয়। অন্যদিকে লেখার ভাষা মন দিয়ে, যতœ করে শিখতে হয়। আমাকেও ছোটবেলায় প্রমিত বাংলা শিখতে হয়েছে। আজমকেও শিখতে হয়েছে। অন্যের কথা জানি না, আমার মাতৃভাষা (প্রমিত) বাংলা নয়, চট্টগ্রামি বাংলা। প্রমিত বাংলা আমার শেখা দ্বিতীয় ভাষা (১৯৬৯ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় ‘মাতাপিতা’ শব্দটিকে ‘মাথার ফিতা’ বলে মনে হয়েছিল!) সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হলে, শিক্ষার মাধ্যম বাংলা হলে সংখ্যাগুরু বাঙলাভাষীদের সুবিধা হতে পারে, কিন্তু আদি-(বা চট্টগ্রাম)-বাসীদেরতো সেই দ্বিতীয় ভাষা বাংলাতেই শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। হায়! মহামতি রবীন্দ্রনাথ সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষীদের কথাই শুধু ভেবেছেন। রবীন্দ্রনাথ নাকি আসাম ও উড়িষ্যার উপর বাংলা ভাষাকে চাপিয়ে দেবার পক্ষপাতি ছিলেন (শিশির কুমার দাশ, মোদের গরব, মোদের আশা, পৃষ্ঠা ১৪৩-৪৪)। ‘কবিগুরু’র এই পক্ষপাতের পেছনে ‘গুরুতর’ কোনো কার্যকারণ থাকতেই পারে, কিন্তু অন্তত এই একটি ব্যাপারে ওঁর মানসিকতাটা যে আগাপাশতলা ঔপনিবেশিক সে ব্যাপারে সন্দেহ করা চলে না।
আজম জানিয়েছেন, বাংলা ব্যাকরণকে সংস্কৃতের প্রভাবমুক্ত করতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। এটা ঠিক যে অদ্যাবধি লেখা প্রতিটি বাংলা ব্যাকরণই সংস্কৃত ও ইংরেজি ব্যাকরণের অক্ষম অনুকরণ। সুকুমার সেন লিখেছেন, তিনি নিজে এবং সুনীতিবাবু এই ‘পাপ’ করেছেন টেক্সটবুক বোর্ডকে খুশি করার জন্যে। যারা সুকুমার-সুনীতিকে অনুসরণ করে স্কুল পাঠ্য বাংলা ব্যাকরণ লিখে চলেছেন, তারাও সেই একই পাপ করে চলেছেন, এপার ও ওপার বাংলায়। এটা উপনিবেশায়নের ফল নয়। বাংলা অঞ্চলে একাধারে শিক্ষিত, দক্ষ ও সৎ ভাষাবিজ্ঞানীর অভাব ছিল এবং এখনও আছে। ‘যতদিন পর্যন্ত এ অভাব পূরণ না হইবে, ততদিন পর্যন্ত একটিও ‘প্রকৃত’ বাংলা ব্যাকরণ রচিত হইবে না।’ (বাংলা) একাডেমি ও আকাদেমির কর্তাব্যক্তিরা এ সত্যটা যত তাড়াতাড়ি হৃদয়ঙ্গম করবেন, ততই মঙ্গল।
প্রকৃত ব্যাকরণ মানে কি? কোনো অজ্ঞাত কারণে কারণে রবীন্দ্রনাথ সাধু ভাষাকে ‘সংস্কৃত’ আর চলিত ভাষাকে ‘প্রাকৃত’ বলতেন। ‘প্রকৃত বাংলা ব্যাকরণ’ বলতে রবীন্দ্রনাথ বুঝতেন বাংলা অঞ্চলের সবগুলো আঞ্চলিক ভাষা বা প্রাকৃতের তুলনামূলক ব্যাকরণ। রবীন্দ্রনাথের মাথায় কোথা থেকে এই ধারণাটি এলো? তূলনামূলক ব্যাকরণের যুগে রবীন্দ্রনাথের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। সেই ব্যাকরণধারায় একাধিক উপভাষার/ভাষার রূপের তুলনা করে অধুনা-বিলুপ্ত আদি রূপটি গঠন করার চেষ্টা করা হতো। কিন্তু এককালিক ব্যাকরণে এই পদ্ধতির কোনো উপযোগিতা নেই। বাংলা ভাষার কোনো মান্য বা স্বল্পমান্য রূপের ব্যাকরণ রচনা করার জন্যে সবগুলো রূপের ব্যাকরণ রচনা এবং/বা সেই সব ব্যকরণের তুলনা অপরিহার্য নয়।
গুরু রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন বাংলা বানান যথাসম্ভব উচ্চারণানুগ হোক, যোগ্য চেলা আজমও সম্ভবত তাই চায়। কিন্তু আগেই বলেছি, What you think or believe does not matter…, পৃথিবীর কোনো ভাষাতেই শব্দের বানান শব্দের উচ্চারণকে টায়ে টায়ে অনুসরণ করে না। বাস্তবে এটা সম্ভব নয়। কার উচ্চারণ অনুসারে লেখা হবে বানান? রবীন্দ্রনাথের, আমার, আপনার, আসাদুজ্জামান নূরের, নাকি রূপা চক্রবর্তির? কোন উচ্চারণরীতি অনুসরণ করা হবে বানানে, ঢাবির ‘কণ্ঠছিলন’ নাকি কবির (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) ‘স্বরসিলন’? রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণ অনুসারে বানান লিখতে গেলে ‘লিখলুম’, ‘অভ্যেস’ (নাকি ‘ওব্যেস’) লিখতে হয়। তার উপর, উচ্চারণ কয়েক দশক পর পর, প্রতি বিশ মাইল অন্তর বদলায়। উচ্চারণ অনুসারে যদি বানান লিখতে হয়, তবে ১৯৯০ সালে এক বানান, ২০১৪ সালে আর এক বানান, ঢাকায় এক বানান, কুমিল্লায় এক বানান, চট্টগ্রামে আর এক বানান লিখতে হবে। বাংলা বর্ণমালার দূর্বল শরীর কি রবীন্দ্রনাথের এই না-হক খায়েশ পুরোপুরি মেটাতে পারবে?
আগে উপনিবেশায়ন নিয়ে সন্দেহাকুল ‘হয়েছিলুম’ (রাবিন্দ্রীক বানান), এবার বাংলা ভাষার বি-উপনিবেশায়নে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা নিয়েও গভীর সন্দেহ জাগতে শুরু ‘করেচে’ (দ্বিজেন্দ্রিক বানান)। আজম নিজেই বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ কখনও কখনও সংস্কৃত শব্দ ব্যবহারের পক্ষেই ওকালতি করেছেন। যদি কোনো ব্যক্তি কখনও সংস্কৃতায়নের পক্ষে বলেন, আবার কখনও বিপক্ষে, তবে বুঝতে হবে, তাঁর মধ্যে এক ধরণের দ্বিধা কাজ করছে। দ্বিধাগ্রস্ত ব্যক্তিকে বি-উপনিবেশায়ন যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ঘোষণা করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, তবে যুদ্ধ যদি আদৌ না লেগে থাকে, তবে সে ভিন্ন কথা।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, ব্যাকরণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু পাকা সিদ্ধান্তের সাথে আমি সহমত। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, ‘তৎসম শব্দ’ বলে কিছু নেই। বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের নিয়ম মেনেই কোনো শব্দকে, সে সংস্কৃত হোক, ফার্সি হোক বা ইংরেজি হোক, বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হতে হয়। সুতরাং বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দ বলে কিছু নেই। নতুন বা কঠিন শব্দ বলেও কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, নতুন শব্দ হচ্ছে ‘পা-কাটা নতুন জুতোর মতো’, এক সময় পায়ে খাপ খেয়ে যায়। তাত্ত্বিক ভাষাবিজ্ঞানের সেই শৈশবে রবীন্দ্রনাথের এই সব মন্তব্য রীতিমত বিস্ময়কর। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, ২০১৪ সালেও রবীন্দ্রনাথের এই সহজ কথাগুলো বেশির ভাগ ভাষাবিজ্ঞানীর মোটা মাথায় ঢোকে না। তারা এখনও ‘কৃতঋণ’ শব্দের কথা বলেন, এদেশে এবং বিদেশে। সেদিক থেকে রবীন্দ্রনাথকে বাংলা বৈয়াকরণদের গুরু বলা অতি সঙ্গত। এ ব্যাপারে আজমের সাথে আমি পুরোপুরি একমত। তবে যে গুরুর কোনো প্রকৃত শিষ্য নাই, শুধু ‘ওষ্ঠসেবক’ (Leap-servive provider) আছেন, ‘তাঁহাকে পদধারণ পূর্বক সিংহাসনে বসাইলেই বা কি, কর্ণধারণপূর্বক নামাইলেই বা কি!’
আগেই বলেছি, আজমের রেফারেন্স দেবার রীতিটি একটু অদ্ভুত। দীর্ঘদিন গবেষণায় নিরত থেকে জীবিত ও মৃত সব লেখকের সাথে তাঁর সম্পর্ক হয়ত এতটাই আন্তরিক হয়ে গেছে যে তিনি তাদের অনেকের নাম ধরে ডাকতে দ্বিধা করেননি। বই ও প্রবন্ধের তালিকা তিনি আলাদা করে দিয়েছেন। এটিও একটি নতুন রীতি। জানি না, এ সবই আজমের একাডেমিক ‘ব্যুপনিবেশায়ন’ প্রক্রিয়ার অংশ কিনা। তবে গবেষণা-পরিচালক, থিসিস পরীক্ষকবৃন্দ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেহেতু এই রীতি অনুমোদন করেছেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেহেতু নির্দিষ্ট কোন শৈলীপত্র বা স্ট্যাইলশীট নেই, সেহেতু, ‘আমরা আর কী করবো, সুন্দরবনে বাঘের সামনে পড়ে গেলে, যা করার বাঘই করবে!’
আমি আজমের thesis এর একটি প্রাথমিক antithesis দাঁড় করাতে চেষ্টা করলাম। এর পর আসবে synthesis এর পর্ব। বলা বাহুল্য, এটাই বিজ্ঞানচর্চার ধারা। এখানে আমি যে সব আপত্তি তুলেছি সেগুলো সবই যে খ-ন-অযোগ্য তা হয়তো নয়। হয়তো আজমের দাবিই সঠিক, আমার আপত্তি ধোপে টিকবে না। সিনথেসিস পর্যায়ে এ ব্যাপারে একটা রফায় আসা যাবে। আপাতত, নতুন একটি দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বাংলা গদ্যের বিবর্তনের ইতিহাসের উপর চমৎকার একটি থিসিস রচনার জন্যে আমি আজমকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এবং ক্ষণে ক্ষণে আমার বাকচাপল্যের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। বইটি মুদ্রণত্রুটিবর্জিত, সুলিখিত, সুমুদ্রিত, সুগ্রন্থিত। কেউ আজমের সাথে একমত হোন বা দ্বিমত পোষণ করুন, ওঁর বইটি না পড়ে বাংলা গদ্যের ইতিহাস সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা কারও পক্ষেই আর উচিত হবে না। আমি নিজে আজমের বইটি পড়ার আগে বাংলা গদ্যের বিবর্তন বিষয়ে প্রায় কিছুই জানতাম না। গত কুড়ি বছরে এ বিষয়ে অনেক বইই কিনেছি, কিন্তু খুলে কখনও দেখিনি। আজমের কল্যাণে এ বিষয় নিয়ে কমবেশি পড়তে হলো, ভাবতে হলো, ভাবতে গিয়ে আজমের সাথে দ্বিমত পোষণ করারও সুযোগ হলো। অপরকে ভাবতে সুযোগ করে দেয়াতেই গবেষণা বা গ্রন্থরচনার সার্থকতা। ‘নাকি মিছা কইলাম?’ (বি-উপনিবেশেক শৈলী)
এন্ডারসনের একটি পুস্তক সমালোচনার উপসংহারে এন্ড্রু কার্স্টেয়ার ম্যাকার্থি বলেছিলেন: ‘এন্ডারসনের মতো গবেষকের যদি কোনো ভুলও হয়ে থাকে তবে সে ভুল থেকেও আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।’ আজমের গবেষণাকর্মটির উপসংহার টানতে গিয়ে ম্যাকার্থির মন্তব্যটা মনে পড়ে গেল।
ইতি ১৬ই আগস্ট, ২০১৪, রাত ২টা ১৫ মিনিট।
occasion du levitra
http://buyplaquenilcv.com/ – plaquenil retinal toxicity
Cialis
Buy Lasix Water Pills
Cialys Online No Prescription
Priligy Dapoxetina Opinioni
Canadian Pharcharmy For Antibiotics
Viagra Tabletten Nebenwirkungen
gabapentin 50mg
Zithromax Indication
Compra Viagra Postepay
Come Usare Il Cialis
Short article together with your physician and press best price cialis 20mg Additionally, the relation between fertility drug use and breast density was not substantially changed after exclusion of four fertility drug users and their matched controls who were dispensed a drug within 1 month of their mammogram OR 1