Scroll Top
19th Ave New York, NY 95822, USA

অবিমৃশ্যকারিতা: বাঙালির প্রধান চারিত্রিক ব্যাধি

13-copy

বাঙালির স্বভাবের কথা ভাবলেই আমার চোখের সামনে এক মৎস্যশিকারীর চিত্র ভেসে ওঠে, যে কিনা সারাদিন ছিপ ফেলে বসে থেকে অনেক কষ্টে বরশিতে একটা মাছ গেঁথে তোলার পর মাছটাকে ইচ্ছে করে পানিতে ছেড়ে দেয় এবং পরক্ষণেই পা ছড়িয়ে বিলাপ করতে শুরু করে এই বলে যে তার ভয়ানক ক্ষতি হয়ে গেল! বাঙালি চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই ‘অবিমৃশ্যকারিতা’, অর্থাৎ ‘অগ্রপশ্চাৎ না ভাবিয়া কাজ করা’। অবিমৃশ্যকারিতা একটি বংশানুক্রমিক এবং সংক্রামক চারিত্রিক ব্যাধি।

কেন বলছি রোগটি বংশানুক্রমিক? চল্লিশের দশকে পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল বাঙালি মুসলমান, যাদের মধ্যে যুবক শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ‘লেড়কে লেঙ্গে’ পাকিস্তান কায়েম হবার অব্যবহিত পরেই পাকিস্তানের বিরোধিতা করতে বাধ্য হলেন শেখ মুজিবুর রহমান সহ অন্য অনেক পাকিস্তানপন্থী বাঙালি নেতা। এই বিরোধিতা যদি অপরিহার্য ও যুক্তিযুক্ত হয়ে থাকে, তবে পাকিস্তান আন্দোলন নিশ্চয়ই ছিল অবিমৃশ্যকারিতা।

প্রিয় পাকিস্তানে প্রায় দেড় দশক দুর্বিসহ কারাভোগ করে ৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী শেখ মুজিবুর রহমান অবশেষে সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা দিলেন: ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বহু লক্ষ শহীদ ও মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও দেশগঠনের জন্যে তিনটি বছরও সময় দেওয়া হয়নি ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম বাঙালি রাষ্ট্রপিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে। নিজের পায়ে এভাবে কুড়াল মারার মতো অবিমৃশ্যকারীতা একমাত্র বাঙালির পক্ষেই করা সম্ভব। পরবর্তি কয়েক দশকে রাষ্ট্রপিতা হত্যার পরিকল্পনাকারী এবং তাদের দোসরেরা সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছিল বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানাতে। জাতীয় পরিচয়, জাতীয় সঙ্গীত পর্যন্ত বদলে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল, যাকে অবিমৃশ্যকারিতা ছাড়া আর কিই বা বলা যেতে পারে?

সাম্প্রতিক সময়ে বহু কোটি টাকা খরচ করে ঢাকা-চট্টগ্রামে তৈরি হচ্ছে একাধিক উড়াল সেতু বা ফ্লাইওভার। কিন্তু অনেকেই বলেছেন এবং এখনও বলছেন, এসব উড়াল সেতু যানজট সমস্যার প্রকৃত সমাধান নয়। অথবা যতটা সমাধান এগুলো করবে, তার চেয়ে ভালো সমাধান আরও কম খরচে করা যায়। সরকারি অফিসের একাংশ, ভারী ও লঘু শিল্প-কলকারখানা ঢাকা থেকে সরিয়ে অন্য জেলায় নেয়া যায়। ঢাকার সাথে পাশ্ববর্তী জেলাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করা যায়। সরকারী ও বেসরকারী গাড়ির সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে সীমিত রাখা যায়। আবাসিক এলাকা থেকে শিক্ষা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেয়া যায়। ফুটপাতকে হকার-মুক্ত ও রাস্তাকে পার্কিংমুক্ত করা যায়। ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের জরিমানা করে একদিকে নগরের সড়ক সুগম করা যায়, আবার অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় কোষাগারও সমৃদ্ধ করা যায়। অন্ততপক্ষে কী কী করা যায়, তা নিয়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ততো নেয়া যায়। না, কর্তাদের ‘মঞ্চায় দেশের কইলজাডারে ফ্লাইওভার দিয়া বান্ধি’, কারণ তাতে চটজলদি টু পাইস কামানোর সুযোগ আছে।

উড়াল সেতুর নির্মাণব্যয় ও নির্মাণকাল দর্শনীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাস্তা ব্যবহারকারি জনগণের ভোগান্তি সহ্যের চরমে পৌঁছার পর জানা গেলো, একটি ফ্লাইওভারের ষাটটি পিলারই নাকি ভেঙে ফেলতে হবে! পরিকল্পনাতে নাকি ত্রুটি আছে, নির্মাণকার্যেও নাকি সমন্বয়হীনতা ছিল। পত্রিকায় প্রকাশিত এই ঘটনা যদি সত্য হয়ে থাকে তবে এটা হবে অবিমৃশ্যকারিতার চুড়ান্ত দৃষ্টান্ত! কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা: সবার চোখের সামনে সব কাজ হচ্ছে, ত্রুটি ও সমন্বয়হীনতা হয়ে থাকলে সবার চোখের সামনেই হয়েছে। একই ঘটনা পাশ্চাত্যে ঘটলে জনগণের অর্থ নয়ছয় করার অপরাধে ‘সবার চোখের সামনেই’ দায়ি ব্যক্তিদের চাকুরিচ্যুত করে জেলে পাঠানো হতো। চীনে আমৃত্যু কারাবাস ও বুলেটের বিল চলে আসতো মরহুমদের বাসায়। হায়! যাদের তিরষ্কার করার কথা বাংলাদেশে তাদের দেয়া হয় পুরষ্কার। এদের সর্বোচ্চ তনখা দিয়ে খুশি রাখতে গিয়ে বাকি সবাই অখুশি হলেও কুছ পরওয়া নেই।

অষ্টম বেতনকাঠামোতে বি(শ্ববিদ্যালয়) শি(ক্ষক)-দের মর্যাদার অবনমন নিয়ে গত এক বছরে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। সবার মতামত নিয়ে, যোগ্য লোকদের দিয়ে যদি বেতনকাঠামো প্রণয়ন করা হতো, তবে এত কালি ও বাকশক্তির অপচয় হতো না। একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক, বিশিদের প্রতি প্রথমে অর্থমন্ত্রী ও পরে প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্যহীন মন্তব্য, অর্থমন্ত্রীর ক্ষমাপ্রার্থনা ইত্যাদি বহুবিধ অকারণ নাটকে রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতার ‘উনিশ পিপে নস্য ফুরিয়ে যাবার’ পর বেতন-কাঠামোর যে সরকারী প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে, তাতে বিশিসহ বেশির ভাগ চাকুরিজীবী আহ্লাদিত হতে পারেননি। বিশি-নেতৃবৃন্দ মনে করেন, প্রশাসনের একটি মহল নাকি নিজেদের ইচ্ছেমতো ভুল বোঝাচ্ছে সরকার-প্রধানকে। এই ‘সরকার’-এর দ্বিতীয় মেয়াদে ‘সর’ যে ঠিক ‘কার’ তা একেবারেই বোঝা যাচ্ছে না, তবে দুধ এবং কড়াই দুটোই যেন ধীরে ধীরে জনগণের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।

সরকারের টনক নড়াতে ব্যর্থকাম হয়ে বহু গড়িমসি করে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে বিশিরা কর্মবিরতি শুরু করেছিলেন, যাতে সমাজের প্রায় সব মহলের সমর্থন ছিল। বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে আমলা বনে যাবার সর্বোচ্চ সরকারী আহ্বানে একেবারেই সাড়া দেননি বিশিরা। টানা এক সপ্তাহ কর্মবিরতির পর তাদের ডাকা হলো ‘পিঠা’ উৎসবে (ভাগ্য ভালো যে ঠ-ধ্বনির মহাপ্রাণতা পুরো অপরাহ্নজুড়ে অক্ষুণœ ছিল!) ‘মুই ক্ষমতার কত কাছে রে!’ খুশিতে ডগমগ সেলফি তুলে ফেসবুক ভরে দিলেন অনেক বিশি নেতা-নেত্রী। ‘আশ্বাস’ পেয়ে বাধ্য সন্তানের মতো ইতিমধ্যে ধর্মঘটে ইতি টেনেছেন বিশিরা। আশ্বাস এখন দীর্ঘশ্বাসে পরিণত না হলেই হয়! তখন সাধারণ বিশিসহ সবাই কর্মবিরতির এই সিদ্ধান্তকেই অবিমৃশ্যকারিতা বলবে। বিশিদের দাবি যদি যৌক্তিক হয়, তবে আট মাস আগেই সরকারের তা বোঝা উচিত ছিল। যদি তাদের দাবি একেবারেই অযৌক্তিক হয়, তবে সরাসরি ব্যাপারটা তাদের বুঝিয়ে দিলেই হয়। সর্বোচ্চ সরকারী আশ্বাসটুকু এক সপ্তাহ আগে পেলে বিশিদের কর্মবিরতিরই প্রয়োজন হতো না। এত লেখালেখি, গলাবাজি, বকাবকি, কর্মবিরতি, পাঠদানঘন্টা অপচয় ও আশ্বাস-বিশ্বাসের মূলে আছে বাঙালি স্বভাবের সেই সুপ্রাচীন দোষ: অবিমৃশ্যকারিতা।

ঢাকা শহরের কোন কোন এলাকা দিয়ে মেট্রোরেলের লাইন যাবে সে ব্যাপারে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবার আগেই সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বিশেষ একটি এলাকার ব্যাপারে আপত্তি জানানো হয়েছিল। সে আপত্তি আমলে নিয়ে কয়েক বছর পর অবশেষে যখন নতুন করে মেট্রোরুট চুড়ান্ত হয়েছে, কাজও শুরু হবার পথে, তখন আপত্তি জানাতে শুরু করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র সংগঠন। মেট্রোরেলের কম্পনে নাকি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার স্থাপত্য ও ভাষ্কর্যের ক্ষতি হবে। শব্দে ব্যাহত হবে লেখাপড়া-গবেষণা। হায় অবিমৃশ্যকারী বনলতা সেন! এতদিন কোথায় ছিলেন? প্যারিস-লন্ডন-নিউইয়র্ক-টোকিওতে মেট্রোলাইন জালের মতো ছড়ানো আছে, মাটির উপরে এবং নিচে। সেখানে যদি ছাত্রদের লেখাপড়া ও গবেষণা করতে অসুবিধা না হয়, তবে ঢাকায়ও অসুবিধা হওয়ার কোনো কারণ নেই। ক্লাসচলাকালীন অপরাজেয় বাংলার সামনে যখন যাত্রাভিনেতার মতো গলা কাঁপিয়ে বক্তৃতা চলে, তখন তরুণ বাগ্মীরা ভুলেই যান যে মুখের সামনে মাইক রয়েছে! র‌্যাগ ডের নামে যখন তীব্র আওয়াজে হিন্দি গান বাজানো হয় ক্যাম্পাসে, তখন লেখাপড়ার ক্ষতি হয় না? লাইব্রেরিতে বসে বি.সি.এস. গাইডবই পড়া বা আড্ডা দেয়াতে মেট্রোরেলের শব্দ কী এমন ব্যাঘাত ঘটাবে?

‘অবিমৃশ্যকারিতা’ নামক এই বংশানুক্রমিক ও সংক্রামক রোগের একমাত্র ও উপযুক্ত ঔষধ হচ্ছে গণতন্ত্র, যা একান্তভাবে নির্ভর করে জবাবদিহিতার উপর। গণতন্ত্র = জবাবদিহিতা। যে দেশে ১০০% ভাগ জবাবদিহিতা আছে, সে দেশে ১০০% ভাগ গণতন্ত্র আছে। জবাবদিহিতা অনেকাংশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর নির্ভর করে। বলা যেতে পারে যে ১০০% মতপ্রকাশের স্বাধীনতা = ১০০% জবাবদিহিতা। স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করা না গেলে, বিরুদ্ধ মত আমলে না নিলে, অবিমৃশ্যকারিতার অবকাশ থেকেই যায়। অবিমৃশ্যকারিতার কারণে রাষ্ট্রের সময় ও অর্থের অপচয় হয়, যার ফলে সরকারের যাবতীয় সদিচ্ছা সত্তেও টেকসই উন্নয়ন স্থবির হয়ে পড়ে।

গণতন্ত্র একটি অভ্যাস, একটি জীবনাচরণ Ñ যার শুরু পরিবার থেকে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ পরিবারেও জবাবদিহিতা নেই, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের উপায় নেই, অর্থাৎ গণতন্ত্র নেই। বাংলাদেশে নামেই শুধু আছে গণতন্ত্র, তলে তলে এখানে চলে স্বৈরতন্ত্র, ঘরে এবং বাইরে। ‘এই চুপ! তুই আমার চেয়ে বেশি বুঝস?’ পরিবারের এই স্বৈরাচার প্রতিফলিত হয় সমাজে এবং রাষ্ট্রে। পরিবারের গণতন্ত্রহীনতার কারণে ব্যক্তি অবিমৃশ্যকারিতার ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়, যা সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ে সমষ্টিতে। দুরারোগ্য এই ব্যাধির কারণে জাতি অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও জ্ঞানগত দিক থেকে দিন দিন দুর্বল হতে থাকে।