উচিৎ শিক্ষা-৩: হাসি হাসি প্রশ্ন ফাঁসই, দেখছে বঙ্গবাসী!

ছাত্রজীবন বড় সুখের হইত, যদি পরীক্ষা না থাকিত। আশি এবং নব্বইয়ের দশকে আমি যখন প্যারিসের সর্বোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ছিলাম, তখন আমার শিক্ষকেরা পরীক্ষায় একটি বা দুটি প্রশ্ন দিতেন। অনেক সময় শিক্ষক নিজের হাতে প্রশ্ন লিখে দিতেন ব্ল্যাকবোর্ডে। সর্বোনের পরীক্ষার হলে নকল করতে বা অন্যের খাতা দেখে কাউকে কখনো লিখতে দেখিনি। প্রশ্নপত্র ফাঁস হবারতো প্রশ্নই ছিল না। শিক্ষক খাতা দেখে খাতার উপরই নম্বর দিয়ে ফলাফল দিয়ে দিতেন এক সপ্তাহ পরেই। খাতার মধ্যে শিক্ষকের সংশোধনী দেখে শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারতো, কোথায় কী ভুল হয়েছে। ৬০% নম্বরে পাস ছিল। সেমিস্টারে কমপক্ষে তিনটা পরীক্ষা হতো, তিনটায় মিলে পাশ করা খুব একটা কঠিন ছিল না। তবুও যারা জুন মাসের চুড়ান্ত পরীক্ষায় এক বা একাধিক বিষয়ে ফেল করতো (আমি ছিলাম তাদের অন্যতম!) পুরো গ্রীস্মকাল রিভিশন দিয়ে আবার অক্টোবরে পরীক্ষা দিয়ে তাদের পাশ করার সুযোগ থাকতো। কানাডাতেও অনেকটা এই পদ্ধতি দেখেছি, তবে সেখানে কোনো বিষয়ে দুই বার পরীক্ষা দেবার সুযোগ নেই। একবার ফেল করলে সেই বিষয়ে আবার ভর্তি হতে হবে, অন্য কোনো সেমিস্টারে।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশ্ন করেন দুই থেকে তিনজন শিক্ষক। প্রশ্নপত্র সমন্বয় কমিটি প্রশ্নপত্রের চূড়ান্ত রূপ নির্ধারণ করেন। পরীক্ষার খাতা দেখেন প্রথমে এক শিক্ষক, তার পর অন্য একজন। খাতায় দাগ দেয়ার নিয়ম নেই। চুড়ান্ত পরীক্ষার খাতা সাধারণত দেখানো হয় না শিক্ষার্থীদের, সুতরাং তারা জানতেও পারে না কে, কোথায়, কী ভুল করেছে। দুই শিক্ষকের ফলাফল এসে যাবার পর সেখান থেকে সর্বাধিক নম্বরটি বাছাই করে অপেক্ষা করতে হয় ট্যাবুলেশন শিটের জন্যে। এই শিট আসতে কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস লেগে যেতে পারে। তারপর নম্বরশিট দেখে ট্যাবুলেশন শিট পূরণ করে তিন চার জনের স্বাক্ষর নিয়ে রেজিস্টার্স অফিসে পাঠানোর পর সেখানে সাইক্লোস্টাইল শিটে নম্বর টাইপ করে আবার সেই শিটে পরীক্ষকদের স্বাক্ষর নেয়া হয়। বাংলাদেশে পরীক্ষাগ্রহণ মহা জটিল এক প্রক্রিয়া। পরীক্ষার্থীর ফর্ম পূরণ থেকে শুরু করে পরীক্ষার ফল বেরুনো পর্যন্ত যতগুলো পর্যায় আছে, ধানচাষেও সম্ভবত অতগুলো পর্যায় নেই। পরীক্ষার ফল দেবার এত জটিল পদ্ধতি ইওরোপ, আমেরিকা, জাপান কোথাও দেখিনি। এত বজ্রআঁটুনির মধ্যেও গেরো ফস্কা হয়ে কখনও কখনও পরীক্ষকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। প্রশ্নফাঁস, অপছন্দের পরীক্ষার্থীকে ইচ্ছে করে নম্বর কম দেওয়া, ট্যাবুলেশন শিটে ঘসামাজা করা ইত্যাদি কত বিচিত্র দুর্নীতি যে আমাদের শিক্ষাঙ্গনে হয় তার তালিকা দিতে গেলে লজ্জ্বা ও দুঃখে মাথা নুয়ে আসে।

বাংলাদেশে পরীক্ষায় নকলের সমস্যা সব সময়েই ছিল, বিভিন্ন সরকারের আমলে সেই সমস্যা বেড়েছে কিংবা কমেছে। প্রশ্নফাঁসের সমস্যা তুলনামূলকভাবে নতুন। বর্তমান সরকারের আমলে প্রশ্নফাঁসের সমস্যা যেন মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে। ভর্তিপরীক্ষা, চাকুরির জন্যে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা, মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকসহ যাবতীয় পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েই চলেছে। হাসি হাসি প্রশ্ন ফাঁসই, (চুপচাপ) দেখছে বঙ্গবাসী। এমন প্রায়ই হয় যে গরীব বাপের সন্তান কোনো ব্যাংকের নিয়োগ-নির্ধারণ পরীক্ষা দিতে রংপুর থেকে ঢাকায় এসে বাস থেকে নামতে না নামতেই শোনে যে প্রশ্ন ফাঁসের কারণে পরীক্ষা অনির্দিষ্ট কালের জন্যে স্থগিত। অনেক সময় পরীক্ষা একবার অনুষ্ঠিত হয়ে গেলে কর্তৃপক্ষ স্বীকারই করতে চায় না যে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। কখনও সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের দোষ দেয়, কখনওবা দোষ দেয় অভিভাবকদের, কিন্তু দায়িত্বপালনে নিজের অক্ষমতা স্বীকার করে ‘এবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি!’ বলে পদত্যাগ করার মহানুভবতা প্রদর্শনের সংস্কৃতি বাংলাদেশে কখনও শুরুই হয়নি, চালু হওয়াতো দূরের কথা।

পরীক্ষার আগের রাতে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের খোঁজে ফেসবুক চোখ রাখতে গিয়ে দু চোখের পাতা এক করতে পারে না পরীক্ষার্থী, তার পিতামাতা, মায় ভাইবোন। ফাঁস হওয়া প্রশ্নের চাহিদা আছে বলেই এর সরবরাহ আছে। দশ-বিশ-ত্রিশ লক্ষ টাকা দিয়ে প্রশ্নপত্র কেনার খদ্দের যদি থাকে বাজারে, শুধু সরকার কেন, কারও সাধ্য নেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া ঠেকায়। টাকায় (এবং ঢাকায়!) বাঘের দুধও নাকি মেলে। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে সন্তানকে কোচিং কারা করায়? এমনও নাকি হয়েছে যে সারারাত কোচিং ক্লাসে কাটিয়ে সকালে পরীক্ষার হলে গিয়ে পরীক্ষার্থী জ্ঞান (উভয় অর্থে) হারিয়েছে। আজ থেকে দুই দশক আগেও বাবামায়েরা লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুস দিয়ে ছেলেমেয়েকে মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি করাতো। সেই ছেলেমেয়েদের মধ্যেও অনেকে হয়তো আজ অভিভাবকে পরিণত হয়ে প্রশ্নফাঁসের দায় শুধু সরকারের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে।

অনেকে মনে করেন, প্রশ্নফাঁসে অভিভাবকদের কোনোই দোষ নেই। তারা অসহায়, নিয়তি-তাড়িত, কলুষিত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বীকার। আহারে! রাষ্ট্র আজ নতুন কলুষিত হয়নি। প্ল্যাটো, এমনকি তারও অনেক আগের আমল থেকে রাষ্ট্র ও রাজনীতিবিদেরা কলুষিত। রাষ্ট্র কলুষিত বলে আমাকেও কলুষিত হয়ে যেতে হবে? আশেপাশে সবাই অপরাধ করছে, অপরাধ করলে শাস্তি হচ্ছে না, এমন পরিবেশে অপরাধ করলেও আমিতো অপরাধীই বটে। ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করা দূরে থাক, আমার অভিভাবক যদি কোনোক্রমে জানতে পারতো যে আমি এ ধরনের প্রশ্ন দেখে পরীক্ষা দিয়েছি, তবে আমাকে কুকুর-পিটান পিটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিত। প্রকৃতপক্ষে এখনকার অভিভাবকেরা নিয়তি নয়, স্বভাব-তাড়িত।

কিছু লোক অপেক্ষা করে আছেন, একদিন বিপ্লব করে রাষ্ট্র ও সমাজের খোল-নলচে পাল্টে দেবেন। তখন পরীক্ষায় দুর্নীতিসহ সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কবে সাত মন তেল পুড়বে, তবেই রাধা নাচবে! সমাজ কখনই কামারের গদার বাড়িতে বদলায় না, বাইন্যার হাতুড়ির টুকুর-টাকুর বাড়িতে সমাজ ধীরে ধীরে বদলায়। যেসব দেশে বিপ্লব সংঘঠিত হয়েছে সে সব দেশে কি দুর্নীতির মূলোৎপাটিত হয়ে গেছে? আদর্শিক বা ধর্মীয়, কোনো বিপ্লবই মানুষকে তার জন্মগত বা অর্জিত স্বভাব, যেমন লোভ-লালসা, স্বার্থপরতা থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়নি। পরলোকে টসটসে অপ্সরা-গেলেমানের দেদার সরবরাহের নিশ্চয়তাতেও খুব একটা কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না।

ফাঁস হওয়া প্রশ্ন সংগ্রহ করে যারা পরীক্ষা দেয়, তাদের কুযুক্তির অভাব নেই: ‘কেন আপনারা সাজেশন পড়ে পরীক্ষা দিতেন না?’ ‘ফাঁস হওয়া প্রশ্ন হাতে এসেছে বলে না হয় পরীক্ষার আগে আগে প্রশ্নগুলোতে একটু চোখ বুলাতে পারছি। এছাড়া লেখাপড়াতো আমরা সারা বছর ঠিকঠাক মতোই করেছি, অন্য সবার মতোই!’ ‘সব প্রশ্ন পায়নিতো, সে কারণে মেয়ের পরীক্ষা ভালো হয়নি’- বলে সাফাই দিতে শোনা গেছে কোনো এক নির্লজ্জ অভিভাবককে। যেমন চরিত্রহীন সব পরীক্ষার্থী, তেমন বদমাশ তাদের বাবা-মা এবং ততোধিক বদমাস সেই সব প্রশ্নফাঁসকারী শিক্ষক-কর্মচারি-কর্মকর্তা যারা নিজেরাও সন্তানের জন্মদাতা। ওলটপালট করে দে মা লুটেপুটে খাই! যারা নিজেরাই মানুষ হয়নি, সন্তানকে তারা কীভাবে মানুষ করবে?

কোনো পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়া মাত্রই: ‘যত দোষ, মন্ত্রী ঘোষ!’ প্রশ্নফাঁসের গর্ডিয়ান ফাঁস খুলতে গিয়ে বেচারা সরকার দিশেহারা। কথিত আছে, গর্ডিয়ান ফাঁস খোলার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে সম্রাট আলেক্সান্ডার তলোয়ারের এক আঘাতে ফাঁসটি কেটে ফেলেছিলেন। গ্রিক সম্রাটের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কর্তৃপক্ষ নিজেই প্রশ্ন ফাঁস করে দিলে কেমন হয়? আমি নিজে এটা করি। সেমিস্টার চলাকালীন বা সেমিস্টারের শেষ দিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে শ খানেক প্রশ্নসম্বলিত একটি প্রশ্নব্যাংক দিয়ে দিই ছাত্রদের। ছাত্রদেরকেও প্রশ্ন করতে বলি। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর তৈরি করতে গিয়ে পুরো সেমিস্টারের পড়ার পুনরাবৃত্তি হয়ে যায়। সেই প্রশ্নব্যাংক থেকে খান বিশেক প্রশ্ন বাছাই করি চুড়ান্ত পরীক্ষায়। অনেক সময় একাধিক সেট প্রশ্ন করি। পরীক্ষার্থীরা একেক জন একেকটি সেটের প্রশ্নের উত্তর দেয়, যার ভাগ্যে যেটা পড়ে। মন্ট্রিয়ল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক ইগল মেলচুকের মুখে শুনেছি, তাঁর ছাত্রজীবনে রাশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হতো।

মিডটার্ম পরীক্ষায় আমি সাধারণত বই খুলেও পরীক্ষা দিতে দিই। চুড়ান্ত পরীক্ষায় বই খুলতে দিতে পারি না, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন নেই বলে। একবার চুড়ান্ত পরীক্ষায় প্রশ্নের উত্তর লেখার পরিবর্তে পঠিত বিষয়ের উপর এমনভাবে কুড়িটি প্রশ্ন করতে বলেছিলাম, যাতে কোনো প্রশ্নে অন্য প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি না হয়। আমার ক্লাসে প্রশ্ন ফাঁস হওয়া বা নকল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। শিক্ষার লক্ষ্য, কোনো একটি বিষয়কে শিক্ষার্থীর মননের অংশ করে তোলা, তোতাপাখীর স্মৃতিশক্তি যাচাই করা নয়।

ধরা যাক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক প্রতিটি পর্বে প্রতিটি বিষয়ে দশ সেট প্রশ্ন তৈরি করে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইটে রাখা হলো (আগের দশ বছরের প্রশ্নও অদলবদল করে দশ সেট প্রশ্ন হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে)। পরীক্ষার্থীরা এই দশ সেট প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে পরিচিত হবেন পরীক্ষার আগেই (অনেকটা যেমন করে মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে আমরা টেস্টপেপার্স ব্যবহার করতাম)। এই দশ সেট প্রশ্ন থেকে চুড়ান্ত পরীক্ষায়, ধরা যাক, তিন সেট প্রশ্ন ব্যবহার করা হবে। পরীক্ষার কিছুক্ষণ আগে আন্তর্জালে বা ফোনে কেন্দ্রপ্রধানকে জানিয়ে দেওয়া হবে, কোন পরীক্ষাকেন্দ্রে কোন তিন সেট প্রশ্ন ব্যবহৃত হবে। পরীক্ষার্থীরা চাইলে বই বা অভিধান ব্যবহার করতে পারে। তবে প্রশ্নগুলো এমনভাবে করা হবে, যাতে শ্রেফ মুখস্ত করে বা বই দেখে সেগুলোর উত্তর দেয়া সম্ভব না হয়। যতদিন না এই সমাধান আমলে নেওয়া হচ্ছে, ততদিন একটা সাময়িক চিকিৎসার নিদান দেয়া যেতে পারে: কর্তৃপক্ষ যে কোনো পরীক্ষার আগে একাধিক প্রশ্ন ফাঁস করে দিক অন্তর্জালের মাধ্যমে বা অন্য কোনো উপায়ে। এতে করে সুযোগসন্ধানীদের কিছুটা হয়তো বিভ্রান্ত করে দেয়া যাবে। কিন্তু ভূতের পকেটেই যদি সরিষা থাকে, তবে সরিষা দিয়ে ভূত তাড়ানোর চেষ্টা সফল হবে না।

দশ সেট প্রশ্ন জানা হয়ে গেলে সবগুলো প্রশ্নের উত্তরসম্বলিত মেড-ইজি বা নোটবই বাজারে চলে আসতে দেরি হবে না। নোটবইয়ের চাহিদা আছে, কারণ এমন কিছু শিক্ষার্থী সব সময়েই থাকবে যারা পরীক্ষা পাশের জন্যে কমবেশি মুখস্তের উপর নির্ভর করবেই। এতে তেমন কোনো ক্ষতি নেই। দশ সেট প্রশ্নে, ধরা যাক দুই শ প্রশ্ন আছে, প্রতি সেটে বিশটি করে। কোনো বিষয়ে দুইশটি প্রশ্নের উত্তর যদি কোনো শিক্ষার্থী জানে, তবে বিষয়টা তার অনেকটাই জানা হয়ে যাওয়ার কথা। আশা করা যেতে পারে যে পরীক্ষকদের এসব নোটবই পড়া থাকবে। যেসব পরীক্ষার্থীর উত্তর পরীক্ষকের কাছে শেখানো বা মুখস্ত করা বুলি মনে হবে, তাদের শ্রেফ পাস নম্বর দেয়া হবে। যারা নিজে থেকে বানিয়ে লিখতে পারবে, সৃজনশীলতার মাত্রা অনুসারে তাদের উচ্চতর নম্বর দেয়া হবে। পাস নম্বর কমপক্ষে ৬০% হতে হবে। ৩৩% পাসনম্বরের অপসংস্কৃতি পরিহার করতে হবে, কারণ কোনো বিষয়ের এক তৃতীয়াংশ জানাটা কোনো বিচারেই যথেষ্ট বিবেচিত হতে পারে না।

‘বাপের নাম কী?’ প্রশ্নের চারটি সম্ভাব্য উত্তরের মধ্যে সঠিকটিতে টিক চিহ্ন দিন: ক, খ, গ, ঘ … পরীক্ষার এই বেজন্মা এমসিকিউ পদ্ধতি পাশের হার বাড়িয়েছে বটে, কিন্তু উচিৎ শিক্ষার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। লেখাপড়া শেখার উদ্দেশ্য যদি লিখতে ও পড়তে শেখা হয়, তবে স্বীকার করতেই হবে যে এমসিকিউ দিয়ে এই দুই দক্ষতা সঠিকভাবে যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না। এমসিকিউ পদ্ধতির কারণে বহু গ-মূর্খ ডিগ্রি পেয়ে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার কার্যকারিতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। যেনতেনভাবে পাশের হার বাড়ালেই শিক্ষার অগ্রগতি হবে না।

শুধু পরীক্ষা নেবার জন্যেই আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেতে পারে। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, ভর্তিপরীক্ষা, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ইত্যাদি সব ধরনের পরীক্ষা নেয়া হবে এই প্রতিষ্ঠানের কাজ। প্রতিটি জিলা শহরে এরকম একটি প্রতিষ্ঠান থাকতেই পারে। কোনো ব্যক্তি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে এই কাজে উদ্যোগী হতে পারেন। প্যারিসের শহরতলীতে এরকম একটি বহুতল ‘পরীক্ষাভবন’ ছিল। সেখানে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত পরীক্ষা হতো। ইনভিজিলেটর নিয়োগ, প্রশ্নপত্র বিতরণ, উত্তরপত্র সংশোধকের নিকট প্রেরণ, ফলাফল প্রকাশ ইত্যাদি সব দায় পরীক্ষাভবন কর্তৃপক্ষের উপর বর্তাবে। প্রতিটি পরীক্ষার জন্যে বীমা করা থাকবে। হরতাল ইত্যাদি কারণে পরীক্ষা বাতিল হলে তার ক্ষতিপূরণ দেবে বীমাকোম্পানি। লোকসান এড়ানোর জন্যে বীমাকোম্পানীর পক্ষ থেকেও পরীক্ষার সময় হরতাল না ডাকার চাপ থাকবে । বাংলাদেশে এ ধরনের পরীক্ষা-ব্যবস্থা চালু হলে প্রশ্নপ্রত্র ফাঁস, পরীক্ষা চলাকালীন দুর্নীতির পরিমাণ অনতিবিলম্বে শূন্যের কোটায় নেমে আসবে।

অযৌক্তিকভাবে কম বা বেশি নম্বর দেবার অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দেশের প্রধান একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে আমি এক সেমিস্টার ভাষাবিজ্ঞান পড়িয়েছিলাম। চুড়ান্ত পরীক্ষায় কয়েকজন শিক্ষার্থীকে শূন্য এবং অন্য কয়েকজন শিক্ষার্থীকে দশে দশ দিয়েছিলাম বলে সহকর্মীরা আমার উপরে নাখোশ হয়েছিলেন। কানাঘুসায় শুনেছিলাম, কোনো উত্তরপত্রে শূন্যও দেওয়া যাবে না, দশও দেওয়া যাবে না এবং সর্বোচ্চ নম্বর ৬০% এর বেশি হতে পারবে না – সেই বিভাগে এটাই নাকি নম্বর প্রদানের বহুদিন ধরে চলে আসা নিয়ম। ‘বাংলাদেশের রাজধানীর নাম কী?’ – এই প্রশ্নের উত্তরে কোনো পরীক্ষার্থী যদি লিখে: ‘কাঠমাণ্ডুতে বৃষ্টি হচ্ছে!’ তবে আমি শূন্য দেবো না কেন? কোনো ছাত্র যদি উত্তরের চমৎকারীত্বে আমাকে অবাক করে দেয়, তবে তাকে আমি দশে দশই বা দেবো না কেন? অনেক শিক্ষক ভাবেন, নম্বর তার বাপদাদার সম্পত্তি, সুতরাং পরীক্ষার্থীকে বেশি নম্বর দিলে রাজভা-ার ফুরিয়ে যাবে। আমার শিক্ষকেরাতো আমাকে কখনো এত নম্বর দেয়নি, আমি কেন ছাত্রদের বেশি নম্বর দেবো? আমি কি ওদের চেয়ে কিছু কম প্রতিভাবান ছিলাম?

আমেরিকা-কানাডায় অনেক শিক্ষককে ইচ্ছে করে নম্বর কম দিতে বা প্রশ্ন অনাবশ্যক কঠিন করতে দেখেছি। এর কারণ, প্রথমত, শিক্ষক ভাবেন, প্রশ্ন কঠিন হলে শিক্ষার্থীরা তাঁকে সমীহ করবে এবং দ্বিতীয়ত, ফেল করলে পরীক্ষার্থী আবার একই বিষয়ে ভর্তি হবে। বার বার ভর্তি হওয়া মানেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক লাভ। এই অপসংস্কৃতির সামনে ছাত্রেরা অসহায়। এক টুকরো কাগজের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টে হাজার হাজার ডলার ঢেলে দিয়েও শিক্ষার্থীদের টু শব্দটি করার ক্ষমতা নেই, কারণ ডিগ্রি আটকে যেতে পারে। ছাত্রছাত্রীদের মতামতের ভিত্তিতে শিক্ষকের দক্ষতা মূল্যায়ন করার একটি সংস্কৃতি আমেরিকায় আছে বটে, কিন্তু শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের কারণে কোনো শিক্ষককে অব্যাহতি পেতে কখনও দেখিনি (বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও এই অপসংস্কৃতি আছে কিনা তা শিক্ষার্থীরাই ভালো বলতে পারবেন)। প্যারিসেও এই অপসংস্কৃতি দেখেছি, তবে আমি প্রতিবাদ করে সর্বোনের কয়েকজন শিক্ষকের প্রশ্ন করার ধরনটুকু শুধু বদলাতে পেরেছিলাম। ছাত্রদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন শিক্ষকও যে পাশ্চাত্যে দেখিনি, তা নয়, কিন্তু তাদের কথা বেশি বলছি না, কারণ আমি এখানে রোগের বর্ণনা দিতে বসেছি, স্বাস্থ্যের নয়।

কোনো পরীক্ষার্থী যদি কোনো উত্তরপত্রের ফলাফলে সন্তুষ্ট না হয়, তবে দ্রুততম সময়ে উপযুক্ত ফি-এর বিনিময়ে উত্তরপত্র পরীক্ষার্থীকে দেখানো এবং প্রয়োজনে উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকা দরকার। উত্তরের উপর পরীক্ষকের রঙিন দাগ ও মন্তব্য থাকা বাঞ্ছনীয়। পরীক্ষক একাধিক হলে একেক জন একেক রঙের কালির কলম বা পেন্সিল ব্যবহার করতে পারেন। আন্তর্জালের মাধ্যমেই স্ক্যান করা খাতা দেখানো যেতে পারে বা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীর বিদ্যায়তনে খাতা পাঠানো যেতে পারে। অতিদ্রুত উত্তরপত্র মূল্যায়নের যে বাধ্যবাধকতা বর্তমানে রয়েছে তাতে সঠিক মূল্যায়ন হয়তো ব্যহত হচ্ছে। আবার খাতা দেখতে প্রয়োজনাতিক্তি কালক্ষেপণ করাও বাঞ্ছনীয় নয়।

এক বা দুই বিষয়ে ফেল করা মানে সব বিষয়ে ফেল – মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় এই অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রতি তিন বা চার মাস পর পর পরীক্ষা নেবার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শিক্ষার্থী যেসব বিষয়ে অকৃতকার্য হবে শুধু সে বিষয়গুলোতে আবার পরীক্ষা দেবে। চুড়ান্ত পরীক্ষা বলে কিছু থাকবে না। সবগুলো বিষয়ে কৃতকার্য হলে শিক্ষার্থীকে সনদ দেয়া হবে। একেক জন শিক্ষার্থী একেক সময় ডিগ্রি শেষ করবে। বছরে একবার ডিগ্রি প্রদানের সমাবর্তন থাকতে পারে। এতে করে ব্যর্থ, ইর্ষান্বিত ও অসংস্কৃত পিতামাতার কাছ থেকে আসা চাপ কমে যাওয়াতে শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিক জীবনযাপনে সমর্থ হবে এবং অকৃতকার্যতাজনিত আত্মহত্যার সংখ্যা হ্রাস পাবে। ছাত্ররা তখনও জি.পি.এ. ফাইভ পাবে, কিন্তু সবাই সেটা জানতে পারবে না। ফলাফল প্রকাশের দিন আদেখলা অভিভাবক এবং নালায়েক মিডিয়ার বেহুদা হৈচৈ কমে যাবে এবং হাজার হাজার মন মিষ্টি খাওয়া থেকেও বেঁচে যাবে লক্ষ লক্ষ বহুমূত্রপ্রবণ বাঙালি অভিভাবক।

বিদ্যমান পরীক্ষা-ব্যবস্থার দোষে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্র হাজার হাজার মুখস্তবাজ তোতা এবং স্তাবক বুলবুলের বিচরণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। গোলায় ওঠার আগেই বাঙালির অর্জনের সব ধান এই সব তোতা ও বুলবুলির পেটে যাচ্ছে। এর অবসান ঘটাতে হলে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক স্তরেই লেখা এবং পড়া – এই দুই দক্ষতা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। লিখতে এবং পড়তে জানে না – এমন কাউকেই যেন কোনো প্রকার ভর্তি এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় যেন পাশ করানো না হয়। অন্যথায় বাঙালির উত্তরপুরুষকেও ‘বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেবো কীসে? – বলে মাথা চাপড়ে বিলাপ করতে হবে।