Scroll Top
19th Ave New York, NY 95822, USA

কেন বাংলাদেশের জয় অনেকের ‘দিলপসন্দ’ নয়?

freedom-fighter

আলোচনার সুবিধার্থে ভারতবর্ষ বা দক্ষিণ এশিয়াকে উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম এই চারটি অঞ্চলে ভাগ করে নেয়া যাক। আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ভারতবর্ষের উত্তর ভাগ নিয়ে উত্তরাঞ্চল, আর্যাবর্ত, বা উত্তরাপথ। এখানকার লোকজন লম্বাচওড়া, নূরানী চেহারা তাদের, চামড়ার রঙ সফেদ, গায়ে অনেক তাকত। বেশির ভাগ লোকের শরীরে তথাকথিত আর্যলক্ষণ সুস্পষ্ট: টিকালো নাক, অনেকের চোখের মণির রঙ জার্মান, ইতালীয় ইত্যাদি আর্য জাতির মতো নীল।

বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা এবং এর সংলগ্ন এলাকা নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বাঞ্চল বা প্রাচী। এখানকার বেশির ভাগ লোক আকারে ছোটখাটো, চেহারা চলনসই, চামড়ার রঙ কালো। অল্প পরিশ্রমে এরা হাঁপিয়ে উঠে। এদের প্রায় সবার চোখের মণির রঙ কালো। আর্য রক্তের ছিঁটেফোটা থাকলেও অনার্য রক্তের স্রোতই এদের ধমনিতে প্রবল।

প্রাগৈতিহাসিকভাবে আর্যাবর্তের লোক ধরেই নিয়েছে যে প্রাচীর অধিবাসীদের তুলনায় তারা উন্নততর প্রজাতি। প্রাচীর লোকজনও আর্যাবর্তবাসীদের পূজ্য জাতি বলে মেনে নিতে অভ্যস্ত। জম্বুদ্বীপের দেবদেবীদের অধিকাংশের চেহারা, গায়ের রঙ পাকিস্তান-আফগানিস্তান তথা আর্যাবর্তের লোকদের মতো। বেদ-উপনিষদ-গীতা ওদেরই পূর্বপুরুষের লেখা। শেরোয়ানি-বিরিয়ানি-বুরখা-গান-ভগবান-সন্ত্রাস-বোমাবাজি সব উত্তর থেকে পূর্বে এসেছে। আত্মঘাতী বোমাবাজি অবশ্য এখনও এসে পৌঁছায়নি। তবে আসতে দেরি হবে না, কারণ রোগই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়।

আফগানিস্থান-ইরান সীমান্তে অবস্থিত আর্যাবর্ত ও চীন সীমান্তে অবস্থিত প্রাচীর মধ্যে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে একটি অদৃশ্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব চলছে। আর্যাবর্ত আধিপত্যবাদী, প্রাচী স্বাতন্ত্র্যবাদী। মহাভারতের নায়ক শ্রীকৃষ্ণের সাথে প্রতিনায়ক শিশুপাল-জরাসন্ধ-পৌ-্র বাসুদেব গং এর শত্রুতারও বহু পূর্বে সম্ভবত এই দ্বন্দ্বের শুরু। পাকিস্তান আন্দোলন এই দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ এই অর্থে যে ১৯০৫ সালে প্রাচীর বাংলাভাষী মুসলমান জনগোষ্ঠী নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার প্রয়োজনে ‘পাকিস্তান’ নামক একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু আর্যাবর্তের কিছু নেতার কূটকৌশলে বাঙালি মুসলমানদের সে স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। প্রায় আড়াই দশক ধরে ‘পাকিস্তান’ নামক রাষ্ট্রযন্ত্রটিকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে প্রাচীর বাঙ্গালি জনগোষ্ঠীর উপর দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে।

জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ট আসন পাওয়া আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে না দেবার অন্তর্লীন কারণ ছিল বাঙালির প্রতি পাকিস্তানের অন্যান্য জাতি, প্রধানত পাঞ্জাবিদের বিদ্বেষ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসন ইয়াহিয়া খান নিজেও বাঙালিদের বিশেষত বাঙালির নেতৃত্বকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন। প্রেসিডেন্টের মনোভাব পরিস্কার ফুটে উঠেছে জেনারেল নিয়াজির জনসংযোগ অফিসার সিদ্দিক সালিকের স্মৃতিকথায়: গভর্নমন্ট হাউজে সুস্বাদু ভোজপর্ব সমাধা হবার পর ঘরোয়া পর্যায়ে আলাপ করার সময় ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করলেন: ‘চিন্তা করো না…এই কালো জারজেরা আমাদের শাসন করবে, আমরা কোনদিনই তা হতে দেব না।’

আশানুরূপ না হলেও সামাজিক অগ্রগতির অনেক সূচকে আর্যাবর্তের রাষ্ট্র পাকিস্তান বা ভারতের তুলনায় এগিয়ে আছে প্রাচীর রাষ্ট্র বাংলাদেশ। কয়েক দিন আগে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের কোয়াটার ফাইনালে ওঠাটাও বাংলাদেশের অগ্রগতির একটা লক্ষণ। প্রাচীর কোনো একটি জাতির এই অভূতপূর্ব সাফল্যে আর্যাবর্তের পাকিস্তানের কিছু লোক অত্যন্ত নাখোশ। বাংলাদেশের এই জয়কে খাটো করে দেখাতে গিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির ভূমিকাকে পর্যন্ত খাটো করে দেখাচ্ছে এই বলে যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জিততে বাংলাদেশকে ভারতের সহায়তা নিতে হয়েছিল। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ একাই জিতেছে। বাংলাদেশের কোনো এক কৃতি খেলোয়ারের বিরুদ্ধে বলাৎকারের অভিযোগ আনছে ওরা, যে অভিযোগ এখনও বাংলাদেশের আদালতেই প্রমাণ হয়নি। যে পরাজিত জাতি ১৯৭১ সালে নিরীহ, নিরপরাধ বাঙালি মা-বোনদের উপর অত্যাচার ও বলাৎকারের জন্যে এখনও ক্ষমা চাইবার সাহসটুকু পর্যন্ত অর্জন করতে পারেনি তাদের মুখে কোনো বাঙালির উপর মিথ্যা অপবাদ দেয়া শোভা পায় না। রমিজ রাজাদের নিন্দাজনক ও অযৌক্তিক মন্তব্যে ভুট্টো-ইয়াহিয়ার বাঙালি-বিদ্বেষী মানসিকতাই প্রতিফলিত হয়েছে।

আর্যাবর্তের অন্য একটি দেশ ভারতের কিছু লোকেরও মনপসন্দ নয় বাংলাদেশের সাফল্য। ফেসবুকে প্রচারিত একটি ভিডিওচিত্রে (মওকা, মওকা!) বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের খেলোয়ারদের চরম অপমান করা হয়েছে। বাংলাবিদ্বেষ ফুটে উঠেছিল ওপার বাংলার অভিনেতা প্রসেনজিতের মন্তব্যেও। তিনিও আর্যাবর্তের সুরেই কথা বলেছেন। আশার কথা এই যে ভারতের কিছু বুদ্ধিজীবী-অভিনেতা-ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ এ ধরনের অপরিণামদর্শী আচরণের প্রতিবাদ করেছেন। বলা বাহুল্য, কিছুু ভারতবাসীর এই বাংলাবিদ্বেষী আচরণ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাম্প্রতিক বিদেশনীতির সাথে একেবারেই সঙ্গতিসম্পন্ন নয়।

বাঙালিরা খ-িত হয়েছে, আবার স্বাধীনও হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তার জন্য বাঙালি কৃতজ্ঞ, কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ বাঙালিই করেছে। কৃতজ্ঞ থেকেও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা যায়। এখনও পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার অন্য যে কোনো জাতির তুলনায় রাজনৈতিকভাবে বাঙ্গালিরা অধিকতর সফল এই অর্থে তারা একটি ভাষাভিত্তিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে সক্ষম হয়েছে।

পৃথিবীর কোনো দেশ বা জাতির সঙ্গে অনর্থক, বালখিল্য বিরোধ নয়, সুস্থ প্রতিযোগিতাই হোক বাঙালির লক্ষ্য। আমরা ভালো খেলতে চাই এবং সম্ভব হলে জিততে চাই। কথায় নয়, কাজে হোক বাঙালির পরিচয়। আশা করা যাক, ক্রিকেটের মতো জীবনের অন্য অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের শক্তি ও স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দিয়ে বাঙালিরা দক্ষিণ এশিয়ায় অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপনে সক্ষম হবে।

Comments (5)

Leave a comment