Scroll Top
19th Ave New York, NY 95822, USA

বুদ্ধপূর্ণিমায় ধর্মভাবনা: বৌদ্ধরা সব গেল কোথায়?

buddha_sky_2_by_hanciong-d6cctvq

ঈশ্বর ও ধর্মের প্রকৃতি কেমন হবে, পৃথিবীর কোন অঞ্চলে কোন ধরনের ধর্মের উৎপত্তি হতে পারে, বা কোথায় কোন ধর্ম সগৌরবে টিকে থাকবে তা হয়তো ভূগোল ও আবহাওয়ার উপর কিছুটা নির্ভর করে। সমভূমির ঈশ্বর ও মরুভূমির ঈশ্বরের প্রকৃতি ও আচরণ এক নয়। বেশির ভাগ ধর্মেই স্বর্গ-নরক আছে, কিন্তু সব ধর্মে স্বর্গের সুযোগ-সুবিধা ও নরকের শাস্তি-যন্ত্রণা এক প্রকারের নয়। উত্তর ভারতের হিন্দু সাধুরা মাথায় জটাভার, মুসলমান-শিখ বুজুর্গরা মাথায় পাগড়ি-টুপি, হিন্দু-মুসলমান-শিখরা গ-দেশে প্রলম্বিত শ্মশ্রু রাখতে পারার একটি কারণ হয়তো এই যে তাদের বাসভূমি শীতপ্রধান। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মস্তক মু-িত এবং মুখম-ল ক্ষৌরিকৃত হবার একটি অন্তর্লীণ কারণ হয়তো এই যে উষ্ণ কিন্তু জলীয় বাষ্পবহুল বাংলা-বিহার অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের সূচনা ও বিকাশ।

ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের অধিবাসীরা এই ভেবে গর্ববোধ করতে পারে যে তাদের এলাকায় সূচিত হওয়া একটি ধর্ম ছড়িয়ে গিয়েছিল এশিয়া মহাদেশের প্রায় সর্বত্র: বাংলা-বিহার থেকে শুরু করে বেলুচিস্তান-আফগানিস্তান-ইরান-তুরস্ক এবং শ্রীলঙ্কা থেকে শুরু করে চীন-তিব্বত-কোরিয়া-কম্বোডিয়া-জাপান পর্যন্ত। উত্তর ভারতের গ্রীক রাজা মেনান্দার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। সপ্তম শতকে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং যখন ভারতভ্রমণে এসেছিলেন তখন আফগানিস্তানের জনসংখ্যার অর্ধেক ছিল হিন্দু আর বাকি অর্ধেক বৌদ্ধ। বামিয়ানে এই সেদিন পর্যন্ত সটান দাঁড়িয়েছিল পাহাড়-প্রমাণ উচ্চতার এক বুদ্ধমূর্তি। তুর্কিস্থানে, ইরানে আবিষ্কৃত হয়েছে বৌদ্ধধর্মের বহু গুরুত্বপূর্ণ পা-ুলিপি। তুর্কিরা প্রায় সবাই এবং ইরানিদের উল্লেখযোগ্য অংশ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিল। এশিয়ার সর্বশেষ প্রান্তে, জাপানের রাজধানী টোকিওর অদূরে কামাকুরায় পদ্মাসনে বসে আছেন ১২৫২ সালে নির্মিত ৪৩ ফুট উঁচু মহিমাময় চেহারার এক অমিতাভ বোধিসত্ত্ব।

লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, যেখানে বৌদ্ধধর্মের উৎপত্তি, সেই দক্ষিণ এশিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা দর্শনীয়ভাবে কমে গেছে। আশ্চর্যের বিষয়, বৌদ্ধ ইতিহাসে বিখ্যাত সব স্থান: বিহারের পাটলিপুত্র (পাটনা), রাজগৃহ (রাজগির), এমনকি বুদ্ধগয়াতেও কোনো বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব নেই। ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের অবস্থা কতটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল তার অন্যতম প্রমাণ অজন্তা। ১৮১৯ সালের ২৮শে এপ্রিল মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির ২৮তম অশ্বারোহী বাহিনীর এক অফিসার জন স্মিথ আওরঙ্গাবাদ শহর থেকে শ খানেক কিলোমিটার দূরের এক জঙ্গলে বাঘ শিকারে গিয়ে আবিষ্কার করেন অজন্তার ১০নং গুহা। ৩০টি গুহা আছে অজন্তায় যার প্রত্যেকটিতে অনিন্দসুন্দর ভাস্কর্য ও দেয়ালচিত্রে বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বদের জীবনকাহিনি বিধৃত হয়েছে। গবেষকদের মতে, চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত দীর্ঘ সময় জুড়ে এই গুহাগুলো অলঙ্কৃত হয়েছিল। সপ্তম শতকে হিউয়েন সাং অজন্তায় বাস করেছেন কিছুদিন। অষ্টম থেকে ঊনবিংশ Ñ হাজার বছরের বেশি সময় ধরে জঙ্গলের নিচে চাপা পড়েছিল অজন্তার শিল্পসম্ভার তথা ভারতবর্ষের গৌরবময় বৌদ্ধ অতীত।

ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধধর্ম হারিয়ে যাবার পেছনে কমপক্ষে চারটি কারণের কথা বলা হয়ে থাকে: ১. অন্তর্কোন্দল, ২. স্থানীয় আক্রমণ, ৩. ধর্মের বিকৃতি এবং ৪. বহিরাক্রমণ। বুদ্ধদেবের জীবনকালেই অন্তর্কোন্দলের শুরু। কী নিয়ে অন্তর্কোন্দল? এ প্রশ্নের উত্তর বর্তমান রচনার ভাটিতে দেওয়া হবে, তবে তার আগে বুদ্ধের দর্শন সম্পর্কে কয়েকটি মোটাদাগের কথা বলে নেওয়া যাক। যে তিনটি বিষয় পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মের স্তম্ভস্বরূপ: ঈশ্বর, আত্মা ও পরলোক (শেষ বিচার, স্বর্গ-নরক, পুনর্জন্ম, পুনরুত্থান ইত্যাদি) সম্পর্কে জানতে চাওয়া বুদ্ধের দৃষ্টিকোণ থেকে নিছক সময় নষ্ট। জীবন দুঃখময়, দুঃখের কারণ তৃষ্ণা এবং তৃষ্ণার কারণ অবিদ্যা। গায়ে তীর এসে বিঁধেছে। এই তীর কে ছুঁড়েছে Ñ সেটা জানার চেয়ে জরুরি হচ্ছে শরীর থেকে তীরটা খুলে ফেলা এবং ক্ষতস্থানে ঔষধ লেপন। সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক ব্যায়াম, সম্যক স্মৃতি, সম্যক সমাধি Ñ এই অষ্টমার্গ অবলম্বন করলে ধীরে ধীরে তৃষ্ণা, অবিদ্যা দূর হবে বলে দাবি করা হয়েছে বৌদ্ধ দর্শনে।

অষ্টমার্গ গৃহী ও ভিক্ষু উভয়ের জন্যে প্রযোজ্য। তবে গৃহীর তুলনায় ভিক্ষুকে অতিরিক্ত কিছু নিয়ম (‘শীল’ বা ‘বিনয়’) মেনে চলতে হয় বলে জানিয়েছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর বৌদ্ধধর্ম শীর্ষক পুস্তকে: ভিক্ষু কাম থেকে বিরত থাকবেন; ভিক্ষান্নে জীবন ধারণ করবেন; গৃহত্যাগ করে সঙ্ঘে অবস্থান করবেন; ভিক্ষুর ব্যবহৃত ভিক্ষাপাত্র হবে মাটির; ভিক্ষু পোষাক নিয়ে বিলাসিতা করতে পারবেন না; সূর্য মধ্যগগনে উপস্থিত হবার পূর্বেই ভিক্ষুকে খাদ্যগ্রহণ শেষ করতে হবে এবং ভিক্ষু দিনে একবার মাত্র খাদ্যগ্রহণ করবে এবং একই বাড়িতে পর পর দুই দিন ভিক্ষায় যাওয়া যাবে না; ভিক্ষু জাতিভেদ, বর্ণভেদ প্রথা মানবেন না; যে কোনো জাতের গৃহীর ভিক্ষা তিনি পরম শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করবেন; কী ভিক্ষা দিতে হবে গৃহীকে তা বলা যাবে না; গোমাংস, বরাহমাংস, কাঁটাযুক্ত মৎস্য… ভিক্ষান্ন যাই হোক না কেন, ভিক্ষুকে তাই গ্রহণ করে সন্তুষ্ট থাকতে হবে (যদিও কিছু কিছু প্রাণী যেমন, হস্তী, কুকুর ইত্যাদি প্রাণীর মাংস খাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে!); ভিক্ষুকে খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে প্রাণীহত্যা করা যাবে না; ভিক্ষুর জন্যে সঞ্চয় নিষিদ্ধ।

সংসার ত্যাগ করে দীর্ঘ ছয় বৎসর বিভিন্ন মত ও পথ অনুসরণ করে সাধনা করার পর এক বৈশাখী পূর্ণিমায় সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধত্ব লাভ করেন। অল্পদিনের মধ্যে তাঁর অনুগামীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। কোশলরাজ প্রসেনজিৎ, মগধরাজ বিম্বিসার ও তদীয় পুুত্র অজাতশত্রু, কৌশাম্বীরাজ উদয়ন বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল, যতক্ষণ না রঙ্গমঞ্চে উপস্থিত হলেন বুদ্ধকাহিনির অন্যতম খলচরিত্র গৌতমের জ্ঞাতিভ্রাতা দেবদত্ত। তরুণ বয়স থেকেই গৌতমের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ ছিল দেবদত্ত। কোনোমতেই গৌতমের সমকক্ষ হতে না পেরে কোনো সুযোগে তাঁর ক্ষতি করার সুযোগ পাবার আশায় দেবদত্ত কয়েকজন বন্ধুসহ বুদ্ধের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে ভিক্ষু হন।

ভিক্ষু হলে কী হবে, মনে মনে দেবদত্ত উচ্চবংশীয় শাক্যই থেকে গিয়েছিলেন। বৌদ্ধধর্মের ত্রিরতœ, অর্থাৎ বুদ্ধ, ধর্ম ও সঙ্ঘের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা ছিল না দেবদত্তের। কয়েকবার তিনি বুদ্ধের প্রাণহরণের চেষ্টা করেন। ক্রমাগত কুমন্ত্রণা দিয়ে বুদ্ধ এবং পিতা বিম্বিসারের প্রতি অজাতশত্রুর মন বিষিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন দেবদত্ত। শুধু তাই নয়, দেবদত্ত নাকি বিনয়ের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন তুলতেন: ব্রাহ্মণ আর চ-ালকে কেন এক দৃষ্টিতে দেখা হবে? আরামদায়ক কাপড় পড়লে বা ভিক্ষাপাত্র যদি স্বর্ণনির্মিত হয়, তবে তাতে সমস্যা কী? এক আধ দিন দ্বিপ্রহরের কিছু পরে খেলেই বা কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল? সঞ্চয় নিষিদ্ধ, কিন্তু পশুর শিঙের মধ্যে সামান্য পরিমাণ লবণ সঞ্চয় করে রাখলে এমন কী দোষ হয়? এ ধরনের দশটি নিয়ম (দশ মহাবস্তু) নিয়ে ভিক্ষুদের মধ্যে মধ্যে ক্রমাগত মতান্তর ও মনান্তর হতে থাকে।

বুদ্ধদেব নারীদেরও শ্রমণী হওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। সমসাময়িক বেশ কয়েকজন নগরনটী ও রাজকুমারী ভিক্ষুণী-জীবন গ্রহণ করেছিলেন। যদিও শ্রমণী ও শ্রমণেরা আলাদা গৃহে বাস করতেন, তবুও জীবনের নিজস্ব নিয়মে ব্যভিচারের কিছু অভিযোগ উঠেছিল বুদ্ধের জীবৎকালেই। এই সব অভিযোগের কারণে সঙ্ঘ ভাঙারও উপক্রম হয়েছিল একাধিক বার। কিন্তু কোনো পাপী যদি অনুতপ্ত হতো, তবে তাকে সঙ্ঘ থেকে বহিষ্কার না করার প্রশ্নে বুদ্ধদেব অনড় থাকতেন। পাপীকে নয়, বুদ্ধদেব পাপকে পরিহার করার পক্ষপাতী ছিলেন।

যারা অক্ষরে অক্ষরে বিনয় মানতে চাইতেন না তাদের বেশির ভাগই সম্ভবত দেবদত্তের মতো উচ্চবংশীয় ভিক্ষু ছিলেন। বৌদ্ধদের বিভক্তির মূল কারণ ভিক্ষুদের পূর্বাশ্রমের (অর্থাৎ ভিক্ষু হবার আগের জীবনের) জাতিভেদ। সুতরাং সমস্যাটা মূলত শ্রেণীগত। বিদ্রোহীদের নেতা ছিলেন কখনও দেবদত্ত, কখনওবা অন্য কেউ। বিদ্রোহী ভিক্ষুদের সংখ্যা যথেষ্টই ছিল, যদিও বুদ্ধদেবের উপস্থিতিতে, তাঁর জ্ঞান আর বাগবিভূতির সাথে পাল্লা দিয়ে ভিন্নমত প্রতিষ্ঠার কোনো উপায় ছিল না। নিজের জীবৎকালে বুদ্ধদেব একাধিক বার সঙ্ঘ ভেঙে বিদ্রোহী ভিক্ষুদের বেরিয়ে যাওয়া ঠেকিয়েছেন। কিন্তু অসন্তোষের তুষের আগুন যে ধিকি ধিকি জ্বলছিল তার প্রমাণ, শাস্তার (বুদ্ধদেবের) পরিনির্বাণের খবর পেয়ে এক ভিক্ষু নাকি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে ফেলেছিলেন: ‘যাক, আজ থেকে আর ঘড়ি ধরে বিনয় পালন করতে বলবে না কেউ!’

৪৮০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে বুদ্ধদেবের মৃত্যুর প্রায় একশত বৎসর পর বিহারের বৈশালী নগরীতে ভিক্ষুদের এক মহাসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় ভিক্ষুরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়: ১. স্থবিরবাদী বা থেরবাদী এবং ২. মহাসাংঘিক। কারও কারও মতে অবশ্য এই বিভক্তি বুদ্ধের জীবৎকালেই ঘটেছিল। আরও প্রায় এক শত বৎসর পর স¤্রাট অশোকের সময় (৩০৪-২৩২ খ্রীষ্টপূর্ব) বিহারের পাটলিপুত্রে আর একটি সভা হয়। এই সভায় মহাসাংঘিকদের নাকি ডাকাই হয়নি। সুতরাং মহাসাংঘিকেরা থেরবাদীদের এই সভাটিকে স্বীকারই করে না। আরও শ দুয়েক বৎসর পরে কুষাণ স¤্রাট কনিষ্কের (১২৭-১৬৩) রাজত্বকালে মহাসাংঘিকেরা পাঞ্চাবের জলন্ধরে এক সভা আহ্বান করে। এই সভায় তারাও স্থবিরবাদীদের খুব একটা আমন্ত্রণ করেনি বলে জানা যায়।

প্রথমে বিনয়ের প্রশ্নে ভিক্ষুদের মধ্যে বিভক্তি এসেছিল, কিন্তু কালক্রমে বিভক্তি এসেছিল বুদ্ধ এবং ধর্মের প্রশ্নেও। বুদ্ধদেবের শিক্ষা হচ্ছে, প্রত্যেককে অষ্টমার্গ অনুসরণ করে নিজ নিজ নির্বাণের লক্ষ্যে সাধনা করতে হবে। প্রত্যেকের জামাকাপড়ের মাপ যেমন আলাদা, প্রত্যেকের সাধনার পথও ‘এক রকম’, কিন্তু ‘একই’ নয়। বুদ্ধদেবের এই শিক্ষায় এখনও বিশ্বাস করেন থেরবাদীরা। মহাসাংঘিকেরা বলতে শুরু করলেন, বুদ্ধদেব অন্য সবাইকে উদ্ধারের জন্যেই সদ্ধর্ম প্রচার করেছেন। সুতরাং নিছক নিজের নির্বাণের চিন্তা করাটা অতি হীন কাজ। থেরবাদীরা ক্ষুদ্রচেতা, তাদের ধর্ম ‘হীনযান’। জগতের সব প্রাণীকে উদ্ধার করার পর মহাসাংঘিকেরা নিজেদের নির্বাণের কথা ভাবতে ইচ্ছুক। সুতরাং তারা উদারমনা, তাদের ধর্ম ‘মহাযান’।

কথিত আছে যে বুদ্ধ হবার আগে সিদ্ধার্থ পাঁচশত পঞ্চাশ বোধিসত্ত্ব জন্ম পার করে এসেছেন। এসব জন্মের কাহিনি বিধৃত আছে ‘জাতক’-এ। মহাযানীদের মতে, এ রকম বোধিসত্ত্ব আরও অনেক আছেন: অবলোকিতেশ্বর, অমিতাভ, মঞ্জুশ্রী… যাঁরা চাইলেই নির্বাণ লাভ করতে পারেন, কিন্তু জগতের বাকি সব প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রতি ‘করুণা’-বশত তাঁরা নির্বাণের আকাক্সক্ষা করেন না। মহাযানীরা মনে করেন, গৌতম বুদ্ধও একজন বোধিসত্ত্ব মাত্র। তবে অন্য বোধিসত্ত্বদের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য হচ্ছে, তিনি হচ্ছেন অন্য সব বোধিসত্ত্বের ‘কলম’ বা মুখপাত্র, যেহেতু তাঁর মুখ দিয়েই সদ্ধর্মের নিয়মগুলো প্রকাশিত হয়েছে। মহাযানীদের সঙ্গে থেরবাদীদের একটা ভাষাগত পার্থক্যও ছিল। বুদ্ধদেব উপদেশ দিতেন সর্বসাধারণের ব্যবহৃত প্রাকৃত ভাষায়। বৌদ্ধধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটকও রচিত হয়েছে ‘পালি’ নামক এক প্রাকৃত ভাষায়। মহাযানীরা শিক্ষিত ভদ্রলোকদের ব্যবহৃত প্রমিত ভাষা সংস্কৃত ব্যবহার করতে অধিকতর আগ্রহী ছিলেন।

মৌর্যস¤্রাট অশোক তাঁর পুত্র (মতান্তরে ভাই) মহেন্দ্র এবং কন্যা সংঘমিত্রাকে সিংহলে (বর্তমান নাম ‘শ্রীলঙ্কা’) পাঠিয়েছিলেন বৌদ্ধধর্ম প্রচারে। মহেন্দ্র আর সংঘমিত্র সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন বুদ্ধগয়ার বোধিবৃক্ষের একটি শাখা। সেই শাখা সিংহলে গত দুই হাজার বছরে কয়েক বর্গমাইলব্যাপী এক মহীরুহে পরিণত হয়েছে। বৌদ্ধধর্মের আদি থেরবাদী রূপটি সম্ভবত অক্ষুণœ আছে শ্রীলঙ্কায়। মহাযান অংশটি ছড়িয়ে গেছে পূর্ব এশিয়ার তিব্বত, চীন, মঙ্গোলিয়া, কোরিয়া ও জাপানে। থেরবাদীরা আছেন বার্মা, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও লাওসে। ভিয়েতনামে শুনেছি মহাযান ও থেরবাদ দুইই আছে।

বুদ্ধদেবের পরিনির্বাণের কয়েক শত বছর পরে বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের প্রতীক ও মূর্তিপূজা চালু হয়। বুদ্ধশরীরের ধাতু (অস্থি, দাঁত) এক জায়গায় জড়ো করে তার উপর বিশেষ ধরনের এক স্থাপত্য-কাঠামো নির্মাণ করা হয়েছিল যার নাম স্তুপ (কারও কারও মতে অবশ্য বুদ্ধ তাঁর জীবৎকালেই দুই শিষ্য সারিপুত্ত ও মৌদগল্যায়নের দেহান্তের পর তাঁদের দেহধাতুর উপর স্তুপ নির্মাণ করিয়ে পূজার ব্যবস্থা করেছিলেন!)। যাই হোক, প্রথম দিকে এই স্তুপ ছিল বুদ্ধের প্রতীক। বুদ্ধ যদিও বার বার বলেছেন, তিনি সাধারণ মানুষ এবং মানুষের জন্যে সদ্ধর্মের অনুসরণই যথেষ্ট, তবুও তাঁর মৃত্যুর পর স্তুপপূজা শুরু হয় এবং কালক্রমে দলমত নির্বিশেষে বৌদ্ধরা বুদ্ধমূর্তির উপাসনা শুরু করে যা অদ্যাবধি চলছে (এটাই স্বাভাবিক, কারণ প্রার্থনার জন্যে কোনো না কোনো মূর্তি অপরিহার্য: মাটি/কাঠ/পাথর/ধাতুর মূর্তি অথবা কথামূর্তি অথবা ভাবমূর্তি)। অজন্তায় প্রাচীনতম গুহাগুলোতে স্তুপ এবং অপেক্ষাকৃত নবীন গুহাগুলোতে বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের মূর্তি/চিত্র লক্ষ্য করা যাবে। সুতরাং যাকে আমরা আজ ‘বৌদ্ধধর্ম’ বলছি ‘বুদ্ধের প্রচারিত’ ধর্মের সঙ্গে তা টায়ে টায়ে মিলে কিনা Ñ সে প্রশ্ন উঠতেই পারে।

মৌর্যবংশের পতনের পর যে শুঙ্গবংশের প্রতিষ্ঠা হয় তার প্রথম স¤্রাট পুষ্যমিত্র ছিলেন সামবেদী ব্রাহ্মণ ও চরম বৌদ্ধবিদ্ধেষী। তিনি ভারত থেকে বৌদ্ধদের বিতাড়িত করার চেষ্টা করেছিলেন। বহু সংখ্যক পশুবলি দিয়ে অশোকের রাজধানী পাটলিপুত্রে (আজকের পাটনায়) বিশাল এক যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন পুষ্যমিত্র। এই যজ্ঞ ছিল বৌদ্ধদের অহিংসার বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের সহিংস প্রতিবাদ। হিন্দুদের হাতে বৌদ্ধরা হয় নিহত হন, অথবা ধীরে ধীরে ধর্মান্তরিত হন হিন্দুধর্মে। পূর্ব ভারতের রাজা শশাঙ্ক এমনই বৌদ্ধবিদ্বেষী ছিলেন যে তিনি নাকি বুদ্ধগয়ার বোধিবৃক্ষটাই কেটে ফেলেছিলেন (পরে সিংহল থেকে বোধিবৃক্ষের একটি শাখা নিয়ে এসে আবার রোপন করা হয় বুদ্ধগয়ার যা থেকে বর্তমান বোধিবৃক্ষ)। শশাঙ্ক আসলেই বৌদ্ধবিদ্ধেষী ছিলেন, নাকি প্রতিদ্বন্দ্বী এবং বৌদ্ধধর্মের সমর্থক হর্ষবর্ধনের প্রতি তাঁর অন্তর্লীন বিদ্বেষ বৌদ্ধবিদ্বেষ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল Ñ সে প্রশ্নও করা যেতে পারে। যাই হোক, প্রধানত থেরবাদীরাই হিন্দু রাজাদের অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন, কারণ তারা বাস করতেন পাটলিপুত্রের আশেপাশে, বুদ্ধদেব যেখানে ধর্মপ্রচার করেছিলেন। মহাযানীরা ইতিমধ্যে পশ্চিম ভারতের দিকে সরে গিয়েছিল। সেখানে শক, যবন, পহ্লব প্রভৃতি জাতির শাসন ছিল। মহাযানীরা সেসব জাতিকে নিজেদের ধর্মে দীক্ষিত করার চেষ্টা চালায় এবং তাতে অনেকটা সফলও হয়। থেরবাদীদের সঙ্গে মহাযানীদের মতান্তর সপ্তম শতকেও অব্যাহত ছিল, কারণ রাজা হর্ষবর্ধন পরিব্রাজক হিউএন সাংকে এই দুই দলের ঝগড়া মেটানোর কাজে নিয়োগ করেছিলেন।

পূর্বভারতে তন্ত্র নামে এক ধর্মমত ছিল যাতে নারী-পুরুষ শরীরকে মোক্ষলাভের উপায় হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তান্ত্রিকেরা ভাবতেন, পুরুষ শরীর শিব আর নারী শরীর শক্তির প্রতীক। শিব আর শক্তির মিলনে কৈবল্যের সাধনা। এক সময় তন্ত্র আর মহাযান বৌদ্ধমত মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। বিকৃত হয়ে যায় সদ্ধর্মের মূল রূপ। ‘তারা’ নামে প্রত্যেক বোধিসত্ত্বের এক একটি শক্তি কল্পনা করা হয়। বোধিসত্ত্ব ও তারার মূর্তির হাত, পা, মাথার সংখ্যা বাড়তে বাড়তে হাজার ছাড়িয়ে যায়। কিছু কিছু মূর্তিতে বোধিসত্ত্ব ও শক্তি বিচিত্র ভঙ্গীতে মিথুনাবদ্ধ। কোনো কোনোটিতে এক বোধিসত্ত্বের সঙ্গে আলিঙ্গনাবব্ধ শক্তি নতুন এক বোধিসত্ত্ব প্রসব করছেন। এ ধরনের কিছু মহাযানী মূর্তিকে ‘বিভৎস’ বলে বর্ণনা করেছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।

কোনো অর্থকরী পেশা গ্রহণ করা ভিক্ষুদের জন্যে নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু কালক্রমে ভিক্ষুরা কারুশিল্পীর মতো ছোটোখাটো পেশা গ্রহণ করতে থাকে। দু পয়সা জমিয়ে অনেকে কমবেশি বড়লোকও হয়, ইওরোপের ইতিহাসে বুর্জোয়াদের মতো। উদ্বৃত্ত অর্থ থাকলে মানুষ চায় আরাম Ñ শরীরের ও মনের। এক সময় মহাযানী ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে শুরু করেন। নিজেদের শরীরকেই তারা নির্বাণ লাভের উপায় হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন। এই মহাযানীদের একটি শাখা বাংলা অঞ্চলের সহজিয়া বৌদ্ধধর্ম। বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ মূলত সহজিয়াদের ধর্মসঙ্গীত। সমাজবহির্ভূত, অশ্লীল ধর্মাচরণের কারণে সহজিয়া মহাযানীরা সম্ভবত তথাকথিত ভদ্র সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এদেরই একটি অংশ সম্ভবত বৈষ্ণব এবং/অথবা বাউলে রূপান্তরিত হয়েছিল।

ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের উপর সর্বশেষ এবং মরণান্তক আঘাতটি করেন বঙ্গদেশে নবাগত তুর্কি ও আফগান শাসক-সেনানায়কেরা যাদের পূর্বপুরুষ এক সময় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল। ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে বখতিয়ার খিলজির নেতৃত্বে তুর্কি সৈন্যরা নালন্দা ও ওদন্তপুর বিহারের হাজার হাজার নিরস্ত্র, মু-িতমস্তক ছাত্র-শিক্ষক ভিক্ষুকে ‘কতল’ করার পর বিহারগুলো ধ্বংস করে। কিছু ভিক্ষু সম্ভবত পালিয়ে যেতে সক্ষম হন নেপাল, তিব্বত ইত্যাদি চীন-সীমান্তবর্তী এলাকায়। ধারণা করা যায় যে পলায়নপর ভিক্ষুরা সঙ্গে করে কিছু পুঁথিপত্র নিয়ে যেতে পেরেছিলেন, যার মধ্যে একটি Ñ (বাংলা ভাষার প্রাচীন নির্দশন) চর্যাপদ ঊনবিংশ শতকে নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগারে আবিস্কৃত হয়।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের কথা বাদ দিলে, বাংলার অন্যত্র এবং উড়িষ্যায় বৌদ্ধধর্মের সর্বশেষ রূপ ধর্মঠাকুরের পূজা। ধর্মঠাকুরের মূর্তি কচ্ছপের মতো। এই কচ্ছপ আর কিছুই নয়, বৌদ্ধধর্মের প্রথম দিকের সেই স্তুপ। এক সময় স্তুপের চেহারা দাঁড়ায় মন্দিরের মতো। মন্দিরের চারপাশে চারটা কুলুঙ্গি। চার কুলুঙ্গিতে চারজন ধ্যানীবুদ্ধ: পূর্বে অক্ষোভ্য, পশ্চিমে অমিতাভ, দক্ষিণে রতœসম্ভব এবং উত্তরে অমোঘসিদ্ধি। প্রথমে এই (মহাযানী) স্তুপে গৌতম বুদ্ধের স্থান ছিল না, কারণ তিনিতো অন্য বুদ্ধদের মুখপাত্র বৈ আর কিছু নন। পরে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে গৌতমের জন্যেও একটা কুলুঙ্গি কাটা হয়। পাঁচ কুলুঙ্গিওয়ালা স্তুপ (চার পা ও এক মাথা) কচ্ছপের আকার ধারণ করে। ধর্মঠাকুরের ভক্তদের একটি অংশ সম্ভবত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল, কারণ রামাই প-িতের ধর্মঠাকুরের পাঁচালিতে আছে: ‘ধর্ম হইল যবনরূপী, মাথায়েতে কাল টুপি, হাতে শোভে তীরুচ কামান।’

শাস্ত্রী মনে করেন, উড়িষ্যার পুরীর মন্দিরের জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলরাম মূলতঃ বৌদ্ধধর্মের ত্রিরতœ: বুদ্ধ, ধর্ম ও সঙ্ঘ। শাস্ত্রী মহাশয়ের দাবি যদি সঠিক হয়, তবে বাংলা-উড়িষ্যা অঞ্চলের রথযাত্রার মধ্যে বৌদ্ধধর্ম অধ্যাবধি সগৌরবে (যদিও প্রচ্ছন্নভাবে) টিকে আছে। এছাড়া বাউলদের সাধন-ভজন-গানের মধ্যেও বৌদ্ধধর্ম কিছু পরিমাণে টিকে আছে বৈকি। বাউলদের জাতপাত না মানা, দেহের খাঁচার ভিতর অচিন পাখি খোঁজা, শরীরকে সাধনার যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা… ইত্যাদিকে মূল বৌদ্ধধর্মের বা মহাযানী বৌদ্ধধর্মের কিছু কিছু আচার ও বিশ্বাসের আধুনিক রকমফের বললে অত্যুক্তি হয় না। বাংলা অঞ্চলে হিন্দুমুসলমান নির্বিশেষে বাউলগানের জনপ্রিয়তা এবং বাউল সমাজের কিছু রীতিনীতির কথা যদি ভাবি, তবে বলতে হয়, বাঙালি মনে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব এখনও একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়নি।

Comments (8)

https://prednisonebuyon.com/ – can you take tylenol with prednisone

viagra y para que sirve

Alkaline water has been touted to have benefits for people with cancer and for cancer prevention, but what does the research say priligy 30 mg

Leave a comment