গত কয়েক বৎসর যাবৎ উভয় বাংলার লেখ্য, দৃশ্য ও শ্রাব্য গণমাধ্যমে ‘ভাষাদূষণ’ অন্যতম আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বলা হচ্ছে, নতুন প্রজন্মের একটি অংশ ইংরেজি ঢঙে এবং অন্য একটি অংশ আঞ্চলিক ঢঙে বাংলা শব্দ বা বাক্য উচ্চারণ করছে এবং বাংলা বলার সময় তারা ইংরেজি ও আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই দূষণের কারণে বুড়িগঙ্গা নদীর মতো বাংলাভাষাও অনতিবিলম্বে ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে: ১) ভাষাব্যাবহারের এই প্রবণতাগুলোকে ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থকে আদৌ দূষণ বলা যাবে কিনা, এবং ২) দূষণের গুজব বাংলাভাষার গুরুতর কোনো সমস্যাকে আড়াল করছে কিনা।
ভাষাদূষণের জন্যে সাধারণত এফ এম রেডিও ও বিশেষ কয়েকটি নাটক-সিরিয়ালের লেখক-পরিচালককে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ইংরেজি ও ফরাসিভাষী অঞ্চলে শত শত এফ. এম. রেডিওর ‘দো-আঁশলা’ ইংরেজি-ফরাসি উচ্চারণের এতটুকুও প্রভাব পড়েনি ইংরেজি বা ফরাসির প্রমিত উচ্চারণে। যারা ইংরেজি ঢঙে বাংলা বলেন তাদের সংখ্যা এত বেশি নয় যে উভয় বঙ্গের প্রায় ত্রিশ কোটি বাংলাভাষীর উচ্চারণকে তারা বদলে দেবে। আঞ্চলিকতার গন্ধযুক্ত বা গন্ধমুক্ত প্রমিত বাংলা যারা বলে তাদের উচ্চারণও অদূরভবিষ্যতে বদলাবে না, কারণ কোনো ভাষাগোষ্ঠীর ধ্বনিতাত্ত্বিক কাঠামো স্বল্প সময়কালে পরিবর্তন হয় না। প্রতিটি অঞ্চলের (চট্টগ্রাম, সিলেট, বীরভূম, মেদিনীপুর…) বিশেষ উচ্চারণভঙ্গীতে যত সংখ্যক লোক প্রমিত বাংলা বলে থাকে তাদের সংখ্যাও প্রমিত বাংলার ধ্বনিতত্ত্বকে বদলে দেবার জন্যে যথেষ্ট নয়।
উপভাষাগুলোর উচ্চারণরীতির সম্মিলিত প্রভাবে প্রমিত বাংলার উচ্চারণরীতি অবশ্যই পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু এই পরিবর্তনের স্বরূপ কী হবে তা আগামি কয়েক শ বছর পরে ছাড়া বলা যাবে না। উপভাষার উচ্চারণের প্রভাবে প্রমিত ভাষার পরিবর্তন অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ব্যাপার এবং বাংলা ভাষার বিবর্তনের স্বার্থেই এ পরিবর্তনটি ঘটা জরুরি। রোমান সা¤্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীরা নিজ নিজ আঞ্চলিক উচ্চারণে ল্যাটিন বলতো বলেই ফরাসি, স্পেনিশ, ইতালিয়ান ইত্যাদি ভাষার উদ্ভব হয়েছিল। ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীরা বিভিন্ন আঞ্চলিক উচ্চারণে সংস্কৃত বলতো বলেই কালক্রমে বাংলা, হিন্দি, মারাঠি ইত্যাদি ভাষার উদ্ভব হয়েছে।
যে কোনো মানব ভাষাই শঙ্কর ভাষা এবং জীবিত সব ভাষা প্রতিনিয়ত শঙ্করায়নের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। শুধু সংস্কৃত বা ল্যাটিনের মতো মৃত ভাষারই শঙ্করায়ন থেমে গেছে চিরদিনের মতো। ভাষার সৃষ্টি ও ক্রমবিকাশ অনেকটা দই পাতার মতো। পুরোনো দই এর সঙ্গে নিত্যনতুন দুধ মিশে যেমন দইয়ের কলেবর বাড়ে তেমনি ভাষাকেও প্রতিনিয়ত মৃত বা জীবিত কোন ভাষা থেকে শব্দরূপ প্রাণরস সংগ্রহ করতে হয়। বাংলা এককালে ঋণ নিয়েছে সংস্কৃত, ফারসি থেকে, এখন ব্যাপক হারে ঋণ নিচ্ছে ইংরেজি থেকে। থাইল্যান্ড, চীন, মালয়েশিয়া, কোরিয়া… সব দেশের প্রমিত ভাষায় ইংরেজি শব্দ ঢুকছে।
শব্দঋণের দুটি উপায় আছে: ১. সরাসরি ঋণ (যেমন, মোবাইল, পিৎজা) ও ২. অনুবাদ ঋণ (যেমন, দূরদর্শন বা মুঠোফোন)। চীনা ভাষার বিশেষ ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের কারণে সরাসরি ঋণ নেওয়া সম্ভব হয় না বলে বিদেশি শব্দ সাধারণত অনুবাদ করে নেয়া হয়। এ জন্যেই মনে হয়, চীনা ভাষায় কোনো বিদেশি শব্দ নেই। বাংলা বা জাপানি ভাষায় ইংরেজি শব্দ ঋণ নিতে ধ্বনিতাত্ত্বিক দিক থেকে কোনো অসুবিধা নেই বলেই এত এত ইংরেজি শব্দ সরাসরি বাংলা ও জাপানি শব্দকোষে প্রবেশ করছে।
শব্দমিশ্রণ ভাষার প্রকাশশক্তিকে দুর্বল করে না বরং সবল করে। অন্য ভাষা থেকে শব্দ নিয়ে নিজের মতো করে ব্যবহার করতে পারাতেই ভাষার শক্তির প্রকাশ। কোনো ভাষায় তথাকথিত বিদেশি শব্দ ব্যবহৃত হলেই যদি সেটি তার সৌন্দর্য হারায় তবে ইংরেজির কোনো সৌন্দর্যই থাকার কথা নয়, কারণ এর সিংহভাগ শব্দ ফরাসি ও ল্যাটিন থেকে এসেছে। শব্দমিশ্রণ উদ্বেগজনক কোনো সঙ্কট হলে, ইংরেজি বহু আগেই ফরাসি শব্দের স্রোতে হারিয়ে যেতো। শব্দকোষ নয়, ভাষার ভিত্তি হচ্ছে ব্যাকরণ। ইংরেজি ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্ব ইংরেজির ইংরেজিত্ব বজায় রেখেছে আবার ফরাসি-ল্যাটিন শব্দ দিয়ে ভাষাটিকে সমৃদ্ধও করেছে। বাংলার ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হবার কোনো কারণ নেই। কোনো বিদেশি শব্দ বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের নিয়মানুসারে পরিবর্তিত না হয়ে বাংলা শব্দকোষে স্থায়ী আসন নিতে পারবে না। উদাহরণস্বরূপ, বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত সংস্কৃত শব্দ ‘চন্দ্র’, ‘অভিমান’ বা ইংরেজি শব্দ ‘চেয়ার’, ‘টেবিল’ এর উচ্চারণ এতটাই বঙ্গীকৃত হয়েছে এগুলোকে সংস্কৃত বা ইংরেজি শব্দ বলে মনেই হয় না।
সমাজের দ্বিভাষী ব্যাক্তিদের ভাষায় অবচেতনভাবে ‘ভাষামিশ্রণ’ শুরু হয় এবং কালক্রমে তা সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে যায়। বাঙালিদের নিকট পূর্বপুরুষদের একাংশ ফার্সি ভাষা জানতো বলেই বাংলা শব্দকোষে এত ফার্সি শব্দ স্থান পেয়েছে। বাঙালিদের দূর পূর্বপুরুষদের একাংশ সংস্কৃত ভাষা জানতো বলেই বাংলায় এত সংস্কৃত শব্দ ব্যবহৃত হয়। এভাবেই ‘হাওয়া’, ‘সিন্দুক’, ‘বই’, ‘কলম’, ‘কাগজ’… বাংলা শব্দকোষের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। ফারসি ‘লাল’ সংস্কৃত তদ্ভব শব্দ ‘রাতা’-কে বিদায় করেছে? আরবি ‘হাওয়া’ সংস্কৃত তৎসম ‘বায়ু’ আর তদ্ভব ‘বাতাস’ এর সাথে সহাবস্থান করছে। ‘বিয়েশাদি’ শব্দে সংস্কৃত তদ্ভব শব্দ ‘বিয়ে’ ফার্সি শব্দ ‘সাদি’’র সাথে চমৎকার ‘লিভ টুগেদার’ করছে।
ইংরেজি-শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা ইচ্ছে করে, স্মার্টনেস দেখানোর জন্য বাংলা বলা সময় ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছে না। তারা তাদের মনের ভাবগুলো বাংলা শব্দে প্রকাশ করতেই শেখেনি। ইংরেজি শব্দ মিশ্রণ বা ইংরেজি ঢঙে বাংলা বলা যদি দূষণের প্রমাণ হয়, তবে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শিক্ষানীতিই সেই দূষণের জন্যে দায়ী। তরুণ প্রজন্ম যদি ইংরেজিতে শিক্ষাগ্রহণ করে থাকে তবে ইংরেজি তার চিন্তার ভাষায় পরিণত হয় এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে ভাবের বাহন হিসেবে ইংরেজি শব্দ চলে আসে তাদের ব্যবহৃত বাংলায়। তরুণদের এই স্বাভাবিক আচরণ যদি কর্তৃপক্ষের না-পছন্দ হয় তবে অনতিবিলম্বে বাংলা ভাষাকে শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম করে তুলতে হবে এবং ইংরেজিকে বিদেশি ভাষা হিসেবে শেখাতে হবে।
ভাষার কোনো একটি রূপ শ পাঁচেক বছরের বেশি বোধগম্য থাকে না। সুতরাং চর্যাপদ বা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষার মতো প্রমিত বাংলা উপভাষাটির মৃত্যুও ঠেকানো যাবে না। একে দীর্ঘজীবী করতে হলে আদালত, শিক্ষা, প্রশাসন ও ব্যবসা সহ সমাজের সর্বস্তরে জগতে এই উপভাষাটির ব্যবহার লাভজনক ও বাধ্যতামূলক করে তুলতে হবে। বিচিত্র পেশার মানুষ যখন তাদের বিচিত্র প্রয়োজন মেটাতে প্রমিত বাংলা ব্যবহার করবে তখন এর শব্দকোষ ও ব্যাকরণ বহুগুন সমৃদ্ধ হবে। ভাষাদূষণ বলে যদি কিছু থাকেও (বর্ষাকালে বুড়িগঙ্গার মতো) সে দূষণ অবিলম্বে দূর হবে।
দূষণের গুজব প্রমিত বাংলার প্রধান দুটি সমস্যাকে আড়াল করে রাখছে: ১. সর্বস্তরে উপভাষাটির প্রয়োগ নেই এবং ২. এর অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা নেই। সর্বস্তরে প্রমিত বাংলা প্রচলনের সাথে উপভাষাটির অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার সম্পর্ক আছে এবং এই উভয়ের সাথে সম্পর্ক আছে এর দীর্ঘজীবীতার। প্রমিত বাংলা ভাষার অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা আর বাংলাভাষীর অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
Plaquenil
cialis on line
hydroxychloroquine online prescription
buy azithromycin 500mg
Levitra Generique Pas Cher
Cialis Pas Generique
the gasoline buy propecia 5mg Not all patients with asymptomatic microhematuria require RBUS