Scroll Top
19th Ave New York, NY 95822, USA

মিত্রদেশের ভিসা

Border

৪৭-এর দেশভাগ যদি মেনে নিই, তবে স্বীকার করতেই হয় যে ‘দেশ’ আগে একটাই ছিল। পৈত্রিক উঠানে বেড়া দিয়ে দুই আপন ভাই যখন ভিন্ন হয়, তখন এক ভাইয়ের বাড়িতে যেতে অন্য ভাইয়ের অনুমতি নিতে হয়, ঠিক যেমন করে মিত্রদেশে যেতে আমাদের ভিসা লাগে।

বছর চারেক আগে মিত্রদেশের সরকার ভিসা প্রদানের প্রক্রিয়াটিকে সহজতর করতে চাইলেন। নতুন ব্যবস্থায় প্রথমে আবেদনপত্র পূরন করে আন্তর্জালে টোকেন নিতে হবে। তারপর কাগজপত্র জমা দিতে হবে দূতাবাস কর্তৃক নির্ধারিত এজেন্সিতে। আগে ভিসার জন্যে কোনো ফি ছিল না। এখনও নেই, তবে ভিসা প্রসেসিং-এর জন্যে আবেদনকেন্দ্রে ৬০০ টাকা জমা দিতে হবে। ডিজিটাল ব্যবস্থায় সরাসরি খাওয়া যায় না, মাথার পিছন দিকে হাত ঘুরিয়ে চামচ দিয়ে খেতে হয়! ডিজি ‘টাল’ হলে যা হয় আর কি!

কয়েক বছর যাবৎ নির্দিষ্ট কিছু কম্পিউটার থেকে আবেদন করলেই নাকি শুধু টোকেন পাওয়া যায়। এই কম্পিউটারগুলোর মালিক কিছু মধ্যস্বত্বভোগী দালাল বা ভদ্রভাষায় বললে ‘ভ্রমণ-সহকারী’ এজেন্ট। ২০১৩ সালে টোকেনপ্রতি দালালদের দিতে হতো ৩০০ টাকা। ২০১৪ সালে তাদের সম্মানী বেড়ে দাঁড়ালো ১০০০ এবং ২০১৫ সালে ৩৫০০ টাকা। টোকেন-সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্যে গত কয়েক বছরে পত্রপত্রিকায় বহু লেখালেখি হয়েছে, একাধিক সমাধানও বাতলানো হয়েছে।

মিত্রদেশ ও বাংলাদেশের কোনো না কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজস ছাড়া এটা যে সম্ভব নয় সে কথা পাগলেও বোঝে। কিন্তু তাঁদের বক্তব্য শুনলে মনে হয়, এক একজন তাঁরা শিবলিঙ্গের গায়ে লেপটানো চন্দনমাখা ‘ধোয়া তুলসী পাতা’। তাহলে দায়ী কে? যত দোষ, দালাল ঘোষ! ১০টি ভিসা আবেদন কেন্দ্র থেকে প্রতি দিন যদি ২০০০ ভিসা দেওয়া হয়, তবে অসহায় জনগণের পকেট কেটে দালালচক্রের দৈনিক বেআইনি গড় আয় ৬ লক্ষ টাকা। এই high commission একা দালালেরাই খাচ্ছে – এ কথা বিশ্বাস করা শক্ত।

২০১৪ সালে মতিঝিলে ব্যর্থ হয়ে ভিসার আবেদনপত্র জমা দিতে গিয়েছিলাম গুলশানে। আবাসিক এলাকার ধুলিধুসরিত রাস্তায় কয়েকটি লাইনে রোদের মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা কয়েক শ লোক। মাঝেসাজেই বড় বড় গাড়ি ঢুকছে এবং আমাদের লাইনগুলোকে বাঁকাতে হচ্ছে অজগরের মতো। এখানে ওখানে ‘ছিইল্লা-কাইট্টা লবন লাগাইয়া’ শশা বিক্রি হচ্ছে। বাদামওয়ালা, আইসক্রিমওয়ালা, একাধিক ঝগড়াটে ব্যাগজমাওয়ালি মিলিয়ে রীতিমত এক মিনি কুম্ভমেলা যেন বসে গেছে মিত্রদেশের দূতাবাসের সামনে। ভিসা দেবার জন্যে এভাবে মেলা বসানোর কোনো বিকল্প কি বের করা যায় না?

আশেপাশে দাঁড়ানো ভিসাপ্রার্থীদের কথোপকথন শুনছিলাম। একজন বললো: ‘ভিসা হেরা তুইলা দিলেইতো পারে!’ শুনে আর একজন উত্তর দিলেন: ‘ভিসা তুইলা দিলে পাকিস্তান-আফগানিস্তান-বাংলাদেশের যত জঙ্গী হ¹লে ভারতে গিয়া হান্দাইব। আমরা মোছলমানরা মানুষত ভালা না!’ ‘আরে, রাহেন মিয়া। বদমাইসের আবার হিন্দু-মোছলমান কি? সীমান্ত পার অইতে জঙ্গীগো পাসপোর্ট-ভিসার দরকার পড়ে না!’ – অন্য এক শ্রোতার রাগতঃ মন্তব্য। ২০১২ সালে বেনাপোল সীমান্তে এক দালাল আমাকে বলেছিল বটে: ‘বেহুদা কেন পার্সপোর্ট-ভিসার ঝামেলায় যান স্যার। আমরাইতো পার করে দিতে পারি!’

এপয়েন্টমেন্ট ছিল দশটায়। কমপক্ষে চারবার লাইন বদলে, ঘণ্টা দুয়েক একতলা-দোতলা-তিনতলা-চারতলার এক্কাদোক্কা খেলে অবশেষে দুপুর একটায় কাগজপত্র দেখানোর সুযোগ পেলাম। উত্তেজনায় আমার নিঃশ্বাস দ্রুততর হচ্ছে, এবারও না আটকে যাই। যেখানে সন্ধ্যা হয়, সেখানেই বাঘের ভয়! ‘আপনার পাসপোর্টে কি এই ক্রেডিট কার্ডটি এনডোর্স করা আছে?’ কর্মকর্তা প্রশ্ন করলেন। হায়! পাসপোর্টে ডলার এনডোর্স করা হয় জানি, কিন্তু ক্রেডিট কার্ডও যে এনডোর্স করা যায় বা করতে হয় বা করা যায়, তা আমার জানা ছিল না। এ রকম বহু বিচিত্র বালখিল্য অজুহাতে ভিসার আবেদনপত্র জমা না নিতে পারে। কাগজপত্র বাতিল হলে জমা দেওয়া টাকা কিন্তু আর ফেরৎ পাবেন না। আবেদনপত্র জমা নিলেও কি ভিসা পাবার কোনো নিশ্চয়তা আছে? সপ্তাহখানেক পর ফের লাইন ধরে যখন পাসপোর্ট ফেরৎ নেবেন, তখন হয়তো মফিজ হয়ে দেখবেন পাসপোর্টের পাতায় ভিসার নামগন্ধ নেই! (কোনো কারণ দর্শাতে মিত্রদেশ বাধ্য নয়!) তখন পুনর্মুষিক ভবঃ! টাকা দিয়ে ফের টোকেন নাও, লাইনে দাঁড়াও, প্রসেসিং ফি দাও। নাকের বদল নরুণ পেলাম, টাক ডুমাডুম ডুম!

ভিসার চাহিদা যেহেতু বেশি সেহেতু আরও বেশি সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারি নিয়োগ দিলেই হয়। মিত্রদেশ কেন তা করে না? বাংলাদেশের ভ্রমণকারীরা প্রধানত যায় মিত্রদেশের বাংলাভাষী প্রদেশে। গুচ্ছের ডলারের সিংহভাগ সেখানেই তারা খরচ করে। ব্যাপারটা হয়তো উত্তরাখ-ের নীতিনির্ধারকদের দিল-পসন্দ নয়। মহাভারতে আছে, উত্তরাখ-ের রাজন্যবর্গের নেতা শ্রীকৃষ্ণ পূর্বভারতের রাজা জরাসন্ধকে অন্যায় যুদ্ধের পর শরীরের মধ্যভাগ বিচ্ছিন্ন করে হত্যা করিয়েছিলেন। পূর্বভারতে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অন্যতম শক্তিশালী জাতি বাঙালিদের দুই অংশের মধ্যে বেশি মেলামেশা হলে তাদের মধ্যে বিভক্তি দূর হয়ে নতুন কোনো ভূরাজনৈতিক সমীকরণ শুরু হতে পারে – উত্তর ভারতের নেতাদের মনের অন্তর্লীন স্তরে এমন কোনো শঙ্কা নেইতো?

ভিসা, পাসপোর্ট, সীমান্ত ইত্যাদি প্রশাসনিক সংস্কৃতি জাতিরাষ্ট্রের ধারণার সাথে অঙ্গাঙ্গী জড়িত। জাতিরাষ্ট্রভিত্তিক ইওরোপে বহু যুদ্ধ হয়েছে, বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে দুই দুইটি। অবশেষে একটি জাতিনির্বিশেষ অর্থনৈতিক জোট গঠনের মাধ্যমে ইওরোপ জাতিরাষ্ট্রের ধারণা বাতিল করার পথে এগোবার চেষ্টা করছে। সম্মিলিত ইওরোপে সীমান্তপ্রথা বিলুপ্তপ্রায়। এক কালে পোল্যান্ড থেকে জার্মানি যাবার সময় পাসপোর্ট-ভিসা চেক করাতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো ভ্রমণকারীদের। এখন বোঝাই যাবে না, কোথায় দুই দেশের সীমান্ত।

আজ প্রশ্ন উঠছে: সীমান্ত কি পৃথিবীব্যাপী চোরাচালান ও মানবপাচার রোধ করতে পেরেছে? বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে প্রতি বছর কত লোকের প্রাণহানী হয়? রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে, অপরাধ দমনে সীমান্ত কার্যকর কোনো সমাধান নয়। সমস্যা অবশ্যই আছে। ফ্রান্স বা জার্মানিতে অপরাধ করে অনেক অপরাধী পালিয়ে আশেপাশের দেশগুলোতে চলে যায়। কিন্তু ভদ্রলোকদের উপর ভিসা নেবার বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে দেওয়া যে এ সমস্যার সমাধান নয় তা বোঝার মতো জ্ঞান ও কা-জ্ঞান ইওরোপের রাষ্ট্রনায়কদের হয়েছে।

জনগণের সর্ববিধ মুক্তির লক্ষে কাজ করবে রাষ্ট্র ও সরকার। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও ঘৃণায় জর্জরিত এবং একাধিক যুদ্ধ ও বিশ্বযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত জার্মানি আর ফ্রান্স যদি পাসপোর্ট-ভিসার প্রশাসনিক নিগড় থেকে তাদের জনগণকে মুক্তি দিতে পারে, জন্মগত মিত্রতার সূত্রে আবদ্ধ বাংলাদেশ-ভারত কেন তা পারবে না?

Comments (8)

Leave a comment