Scroll Top
19th Ave New York, NY 95822, USA

কুমিরার যুদ্ধ

1971-Bangladesh-soldiers

প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রটি যে দু’টি দুরারোগ্য রোগে ভুগে চলেছিল তার একটি ছিল প্রাসাদ যড়যন্ত্র আর অন্যটি ছিল সামরিক শাসন। দীর্ঘ সামরিক শাসনে ক্লান্ত, অবসন্ন (উভয়) পাকিস্তানের জনগণ অবশেষে ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিল। এই নির্বাচনে পাকিস্তানের মোট ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন পেয়ে একমাত্র আওয়ামী লীগই পুরো পাকিস্তানের সরকার গঠন করতে সক্ষম ছিল। কিন্তু ভুট্টো তাতে রাজি ছিলেন না। রাজি ছিলেন না পশ্চিম পাকিস্তানের বাদবাকি নেতারাও। তাদের রাজি না হওয়ার প্রধান কারণ বাঙালির প্রতি অন্যান্য জাতি, প্রধানত পাঞ্জাবিদের জাতিগত বিদ্বেষ (এটি মূলত পূর্ব ভারতের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতি উত্তর ভারতের আর্য্য জাতিগোষ্ঠীর প্রাগৈতিহাসিক ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ)। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসন ইয়াহিয়া খান নিজেও বাঙালিদের বিশেষত বাঙালির নেতৃত্বকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন। প্রেসিডেন্টের মনোভাব পরিস্কার ফুটে উঠেছে জেনারেল নিয়াজির জনসংযোগ অফিসার সিদ্দিক সালিকের স্মৃতিকথায়: গভর্নমন্ট হাউজে সুস্বাদু ভোজপর্ব সমাধা হবার পর ঘরোয়া পর্যায়ে আলাপ করার সময় ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করলেন: ‘চিন্তা করো না…এই কালো জারজেরা (Black bastards) আমাদের শাসন করবে, আমরা তা কোনদিনই হতে দেব না।’
পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশনের তারিখ নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে গড়িমসি করার পর ১লা মার্চ তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলেন। এর ফলশ্রুতিতে ২রা মার্চ থেকে পুর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলো। চট্টগ্রামের কুমিরা গ্রামের অধিবাসী কানাই লাল চক্রবর্ত্তী লিখেছেন (শরণার্থীর দিনলিপি, পৃষ্ঠা ১৭):

‘যানবাহন, অফিস আদালত, কলকারখানা, এমনকি আরক্ষা বিভাগ (থানা) ও বন্ধ হইয়া যায়। বলা বাহুল্য, কোনো লোক হয়ত দূর-দূরান্তে তার আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবদের বাড়ীতে গিয়েছে। সে সেই স্থানেই রহিয়া গেল। এইরূপ দৃষ্টান্ত অনেক। জিনিষপত্রের চড়াদাম ও দোকানপাট প্রায় বন্ধ। এইভাবে ২৫/৩/৭১ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চলিল।’

২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। এর আগেই তিনি বাঙালিদের অসহযোগ আন্দোলন স্তব্দ করে দেওয়ার জন্য ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক একটি সামরিক হামলার পরিকল্পনা অনুমোদন করেন। হামলার সময় নির্ধারণ করা হয় ২৫শে মার্চ দিবাগত রাত্রে অর্থাৎ ২৬শে মার্চ রাত ১টায়। জেনারেল খাদিম রাজা ও জেনারেল ফরমানের উপর এই অপারেশনের দায়িত্ব দেয়া হয়। এর কিছু দিন আগে থেকেই ভারত তার সীমারেখার উপর দিয়ে পাকিস্তানি বিমান উড্ডয়ন নিষিদ্ধ করেছিল। সুতরাং পাকিস্তানের কোনো এক অংশে আসার জন্য পাকিস্তান এয়ার লাইন্সের (পি.আই.এ.) বিমানকে শ্রীলঙ্কা ঘুড়ে আসতে হতো। ইয়াহিয়ার পি.আই.এ. ফ্লাইট কলম্বো পৌঁছানোর আগেই, নির্ধারিত সময়ের প্রায় দেড় ঘন্টা আগে, রাত ১১টা ৩০ মিনিটে ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইট শুরু হয়। রকেট ল্যাঞ্চার, মেশিনগান ও মর্টার ব্যবহার করে রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পুরোনো ঢাকায় অসংখ্য লোককে হত্যা করা হয়। ২৫শে মার্চ রাত শেষ হবার আগেই সমস্ত রকম বিরোধিতা নিশ্চিন্ন হয়ে ঢাকার উপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য শহরের বিরোধীদের শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে ২৫শে মার্চ মার্চ রাতেই শুরু হয় অপারেশন সার্চলাইট-২। কয়েকটি শহর যেমন, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও পাবনার পরিস্থিত ছিল পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের জন্য ‘খুবই উদ্বেগজনক’। পাকিস্তানিদের দৃষ্টিকোণ থেকে চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ছিল বিশেষভাবে নাজুক, কারণ সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈনিকের সংখ্যা ছিল মাত্র ৬শত এবং বাঙালি সৈনিকের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ হাজার। চট্টগ্রামের নাজুক অবস্থা সামাল দেবার জন্য জি.ও.সি. টিক্কা খান ২৫শে মার্চ রাতেই কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত ৫৩তম ব্রিগেডের অধিনায়ক ইকবাল শফিকে চট্টগ্রামের দিকে এক দল সৈন্য পাঠিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আদেশ পাওয়ামাত্র লেফটেনেন্ট কর্ণেল শাহপুর খানের অধিনায়কত্বে এফ. এফ. রেজিমেন্টের ২৪নং ব্যাটেলিয়ন চট্টগ্রামে পাকবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড ধরে রওয়ানা হয়ে যায। যতক্ষণ এই সৈন্যরা এসে না পৌঁছায় ততক্ষণ চট্টগ্রামে অবস্থানরত বালুচ রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফাতেমিকে চট্টগ্রামকে পরিস্থিতি সামাল দেবার নির্দেশ দেয়া হয়।
ই.পি.আর. এর ৬নং সেক্টর সদরে অবস্থান ছিল চট্টগ্রামের হালিশহরে। সেক্টর সদরে বাঙালি অফিসার ছিলেন মাত্র দুই জন। মেডিক্যাল অফিসার মেজর আমিনুল ইসলাম ও সেক্টর এ্যাডজুটেন্ড ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম (‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ গ্রন্থের লেখক ও বাংলাদেশের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী)। কুমিল্লা থেকে সিগন্যাল বিভাগের মেজর বাহার চট্টগ্রাম এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ক্যাপ্টেন রফিককে জানিয়ে দিলেন যে এফ.এফ. রেজিমেন্ট চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হচেছ। খবর পেয়ে পাক বাহিনীকে বাধা দেবার জন্য ক্যাপ্টেন রফিক নায়েক সুবেদার মুসাকে এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে হালিশহর থেকে শুভপুরের দিকে রওয়ানা হতে নির্দেশ দিলেন।
ফেনীর কাছাকাছি এসে শাহপুর খানের বাহিনী থেমে যেতে বাধ্য হয়, কারণ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা ইতিমধ্যেই ঢাকা ট্রাঙ্করোডের শুভপুর সেতুটি উড়িয়ে দিয়েছে। মেজর জেনারেল খাদিম রাজা ২৫শে মার্চ রাত ১২টা ১৫ মিনিটেই ঢাকায় বসে কুমিল্লা সেনাদলের পথরোধের খবর শুনলেন। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফিকে তিনি পুলটির দখল ছেড়ে দিয়ে পাশের গিরিখাদ পার হয়ে চট্টগ্রাম শহরের দিকে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু শুভপুর সেতু দখল না করে ইকবাল শফি চট্টগ্রামের যাবার পথ করে নিতে সক্ষম হলেন না। ই.পি.আর.বাহিনীর সদস্যদের প্রতিরোধের কারণে শুভপুর সেতুর দখল নিতে পাাকিস্তানী সৈন্যদের ২৬শে মার্চ সকাল দশটা পর্যন্ত লেগে যায়। অতঃপর সেনাদলটি চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে।
পাকবাহিনী শুভপুর সেতু অতিক্রম করে বিনা বাধায় তীব্র গতিতে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে – এই খবর শুনে রামগড় থেকে ই.পি.আর. বাহিনীর কিছু সৈন্য চট্টগ্রাম থেকে কুড়ি কিলোমিটার দুরে কুমিরা গ্রামে এসে তাদেরকে বাধা দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। এছাড়া ক্যাপ্টেন রফিকের পরামর্শে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের হোল্ডিং কোম্পানির অধিনায়ক ক্যাপ্টেন এম.এস.এ. ভূঁইয়া ১০২ জন সৈন্য নিয়ে কুমিরার দিকে অগ্রসর হন।
এখন পুরো ঘটনাটিকে সাধারণ জনগণের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যাক। কানাই লাল চক্রবর্তী লিখেছেন (শরণার্থীর দিনলিপি, পৃষ্ঠা ১৭-১৮):

“পূর্ব্ব রাত্রে (২৫/৩/৭১) শুনিয়াছিলাম, চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজে নাকি সাধারণ গুলি-গোলা ও গন্ডগোল হয়েছে বাঙালী ও পাঞ্জাবীদের মধ্যে। এর বেশ কিছু নয়। কিন্তু শেষ রাতে ঘুম হইতে আমাকে জাগিয়ে দেওয়ার পর শুনিতেছি, অসম্ভব সোরগোল। আমার বাড়ীর নিকটে পূর্ব্ব দিকে ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডের উপর বড় কুমিরা বাজার। … বন্ধুদের সঙ্গে বাজারে গেলাম ও প্রভাতের সামান্য প্রাতরাশ সারিয়া অবসর হওয়ার সাথেই দেখি অনেক মিলেটারী, মানুষজন ও কিছু সংখ্যক গুলিগোলা ইত্যাদি। বাজারের রাস্তা, ঢাকা ট্রাংক রোড লোকে লোকারণ্য। সবাই শুধু বলাবলি ও দৌঁড়াদৌড়ি করিতেছে।…আরও শুনিতেছি: একদল পাঞ্জাবী সরকারী সৈন্য পায়দলে উত্তর দিকে হইতে (কুমিল্লার দিক হইতে) চট্টগ্রাম অভিমুখে রওনা হইয়াছে। … শুনিতেছি, বাঙালী সৈন্যরা কুমিরা রেলওয়ে ষ্টেশনের সংলগ্ন যক্ষèা হাসপাতালে ঘাঁটি করিয়াছে। বাজার হইতে ইহার দুরত্ব প্রায় আধ-মাইল।”

অধ্যাপক হিরণ¥য় চক্রবর্তী তাঁর ‘কুমিরার যুদ্ধ’ প্রবন্ধে লিখেছেন:

“২৬শে মার্চ প্রত্যূষে কুমিরা হাইস্কুল মাঠ থেকে তীব্র হৈচৈ এর শব্দ ভেসে এলো। ছুৃটে গেল গ্রামবাসী। অনেক বাঙালী সৈন্য হাজির হয়েছে, কয়েক জন আহত। সবার মুখে বিভীষিকার ছাপ। কারো ড্রেস আছে, কারো নাই। নতুনপাড়া ক্যান্টনমেন্টের হত্যাযজ্ঞ থেকে পালিয়ে এসেছে তারা। সৈন্যদের খাওয়া ও চিকিৎসার ব্যবস্থা হলো। ডাঃ আখতারুজ্জামান এক জন মেজরের নিতম্ব থেকে অপারেশন করে একটা গুলি বের করলেন। উরুর গুলিটা বার করতে পারলেন না। চিকিৎসা দিলেন অনেককে।”

যদিও লেঃ কর্ণেল (অবঃ) ওসমান গণি লিখেছেন ‘সন্ধ্যা ৬টার মধ্যেই ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া ও তাঁর সৈনিকেরা কুমিরা পৌছে গেলেন’ হিরণ¥য় চক্রবর্তী কিন্তু বলছেন ভিন্ন কথা।

“সকাল সাড়ে নয়টার দিকে রেলের একটি ইঞ্জিন চালিয়ে উত্তর দিক থেকে এসে পড়লেন ক্যাপ্টেন এম.এস. ভূঁইয়া ও অন্য একজন। ক্যাপ্টেনের পরনে ছিল ঘিয়া রঙের পাঞ্জাবী ও লুঙ্গি। জানা গেল, আজ বিকেলের মধ্যেই পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছানোর কথা।”

কুমিরা পৌঁছেই ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া ই.পি.আর. বাহিনীকে সঙ্ঘবদ্ধ করে তাদের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করলেন। শত্রুকে বাধা দেওয়ার জন্য কুমিরা খুবই উপযুক্ত স্থান বলে মনে হলো তাঁর। এর কারণ, কুমিরা গ্রামের পূর্বদিকে রয়েছে চন্দ্রনাথ পর্বতমালা এবং পশ্চিম দিকে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। পাহাড় ও সাগরেরর মধ্যে দূরত্ব এক কিলোমিটারের বেশি নয়। সুতরাং শত্রুর ডান ও বাম দুই দিকেই প্রতিবন্ধকতা রয়েছে এবং শত্রুকে চট্টগ্রামের দিকে এগুতে হলে ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড ধরে এগোতেই হইবে।
হিরণ¥য় চক্রবর্তী লিখেছেন:

“শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ প্রস্তুতি। প্রথমে কুমিরা স্কুলের মাঠকে আক্রমণ পরিচালনার ক্ষেত্র হিসাবে প্ল্যান হলেও বাজার ও বসতির কথা চিন্তা করে তা বাতিল করা হলো। নতুন প্ল্যান হলো, এম. এন. পালের ইটখোলা (বর্তমান কুমিরা বালিকা বিদ্যালয়) থেকে আক্রমণ করা হবে। জনগণের সহায়তায় ব্যাংকার খোড়া হলো অনেকগুলো। মাইল খানেক উত্তরে (ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডের উপর) ছোট কুমিরা পুল (বেইক্যা পুল) এর দক্ষিণ পাশে একটি শতাব্দী-প্রাচীন জির গাছ ছিল। বিশাল জির গাছটি কেটে বেইক্যা (বাঁকা) পুলের সামনে ভালো রকম একটি ব্যারিকেড গড়া হলো।”

আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানী বাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য ইপিআরদের সম্বল ছিল মাত্র ১টি এইচ.এম.জি., কয়েকটি এল.এম.জি আর বাকি সব রাইফেল। ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন যে এত অল্পসংখ্যক সৈন্য ও যুদ্ধ সরঞ্জাম নিয়ে পুরো একটি সুসংগঠিত ব্যাটেলিয়নের মোকাবেলা করার ঝুঁকি যে কি বিরাট এবং এর পরিণতি যে কত মারাত্মক হতে পারে তা তাঁরা তখনও উপলদ্ধি করতে পারেননি।
এম.এন. পালের ব্রিকফিল্ডের সামান্য দক্ষিণে ঘোড়ামারা বা জোড় আমতলা। কুমিরা গ্রাম থেকে ঘোড়ামারার দুরত্ব মাইল খানেকের মতো। ঘোড়ামারা খালের পাড় থেকে পাঁচ-ছয় গজ সামনে পজিশন নেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। খালটাকে ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া পেছনে রাখলেন এই ভেবে যে পাকবাহিনীর আক্রমণের মুখে পশ্চাদপসরণ যদি করতেই হয় তবে খালে নেমে পজিশন নেওয়া যাবে। ‘মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস’ নামক স্মৃতিকথায় ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন:

“তিনজন প্লাটুন কমান্ডারকে ডেকে খুব সংক্ষেপে আমার পরিকল্পনার কথা জানালাম এবং নিজ নিজ স্থানে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পজিশন নেওয়ার নির্দেশ দিলাম। আমার নির্দেশ অনুযায়ী এইচ. এম. জি.টাকে ডানপাশে পাহাড়ের ঢালুতে ফিট করা হলো। ই.পি.আর সুবেদার মুসা নিজে থাকলেন এই মেশিনগানটির দায়িত্বে। এই ভারী মেশিন গানটিই আমাদের প্রধান হাতিয়ার এবং সবচেয়ে বড় সম্বল। আমি রাস্তার বামদিকে কয়েকটি এল.এম.জি.-এর পজিশন ঠিক করে দিলাম। আমার নির্দেশমতো সবাই মাটিতে পজিশন নিয়ে নিল। পজিশন এর অবস্থা ছিল অনেকটা ইংরেজী ইউ অক্ষরের মতো। অর্থাৎ ডানে, বাঁয়ে এবং পেছনে আমাদের সৈন্য। যেদিক থেকে পাকিস্তানী সৈন্যরা এগিয়ে আসছে কেবল সেই সামনের দিকটা সাঁড়াশির হা এর মতো খোলা”।

এর পর অপেক্ষা, কখন শক্ররা এসে পৌঁছবে ব্যারিকেডের সামনে। হিরণ¥য় চক্রবর্তী জানাচ্ছেন:

“বিকেল সোয়া পাঁচটায় পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈন্যদের গাড়ির বহর এসে পৌঁছালো ছোট কুমিরায়। ছোট কুমিরার গুল আহমদ জুট মিলের গেটে এক বিহারী দারোয়ান তাদের সর্তক করে দিলো ‘দুশমন সামনে হ্যায়’। কথাটিকে খুব গুরুত্ব দিল না বোধ হয় গর্বিত বাহিনী। কিন্তু ছোট কুমিরা পুলের সামনে জির গাছের ব্যারিকেড সরাতে না পেরে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে শ’ খানেক সৈন্য রেল লাইন ধরে এবং বাকীরা ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড দিয়ে পদব্রজে দুই সারিতে দক্ষিণ দিকে এগোতে লাগল। কুমিরা বাজার এলাকায় ঢুকেই ‘ব্যানচোদ’ ইত্যাদি বলে গালি দিতে দিতে বিভিন্ন দোকানে টাঙানো কালো পতাকা ও বাংলাদেশী পতাকা ছিঁড়ে ফেলতে লাগলো। সবার কাঁধে অত্যাধুনিক অস্ত্র। সৈন্যদের পেছনে পেছনে আমরা কয়েকজন তামসগীর এগুতে লাগলাম।”

সন্ধ্যা যখন সোয়া সাতটা তখন পাকবাহিনীকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে দেখলো বাঙ্কারে থাকা ই.পি.আর. সৈন্যরা। সুবেদার মুসা ডান দিকের পাহাড় থেকে ভারী মেশিনগানটি দিয়ে তাদের উপর চার্জ করলেন। ‘শুরু হলো শক্র নিধন পালা’। লিখেছেন ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া তাঁর স্মৃতিকথায়। চারদিকে থেকে কেবল গুলির আওয়াজই শুধু শোনা যাচ্ছে। ভারী মেশিনগানটি থেকে ট্রেসার বের হতে শুরু করলো। হিরণ¥য় চক্রবর্তী লিখেছেন:

“ঘাটঘর (কুমিরা) রাস্তার মাথায় যেতে না যেতেই বিকট আওয়াজে ঝাঁকে ঝাঁকে দক্ষিণ দিক থেকে গুলি আসতে লাগলো। কয়েকজনকে পড়ে যেতে দেখলাম। ঝাঁপিয়ে পড়লাম শঙ্কর দীঘিতে। প্রতি মুহুর্তে অসংখ্য গুলির ফাঁকে বাড়ী এসে পৌঁছলাম।”

ঘটনার অন্যপ্রান্তে কানাই লাল চক্রবর্তীর বক্তব্য শোনা যাক (শরণার্থীর দিনলিপি, পৃষ্ঠা ১৯):

“হঠাৎ বিকট শব্দ ট্র-ট্র-ট্র-ট্র-ট্র-ট্র-ট্র-ঢুম্-শোঁ-শোঁ, শোঁ-শোঁ। এতগুলি আওয়াজ ও এত অগ্নিকণা আর দেখি বা শুনি নাই। এমতাবস্থায় কি করা কর্তব্য তাহা জানিও না। গত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় শুনিয়াছিলাম, ‘সাইরেন’ নামে বিপদ-সংকেত বাজিত, কিন্তু কই? কোথায় গেল আমার রোগীপত্র, কোথায় গেল হাটবাজার, ছোট বাচ্চাকাচ্চাসহ কোঠায় ঢুকিয়া পড়িলাম। প্রথম দিকে গুলি শুধু উত্তরাভিমুখে গিয়াছিল। কয়েক মিনিটের মধ্যে অনবরত গুলি শুরু হইল এবং গুলি যে কোনো দিক হইতে পড়ে তাহা বুঝা মুস্কিল।”

গোলাগুলি শুরু হবার পূর্ব মুহূর্তে আমার দিদিমা চারুবালা দেবী। (কানাই লাল চক্রবর্তীর মা) ভাবলেন, বাড়িতে আসা রোগীদের একটু চা দেওয়া যাক। কিন্তু চা করতে গিয়ে দেখলেন, ঘরে দুধ নেই। তিনি ভাবলেন, যুদ্ধ শুরু হতে দেরি আছে, এই অবসরে একটু দুধ দুইয়ে আনি না কেন। বারান্দার সামনে লিচু গাছের তলায় বাঁধা গরুটার ওলানের নিচে বালতি রেখে তিনি বসেছেন। সাত বছরের কিশোর আমি বাছুরটা ধরে আছি। দিদিমা দুই আঙ্গুলে গরুর ওলান ধরে টান দিয়েছেন কি দেননি, তখনি আক্রমণ-প্রতি-আক্রমণ শুরু। গোলাগুলির ভয়ঙ্কর শব্দে ভয়ে তার হাতের আঙ্গুল যেন অসার হয়ে গেল। দুধ দুইবার প্রশ্নই আসে না, কোনমতে দুধের বালতি গরুর পায়ের কাছে ফেলে দুই দিদা-নাতি পড়ি কি মরি করে ঘরে এসে ঢুকলাম। গরুটা সেখানেই বাঁধা থাকে সারা রাত। সৌভাগ্যবশত গরুটির গায়ে কোনো গুলি লাগেনি।
আকস্মিক আক্রমণে পাকসৈন্যরা দিশেহারা হয়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। পুরো ব্যাটেলিয়ান অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে পিছু হটতে বাধ্য হয়। অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই এফ.এফ. রেজিমেন্ট প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে ই. পি. আর. বাহিনীর উপর মেশিনগান, মর্টার ও আর্টিলারী থেকে অবিশ্রান্ত গোলাবর্ষণ করতে শুরু করে। হিরণ¥য় চক্রবর্তী লিখেছেন:

“রেল লাইন দিয়ে অগ্রসরমান পাক সৈন্যরা দ্রুত পাহাড়ের উপর টি বি স্যানাটোরিয়ামে উঠে পড়লো এবং পাল্টা আক্রমণ শুরু করলো। হঠাৎ আক্রমণে রাস্তায় জনা বিশেক পাক সৈন্য মারা পড়েছিল এবং বাকীরা ক্রলিং দিয়ে পাহাড়ে উঠে গিয়েছিল।”

যুদ্ধ চলতে থাকে। এক পর্যায়ে স্বাভাবিক ভাবেই মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদের স্বল্পতা দেখা দিল। অগ্রবর্তী স্থান থেকে এ্যামুনিশন সরবরাহের জন্য তাগিদ আসতে লাগলো বার বার। অনেক চেষ্টা করেও এ্যামুনিশন সংগ্রহ করতে না পেরে ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া এ্যামুনিশন সংগ্রহের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম শহরের দিকে রওয়ানা হন। প্রতিকূল অবস্থার কারণে তিনি আর কুমিরায় ফিরে এসে ই.পি.আর. সৈনিকদের সঙ্গে যোগ দিতে পারেননি। এভাবে কুমিরা রণাঙ্গন সারা রাত অফিসারশূন্য থাকে। ই.পি.আর. সৈনিকেরা তীব্রভাবে জনশক্তি ও গোলাবারুদের অপ্রতুলতা এবং উপযুক্ত অফিসারের অভাবে অনুভব করতে থাকে। তবুও অটুট মনোবল নিয়ে তাঁরা তাঁদের পজিশন আঁ^কড়ে থাকার চেষ্টা করেন। রফিকুল ইসলাম লিখেছেন:

“শত্রুপক্ষের পিছনের অংশ যারা আমাদের অস্ত্রের আওতায় বাইরে ছিল তারা সঙ্গে সঙ্গেই সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নিয়ে পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করেছিল। এক ঘন্টারও বেশি সময় এই গুলি বিনিময় চললো। ইতিমধ্যে পাকিস্তানীদের মর্টার বহর শুভপুর সেতু অতিক্রম করে তাদের অগ্রবর্তী দলের সঙ্গে যোগ দিলো। এই সময় আমাদের সেনারা প্রায় তিন মাইল সরে এসে পরবর্তী অবস্থানের প্রস্তুতি গ্রহণ করলো। এই ভয়াবহ সংঘর্ষে ইপিআর এর পাঁচ জন গুরুতরভাবে আহত হয়।”

টিক্কা খানের জনসংযোগ অফিসার সিদ্দিক সালিক তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন যে সেদিন সন্ধ্যার আক্রমণে পাকবাহিনীর এগারো জন হতাহত হয়, নিহত হয় কোম্পানীর কমান্ডিং অফিসার। কিন্তু লেঃ কর্ণেল (অবঃ) আবু ওসমান চৌধুরীর লেখায় আছে এবং প্রত্যক্ষদর্শীরাও জানিয়েছেন যে দুই ঘন্টার এই সংঘর্ষে সেদিন সন্ধ্যায় ২০০ জনের মতো পাকসেনা নিহত হয় এবং ৩টিরও বেশি গাড়ি ধ্বংস হয়। ক্যাপ্টেন ভুঁইয়া লিখেছেন যে ২৬ তারিখ সন্ধ্যায় শত্রুবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার, লেঃ কর্ণেল ও একজন লেফটেন্যান্ট সহ ১৫২ জন সাধারণ সৈনিক প্রাণ হারায়। ই পি আর পক্ষেও ১৪ জন বীর সৈনিক শহীদ হন। রফিকুল ইসলাম লিখেছেন:

“লাইট মেশিনগানের ঝাঁক ঝাঁক গুলির শিকার হয়েছিলেন ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার শাহপুর খানসহ প্রায় ৭০ জন পাকসেনা। আহত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত যানবাহনের সংখ্যাও ছিল প্রচুর। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি জীবন বাঁচাবার জন্যে তখন প্রাণপণে ছুটছিলেন পাহাড়ের দিকে। কয়েক জন সঙ্গীও তাঁকে অনুসরণ করলো। ভীত সন্ত্রস্ত সৈনিকেরা হাতিয়ার, যানবাহন ও অন্যান্য জিনিষপত্র ফেলেই প্রাণপণে ছুটছিল।”

এই আক্রমণের ফলে কুমিল্লার ব্রিগেড সদর দফতর ও ঢাকার ডিভিশনার সদর দফতরের সাথে এফ.এফ. ব্যাটেলিয়নের ২৪নং ব্যাটালিয়নের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তবে রফিকুল ইসলাম লিখেছেন:

“এই অ্যামবুশের পরেই আমরা একটি অয়ারলেস বার্তা শুনে ফেলি। চট্টগ্রামের জনৈক কমান্ডার ঢাকায় ৯৪ ডিভিশনের কর্ণেল স্টাফ হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তিনি বলছিলেন, আমাদের অনেক লোক হতাহত হয়েছে। সীতাকুন্ডের দক্ষিণে বাকি সৈন্যরা আটকা পড়া আছে। বিমানে সৈন্য পাঠানোর অনুরোধ করছি। জরুরী ভিত্তিতে বিমানে করে হতাহতদের সরাবার ব্যবস্থা করা দরকার। ”

২৪নং ব্যাটেলিয়ান ২৭ তারিখে সকালেও সম্ভবত কুমিরার আশেপাশেই অবস্থান করছিল কারণ কানাই লাল চক্রবর্ত্তী লিখেছেন (শরণার্থীর দিনলিপি, পৃষ্ঠা ২২):

“বারান্দায় দাড়াইয়া দেখিতেছি, গ্রামের বিভিন্ন রাস্তা দিয়া সশস্র পাক সৈন্য ঘুরাফিরা করিতেছে রাজাপুর, মছজিদ্যা, আকিলপুর, কাজীপাড়া, জমাদারপাড়া ও অন্যান্য গ্রামে। শুনিতেছি, কিছু গ্রামবাসী পাক সৈন্যের গুলিতে আহত এবং নিহত হইয়াছে।”

ঢাকায় জেনারেল অফিসার ইন কমান্ড (জি.ও.সি.) টিক্কা খান হারিয়ে যাওয়া সেনাদলটি সম্পর্কে উদ্বিঘœ বোধ করলেন এবং নিজেই তাদের খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সিদ্দিক সালিক লিখেছেন:

“২৭শে মার্চ সকালে জি.ও.সি. একটি হেলিকপ্টার নিয়ে বের হলেন। হেলিকপ্টারটি চালাচ্ছিল মেজর লিয়াকত বোখারী এবং তাকে সাহায্য করছিলেন মেজর পিটার। চট্টগ্রামে অবস্থানরত ২০ বালুচ রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট কর্ণেল ফাতেমীর সঙ্গে দেখা করে তিনি কুমিল্লার দিকে রওয়ানা হলেন এফ.এফ. রেজিমেন্টের খোঁজে। ঘন মেঘ থাকায় জি.ও.সি কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না। কুমিল্লার প্রায় কাছাকাছি এসে জি.ও.সি. নিজের হাঁটুর উপর ছোট্ট একটা ম্যাপ মেলে ধরে বাইরের দিকে তাকালেন এবং পাইলটকে মেঘ ভেদে করে নীচে নামতে নির্দেশ দিলেন।
হেলিকপ্টারটি নীচে নামাতেই টিক্কা খান জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে দেন হারিয়ে যাওয়া সেনাদলের খোঁজে। সঙ্গে সঙ্গে এক ঝাঁকগুলি ভুমি থেকে লাফিয়ে উঠলো। পাইলট বোখারী এবং তাঁর সহকারী মেজার পিটার মুহূর্তে হেলিকপ্টারকে উপরে উঠিয়ে নিলেন। তথাপি হেলিকপ্টারটির মেশিনে গুলি লাগে। একটি গুলি আঘাত হানলো লেজে। অপরটি তেলের ট্যাংকি থেকে কয়েক ইঞ্চি দুরে গিয়ে কপ্টারের গেট বিদ্ধ করে। মেজর বোখারীর ইচ্ছা ছিল আরও কিছুক্ষণ চেষ্টা করার। কিন্তু টিক্কা খান পাইলটকে ঢাকা ফিরে যাবার নির্দেশ দিলেন। টিক্কা খানের মিশন ব্যর্থ হলো। যোগাযোগ বিছিন্ন হওয়া সেনাদলের কোনো খোঁজ মিললো না।”

চট্টগ্রামের পাকিস্তান রেডিও অফিসটি তখনও সম্ভবত ই. পি. আর. বাহিনীর দখলে ছিল কারণ, টিক্কা খানের হেলিকপ্টার আক্রান্ত হ্ওয়ার খবরটি রেডিও পাকিস্তান চট্টগ্রাম থেকে টিক্কা খানের মুত্যু সংবাদ হিসেবে প্রচারিত হয়। কানাই লাল চক্রবর্ত্তী লিখেছেন (শরণার্থীর দিনলিপি, পৃষ্ঠা ২২ ):

“বেলা প্রায় তিনটার সময় রেডিও হইতে সংবাদ প্রচার হইল (মিথ্যা বা ভুল সংবাদ): লেফটেনেন্ট জেনারেল টিক্কাখান সদলবলে নিহত। উপস্থিত শ্রোতাগণ মুহূর্তের জন্য আনন্দিত হইল।”

ইতিমধ্যে জেনারেল মিঠঠাও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সেনাদলের সাথে সংযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে ই.এক্স.-৩ নামক কমান্ডো ব্যাটেলিয়নকে ঢাকা থেকে আকাশপথে চট্টগ্রামে পাঠালেন। কমান্ডো সেনারা এফ. এফ. ব্যাটালিয়ন বা ই. পি. আর. বাহিনীর অবস্থানের খবরাখবর সম্পর্কে কিছুই জানতো না। এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে মুসকিল আসান হয়ে দেখা দিলেন এক অতি উৎসাহী বাঙালি অফিসার ক্যাপ্টেন হামিদ। তিনি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকায় ছুটিতে এসেছিলেন। ক্যাপ্টেন হামিদ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বললেন: ‘আমি এলাকাটি চিনি। গাইড হয়ে কি আমি তোমাদের সাথে যেতে পারি।” ক্যাপ্টেন হামিদকে সাথে নেয়া হলো।
এদিকে চট্টগ্রাম থেকে ২০নং বালুচ রেজিমেন্টের একটি সেনাদলকেও পাঠানো হলো কুমিরার দিকে। এই তিনটি সেনাদল অর্থাৎ এফ. এফ. ব্যাটেলিয়ন, ই.এক্স-৩ কমান্ডো সেনাদল আর বালুচ রেজিমেন্টের সেনাদলটির সংযুক্তির উপর সম্পূর্ণ অপারেশনটির সাফল্য নির্ভর করছিল। ২০নং বালুচ রেজিমেন্টের সেনারা কুমিরার দিকে এগোতে না এগোতেই ই. পি. আর. সৈনিকদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল। কমান্ডোরা ক্যাপ্টেন হামিদকে সাথে নিয়ে তাদের লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হয়ে বেশি দুর এগোনোর আগেই রাস্তার দুই দিক থেকে দ্বিমুখী গুলিবর্ষণের মুখোমুখি হয়েছিল। কমান্ডোদের মধ্যে মোট মারা গিয়েছিল ১৩ জন। এর মধ্যে কমান্ডিং অফিসার সহ ছিল ২ জন তরুণ অফিসার, ১ জন জুনিয়র কমিশনড অফিসার এবং ৯ জন ছিল অন্যান্য পদের। এটা অবশ্য ঢাকায় অবস্থানরত সিদ্দিক সালিকের সরকারী ভাষ্য। মৃতের সংখ্যা কম বা বেশি হওয়া অসম্ভব নয়।
২৭শে মার্চ তারিখে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে বলে জানাচ্ছেন হিরম্ময় চক্রবর্তী।

“(কুমিরা) সমুদ্র উপকুলে একট টার্মিনাল ভবন ছিল। কয়েকজন ই. পি. আর. সৈন্য সেই টার্মিনাল ভবনে উঠে পাহাড়ে অবস্থিত পাকসৈন্যদের উপর গুলি চালায়। ব্যাপারটা টের পেয়ে পাক সৈন্যদের কমান্ডার কর্ণেল শাপুর (শাহপুর?) খান ৩০/৪০ জন সৈন্য নিয়ে কোর্টপাড়ার ভিতরে দিয়ে গিয়ে টার্মিনাল ভবনটি ঘিরে ফেরে। টার্মিনাল ভবন থেকে দুই জন ই.পি.আর. সৈন্য অত্যন্ত কাছ থেকে গুলি করলো তাদের। মারা গেল কর্নেল শাপুর খান, মেজর লালদাদ খান ও অন্য এক জন। প্রতিআক্রমণ করলো পাকসৈন্যদের বাকি সদস্যরা। এই দুই ই.পি.আর. সৈন্যদের একজন আহত অবস্থায় লাফ দিয়ে জোয়ারের পানিতে ডুব দিয়ে পালিয়ে যায়। অন্য একজনকে ভবনের পানির ট্যাংক থেকে বের করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে পানিতে ফেলে দিল পাক সৈন্যরা। এর পর লাশ তিনটাকে বয়ে এসে টি. বি. স্যানাটারিয়ামের পাশে কবর দিল তারা।”

এই সংঘর্ষের কথাই সম্ভবত লিখেছেন কানাই লাল চক্রবর্তী (শরণার্থীর দিনলিপি, পৃষ্ঠা:২১)

“প্রায় নয়টার সময় শান্ত পরিবেশ মনে করিলাম।… একটু আলাপ করিব ভাবিয়া চৌধুরীবাড়ী গেলাম ও মাত্র ৫/৭ মিনিট আলাপের পর বাড়ী ফিরিয়া আসিলাম। ইহার পর আমার মা (শ্রীমতি চারুবালা দেবী) আমার মেয়ে মিষ্টিকে সঙ্গে লইয়া তাহাদের দেখিতে গেলেন। উনিও উঠানে গিয়া হাজির এবং অমনি আবার ট্র-ট্র-ট্র, শোঁ, শোঁ, শোঁ আওয়াজ শুরু। আশ্রিত ব্যক্তিরা আমার মায়ের কথা চিন্তা না করিয়াই ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া দিল। মা গুলির মধ্য দিয়া ঘরে ফিরিয়া আসিলেন। আমার ঘরের দরজা-জানালা আবার বন্ধ হইল।”

কুমিরার সংঘর্ষের পর কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ব্রিগেডিয়ার ইকবার শফি নিজেই সেনাদলের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন। তিনি কিছু মর্টার চেয়ে পাঠালেন। ২৭শে মার্চ সেগুলো পৌঁছে গেল এবং ২৮শে মার্চ ভোরে তিনি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন। আক্রমণ সফল হলো এবং ই. পি. আর. সৈনিকদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে চট্টগ্রাম শহরের রাস্তা পরিষ্কার হয়ে গেল। কানাই লাল চক্রবর্তী ও হিরণ¥য় চক্রবর্তীর বয়ান দিয়ে যুদ্ধের কাহিনী শেষ করা যাক:

“রবিবার সকালে প্রথম একদফা খুবই শব্দ শুনিলাম। শব্দগুলি খুবই ভীষণ। কিসের শব্দ তাহা পাঠকের বুঝিতে বিলম্ব হইবে না। সকাল সাতটায় দেখি দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ কুমিরা যক্ষèা হাসপাতালের দিকে ঢাকা ট্রাংক রোড়ের দুই পাশেই আগুনের শিখা। ধুয়াঁ ও পোড়া ছাই উড়িয়া আসিতেছে এবং ঘরদুয়ার সব ছাইময় হইতেছে। শব্দ নাই, বারান্দায় দাড়াইয়া লক্ষ্য করিলাম ২/১ জন লোক সামনের গ্রাম্য রাস্তা দিয়া চলাচল করিতেছে। জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম, বাঙালী সৈন্যরা কোথায় তাহারা জানে না, তবে পাক-সরকার বাহিনী দক্ষিণ দিকে পায়ে হাঁটিয়া যাইতে যাইতে সরকারী রাস্তার দুই পাশে ২০০ (দুইশত) ফুট আগুনে ধ্বংস করিতেছে। কোনো লোক দেখিলে হাত পা বাঁধিয়া আগুনে নিক্ষেপ করিতেছে বা গুলি করিয়া মারিতেছে। তবে বিশেষত্ব এই যে কোনো বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা রমণীর তেমন কোনো ক্ষতি তাহারা করে নাই।…ইতিমধ্যে অনেকে বুদ্ধির তীক্ষতা জাহির করিবার মানসে জাতীয় পতাকা (চধশরংঃধহর ভষধম) উত্তোলন করিয়া দিয়া বাড়ীঘর ছাড়িয়াছে, কিন্তু তাহাদের বাড়ীও বাদ যায় নাই।…রাস্তাঘাট প্রায় অচল, অনেক কষ্টে লোকেরা বঙ্গোপসাগরের ধার দিয়ে হাঁটা-হাঁটি করিতেছে। শুনিতেছি, পাঞ্জাবীরা ফৌজদার হাট কেডেট কলেজে ঘাঁটি করিয়াছে। অনেকে ভয়ে ট্রেনসে আশ্রয় নিয়াছিল, কিন্তু সেইখানেও দুষ্টের হাত হইতে নিস্তার পায় নাই। দুপুরে শুনিলাম, বার আওলিয়াতে অনেক মানুষ আহত ও নিহত হইয়াছে।” (শরণার্থীর দিনলিপি, পৃষ্ঠা: ২৪-২৫]

এবার হিরণ¥য় চক্রবর্তীর স্মৃতিচারণ:

“২৮শে মার্চ সকালে পাক সৈন্যরা বাঙালি মারতে মারতে চট্টগ্রাম অভিমুখে রওনা হয়। বার আউলিয়া মাজারের উত্তরে মাউধ্যার হাটে ছিল এক বটগাছ। সে গাছে যে একজন সংশপ্তক বাঙালি সৈন্য ওত পেতে ছিল এটা কেউ জানতো না। পাকসৈন্য এগিয়ে আসতেই সে ১২/১৪ জনকে গুলি করে হত্যা করে। পরে পাক সৈন্যের গুলিতে সেও নিহত হয়। এর পর পাকসৈন্যরা ক্ষেপে গিয়ে পাশের দুটো চা দোকানের ভিতরে সাত জন বাঙালীকে শিকল দিয়ে বেঁধে দোকানে আগুন লাগিয়ে দেয়। বার আউলিয়া মাজারে আশ্রয়গ্রহণকারী কাউকে তারা না মারলেও সামনের দোকান থেকে যারা ভয়ে পালাছিল তাদের গুলি করে হত্যা করে। ২৮শে মার্চ দুপুরে বার আউলিয়া গিয়ে আমি রাস্তার উপর সাতাশটা বাঙালীর লাশ গুনেছি। উক্ত দুটি দোকানে শেকলবাধা অবস্থায় পুড়ে যাওয়া বীভৎস সাতটি মৃতদেহের যে দৃশ্য সেদিন দেখেছিলাম তা এখনও চোখে ভাসছে।”

বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে কুমিরার যুদ্ধের একটি বিশেষ স্থান রয়েছে, কারণ এখানেই পাকিস্তানি বাহিনী সর্বপ্রথম পরিকল্পিত প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। রফিকুল ইসলাম মনে করেন, ‘কুমিরায় শক্রর বিরুদ্ধে ই.পি.আর. সেনাদের এই অ্যামবুশ ছিল আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে প্রথম সরাসরি আক্রমণ। কুমিরার যুদ্ধের গুরুত্ব এতই সুদুরপ্রসারী ছিল যে, এই ঘটনা পাকিস্তানি সৈন্যদের চট্টগ্রামে অবাধে কিছু করার মুল পরিকল্পনা ব্যহত করে দেয়।’

Comments (9)

Leave a comment