Scroll Top
19th Ave New York, NY 95822, USA

অষ্টম বেতন স্কেল

br10

এক চতুর কায়স্থের সেবা, চাটুকারিতা ও প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়ে সমতটের জাগ্রত দেবী সুখহাসিনি তাকে ইচ্ছাপূরণের বর দিয়েছিলেন। যা বর চাইবে তাই সে পাবে, তবে এক শর্তে: তার প্রতিবেশিরা একই জিনিষ দুটি করে পাবে। কায়স্থ তার নিজের জন্যে পদোন্নতি চাইল, নতুন গাড়ি চাইল এবং সঙ্গে সঙ্গে পেয়েও গেল। প্রতিবেশিরাও প্রত্যেকে দুটি পদোন্নতি পেলো এবং দুখানা করে গাড়ি পেলো। অন্যরা কেন তার চেয়ে বেশি পাচ্ছে? ঈর্ষায় জর্জরিত কায়স্থের মাথায় হঠাৎ এক বুদ্ধি আসলো। সে বর চাইল: আমার এক চোখ কানা হোক! অনতিবিলম্বে প্রতিবেশিরা সবাই অন্ধ হয়ে চাকরি হারালো এবং কায়স্থ সবার গাড়িগুলো চুরি করে নিজের কাছে নিয়ে এলো।

সমতটের সরকারী প্রজ্ঞাপনে ব্রাহ্মণদের তুলনায় কায়স্থদের বেশি সুবিধা দেবার পক্ষে কমপক্ষে পাঁচটি দুর্বল সাফাই গাওয়া হয়েছে। প্রথম সাফাই: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রাহ্মণেরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ পান, যা কায়স্থেরা পায় না। কথাটা সত্যি নয়। অনেক কায়স্থও বাইরে পার্টটাইম কাজ করে থাকেন। ব্রাহ্মণদের মধ্যে শতকরা কতজনের অন্যত্র কর্মসংস্থান হয়? কাজের সুযোগ পেলেই কি সবাই সুযোগ নিতে পারে, না নিয়ে থাকে? কিছু সংখ্যক ব্রাহ্মণ একটা বিশেষ সুযোগ পান, এই অপরাধে সব ব্রাহ্মণকে কেন কম পারিশ্রমিক দিতে হবে?

দ্বিতীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ যারা পেয়ে থাকেন, যোগ্যতা আছে বলেই তাঁরা তা পেয়ে থাকেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিরিক্ত আয় করার জন্যে ব্রাহ্মণদের অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়। অতিরিক্ত কাজ করে অতিরিক্ত আয় করা যদি আইনসঙ্গত হয়, তবে কায়স্থদেরও এ সুযোগ দিতে বাধা কোথায়? আর যদি তা বেআইনী হয়, তবে ব্রাহ্মণদের জন্যেও এ সুযোগ রহিত করা হোক। একজন ব্যক্তির বিশেষ কোনো সুযোগ আছে বলেই তাকে কম বেতন দেয়া যায় না। দেখতে হবে, সেই ব্যক্তি আদৌ সেই সুযোগ নেন কি না। সুযোগ থাকলেও কি সব কায়স্থ উৎকোচ গ্রহণ করেন?

দ্বিতীয় সাফাই: প্রথম গ্রেডে পদোন্নতি পেতে হলে কায়স্থদের নাকি ২৭ থেকে ৩০ বছর বা তারও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ব্রাহ্মণ নাকি ১২ বছরের মধ্যেই ৩য় গ্রেডে পদোন্নতি পান, ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে প্রথম গ্রেড প্রাপ্ত হন। প্রথমত, সব ব্রাহ্মণ এত কম সময়ে পদোন্নতি পান না। দ্বিতীয়ত, প্রশাসনে পদোন্নতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতি এক জিনিষ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরি সব নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত। যোগ্যতা থাকলে ন্যূনতম ২৫ বছর বয়সেই পি.এইচ.ডি. শেষ করে অধ্যাপক পদে চাকুরিতে ঢোকা যায়, যোগদানের পর ১২ বছর অপেক্ষা করার প্রয়োজন হয় না। তৃতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতির জন্য শুধু নির্দিষ্ট সময় চাকরি করাই যথেষ্ট নয়। নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রবন্ধ দেশ-বিদেশের স্বীকৃত গবেষণাপত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর এবং দেশে বা বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি করার পরই অধিকাংশ ব্রাহ্মণ প্রমোশন পেয়ে থাকেন।

তৃতীয় সাফাই: কায়স্থদের সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টার পরও অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। ব্রাহ্মণেরা ৯টা-৫টা অফিস করেন না বটে, কিন্তু শ্রেণীকক্ষে পড়ানোর পর বাসায় ফিরেও তাঁকে প্রশ্ন করা, খাতা দেখা, পরের দিনের বক্তৃতার জন্যে প্রস্তুত হওয়া, পদোন্নতি বা আত্মার তাগিদে গবেষণা করা ইত্যাদি হাজারো কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। অফিসে নিয়মিত উপস্থিত থাকেন না এমন কায়স্থ যেমন আছেন, সারা রাত অধ্যয়নে অতিবাহিত করেন, তেমন ব্রাহ্মণও বিরল নন।

চতুর্থ সাফাই: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্রাহ্মণদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ বছর। অন্যদিকে কায়স্থদের অবসর গ্রহণের বয়সসীমা ৫৯ বছর। ৫৯ থেকে ৬৫ পর্যন্ত সময়টা শিক্ষকেরা পরিশ্রম করেই বেতন নিয়ে থাকেন। বাঙালিদের গড় আয়ু যেভাবে বাড়ছে, কায়স্থদের অবসর গ্রহণের বয়সসীমা কোনো একদিন নিশ্চয়ই পাশ্চাত্যের দেশগুলোর মতো ৬৫-৭০ বছর করা হবে। ততদিন পর্যন্ত ব্রাহ্মণদের কম বেতন দেওয়া কি যুক্তিযুক্ত? তাছাড়া, কে কখন অবসর নেবেন সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। একজন ব্রাহ্মণ যদি কায়স্থদের মতো ৫৯ বছর বয়সে অবসর নেবার সিদ্ধান্ত নেন, তবে চাকুরিকালে তাঁকে কি কায়স্থদের সমান বেতন দেয়া হবে?

পঞ্চম সাফাই: প্রথম গ্রেডভূক্ত কায়স্থের সংখ্যা বর্তমানে ১২২, কিন্তু প্রথম গ্রেডভুক্ত ব্রাহ্মণের সংখ্যা ৮২০। নতুন স্কেলে ব্রাহ্মণদের প্রথম গ্রেড দিলে সরকারের খরচ বেড়ে যায় বটে, তবে খরচের সে অঙ্ক পদ্মা সেতু করার ক্ষমতাসম্পন্ন মধ্য আয়ের একটি দেশের জন্যে এমন কিছু বেশি নয়। মূল সমস্যা অন্য জায়গায়। ব্রাহ্মণদের প্রথম গ্রেড দিলে প্রথম গ্রেডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কায়স্থরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়বেন। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হওয়াটা যে খুব একটা নিরাপদ নয়, সে কথা বলা বাহুল্য।

প্রজ্ঞাপনে যা উল্লেখ করা হয়নি তা হচ্ছে, প্রত্যেক কায়স্থ বিনা সুদে ঋণ পায়, গাড়ি পায়, কর্তব্য পালনের জন্যে অপরিহার্য না হলেও বিদেশে গিয়ে পি.এইচ.ডি. করার জন্যে মোটা অনুদান পায়, এখন-তখন বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে প্রমোদভ্রমণের সুযোগ পায়। কায়স্থরাই বিদেশ থেকে আসা শিক্ষাবৃত্তির সিংহভাগ কুক্ষিগত করে। কায়স্থ চাইলেই ক্ষমতা অপব্যবহারের সুযোগ পায়, আর ব্রাহ্মণদেরতো কোনো ক্ষমতাই নেই! অবসরের পর গড় শিক্ষকদের সম্পদ ও গড় কায়স্থদের সম্পদের তুলনা করলেই পরিষ্কার হবে, চাকুরি-জীবনে কে কেমন সুযোগ পেয়ে থাকেন।

সপ্তম বেতন-স্কেল পর্যন্ত কায়স্থতন্ত্রের একজন পিয়নও টাইম স্কেল পেতো, যা ব্রাহ্মণদের কখনই দেয়া হতো না। কিছু সংখ্যক ব্রাহ্মণ সিলেকশান গ্রেড পেতেন বটে। সব মিলিয়ে ব্রাহ্মণদের প্রতি তখনও বিমাতাসুলভ আচরণ করা হতো, এখনও হচ্ছে। জাতীয় অধ্যাপকদের সাথে নাকি কোনো কায়স্থের তুলনা চলে না। অন্নদাশঙ্কর রায় বা সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর মতো কায়স্থের সঙ্গেও কি সব ব্রাহ্মণের তুলনা চলে? বিরল একজন কায়স্থ বা ব্রাহ্মণের অর্জন ও সম্মানের নিরিখে সব কায়স্থ বা ব্রাহ্মণকে বিচার করা যুক্তিমনষ্কতার পরিচায়ক নয়।

সমতটের নবকায়স্থরা দেবীর বরপুত্র। তাদের অন্তকরণে ব্রাহ্মণসহ অন্য পেশাজীবীদের প্রতি গোপন কোনো ঈর্ষা থাকাও বিচিত্র নয়। প্রাচীন ভারতে প্রবাদ ছিল: মায়ের পেটে থাকার সময় কায়স্থ যে (মাকরশার বাচ্চার মতো) মাকে খেয়ে ফেলে না, সে শুধু তখনও তাদের দাঁত গজায়নি বলে। অন্য কেউ তাদের সমান খাবে, কোন ‘কায়েতের বেটা’ সেটা সহ্য করতে পারে!