‘অনাহারে মরে সে!’ এই হীরক-রাজকীয় প্যারডি ছাড়াও একাধিক বাংলা প্রবচনে লেখাপড়ার প্রতি বাঙালির তাচ্ছিল্য এবং অনাগ্রহের কথা প্রকাশ পেয়েছে: ‘সোমবারে মাথা ধরা, মঙ্গলবারে পেট কামড়া, বুধবারে গায়ে কেমন, বিষুদবারে পলায়ন!’ ‘লিখিব, পড়িব, মরিব দুখে; মৎস্য মারিব খাইব সুখে!’ ‘মৎস্য মারিব, খাইব ভাত; লেখাপড়া, এ কী উৎপাত!’ সত্যিই তো, মাছে-ভাতে সুখী গড়পড়তা বাঙালি সন্তান কেন লেখাপড়ার উটকো ঝামেলা মাথায় নিতে যাবে?
লেখাপড়া শিখতে হবে কেন? কেনই বা শিশুদের লেখাপড়া শেখাতে হবে? সত্যি কথা বলতে কী, লেখাপড়া শেখার ঝামেলাটা মানুষের জীবনে সব সময় ছিল না। মধ্যযুগের দ্বিতীয় পর্বে (১১০০-১৩০০) যখন থেকে ইওরোপে বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রিক আধুনিক শিক্ষার সূত্রপাত, তখন থেকেই বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর লক্ষ্য একটা ডিগ্রি অর্জন, যে ডিগ্রি দেখিয়ে সে একটা কাজ পাবে। সে যুগে অর্থাৎ দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে ইওরোপের সমাজে আইন, ধর্ম, মুক্তকলা এবং চিকিৎসা – এই চারটি বিষয়ে দক্ষতাসম্পন্ন মানুষের একটা চাহিদা সৃষ্টি হয়েছিল। ডিগ্রিগুলো ছিল সেই দক্ষতার রাষ্ট্রীয়/ধর্মীয় স্বীকৃতি। ডিগ্রির চাহিদা ছিল বলে ডিগ্রি সরবরাহের ব্যবস্থা হয়েছিল, প্রথমে ইতালি এবং ফ্রান্সে, পরে সারা ইওরোপে এবং আরও পরে সারা পৃথিবীতে। সে যুগেও অবশ্য কিছু শিক্ষার্থী নিছক জ্ঞান অর্জনের জন্যেই লেখাপড়া করতো, তবে তাদের সংখ্যা ছিল খুবই কম।
যে মানুষ একটা প্রাণী হয়ে পৃথিবীতে জন্ম নেয়, শিক্ষকেরা তাকে কমবেশি কেটে-ছেঁটে, সংস্কৃতি ও জ্ঞানের সঙ্গে তার সংযোগ ঘটিয়ে, ‘মানুষের মতো মানুষ’ করে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন। শিক্ষার মাধ্যমে পূর্ববর্তী প্রজন্মের জ্ঞান পরবর্তী প্রজন্মের হাতে পৌঁছায়। কিন্তু মধ্যযুগের মতো বর্তমান যুগেও বেশির ভাগ মানুষ শ্রেফ জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে লেখাপড়া করে না। মানুষ একটা ডিগ্রি হাতে পেতে চায়, কারণ গত কয়েক শ বছর ধরে সমাজ তাকে কোনও না কোনোভাবে (মিথ্যা?) আশ্বাস দিয়ে আসছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ডিগ্রি হাতে থাকলে ‘সম্মানজনক’ একটা কাজ তাকে দেয়া হবে। একটা সম্মানজনক পেশা থাকলে (অন্ততপক্ষে দক্ষিণ এশিয়ায়) বিয়ের বাজারেও পাত্র বা পাত্রীর একটা দাম থাকে বৈকি।
কিন্তু গত এক দশক যাবৎ পাশ্চাত্যে কাজের জগৎ বদলে যাচ্ছে। নিছক ডিগ্রি দেখিয়ে আশানুরূপ কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা কমে আসছে দিন দিন, বিশেষ করে উত্তর আমেরিকায়। একজন কলেজ বা স্কুলপাশ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়পাশ শিক্ষার্থীর তুলনায় বেশি বেতনের চাকুরি পেতে পারে, পাচ্ছেও, কারণ ঐ কাজে তার দক্ষতা আছে এবং/বা ছাত্রজীবনে সে লেখাপড়া ছাড়াও সঙ্গীত করেছে, নাটক করেছে, স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বিভিন্ন সময়ে সমাজের সেবা করেছে বা বিপন্নের রক্ষায় এগিয়ে এসেছে। নিছক ডিগ্রিধারী নয়, একজন জ্ঞানবান এবং সম্পূর্ণ মানুষকেই উচ্চতর বেতনে নিয়োগ দেওয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ। নিয়োগকর্তাদের কাছে ডিগ্রি নয়, কর্মপ্রার্থীর দক্ষতা, সহমর্মীতা বা মানবিকতা বড় গুন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
আমাদের নিয়োগকর্তারাও যদি এখনি এদিকে একটু দৃষ্টি দেন, তবে বাঙালি সমাজে বেহুদা ডিগ্রি-লোলুপতা ধীরে ধীরে কমে আসতে পারে। কৃষিতে যার আদৌ আগ্রহ নেই, তাকে কেন কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি নিতে হবে? কৃষিবিজ্ঞানে যার স্নাতক ডিগ্রি আছে তাকেই বা কেন ব্যাংকে চাকুরি করতে হবে? এগুলো নেহায়েতই ব্যক্তি, পরিবার ও রাষ্ট্রের সময়, সামর্থ্য ও অর্থের অপচয়। ব্যাংক বা আমলাতন্ত্র সামাল দেয়ার জন্যে মাধ্যমিকের পর চার বছরের একটি সাধারণ কলেজ ডিগ্রিই কি যথেষ্ট হওয়া উচিত নয়? কোনো বিশেষ বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের আগ্রহ যাদের নেই, তারা সেই কলেজ ডিগ্রি নিয়ে কর্মজীবনে ঢুকে যাবে। সেই সাধারণ কলেজ-ডিগ্রির সিলেবাসে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, অংক, ভূগোল, ইতিহাস, আইন, বাণিজ্য সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতিবিজ্ঞান ইত্যাদিসহ এমন অনেক বিষয়ই থাকবে যেগুলো শিক্ষার্থীকে একজন সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখতে পারে। যারা বিশেষায়িত জ্ঞানে আগ্রহী তারা নিজেদের যোগ্যতা অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট বিষয়ে ভর্তি হতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হবে মূলত গবেষণা। শিক্ষাদান হবে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের আলোচনা-ভিত্তিক, নিছক শিক্ষকের বক্তৃতা-ভিত্তিক নয়।
উচিৎ শিক্ষা অনেকাংশে পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের উপর নির্ভর করে। শিক্ষকের একার কাঁধে শিক্ষার দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিত থাকলে চলবে না। শিক্ষা একটা সামগ্রিক ব্যাপার। বাচ্চারা শুনে শেখে, দেখে শেখে। অনেক শিক্ষিত অভিভাবকের বাড়িতেও বই বলতে আছে শুধু চেকবই। আপনার বাচ্চা যদি বই পড়ার পরিবর্তে সারাদিন আপনাকে টিভি দেখায় ব্যস্ত দেখে, তবে সেইবা বই পড়তে চাইবে কেন? বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার পরিবর্তে পিতামাতা যদি অন্যের প্রতি ইর্ষাপ্রসূত সমালোচনা বা গীবত, চাকুরি বা ব্যবসার তরিক্কি, শাড়ি-গয়না-মেকআপের আলোচনায় ব্যস্ত থাকে, তবে সন্তানের মধ্যে চিন্তাশীলতার বিকাশ আশা করা কি ঠিক হবে?
শিক্ষার উদ্দেশ্য যদি জ্ঞান অর্জন হয়, তবে প্রশ্ন হতে পারে, জ্ঞান কী? জ্ঞান কি শুধুই স্মৃতি? এক গাদা তথ্য মনে রাখাই কি জ্ঞান? আমাদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোতে সাধারণত পরীক্ষার্থীর স্মৃতিশক্তি যাচাই করা হয়। ‘সুবিন্যস্ত স্মৃতির ভিত্তিতে যুক্তির আলোকে নতুন কোনো তথ্য বিশ্লেষণ করে সাধারণীকরণ করার ক্ষমতাই হচ্ছে জ্ঞান – এ রকম একটি কাজ চালানোর মতো সংজ্ঞা মেনে নেওয়া যাক। আজকের বৈদ্যুতিন যুগে স্মৃতির উপর চাপ কিছুটা কমে এসেছে, কারণ তথ্য এখন হাতের মুঠোয়। কিন্তু যুক্তির আলোকে কীভাবে তথ্য বিশ্লেষণ করতে হয়, সেটা আমাদের এখনও শিখতে হবে, শেখাতে হবে। আন্তর্জালের বদৌলতে এখনকার শিক্ষার্থীরা তথ্যে সয়লাব, কিন্তু যুক্তিসম্মত বিশ্লেষণ করার মতো দক্ষতা যদি অর্জিত না হয়, তবে শিক্ষা অনেকটাই বিফল।
প্রতিটি মানুষ আলাদা। প্রত্যেক শিশুর মেধা আছে, আলাদা আলাদা মেধা। উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা গেলে নিজের সন্তানের মেধার স্ফুরণ দেখে বাবা-মা ও সমাজ অবাক হয়ে যাবে। মানবশিশুর মেধার এই স্ফুরণ শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত। হাওয়ার্ড গার্ডনার তাঁর ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত পুস্তক Frames of Mind: The Theory of Multiple Intelligences পুস্তকে নয় ধরনের মেধার কথা উল্লেখ করেছেন।
১. প্রকৃতি-মেধা: এই মেধাটি থাকাতে আদিম মানুষ প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান, প্রাণী, উদ্ভিদ, ধাতু ইত্যাদির মধ্যে পার্থক্য করতে পারতো এবং সেই পার্থক্য মনে রাখতে পারতো। কোন উপাদানটি বিপদজনক আর কোনটি জীবনসহায়ক – আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে কেউ কেউ এই পার্থক্য করতে না পারলে মানুষের টিকে থাকা সম্ভব হতো না। যাদের মধ্যে এই মেধা আছে তারা হয়তো সহজে বলতে পারে, কোন গাড়িটি, কোন মাংসটুকু বা কোন কোম্পানির ওষ্ঠরঞ্জনী ভালো কিংবা খারাপ।
২. সঙ্গীত-মেধা: এই মেধা যাদের রয়েছে তারা সঙ্গীতের স্বরলিপি-তাল-বিট ইত্যাদি খুব তাড়াতাড়ি বোঝে। এরা সাধারণত শুনে শুনেই গাইতে পারে বা কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শিখে যায়।
৩. যুক্তি-গণিত মেধা: যারা এই মেধার অধিকারী তারা সাধারণত অংকে ভালো হয়। বিভিন্ন সম্ভাবনা বা প্রস্তাবের (লজিক্যাল প্রপোজিশন) মধ্যে তুলনা করে, এ্যারিস্টটলীয় যুক্তিবিদ্যার আরোহ-অবরোহ পদ্ধতি অবলম্বন করে এরা শার্লক হোমসের মতো দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছে যেতে পারে। প্রকৃতিতে ও বাস্তবে বিভিন্ন ঘটনা বা বস্তুর বিভিন্ন প্যাটার্ন, ক্যাটাগরিকে আলাদা করতে পারে এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় করতে পারে। এদের সাত-পাঁচ চৌদ্দ বোঝানো যায় না। এরা বিজ্ঞানী হয়, গোয়েন্দা হয়, অংকবিদ হয়।
৪. অস্তিত্ব-মেধা: এই মেধা যাদের আছে তারা জীবনের উদ্দেশ্য কী, মৃত্যুর পর কী হবে, এই সব নিয়ে প্রশ্ন করে। সুতরাং এরা দার্শনিক, ধর্মপ্রচারক ইত্যাদি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এটা হচ্ছে গার্ডনারের মত। অন্য একটি দৃষ্টিকোণ থেকেও এই মেধাকে দেখা যায়। এই মেধা যাদের আছে তারা যে কোনো পরিবেশে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। দশ জন মানুষকে যদি জনমানবহীন কোনো বনে ছেড়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানে তারাই হয়তো টিকে থাকবে যাদের অস্তিত্বমেধা রয়েছে।
৫. আন্তসম্পর্ক মেধা: এই মেধার অধিকারীরা অন্যের মনোভাব, ব্যক্তিত্বের ধরন, মানসিক অবস্থা বুঝে কার্যকর ভাষিক ও ইঙ্গিতনির্ভর যোগাযোগ করতে পারে। এই মেধার অধিকারী ব্যক্তিরা নেতা, শিক্ষক বা উকিল হিসেবে নাম করতে পারেন।
৬. শরীর-সঞ্চালন মেধা: মন ও শরীরের মধ্যে দ্রুত যোগাযোগ সাধন করে সঠিক সময়ে শরীরের সঠিক অঙ্গটি সঠিক ভঙ্গিতে এবং সঠিক দিকে চালনা করার দক্ষতা থাকে এই মেধার অধিকারীদের। এরা সার্কাসে, খেলাধুলায় ভালো করে। ভালো ড্রাইভিং করার কথা এদের। এরা ভালো সার্জন হতে পারে।
৭. ভাষাগত মেধা: এই মেধার অধিকারীরা ভাষা ব্যবহারে দক্ষ হয়। এরা পড়তে, লিখতে, গল্প বলায়, তড়িৎ উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পাওয়া দক্ষ হয়ে থাকে। এরা সাহিত্যিক, লেখক, বক্তা, চলচ্চিত্রকার ইত্যাদি পেশায় ভালো করার কথা।
৮. আত্মজ্ঞান মেধা: ‘আত্মানাম বিদ্ধি’ বা ‘নিজেকে জানো’। যারা এই মেধার অধিকারী তারা ভালো করে জানে, কী তাদের দ্বারা করা সম্ভব এবং সম্ভব নয় এবং সেই অনুসারে তারা জীবনে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়। অন্য কারো কাছ থেকে এদের অনুপ্রেরণা পাবার প্রয়োজন নেই। মনস্তত্ববিদ, নবী, দার্শনিক, ধর্মগুরুদের মধ্যে এই মেধা দেখা যায়।
৯. স্থানিক মেধা: নিজের অবস্থান এবং তার চতুর্পাশের ছবি অথবা মনে আগে থেকে থাকা ছবি দ্রুত বিশ্লেষণ করে যুক্তির ভিত্তিতে এরা পরবর্তি পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এক খ- পাথর দেখে ভাস্কর কল্পনা করতে পারে, সেই পাথর দিয়ে তৈরি ভাস্কর্য দেখতে কেমন হবে। ইলোরার শিল্পিকে বড়সড় একটি পাথুরে পাহাড় দেখে কল্পনা করতে হয়েছিল ভিতরের মূর্তি, চত্বর, স্তম্ভ, দেয়ালের রিলিফ ভাস্কর্য ইত্যাদি কেমন হবে। নাবিক, পাইলট, অঙ্কনশিল্পি, ভাস্কর, গ্রাফিক ডিজাইনার হতে গেলে এই ধরনের মেধা থাকতে হয়।
গার্ডনারের এই নবমেধার সঙ্গে সবাই একমত নন এবং অনেক ক্ষেত্রে একটি মেধাকে অন্যটি থেকে ঠিকঠাকমতো আলাদাও করা যায় না। তবুও এটুকু স্বীকার করতে বাধা নেই যে হোমো সাপিয়েন্স মানবের মধ্যে এসব মেধা কমবেশি ছিল বলেই মানবজাতি টিকে থাকতে পেরেছে এবং মানবসমাজ গঠিত হতে পেরেছে। তাদের উত্তরপুরুষ আমাদের মধ্যেও এসব মেধা কমবেশি থাকার কথা। অনেক ব্যক্তির মধ্যে একাধিক মেধার সমন্বয় বিরল নয়। একেক জন মানুষের মধ্যে একেক মেধা প্রবল হতেও দেখি আমরা, কিন্তু তার মানে এই নয় যে যার মধ্যে সেই বিশেষ মেধা নেই, চেষ্টা করলেও সেই মেধার অনুরূপ দক্ষতা সে অর্জন করতে পারবে না। চেষ্টা করলে যে কেউ যে কোনো দক্ষতা অর্জন করতে পারে Ñ শিক্ষাব্যবস্থার কর্তাব্যক্তিদের এটাই ধরে নিতে হবে, এর বিপরীতটা নয়, কারণ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, কোনো প্রয়াসরত অ-মেধাবী লোকের অর্জন জন্মগতভাবে মেধাবী (কিন্ত প্রশিক্ষণহীন, চেষ্টাহীন) লোকের অর্জনকে ছাড়িয়ে গেছে।
সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড ইত্যাদি নরডিক দেশগুলো বা আমেরিকা-কানাডার স্কুল-কলেজে সব ধরনের মেধা বা দক্ষতাকে উদ্দীপ্ত করার কমবেশি চেষ্টা থাকে। কানাডার কুইবেকের অনেক স্কুলে অংকে ফেল করলেও ছাড় দেওয়া হয়, কিন্তু খেলাধুলা বা অভিনয়ে পাশ নম্বর পেতেই হয়। বাংলাদেশের অভিভাবক, সমাজ এবং শিক্ষাব্যবস্থা সাধারণত দুই ধরনের মেধা, ৩নং ও ৭নং অর্থাৎ যুক্তিগণিত মেধা বা ভাষাগত মেধা/দক্ষতা অর্জনের পরিমাণের আলোকে শিক্ষার্থীকে বিচার করে থাকে। বাকি ৭টি মেধার অধিকারী শিক্ষার্থীকে কম মূল্যায়ন করা হয় বা আদৌ মূল্যায়ন করা হয় না। এটা আমাদের এবং অন্য অনেক দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম দুর্বলতা।
বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের পরিমাণ আশির দশকের পর থেকে কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের ছাত্রজীবনে প্রত্যেক জাতীয় দিবসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো এবং এর প্রস্তুতি চলতো কয়েক মাস ধরে। শিক্ষকদের উৎসাহে ছাত্রছাত্রীরা যে যার মেধা অনুসারে গান, নাচ, কবিতা আবৃত্তি, উপস্থিত বক্তৃতা, খেলাধুলা ইত্যাদির অনুশীলন করতো। বছরে অন্তত একটা নাটকতো হতোই আমাদের স্কুলে। আমরা ছাত্ররাই চাঁদা তুলে অনুষ্ঠানের খরচ জোগাড় করতাম। দিনের পর দিন রিহার্সাল, আমন্ত্রণপত্র ছাপানো, সিন-সিনারী, মাইক ভাড়া করা, মেকআপম্যানকে খবর দেয়া, আশে পাশের বাড়ি থেকে চৌকি এনে স্টেজ বাঁধাসহ বহু বিচিত্র কর্মকা-ে বেশ একটা উৎসব-উৎসব ভাবের সৃষ্টি হতো স্কুলে। এতে করে আমরা শিখতাম, কীভাবে নেতৃত্ব দিতে হয়, নেতার নির্দেশ পালন করতে হয়। চোখের দুই ‘চুইংগাম’ (অথবা ‘আইগাম’ বা ‘দৃষ্টিলেহন’) অর্থাৎ আশির দশক থেকে সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে যাওয়া নালায়েক টিভি (সংক্রামক যক্ষèা রোগের প্রতিশব্দ নয়!), নব্বয়ের দশকে হাজারটা দেশি-বিদেশি ‘ছ্যানাল’ (চাঁপাই-নবাবগঞ্জের ভাষায়) আর তারপর একবিংশ শতকের শুরুতে মোবাইল এসে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণমূলক সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সাড়ে ১২টা বাজিয়ে দিয়েছে। ফরাসিতে একটা প্রবাদ আছে: এটা ওটাকে ধ্বংস করবে। সংস্কৃতিকে যদি মুছে দেওয়া হয়, তবে ড্রাগ আর ধর্মান্ধতা এসে তার জায়গা দখল করবে, ইতিমধ্যে করেছেও। মাও সে তুঙ ধর্মকে গরীবের আফিম বলেছিলেন, সেই চল্লিশের দশকে।
মেধা হয়তো অনেকটাই জন্মগত, কিন্তু দক্ষতাটা অনুশীলন করে অর্জন করতে হয়। একজন শিক্ষার্থী যখন উচ্চমাধ্যমিক পাশ করবে, তখন তার কাছ থেকে আমরা কী কী দক্ষতা আশা করতে পারি?
প্রথম দক্ষতা হচ্ছে, অন্যকে সহযোগিতা এবং দলগত সাফল্যে অবদান রাখতে পারা (টিমওয়ার্ক)। সমাজে আমরা একা বাস করি না। দশে মিলি করি কাজ। শ্রেণীকক্ষে সবাই মিলে নোট নিতে হবে, নোট শেয়ার করতে হবে, সবাই মিলে শিখতে হবে, বাঁচতে হবে। সবার আগে চলে গেলেনতো আপনি একা হয়ে গেলেন। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়াটাই হচ্ছে আসল দক্ষতা। অন্ধের দেশে কানা রাজা হয়ে কী লাভ?
দ্বিতীয় দক্ষতা হচ্ছে সৃজনশীলতা এবং কল্পনাশক্তি। ‘আমার ছেলেটাকে বিজ্ঞানী হিসেবে গড়ে তুলতে হলে কী করতে হবে?’ আইনস্টাইনকে জিগ্যেস করেছিল এক মা। আইনস্টাইন উত্তর দিয়েছিলেন: ‘ওকে রূপকথা পড়ে শোনান। আর আমার চেয়েও বড় বিজ্ঞানী যদি বানাতে চান, তবে তাকে আরও বেশি করে রূপকথা শোনান!’
বাংলাদেশ এবং বিদেশের স্কুলে আগে কবিতা বা ছড়া মুখস্ত করার একটা প্রথা ছিল। গত কয়েক দশকে সে প্রথা বাতিল হয়েছে, সম্ভবত কোনো একদল নালায়েক শিক্ষাবিদের পরামর্শে: ‘মুখস্ত করা চলবে না, সবাইকে সৃজনশীল হতে হবে!’ সৃজনশীলতার সঙ্গে স্মৃতিশক্তির একটা সম্পর্ক থাকাটা অসম্ভব নয়। বাচ্চাদের যদি কবিতা বা ছড়া মুখস্ত করানো হয়, তবে তার স্মৃতিশক্তি বাড়বে, কবিতার প্রতি তার একটা ভালোবাসা দাঁড়িয়ে যাওয়াও অসম্ভব নয়। ভিয়েনায় আমার পরিচিত আট বছরের এক ছেলে, যার নাম শব্দ, তাকে কয়েকটি বাংলা কবিতা ও ছড়া মুখস্ত করিয়েছিলাম। কয়েক মাসের মাথায় শব্দ তার মাতৃভাষা জার্মানে তার মতো করে কবিতা লিখতে শুরু করেছে। এটা কাকতালীয় ঘটনা হতে পারে, কিন্তু স্মৃতিতে ছন্দময় কিছু বয়ান থাকার সঙ্গে মনে কবিতা লেখার ইচ্ছা হওয়া বা কমবেশি ক্ষমতা সৃষ্টি হবার মধ্যে একটা সম্পর্ক থাকাটা অসম্ভব নয়।
তৃতীয় দক্ষতা হচ্ছে সমালোচনামূলক চিন্তা, ইংরেজিতে যাকে বলে ক্রিটিক্যাল থিংকিং। যে কোনো সিদ্ধান্ত বা থিসিসকে সিংহাবলোকন (দূর থেকে দেখা) বিহঙ্গাবলোকন (উপর থেকে দেখা) এবং কীটাবলোকনে (কাছ থেকে দেখা) বিচার করার পারার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। নিরন্তর নিজেকে সন্দেহ করতে হবে: আমি যা বলছি সেটা হয়তো ঠিক নয়, হয়তো অন্যেরটাই ঠিক। আমি যা ভাবি বা বলি তাইই সঠিক – এ ধরণের অসংস্কৃত মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
চতুর্থ দক্ষতা হচ্ছে, কোনো সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা। চরিত্র ও আচরণের নমনীয়তা এবং যে কোনো পরিস্থিতি বা ব্যক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবার ক্ষমতা হচ্ছে পঞ্চম দক্ষতা। অন্যের মতের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে, প্রয়োজনে নিজের মতের পরিবর্তন করতে হবে এবং অন্যের মত মেনে নিতে হবে।
ষষ্ট দক্ষতা হচ্ছে বৈশ্বিক ও সাংস্কৃতিক জ্ঞানের অধিকারী হওয়া। স্বদেশীয়, আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক সংস্কৃতি সম্পর্কে ওয়াকেবহাল থাকতে হবে। তথ্যভাণ্ডারে প্রবেশ করতে শেখা হচ্ছে সপ্তম দক্ষতা। আন্তর্জাল, পাঠাগার ইত্যাদি ব্যবহারে দক্ষ হয়ে উঠতে হবে। তথ্য ছড়িয়ে আছে সবখানে, প্রয়োজনমতো তথ্য খুঁজে নিয়ে নিজেকে সব সময় আপডেটেড রাখতে হবে। যে লোক আপডেটেড থাকে, তাকে সাত-পাঁচ-চৌদ্দ বোঝানো যায় না।
অষ্টম দক্ষতা হচ্ছে, নেতৃত্ব। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব দিতে শেখাতে হবে। দক্ষ নেতৃত্বের উপর সমাজের অগ্রগতি অনেকাংশে নির্ভর করে। সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষমতা হচ্ছে নবম দক্ষতা। সমাজে থাকতে হলে কী কী করা যায়, আর কী কী করা উচিৎ নয় শিক্ষার্থীকে সেটা জানতে হবে। ভাষার বাচনিক ও লিখিত রূপ শিক্ষার্থীর নিয়ন্ত্রণে থাকাটা হচ্ছে দশম দক্ষতা। এই দক্ষতা যাদের আছে, তারা ভালো লেখক, সাংবাদিক, নাট্যকার বা চিত্রনাট্যকার হয়ে থাকেন। একাদশ দক্ষতা হচ্ছে, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি নিজের দায়িত্ব পালন এবং নৈতিক অবক্ষয় রোধ। ব্যক্তি ও সমাজের উন্নতিকল্পে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে দ্বাদশ দক্ষতা।
স্কুলজীবন থেকেই প্রতিটি ছাত্রের একটা (মেধা, দক্ষতা বা প্রবণতার) ক্যারিয়ার চার্ট থাকতে পারে, যা দেখে বোঝা যেতে পারে, ছাত্রের মধ্যে কোন ধরনের মেধা আছে বা কোন ধরনের যোগ্যতা অর্জনের দিকে তার কমবেশি ঝোঁক আছে। তবে এমন অনেক মানুষও আছে, যাদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন মেধার বিকাশ হতে দেখা গেছে বা তারা বিভিন্ন দক্ষতা অর্জনে আগ্রহী হয়েছে। নিয়োগকর্তারা সময়-সুযোগমতো এই ক্যারিয়ার চার্টের উপর নির্ভর করতে পারেন।
লেখাপড়া ভয়ের নয়, আনন্দের বিষয় হবে এবং এর সঙ্গে প্রকৃতি, সমাজ ও বিশ্বের সার্বক্ষণিক যোগ থাকতে হবে। ‘বালকদিগের হৃদয় যখন নবীন আছে, কৌতুহল যখন সজীব এবং সমুদয় ইন্দ্রিয়শক্তি যখন সতেজ তখনই তাহাদিগকে মেঘ ও রৌদ্রের লীলাভূমি অবারিত আকাশের তলে খেলা করিতে দাও… তরুলতার শাখাপল্লবিত নাট্যশালায় ছয় অঙ্কে ছয় ঋতুর নানারসবিচিত্র গীতিনাট্যাভিনয় তাহাদের সম্মুখে ঘটিতে দাও।’ শিক্ষাসমস্যা প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের উপরোক্ত সুপারিশের আলোকে বলা যেতে পারে: বিদ্যালয়, স্কুল, মাদ্রাসা… সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেশের প্রকৃতি, সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম ইত্যাদির পরিচয় ঘটাতে হবে। প্রবাদ আছে: বিদ্যার সঙ্গে সম্পর্কহীন জীবন অন্ধ এবং জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন বিদ্যা পঙ্গু। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র, যেমন বাজার, শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি ইত্যাদির সঙ্গে শিক্ষার্থীর মেধা ও যোগ্যতার সংযোগ ঘটিয়ে বর্তমান ও অনাগত ভবিষ্যতের বিচিত্র দাবি মেটানোই শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিৎ।
Viagracanada
http://buylasixshop.com/ – what foods to avoid when taking furosemide?
Lasix
http://buyzithromaxinf.com/ – azithromycin 250 mg tablet
https://buyneurontine.com/ – gabapentin in dogs
Where To Buy Finasteride
Viagra Generico Originale
Benadryl And Amoxicillin Same Time
Viagra Rezeptfrei Bankeinzug
Citalopram Propecia
viagra sildenafil citrate cialis 20 mg
Keflex Side Effects Eye
cialis order online
plaquenil and weight gain
gabapentin overdose
best place to buy cialis online
Fedex Stendra Visa Free Shipping On Line
no perscription azithromocin tablets
propecia vs generic finasteride
Amoxicillin And Pill Size
do you need a prescription for propecia
Canadian Px
cialis items http://alevitrasp.com natdyncdrync
commande viagra Plaquenil Amoxicillin Safety Dosing For Dogs Yaqzem
I every time spent my half an hour to read this webpage’s articles or reviews daily along with a cup of coffee.
Placing your issues do proceeds, that nilai nilai Al natural process answer and catering for the that cannot my life does viagra make you bigger Factory Supply API Medicine Grade Sildenafil CAS 139755 83 2