সর্দারজী যখন গোঁফ মুচড়ে, দাঁড়ি আঁচড়ে, পাগড়ি বাঁধতে শুরু করলে তখন বুঝলুম, ট্রেন পেশোয়ার পৌঁছতে আর বেশি দেরি নেই – অনেকটা এ রকম কিছুই লিখেছিলেন গুরু মুজতবা আলী তাঁর ‘দেশে বিদেশে’ পুস্তকে। আমিরাত ফ্লাইটে কিশোরী-যুবতী-পক্ককেশী বুড়ি ইস্তক সবাই যখন চরম অনিচ্ছায়, হঠাৎ গোমড়া হয়ে ওঠা মুখ বাঁকিয়ে অস্ফূট স্বরে গজরাতে গজরাতে নিজের খালি মাথা ওড়না দিয়ে ঢাকতে আরম্ভ করলে, তখন আমিও বুঝে ফেললুম, অনতিবিলম্বে তেহরান বিমানবন্দরে অবতরণ করতে যাচ্ছি।
অতি ছিমছাম কিন্তু খুব কাজের বিমানবন্দর এই তেহরান। অসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে পাসপোর্টে সিল মেরে যাত্রীদের ‘খালাস’ করে দিল অভিবাসন কর্মকর্তা, কোনো প্রকার ফালতু, খাজুইরা প্রশ্ন করা ছাড়াই। বাইরে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল চীনা ভাষার দুই শিক্ষক, একজন চীনা এবং অন্যজন ইরানী। তাদের সঙ্গে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে লক্ষ্য করলাম, সি-অফ বা রিসিভ করতে আসা বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজন বিমানবন্দরে ঢুকে যাত্রীর সঙ্গে চা-কফি খেতে খেতে খোশগল্প করতে পারে। এতে করে যাত্রীরা স্বস্তি পায়, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ পায় নগদ নারায়ণ। এগুলো হচ্ছে সভ্য জাতির সভ্য বিমানবন্দরের লক্ষণ। এই অতি সাধারণ এক একটা সুবিধা কিংবা সভ্যতার ছোঁয়া ঢাকা, কোলকাতার বিমানবন্দরে নেই বলে দুঃখ করছি না, কারণ বহু বছরের অভ্যাসে এসব অসভ্যতা সয়ে গেছে।
বিমানবন্দর শহর থেকে বেশ দূরে। গাড়ি চলছেতো চলছেই। রাস্তার বামদিকে ঝাউ আর দেবদারু গাছের সারির পেছনে গমের ক্ষেত। ডানদিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, সর্ষেক্ষেত ফুলে-ফুলে হলুদ হয়ে আছে। মাটিতে পানির অভাব আছে বলে মনে হলো। কোথাও কোথাও স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেচ চলতে দেখলাম। অনেক রুক্ষ জমি খিল পড়ে আছে। বেশির ভাগ গাছ গুল্মজাতীয়, বড় গাছ কম। জমি খুব উর্বর বলে মনে হলো না। অবশ্য জমি যদি উর্বরই হতো, তবে পারসিকরা কি হাজার বছর আগে ইরান থেকে সুদূর বাংলা অঞ্চলে চলে আসতো। মুজতবা আলীর লেখায় কোনো ইরানি কবির কবিতা পড়েছিলাম: ‘পরিপূর্ণতা পাবে তুমি কোথা, ইরান দেশের ভূঁয়ে; মেহেদির পাতা কড়া লাল হয় ভারতের মাটি ছুঁয়ে।’
বিমানবন্দর সড়ক থেকে ডানদিকে তাকালে মাইলখানেক দূরে পাহাড়ের সারি। পেছনের পাহাড়গুলো ন্যাড়া আর সামনের একটি পাহাড়ের সাড়ি ঘন সবুজ গাছে ঢাকা। সম্ভবত পাহাড়গুলোতে বনায়ন শুরু হয়েছে। মাঝে মাঝে মাটির বর্হিদেয়ালের ভিতরে পরিত্যক্ত কিছু মাটির বাড়ি দেখলাম। কাবুলে ঢোকার পথে এ ধরনের একটি বাড়িতে অন্তত একটি রাত কাটিয়েছিলেন বলে লিখেছেন মুজতবা আলী তাঁর দেশেবিদেশে পুস্তকে। এ রকম মাটির দেয়ালের কেল্লার কথা রবীন্দ্রনাথও লিখেছেন তাঁর পারস্যযাত্রীর পত্রে। শহরে ঢোকার আগে সোনালী রঙের মিনার ও গম্বুজযুক্ত বড়সড় মসজিদ-আকৃতির একটি ইমারত দেখলাম যাকে ‘স্বর্ণমসজিদ’ বলা যেতে পারে না কি? ফেরার পথে জেনেছিলাম, এটাই ইমাম খোমেনির মাজার।
শহরে ঢুকতে ঢুকতে সূর্য পাটে বসে গেল। রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি দেখে যে প্রাথমিক ধারণাটা হলো তা হচ্ছে এই: তেহরানের মাটিতে যেমন পানির অভাব, তেমনি সমাজেও পয়সার আকাল চলছে। যে উন্নয়ন কুড়ি বছর আগে হবার কথা ছিল তা হয়নি। শহর দেখে মনে হচ্ছিল, ত্রিশের দশকের প্যারিস কিংবা আশির দশকের ইস্তাম্বুল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর তার মিত্ররা সেই কবে থেকেই অর্থনৈতিক অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে ইরানের বিরুদ্ধে। দেশটি যে এখনও টিকে আছে তাইতো আশ্চর্যের। তবে রাস্তাঘাট বেশ পরিষ্কার। মুখে যাবতীয় মেকআপ সত্তেও প্রথম দর্শনেই ঢাকাকে ‘গরীব এবং নোংরা’ মনে হবে যে কারও চোখে। তেহরানকে মনে হবে ‘নি¤œমধ্যবিত্ত এবং পরিচ্ছন্ন’।
হোটেলের সামনে গাড়ি থেকে নামলাম। ‘ধন্যবাদ দিতে কী বলেন আপনারা, শুকরিয়া?’ প্রশ্ন করলাম গাইডকে, কারণ এই একটা শব্দতো অন্ততপক্ষে শিখতে হবে। প্রশ্ন শুনে গাইড একটু আহতই হলো যেন। ‘শুকরিয়া’ আরবি শব্দ। আমাদের মাতৃভাষা ফার্সি। ফার্সিতে ‘মামনুন’ বলা যেতে পারে।’ তবে সাধারণ মানুষ বলে ‘মের্সি’। ফরাসি ভাষার এই শব্দের অর্থ ‘ধন্যবাদ’। যে চারদিন তেহরানে ছিলাম, অনেকবার ‘মের্সি’ বলতে শুনেছি, কিন্তু ‘মামনুন’ কখনও শুনিনি। এমনও হতে পারে যে ফার্সি ‘মামনুন’ এখন প্রায় অচল শব্দ হয়ে গেছে এবং ফরাসি ‘মের্সি’ উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।
বেশ বড়সড় একটি পাঁচতারা হোটেলে রাখা হয়েছে আমাদের। রুমে মালপত্র রেখে হোটেলের রেস্টুরেন্টে ডিনারের পর হোটেলের সামনের বুলভার্ডে হাঁটতে বেরোলাম। কেশাভার্জ বুলভার্ড। দুই দিকে গাড়ি চলার রাস্তার দুই পাশে গাছের সারি এবং তারপর প্রশস্ত ফুটপাথ। দুই রাস্তার মাঝে খাল, তবে খালে পানি নেই। খালের দুই পাশে পায়ে চলার রাস্তা। মাঝে মাঝে বেঞ্চ বসানো আছে। বেঞ্চে এত রাতে একা নারী বা পুরুষ বসে আছে কিংবা কোথাও যুগল বসে আড্ডা দিচ্ছে। তবে যাকে আমাদের দেশে অশালীনতা বলা হয়, তা চোখে পড়লো না কোথাও। শূন্যের উপরে পনেরো ডিগ্রি তাপমাত্রা, আমাদের দেশের তুলনায় ঠান্ডাই বলতে হবে। লোকজন শীতের কাপড়চোপড়ই পড়ে আছে।
তেহরানের রাস্তার দুদিকে যেদিকেই তাকাই শুধু ব্যাংক আর ব্যাংক: সিপাহ ব্যাংক, তেজারত ব্যাংক, ব্যাংক অব পার্শিয়া… মার্ক টোয়েন নাকি কোথাও লিখেছিলেন, কানাডার মন্ট্রিয়ল শহরে যে কোনো দিকে আন্দাজি একট ঢিল ছুঁড়লে কোনও না কোনো গীর্জার জানালার কাচ ভেঙে যাবেই যাবে। তেহরানের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আন্দাজি ঢিল ছুঁড়লে কোনও না কোনো ব্যাংকের কাচে গিয়ে লাগতে পারে। টাকা পয়সার অভাব থাকলেও ব্যাংকের অভাব নেই এ শহরে।
সকালের নাস্তায় মাংস ছিল, ছিল বিভিন্ন ধরনের পনির আর রুটি। কয়েক ধরনের জেলি এবং মধু ছিল। ছিল ডালের সুপ, শব্জীসেদ্ধ, মাংসের টুকরা এবং টমেটো কুচি মিশিয়ে বানানো গরমাগরম ওমলেট। ছিল আলুবোখারা, লাল এবং সবুজ কিসমিস, মুখে দেবার সঙ্গে সঙ্গে জিহ্বার উপর নরম হয়ে মিলিয়ে যেতে থাকা অতি চমৎকার খোর্মা। এছাড়া, আমেরিকান, কন্টিনেন্টাল মিলিয়ে খান ত্রিশেক পদতো ছিলই। কয়েক রকমের চা আর কফির কথা নাইবা বললাম।
হোটেলে ১০০ ডলার ভাঙিয়ে ২৪টা ৫ লক্ষ রিয়ালের নোট পেলাম। ৫ লক্ষ রিয়ালে প্রায় ৪ ডলার অর্থাৎ আমাদের ৩২০ টাকার মতো। ট্যাক্সি করে ন্যাশনাল মিউজিয়ামে যেতে ড্রাইভার ৩ লক্ষ রিয়াল অর্থাৎ ৩ ডলার বা ২৪০ টাকা নিল। সস্তাই বলতে হবে। ইরান এখনও সস্তার দেশ। জনপ্রতি ১০ ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশের ৮০০ টাকা দিয়ে পাঁচ তারা হোটেলে কিংবা সবচেয়ে হাইফাই রেস্টুরেন্টে নাকি পেটভরে খাওয়া যায়। বাংলাদেশে এত সস্তায় এত ভালো খাবার কল্পনাও করা যায় না।
ন্যাশনাল মিউজিয়মে ইরান অঞ্চলের ৩০ লক্ষ (জ্বী জনাব, তিশ লাখ লেখা ম্যায়নে!) বছরের ইতিহাস বেশ সুন্দরভাবে সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করা হয়েছে। পুরাতন ও নতুন পাথরের যুগ, ৩৩০০ খ্রীস্টপূর্ব থেকে ৫৫০ খ্রীস্টপূর্ব পর্যন্ত ইলম জাতি, তারপর ৫৫৯ থেকে ৩৩০ খ্রীস্টপূর্ব পর্যন্ত আকামেনিদ জাতি। এই আকামেনিদ সাম্রাজ্য মানব ইতিহাসের প্রথম সা¤্রাজ্য এবং এত বৃহদাকার সা¤্রাজ্য পৃথিবীতে এখনও পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়নি। রবীন্দ্রনাথও লিখেছেন: পশ্চিম এশিয়ায় বড় বড় সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কারণ প্রকৃতি এখানে নির্দয়-কঠোর, ঠেলে বাইরে বের করে দেয় আপন সন্তানদের। ‘তারা প্রকৃতির অযাজিত আতিথ্য পায়নি, কেড়ে খেতে হয়েছে পরের অন্ন, আহার সংগ্রহ করতে হয়েছে নূতন নূতন ক্ষেত্রে এগিয়ে এগিয়ে।’ আলেকজান্ডারের হাতে আকমেনিদ সা¤্রাজ্যের পতন ও রাজধানী পার্সিপোলিস ধ্বংস হবার পর প্রতিষ্ঠিত হয় সেলুসিদ সাম্রাজ্য (আলেকজান্ডারের সেনাপতি সেলুকাসের নামানুসারে। এই সেই সেলুকাস যার নাম আমরা পাই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে আলেকজান্ডারের মুখে সেই বিখ্যাত সংলাপে: ‘সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!’), পার্থিয়ান, সাসানিয়ান ইত্যাদি আরও কত জাতি যে ইরানকে বাসভূমি করেছে তার ইয়ত্তা নেই।
প্রতিটি জাতির শিল্পপ্রতিভা ও উদ্ভাবনী শক্তির বিচিত্র প্রকাশ দর্শককে অবাক না করে পারে না। কুনেইফর্ম ও হায়ারোগ্লিফিক লিপিতে দারিউসের বিখ্যাত উক্তি: ‘আমি সম্রাট দারিউস, সসাগরা পৃথিবীর রাজা আমি, সকল রাজাদের রাজা!’ পড়ে অনির্বচনীয় অনুভূতি হয় মনে। হাজার দশেক আগে পোড়ামাটিতে নির্মিত অদ্ভূত সুন্দর এক একটি পানপাত্র দেখে চোখ ফেরানো যায় না। এগুলো দেখে দেখে তৈরি করার ক্ষমতা আমরা আধুনিক মানুষদের অবশ্যই আছে, কিন্তু অনুরূপ ডিজাইন কল্পনা করার ক্ষমতা আমাদের আছে বলে মনে হয় না। দারিউসের মূর্তি, আলেকজান্ডারের মুদ্রাসহ আরও কত কী যে এই যাদুঘরে রয়েছে বলে শেষ করা যাবে না।
‘নিষ্টুর ইতিহাসের হাত থেকে পারস্য যেভাবে বরাবর আঘাত পেয়েছে, অন্য কোনো দেশ এমন পায়নি।’ লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। কথা সত্য। ইরান বার বার আক্রান্ত হয়েছে প্রাগিতিহাস এবং ইতিহাসে। গ্রীক, রোমান, আরব, মোঙ্গল… কে আক্রমণ করেনি পারস্যকে? টেংরি (নীল আকাশের ধর্ম, ইন্দ্রের মতো কোনো দেবতা যার অধিপতি) ধর্মাবলম্বী চেঙ্গিস খান এবং তার নাতি হালাকু খান ইরান আক্রমণ করে বহু মসজিদ ধ্বংস করেন এবং একাধিক মসজিদকে প্যাগোডায় রূপান্তরিত করেন। কেন প্যাগোডা বানাতে গেলেন তিনি তা আমি জানি না, তবে বৌদ্ধ ভিক্ষু বা ধর্মগুরুরা তাঁর পছন্দের লোক ছিল। ‘খান’ ছিল মধ্য এশিয়ার রাজাদের একটি উপাধি, যেটি এখন উপমহাদেশের বহু মুসলমানের পারিবারিক নামে পরিণত হয়েছে।
সপ্তম শতকে আরবরা ইরান দখল করার পর পারস্যের প্রাচীন জরথুস্ত ধর্ম অনতিবিলম্বে হারিয়ে যায়। কিন্তু প্রাগ-ইসলাম আমলের বহু রীতিনীতি এখনও টিকে আছে, যেমন পারসিক নওরোজ বা নববর্ষ। অনেক ইরানীর দৃষ্টিতে এই সব রীতিনীতি-সংস্কৃতি হানাদার আরবদের হাতে নিজেদের পরাজয়ের স্মারক। আবার এমন ইরানিও আছে যারা ইসলামপূর্ব যুগের রীতিনীতি পালন করা পছন্দ করেন না। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া বেশির ভাগ জায়গায় আরবেরা নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দিয়ে স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে হত্যা করতে সফল হয়েছে। ইরানেও তারা চেষ্টা করেছিল পারসিক ভাষা ও সংস্কৃতি মুছে দিতে, কিন্তু সফল হয়নি। বরং ইরানের সংস্পর্শে এসে সুসভ্য হয়েছে আরব জাতি। শোনা যায়, ইরান দখলের পর আরবেরা গণিমতের মাল হিসেবে পাওয়া ইরানি কার্পেট টুকরা টুকরা করে ভাগ করে নিয়েছিল, কারণ তারা জানতোই না যে প্রতিটি কার্পেট একটি সম্পূর্ণ শিল্পকর্ম যাকে বিভক্ত করা অসম্ভব।
ইরানিরা বাধ্য হয়ে ইসলাম কবুল করলেও কালক্রমে ইসলামের নতুন কয়েকটি ধারা সৃষ্টি হয়েছে ইরানে: সুফিবাদ, শিয়াবাদ ইত্যাদি। ইরানের মাধ্যমেই ইসলাম ছড়িয়েছে ভারতবর্ষে, বাংলাদেশে। যাকে আমরা ইসলামী পোশাক বলে জানি তাও ইরানের অবদান। মূলত সেলাই করা কাপড়, যেমন পাজামা কিংবা কুর্তা ইরান থেকেই আরবদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে সারা পৃথিবীতে। হজরত ওমরের সময়েই সেলাইবিহীন কাপড়ের (যেরকম পোশাক হজ্বের সময় পরা হয়) পরিবর্তে পারসিক ধাঁচের পোশাক জনপ্রিয় হতে শুরু করেছিল আরব উপদ্বীপে। হজরত ওমর নাকি এই ‘বিদেশি’ পোশাক খুব একটা পছন্দ করতেন না। যাকে আমরা ইসলামী শিল্পকলা বলে জানি, সেটাও মূলত পারস্যেরই অবদান। বড় বড় চিন্তাবিদ, কবি, বিজ্ঞানী যেমন ইবনে সিনা, ওমর খৈয়াম কিংবা আলবেরুনী আরব নয়, পারসিক ছিলেন। সাহিত্যে ফেরদৌসী, খৈয়াম, হাফিজ, রুমীর পাশে দাঁড়াতে পারেন এমন আরব সাহিত্যিক বিরল।
কয়েক হাজার বছরের সভ্য পারসিক এবং তাদের প্রভাবে প্রায় সভ্য হয়ে ওঠা আরবদের মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্বকে অস্বীকার করার উপায় নেই। অন্তর্লীন স্তরে শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্ব মূলত আরব-পারসিক দ্বন্দ্ব। আরবেরা সেমিটিক, পারসিকেরা ইন্দো-ইওরোপীয়। এই দ্বন্দ্ব সেমিটিক-আর্য সংস্কৃতির দ্বন্দ্বও বটে। গত শ খানেক বছর দরে আরবেরা তাদের ওহাবি মতবাদ নিয়ে পারসিক ইসলামের সুফিবাদের মোকাবিলা করতে চাইছে। এ কাজে সফল হতে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এমনকি ইসরায়েলের সঙ্গে জোট বেঁধেছে। ইহুদিরাও অবশ্য সেমিটিক জাতি, আরবদের সঙ্গে তাদের রক্তের সম্পর্ক। এই দ্বন্দ্বে প্রাণহানি হচ্ছে ইন্দোইওরোপীয়দের, যেমন অতি সম্প্রতি কয়েকজন সুফি মুসলমান খুন হয়েছেন পাকিস্তানে। ‘খোদা হাফেজ’ এর পরিবর্তে ‘আল্লা হাফেজ’ ব্যবহার করা এই দ্বন্দ্বের অন্যতম একটি ভাষিক প্রমাণ। মনে রাখা দরকার যে ইসলাম নাজেল হবার পূর্বে ‘আল্লা’ ছিলেন কুরাইশদের বৃষ্টি ও সৃষ্টির ‘দেবতা’, শত শত দেবতার মধ্যে একজন। প্রাক-ইসলাম কাবাঘরে এই দেবতারও মূর্তি স্থাপিত ছিল নিশ্চয়ই। অন্যদিকে ‘খোদা’ ছিলেন পারসিকদের সর্বশক্তিমান একক ঈশ্বর, যার সংস্কৃত প্রতিশব্দ ছিল ‘স্বধা’, অর্থাৎ ‘যিনি নিজেই নিজেকে সৃষ্টি বা ধারণ করেন।’
‘তুনে মারি এন্ট্রি আর দিলমে বাজি ঘন্টি আর, ট্যাং ট্যাং ট্যাং।’ সুদূর তেহরানে প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, অর্জুন কাপুর আর রণবীর সিং-এর নৃত্যসঙ্গত হিসেবে ব্যবহৃত অতি পরিচিত হিন্দি গান শুনে চমকে উঠলাম। গান বাজছে মিউজিয়মের পাশে এক খাবারের দোকানে। টং দোকান। দোকানের সামনে দুই একটা ভারতীয় শৈলীর মূর্তিও রাখা আছে দেখলাম। দোকানদারনী টুকটাক ইংরেজি বলতে পারে ভেবে সেই দোকানের সামনে থেকে ট্যাক্সি নিতে গেলাম। দেশি ভাইয়ার প্রতি দোকানদারনী বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখালো না। তবে টুকটাক ইংরেজি-জানা কয়েকজন পথচারি মুসকিল আসান হয়ে এগিয়ে এলেন। সবাই মিলে বুড়ো ড্রাইভারকে যতই বলে ‘ম্যুজে’ (ইরানিরা যাদুঘরের জন্য এই ফরাসি শব্দটা ব্যবহার করে) অব মডার্ন আর্টে নিয়ে যেতে হবে, সে ততই পুনরাবৃত্তি করে: ‘আর্ক’, ‘আর্ক’, বুঝেছি, উঠে পড়–ন! ‘আর্ক’ মানে কি আমি জানি না। ওর ভাব দেখে মনে হচ্ছিল, আমি কোথায় যাবো না যাবো, সেও কিছু বোঝেনি। তবু ‘মামনুন’ (অর্থাৎ ‘ধন্যবাদ’) বলে ইরানের প্রাচীন ঈশ্বর আহুর মাজদাকে স্মরণ করে উঠে পড়লাম ট্যাক্সিতে। ভাবলাম, কত দূরে আর নিয়ে যাবে বুড়ো, ভাড়া যেহেতু বেশি নয়, টাক্সিতে যেতে যেতে ফোকটে শহর দেখাটা হয়ে যাবে আর গতিক বুঝে হাতে লাখ তিনেক রিয়াল গুজে দিয়ে এক সময় নেমে গেলেই চলবে। তাই হলো শেষ পর্যন্ত। একটা পার্কের চারপাশে ঘুরিয়ে বড় রাস্তায় এসে ড্রাইভার জ্যামে পড়লো, ঝগড়া লাগালো রঙসাইড দিয়ে ব্যাকে আসা অন্য এক ড্রাইভারের সঙ্গে। পরে আমাকে ইঙ্গিতে বললো নেমে যেতে। ‘নেমে ডানে গেলেই মুজে, বুঝেছো?’ পরদিন আমরা দেখবো যে ড্রাইভার আমাদের নামিয়ে দিয়েছিল গুলিস্তান রাজপ্রাসাদের পাশে, যে রাজপ্রাসাদে একটি মিউজিয়ম আছে বটে।
শহর দেখায় ক্ষ্যান্ত দিয়ে হোটেলে ফিরতে হলো, কারণ চীনা বন্ধুদের সঙ্গে বইমেলায় যেতে হবে। যে সম্মেলন উপলক্ষে আমরা বাংলাদেশের চার অধ্যাপক এবং বার্মার তিন অধ্যাপক তেহরানে এসেছি তার পরিকল্পনা করেছেন এবং উদ্যোগ নিয়েছেন চীনের ইউনান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ওরা বলে ‘সুজি’ অর্থাৎ চেয়ারম্যান) ইয়াং লিন। গত বছরের শেষ দিকে যখন চীনের চেংডু গিয়েছিলাম, তখন সুজি বলেছিলেন যে তিনি বার্মা আর বাংলাদেশের কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটের পরিচালকদের সঙ্গে আলাপ করতে চান তাদের ‘কৃত এবং কৃত্য’ কার্যক্রম নিয়ে, তবে আলাপটা হবে ইরানে। ইরানে আসার মূল উপলক্ষ এটাই। তবে শুধুমাত্র আলাপ করার জন্যই যে হাজার হাজার আর.এন.বি. বা ইউয়ান (চীনা মুদ্রার নাম) খরচ করে আমাদের ভ্রমণের ব্যবস্থা হয়েছে তা কিন্তু নয়। বইমেলায় চীন-ইরান ভাষিক-সাংস্কৃতিক বিনিময়-গবেষণা নিয়ে একটি সেমিনার হবে। সেখানে উপস্থিত থেকে চীন-ইরান সম্পর্কের অতীত-বর্তমান সম্পর্কে একটি ধারণা নেওয়াও এই ভ্রমণের অন্যতম উদ্দেশ্য – অন্তত সে রকমটিই বলবেন সুজি সান্ধ্য ভোজসভায়, অবশ্য আরও ঘণ্টা দুয়েক পরে, ‘সান্দিজ’ নামক তেহরানের সুবিখ্যাত এক রেস্টুরেন্টে।
বইমেলা হচ্ছে তেহরানের গ্র্যান্ড মসজিদে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি ভাষার অধ্যাপক জনাব সবুর জানালেন, এর নাম ‘মুসল্লায়ে তেহরান’। শুক্রবারের জুম্মার নামাজটা শুধু এখানে হয়, অনেকটা আমাদের দেশের ইদগাহে যেমন শুধু ঈদের নামাজ হয়। জনাব সবুরকে ধন্যবাদ)। এখানে বিশাল এই মসজিদের নিচ তলায় শ পাঁচেক স্টল বসানো হয়েছে। যদিও গায়ের সঙ্গে গা মিলিয়ে বসেছে স্টলগুলো, তবুও স্টলের সংখ্যা থেকে মসজিদের স্থানসঙ্কুলান ক্ষমতা সম্পর্কে পাঠক একটা ধারণা করতে পারবেন। ইস্তাম্বুলেও একটি বইমেলায় যাবার সুযোগ হয়েছিল, তবে সেখানে সব ছিল ধর্মসংক্রান্ত বই। তেহরানের বইমেলাতেও ধর্মসংক্রান্ত বই নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু অন্য বইও রয়েছে দেদার। বইপত্র দেখে মনে হলো, হেন কোনো বিখ্যাত বিদেশি সাহিত্যিক নেই যার লেখা ফার্সি ভাষায় অনুবাদ হয়নি। হোটেলের কাছে একটি পুস্তক-বিপনীতে গিয়েও একই ধারণা হলো। ‘বইয়ের দোকান’ না বলে ‘পুস্তক-বিপনী’ লিখলাম ইচ্ছে করেই, কারণ দোকানটি এত সুন্দর করে সাজানো যে সেটি দোকান’ পর্যায় থেকে ‘বিপনী’-তে উন্নীত হয়েছে (ফার্সি রুচি ও সৌন্দর্যবোধের এ রকম আরও অনেক প্রমাণ আমরা আগামি কয়েক দিনে পাবো)। পুস্তকের মুদ্রণের মান ও শৈলী পাশ্চাত্যের অনুরূপ। ফার্সি লেখার জন্য ব্যবহৃত আরবি বর্ণের ফন্টগুলো, সে কাগজের উপরেই হোক কিংবা হোক কম্পিউটারের পর্দায়, আমার কাছে আরব অঞ্চল বা পাকিস্তানে উর্দু ভাষার জন্যে ব্যবহৃত ফন্টের তুলনায় সুশ্রীতর মনে হলো। ফন্ট বা হরফ একটি জাতির যুগান্তরের সৌন্দর্যবোধের পরিচায়ক বলে আমি বিশ্বাস করি।
পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের বিভিন্ন প্রকাশকও তাদের বইয়ের পসরা নিয়ে হাজির হয়েছেন বইমেলায়। এদের সবাইকে সম্মান করে দোতলায় স্টল দেওয়া হয়েছে, নিচের তলায় আছেন স্থানীয় প্রকাশকেরা। মসজিদের দোতলায় বিভিন্ন বিষয়ে সেমিনার-আলোচনা হচ্ছে একাধিক স্থানে, যার মধ্যে আমাদের সেমিনারটিও ছিল। কেউ বলছিলেন, ফার্সিতে, কেউবা চীনা ভাষায়। বক্তাদের মধ্যে নারী-পুরুষ দুইই আছেন। বেশির ভাগ বক্তাকেই এক সময়ে থামাতে হচ্ছিল কারণ প্রায় কারোরই সময়সীমা মানার অভ্যাস কিংবা ক্ষমতা ছিল না, অনেকটা বাঙালি বক্তাদের মতোই। ফার্সি ভাষার দুর্ভেদ্য উচ্চারণ-বনে ক্বচিৎ কখনও দুই একটি শব্দকুসুম (‘মুশকিল’, ‘দুনিয়া’ ইত্যাদি) নিকাব খুলে পাপড়ি মেললেও চীনা ভাষার বনটি দুর্বোধ্য-দুর্ভেদ্যই রয়ে গেল। দুই এক জনের পাওয়ার-পয়েন্টে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার ছিল বলে ফার্সি ও চীনা ভাষার উচ্চারণ-সৌন্দর্য উপভোগ করা ছাড়াও সামান্য কিছু অর্থবোধ হয়েছে, অর্থাৎ চীন ও ইরানে গবেষণা-লেখাপড়ার কিছুটা খবরাখবর পাওয়া গেছে। চীনে ইরান কিংবা পারস্য সভ্যতা নিয়ে গবেষণা-লেখালেখি হচ্ছে গত এক শ বছর ধরে কিংবা তারও আগে থেকে। ১০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্সি বিভাগ আছে। ইরানের অবস্থাও অনুরূপ। চীনা ভাষা চীনাদের মতো করে বলতে পারেন এমন বহু অধ্যাপক-ছাত্র আছেন তেহরানে।
যা বলছিলাম, মসজিদে বইমেলা হচ্ছে এবং এ ধরনের আয়োজনের জন্য অধিকতর উপযুক্ত করে তোলার লক্ষ্যে মসজিদের পরিসর বাড়ানো হচ্ছে। সন্ধ্যা হয়ে আসছিল এবং দেশের অভ্যাসবশত আমি আজানের অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু আজান শুনছিলাম না বলে চীনা ভাষার এক ছাত্র এবং আমাদের দোভাষী মুস্তাফার কাছে কারণ জানতে চাইলাম। উত্তরে সে বললো যে শিয়ারা নামাজ পড়ে দিনে তিনবার: সকালে, দুপুরে এবং সন্ধ্যায়। আজানের প্রয়োজন পড়ে না, কারণ ইরানিরা শতভাগ শিক্ষিত এবং সবার মোবাইলে ঘড়ি আছে। নামাজের সময় হলে নামাজ নিজেই পড়ে নেবে। তেহরানে যে সাড়ে চার দিন ছিলাম, একবারও আজান শুনিনি। না ভুল বললাম, একদিন কোথাও যেন শুনেছিলাম, মাইক ছাড়া, সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, খুবই সুললিত মনে হয়েছিল মুয়াজ্জিনের কন্ঠ। এক সময় বাংলাদেশেও আজানে মাইক ব্যবহার করা হতো না। চট্টগ্রামে প্রথম যখন আজানে মাইক ব্যবহারের প্রথা শুরু হয়, তখন মুসল্লীরা এর প্রতিবাদে মিছিল করেছিল। একটা ছড়াও লেখা হয়েছিল যার অংশবিশেষ এরকম: মাইকের আগুনে দিলে খোদায়ী জবান। সহ্য করিবে কি কোনো মুসলমান!’ নারী-পুরুষ-শিশু সবাই মসজিদে ঢুকে বইমেলার স্টলে বই কিনছে কিংবা শ্রেফ উল্টেপাল্টে দেখছে। ‘এই যে মসজিদে নামাজের জায়গাজুড়ে বইমেলা হচ্ছে, লোকজন নামাজ পড়বে কোথায়?’ Ñ জিগ্যেস করলাম আমি। মুস্তাফা তার ভাঙা ইংরেজিতে উত্তর দিল: ‘কোথাও গিয়ে পড়ে নেবে, কোনো মসজিদে বা অন্য কোথাও। নামাজ পড়ার জন্যে মসজিদ অপরিহার্য নয়।’
বইমেলা দেখতে আসা মহিলাদের মধ্যে কেউ কেউ কালো (কালো এদের পছন্দের রঙ) বোরখায় শরীর ঢেকেছে, কিন্তু নেকাব দিয়ে মুখ ঢাকতে দেখিনি কাউকেই। অধিকাংশ নারী ইওরোপীয় পোষাক পরা (জিন্স প্যান্ট এদের পছন্দের নি¤œবাস)। কারো কারো মাথার সম্পূর্ণ উপরিভাগ এবং বেশির ভাগের মাথার অর্ধভাগ ওড়না কিংবা চাদর দিয়ে ঢাকা। যাদের মাথার অর্ধভাগ ঢাকা তারা এক বা একাধিক ক্লিপ দিয়ে চুলের সঙ্গে ওড়নাটি আটকে দেয়, সামনের কুন্তলগুচ্ছ দৃশ্যমান থাকে।
উত্তর ভারত, পূর্ব ভারত কিংবা বাংলাদেশে বেশির ভাগ পুরুষ মেয়েদের দিকে তাকাতে শেখেনি। পারিবারিক শিক্ষার অভাবে পুরুষেরা এখানে বংশানুক্রমে অসভ্য। মেয়েদের দিকে এরা তাকায়তো না, যেন এক ঢোক শরবৎ দিয়ে গিলে নেয়। পারসিক নারী-পুরুষ যখন পরস্পরের দিকে তাকায়, উভয়ের কারও দৃষ্টিতে রিরংসা দেখিনি একবারও। বিদেশিদের প্রতিও কোনো প্রকার ঘৃণা কিংবা তাচ্ছিল্য চোখে পড়েনি তেহরানে কোনো পারসিকের দৃষ্টিতে কিংবা ব্যবহারে। প্রায় শতভাগ পারসিক নারীপুরুষ শারিরীক গঠন, চামড়ার রঙ ও মুখশ্রীর বিচারে অত্যন্ত সুশ্রী। কুশ্রী কেউ চোখে পড়েনি, একান্তই দেখতে চাইলে সম্ভবত খুঁজতে হবে। তুরস্ক, পাশ্চাত্য, জাপান ইত্যাদি যত দেশে আমি ছিলাম, সুন্দর মানুষের সংখ্যা কোথাও এত বেশি মনে হয়নি। এদের রঙ পাশ্চাত্যের লোকদের মতো সাদা নয়, বাংলায় যাকে বলে ‘দুধে-আলতা’। কিন্তু গাত্রবর্ণ এদের শারিরীক সৌন্দর্যের প্রধান নিয়ামক নয়। শরীর এবং মুখম-লে একটা আকৃতিগত সুসমতা আছে পারসিকদের, যেরকমটি খুব কম জাতির মধ্যে দেখেছি এবং এত বেশি মাত্রায় কোনো জাতির মধ্যে দেখিনি। এত সুন্দর হওয়া সত্তেও মেয়েরা কড়া মেকআপ করে, সঙ্গতি থাকলে খাড়া নাক আরও খাড়া করতে প্ল্যাস্টিক সার্জাারি করিয়ে নেয়। চার দিনে বেশ কয়েকজন তরুণীর নাকের ডগায় স্বচ্ছ ব্যান্ডেজ লাগানো দেখলাম।
ঢাকার মতোই তেহরান শহর দুই ভাগে বিভক্ত: উত্তর ও দক্ষিণ। ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ’ লিখছিলেন নজরুল। তেহরানের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্য, তবে এখানে ‘পাহাড়ে হেলান দিয়ে শহর জাগে ঐ’ দর্শকের উপরি পাওনা। শহর থেকে, এমন কি আমার হোটেলের কক্ষ থেকেও এই বরফঢাকা পর্বতশ্রেণী চোখে পড়ে। শহরের উত্তর দিকটা এই পাহাড়ের কাছে বলে সেখানকার তাপমাত্রা দক্ষিণের তুলনায় পাঁচ-দশ ডিগ্রি কম থাকে। শুনলাম, এ বছর শীতকালটা নাকি একটু দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং আরও শুনলাম, গ্রীস্মকাল ছাড়া বছরের অন্য সময় নাকি দূষণের জন্য এই পাহাড় দেখা যায় না।
উত্তরের লোকজন ধনী, তাদের বাড়িঘর সুন্দর এবং উন্নতমানের। দক্ষিণের লোকজন অপেক্ষাকৃত গরীব, তাদের বাড়িঘর পুরনো। কিন্তু উত্তরে তেমন কাজ নেই। কাজ করার জন্যে উত্তরের লোকজনকে দক্ষিণে আসতে হয়। দক্ষিণেই তাদের ব্যবসাপাতি। দক্ষিণ থেকে উত্তরে যাবার পথে আছে একটি ট্যুরিস্ট উড়ালসেতু, যার দুই পাশে রয়েছে দুটি মনোরম বন। সেই উড়ালসেতুতে বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে, আছে টয়লেটের ব্যবস্থা। একটি গোলাকার চত্ত্বর রয়েছে, যেখানে দাঁড়িয়ে লোকজন ছবি তুলছে। আলোক বা স্বালোকচিত্রামোদীদের পশ্চাৎপটে থাকে উত্তর তেহরানের আকাশচুম্বী ভবনের সারি এবং তারও পেছনে, আগেই বলেছি, বরফঢাকা পর্বতমালা। উদীয়মান বা অস্তায়মান সূর্যরশ্মি যখন সেই বরফে বিচ্ছুরিত হয়, তখন একটি নয়নমনোহর দৃশ্যের সৃষ্টি হয় বটে।
এই উড়াল সেতুর বিভিন্ন স্থানে ইজেল আর রঙতুলি নিয়ে পোট্রেট আঁকিয়েরা বসে আছেন। অনেকেই ছবি আঁকাচ্ছেন আগ্রহভরে এবং তাদের বেশির ভাগই স্থানীয় ট্যুরিস্ট। এ ধরনের দৃশ্য প্যারিস বা অন্যান্য পাশ্চাত্য শহরে চোখে পড়ে, কিন্তু কোনো মুসলিমপ্রধান দেশে এমন দৃশ্য বিরল। শুধু তাই নয়, রাস্তায় রাস্তায় ভাস্কর্য রয়েছে তেহরানে, আছে ইমাম খোমেনির আবক্ষ মূর্তি। ছবিতো রাস্তার মোড়ে মোড়ে। আমি শুনেছিলাম, ইরানে লোকজন হজরত আলী (রাঃ) এমনকি হজরত মুহম্মদ (সঃ) এর ছবি বা ভিউকার্ড ঘরে কিংবা মানিব্যাগে রাখে। আমাদের গাইড নেগাকে (‘নেগা’ হিন্দি-উর্দুতে ‘নিগাহ’। এর অর্থ ‘দৃষ্টি’) জিগ্যেস করলাম এ ব্যাপারে। কোনো উত্তর না দিয়ে নেগা তার মোবাইল টিপে একটি ছবি দেখালো : সুশ্রী, এক আরব বালকের হাস্যমুখ আবক্ষচিত্র। গোঁড়া মানসিকতার লোক যারা তারা নাকি নবীর চিত্র রাখা পছন্দ করে না, কিন্তু সাধারণ লোকজনের চিত্র রাখতে আপত্তি নেই, বরং তারা নাকি ব্যাপারটা পছন্দই করে। আমাদের এক ভ্রমণসঙ্গী, সুন্নী মুসলমান তিনি, লোকজনের ঘরে-পকেটে-মোবাইলে নবীর মোহাম্মদ (সঃ)-এর ছবি থাকার ব্যাপারটা শুনে একটু আহতই হলেন মনে হলো।
কোনো মানুষই ধর্মের নিয়মনীতি শতভাগ মানে না। কেউ ঘুস খায়, কেউ খুন করে, কেউবা প্রেরিত পুরুষের ছবি রাখে… এগুলোকে অধর্ম বলা যেতেই পারে, কিন্তু অধর্মের লোম বাছতে গেলে ধর্মের কম্বল থাকবে কিনা সে প্রশ্নও পুরোপুরি অসঙ্গত বলা যাবে না। মানুষ যুগে যুগে দেশে দেশে নিজের মতো করেই যতটা পেরেছে, ধর্মপালন করে গেছে। ‘অমঙ্গলকে জগৎ হইতে উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিও না, তাহা হইলে সে মঙ্গলসহ উড়িয়া যাইবে।’ বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। গুরুকে অনুসরণ করে বলা যেতে পারে: ‘অধর্মকে উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিলে ধর্মও উড়িয়া যাইতে পারে।’ সম্ভবত এ কারণেই ধর্ম এবং ধর্মগুরুরা অধর্মকে কমবেশি সহ্য করে। বাংলাদেশের কোনো ধর্মগুরু কি ঘুস-দুর্নীতি-গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে একটি শব্দও কখনও উচ্চারণ করেন তাঁদের বক্তৃতা-খোৎবায়?
সুদর্শন-সুদর্শনাদের ভিড়ে আমরা কয়েকজন বাঙালি এবং চীনাকে আলাদা বলে মনে হচ্ছিল। অনেকটা সে কারনেই বোধ করি এক দল কুর্দি যুবক এগিয়ে এসে ছবি তুলতে চাইলো আমাদের সঙ্গে, ঠিক যেমন করে বাংলাদেশের গ্রামের লোকজন ককেশীয় লোকজন কাছে পেলে ছবি বা সেলফি তুলতে চায়। অবশ্য ছবি তোলার আগে যুবক আমাকে জিগ্যেস করলো: ‘আপনি কী করেন?’ আমি যখন বললাম, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি।’ তখনই শুধু ছবির জন্যে পোজ দিল। ভাবখানা যেন এই যে নি¤œমানের কোনো পেশার লোক হলে তার সঙ্গে ছবি তোলার প্রয়োজন নেই। ‘কেমন আছো তোমরা কুর্দিরা ইরানে।’ যুবকদের মধ্যে নেতা গোছের একজন অস্ফূটস্বরে ভাঙা ইংরেজিতে বললো: ‘আমরা কুর্দিরা কোথাও ভালো নেই, ইরানেও না।’
চেয়ারম্যান লিঙ পিন আমাদের নিয়ে গেলেন উত্তর তেহরানের বিখ্যাত রেস্টুরেন্টগুলোর মধ্যে একটিতে। সান্দিজ। ইরানের একটি গ্রাম বা এলাকার নামে এই রেস্টুরেন্টের নাম। প্রথমে মাখন, লেবুজলে জারিত জলপাই এবং রসুন দিয়ে গেল। কোক-স্প্রাইটের মতো পরিচিত পানীয় ছিল, ছিল এ্যালকোহলমুক্ত ইরানি বিয়র। সেগুলো টুকটাক মুখে দিচ্ছি, এমন সময়ে খান ত্রিশেক তলোয়ার আকৃতির মাংসগাথা লোহার ফালি নিয়ে হাজির হলো সুদৃশ্য সব ওয়েটার। ঘন ঝোলে অর্ধমগ্ন পুরো একেকটি ভেড়ার রান ছিল লম্বা একেকটি ট্রেতে। কী করে এই শক্ত মাংস কেটে নেবো ভাবতে ভাবতে যেই হাড্ডি আর মাংসের সঙ্গমস্থলে চামচ ঢোকালাম, মাংস ফিরনির মতো চামচে উঠে এলো। মুখে নিয়ে চিবানোর দরকার পড়েনি, জিহ্বার উপরই গলে গেল সেই সুসিদ্ধ মাংস। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের বহু দেশে ভেড়ার মাংস খেয়েছি, বোঁটকা গন্ধে দ্বিতীয় টুকরা মুখে দিতে পারিনি। ইরানের ভেড়ার মাংসে বিন্দুমাত্র দুর্গন্ধ নেই, আর স্বাদের কথা বলা বাহুল্য। এমন স্বাদ আমাদের দেশের খাসি কিংবা পাঁঠার মাংসে নেই, পৃথিবীর অন্য কোথাওও খুব একটা দেখিনি।
পারসিক খাবারে মাংসের জয়জয়কার। ভেড়ার মাসের কিমা দিয়ে তৈরি কাবাব, হাড্ডিসহ বুকের মাংসের মাটনচপ, মুরগীর টুকরা। মুরগির মাংস আর মাটনচপতো আকার দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু লম্বা প্লেটের এদিক থেকে ওদিকে পড়ে থাকা, শাড়ির লেসের মতো বস্তুটা কি ভেড়া নাকি গরুর মাংসের কিমা দিয়ে বানানো বুঝতে পারছিলাম না। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি ভাষার অধ্যাপক বসেছিলেন আমার পাশে। আমাকে ইতস্তত করতে দেখে অভয় দিয়ে বললেন: ‘ইরানে ভদ্রলোকে গরুর মাংস খায় না। ইরানিরা মনে করে, গরুর মাংস শরীরের জন্য ক্ষতিকারক। সান্দিজের মতো রেস্টুরেন্টে কিংবা কোনো রেস্টুরেন্টে আপনি গরুর মাংস পাবেন না। গরুর মাংসকে আমরা ছোটলোকের খাদ্য মনে করি। ইরানে গরুর মাংস জলের দামে বিক্রি হয় এবং গরীব মানুষেরাই গোমাংসের মূল খরিদ্দার।’ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি ভাষার আরেক শিক্ষক মুমিত আল রশিদ অবশ্য জানালেন, গোমাংস খুব দামী খাবার ইরানে। কার কথা সত্য কে জানে!)
ইরানে গরীব মানুষ হচ্ছে প্রধানত আফগানরা। রাস্তাঘাট সাফাই থেকে শুরু করে যত তথাকথিত নি¤œমানের কাজ সব আফগানরাই করে। কোথাও চুরিচামারি হলে, আফগানদের উপরই দোষটা প্রথমে পড়ে। যত দোষ আফগান ঘোষ। তবে আফগানিস্তানে ‘শান্তি ফিরে আসাতে’ আফগান উদ্বাস্তুদের মধ্যে অনেকেই নাকি দেশে ফিরে যাচ্ছে এবং তেহরানের বাসাবাড়িতে কাজের লোকের আকাল শুরু হয়েছে।
ইরানি রেস্টুরেন্টে প্রচুর খাবার দেয়, এত মাংস দেয় যে ক্ষীণদেহ বাঙালির পক্ষে তা উদরস্থ করা প্রায় অসম্ভব। সাথে শব্জীর মধ্যে বেগুন থাকে, থাকে ভাত। ভাতের উপর থাকে জাফরান দিয়ে রাঙা এবং মচমচে করে ভাজা ভাতের একটা বড়সড় টুকরা। সান্দিজে আমাদের যা খাবার দিয়েছিল তার অর্ধেকই বেঁচে গেল। ‘এত বেশি কেন অর্ডার দেওয়া হলো?’ Ñ এই প্রশ্ন যখন করলাম, তখন ইরানি সহকর্মী-বন্ধুরা জানালেন যে অর্ডার ঠিকঠাকমতোই দেওয়া হয়েছে, আপনাদের ক্ষুধা বা খোরাক যে কম সেটা ওয়েটাররা কীভাবে জানবে!’ কথা সত্য। একই খাবার পাশের টেবিলে বসা ইরানিরা চেটেপুটে খেয়ে ফেললো। পরের দিন গ্র্যান্ড বাজারের এক পপুলার রেস্টুরেন্টেও একই ব্যাপার দেখলাম।
চীনা ভোজসভায় একটানা বসে খেয়েই যাবেন Ñ এমনটা হবে না। মাঝে মাঝেই সুজি অর্থাৎ বস তার কড়া এ্যালকোহলিক পানীয়পূর্ণ গ্লাস হাতে নিয়ে আপনার কাছে আসবেন। আপনার গ্লাসের সঙ্গে নিজের গ্লাস দিয়ে টোকা দিয়ে এক চুমুকে সেই পানীয় গলাধঃকরণ করবেন। বিদেশিরা অতটা না পারলেও অন্তত এক চুমুক পান করবে। কিছুক্ষণ পর আপনিও সুজির কাছে যাবেন পানীয় হাতে, আমন্ত্রণ করার জন্য সুজিকে ধন্যবাদ দিয়ে মাথা নিচু করবেন এবং বসের সাথে স্বাস্থ্যপান করবেন। আমাদের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হলো না। আমরা গেলাম এবং সুজিও আসলেন। পেট ভরা, কিন্তু সুজির ‘লাইগ’ অর্থাৎ (চীনা ভাষায়) ‘আর একটা নিন না’ অনুরোধ শুনে পেটে উপচে পড়া ‘মাংসের বোঝার’ উপর কাবাবের ‘শাকের আঁটি’ ঢোকাতেই হলো।
পরদিন সকালে আমাদের গন্তব্য গুলিস্তান রাজপ্রাসাদ, ইরানের রাজাদের বাড়ি। এখানেই আগের দিন আমাদের নিয়ে এসেছিল আমাদের ট্যাক্সিওয়ালা মডার্ন আর্ট মিউজিয়ম মনে করে। যাবার পথে একটা পার্ক দেখিয়ে গাইড নেগা বললো এখানে আগে ছেলেমেয়েরা ডেটিং করতে আসতো। এখন তেহরানে এ রকম পার্ক প্রচুর আছে। সুতরাং এখানে তেমন কেউ আসে না। ইরানে হিজাবও চলে, ডেটিংও বন্ধ নেই, অনেকটা বাংলায় যেমন বলে, ডুডুও চলে, তামাকও চলে।
গুলিস্তান প্রাসাদে ঢুকে নেগা আমাদের ইরানের রাজা আর রাজবংশের গল্প বলে গেল একের পর, আগা মোহাম্মদ শাহ, নাসরুদ্দীন শাহ প্রমূখ। এক রাজা ইওরোপ ভ্রমণে গিয়ে ফিরে এসেছিলেন নতুন ধারনা, নতুন যন্ত্রপাতি (বাদ্যযন্ত্র, মুদ্রণযন্ত্র, টাইপমেশিন) নিয়ে, ইরানকে বদলে দেন ইওরোপের অভিজ্ঞতার আলোকে। অন্য এক রাজা তার প্রতিপক্ষকে খুন করে এই গুলিস্তানের এক কক্ষের মেঝেতে কবর দিয়েছিলেন। প্রতিদিন সকালে সেই কবরে উপর লাথি মেরে রাজা যা বলতেন, বাংলায় তার অনুবাদ হবে: ‘দেখ শালা তোকে কেমন বাগে পেয়েছি!’ পরে সেই রাজার মৃত্যুর পর রাজপুত্র পিতৃশত্রুর হাঁড়গোড় তুলে নিয়ে গিয়ে অন্যত্র কবর দেয়। আরেক রাজা যিনি নাকি ইরানকে আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন তাঁর এক প্রিয় শিল্পী ছিল। প্রধানমন্ত্রীকেও রাজা খুব পছন্দ করতেন। কিন্তু পুত্র পছন্দ করে এমন কাউকেই রাজমাতা সহ্য করতে পারতেন না। সুযোগ বুঝে গুপ্তঘাতককে দিয়ে সেই শিল্পী ও প্রধানমন্ত্রীসহ আরও অনেককে একে একে খুন করান রাজমাতা।
এক রাজার হেরেমে চল্লিশ জন বেগম ছিল যার মধ্যে একজনকে রাজা খুব পছন্দ করতেন। সেই বেগম মাঝেমাঝেই তার পিরের মাজারে গিয়ে এক পবিত্র গাছে সুতা বাঁধতো বলে প্রাসাদের সামনেই রাজা রাতারাতি অনুরূপ একটি বৃক্ষ রোপন করে দেন, যাতে রাণীকে প্রাসাদের বাইরে যেতে না হয়। গাছটি এখনও সটান দাঁড়িয়ে আছে। এত এত রাজার নাম উল্লেখ করলাম না, কারণ নামে কী যায় আসে, সে গোলাপেরই হোক কিংবা রাজারই হোক। সর্বশেষ রাজার নাম রেজা মোহাম্মদ শাহ পহ্লবী। ‘পাহলোয়ান’ থেকেই নাকি ‘পহ্লবী’ শব্দের উৎপত্তি। মোহাম্মদ শাহ পহ্লবী তিন বিয়ে করেন। প্রথম রাণীর সঙ্গে রাজমাতার সম্পর্ক ভালো ছিল না বলে তাকে তালাক দিতে হয়। দ্বিতীয় রানী সুরাইয়া সুন্দরী ও বুদ্ধিমতী ছিলেন, কিন্তু তাঁর কোনো সন্তান হচ্ছিল না বলে তাকেও তালাক দেন রেজা শাহ। অবশেষে প্যারিস বেড়াতে গিয়ে দেখা হয় স্থাপত্যকলার ছাত্রী ফারাহ দিবার সঙ্গে এবং তাকে পছন্দ হয়ে যায় শাহের। গুলিস্তান প্রাসাদে রেজা শাহ পহ্লবী আর রাণী ফারাহ দিবার বিবাহোৎসব হয়েছিল। ফারাহ দিবার গর্ভে চার সন্তান হয় শাহের, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। এক ছেলে ও এক মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। বাকি দুইজন বেঁচে আছে। রাণী নিজেও এখনও জীবিত। রাজপুত্র ও রাজকন্যা নাকি বলেছেন, তাদের আর রাজা হবার সাধ নেই। ইরানে ফিরে এসে সাধারণ লোকের মতো জীবন কাটাতে পারলেই তারা খুশি।
গুলিস্তান প্রাসাদে একটি ‘মর্মর তখত’ বা মার্বেল পাথরের সিংহাসন আছে। আগাগোড়া ফিকে সবুজ মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি এই সিংহাসনটি মূলত একটি সেমি ডবল খাট। কোনো এক রাজার খুবই প্রিয় ছিল এই খাট। ‘মর্মর-তখত’ শব্দটা পড়েই আমি যখন বুঝে গেলাম এটা মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি একটা সিংহাসন তখন আমাদের গাইড একটু অবাকই হলো। কিছু মার্বেল পাথরের মূর্তি সেই সিংহাসন কাঁধে বহন করছে যা দেখে বিদ্যাসাগরের অনুবাদ করা বত্রিশ সিংহাসনের কথা মনে পড়ে যায়। ইরানের কোনো এক রাজা এই সিংহাসনে বসে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আলাপ করতে পছন্দ করতেন। গুলিস্তান প্রাসাদে বেশ কয়েকটি (চারদিকের দেয়াল এবং সিলিঙে কাচলাগানো) শীশমহল আছে যেগুলো দেখে ধারণা করা যেতে পারে মোগল প্রাসাদের শিশমহলগুলো কেমন দেখতে ছিল। প্রাসাদে পুরুষ আর মহিলা সাধারণত একসঙ্গে বসতে পারতো না। মহিলাদের বসার আলাদা জায়গা ছিল। সেখানে তারা নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্যে নাচগানও করতেন। সেই কক্ষের দেয়ালে প্রায় অনাবৃত, অর্ধ-আবৃত নারী শরীরের প্রতিকৃতিও আছে।
গুলিস্তানের পাশেই তেহরানের গ্র্যান্ড বাজার। সেখানে ইস্তাম্বুলের গ্র্যান্ড বাজারের মতো ‘বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি’। এক এক গলিতে এক এক জিনিষের বাজার। পেস্তাবাদামের দোকান থেকে পেস্তা, আখরোট, শুকনো ডুমুর ইত্যাদি কেনা হলো। দেখে দাম কম বলে মনে হলেও দিতে গিয়ে দেখা গেল দাম খুব একটা কমও নয়। টাকা অনেকটাই শেষ হয়ে গেল বলে ডলার ভাঙাতে হলো দালালের কাছে এবং হোটেলের চেয়ে হাজার তিনেক রিয়াল বেশি পাওয়া গেল। ১০০ ডলার ভাঙিয়ে পাওয়া গেল ৫০,০০০ রিয়ালের ২৭টি নোট, যেখানে কিনা হোটেলে দিয়েছিল ২৪টি নোট। ভাঙানোর সময় কোনো দুই নম্বরী দেখলাম না। খুবই ভদ্র, সুবেশ দালাল একেকজন। এমনিতেও ইরানি দোকানদারেরা খুবই ভদ্র। একবারও আপনাকে কিনতে জোর করবে না। আপনি দোকানে ঢুকলেন, দাম জিগ্যেস করলেন, দামে বনলে কিনলেন। না কিনলেও দোকানীর দৃষ্টি, বাক্য কিংবা ব্যবহারে অসন্তুষ্টির চিহ্নমাত্র পাবেন না। ব্যাবসায়ীদের অসভ্যতার শুরু সম্ভবত উত্তর ভারতে এবং শেষ সম্ভবত ভারতবর্ষের সর্বশেষ প্রান্ত এই বাংলাদেশে।
গ্র্যান্ড বাজারের এক রেস্টুরেন্টের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এলাম গাইড নেগাকে অনুসরণ করে। ‘কী খাবেন? মুরগি নাকি ভেড়া?’ সুদর্শন ওয়েটার এসে প্রশ্ন করলো। ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছেন বোরখাপড়া কিন্তু মুখখোলা এক মহিলা। ওয়েটাররা সবাই পুরুষ। প্লেটের দুই প্রান্ত ছুঁয়ে পড়ে আছে ভেড়া বা মুরগির মাংসের কিমা দিয়ে তৈরি ‘কবব’। ঝরঝরে ইরানি চালের ভাতের উপর রাখা আছে এক পাশে জাফরান লাগানো এবং কড়কড়ে করে পোড়া জমাটবাঁধা ভাতের একটি টুকরো। সাথে ছিল প্ল্যাস্টিকের প্যাকেটে অতি পাতলা রুটি, এতই পাতলা যে আগে থেকে বলে না দিলে, মুখ মোছার কাগজের ন্যাপকিন মনে হতে পারে। সেদ্ধ বেগুনের একটি ফালিও ছিল না কি? গতরাতেও দেখেছিলাম, এতখানি কাবাব আর ভাত আমরা বাঙালিরা খেতে পারি না। কিন্তু ইরানিরা ঠিকই সব সাঁপটে দেয়। গঠনে অবশ্য ওরা আমাদের চেয়ে বড়সড়, লম্বা। সুতরাং ওদের খোরাক আমাদের চেয়ে বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক।
বিকালে আমরা গেলাম উত্তর তেহরানের এক রাজপ্রাসাদে যেখানে শেষ রাণী ফারাহ দিবা নিজে থাকতেন। প্রাসাদটি ঘরে-বাইরে ইওরোপীয় ধাঁচের Ñ ইওরোপীয় শৈলীর আসবাব, সাজসজ্জ্বা। রাজপ্রাসাদের যে বাড়িতে দর্শনার্থীরা এসে প্রথমে বসতেন সেটিকে রাণী একটি শিল্পসংগ্রহশালায় পরিণত করেন। সেই প্রাসাদের তিন তলা জুড়ে ইওরোপীয় ও ইরানি শিল্পীদের করা তৈলচিত্র, ট্যাপিস্ট্রি, মর্মরমূর্তির সংগ্রহ প্রশংসা করার মতো। রাণী ফারাহ দিবা নিজেও নাকি চিত্রশিল্পী ছিলেন।
যে রাস্তা দিয়ে আমরা উত্তরের রাজপ্রাসাদে গেলাম সেই রাস্তাটি ইরানের সর্বশেষ রাজা রেজা শাহের বাবার আমলে তৈরি। ‘ইরানের ভালো যা কিছু, সব শাহের আমলে হয়েছে। আগে ইরান ছিল নোংরা, লেখাপড়ার চল ছিল না এখানে। রেজা শাহ ইরানকে বাসযোগ্য করেছেন। মেয়েদের তিনি বলেছিলেন, হিজাব খুলে আধুনিক হতে। আমার বয়সতো বেশি নয়, কিন্তু আমার মায়ের সব মনে আছে। আমরা ইরানিরা ভালো ছিলাম, শাহের আমলে। এটা ঠিক যে শাহের আমলে গণতন্ত্র ছিল না, কিন্তু এখনই কি গণতন্ত্র আছে ইরানে? সব জায়গায় পুলিশ ঘুরে বেড়াচ্ছে সাধারণ পোষাকে। সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলেছেন কি আপনাকে ধরে নিয়ে গিয়ে জেলে পুরবে। ফুটন্ত জলের ডেকচি থেকে গরম তেলের কড়াইতে গিয়ে পড়েছে ইরানের মানুষ।’ বলতে বলতে নেগা এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিশ্চিত হয় যে তার কথা কেউ শুনছে না।
ফারাহ দিবার প্রাসাদের পাশে দুটি এক মানুষ সমান বুটজুতা পড়া পায়ের ভাষ্কর্য। পিতল বা ব্রোঞ্জের তৈরি। মোহাম্মদ শাহ পহ্লবীর বাবা রেজা শাহের পা নাকি এগুলো। তিনি সৈনিক ছিলেন এবং সব সমসময় নাকি মিলিটারি মেজাজে থাকতেন। যেখানেই যেতেন অমনোযোগ ও অপদার্থতার জান্যে শাস্তি দিতেন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। ১৯৩২ সালে ইনিই রবীন্দ্রনাথকে ইরানে আমন্ত্রণ করেন। রবীন্দ্রনাথের সফরসঙ্গী কবি অমিয় চক্রবর্তী রেজা মোহাম্মদ শাহকে নিজে উপস্থিত থেকে সড়ক মেরামতের কাজ তদারকি করতে দেখেছেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ইনি ‘মোল্লাদের আধিপত্যজালে দৃঢ়বদ্ধ পারস্যকে মুক্তি দিয়ে রাষ্ট্রতন্ত্রকে প্রবল ও অচল বাধা থেকে উদ্ধার করেছেন।’ অথচ কিনা, তারই পুত্রের শাসনকালে, মাত্র অর্ধশতক পর, ইরানিরা স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে সেই পশ্চাদপদতাকেই আবার বরণ করে নিয়েছে। এখন আবার তারা মুক্ত হতে চাইছে মোল্লাতন্ত্রের খপ্পর থেকে। লালন শাহের গান: ‘কপালের ফের, নইলে কী আর, পাখিটির এমন ব্যবহার!’
প্রাসাদের সামনে রয়েছে এক তীরন্দাজের মূর্তি। ইরান থেকে তীর ছুড়ে কে সুদূর তুরানে আঘাত করতে পারবে? ‘ইরান-তুরান পার হয়ে আজ তোমার দেশে এসেছি’ গানে যে তুরানের কথা বলা হয়েছে এ হচ্ছে সেই তুরান, তুর্কমেনিস্তান অর্থাৎ এখনকার তুরস্ক। এক সৈনিক নাকি এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন। কিন্তু জ্যা থেকে তীর অবমুক্ত হবার সঙ্গে সঙ্গেই সেই সৈনিক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। সম্ভবত শাহনামার কাহিনি। সোহরাব-রুস্তমের সঙ্গীসাথী কেউ হবেন হয়তো এই সৈনিক, যার মূর্তি তেহরানের অন্যত্রও দেখেছি।
‘তোমার কি শাহের আমলের কথা মনে আছে?’ নেগাকে জিগ্যেস করলাম আমি। ‘আপনি আমার বয়স জানতে চাইছেন, তাইতো? না, আমি অতটা বুড়ি নই, খুব একটা খুকীও অবশ্য নই। আমার বয়স ছত্রিশ। আসলে আমার মা বলেন শাহের আমলের কথা। আমি দেখিনি।’ নেগা মোবাইলে ওর মায়ের ছবি দেখালো। গড়পড়তা ইরানিদের মতোই সুশ্রী এক মহিলা। মাথায় কাপড় নেই। ছবিটি সম্ভবত বাড়িতে তোলা। নেগার এক ভাই আছে। ভাইটি গানবাজনা করে এবং বইয়ের দোকানে কাজ করে। শুধু বইয়ের দোকানেই কাজ করে সে, কারণ সে বই পড়তে, বই নাড়াচাড়া করতে ভালোবাসে। নেগা এখনও বিয়ে করেনি, তবে ছেলেবন্ধু আছে। ‘বিয়ে করছি না কারণ মনের মতো পাচ্ছি না কাউকে। আমার ছেলেবন্ধুটির বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে, ওর নিজের সন্তানও আছে। এ ধরনের কোনো পুরুষের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আমার মনে হয়, ইরানে প্রেম নেই। সে জন্যেইতো আমি কানাডা চলে যাচ্ছি প্রেমের খোঁজে।’ বলে হাহা করে প্রাণখোলা হাসি হাসতে থাকে নেগা। হাসির দমকে মাথার বাদামি ওড়না কাঁধে নেমে আসে। অস্তায়মান সূর্যের আলোকে তেহরানের রাজপথের দুপাশের ম্যাপল গাছের ছায়ায় চোখদুটো সামান্য ফোলা ফোলা, পুরু ঠোঁট, গড়পড়তা ইরানি মেয়ের মতোই সুন্দরী, অতি প্রাণবন্ত এবং সর্বোপরি দারুণ এক কৌতুকবোধের অধিকারী নেগার হাসিটা দারুন লাগে।
কানাডায় অভিবাসনের আবেদনপত্র পুরণ করার জন্যে ফারাহ তার উকিলকে ছয় হাজার ডলার দিয়েছে। ‘এ টাকাটা তুমি অপচয় করেছো। নিজেই আবেদন করা যায়’ বলেছিলাম আমি। ‘বেশির ভাগ ইরানি আমেরিকা-কানাডায় গিয়ে থাকতে চায়, টাকা কোনো ব্যাপারই নয়। আপনারা মিস্টার ট্রাম্পকে আমরা ইরানিদের মনের কথাটা একটু বুঝিয়ে বলুন না!’ বলেছিল নেগা। মনে পড়লো, লস এঞ্জেলসে আমাদের আরেক ইরানি বন্ধু আমীর বলেছিল : আমার দেশ হচ্ছে ওৎধহ, মানে ও ৎধহ ‘আমি দৌঁড়ে পালিয়ে বেঁচেছি!’ গুলিস্তান প্রাসাদে নেগা বলেছিল, এত ইরানি পালিয়ে এসেছে লস এঞ্জেলসে যে শহরটাকে অনেক ‘ইরানেঞ্জেলস’ বলে থাকে।
ইরানে ছেলেমেয়েরা বিয়ে করতে চায় না। বিয়ে করলে ডিভোর্সের প্রশ্ন আসে। ডিভোর্সে সমস্যা আছে, কারণ ডিভোর্স-সংক্রান্ত সব আইন পুরুষের পক্ষে। বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন করা কোনো দম্পতির যদি বাচ্চা থাকে, তবে সে বাচ্চা বাপের সঙ্গে থাকবে। ডিভোর্সের আর একটি বড় সমস্যা হচ্ছে, মোহরানার পরিমাণ এত বেশি যে সে টাকা পরিশোধ করা সম্ভব হয় না বেশির ভাগ ছেলের পক্ষে। আর তালাক পাওয়া একটা মেয়ে তার প্রাপ্য মোহরানা ছাড়বেই বা কেন। ডিভোর্সি মেয়েকে কেউ বিয়ে করতে চায় না। বাপমায়ের সংসারেও তার জীবন সুখের নয়। এসব কারনে ছেলেমেয়েরা বিয়ে না করে লিভ টুগেদার করে। সমাজও বাধ্য হয়ে এই নতুন প্রথা মেনে নিচ্ছে। ইরানে এ ধরনের সম্পর্ককে ‘হোয়াইট ম্যারেজ’ বলে। খুব কট্টর মানসিকতার লোক ছাড়া হোয়াইট ম্যারেজ নিয়ে কেউ আপত্তি করে না। বিয়ের সংখ্যা কমে যাওয়াতে বাচ্চার সংখ্যাও নিশ্চয়ই কমে যাচ্ছে। যে চারদিন তেহরানে ছিলাম, রাস্তাঘাটে বাচ্চা খুব একটা দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।
শিশুর সংখ্যা কমছে, কমছে বিশ্বাসীর সংখ্যাও। যে কোনো বিশ্বাস রূপকথার মতো কিছুটা শিশুসুলভতো বটেই। প্রকৃত প্রাপ্তবয়স্ক লোক চোখ বুঝে বিশ্বাস করতেই পারে না। আমরা সবাই কমবেশি বিশ্বাসী, সুতরাং আমরা প্রত্যেকেই কমবেশি শিশু, নাবালক। ইরানিরা কি সাবালক হয়ে উঠছে? ইরানের মসজিদে মুসল্লির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বাধ্য না হলে যুবসমাজ নামাজ পড়তেই চায় না। নামাজের সময় দোকানপাট সব খোলা দেখে আমরা অবাক হওয়াতে গাইড সবিনয়ে জানালেন: ‘এটা আরবদেশ নয়, আপনারা মহান পারস্যদেশে রয়েছেন!’ তেহরান শহরে খুব বেশি মসজিদ চোখে পড়ে না। আমি যখন বললাম, ঢাকা শহরে চোখ ঘোরালেই মসজিদ চোখে পড়ে, তখন গাইড নেগা জানালো সিরাজ বা কোম-এর মতো শহরে অনেক মসজিদ আছে। তবে তেহরান যেহেতু রাজধানী এবং এখানে আগে থেকেই যেহেতু বিশ্বাসী লোকজন সংখ্যায় কম, সেহেতু মসজিদও সংখ্যায় কম। তেহরানে সাড়ে চার দিনে যে দুই গাইড ছিল আমাদের সঙ্গে, একজন নারী ও অন্যজন পুরুষ, দুজনেই নাস্তিক। এক নির্ভরযোগ্য জনমত যাচাইয়ে নাকি দেখা গেছে, যুবসমাজের শতকরা সত্তর ভাগের ঈশ্বর-ধর্ম-পরকালে কোনো প্রকার বিশ্বাস কিংবা আগ্রহ নেই। ‘আপাতত ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করছি। ভালো মানুষই যদি হতে না পারলাম, তবে ধর্ম-কর্ম সবই বৃথা।’ বলেছিল আমাদের পুরুষ গাইড।
‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষকদের বেতন কত?’ জিগ্যেস করেছিলাম এক অধ্যাপককে। ‘সেটাতো আমেরিকার খেয়ালখুশির উপর নির্ভর করে। কয়েক বছর আগে আমার যা বেতন ছিল তা ৯০০ মার্কিন ডলারের সমান। এখন ট্রাম্পের অবরোধের কারনে বেতন হয়তো ৪০০ মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে, কারণ রিয়ালের দাম পড়ে গেছে। জিনিষপত্রের দাম বেড়ে গেছে কয়েক গুন।’ আমি তাকে জানালাম যে বাংলাদেশে যে কোনো জিনিষের দাম ইরানের কমপক্ষে তিনগুন। অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে ইরান এখনও সস্তার দেশ। বলেছিলাম না, মাত্র দশ ডলারে শেরাটনের মতো হোটেলে লাঞ্চ-ডিনার সেরে ফেলা যায়।
প্রথম দিনই মনে হয়েছিল, তেহরান একটি মধ্যবিত্তপ্রধান পরিচ্ছন শহর (এবং ঢাকা একটি গরীব, অপরিচ্ছন্ন, রূচিহীন শহর)। একটা উদাহরণ দিই। পৃথিবীর প্রায় সব দেশের মানুষ ব্যালকনিতে কাপড় শুকায়। রাস্তা থেকে বাড়ির দিকে তাকালে ব্যালকনিতে ঝুলানো কাপড় দেখে বাড়ির নারী-পুরুষের শরীরের জ্যামিতি সম্পর্কে ধারণা হয়ে যায়। তেহরানের লোকজনের যে রূচি আছে তার অন্যতম প্রমাণ, তারা ব্যালকনিতে কাপড় শুকায় না। রাস্তায় নোংরা ফেলে না ইরানিরা, কোনো জরিমানার ভয়ে নয়, নিজে থেকেই ফেলে না, ব্যক্তিগত ও সামাজিক সৌন্দর্যবোধের কারনে। ইচ্ছেমতো নোংরা ফেলা আর জরিমানার ভয়ে নোংরা না ফেলা অনেকটা একই মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।
তেহরানে সামাজিক বৈষম্য অবশ্যই আছে, কিন্তু বাংলাদেশের মতো নয়। রাস্তার গাড়ির দিকে তাকালেই ব্যাপারটা বোঝা যায়। বেশির ভাগ গাড়ি হাল্কা, ফরাসি রিকন্ডিশন্ড গাড়ি: রনো, পোজো ইত্যাদি। বাংলাদেশের মতো কোটি কোটি টাকার জবরদস্ত গাড়ি রাস্তায় নেই বললেই চলে। জাপানি গাড়িও বিরল। অবরোধের কারণে সম্পদ ও অর্থনীতি বিকশিত হতে পারেনি ইরানে, কিন্তু সম্পদ যতটুকু আছে ততটুকু সুষমভাবে বণ্টন হচ্ছে বলেই মনে হলো। ইসলামের অন্যতম এই বৈশিষ্টটি ইরানিরা যেভাবে অনুসরণ করছে, অন্য দেশের মুসলমানদের জন্য সেটি অনুকরণীয় হতে পারে।
গাড়ির সংখ্যা কম নয়, যানজট প্রায় প্রতিদিন হয়, কিন্তু সবাই ট্র্যাফিক আইন মেনে চলে। বাসের জন্য আলাদা লেন আছে। বাসে নারী-পুুরুষ আলাদা বসে। অর্ধেকটা বাস নারীর, বাকি অর্ধেকটা পুরুষের। আইনভাঙার প্রশ্নই আসে না, তবে মটরসাইকেলে বসা তরুণেরা কখনো কখনো গতিসীমা ছাড়িয়ে যায় বটে। তরুণদের পোশাক-আশাক, চুলের কাটিং সব পশ্চিমাদের মতো। খুবই ফ্যাশনেবল পোশাক পরে ইরানি তরুণেরা। তরুণীদের ফ্যাশনটা অবশ্য হিজাবের কারনে খুব একটা দেখার উপায় নেই। তরুণদের সুগঠিত শরীর ও মুখশ্রীর সঙ্গে পোষাকটা মানিয়েও যায়। দুধে-আলতা রঙের সাথে কালো চোখ, কালো চুল, কালো চাপদাড়ি কিংবা কালো ওড়না-চাদরের বর্ণবৈষম্য দেখতে ভালোই লাগে। ইরানি রাজনীতিকদের প্রায় সবারই চাপদাড়ি এবং গোঁফ আছে, ধর্মীয় নেতাদের আছে রবীন্দ্রনাথের মতো লম্বা দাড়ি (এবং সাথে অবশ্যই গোল পাগড়ি)। হো-চি-মিন টাইপ ছাগলদাড়ি কারও দেখিনি। সাধারণ মানুষ চাপদাড়ি রাখে কিংবা ক্লিন শেভ করে। লম্বা দাড়ি রাস্তাঘাটে দেখা যায় না খুব একটা। তারা হয়তো মসজিদ কিংবা খানকায় (ইরান পীর-ফকির-তাবিজ-মাজারের দেশ!) থাকে।
তেহরানে তৃতীয় দিনে আমরা গেলাম তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৮৫১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা যারা চীনের ইউনান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে এবং তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে তেহরানে এসেছি তাদের একটি ছোটখাট কনফারেন্সে মিলিত হবার কথা। ইউনান বিশ্ববিদ্যালয়ে আচার্য (চীনে উপাচার্যকে বলে প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্টও আছেন) বা ডিরেক্টর উপাচার্যের উপরস্থ কর্মকর্তা। আচার্য ব্যাখ্যা করলেন কেন তিনি বাংলাদেশ ও বার্মার শিক্ষকদের নিয়ে তেহরানে মিলিত হয়েছেন। এটা চীনের ‘বেল্ট এ্যান্ড রোড’ প্রকল্পের অংশ। এর উদ্দেশ্য, পরস্পরকে জানা-বোঝা যা ছাড়া জ্ঞানের চর্চা কিংবা অর্জন কোনোটাই সম্ভব নয়।
আমি আমার বক্তৃতায় আচার্যকে ধন্যবাদ দিলাম। রাজনীতির কড়ি ও কোমলের কথা বললাম। যে কোমল রাজনীতি অতীতে রোমান, গ্রীক আরব ও ফরাসিরা অনুসরণ করেছিল, সেই একই রাজনীতি চীনও অনুসরণ করছে, কিন্তু অনেক পরিকল্পনা, বিনিয়োগ এবং মুন্সিয়ানার সঙ্গে। এর সুফল ফলবে অনতিবিলম্বে এবং যেসব জাতি এই রাজনীতি অনুসরণ করতে অযথা দেরি করবে, তারা বেহুদা পেছনে পড়ে যাবে। আচার্য আমার বক্তৃতা (আসলে আমার বক্তব্যের চীনা অনুবাদ, কারণ আচার্য ইংরেজি জানেন না বললেই চলে!) শুনে অত্যন্ত খুশি হলেন এবং সবার বক্তৃতার শেষে আমার কাছে এসে বারবার আমাকে ধন্যবাদ দিলেন।
কনফারেন্স শেষ হলে আমরা মধ্যাহ্নভোজে বসলাম। ‘এরা আতিথেয় বলে বিখ্যাত এবং সেই আতিথ্যে পংতিভেদ নেই।’ লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর পারস্যভ্রমণ কাহিনিতে। ইরানীরা পংতিভেদ না মানলেও চীনারা খুব মানে। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শুদ্র মিলেমিশে একাকার হতে দিতে নারাজ চীনের সমাজ। চীনারা যখন কোনো ভোজ কিংবা সভার আয়োজন করে তখন সেখানে হুট করে কোনো চেয়ারে বসে পড়লে সেই চেয়ার থেকে অনতিবিলম্বে উঠে পড়তে হতে পারে। ইওরোপের ভাষায় যাকে ‘হায়ারার্কি’ বলে সেই ক্ষমতাক্রম বা মর্যাদাক্রম অনুসারে বসতে, বসাতে হয় চীনা (ভোজ বা অন্য কোনো) সভায়। যারা জানে না বা খেয়াল করে না, তারা আগেভাগে বসে পড়ে নাকাল হয়।
ইরানিরা কোনো একটি চেয়ারে বসে পড়তে বললেও আমি দাঁড়িয়েই ছিলাম, কারণ আমি জানতাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে আমি কোথায় বসবো না বসবো তা উদ্যোক্তা চীনারাই ঠিক করবেন। তাই হলো। নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ইউনান বিশ্ববিদ্যালয়ের সুজি বা চেয়ারম্যান (উপাচার্যের উপরস্থ কর্মকর্তা), তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশি ভাষা বিভাগের পরিচালকের সঙ্গে একটি টেবিলে স্থান হলো আমার। খাবার? সেই কাবাব এবং জাফরানরাঙা চিকন চালের ভাত। পালংশাক, ডাল ও মাংসের টুকরা সহযোগে স্টুয়ের মতো একটি পদও ছিল। কাবাব খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে উঠছিলাম, বলা বাহুল্য। ইরানিরা কীভাবে সারা জীবন ধরে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কাবাব খেয়েই চলেছে, সেটা আমরা বাঙালিদের জন্যে একটা বিস্ময়ের ব্যাপার বটে।
মধ্যাহ্নভোজনের পর ক্যাম্পাস দেখতে বের হলাম। আমাদের দেশের ক্যাম্পাসে ছেলে-মেয়ে একসাথে বসে আড্ডা দেয়। এখানে ছেলে-মেয়ে দূরে থাক, ছেলে-ছেলে বা মেয়ে-মেয়েও আড্ডা দিতে দেখলাম না। সবাই কেমন যেন একটু একা একা থাকতে চায়। ছেলেমেয়েরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী, অনেকটা ইওরোপ-আমেরিকার মতো। মনে পড়ছে, আড্ডার প্রসঙ্গে মুজতবা আলী মিশরীয়দের কথা বলেছিলেন। ইরানিদের কথা বলেছিলেন কি কোথাও? খুব একটা ক্যাফে দেখলাম না তেহরানে। ইস্তাম্বুলে প্রচুর ক্যাফে ছিল যেখানে লোকজন বসে রাজাউজির মারতো। ইরানে সরকারের প্রকাশ্য সমালোচনা করা যায় না। তুরস্কে সমালোচনা সহ্য করা হয়। সরকারের সমালোচনাই যদি করা না যায়, তবে আড্ডায় মানুষ বলবেটা কী? ইরানে সরকারের সমালোচনা নেই বলে আড্ডা নেই। আড্ডা নেই বলে ক্যাফেও নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেশ কম। লাইব্রেরিতে অবশ্য অনেক শিক্ষার্থীর দেখা মিললো। ছেলে আর মেয়ে আলাদা সারিতে বসে নিজ নিজ ল্যাপটপে কাজ করছে। ক্যাম্পাসে পর্দা কম হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু দেখা গেল চাদর নয়, বোরখা পড়ছে মেয়েরা ক্যাম্পাসে এবং শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে বোরখার সংখ্যা রাস্তার তুলনায় ঢের বেশি। তবে নেকাব নেই, রবীন্দ্রনাথ যেমনটা দেখেছিলেন সিরাজ নগরে ১৯৩২ সালে: ‘কালো কালো আঙরাখায় মেয়েদের সর্বাঙ্গ ঢাকা, মুখেরও অনেকখানি কিন্তু বুরখা নয়।’ রাস্তায় আগে মাথা না ঢাকলে ধর্মপুলিশ এসে মেয়েদের শাস্তি দিতো। এখন মাথার অর্ধেক ঢাকলেই চলে, না ঢাকলেও পুলিশ কিছু বলে না। তাহলে ক্যাম্পাসে এই অবস্থা কেন? গাইড নেগা জানালো, নিয়ন্ত্রণ শিথিল হচ্ছে, কারণ মেয়েরা জেল-জরিমানার ঝুঁকি নিয়ে প্রতিবাদ করছে। আমাদের ভ্রমণসঙ্গী নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাহমুদ এর ব্যাখ্যা দিলেন এভাবে: যে কোনো দমন-ইচ্ছুক কর্তৃপক্ষ প্রধানত প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, কারণ সেখানে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। ঝিকে মারলেই বৌ শিখে যাবে। ক্ষমতা কোথায় দেখাতে হবে, সেটা সফল শাসককে বুঝতে হবে। মসজিদে, বিদ্যালয়ে ক্ষমতা দেখাতে হবে, কারণ সেখানে লোকসমাগম ঘটে। মাঠে-ঘাটে ক্ষমতা দেখানো শাসকের ক্ষমতা ও সময়ের অপচয়।
রাজনীতি বিজ্ঞান অনুষদের মিলনায়তনে একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ছিল। বিষয়: ইরানের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায় অবরোধ। চলচ্চিত্র দেখতে দেখতে দর্শক মাঝে মাঝে শ্লোগান দিচ্ছে: ‘আমেরিকা নিপাত যাক!’ দিতেই পারে। কিন্তু মনে হলো, এই শ্লোগান হৃদয় থেকে উৎসারিত নয়। শ্লোগান দিতে দর্শকদের বাধ্য করা হচ্ছে, কিংবা, শ্লোগান দেবার জন্যেই এই দর্শকদের ভাড়া করা হয়েছে। শ তিনেক লোক ধরে এমন মাঝারি আকারের মিলনায়তনে খান দশেক লোক বসে আছে। প্রবেশপথে সাদা কালো চেক গামছা জাতীয় উড়নি দিয়ে ঘাড়-মাথা ঢাকার চেষ্টা করছে অল্পবয়সী কয়েক জন তরুণ। এই চেক উড়নি সম্ভবত ইসলামী বিপ্লবের প্রতীক। একজন বৃদ্ধ আয়াতুল্লাহ এই কাপড়ে কাঁধ-মাথা ঢেকে মিলনায়তনের স্টেজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। দরজার পাশে হুইলচেয়ারে বসে আছেন ইরান-ইরাক যুদ্ধে দুই পা হারানো যুদ্ধাহত এক যোদ্ধা। তার হাতে একটি চেক উড়নি তুলে দেওয়া হলো এবং তিনি সেই উড়নিতে মাথা-ঘাড় ঢাকতে শুরু করলেন। আমি দুই একটা ছবি তুললাম, কিন্তু আশেপাশে লোকজন আমার ছবি তোলার ব্যাপারটা পছন্দ করছে না বলেই মনে হলো। গাইডরাও বের হয়ে যাবার জন্যে আমাদের তাড়া দিতে শুরু করলো। ইরানের বর্তমান সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা চমৎকারভাবে তুলে ধরছে এই ঘটনা।
ইরান-ইরাক যুদ্ধ বর্তমান সরকারের প্রপাগান্ডার অন্যতম অস্ত্র। সেই যুদ্ধে শহীদদের রঙিন ছবি লাগানো আছে রাস্তার মোড়ে মোড়ে। বিমানবন্দরে যাবার পথে দেখলাম রাস্তার পাশের এক বাড়ির দেয়ালে আঁকা এক চিত্রে যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া ছেলের আলোকচিত্র হাতে নিয়ে বৃদ্ধা মা দূরে তাকিয়ে রয়েছেন। ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না। ওরা আসবে চুপি চুপি’। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এসব সেন্টিমেন্টের আদৌ কোনো মূল্য আছে বলে মনে হয় না। দুই তিন দশক আগে ঘটে যাওয়া ধর্মবিপ্লব, ইসলামী বিপ্লব নিয়ে তরুণদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা চায় কাজ, টাকা, আমেরিকান স্ট্যাইলের জীবন। আমেরিকা যদি ভিসা দেয়, তবে কত জন লোক ইরানে পড়ে থাকবে, সে প্রশ্ন করা যেতেই পারে।
তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসটি শহরের এখানে-ওখানে ছড়ানো ছিটানো। সব ফ্যাকাল্টি এক জায়গায় নয়। আমরা তেহরানের কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটে গেলাম। একটি ভাষা ইনস্টিটিউটের ভিতরে অবস্থিত এই ইনস্টিটিউট। গেটের দারোয়ান ঢুকতে দিল সহজেই, কিন্তু দুয়ারের দারোয়ান বাধা দিল। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি প্রয়োজন। অনুমতির জন্য অনেক ফোন করা হলো, আবেদন-নিবেদন করা হলো। অনুমতি পাওয়া গেল না শেষ পর্যন্ত। কোনো প্রকার যোগাযোগ-বৈকল্যের কারণে এই অব্যবস্থাপনা ঘটে থাকবে। বোঝা গেল, ইরানের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ ও প্রস্থান পাশ্চাত্য, জাপান কিংবা বাংলাদেশের মতো অবারিত নয়। সুকুমার রায় হলে হয়তো লিখতেন: ‘শুনেছো কি বলে গেল সীতানাথ বন্দ্যো? ইরানের গায়ে নাকি টক টক গন্ধো!’
রবীন্দ্রনাথ তাঁর পারস্যযাত্রীর পত্রে ইরানে দুই দল লোকের কথা লিখেছিলেন। এক দল যারা পুরনোকে আঁকড়ে ধরে আছে, তারা নতুনকে চেনেই না। আরেক দল নতুন নিয়ে এতই মশগুল যে পুরনো সম্পর্কে কোনো খবরই তারা রাখে না। ‘এই দ্বিধাবিভক্তির মধ্যে ‘শাশ্বত পারস্য’ যে কী রকম বস্তু তা খুঁজে বের করা মুশকিল’ রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন তৎকালীন পারসিক পার্লামেন্টের এক সদস্য। ইরানে এখনও এই ‘দ্বিধা’ (উভয়ার্থে: দ্বিধা এবং দ্বি-ধা) এক চরম বাস্তবতা। এখনও দুটি পৃথক দলে বিভক্ত ইরানের সমাজ। দ্বিতীয় দলের আছে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মন, যে মনের সকল প্রশ্নের উত্তর প্রথম দল দিতে অক্ষম – প্রথমত, জ্ঞান ও কাণ্ডজ্ঞানের অভাবে এবং দ্বিতীয়ত, ক্ষমতার স্বভাবে।
ইরানের বর্তমান সরকারের সক্ষমতার অন্যতম দুটি নিদর্শন মিল্লাত মিনার এবং ইমাম খোমেনির মাজার। প্রথমে মিনারের প্রসঙ্গে আসি। খুব মুন্সিয়ানার সঙ্গে নির্মিত হয়েছে এই মিনার। মিল্লাত টাওয়ার সম্ভবত নির্মিত হয়েছে আমেরিকা তথা সারা বিশ্বকে ইরানের সক্ষমতা দেখানোর জন্যে। দেখ্ আমরাও পারি! মিনার থেকে দেখা চারদিকের দৃশ্য অতি চমৎকার। টাওয়ারের মাথার মুকুটের গোলাকার স্থানে বসার জন্য সোফা রাখা আছে। ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে ফেরদৌসী, হাফিজ, রুমি, খৈয়ামসহ ইরানের কৃতি সন্তানদের মোমের মূতি। প্যারিসের ইফেল টাওয়ার, ভিয়েনার দানিউব টাওয়ার, টরোন্টো টাওয়ার, মিউনিখ টাওয়ার, ক্যান্টন টাওয়ার, টোকিও টাওয়ার… একাধিক মিনার দেখেছি আমি, কিন্তু কোনো টাওয়ারের উপর থেকে দেখা দৃশ্যই মিল্লাত টাওয়ারের সঙ্গে তুলনীয় নয়। আর যে দৃশ্যটি খুব কম টাওয়ার থেকে দেখা যায়, সেটি হচ্ছে তেহরানের পর্বতশীর্ষে বরফের সফেদ তাজ, হাত বাড়ালেই যেন এক মুঠো বরফ তুলে নেয়া যাবে।
ইরানে বিদেশি ট্যুরিস্ট খুব বেশি আসে না বলে তেহরানের কোনো দ্রষ্টব্যস্থানেই ভিড় খুব একটা নেই। পাসপোর্টে ইরানী ভিসা থাকলে অন্য দেশের ভিসা পেতে ঝামেলা হতে পারে ভেবে অনেকেই ইরানে আসতে চান না। এতেও ক্ষতি হচ্ছে ইরানের অর্থনীতির। তবে ইরানিরা শুনেছি রাশিয়া যায় খুব এবং রুশরাও ইরানে আসে। রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক খুব ভালো। আমাদের দুজন গাইডই রুশ বলতে পারে। তারাই বললো যে ইরানে রুশ ভাষা শেখার খুব চল আছে। আর বাঙালির আত্মার মনিবের ভাষা ইংরেজির কী অবস্থা ইরানে? সত্য কথা বলতে কী, ইংরেজি বলতে পারে এমন একজনকেও পাইনি তেহরানের রাস্তাঘাটে। ইংরেজি না জানার জন্যে ইরানের ব্যষ্টিক কিংবা সামষ্টিক অর্থনীতি কিংবা সংস্কৃতির কোনো ক্ষতি হচ্ছে বলে কেউ এখনও দাবি করেনি।
শেষ রাজা রেজা মোহাম্মদ শাহ অনেকগুলো প্রাসাদ নির্মাণ করিয়েছিলেন। ইসলামী বিপ্লবীরা যেহেতু প্রাসাদের শানশওকতে বিশ্বাস করে না, সেহেতু তারা নির্মাণ করছে ইসলামী ইরানের অন্যতম রূপকার ইমাম খোমেনির মাজার। মাজারে খোমেনি এবং তাঁর পুত্রের কবর রয়েছে। চার চারটি সোনালি রঙের মিনার ও গম্বুজযুক্ত বিশাল এক কমপ্লেক্স, যাকে বিমানবন্দর থেকে আসার পথে স্বর্ণমসজিদ মনে হয়েছিল। এখানে একটা প্রতিযোগিতার ব্যাপার রয়েছে। তোরা প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলি, আমরা মাজার নির্মাণ করছি। কবরপূজা এবং তাবিজ পরা ইরানীদের আবহমান সংস্কৃতির অংশ। তারা যখন বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টান ছিল, তখনও তারা কবর পূজা করতো এবং তাবিজ পড়তো। কবর ও তাবিজের পারসিক ঐতিহ্য আফগানিস্তান, হিন্দুস্তান হয়ে ছড়িয়ে গেছে আমাদের বাংলাদেশেও।
ইরানিরা এবং চীনারা আমাদের একা কোথাও যেতে দিতে ভয় পেতো। ওরা চাইতো, সব সময় গাইড সঙ্গে থাকুক। যদি কোথাও কিছু হয়ে যায়। আমার অবশ্য কোনো ইরানিকেই বেয়াদব বা উগ্র মনে হয়নি। আয়োজকদের বাধা উপেক্ষা করে আমি টুকটাক কেনাকাটা করেছি। আগেই বলেছি, ইরান এখনও সস্তার দেশ এবং দোকানদারেরা অত্যন্ত সজ্জন। প্রোগ্রামের চাপে কেনাকাটা বিশেষ করা যায়নি সদলবলে। শেষ দিন সকালে আমরা শপিংপিয়াসী কয়েকজনকে নিয়ে যাওয়া হলো ফেরদৌসী রোডে। ঘন্টা দুয়েক পরে মধ্যাহ্নভোজন। চীনাদের আবার বেলা দ্বিপ্রহরের মধ্যেই মধ্যাহ্নভোজন শেষ করতে হবে প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মণদের মতো।
আমাদের ফিরিয়ে আনা হলো হোটেলে। আমরা কয়েকজন, যাদের নেতা ছিলাম আমি, বললাম যে আমাদের খিদে নেই। বাকিরা যখন খাবে, আমরা হোটেলের কাছে কোথাও শপিং করবো। ইরানিরা অবাক হলেও বাধা দিল না। গেলাম কেশাবার্জ বুলভার্ডের কাছের এক এভেনিউতে। প্রশস্ত ফুটপাথের এখানে ওখানে দোকান বসেছে ভূমিতে পণ্যের পসরা সাজিয়ে। পণ্যসামগ্রী বেশির ভাগই ‘মেড ইন চাইনা’ দেখে আমরা ইঙ্গিতে বললাম: ‘চাই না, চাই না।’ বন্ধুদের কেউ কেউ হিজাব বা ওড়না কিনলেন। আমাদের দেশের মতোই হিজাব জিনিষটা ইরানে এখনও দেদার পাওয়া যায় এবং পাওয়া যায় বেশ সস্তায়। ফুটপাতের দোকানিদের মধ্যে অন্তত একজন ছিল যে হিন্দি বলতে পারতো। সম্ভবত পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তান থেকে আসা কেউ হবে। দ্বিতীয় রাতে দেখেছিলাম, রাতের বেলা ফুটপাতে দোকানের সংখ্যা বাড়ে। পুলিশ ফুটপাথে দোকান করতে বাধা দেয় না সব সময়।
ইরানে স্ক্রু-ড্রাইভার, করাত, হাতুড়ি ইত্যাদি অর্থাৎ গৃহস্থালী মেরামতের দোকান চোখে পড়েছে প্রায় সর্বত্রই। আমারও এই যন্ত্রপাতিগুলোর প্রতি আগ্রহ আছে। ফ্রিজ-এয়ারকন্ডিশনার মেশিনের দোকানও প্রায় প্রতি রাস্তায়। বইয়ের দোকানগুলো খুব সুন্দর করে সাজানো। লোকজনকে বই-খাতা-কলম প্রচুর কিনতে দেখেছি, ইওরোপের মতো। এখানে-ওখানে ফুলের দোকানও ছিল, প্যারিসের মতো অতটা নয়, কিন্তু ছিল। ইস্তাম্বুলে ফুলের দোকান দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। ইরানি জাতির পুষ্পপ্রীতি তুর্কিদের চেয়ে বেশি হবার কথা, কারণ আরবদের মতো তুর্কিরাও ইরানিদের সংস্পর্শে এসেই সভ্য হয়েছিল কিনা। আমার মনে হয়, পুরো মধ্য এশিয়ার সংস্কৃতির নাভিদেশ হচ্ছে ইরাণ।
বিমান বন্দরে আসার পথে আমরা গেলাম একটি পাহাড়ি এলাকায় যেখানে পাহাড়ে খাঁজ কেটে রেস্টুরেন্ট বানানো হয়েছে, করা হয়েছে ফুলের চাষ, বিশেষত টিউলিপের। এলাকায় ঢোকার পথে ছিল এক ইরানি পর্বতারোহীর মূর্তি যে কিনা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কিছু মার্কিন পর্বতারোহীকে বাঁচিয়েছিল। সেই এলাকার এখানে ওখানে ধুনি জ্বালানো হয়েছে, যদিও আগুন পোহানোর মতো শীত পড়ছে না তেহরানে। ইরানের প্রাচীন ধর্ম অগ্নিউপাসক জরথুস্ত্রদের সংস্কৃতির অন্তর্লীন বহমানতার প্রমাণ নয়তো এই সব অগ্নিশিখা? উপরে তাকালে শুধু পাহাড় চোখে পড়ে, এমন ন্যাড়া, এমন রুক্ষ সেই পাহাড় যে ঘাসের একটি ফালি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল না। এমন পাহাড়ে কি সারা জীবন কাটিয়ে দেয়া সম্ভব? এ জন্যেই বোধ করি ভাগ্যান্বেষণে ইরানীরা চলে আসতো ভারতবর্ষে, বাংলা অঞ্চলে।
শেষ হয়ে গেল সাড়ে চারটি দিন। অনেক কিছুই দেখা হয়নি, কাজের চাপে, সময়ের অভাবে। কিন্তু যা দেখেছি তাইবা কম কী! তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি আমাদের পৌঁছে দিল ফড়–ৎগাহে, অর্থাৎ বিমানবন্দরে। বাংলা ভাষায় পাখি ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়, কিন্তু ফার্সি ভাষায় পাখি ফুড়ুত্ করে এসে মাটিতে নামে। ঈদগাহ, দরগাহ, ফড়ুৎগাহ… এসব শব্দের মধ্যে কিছু কিছু সুদূর পারস্য থেকে উড়ে এসে বাংলা ভাষায় জুড়ে বসেছে, কারণ ফার্সি ছিল কমবেশি আট শো বছর ভারতবর্ষ তথা বাংলাদেশের দাপ্তরিক ভাষা কিংবা রাষ্ট্রভাষা। শুধু তাই নয়, বাংলার সঙ্গে যে ভাষার গভীর জন্মসম্পর্ক সেই সংস্কৃত ও ফার্সির জননী পহ্লবী পরস্পর ভগ্নীভাষা। পারসিক ‘আহুর’ সংস্কৃতে ‘অসুর’। পারসিক ‘খোদা’ সংস্কৃতে ‘স্বধা’। বাংলার সঙ্গে পারস্যের সম্পর্ক হাজার হাজার বছরের। সে তুলনায় বাংলার সঙ্গে আরবের সম্পর্ক মাত্র কয়েক শ বছরের।
বিমানবন্দরে আবার সেই সহৃদয় ব্যবহার: নেই বিন্দুমাত্র অপমান, নেই যাত্রীদের সঙ্গে বিমানবন্দরের কর্মকর্তাদের কোনো প্রকার বেয়াদবি, দৃষ্টি, বাক্য, কিংবা আচরণে, যে রকমটি দেখা যায় আরব, বাংলা কিংবা ভারতের বিমানবন্দরে। ইরানিরা খুবই ভদ্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বাদই দিলাম, কারণ সেখানে শিক্ষিত লোকের মেলা। কিন্তু রাস্তাঘাটেও গত কয়েকদিনে সেই এক বুড়ো ড্রাইভার ছাড়া কাউকেই উচ্চস্বরে কথা বলতে শুনিনি Ñ গালাগালি, ঝগড়াতো ‘দূর কী বাত’! নারীপুরুষ রাস্তাঘাটে পরস্পরের সঙ্গে মিশছে, আলাপ করছে, কিন্তু কোনো প্রকার অশ্লীলতা নেই, ঢাকায় যা নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা।
নিজের দেশের মানুষের কাছে স্বীকার করতে বাধা নেই, আগেও বলেছি, ঢাকা সবদিক থেকে একটি গরীব, নীচ এবং নোংরা শহর। নীচ, কারণ এখানে মানুষে-মানুষ সম্পদের পার্থক্য বিশাল এবং তাতে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। অন্যের কথা বিন্দুমাত্র না ভাবা, শুধু নিজের কথা ভাবা, নীচ বা ছোটলোকের অন্যতম লক্ষণ এবং এর ফলে সমাজ সব দিক থেকে গরীব হয়ে যায়। বাংলাদেশে যেনতেনপ্রকারেন সবাই আগে যেতে চায় এবং সমাজ ও রাষ্ট্র পারতপক্ষে এই অস্বাভাবিক, অসুস্থ আচরণে বাধা দেয় না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন: ‘তুমি যারে নিচে ফেল, সে তোমারে বাঁধিবে যে নিচে। পশ্চাতে ফেলিছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।’ এমনটা হওয়া অসম্ভব নয় যে বাংলাদেশের বেশির ভাগ না হলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ মনের অন্তর্লীন স্তরে ঘোরতর ভ- কারণ গরীব প্রতিবেশির কথা যারা ভাবে না, তাদের প্রকৃত মুমীন বলা যায় কি? সৃষ্টিকর্তা কিংবা পরলোকে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস থাকলে মানুষ কখনই এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারতো না।
এসব কথা প্রকাশ্যে বলতে হবে, অনেকে মিলে বলতে হবে, কারণ আপনি যে অসুস্থ সেটা যদি আপনি নিজে স্বীকার না করেন, তবে আপনার চিকিৎসা হবে কেমন করে? যেমন ধরুন, ঢাকা হয়তো পৃথিবীর একমাত্র শহর যেখানে লাল আলো জ্বললেও গাড়ি চলে। তেহরানেও প্রায় এক কোটি লোকের বাস, ঠিকইতো সবাই ট্র্যাফিক নিয়ম মেনে সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি চালাচ্ছে, এমনকি গভীর রাতেও। আমরা দুর্নীতিরটাকায় পাজেরো, হ্যামার, মার্সিডিস চালাচ্ছি, কিন্তু দিনে দুপুরে ট্র্যাফিক নিয়ম মানছি না। এগুলো কি সুস্থ, স্বাভাবিক লোকের আচরণ হতে পারে কখনও? দেশে থাকতে এই ভাবনাগুলো মাথায় আসে না, কারণ নর্দমায় আ-নাসিকা ডুবে থাকা ঘোঁতঘোত করা বরাহ-শাবক কি বিষ্ঠার দুর্গন্ধ পায় কখনও? বিদেশের ‘মানবিক’ পরিবেশে গেলে মন নিজে থেকেই তুলনা করতে শুরু করে, নিজের দেশের অসামঞ্জস্যগুলো প্রকট হয়ে ধরা দেয়, অন্ততপক্ষে তাদের কাছে, দুই, তিন নম্বরী করতে করতে মনটা যাদের এখনও মরে ভূত হয়ে যায়নি।
ফরুৎ। ফুরুৎ করেই যেন শেষ হয়ে গেল তেহরানে আমাদের সাড়ে চারটি দিন। ভালো থেকো তোমরা ইরানিরা। ‘ইরানের আত্মশক্তি বার বার নিজের পুনঃসংস্কার করেছে, ইরান জেগে উঠেছে আপনার মুর্ছিত দশা থেকে।’ – লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ পারস্য যাত্রীর পত্রে। আহুর মাজদা, টেংরি, ইন্দ্র কিংবা খোদা যিনিই ইদানিং কালে আকাশের অধিশ্বর হোন, অবরোধের এই কঠিন সময়ে তিনি তোমাদের রক্ষা করুন। তোমাদের শারিরীক, মানসিক, সামাজিক ও চারিত্রিক সৌন্দর্য অটুট থাক। খোদা হাফেজ। রাহমত-আল্লা-এ-বারকাতু।
Lekhar dhoronti atio chomotkar ze last line porzonto pathok zege thakbe–
ভাল লাগল । অন্য একটা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইরানকে দেখতে পেলাম । নিজেদের দীনতা বুঝতে পেলাম
Zithromax
http://buyplaquenilcv.com/ – plaquenil rheumatoid arthritis
http://buyzithromaxinf.com/ – Zithromax
canada can you buy prednisone
http://prednisonebuyon.com/ – what is prednisone for
best price propecia in uk
Cialis
Generic Cialis Lowest Price
Levitra Svizzera
Acheter Kamagra Ligne Suisse
cialis o viagra que es mejor
Propecia Precio Cialis Levitra
Doryx Bacterial Infections Buying Low Price Pharmacy On Line
buy kamagra discrete uk kamagra rx review kamagra alicante
eviffviony This is called staging. order priligy online
Priligy Overnight Ntdoxl plaquenil lupus
Plaquenil Prix Du Levitra 10 Mgf
cialis prices forte ratiopharm is a potassium sparing diuretic
Newton, Iowa 6 2 2018 viagra vs cialis My ovaries hyperstimulated and I had 7 follicles and a large bunch of immature