Scroll Top
19th Ave New York, NY 95822, USA

পথের ক্লান্তি ভুলে…

ঢাকা থেকে ক্যান্টন এবং টরোন্টো হয়ে মন্ট্রিয়ল যাবো। নিকট প্রাচ্য থেকে দূর প্রাচ্য এবং সেখান থেকে বহুদূর প্রতীচ্যে। বিমানবালা এবং আকাশবুয়ার মধ্যে যে পার্থক্য আছে, তা বুঝলাম দুই দুইবার চীনসফর করে। প্রথমবার গিয়েছিলাম ইউনানে চাইনা ইস্টার্ন এয়ারলাইন্সে। সেই বিমানে ছিল কলের পুতুলের মতো সব আকাশবুয়া। মুখে ছিল কৃত্রিম হাসি, আচরণও যন্ত্রবৎ। খাবারের কথা কী বলবো, মুখে দিয়ে মুরগি না মাছ বুঝতে পারছিলাম না কিছুতেই। ভেবেছিলাম, চীনা এয়ারলাইনগুলোতে যাত্রীসেবা বোধহয় এই মাপেরই হয়। ভুল ভাঙলো সাউদার্ন চাইনা এয়ারলাইনে ভ্রমণ করে। খাবার পূর্ববৎ, কিন্তু আকাশবুয়ার জায়গায় এবার পেলাম বিমানবালাদের। সুন্দরী, ভদ্র, ব্যবহারে আন্তরিকতার ছাপ সুস্পষ্ট। সাউদার্নের ছেলে-মেয়েরা নিজেদের কাজটা পছন্দ করে। ইস্টার্নের ছেলেমেয়েদের ভাব দেখে মনে হচ্ছিল, তাদের প্রত্যেকের পাইলট হওয়ার কথা ছিল। তারা যে হতে পারেনি সেটা একান্তই আপনার দোষ এবং আপনাকে যেনতেন ধরনের একটা সার্ভিস দিয়ে তারা আপানাকে শাস্তি দেবেই দেবে।

আকাশ থেকে আলতো করে নেমে সাউদার্নের বিমান ক্যান্টনের এয়ারপোর্টে বুক পেতে দিল। দৈর্ঘ, প্রস্থ, উচ্চতা মিলিয়ে কী বিশাল পরিসরের বিমানবন্দর! ইওরোপ-আমেরিকার বেশির ভাগ বিমানবন্দরগুলো লজ্জায় মুখ ঢাকবে, মধ্যপ্রাচ্য কিংবা আমাদের মতো দেশের কথা আর নাইবা তুললাম। যা কিছু চান, টয়লেট, লাগেজ-বেল্ট, ইমিগ্রেশন, কাস্টমস সব কিছু পাবেন কাছেই, নিজের মাথাটা ঘাড়ের ডান বা বামদিকে ৩০ ডিগ্রি ঘোরাতেই। লাগেজ প্যাক করবেন? চোখের সামনেই মেশিন পাবেন এবং সেই মেশিনের পর্দায় একাধিক রকমের প্যাকিং সিস্টেম এবং দাম লেখা আছে। কখনও কোনো বিমানবন্দরে দেখেছেন, লাউঞ্জে দুই তিন রকমের বিস্কিট, ঠাণ্ডা পানীয়, চা-কফি, ঠাণ্ডা-কুসুম গরম পানির মেশিন রাখা আছে এখানে ওখানে, হাতের কাছেই। যেদিকে তাকাবেন ফুলের সমারোহ, এবং সে ফুল ঢাকা বিমানবন্দরের মতো রূচিহীন প্ল্যাস্টিকের নয়।

৯ই সেপ্টেম্বর ক্যান্টনে যখন বিমান ল্যান্ড করলো সময় তখন সকাল সাতটার কম হবে না। ইমিগ্রেশনে গিয়ে দেখি, কর্মকর্তাদের ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে এস.এল.আর. ক্যামেরায় ক্লোজ-আপ, প্যান, টিল্ট ডাউন করে এক দশাশই লম্বা চীনা যুবক ভিডিও ছবি তুলছে আরেক ছোটখাটো চীনা যুবকের যার হাতে হ্যান্ডকাফ, মুখ সাধারণ চীনাদের চেয়েও নির্বিকার। আশেপাশে বেশ কয়েক জন পুলিশের লোক ছিল, তবে সাদা পোষাকে ছিল বলে এতক্ষণ খেয়াল করিনি। ইমিগ্রেশন পার করে বাইরে বের করা হলো না সন্দেহভাজন কিংবা অপরাধীকে। বিমানবন্দরের ভিতরেই রাখা হলো। না, কোনো ছবির শুটিং হচ্ছিল বলে মনে হয়নি।

পরবর্তী ফ্লাইট বিকাল সাড়ে তিনটায়। পাসপোর্টে আগে থেকেই চীনের ভিসা ছিল বলে ঘন্টা দশেক বিমানবন্দরে বেহুদা গড়াগড়ি খাওয়া থেকে মুক্তি পেলাম। হোটেলে যাবার একটা কাগজ ধরিয়ে দিল হাতে। নির্দিষ্ট কাউন্টারে উপস্থিত হলাম। ছবি দেখিয়ে কয়েকটি হোটেলের মধ্যে যে কোনো একটি বাছাই করতে বলা হলো। সঙ্গে লস এঞ্জেলসগামী এক বাংলাদেশি বয়স্ক দম্পতি ছিলেন। ছিল কিছু নিউজিল্যান্ডের যাত্রী। আমি ‘পাকো’ নামে এক হোটেল বাছাই করলাম, সামনে গাছপালা আছে দেখে। বাকী সবাইও দেশি তাই করলো। হোটেলে পৌঁছে অবশ্য দেখেছিলাম, সব হোটেল একই জায়গায়, সব হোটেলের সামনে একই কাঞ্চন গাছ। পার্থক্য শুধু ছবির এঙ্গেলের। এক চীনা যুবক এগিয়ে এসে বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে গেল। চীনা ছাড়া অন্য কোনো ভাষাই বলতে পারে না সেই যুবক। আমি যা বলি, মোবাইলে রেকর্ড করে অনুবাদ করে বুঝে নোরয়। সে যা বলে, তা মোবাইলে অনুবাদ করে পড়িয়ে নেয়। যন্ত্র দিয়ে যন্ত্রণার অবসান। আমি বাসে ওঠা পর্যন্তই তার দায়িত্ব এবং সে দায়িত্ব পালন করার জন্যে ইংরেজি না জানলেও চলে।

হোটেলে স্নান করে প্রাতঃরাশ খেতে গেলাম। খাবার জায়গাটা ছিমছাম, সহজ, সুন্দর। সেই একই চীনা খাবার, ভাত, ভাতের স্যুপ, সসিজ, বাঁধাকপি সেদ্ধ, চিকন করে কাটা আলুভাজা, মিষ্টি (সুস্বাদু) আলু সেদ্ধ, তরমুজ, কেক ইত্যাদি। ছোট, সফরি হোটেল বলে আইটেম সংখ্যায় কম। দেয়ালে ভ্যানগখের আদলে আঁকা একটি তৈলচিত্রের অনুলিপি, অথবা হয়তো ভ্যানগখেরই। এর আগে ক্যান্টনে ছিলাম সপ্তাহ খানেক, ছিলাম ইউনানেও। সেখানেও দেখেছি, পাশ্চাত্য আর্টের প্রতি চীনাদের একটা আকর্ষণ রয়েছে, এমনকি সাধারণ জনগণেরও।

পদ্মপাতায় মোড়া একটি ভাতের দলা ছিল। খেতে ভালোই লাগলো। এই আইটেমটি আগে দেখিনি, তবে শটিপাতায় মোড়া একই রকম ভাতের দলা খেয়েছি বটে বাংলাদেশে চীনা বন্ধুদের সৌজন্যে। সেই কোন অতীতে এক রাজা সন্দেহবশতঃ তার রাজভক্ত মন্ত্রীকে জলে ডুবিয়ে হত্যা করিয়েছিলেন। মন্ত্রীভক্ত জনগণ পাতায় মোড়া অন্নপিণ্ড নদীতে ফেলেছিল যাতে এই খাবার খেয়ে মাছেদের পেট ভরে যায় এবং তারা মন্ত্রীর মৃতদেহটিকে রেহাই দেয়। ভাতের দলার এই সংস্কৃতি জাপানেও দেখেছি। যে কোনো জিনিষ ‘জাপানেও দেখেছি বললে’ আমাদের চীনা বন্ধুরা রাগ করে। ‘আরে চীন থেকেই জাপানে গিয়েছে!’ কথা সত্য। জাপানে এই ভাতের দলার নাম ‘ওনিগিরি’। ‘ও’ মানে মহান আর ‘নিগিরি’ মানে অন্নপিণ্ড। ‘ওনিগিরি’ শব্দের সম্পূর্ণ অর্থ ‘মহান অন্নপি-’। ওনিগিরির চীনা নাম কী জানা হয়নি এখনও।

প্রাতরাশ খেতে খেতে আলাপ হচ্ছিল লস এঞ্জেলসগামী দম্পতির সঙ্গে। ‘উৎসবের ঠিক আগেই কেন দেশ ছাড়লেন?’- এই প্রশ্নের জবাবে কর্তা জবাব দিলেন ‘ছেলে-মেয়ে দুজনেই এল.এ.-তে থাকে। এরাইতো সবচেয়ে আপনজন। সুতরাং উৎসবে ছেলেমেয়ের সঙ্গেই থাকতে চাই।’ কর্ত্রী তুলনামূলক চুপচাপ, কারণ কর্তাটি বেশ কড়া, যদিও বৌয়ের ব্যাগট্যাগ টানতে দেখেছি বিমানবন্দরে। চীনের সঙ্গে কর্তার পরিচয় দীর্ঘদিনের। ৭৫-৭৬ সালেও চীনে এসেছেন কোনো প্রশিক্ষণে। ‘এরাতো বাংলাদেশকে স্বীকৃতিই দেয়নি মাওয়ের মৃত্যু পর্যন্ত। জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভেরও বিরোধিতা করেছিল চীন। অথচ এরাই এখন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথম ক্ষমতায় এসে প্রথম যে দেশটি সফরে যান, সেটি ছিল চীন!’ আমি বললাম, ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামি লীগের গায়ে এতটাই ভারত-ভারত গন্ধ যে দেখানোর জন্য হলেও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে সে বাধ্য। তাছাড়া, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষার জন্যেও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক রাখা দরকার। অন্তত এদিক থেকে শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত সঠিক।’

প্রাতরাশ সেরে বাইরে বের হয়ে এলাম। পাকো হোটেলের পাশের চীনা রেস্টুরেন্টের মালকিন সাদরে আহ্বান করলো মধ্যাহ্নভোজনে। কিন্তু পেট ভরা বলে তার সাদর আহ্বানে সাড়া দিতে পারলাম না। চীনা তরুণী তার প্রায় দুধের বাচ্চাকে মপেডে দাঁড় করিয়ে মপেড স্ট্যার্ট দিচ্ছে। বছর নব্বই বছরের এক বুড়ি রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে। মাথার উপরে পত পত করে উড়ছে পাঁচ হলুদ তারকাখচিত লাল চীনা পতাকা। সাফাইকর্মী নিজের কাজে ব্যস্ত। সাফাই ব্যবস্থা ঢাকার মানেরই মনে হলো, যদিও ক্যান্টনের পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে ঢাকার তুলনা পাগলেও করবে না। আমরা আগ বাড়িয়ে উন্নত দেশ হবার ঘোষণা দিয়ে ফেলেছি, কিন্তু এখনও রাজধানীর বর্জ্য-ব্যবস্থাপনাটাই ঠিকঠাকমতো করে উঠতে পারিনি।

আবহাওয়া বাড়াবাড়ি রকম গরমই বলতে হবে, ঢাকার কাছাকাছি। চোখ ধাঁধানো কড়া রোদে চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে দেখলাম, রাস্তাঘাট নির্মিত হচ্ছে, ফুটপাথ সারাই হচ্ছে। উন্নয়নের ধুম লেগেছে ক্যান্টনে, চীনের অন্য সব শহরের মতোই। সুপরিসর ফুটপাথের দুই পাশে গুল্ম ও গাছের সারি। এখানে ওখানে বেলিফুল থেকে সুগন্ধ এসে নাকে লাগছে। ফ্লাইওভারগুলোর দুই পাশ বাগানবিলাসের ম্যাজেন্টা-রঙে রাঙানো, নিচটা লতায়-গাছে সবুজ। সাদা আর ম্যাজেন্টা কাঞ্চনে বর্ণিল হয়ে আছে রাস্তার দুই পাশ। ফ্লাইওভারের নিচে বাগান, পাশে বাগান। অতি সাধারণ সব প্রাকৃতিক গাছ। এমন হাজারো গাছে ভরা আমাদের দেশ। তবুও আমাদের বিমানবন্দর সড়কে লাগানো হয়েছে চীন থেকে আমদানি করা বনসাই। আমাদের ফ্লাইওভারগুলো ভাগ্য ভালো হলে ন্যাড়া, খারাপ হলে নোংরা পোস্টারে মোড়া। ‘হায়! মোগো কবে এড্ডু রুsi অইবে!’ তপন রায় চৌধুরীর স্মৃতিকথা পড়ছিলাম ফ্লাইটে। তাই কথায়-উচ্চারণে এই বরিশাইল্যা টান।

ঘুম ভাঙলো রিসেপনিস্টের ফোনে। ‘দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি, বেলা দ্বিপ্রহর’ বা তার চেয়ে ঘণ্টা খানেক বেশি। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিমানবন্দরে নিয়ে যাবার নিজস্ব বাস আছে হোটেলের। বাসে আমি একাই যাত্রী। সিকিউরিটি-ইমিগ্রেশন শেষ করে বসে আছি টরন্টোর বিমানের অপেক্ষায়। ক্যান্টন বিমানবন্দর আগেও দেখেছি, সুযোগ-সুবিধা, পরিসরের বিচারে বিশ্বের বড় বড় বিমানবন্দরগুলোকে লজ্জা দিতে পারে। যত সুবিধা আপনার দরকার, এই যেমন ধরুন টয়লেট, খাবার জায়গা, উপহার কেনার দোকান, সব ঘাড় ঘোরালেই দেখতে পাবেন। কত রকমের চেয়ার যে রেখেছে বসার জন্যে। কিছু চেয়ারে স্বয়ংক্রিয় ম্যাসাজও পাবেন। সব জায়গায় অর্কিড, গুল্ম –  প্ল্যাস্টিক নয়, আসল। গরম, কুসুম গরম, ঠাণ্ডা পানির মেশিন আছে এখানে-ওখানে। আছে বাচ্চাদের খেলার জায়গা। ট্র্যানজিট এলাকায় বিস্কিট-কুকিজও রাখা থাকে। পৃথিবীর কোন বিমানবন্দরে পাবেন আপনি এমন জামাই-আদর? ব্যবহারও ভালো চীনাদের। মাথা একদম ঠাণ্ডা। প্রতিটি টয়লেট খটখটে শুকনো, পরিষ্কার, যেমনটা ইস্তাম্বুল বা আরবদেশেও দেখা যায় না। মোগো দেশের কথা বলা বাহুল্য। এর কারণ প্রতি টয়লেটের জন্যে আছে কমপক্ষে একজন করে সাফাই কর্মী যে কোথাও নোংরা হওয়ামাত্র সাফ করে দিচ্ছে। মেঝে ভেজা এই তথ্যটা সিলিং থেকে মেঝেতে ছায়াচিত্র ফেলে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ সব প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার দেখা যাবে ক্যান্টন বিমানবন্দরে।

বিমান ছাড়ার কথা ছিল আড়াইটায়। দুইটার দিকে জানানো হলো উড়াল দিতে ঘণ্টাখানেক দেরি হবে। ঘণ্টাখানেক পরে আরও ঘণ্টাখানেক, এভাবে প্রায় তিন ঘণ্টা কেটে গেলো। মানিব্যাগে চীনামুদ্রা ইউয়ান বা আরএমবি ছিল কয়েক শ। বিরক্তি কাটাতে খাবার দোকানে গিয়ে হাঁসের মাংস, শব্জী, স্যুপ আর ভাতের অর্ডার দিলাম, সাথে তরমুজের রস। খাওয়া শেষ হবার পর অপেক্ষার দীর্ঘ সময় কাটতে চায় না। তাকিয়ে ছিলাম টিভির দিকে। চৌকশ সেনাবাহিনী, স্যালুট করা সৈন্য, শিশু, বৃদ্ধ, নার্স, বিজ্ঞানী। রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত কতো উন্নত, কত ভালো আছে এখন চীনারা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো হচ্ছে দর্শককে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে, সংখ্যাগরিষ্ট হান এবং বিভিন্ন উপজাতির। দেখে বাপের কাঁধে বসা চীনা শিশু তারকখচিত লাল পতাকা দোলাচ্ছে। নিজে থেকেই দোলাচ্ছে কিংবা বাপই হাত ধরে দুলিয়ে দিচ্ছে, নাকি পাছায় চিমটি খেয়ে দোলাতে বাধ্য হচ্ছে সার্কাসের প্রশিক্ষিত পশুর মতো, সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। উন্নয়ন অবশ্যই হচ্ছে এবং সরকারি প্রপাগান্ডাও সমানে চলছে। বাংলাদেশ সরকার চীনাদের কাছ থেকে শিখতে পারে, কীভাবে উন্নয়ন প্রপাগান্ডা চালাতে হয়।

প্রথমে বলা হয়েছিল টায়ার পাংচার। পরে জানা গেল, টায়ার নয়, আকাশ পাংচার – চীনে সাইক্লোন চলছে। পরের দিন আমরা জানবো, প্রায় পঞ্চাশ জন লোক মারা গেছে চীনে, যদিও এ মুহূর্তে ক্যান্টনের আকাশ পরিষ্কার। এক সর্দারজি বল্লেন: ‘বলছেতো টায়ার, আসলে কী সমস্যা কে জানে। পনেরো ঘণ্টার ভ্রমণ, সোজা কথা নয়। বোয়িং কোম্পানীর সঙ্গে যোগাযোগ করার দরকার ছিল, করেছে কিনা কে বলবে।’ মাঝে প্রত্যেক যাত্রীকে চাইনা সাউদার্নের কাউন্টারে ডেকে নিয়ে এক বোতল করে পানি এবং একটা বিস্কিটের প্যাকেট ধরিয়ে দেওয়া হলো হাতে। সান্তনা পুরষ্কার।

‘টরন্টোতেই থাকেন বুঝি?’ জিগ্যেস করলাম আমি। ‘না টরন্টো যাচ্ছি, কিন্তু ফিলহাল আমি চন্ডীগড়ের বাসিন্দা।’ ‘কেমন চলছে মোদি সাহেব কা ভারত?’ ‘তং আ গিয়া, ভাইসাব। কংগ্রেস, বিজেপি কেউ কিছু করছে না, করার ইচ্ছাও কারও নেই। কিছু করা যে সম্ভব সেই বিশ্বাসও নেই নেতাদের। তেনারা (উভয়ার্থে) সব নিজের আখের গোছাচ্ছেন। মধ্যবিত্তের অবস্থা খারাপ হচ্ছে দিনকে দিন। কৃষকেরাতো হতাশ হয়ে গলায় দড়িই দিচ্ছে। আমার ভায়রার কারখানা, ব্যবসা সব ছিল পাঞ্জাবে। সব কিছু বিক্রি করে তিনি আমেরিকা চলে গেছেন কযেক বছর আগে। ওঁর ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ব্যাংকঋণ নিয়েছে সে। ডিগ্রি পাবার পর চাকরি করে ছেলে এই ঋণ পরিশোধ করবে। ছেলের লেখাপড়ার জন্যে আমার ভায়রাকে পকেট থেকে একটি ডলারও বের করতে হয়নি। এবং, ভাবুন একবার, এখনও ওরা কিন্তু আমেরিকান নাগরিকও হয়নি। ঔর ইন্ডিয়ামে? কখনও ব্যাংকলোন নিতে গেলে বুঝবেন, কত গেঁহুতে কত আটা! স্যার, সরকারকে বিশ টাকা ট্যাক্স দিলে অন্তত দশ টাকার সুযোগ-সুবিধাতো আমি ফেরৎ পাবো! আমাকে সরকার যা ফেরৎ দিচ্ছে তার দাম দুই টাকাও নয়। কোন দুঃখে লোকে থাকতে যাবে ইন্ডিয়াতে। যার সাধ্য আছে, সেই চলে যাচ্ছে। আমিও থাকবো না। এখানে, এই চীনে দেখুনতো, রাস্তাঘাট-সুযোগ-সুবিধা দিনকে দিন বাড়ছেই। ‘কিন্তু কথা যে বলা যায় না চীনে!’ মৃদু অনুযোগ করলাম আমি। ‘সব কি পাবেন কোথাও? ইন্ডিয়াতে কথা বলতে পারবেন, কিন্তু পাবেন না কিছুই। আপনার কথা শুনছে কে? চীনে কথা বলতে পারবেন না, কিন্তু লোকে কথাতো বলে কিছু পাবার জন্যে। আগে থেকেই যদি যা যা দরকার সব কিছু পেয়ে যায়, তবে কথা বলার দরকারটা কী?’

ক্যান্টনে ঘণ্টা ছয়েক দেরির কারণে টরন্টো-মন্ট্রিয়ল শেষ ফ্লাইটটিও ধরা গেল না। বিমানের দরজাতেই দাঁড়িয়েছিল চাইনা সাউদার্নের প্রতিনিধি কাগজের উপর বড় বড় অক্ষরে আমার নাম লিখে, পরদিন সকালের ফ্লাইট আর হোটেল শেরাটনের রিজার্ভেশনের কাগজ নিয়ে। শেরাটনের রুমে মালপত্র রেখে নিচে রেস্টুরেন্টে এসে দেখি, আর মিনিট পনেরো দেরি করে আসলেই রাতে উপোষ করতে হতো, কারণ রাত সাড়ে বারোটায় পর আর অর্ডার নেয়া হয় না। সব খাবার নেই, যেসব ডিসের পাশে অর্ধচন্দ্র চিহ্ন আছে, শুধু সেগুলোরই অর্ডার দেওয়া যাবে। একটা বিয়ার আর পিৎজার অর্ডার দিলাম। মেশিনের বিয়ার দিয়ে গেল ওয়েটার, সাথে বাদাম ইত্যাদির অনুপান। পানিপথে পাশ্চাত্যের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হলো দীর্ঘ এক বছর পর। অনেক রাত হওয়া সত্ত্বেও স্বাদু ছিল পিৎজাটা (শেরাটনের শেফ বলে কথা!), কিন্তু এত বড় ছিল যে একজনের পক্ষে খাওয়া মুশকিল।

খেতে খেতে ভাবছিলাম, পাশ্চাত্যের এই জলজ-কঠিন সুখটুকুর স্বপ্নই কি দেখেছিল এই লোক দূর-শৈশবে, চট্টগ্রামের এক গ-গ্রাম কুমিরায়? এই সুখটুকুর জন্যেই কি সারা জীবন ওর এত দৌঁড়ঝাপ, এত তিড়িংবিড়িং? স্বর্গে বিশ্বাস করার মতো শিশুতোষ নয় সে, কিন্তু স্বর্গে এটুকু সুখ থাকলেও ওর চলবে, এক গ্লাস বিয়ার, সাথে একটু অনুপান এবং একটা স্বাদু পিৎজা। মরার আগে স্বদেশে পাওয়া গেলে স্বর্গে না গেলেও দুঃখ নেই। তাছাড়া যে মালগুলো ওখানে নিশ্চিত যাবে বলে দাবি করে, তাদের সঙ্গ পৃথিবীতেই আমার অসহ্য লাগে, অনন্ত স্বর্গে গিয়ে ওদেরই সঙ্গে থাকতে হলেতো ‘ওরে বাপরে!’ বলে আবার মরে যেতে ইচ্ছে করবে।

ঘুমাতে ঘুমাতে রাত তিনটা। সকাল পাঁচটায় এলার্ম দিয়েছিলাম আইফোনে। বাথটাব উপচে পানি গড়িয়ে আসছিল আমার বিছানার দিকে। ম্যানেজারকে ডাকলাম, তিনি আসলেন এবং ব্যবস্থা নিলেন। এত সব কিছু করতে গিয়ে ফ্লাইট মিস করলাম এবং নিজেকে বললাম, অসুবিধা নেই, পরের ফ্লাইটে যাবো। এমন সময় ঘুম ভেঙে গেল। কিছুক্ষণ বুঝতে পারছিলাম না, কোনটা স্বপ্ন আর কোনটা সত্যি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সকাল সাড়ে পাঁচটা। ক্লান্ত মস্তিষ্ক আমাকে দিয়ে এলার্ম বন্ধ করিয়েছিল এবং আধ ঘণ্টা পরে নিজেই সময়মতো জাগিয়ে দিয়েছে। চীনা দার্শনিক লাও ৎসের (লাওশি) কথা মনে পড়লো। লাও ৎসে একদিন ঘুম থেকে উঠে কাঁদতে শুরু করেছেন। শিষ্যেরা কান্নার কারণ জিগ্যেস করাতে লাও ৎসে জানালেন: ‘স্বপ্নে দেখলাম, আমি প্রজাপতি হয়ে ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াচ্ছি।’ ‘সুন্দর স্বপ্নতো, কান্নার কী আছে!’ সান্তনা দিল শিষ্যেরা। ‘কাঁদছি, কারণ আমি যে এখন তোমাদের সঙ্গে কথা বলছি – এই ঘটনাটা যে সেই প্রজাপতিটার স্বপ্ন নয়, সেই নিশ্চয়তা কে দেবে?’

সিকিউরিটি চেকের দিকে এগোচ্ছি, এমন সময় এক লম্বাচওড়া, ভ্যাবলা চেহারার, মোটু অফিসার এসে স্যালুট করে বললো: ‘স্যার! আপনার ব্যাগের ল্যাপটপটা একটু চেক করবো।’ দৈবচয়ন বা র‍্যানডম সিলেকশন করে যাত্রীদের চেক করছে সে। কাঠির আগায় লাগানো তুলায় কী এক তরল লাগিয়ে সেটা আমার ল্যাপটপের উপর বুলিয়ে দিয়ে কী পরীক্ষা করলো সেই জানে। এতে অবশ্য আমার একটু সুবিধা হলো, আমাকে আর লম্বা লাইন ধরতে হলো না। অফিসার মহোদয় আরও কয়েকজনকে দৈবচয়ন করলেন এবং দৈবক্রমে তারা সবাই দক্ষিণ এশীয়, আমার মতোই, কিংবা নিদেনপক্ষে আফ্রিকান বংশোদ্ভূত।

আমার মতোই দৈবচয়িত এক ভারতীয় গৃহবধূকে বললাম: ‘ও আসলে দৈবচয়ন নয়, বর্ণচয়ন করছে!’ ‘আমারও তাই মনে হয়, তবে দ্যাটস ফাইন!’ গৃহবধূ উত্তর দিলেন। যারা কুকুর, বিড়াল ইত্যাদি গৃহপালিত পশু নিয়ে ভ্রমণ করছে, তারাও আমাদের দৈবচয়িতদের লাইন দিয়েই পার হচ্ছে। এক সময় ঢাকা ক্লাবের মতো বনেদি ক্লাবগুলোর প্রবেশপথে লেখা থাকতো: ‘ডগস এ্যান্ড ইন্ডিয়ানস আর নট এ্যালাউড!’ পাশে থাকতো একটা তলায় কাঁটা-লাগানো জুতার ছবি। ‘কালার্ড ওয়ানস আর র‌্যান্ডমলি চুজেন এ্যালং উইথ দি অ্যানিমালস!’ – এখানে লেখা থাকতে পারতো। বর্ণবাদকে মানুষের অবচেতন থেকে বাদ দেওয়া যে বর্ণাশ্রম বাতিল করার মতোই কঠিন কাজ, সেটা আবারও হৃদয়ঙ্গম করলাম। সিকিউরিটি চেকের পর খুব খেয়াল করে জিনিষপত্র সব ব্যাগে-পকেটে ভরলাম, কোমড়ে বেল্ট এবং পায়ে জুতা পরলাম। কিন্তু একটা দামী আর অপরিহার্য জিনিষ যে ফেলে গেলাম, সেটা জানবো আরও মিনিট ত্রিশেক পর।

ইমিগ্রেশন আর সিকিউরিটি পার হয়ে মন্ট্রিয়লের ফ্লাইট ধরতে যাচ্ছি। ডান দিকে চোখে পড়লো কফিহাউজ ‘টিম হর্টন’- মন্ট্রিয়লের অন্যতম প্রতীক। একটা মাফিন আর স্মল কফির অর্ডার দিলাম, ডবল ডবল, অর্থাৎ দুটি চিনি, দুটি দুধ সহযোগে আমেরিকান কফি। মন্ট্রিয়লের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হলো, এবারও পানিপথে, যদিও ভিন্ন ধরণের পানি। মাইকে ফ্লাইট সংক্রান্ত ঘোষণা হচ্ছিল ফরাসিতে। ধাত্রীভাষা শুনে অনির্বচনীয় আনন্দ হচ্ছিল মনে, যেমনটা হয় আমার মাতৃভাষা চট্টগ্রামি শুনলে। প্রমিত বাংলা শুনে কেন জানি মনপবনের নাও অতটা দুলে উঠে না।

বাইরে অপেক্ষমান বিমানটির দিকে তাকিয়ে বসেছিলাম। কফি ও মাফিন খাওয়া শেষ। ভাবলাম, বসেইতো আছি, দুই লাইন ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’ লিখলে লেখাটা একটু এগোবে। ব্যাগ খুলে দেখি, ল্যাপটপটই নেই। কোথায় ফেলে আসতে পারি? সিকিউরিটি চেক ছাড়া আর কোথায় হবে! সেকি এখানে? খান দশেক সিঁড়ি, এক্সেলেটর মিলিয়ে প্রায় মাইলখানেকের রাস্তা। একজনকে জিগ্যেস করলাম, কীভাবে তাড়াতাড়ি যাওয়া যায় সিকিউরিটি চেকপোস্টে। ‘তুমি কেন ওখানে মরতে যাবে? তুমি এখানে মানে তোমারতো সিকিউরিটি চেক হয়ে গেছে!’ কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো মনে হলো উত্তরটা। কিন্তু মাথা গরম করারও সময় নেই। ভাবলাম, যত দ্রুতই যাই, যেতে আসতে প্রায় ত্রিশ মিনিটের ধাক্কা, ফ্লাইট মিস করবো নির্ঘাৎ। পিঠে-হাতে তিন তিনটা ব্যাগ নিয়ে ছাপান্ন বছর বয়সের আধপাকা শরীর নিয়ে ভোঁ দৌঁড় দিলাম এবং চড়াই-উৎরাই পার হয়ে অবশেষে এক সময় সিকিউরিটি চেকপোস্টেও পৌঁছালাম। ‘আপনার ল্যাপটপের ব্র্যান্ড কী?’ সিকিউরিটি ম্যানেজারের প্রশ্নের জবাবে বললাম: ‘চাইনা সাউদার্ন!’ সবাই হেসে ফেললো। ক্লান্ত মাথা তখন আর কাজ করছিল না। এই ল্যাপটপটি এ পর্যন্ত তিনবার তিন এয়ারপোর্টে হারিয়েছি এবং যথারীতি আবার খুঁজেও পেয়েছি। বোঝা গেল, এই অঙ্কশায়িনী (ল্যাপটপের বাংলা) আমাকে ছেড়ে যাবে না।

আরও ঘণ্টাখানেকের উড়াল এবং অবশেষে বিহগদৃষ্টিতে গেরুয়া রঙের টালি লাগানো হাজার হাজার বাড়ির দৃষ্টিসুখকর দৃশ্য দেখতে দেখতে মন্ট্রিয়ল-ভূমিতে অবতরণ। আরও আধ ঘণ্টাটাক পরে প্রায় এক যুগ ধরে মন্ট্রিয়লে পার্ক এক্সটেনশন এলাকায় ‘যাচ্ছেতাই’ (সদর্থক) কিন্তু অনন্য সুন্দরভাবে সাজিয়ে তোলা এ্যাপার্টমেন্টে স্বজন-স্বাক্ষাৎ এবং ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’ ভ্রমণ-দর্শনের আপাত পরিসমাপ্তি।

Comments (104)

Amoxicillin Makes Me Feel Crazy

is cialis eligible under manulife insurance

http://buyplaquenilcv.com/ – hydroxychloroquine 200 mg price

https://buyplaquenilcv.com/ – hydroxychloroquine tablets for sale

http://buyneurontine.com/ – doses of gabapentin for anxiety

http://prednisonebuyon.com/ – prednisone without a prescription

http://prednisonebuyon.com/ – buy prednisone from india

Buy Viagra No Perscription

Buy Propecia Finasteride 1mg

Online Pharmacy Doxycycline 100mg

Order Without A Prescription buy cialis online india

Amoxil Dosage For Children

Where To Order Real Isotretinoin Drugs On Line

Giardiasis Treatment With Amoxicillin

el viagra en las mujeres worldwide pharmacy kamagra Viagra Samples From The Us

Levitra Stomaco Pieno O Vuoto kamagra oral jelly cvs Viagra Generico Farmacia Andorra

kamagra for sale in us kamagra generica kamagra delivered overnight

genericos de kamagra eroxim kamagra kamagra accion terapeutica

After solving the problem, he stepped forward to straighten the teacup, the young seedling still looked like he was bio hard pills to die, Margarete Motsinger turned his is there an otc Cialis Michaud Come with me, I ll take you to a place I said you It s my ancestor, don t 800 mg black Cialis this cialis 20mg price

4 billion deal with CPMIEC but that itsdecision is not yet final buy cialis canada pharmacy

propecia sell It is broken down in exactly the same way as tamoxifen, and, is relatively harmless in comparison with the powerful anti cancer drug

51 patients were randomly assigned to 150 mg bicalutamide per day, 50 patients to 150 mg bicalutamide per day and to 10 mg tamoxifen per day for 24 weeks, and 50 patients to 150 mg bicalutamide per day and radiotherapy one 12 Gy fraction on the day of starting bicalutamide cheap cialis

over the counter viagra These include indirect arterial blood pressure BP measurement, the electrocardiogram ECG, thoracic radiography, clinical laboratory tests, and echocardiography with Doppler studies

The failure of adrenal glands is most commonly the result of autoimmune disease levitra o viagra o cialis Studies that compared any intervention for fibrosis to another intervention, placebo, or no intervention were included

Leave a comment