Scroll Top
19th Ave New York, NY 95822, USA

চম্পকনগরের উপকথা

asdfasdfasdfasdf

সত্যযুগেরও বহু যুগ আগে দেবতা, দানব আর মানবেরা নাকি একবার ব্রহ্মার কাছে এসেছিলেন উপদেশ নিতে। আকাশের ঘনকৃষ্ণ ব্ল্যাকবোর্ডে বিদ্যুতের চক দিয়ে ব্রহ্মা একটি মাত্র অক্ষরে লিখে দিয়েছিলেন তাঁর উপদেশ: ‘দ’। ‘দয়া’, ‘দমন’ ও ‘দান’ শব্দের আদ্যাক্ষর। দেবতারা করবে দয়া, দানবেরা করবে দমন আর মানুষেরা করবে দান। ব্রহ্মার উপদেশে কর্ণপাত না করা অহঙ্কারী ক্ষমতাধর মানুষ আর আধিপত্যকামী দেবতার সঙ্ঘাত বাংলা সাহিত্যের অন্যতম মঙ্গলকাব্য পদ্মাপুরাণের উপজীব্য।

বিজয়গুপ্ত, রায় বিনোদ বা বাইশ কবি রচিত পদ্মপুরাণের কাহিনির ভিত্তিতে রচিত এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার ও পারফরম্যান্স স্ট্যাডিজ বিভাগ প্রযোজিত নাটক ‘চম্পক নগরের উপকথা’র মঞ্চায়ন বর্তমান আলোচনার বিষয়বস্তু। নাটকে অভিনয় করেছে বিভাগের ২য় বর্ষের চতুর্থ সেমিস্টারের শিক্ষার্থীবৃন্দ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্চ নাটম-লে ১৪২২ নববর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে ৩১শে চৈত্র থেকে ৩রা বৈশাখ, দেড় ঘন্টার এই নাটকের চারটি প্রদর্শনী হয়েছে।

q

বৃত্তাকৃতির একটি এ্যাপল-বক্সকে চারভাগ করে প্রতিটি ত্রিকোণ কোয়ার্টারকে একটি বেদীর মতো চার পাশে রেখে মঞ্চের সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। ত্রিকোণ বেদীগুলোকে যুক্ত করেছে পদ্মফুল ও পদ্মপাতার ছবিযুক্ত আলপনা। মঞ্চের ঠিক মাঝখানে একটি পদ্মফুলের হস্তাঙ্কিত চিত্র এবং চার পাশে পদ্মপাতা বসিয়ে একটি ম-ল রচিত হয়েছে। মঞ্চের দুই পাশে দুই সারিতে বসে আছেন কুশিলবগণ। তাদের পোশাকে, বিশেষত মেয়েদের শাড়ির আঁচলেও আলপনার সেই একই মোটিফ। রঘুনাথ চক্রবর্তীর পটঅঙ্কন সরল ও সুন্দর।

অভিনেতারা গায়ক ও বাদকও বটেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে ঢোল, পাখোয়াজ, খমক, নাকাড়া, করতাল, দোতারা, হার্মোনিয়ম, মন্দিরা, বাঁশি, জিপসি, চিক ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাজালেন তাঁরা মিনিট দশেক ধরে। দোতারা, বাঁশি, মৃদঙ্গ, হার্মোনিয়ম সব যন্ত্রই সমান মুন্সিয়ানার সাথে বাজাতে সক্ষম গায়েন তথা সূত্রধার জুম্মন সাদিক। এর পর অভিনেতারা মিনিট পাঁচেক ধরে দেবী সরস্বতী, পীর মুরশিদ, নবী-রসুল, গুরু-আদি মান্য ব্যক্তিসহ চতুর্দিকের দেবতা-দিকপালদের প্রতি সম্মান জানিয়ে মঞ্চের এদিক থেকে ওদিকে ছুটে গিয়ে বিপ্রতীপ অবস্থানে রাখা চতুর্বেদীর উপর দাঁড়িয়ে বন্দনাগীত গাইলেন। বন্দনাগীত রচিত হয়েছে বিভাগেরই একটি সাবেক প্রযোজনা বেহুলার ভাসানের বন্দনাগীত অবলম্বনে।

বন্দনা ও মঙ্গলগীত শেষ হওয়ার পর জুম্মান সাদিক শুরু করলেন দেবি পদ্মাবতী বা মনসার কাহিনি। বনমধ্যে ময়ূরের কামকেলি দর্শনে কামগ্রস্ত শিবের বীর্য স্খলিত হয় পদ্মপত্রে এবং পদ্মের নাল বেয়ে তা পৌঁছে যায় পাতালে সর্পরাজ বাসুকীর কাছে। বাসুকী সেই বীর্য গর্ভে ধারণ করে জন্ম দেন দেবী পদ্মাবতীর। অনার্য গর্ভে জন্ম নেয়া পদ্মাবতীকে দেবী বলে স্বীকার করতে চাননি দেবতারা। দেবতা হতে হলে ভক্ত থাকতে হবে, ঠিক যেমন নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে থাকতে হবে সমর্থক-চেলাচামু-া। কীভাবে দেবীর স্বীকৃতি পেতে পারে মনসা? মঞ্চের চারটি বেদির একটিতে আলোক-সম্পাত হলো দ-ায়মান শিবের উপর। হাতে ডম্বরু-বাঁধা ত্রিশূল, গলায় সাপের মাফলার জড়ানো শিবরূপী সানোয়ারুল হক সনি মনসাকে বললেন, ‘আমার ভক্ত চম্পক নগরের চাঁদ সওদাগর যদি তোমার পূজা করে তবেই তোমাকে দেবী বলে মেনে নেওয়া হবে!’

চাঁদপত্নী সনকা আর ছয় পুত্রবধূ উঠে আসে মঞ্চে। সনকার হাতে মনসাপূজার অলঙ্কৃত ঘট, যে ঘট গ্রামবাংলায় আজও ব্যবহৃত হয় মনসাপূজায়। উলুধ্বনি, গীত-বাদ্যসহকারে পূজা চলছে, এমন সময় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো হেমতালের বাঁকানো লাঠি হাতে ছুটে এলো ক্রোধান্ধ চাঁদ সওদাগর। বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা! লাঠির বাড়ি মেরে মনসার ঘট ভেঙে দিল চাঁদ। রাজ্যে নিষিদ্ধ হলো মনসার পূজা। চাঁদের ক্ষমতা আর ঔদ্ধত্যের কাছে অসহায় সনকা, ছয় পুত্রবধূ আর চম্পকনগরের জনগণ। হাত তুলে মনসার সম্ভাব্য অভিশাপ বুঝি ঠেকাতে চান সনকা-রূপীনি সুরাইয়া খাতুন। চোখে-মুখে আতঙ্ক। চার পাশে ভয়ে মুখ গুঁজে পড়ে আছে ছয় পুত্রবধূ: উম্মে হানী, শুভ্রা গোস্বামী, তানিয়া আক্তার, ফারজানা হাবিব, ইসরাত জাহান মৌটুসী, আর নিপা সরকার।

w

দেবী মনসা তাঁর নাগ মাস্তানদের ডেকে এনে ধ্বংস করে দিলো চাঁদের বাগানবাড়ি। কিন্তু অচিরেই শিবের দেয়া জীয়নমন্ত্র আর শঙ্কু গাড়ুরির সহায়তায় নিজের বাগানবাড়ি পুনরুজ্জীবিত করলো চাঁদ। সখী নেতার পরামর্শে শঙ্কু গাড়–রিকে খুন করালো মনসা। সুন্দরী মালিনীর বেশ ধারণ করে চাঁদের কাছে এসে তার কামপ্রবৃত্তি জাগ্রত করে মনসা হরণ করে নিল জীয়নমন্ত্র। নাটকের এই অংশে অনবদ্য অভিনয় করেছেন মনসার ভূমিকায় উম্মে সুমাইয়া আর চাঁদের ভূমিকায় শঙ্কর কুমার বিশ্বাস ও তন্ময় পাল। চমৎকার শৃঙ্গাররস। শঙ্কর বিশ্বাসের ঝাঁকরা চুল ধরে টান দিয়ে মাটিতে ফেলে উম্মে সুমাইয়া যখন তার বক্ষে পা দিয়ে দাঁড়ায় তখন তাকে মহিষাসুরমর্দিনী দূর্গামূর্তির মতো মনে হয়। অদ্ভুত বীররস। পরক্ষণেই দুই উরুর মাঝখানের কাপড় সামলাতে সামলাতে এসে সূত্রধার জুম্মান সাদিক যখন কামপীড়িত চাঁদের বোকামির কথা বলে আফসোস করে তখন হাস্যরস ও করুণ রস পরস্পরের সাথে মিশে যায়।

বাগানবাড়ি আবার ধ্বংস হলো মনসার হাতে। সনকা একদিন পুত্রদের মুখে তুলে দিচ্ছিল দইমাখা পান্তাভাত। দর্শক বাৎসল্যরসে আপ্লুত হতে না হতেই সেই ভাতে বিষ মিশিয়ে দিয়ে সনকার নিজের হাতে তার ছয় পুত্রকে খুন করালো মনসা। সাখাওয়াত ফাহাদ, রাফি হাসান রহমান, রনি দাস, মাহবুব আলম সরকার, আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখ ‘কী খাওয়ালি মা!’ বলে মরণচিৎকার দিয়ে উঠলে করুণ রসের অবতারণা হয়। অনতিবিলম্বে সদ্যবিধবা বধূরা মঞ্চে ছুটে এসে বিলাপে আকুল হয়। আলোক-সম্পাত হয় চারটি বেদির একটিতে দণ্ডায়মান চাঁদের উপর। শিবের বরে ছয় ছয়টি পুত্র লাভের কথা বলে প্রথমে করুণ হাসে চাঁদ, কিন্তু পরক্ষণেই পুত্রশোকে কেঁদে আকুল হয়ে মনসাকে গালাগালি করে। ‘কে মোর মুখাগ্নি করিবে!’ বলে হাহাকার করে চাঁদ। পুত্রদের সাদা উত্তরীয়কে মৃতদেহের প্রতীকে পরিণত করে শ্মশানযাত্রীরা যখন হরিধ্বনি দিতে দিতে কাঁধে করে বিষের মড়া নিয়ে যায় নদীতে ভাসিয়ে দিতে তখন এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। উপযুক্ত আলোক-সম্পাত, বাদ্যযন্ত্রের করুণ সুর, অভিনেতাদের হাহাকার… সব মিলিয়ে দর্শকের হৃদয় করুণ রসের তুঙ্গে উঠে যায়।

e

অসহায় চাঁদ-সনকার বাঁচবার কোনো অবলম্বনই আর রইল না। কিছুই যার নেই সে ভয় বা ভক্তি করবে কোন দুঃখে? মনসাকে পরামর্শ দিতে বেদীতে উঠে দাঁড়ালেন নেতারূপিনী ফারজানা হাবিব লাবণ্য। মনসা চলে গেলেন স্বর্গের অডিটোরিয়ামে যেখানে বেদিতে উপবিষ্ট শিবের সামনে নৃত্য পরিবেশন করছে অপ্সরা ঊষা আর গন্ধর্ব অনিরুদ্ধ। শুভ্রা গোস্বামী আর রনি দাসের ওড়িশি বা দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় ধাঁচের অনবদ্য নৃত্যে তালচ্যুতি ঘটালো মনসা। ক্রোধান্বিত শিব এই বাদক-নর্তক দম্পতিকে স্বর্গ থেকে নির্বাসিত হবার আদেশ দিলেন। শিবের অনুমতিক্রমে মনসা তাদের দুজনের আত্মা পৃথিবীতে নিয়ে এসে অনিরুদ্ধের আত্মাকে চম্পক নগরের সনকার গর্ভে এবং ঊষার আত্মাকে উজানি নগরের সুমিত্রার গর্ভে স্থাপন করলো। সনকাকে পুত্রদান করলেন মনসা, কিন্তু শর্ত দিলেন, মনসার পূজা না করে পুত্রের বিবাহ দিলে বাসর রাতেই সর্পদংশনে মৃত্যু ঘটবে পুত্র লক্ষ্মীন্দরের।

r

স্ত্রীকে গর্ভবতী রেখে বাণিজ্যযাত্রা করলেন গন্ধবণিক চাঁদ। হাতের উত্তরীয়কে নৌকার দাঁড়ের রূপক বানিয়ে চমৎকারভাবে সমুদ্রের ঢেউ সৃষ্টি করেছেন অভিনেতারা। চৌদ্দ বছর পর ফেরার পথে নিজের নাবিকদের মনসার পূজা করতে দেখে আবার ঘট ভেঙে দিল আত্মগর্বী চাঁদ সওদাগর। মনসার অভিশাপে সপ্তডিঙামধুকরের ভরাডুবি হলো। ভরাডুবির দৃশ্যেও ব্যবহৃত হয়েছে সেই একই উত্তরীয়।

t

জলে হাবুডুবু খেয়ে কোনোমতো তীরে উঠে ঘুরতে ঘুরতে চম্পক নগরে এসে পৌঁছালেন চাঁদ। স্মৃতিভ্রষ্ট চাঁদ নিজের নগরকেই চিনতে পারেন না। নেতার পরামর্শে মনসা ফিরিয়ে দিলেন চাঁদের স্মৃতি। স্ত্রী-পুত্রকে চিনতে পারলেন চাঁদ এবং অনতিবিলম্বে ঠিক করলেন যে পুত্র লক্ষ্মীন্দরের বিয়ে দেবেন উজানি নগরের বেহুলার সাথে। সনকা মনসার শর্ত স্মরণ করিয়ে দিল চাঁদকে। সনকার কথায় কর্ণপাত না করে অহঙ্কারী চাঁদ তারাপতি কামারকে ডেকে এক নিশ্চিদ্র লোহার বাসরঘর নির্মাণের হুকুম দিল। চাঁদের হুঙ্কার: ‘দেখি, ব্যাঙখাগী কাণী মোর কী করিতে পারে!’

রঙিন উত্তরীয় আকাশে ছুঁড়ে, গান গেয়ে, বাজনা বাজিয়ে, উলুধ্বনি দিয়ে বিবাহের পরিবেশ সৃষ্টি হলো মঞ্চে। কন্যার নাম ‘বেহুলা’ নাকি ‘ভেউলা’ গায়েনের এই প্রশ্নে হাস্যরসের অবতারণা হয়। ‘খন্যা কী খরিত ফারে?’ – গায়েনের এই প্রশ্নের উত্তরে এক অভিনেতা ‘খন্যা পাড়া বেড়াইত ফারে’, ‘খন্যা ভর্তা খরত ফারে’, ‘খন্যা ফাক করত ফারে’ ইত্যাদি বলার পর শেষে যখন বললো: ‘খন্যা সেল্ফি তুলত ফারে!’ দর্শকের মনে হাস্যরস তখন তুঙ্গে।

চার কোণে রাখা চারটি ত্রিকোণ বেদি মঞ্চের মাঝখানে এনে তার উপর চার কিনারে পদ্মফুল আর পদ্মপাতার ছবিযুক্ত একটি সাদা চাদর বিছিয়ে প্রায় বৃত্তাকার একটি উপমঞ্চ তৈরি করা হলো। বরসুলভ লাজুক হাসি ঠোঁটের কোনায় ঝুলিয়ে লক্ষ্মীন্দর মাহবুব আলম সরকার আর ঘোমটাদেয়া বেহুলা শুভ্রা গোস্বামী (বা নিপা সরকার) কে উপমঞ্চে নিয়ে আসে তাদের নিজনিজ সখা-সখীরা। বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের মাথায় টোপর পড়িয়ে দেয় আর লক্ষ্মীন্দর বেহুলার গলায় পড়িয়ে দেয় ফুলের মালা। বর আর বধূ, এই দুজনের মধ্যে কার গুরুত্ব বেশি তা নিয়ে উভয়ের সঙ্গীদের মধ্যে মৃদু কথাকাটাকাটিও হলো। এর পর বেহুলা আর লক্ষ্মীন্দর বাসরঘরে কী করবে দর্শকদের এই প্রশ্ন করে সূত্রধার জুম্মান সাদিক জানালেন যে বর-বধূ বেঘোরে ঘুমাবে, দর্শকেরা মনে মনে যা ভাবছে সেসব তারা কিছুই করবে না। আবারও হাস্যরসের অবতারণা।

f

মনসার হুকুমে বাসরঘরে এক ছিদ্র রেখে দিয়েছিল তারাপতি কামার। সেই ছিদ্রপথে ঢুকে বিলাপ করতে থাকে কালনাগ: কীভাবে এই নিরপরাধ, সর্বাঙ্গসুন্দর নবযুবককে সে দংশন করবে? করুণ রসের সূচনা। এক সময় ঘুমন্ত লক্ষ্মীন্দরের পা পড়ে গেল তার লেজে এবং সেই অপরাধে লক্ষ্মীন্দরের পায়ের কড়ে আঙ্গুলে বিষ ঢেলে দিল কালনাগ। বাইশকবি লিখেছেন: ‘না হইল মাস পক্ষ দিন অষ্ট চারি। কাল-রাত্রি পদ্মাবতী তোমা কৈল রাঁড়ী।’ হাতের শাখা, গলার মালা, রঙিন শাড়ি… দাম্পত্য জীবনের সকল সম্ভাব্য সুখকে একে একে বিদায় জানিয়ে বিলাপ করতে করতে উপমঞ্চে লুটিয়ে পড়ে বেহুলা। করুণ রসে জারিত হয় দর্শকের হৃদয়। পুত্রহারা সনকা হাহাকার করে দেবী মনসার কাছে কৈফিয়ৎ তলব করে: ‘সারা জীবন তোমার পূজা করে আমি কী পেলাম?’ বিবদমান দুই প্রতিপক্ষ মনসা ও চাঁদ সওদাগর উভয়েই অবশেষে উপলব্ধি করে: ‘অহং নয়, দয়া আর প্রেম রাখতে হবে মনের আরশিতে।’

দুই প্রবল প্রতাপান্বিত শক্তির ক্ষমতার দ্বন্দ্বে স্বামীহারা হয়েছে সাত সাতটি মহিলা এবং পুত্রহারা হয়েছে সনকাসহ আরও অনেকে। সপ্তডিঙামধুকরের সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। খুন হয়েছে শঙ্কু গাড়–রি, জলে ডুবে মারা গেছে সপ্তডিঙার মাঝিমাল্লা। যুদ্ধ হয়েছে রাজায় রাজায় আর প্রাণ গিয়েছে উলুখাগড়ার, যেমনটি আমরা দেখেছি সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে, অবরোধ-হরতাল-পেট্রোল বোমার বিভীষিকার দীর্ঘ তিন মাসে, তারও আগে এবং আরও আগে। নাট্যকার শঙ্কর কুমার বিশ্বাস ও জুম্মান সাদিক মুন্সিয়ানার সাথে মঙ্গলকাব্যের কাহিনিতে সাম্প্রতিক অমঙ্গলের ভয়াবহতা প্রতিফলিত করতে সক্ষম হয়েছেন। ‘হিংসা বা অহঙ্কার নয়, মনের আরশিতে প্রতিফলিত হোক দয়া আর প্রেম’ – ব্রহ্মার উপদেশভিত্তিক এই ভরতবাক্য বারবার উচ্চারণ করে ও শাহমান মৈশাল রচিত মঙ্গলগীত গেয়ে কুশীলবেরা নাট্যস্থল ত্যাগ করেছে।

পদ্মাপুরাণের মূল কাহিনীতে বেহুলা স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে ভেলায় করে নদীপথে স্বর্গের দিকে রওয়ানা হয়েছিল। স্বর্গে গিয়ে নৃত্যগীতে শিব ও দেবতাদের সন্তুষ্ট করে স্বামী আর ছয় ভাসুরকে জীবিত করে চম্পক নগরে ফিরে এসেছিল পণ্যভর্তি সপ্তডিঙা মধুকর নিয়ে। মনসার পূজায় সম্মত হয়েছিল চাঁদ, তবে শর্ত জুড়ে দিয়েছিল, ডান হাতে নয়, অপবিত্র বাম হাতে সে মনসার পূজা করবে। মনসা তাতেই রাজি। নাট্যকারদ্বয় অবশ্য বেহুলার ভাসান অংশটিকে সুচিন্তিতভাবে বাদ দিয়েছেন নাটকের কাহিনি থেকে। যে দর্শকেরা পদ্মাপুরাণের কাহিনির সাথে পরিচিত তাদের মনে ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’ জাতীয় অনুভূতি সৃষ্টি হতে পারে নাটকের শেষে। তবে নাট্যকারদের যুক্তি সম্ভবত এই যে দুই প্রতাপশালীর দ্বন্দ্বে একজন হয়তো জিতে, কিন্তু তাদের কারও জয়ে সাধারণ মানুষের কিছু যায় আসে না। প্রবলের স্বার্থযুদ্ধে অসহায় মানুষের ভাগ্যে লেখা হয় চরম ভোগান্তি আর অপমৃত্যু।

চম্পক নগরের উপকথার অভিনয়-আয়তন পরিকল্পনা করেছেৃন সুদীপ চক্রবর্তী। পোষাক ও নাট্যদ্রব্য পরিকল্পনা করেছেন নাটকের নির্দেশক কাজী তামান্না হক সিগমা। রূপসজ্জা ও অলঙ্কারের দায়িত্বে ছিলেন ইসরাত জাহান মৌটুসী, নিপা সরকার, তানিয়া আক্তার ও উম্মে হানী। মনসা, চাঁদ সওদাগর, সনকা, বেহুলা, লক্ষ্মীন্দরসহ সব চরিত্রের বেশবাস বাহুল্যবর্জিত, সহজ-সুন্দর। মনসার মাথার পেছনে লাগানো সর্পমুকুট খুব সুন্দর লেগেছে। কদমছাট চুলের পরিবর্তে শিবের মাথায় জটা থাকলে এবং জটায় একটি অর্ধচন্দ্র আটকে দিলে হয়তো ভালো হতো। শিবের শরীরে পেশি ও মুখম-লে অভিব্যক্তির ঘাটতি ছিল। গায়েন চরিত্রে জুম্মান সাদিক আর মনসা চরিত্রে উম্মে সুমাইয়া অনবদ্য অভিনয় করেছেন। চাঁদ চরিত্রে ঝাঁকড়া চুলের শঙ্কর কুমার বিশ্বাসকে তন্ময় পালের তুলনায় সাবলীল মনে হয়েছে। সংলাপের উচ্চারণ যথাযথ, স্বরনিঃক্ষেপ চমৎকার। অঙ্গবিন্যাস, সঙ্গীত, নৃত্য, কোরিওগ্রাফী, পোশাক, মেকআপ, দৃশ্যপরম্পরা সব কিছুতে সারল্য, সৌন্দর্য ও পরিমিতিবোধের স্বাক্ষর রেখেছেন নাটকটির নির্দেশক ও কলাকুশলীরা।

সুর সৃজন ও সম্পাদনা করেছেন জুম্মান সাদিক, শংকর কুমার বিশ্বাস, শুভ্রা গোস্বামী ও নিপা সরকার। সুর চমৎকার এবং সুরের প্রয়োগ যথাযথ। দেহবিন্যাস ও নৃত্যশৈলী বিন্যাসের দায়িত্বে ছিলেন যথাক্রমে সাইদুর রহমান লিপন ও অমিত চৌধুরী। আলোক পরিকল্পনা করেছেন আশিক রহমান লিয়ন এবং আলোক প্রক্ষেপণের দায়িত্বে ছিলেন শাহারুল ইসলাম ও শাহাবুদ্দিন মিয়া। আলোকসম্পাত কখনই রসভঙ্গ করেনি, রসকে বরং উসকে দিয়েছে। মঞ্চনির্মাণ করেছেন কাজী রুবেল। আলোক-প্রক্ষেপণ, রূপসজ্জা, অলঙ্কার, নাট্যদ্রব্য, মঞ্চ কোনো কিছুতেই উল্লেখযোগ্য কোনো ঘাটতি দৃষ্টিগোচর হয়নি।

নাটকের মধ্যে চাঁদ সওদাগর একাধিকবার মনসাকে ‘কাণী’, ‘বেঙখাগী’, ‘মহাদেবের শালী’ বলে গালি দিয়েছে। মেকআপেও মনসার একটি চোখ অন্ধ দেখানো হয়েছে। এই সব গালি এবং মনসার আংশিক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ার হেতু কী নাটকে তা বলা হয়নি। পিতার সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে কৈলাসে এসে হাজির হলে শিবের দুই স্ত্রী গৌরী ও গঙ্গা পদ্মাবতীকে নতুন কোনো সতীন মনে করেছিলেন এবং অসূয়াজর্জর হয়ে কুশশলাকা দিয়ে তার একটি চোখ কানা করে দিয়েছিলেন। পরে তাদের ভুল ভাঙে, মনসার চোখও ঠিক হয়ে যায় মাতাদের আশীর্বাদে, কিন্তু মনসার ‘কাণী’ নাম থেকে যায়। মনসাকে চাঁদ ‘বেঙখাগী’ বলে গালি দেয়, কারণ সাপের অন্যতম শিকার নিরীহ বেঙ এবং মনসা সর্পদেবী। তবে চম্পক নগরের উপকথা যেহেতু নাটকমাত্র, ইতিহাস বা পুরাণ নয়, সেহেতু সব বলা বা বোঝানোর দায় নাট্যকারদের থাকার কথা নয়।

মনসামঙ্গল বা পদ্মাপুরাণ নাট্যকলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারের পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। কোনো কাহিনি ও এর প্রেক্ষাপট সম্যক অনুধাবনের উত্তম পন্থাগুলোর একটি হতে পারে অভিনয়। নাটকের প্রচার-পুস্তিকায় বিভাগের প্রভাষক তামান্না হক সিগমা বলেছেন, চম্পক নগরের উপকথা তাঁর প্রথম নির্দেশনা এবং এটি একটি সম্মিলিত পরীক্ষামূলক কাজ। রসসৃষ্টি যদি শিল্পের মূল লক্ষ্য হয়ে থাকে তবে উপরোক্ত পরীক্ষায় নির্দেশক ও কলাকুশলীরা চমৎকারভাবে উৎরে গিয়েছেন। বিন্দুমাত্র রসভঙ্গ না করে এই নাটক দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে দর্শককে রস থেকে রসান্তরে নিয়ে যায়। খুবই সহজ এবং স্বাভাবিকভাবে একের পর এক শৃঙ্গাররস, বাৎসল্যরস, বীররস, হাস্যরস, করুণরসের অবতারণা ঘটিয়ে নাট্যকার ও অভিনেতারা দর্শক-শ্রোতার মনে নবরসের সুষমা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। নাটকের কোথাও রসবিকৃতি বা রসহীনতা নেই, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নবরস মিলেমিশে ‘নব’ (নতুন অর্থে) রসের সৃষ্টি হয়েছে।

অনেক দিন স্মৃতিতে জাগরুক থাকার মতো একটি অনবদ্য প্রযোজনা চম্পক নগরের উপকথা। চিরায়ত বাঙালি ঐতিহ্যের সাথে বাংলাভাষীদের পরিচয় করিয়ে দেবার ক্ষেত্রে পদ্মাপুরাণের মতো কাহিনিগুলো মঞ্চায়নের গুরুত্ব আছে। বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বে এই নাটকের বহু শত প্রদর্শনী হওয়া প্রয়োজন।

শিশির ভট্টাচার্য্য, অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Comments (6)

Leave a comment