Scroll Top
19th Ave New York, NY 95822, USA

যাত্রাপালা: চন্দ্রগুপ্ত-৮। অষ্টম অঙ্ক, ১ম দৃশ্য।

Chandragupta-1

[পাটলিপুত্র নগরে চাণক্যের গৃহের বিশ্রম্ভাগার। হস্তোপরি মস্তক রাখিয়া একটি উপাধান অবলম্বনপূর্বক মহামতি চাণক্য একটি কাষ্ঠাসনে অর্ধশায়িত রহিয়াছেন। অন্য একটি আরামদায়ক আসনে স¤্রাট চন্দ্রগুপ্ত অতি ভদ্রভাবে জানুদ্বয় দৃঢ়ভাবে সংযোজিত করিয়া উপবিষ্ট। ভালো করিয়া লক্ষ্য করিলে চাণক্যের অক্ষি ও ওষ্ঠদেশে দ্বিতীয়া তিথির চন্দ্রসদৃশ বিদ্রুপান্বিত ক্ষীণ হাস্যরেখা এবং সম্রাটের মুখমণ্ডলে অস্বস্তির পুঞ্জীভূত মেঘ দৃষ্টিগোচর হইলেও হইতে পারে।]

চাণক্য: গুরুদেব, একটি চমৎকার কাহিনি শুনাইবেন বলিয়া দূতমারফৎ জরুরি এত্তেলা দিয়া আমাকে ডাকাইয়া আনিয়া এতক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে আমার মুখপানে তাকাইয়া আছেন। পরিস্থিতি ভালো বোধ হইতেছে না। প্রভূ, বাক্যে, আচরণে কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণে সম্প্রতি নতুন কি কোনো ভুল করিয়াছি?

চাণক্য: করিয়াছ কি কর নাই, প্রথম গল্পটি শুনিলেই বুঝিতে পারিবে, অবশ্য তোমার বুদ্ধি ও কা-জ্ঞান যদি অদ্যাবধি অবশিষ্ট থাকে। আমি অবশ্য ভাবিয়াছিলাম, ফৌসবুক বা মুখপুস্তিকা মারফৎ গল্পটি ইতিমধ্যে তোমার কর্ণগোচর হইয়াছে এবং আমার নির্বাক হাসি দেখিয়াই তুমি যাহা বুঝিবার বুঝিয়া লইবে। তোমার ভাব দেখিয়া মনে হইতেছে, গল্পটি তুমি এক্ষণাবধি শোন নাই, যাহার নিগলিতার্থহইতেছে, তোমার তথ্যমন্ত্রক নিতান্তই একটি আমড়াকাষ্ঠের ঢেঁকি।

গল্পটির একটি ক্ষুদ্র ভূমিকা আবশ্যক। মধ্যপ্রাচ্য নামক অঞ্চলে ‘আরবি’ নামে এক ভাষা আছে। সেই ভাষায় পিতৃমাতৃহীন শিশুদিগকে ‘ইয়াতিম’ কহে এবং অর্বাচীন গৌড়ভাষায় যে গৃহে ইয়াতিম শিশুগণ বাস করে তাহার নাম ‘ইয়াতিমখানা’। কোনো রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা পিতা যদি মৃত্যুবরণ করেন, তবে সেই রাষ্ট্রকেও একটি মহা ইয়াতিমখানা বলা যাইতে পারে বটে।

এইবার মূল গল্পে আসা যাউক। একদা গৌড়দেশ নামক মহা ইয়াতিমখানার অন্তর্ভুক্ত একাধিক সাধারণ ইয়াতিমখানার পোষ্য ইয়াতিমগণ চারি জনের কক্ষে বিংশতি জন, এক জনের বিছানায় আড়াই জন শুইয়া, ভাঙা সানকিতেডায়রিয়া-সদৃশ ডাউল এবং পঁচা তণ্ডুলভক্ষণ করিতে করিতে বিরক্ত হইয়া উচ্চস্বরে ক্রন্দন করিতেছিল। ক্রন্দন শুনিয়া মহা ইয়াতিমখানার উপাধ্যক্ষ ক্রোধে কাণ্ডজ্ঞান হারাইয়া চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন: ‘আজি হইতে ইয়াতিমগণের সানকিতেঅন্নভক্ষণ নিষিদ্ধ!’

গৌড়দেশের হতভাগ্য ইয়াতিম শিশুগণ সারমেয়-সন্তান। মহান উপাধ্যক্ষ তাহাদিগের পিতামাতা। পছন্দ হউক কিংবা না হউক, পিতৃমাতৃবাক্যের বিরোধিতা করা কোনো কালেই আর্যাবর্তের সংস্কৃতি ছিল না। বিস্মরণশীল ইয়াতিমগণ সেই সানকিবিপ্লবের কথা প্রায় ভুলিয়াই গিয়াছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত না অবিমৃশ্যকারী সেই অধ্যক্ষ মহোদয় একদিন ইচ্ছা করিয়া স্বীয় জিহ্বা দ্বারা তাহাদিগের বিশুষ্কমান ক্ষতে লবণের ছিটা দিতে শুরু করিলেন (একবার বলিতে শুরু করিলে এই দীর্ঘজিহ্ব অধ্যক্ষকে থামায় কার সাধ্য!)।

‘আমার একমাত্র পুত্রের একবার বিরিয়ানি ভক্ষণের সাধ হইয়াছিল। তখন হতদরিদ্র আমি, পান্তন্ন আনিতে লবন ফুরাইয়া যায়। সন্তানের সেই অ-সামান্য সাধটুকু পুরাইবার সাধ্য আমার ছিল না। বাধ্য হইয়া পুত্র আমার আর্যাবর্তের নগরবাসী মধ্যবিত্ত ও দরিদ্রদিগের মত বিষ্ঠাহ্রদে চাষকৃত পাঙ্গাস মৎস্যের ঝোল দিয়া অর্ধসিদ্ধ তণ্ডুলমাখিয়া খাইল। এই দুঃখ বিস্মরণ হইবার নিমিত্ত বহু বর্ষ পরে একবার রিকশাযোগে ধান্যম-িকা এলাকার স্টর কৈবব নামক খাদ্যাপণে পুত্রের নিমিত্ত পোলাওয়ের অর্ডার দিতে গমন করিতেছিলাম। আমার কৃষ্ণমাণিক্য পুত্র ততদিনে এক শ্বেতবর্ণা, ককেশীয়া পুত্রবধূ গৃহে তুলিয়াছে। অজানা কোনো অভিশাপের কারনে মৌর্য বংশের বৃদ্ধি ঘটাইতে সে সক্ষম না হইলেও বংশের সম্মান যে আমার অজৈয় বহুগুন বৃদ্ধি করিয়াছে তাহাতে সন্দেহ কী! কিন্তু বিধি বাম (ইহা মূলত চন্দ্রগুপ্তের করুণাপ্রার্থী বামপন্থী নেতৃবৃন্দের দোষ!)।পথমধ্যে কোথা হইতে এক চ্যাঙড়া তষ্কর হঠাৎ ছুটিয়া আসিয়া আমার অর্থ-থলিকাটি ছিনাইয়া লইয়া (অর্বাচীন ইঙ্গরাজি ভাষায়) ‘ভ্যানিশ’ হইয়া গেল।

আমি বাধা দিতে পারি নাই। কেন বাধা দিব? সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত কিংবা তাহার পিতা শাক্য মজ্জব কি কখনও কাহাকে অন্যায় করিতে বাধা দিয়াছে?  আমলক দলের রাঘব বোয়ালগণ যখন ক্রমাগত ব্যাংক লুট অর্থাৎ রাজকোষ লুট করিতেছিল, তখনও কি কেহ টু শব্দটি করিয়াছে? আর্যাবর্ত ব্যাংকের যে কক্ষে পুকুরচুরির প্রমাণাদি ছিল সেই কক্ষে কে বা কাহারা অগ্নিসংযোগ করিয়াছিল। লোক দেখানো তদন্ত পর্যন্ত হয় নাই। তদন্ত করিয়া কী লাভ? কাহারা অপরাধ করিতেছে, আমরা সকলেই জানি। সকলেইতো আমাদিগের সন্তান, ভাই, বন্ধু। লুটিয়া পুটিয়া খাউক না, কত খাইবে! না, অন্যায়ে বাধা দেওয়া আর্যাবর্তের কিংবা আমলক দলের ঐতিহ্য নহে। আমরা মুখে বলিব: ‘সাবধান বাবাসকল! অন্যায় করিও না!’, কিন্তু কার্যত অন্যায় করিতে কাহাকেও আমরা বাধা দিব না, দিব না, দিব না- তষ্কর সামান্য ছিনতাইকারীই হোক, কিংবা মহান ব্যাংক-লুটেরাই হোক।

আর ঐ যে আসনোপরি আমার নুদস-নৌদস বন্ধুটি দৃশ্যমান হইতেছেন, এতিমখানার মাননীয়া ‘বক্তী’, তাহার অভিজ্ঞতাতো অধিকতর করুণ। একদা তিনি পিতা সমভিব্যাহারে হস্তিসেতুর নিকটবর্তী ‘শর্মা হউজ’ নামক এক খাদ্যাপনে গিয়া গো-বর্গরের অর্ডার দিয়াছিলেন। বর্গর পরিবেশিত হইবার পূর্বেই পিতা সৌভাগ্যবশত হৃদয়ঙ্গম করিলেন যে থলিতে যথেষ্ট অর্থ নাই। বাড়া বর্গরে ছাই পড়িলে পিতা-পুত্রী ‘নষ্টব্যঞ্জন’ নামক নীলক্ষেত্রের অতি নিম্নমানের এক খাদ্যাপনে গিয়ে গিয়া উদর ভরিয়া ডাউলান্ন ভক্ষণ করিল। (ফিস ফিস করিয়া পার্শ্ববর্তী ব্যক্তির কর্ণকুহরে) গায়ে গত্তি লাগাইতে অবশ্য ডাউলান্নের জুড়ি নাই। তাকাইয়া দেখুন, কোথায় যে উহার গ-ের শেষ এবং কোথায় যে চিবুকের শুরু- নির্ণয় করিতে হইলে তদীয় মুখমণ্ডলের ইতিহাস ও ভূগোল দুইই উত্তম করিয়া ঘাঁটিতে হইবে? (প্রকাশ্যে চিৎকার করিয়া) হায়! ঐ বরাহ-জাতক ইয়াতিমেরা কি জানে, আমাদিগের মত মহৎ ব্যক্তিগণও সুদূর অতীতে কত কষ্টে দিনাতিপাত করিতে বাধ্য হইয়াছিলাম? ‘ভো’ (সংস্কৃত সম্বোধন পদ। অর্থ: ‘ওরে’!) হাভাতের দল! আমাদিগের ইয়াতিমখানা হইতে বেশি আরামে কোথাও তোরা থাকিতে পাইবি না, আমার শ্রীমুখনিঃসৃত এই অমূল্য বাক্যখানা অন্তত স্মরণে রাখিস!’

চন্দ্রগুপ্ত (উচ্চস্বরে হাস্য করিয়া): প্রভূ, কাহিনি শুনিয়া ব্যাপক আনন্দ পাইলাম। কিন্তু কাহাকে উদ্দেশ্য করিয়া এই কাহিনি, কিংবা ইহার অন্তর্নিহিত শিক্ষাই বা কী, ঠিকঠাকমতো ধরিতে পারিতেছি না।

চাণক্য: রাজার এই জাতীয় বোধ-অগম্যতা রাজ্য শাসনের জন্য যতই ক্ষতিকর হউক, প্রহসন রচয়িতার জন্যে ইহা হিতকর এই অর্থে যে ইহার ফলে তাহার মস্তকখানি স্বস্থানে অটুট থাকে। সা¤্রাজ্যের প্রচলিত কাহিনি-সমূহের শানে নজুল না বোঝা কেন রাজার জন্য ক্ষতিকর, তাহা তোমাকে বুঝাইয়া বলি। দেখ চন্দ্রগুপ্ত, শাসকও মানুষ, সুতরাং তাহারও ভুল হয়। শাসককে যেহেতু অনেক ধরণের কাজ করিতে হয়,  সেহেতু তাহার অনেক বেশি এবং বিচিত্র ধরনের ভুল হয়। শাসকের ভুল হইবে, ভুল হইতে সমাজে গল্পের উদ্ভব হইবে, এই সকলই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক পরিস্থিতি হইতেছে, যখন কোনো শাসক নিজের ভুলটুকু বেমালুম অস্বীকার করেন। শাসকগণের অদ্ভুত, যুক্তিহীন আচরণ হইতে যুগে যুগে সমাজে বহু গল্পেরও উদ্ভব হইয়াছে। যে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজার কৃত ভুলের প্রতিবাদ-সমালোচনা নিষিদ্ধ হইয়া যায়, সেই পরিস্থিতিতে গুজবের সৃষ্টি হয়। গল্প স্বাভাবিক, গুজব অস্বাভাবিক, কিন্তু ‘গল্প’ আর ‘গুজব’ একে অপরকে ছাড়িয়া থাকিতে পারে না বলিয়া ‘গল্পগুজব’ নামক দ্বন্দ্বসমাসান্ত শব্দের সৃষ্টি হইয়াছে। কর্তৃপক্ষের ঠিক কোন ভুলটির কারণে রাজ্যে গল্পগুজবের সৃষ্টি হইয়াছে, রাজার প্রথম এবং প্রধান কাজ, সেই ভুলটি সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা। কোন কথা কে কোন উদ্দেশ্যে লিখিয়াছে কিংবা বলিয়াছে, তাহা রাজার নিকট কোনো গুরুত্ব বহন করিবে না, কী লিখিয়াছে সেটাই আগে দেখা দরকার। রাজ্যের ধান্দাবাজ অমাত্য ও অপদার্থ কায়স্থবৃন্দ স্বীয় হীন স্বার্থে নির্বাচিত কিছু তিলকে তাল করিয়া কুশাসকের কর্ণকুহর ভর্তি করিয়া রাখেন বটে, কিন্তু সুশাসকের সঙ্গে ইদৃশ পানাই-ধানাই চলে না, কারণ তিনি কান দিয়া দেখিতে জানেন এবং গুপ্তচররূপ অশ্বরজ্জু দ্বারা রাজ্য নামক রথকে নিয়ন্ত্রণ করেন।

তোমার তথ্য-অমাত্য প্রায়শই বড় মুখ করিয়া বলিয়া থাকেন, তোমার আমলে নাকি আর্যাবর্তে বাক-স্বাধীনতা পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পাইয়াছে এবং তুমিও তাহার অসার বাক্যে বিশ্বাস করিয়া নিশ্চিন্তে বসিয়া আছ। সারাক্ষণ মিথ্যা শুনিতে থাকিলে এক সময় ডাহা মিথ্যাকেই পরম সত্য বলিয়া প্রতীয়মান হয় বটে। তুমি কি লক্ষ্য করিয়াছ চন্দ্রগুপ্ত, তোমার প্রায় এক দশকের শাসনামলে ‘শেষ অন্ধকার’ পত্রিকার বিখ্যাত চিত্রকর শৈশরক একটি ব্যঙ্গচিত্রও অঙ্কন করিতে সাহস করেন নাই? কই, খৈলদার বৈনপী শাসনামলেতো কখনও এমনটা হয় নাই! এই ঘটনা কি নেহায়েত কাকতালীয় বলিয়া তুমি মনে কর? যদি করিয়া থাক, তবে বলিতে হইবে,আর্যাবর্তের দুঃখ-যামিনীর অবসান এখনও দূর অস্ত।

‘গুজবে কান দিবেন না!’ প্রচার না করিয়া সুশাসকের উচিত, গুপ্তচর দ্বারা সাম্রাজ্যের সব গল্প-গুজব, ব্যঙ্গচিত্র সংগ্রহ করিয়া জনমনের ক্ষত নিরাময়ের ব্যবস্থা করা। ব্যঙ্গচিত্র নয়, ব্যঙ্গের কারণ দূর করিতে হইবে। এমনভাবে রাজ্যশাসন করিতে হইবে যেন ব্যঙ্গচিত্র অঙ্কনেরই কোনো প্রয়োজন না হয়। কিয়ৎকাল পূর্বে তুমি অট্টহাস্য করিয়াছিলে। হাসির কথা হইলে রাজা অবশ্যই হাসিবেন, কিন্তু হাসির বস্তুটিকে হাসিয়া উড়াইয়া দিবেন না। রাজা হওয়া সবচেয়ে কঠিন কাজ চন্দ্রগুপ্ত। অর্বাচীন যুগের বাঙালি সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ লিখিবেন: ‘রাজাকে বধ করিয়া রাজত্ব মেলে না ভাই, পৃথিবীকে বশ করিয়া রাজা হইতে হয়!’জনদেহের বিবিধ ক্ষতের নিরাময় ও জনমনের বশীকরণ রাজনীতির অন্যতম উপায় বটে। দূর ভবিষ্যতে অগ্নিদগ্ধ এক মুঘল রাজকন্যাকে নিরাময় করিয়া হিন্দুস্থানে ইংরাজ বণিকের মানদণ্ডরাজদণ্ডেপরিণত হইবার শুভ কিংবা অশুভ সূচনা হইবে।

চন্দ্রগুপ্ত: শুনিলাম, মহাসৈন্যাধ্যক্ষ নিয়োগ লইয়াও নাকি সামাজিক গণমাধ্যমে তুলকালাম হইতেছে। এই প্রসঙ্গে আপনার মত জানিতে আমি আগ্রহী।

চাণক্য: প্রিয় চন্দ্রগুপ্ত, সামাজিক গণমাধ্যমে তুলকালাম কিংবা আবদুল কালাম যাহাই হইতেছে, কিংবা না হইতেছে, তাহা তুমি আমাকে কী কারণে জিজ্ঞাসা করিতেছ? মুখপুস্তিকা, ঐনস্টগ্রম ইত্যাদি সামাজিক গণমাধ্যমের সহিত তোমার যদি বিন্দুমাত্র যোগাযোগ না থাকে, তবে তুমি আধুনিক কালে সাম্রাজ্য শাসন করিবে কী করিয়া?  প্রাচীন কালে সুশাসক রাজা কিংবা সম্রাটগণ ছদ্মবেশে রাজধানী কিংবা সাম্রাজ্যে ঘুরিয়া ঘুরিয়া জনগণের মত জানিতে সচেষ্ট হইতেন। এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে তুমি ঘরে বসিয়া নিজে নিজেই এই কাজ করিতে পার। তোমার পুত্রটিতো শুনিয়াছি আর্যাবর্তে বৈদ্যুতিন যোগাযোগের অন্যতম রূপকার! আমার উপদেশ যদি মানো, তবে ফৌসবুক বা মুখপুস্তিকায় প্রতি দিন ঘণ্টাখানেক সময় কাটাও। আযাবর্ত শুধু নহে, সারা বিশ্বের লোক কী ভাবিতেছে, অনতিবিলম্বে তোমার হৃদয়ঙ্গম হইয়া যাইবে। ‘বৈদি নৈউজ’ নামক বৈদ্যুতিন সম্বাদপত্রে শিশির ভট্টাচার্য্য রচিত ‘যাত্রাপালা চন্দ্রগুপ্ত’ শীর্ষক প্রহসন পড়ার অবসরও কি তোমার হয় না, বৎস? মুদ্রিত পত্রপত্রিকা, দূরদর্শনের মতো ব্যর্থ সংবাদমাধ্যমে অধিক সময় নষ্ট করিও না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মনোযোগ দাও। অর্বাচীন ইঙ্গরাজি ভাষায় যাহাকে ‘নিউজ’ এবং ‘ভিউজ’ কহে সেই উভয়ই তোমার নখদর্পণে প্রতিভাত হইবে, গুপ্তচরবাহিনীরও প্রয়োজন হইবে না। কলিযুগের যে শাসক মুখপুস্তিকা পড়ে না, আমার বিশ্বাস, দিন দিন তাহার পক্ষে মুখরক্ষা করা কঠিনতর হইবে।

প্রিয় চন্দ্রগুপ্ত, হস্তীঝিলে যখন একাধিক পদ্মপুষ্প ‘ভ্যাটকাইয়া’ রহিয়াছে, তখন গোবর হইতে কী কারণে আমি পদ্মপুষ্প সংগ্রহ করিব, যদিও কে না জানে যে গোবরেও পদ্মপুষ্প ফুটিতে পারে। দশরথের চার পুত্রের মধ্যে লক্ষণ, শত্রুঘ্ন ও ভরত- এই তিন ভ্রাতাই যদি মৃত্যুণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত পলাতক আসামী হইয়া থাকে, সেক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রামকেই বা আমি ধৌত তুলসীপত্র বলি কী করিয়া? তুমি হয়ত বলিবে, আমার তুলসীপত্র হইলেই চলিবে, ধৌত কি অধৌত, তাহা দেখিবার প্রয়োজন আমার নাই। কিন্তু বৎস, সাম্রাজ্যশুধুমাত্র রাজার প্রয়োজন কিংবা অপ্রয়োজন দ্বারা পরিচালিত হয় না। সাম্রাজ্যের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পদের একটি সম্মান আছে এবং সেই সব পদে বসিবার জন্যে কে যোগ্য, আর কে অযোগ্য, সে সম্পর্কেও জনমনে পরিষ্কার ধারণা আছে। সেই সম্মান রক্ষা না করিলে সাধারণ্যে প্রশ্ন উঠিতেই পারে। সিংহাসনে বসিয়া কেন বিস্মৃত হও যে প্রকৃতপক্ষে কোনো ক্ষমতাই তোমার নাই। জনগণই নেহায়েত বাধ্য হইয়া তোমাকে তাহাদের ক্ষমতা কিছু কালের জন্য ব্যবহার করিতে দিয়াছে? তোমার পিতা আর্যাবর্তের রাষ্ট্রপিতা, কিন্তু কোনো পিতাই যেমন সন্তানের দেহমনের উপর পূর্ণ অধিকার রাখেন না, তেমনি তুমিও এই আর্যাবর্তকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত পিতৃসম্পত্তি বলিয়া মনে করিতে পার না।

দ্বিতীয় আপত্তি হইতেছে, যে কোনো ক্ষমতাক্রমে উচ্চস্তরের যোগ্য কয়েক জনকে ডিঙাইয়া তুমি যখন নিম্নস্তরের এক জনকে স্বীয় ক্ষমতাবলে পদোন্নতি দিবে, তখন বাকিরা হাত-পা গুটাইয়া বসিয়াও যদি থাকে, তাহাদিগের অপ্রাপ্তিজনিত মনোবেদনা তুমি দূর করিবে কী করিয়া? তাহার উপর তুমি আবার সম্প্রতি চাকুরির বয়স বাড়াইয়া দিয়াছ। সুতরাং তিনিতো সহজে বিদায় হইবার নহেন। মনে পড়ে, এক সিংহকে তুমি বহুদিন যাবৎ বিচারালয়ে পালন করিয়াছিলেন। মূর্খ তুমি, সিংহরা কখনও পোষ মানে? যেসব পশু পোষ মানিবার, যেমন গরু, ছাগল, কুকুর, বিড়াল তাহারা গত সহস্র বৎসরে পোষ মানিয়াই গিয়াছে। ইহা ছাড়া অন্তরে কে সিংহ আর কে যে দুষ্ট চিতা তুমি আগে হইতে জানিবে কী করিয়া? ইনিও যদি সেই সিংহ মহোদয়ের মতো হঠাৎ বিগড়াইয়া বসেন? কণ্ঠদেশে আটকানো জীবিত কইমৎস্যের মত তখন না পারিবে তাহাকে গিলিতে, না পারিবে উদ্গীরণ করিতে।

তৃতীয় আপত্তি হইতেছে, তুমি ভাবিতেছ, অমুককে পদ দিলে সে তোমার সহিত ঝামেলা করিবে না, বিশেষত তুমি যখন আইনকে তোমার নিজস্ব গতিতে চালাইয়া তাহার অনুজ সন্ত জৌসফের প্রাণরক্ষা করিয়াছ। ‘রারা’ (রামরাজ্য) নামক ব্রহ্মাবর্তের গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চমহলও সম্ভবত তোমাকে অনুরূপ কোনো পরামর্শ দিয়া থাকিবে। তুমি যেহেতু তাহার বিপদের বন্ধু হইয়াছ, সেহেতু সেও তোমার বিপদে পাশে থাকিবে- এই কথা তুমি কিংবা রারা ভাবিতেছে। কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত, সাবধানের যেমন মাইর নাই,তেমনি মাইরেরও সাবধান নাই। রারা কি শাক্য মজ্জবকেও তাঁহার সুরক্ষা-সংক্রান্ত পরামর্শ দেয় নাই?  কী লাভ হইয়াছিল? সমস্যা হইতেছে, রাজনীতি ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের বিশ্বকৌপ ফৌটবলের মতো। যাবতীয় হিসাব শতভাগ শুদ্ধভাবে কষিয়া এবং ভালো খেলিয়াও একটি দল হারিয়া যাইতে পারে। আবার যেনতেনভাবে খেলিয়াও দুর্বল একটি দল কৌপ ঘরে তুলিতে পারে।

বহু কাল পূর্বে তোমার পিতা শাক্য মজ্জব কাহারও (রারা?) কুপরামর্শে জৈয়হর্মনকে বাদ দিয়া অসফুল্লহকে আর্যাবর্তের সৈনাধ্যক্ষ করিয়াছিলেন। ইতিহাস সাক্ষী, এই সিদ্ধান্ত তাঁর নিজের কিংবা আর্যাবর্তের জন্যে কোনো সুফল বহিয়া আনে নাই। আর্যাবর্তের পাঁচ পাঁচটি দশক অপচয় হইয়াছে এই একটি মাত্র ভুল সিদ্ধান্তের কারণে। তোমার পিতা যদি এই বিশেষ সিদ্ধান্তটি না নিতেন, তবে জৈয়হর্মন তাঁহার পক্ষে থাকিতেন, চিরকালের ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ (‘কিং’ অর্থাৎ রাজা বিপদে পড়িলে কী কর্তব্য তাহা যে মূঢ় বুঝিতে পারে না, তাহাকে ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ কহে)অসফুল্লহকিছুই করিত না। মনে পড়ে কি, শাক্য মজ্জব আক্রান্ত হইয়া দূরালাপনীযোগে তাঁহার পছন্দের সৈনাধ্যক্ষের সাহায্য প্রার্থনা করিলে অসফুল্লহনিজে আরাম কেদারা হইতে আপন পশ্চাদ্দেশটি পর্যন্ত না তুলিয়া রাষ্ট্রপিতাকে গৃহের প্রাচীর টপকাইবার ‘সুপরামর্শ’ দিয়াছিলেন?

চন্দ্রগুপ্ত (দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া হতাশ ও উদ্বিঘ্নকণ্ঠে) : আর কিছু,গুরুদেব?

চাণক্য (দন্তদ্বারা নিম্নওষ্ঠ ঈষৎ মর্দন করিয়া): বৎস, কয়টি ভুলের কথা বলিব? ক্ষমতায় থাকিতে থাকিতে তুমি এবং তোমার অমাত্যগণ ক্লান্ত। তোমরা প্রত্যেকে অজানা কোনো ভয়ে ভীত। এই ক্লান্তি ও ভয় তোমাদের প্রত্যেকের, প্রত্যেকটি আচরণে প্রতিফলিত হইতেছে।তোমার দ্বিতীয় শাসনকালের সন্ধ্যা সমাগত। সন্ধ্যার স্বল্প আলোকের কারণে আশপাশ ভালো করিয়া তোমার দৃষ্টিগোচর হইতেছে না। সুতরাং ভুলও তুমি অবিরত করিতেছ, যদিও তোমার ভুল ধরাইয়া দিবার কিংবা প্রতিবাদ করার কোনো উপায় তুমি রাখিতেছ না। সামান্য প্রতিবাদ করিলেই তোমার সূর্যসেনারা প্রতিবাদকারীগণকে নির্মমভাবে মারিয়া-পিটিয়া সড়কপ্রান্ত হইতে খেদাইয়া দিতেছে,যেমনটি ঘটিয়াছে সম্প্রতি তক্ষশীলার পাঠাগারের সন্মুখে, ভাষাস্তম্ভ চত্বরে, শাহরাজি বিশ্ববিদ্যালয়ে। হাতুড়ি, বংশলাঠি ইত্যাদি তামাদি অস্ত্র দিয়া কুকুর পিটান পিটাইয়া হাড়গোড় ভগ্ন করিতে তুমি অকুণ্ঠভাবে একদল তরুণকে অন্য এক দল তরুণের প্রতি লেলাইয়া দিতেছ। তোমার সূর্যসেনা এবং রাজরক্ষীগণ তক্ষশীলার শিক্ষকদের গায়ে হাত দিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করিতেছে না।

ভাবিতে অবাক লাগে,এই অমানুষেরা নাকি শিক্ষার্থী! এই তরুণ বয়সে এত নৃশংস ইহারা কেমন করিয়া হয়? ভাইয়ের, বন্ধুর শরীতে হাতুড়ি দিয়া আঘাত করিতে একবারও কি তাহাদের বুক কাঁপে না। কেন তরুণ-কিশোরদের অমানুষে পরিণত করিতেছ, চন্দ্রগুপ্ত? তোমার কিংবা তোমার অমাত্যগণের সন্তান-সন্ততি আর্যাবর্তের বহির্ভাগে নিরাপদে আছে, থাক, কিন্তু তুমি কি আর্যাবর্তের এইহতভাগ্যদিগের কথা একবারও চিন্তা করিবে না?শিক্ষার্থীদিগের চরিত্রহননের জন্য আর্যাবর্তের আমলক বুদ্ধিজীবীগন জৈয়হর্মন এবং ঐরশদকে দোষ দিয়া থাকেন। কিন্তু তুমি চন্দ্রগুপ্তও যে একই দোষে শতগুন দোষী, তাহা মহাশয়েরা দেখেন না, কারণ কর্তার বাতকর্ম কদাপিগন্ধযুক্ত হইতে পারে না।

তোমার অমাত্য ঐবদুল্ল কৈদরের মত তুমি অবশ্যই দাবি করিতে পার, ইহারা তোমার সূর্যসেনা নহে, জৈমত-বৈনপীর ‘কাউয়া’। তোমার নিজেরই কথার কোনো ঠিক নাই। তুমিই বড় মুখ করিয়া বলিলে, কৌটা নাই, আবার তুমি নিজেই কৌটা বাতিল নিয়া করিতেছ ধানাই-পানাই! হায়! অসহায় জনগণ আর কাহার কথার উপর বিশ্বাস রাখিবে? মিথ্যা বলা, কথা দিয়া কথা না রাখা আর্যাবর্তের অপশাসকদের জন্মস্বভাব, অথবা ক্ষমতায় থাকিতে থাকিতে এই স্বভাব সম্ভবত তোমরা অর্জন করিয়াছ। সূর্যসেনারাও দাবি করিতেছে,কাহারও গাত্রে তাহারা পুষ্পাঘাতটুকুও করে নাই। কিন্তু, ‘কত গোধূমে কত আটা’জনগণ ঠিকই বোঝে। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত এই সব অসভ্যতা ও গুন্ডামির ফল কি ভালো হইবে বলিয়া মনে করিতেছ,চন্দ্রগুপ্ত? যাহাদের আঘাত করিতেছ তাহারা সংখ্যায় এক-দুই জন হইতে পারে, কিন্তু  তাহাদিগের দাবির সহিত একমত এমন কোটি জনতা আর্যাবতে আছে। দুই এক জনের গণ্ডেপতিত তোমার এই অনর্থক অথচ কঠিন চপেটাঘাত কোটি জনের গণ্ডে কঠিনতর হইয়া অনুভূত হইতেছে। এই ধরনের বিশাল অভিঘাতসম্পন্ন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পাপের কারণেই স¤্রাটের পতন হয়। তুমি ইচ্ছা করিয়া স্বপদে কুঠারাঘাত করিতেছ। তোমার ধামাধরা সূর্যসন্তানেরা যাহাদের আজ হাতুড়ি দিয়া পিটাইতেছ,সুযোগ পাইলে তাহারা তোমাদিগকে দুরমুশ দিয়া পিটাইবে, শাক্য মজ্জবের সন্তান কিংবা অনুসারী বলিয়া দয়া করিয়া ছাড়িয়া দিবে না। এই ভাবেই আর্যাবর্ত দিনে দিনেএকটি নরকে পরিণত হইবে। হাজার পদ্মাসেতু কিংবা মেট্রো নির্মাণ করিয়াও এই নরককে তুমি আর স্বর্গে রূপান্তরিত করিতে পারিবে না। ‘তুমি যারে নিচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নিচে। পশ্চাতে ফেলিছ যারে, সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।’ অর্বাচীন বঙ্গভাষার কবি রবীন্দ্রনাথের কবিতার এই দুই চরণ তুমিও এক সময় পড়িয়াছ, কিন্তু ইদানিং ক্ষমতার মোহে এই সকল আপ্তবাক্যে তুমি আর বিশ্বাস করিতে চাহ না।

সম্প্রতি তোমার নির্দেশে নেশাব্যবসায়ের সহিত জড়িত থাকার অপরাধে রাজরক্ষীগণ শত শত ব্যক্তিকে বিনা বিচারে হত্যা করিয়াছে। ভুলবশত কিংবা ইচ্ছা করিয়া নিরাপরাধ একাধিক ব্যক্তি যে ইহাদের হাতে নিহত হয় নাই তাহার নিশ্চয়তা কে দিবে? বংশানুক্রমে, যুগের পর যুগ ধরিয়া যে ব্যক্তি নেশার তেজারতির সহিত জড়িত, তাহাকে গোপনে মক্কধাম নামক তীর্থে পাঠাইয়া তুমি তোমারই দলের সৎ ও নিরলস কর্মী ঐক্রমলকে বিপ্রতীপ তীরন্দাজীতে হত্যা করাইয়াছ। গত কয়েক মাসে এরকম আরও কত নিরপরাধ ঐক্রমলের জীবনাবসান হইয়াছে তাহার হিসাব কে রাখে। হায় চন্দ্রগুপ্ত! পৃথিবীর ইতিহাসে এইভাবে নেশাচক্রের অবসান ঘটানো কোথাও কি সম্ভবপর হইয়াছে? তুমি কি বোঝ না যে রাজরক্ষীর সহায়তা এবং অমাত্যগণের সমর্থন ছাড়া কোনো দেশে নেশার ব্যবসা চলিতে পারে না? তোমার উদ্দেশ্য কি নেশাচক্রের অবসান, নাকি ভিতরে ভিতরে অন্য কিছু? ‘পিতা, তুমি যদি নিরাপদই হইবে, তবে তুমি ক্রন্দন করিতেছ যে?’ বলিয়া চট্টগ্রামি অপভ্রংশে ঐক্রমলের কিশোরী কন্যাদ্বয়ের বিলাপ শুনিবার অবসর কি তুমি পাইয়াছিলে, চন্দ্রগুপ্ত। পাপ বাপকে ছাড়ে না, অবশ্য তোমার তাহাতে কোনো সমস্যা নাই, কারণ তোমার পিতৃদেবতো বহু আগেই অন্য এক তীরন্দাজীতে স্বর্গবাসী হইয়াছেন। পিতা না থাকিলেও সন্তানতো তোমার আছে। তাহাদিগের সহিত ঐক্রমলের কন্যাদের তফাৎ কী? ভাবিয়া দেখতো,তোমার পুত্রী কিংবা পৌত্রীর যদি কোন দিন ঐক্রমলের কন্যাগণের দশা হয় (ঈশ্বর না করুন!) তবে তোমার মনের অবস্থা কেমন হইবে।

সম্প্রতি তুমি বহু কোটি মুদ্রা ব্যয় করিয়া একটি বিশেষ ধর্মের অষ্ট শতাধিক প্রার্থনাগৃহ নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছ। প্রথমত, রাষ্ট্র সবার চন্দ্রগুপ্ত, একটি বিশেষ ধর্মের অনুসারীগণের নহে। যেহেতু আর্যাবর্তে একাধিক ধর্মাবলম্বী লোকের বসবাস,সেহেতু তুমি একটিমাত্র ধর্মের প্রার্থনাগৃহ নির্মাণের জন্য এত অর্থ ব্যয় করিতে পার না। দ্বিতীয়ত, ধর্ম নহে, উন্নয়ন ও গবেষণাই যে কোনো সুশাসকের মনোযোগের বিষয় হওয়া উচিত। গবেষণার জন্য ব্যয় করিবার মত অর্থই যেখানে তোমার নাই, সেখানে প্রার্থনাগৃহ নির্মাণে তুমি কোন বিবেচনায় এই বৃহৎ পরিমাণ অর্থ ব্যয় করিতেছ? গবেষণা অবশ্য তোমার সা¤্রাজ্যে কখনই তেমন গুরুত্ব পায় নাই। সম্প্রতি তোমার পছন্দের উপাধ্যক্ষ আকৈত্রজম্মন তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈজট ঘোষণা করিয়াছেন। আশ্চর্যের বিষয়, সেই বৈজটে গবেষণার জন্য একটি ফুটা পয়সাও রাখা হয় নাই। গবেষণার সঙ্গে সম্পর্কহীন কোনো বিদ্যায়তনকে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’না বলিয়া ‘উচ্চবিদ্যালয়’ এবং উক্ত বিদ্যায়তনের উপাধ্যক্ষকে ‘প্রধান শিক্ষক’ বলিলে যথার্থ হয়।

তৃতীয়ত, ধর্মে যে কোনো ধরনের বিনিয়োগ আগে পরে যে কোনো শাসকের জন্য ভস্মে ঘি ঢালার সামিল প্রমাণিত হয়। কোনো একটি মহলকে সন্তুষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে তোমার পিতা শাক্য মজ্জব আত্মসমর্পী ধর্মের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ দিয়াছিলেন। উক্ত ধর্মের প্রচার-প্রসারের জন্যে একটি সংস্থাও তিনি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। বলা বাহুল্য, ইহাতে কোনো ফল হয় নাই। তিনি প্রকৃত ধার্মিক ছিলেন,অথচ আর্যাবর্তে প্রায় দুই দশক শাক্য মজ্জবের নাম উচ্চারণ পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। ধর্মসমূহ কোনো কালেই প্রকৃত ধার্মিকগণের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। বৎস চন্দ্রগুপ্ত, আর্যাবর্তের জনমন দুই ভাগে বিভক্ত। খৈলদা দিবারাত্রী সুরাপান করিলেও ধর্মধ্বজীরা তাহাকেই সমর্থন করিবে। নিজের হৃৎপিণ্ডকিমা বানাইয়া খাওয়াইলেও তুমি কদাপি তাহাদের সমর্থন আদায় করিতে পারিবে না। সুতরাং এখনও সময় আছে। রাষ্ট্র হইতে ধর্মকে পৃথক কর,চন্দ্রগুপ্ত, কারণ তেলে-জলে মিশ খায় না। ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’- ইহাই সাম্রাজ্যের অনুসরণীয় মূলনীতি হওয়া উচিত।

সর্বশেষ কথাটি বলিয়া তোমাকে বিদায় দিই। রাত্রি গভীর হইতেছে। প্রাসাদের শয়নকক্ষে মহারাণী নিশ্চয়ই এতক্ষণে উদ্বিঘ্নহইতেছেন, কারণ শয়নকক্ষের নিরাপত্তা দিতে পারিবে না বলিয়া একদা তুমি ঘোষণা দিয়াছিলে। (দ্বারের দিকে অগ্রসর হইতে হইতে) ক্ষমতা যত দীর্ঘজীবী হয়, তাহার দীর্ঘসূত্রীতাও তত বাড়িতে থাকে এবং সেই সাথে কমিতে থাকে ক্ষমতার কার্যকারিতা। একদিকে ক্ষমতা প্রাণী শরীরের মতো, দেহের ধ্বংসের বীজ দেহের ভিতরেই নিহিত থাকে। অন্যদিকে ক্ষমতা জেরুজালেমের মতো। ক্ষমতা কখনও এক ব্যক্তি কিংবা এক জাতির অধীনে থাকে না। তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ ঐরাবিণকেই দেখ না কেন। তিনি ছাড়াও তক্ষশীলা কী চমৎকার চলিতেছে, অথচ এক সময় লোকে ভাবিত, তক্ষশীলার ‘র‌্যামরাজ্য’ ঐরাবিণ ছাড়া অচল। পরিতাপের বিষয়, ঐরাবিণেরই বীর্যসৃষ্ট (‘বীর’ হইতে ‘বীর্য’, ‘বীরত্ব’ বা ‘ক্ষমতা’ অর্থে) কোনো কোনো র‌্যাম বা মেষ শেষমেশ ঐরাবিণের কৃতকর্মের বিচার দাবি করিতেছে। হায় অদৃষ্ট! ‘কর্দমে পড়িলে হস্তী। মুষিকেও করে মস্তি!’অথবা তক্ষশীলার শিক্ষক রসগোপাল শৈমশূল রগড় করিয়া যেমন কহিয়া থাকেন: ‘নিদারুণ কলিকাল। ছাগলে চাটে বাঘের গাল!’

তুমি যত ভাল শাসনই কর না কেন, ইতিহাসে ‘মহান চন্দ্রগুপ্ত’ কেহ বলিবে না। তোমার প্রপৌত্র অশোক ‘মহান’ বলিয়া অভিহিত হইবে। বহু যুগ পর মোঘল বংশের বাবর, আকবর, জাহাঙ্গীর, সাজাহান, ঔরঙ্গজেব এবং তাহার বংশধরেরা একে একে আর্যাবর্ত শাসন করিবেন। কিন্তু একমাত্র আকবরকেই লোকে ‘মহান আকবর’ কিংবা অর্বাচীন ইঙ্গরাজিতে ‘আকবর দি গ্রেট’ নামে অভিহিত করিবে। অশোক কিংবা আকবর তোমার তুলনায় বেশি ছাড়া কম নরহত্যা করিবেন না। তবুও ‘কেন ইহারা মহান হইবেন, তোমরা অন্যরা কেন সামান্য শাসক মাত্র বলিয়া বিবেচিত হইবে’ – এই প্রশ্ন তোমার মনে নিশ্চয়ই উঠিতেছে।

আর্যাবর্তের জনগণ মূলত সুশাসনের কাঙাল। বিপ্রতীপ তীরন্দাজীতে তাহাদের বেঘোরে মারিতেছ, ভগ্ন সানকিতে ডায়রিয়া-সদৃশ ডাউল দিয়া অর্ধসিদ্ধ অন্ন মাখিয়া খাওয়াইয়া তুমি নিজে তৃপ্তি ঢেকুর তুলিতেছ। এই সব পানাই-ধানাই জনগণ বেশি দিন সহ্য করিতে রাজি হইবে বলিয়া মনে হয় না। সুযোগ পাইবামাত্র ১৯৫৪, ১৯৭০, ১৯৯০, ২০০৭ সনে আর্যাবর্তের জনগণ কী জবাব দিয়াছিল মনে নাই? কেন বিস্মৃত হও চন্দ্রগুপ্ত, অগ্নিস্থানের (অগ্নিদেবের প্রতিশব্দ ‘পাবক’ হইতে ফার্সি ‘পাক’ এবং ‘পাক’ হইতে যদি ‘পাকিস্তান’ হয়!) ভয়ঙ্কর সেনাবাহিনীকে যাহারা একদিন প্রায় খালি হাতে পরাস্থ করিতে সক্ষম হইয়াছিল, তুমি কি নিশ্চিত যে জুজুর ভয় দেখাইয়া তাহাদিগকে (মহান শাক্য মজ্জবের ভাষায়) ‘দাবাইয়া’ রাখিতে পারিবে? তোমার মন্ত্রীগণকে ইদানিং প্রায়ই বলিতে শুনিতেছি, এত উন্নয়ন করিলাম,তবুও কেন এত ক্ষোভ আর্যাবর্তে? মুখপুস্তিকায় জনগণ কী বলিতেছে জান? শুধুমাত্র ব্যাংক লুটপাট, অর্থাৎ রাজকোষ হইতে পুকুরচুরির জন্যেই নাকি এতদিনে মৌর্য মন্ত্রকের কয়েক বার প্রাণদন্ড হওয়া উচিত ছিল।

Comments (6)

Leave a comment