Scroll Top
19th Ave New York, NY 95822, USA

যাত্রাপালা: চন্দ্রগুপ্ত-১০। দশম অঙ্ক

দশম অঙ্ক। ১ম দৃশ্য

তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষের কার্যালয়। উপাধ্যক্ষ মহোদয় স্বীয় আসনে উরুদ্বয় প্রয়োজনাতিরিক্ত ব্যাদান করিয়া উপবিষ্ট। আসনের তুলনায় ব্যক্তি যদি নিজেকে ক্ষুদ্রতর মনে করে, তবে সে উরুব্যাদান করিয়া প্রমাণ করিতে চাহে যে সম্পূর্ণ আসনে বসিবার অধিকার একমাত্র তাহারই, দ্বিতীয় ব্যক্তির স্থানসংকুলান সেই আসনে হইবে না। চন্দ্রগুপ্তের প্রথম শাসনামলে আর্যাবর্তের এক প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি শাহবর্ধন ঠিক এইভাবে জানু চেগাইয়া আসনস্থ হইতেন। তক্ষশীলার এক প্রবীণ শিক্ষক সইদহর্মণ (শাহবর্ধনের!) এই জানুমুদ্রার কারণে তাহাকে ‘চেগামিয়া’ এবং অন্য এক শিক্ষক শারিরীক খর্বতার কারণে আদর করিয়া তাহাকে ‘ন্যানোগোপাল’ নামে ডাকিয়া থাকেন।

অন্তর্দ্বারের দক্ষিণ কবাট উন্মোচন করিয়া অধ্যাপক শৈশরক প্রবেশ করিলে উপাধ্যক্ষ সহাস্যে ও সাদরে তাঁহাকে সন্মুখস্থ কেদারায় উপবেশন করিতে ইঙ্গিত করিলেন।

অনুগ্রহাকাক্সক্ষী চাটুকারের দল ঐরাবিণের টেবিল ঘিরিয়া দিবারাত্রি চাতকের মতো হত্যা দিয়া পড়িয়া থাকিত এবং তিনিও তাহাদিগের সঙ্গ কমবেশি উপভোগ করিতেন। দীর্ঘকায় ঐরাবিণ এবং নাতিদীর্ঘকায় আকৈত্রজম্মন – এই উভয় উপাধ্যক্ষের আমল যে কেহ স্বচক্ষে অবলোকন করিয়াছেন, তিনিই স্বীকার করিবেন যে আকৈত্রজম্মন অধ্যাপকগণের এই নোংরামি, নীচতাকে প্রশ্রয় দেন না। তবুও গুড়ের সুগন্ধে যেমন পিপীলিকা আসিতে দেরি হয় না, চাটুকারের শূন্য স্থানসমূহও কমবেশি পূরণ হইয়াই যায়। সত্য বলিতে কী, একদিনে কেহ তক্ষশীলার উপাধ্যক্ষ হয় না। ক্ষমতার সাপলুডু খেলায় গুটি চালাচালি করিয়া আকৈত্রজম্মনকে যাহারা শিকর হইতে উন্নতির চরম শিখরে তুলিয়াছেন, কিংবা ব্যাদিত সর্পমুখে পড়িয়া বেঘোরে মৃত্যুর হস্ত হইতে যাঁহারা তাঁহাকে সময়ে-অসময়ে রক্ষা করিয়াছিলেন, সেই মজলিশে সুরার সদস্যবৃন্দইবা নিজ নিজ সুরার বখরা আদায় করিতে মুক্তবোতল হইয়া ছুটিয়া আসিবেন না কেন? আর্যাবর্তে অর্বাচীন সংস্কৃত প্রবাদ প্রচলিত আছে: ‘ধান্দাহি কেবলম্’ কিংবা ‘টঙ্কাহি কেবলম’ অর্থাৎ ‘ধান্দা ও টাকাব্যতীত সংসারে বাকি সব কিছু অ-সার।’

ঐরাবিণের প্রাক্তন এক অনুগ্রহজীবী মৌনাসুর (জিহ্বার জড়তাবশত যিনি নিজের নাম উচ্চারণ করেন মমৌনাসুর) আকৈত্রজম্মনের সম্মুখে উপবিষ্ট। অতীতে কোনো একদিন নিতান্ত দয়াপরবশ হইয়া ঐরাবিণ শ্রীমান মৌনাসুরকে উত্তরের বাদশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হইতে আনিয়া তক্ষশীলার পত্রকার বিভাগে শিক্ষক নিযুক্ত করিয়াছিলেন। কিন্তু সেই মৌনাসুর সম্প্রতি ঐরাবিণের যাবতীয় অপকর্মের বিচার দাবি করিয়াছেন। তাঁহাকে আকৈত্রজম্মনের কার্যালয়ে দেখিয়া অধ্যাপক শৈশরক বিন্দুমাত্র আশ্চর্য হইলেন না, কারণ উপকারকের পশ্চাদ্দেশে কঞ্চিপ্রদান আর্যাবর্তের যুগান্তরের সংস্কৃতি এবং সুযোগ-সন্ধানী ব্যক্তিমাত্রেই যে পুরাতন প্রভূকে ত্যাগ করিয়া নতুন প্রভূ খুঁজিতে তৎপর হইবে, ইহাই স্বাভাবিক।

মৌনাসুর: অধ্যাপক শৈশরক, অনেকক্ষণ ধরিয়া আপনার চোখে পড়িবার চেষ্টা করিতেছিলাম, কিন্তু কোনো ক্রমেই চারচক্ষুর মিলন হইতেছিল না।
শৈশরক: ক্ষমা করিবেন, অধ্যাপক মৌনাসুর। আপনাকে তক্ষশীলা বিশ্রম্ভাগারে দেখি না কেন? কাহারও প্রতি ক্ষোভবশতঃ কি?
মৌনাসুর: অবশ্যই। অবধান করুন, বিশ্রম্ভাগারে কিছুই পান-ভক্ষণ করি না, তথাপি প্রতি মাসে আমার বেতন হইতে বহু সহস্র মুদ্রা কাটিয়া রাখে। তক্ষশীলায় ‘মৌনাসুর’ নামের একাধিক শিক্ষক কর্মরত আছেন এবং এই সকল বদমাইশ অধ্যাপক বিশ্রম্ভাগারে ভালোমন্দ খাইয়া আমার নামে লিখিয়া রাখেন। আপনাদিগের চট্টগ্রামনিবাসী মমমৌনাসুর মমউসা ইহাদিগের অন্যতম।
আকৈত্রজম্মন আনতচক্ষে নথি দেখিতে ব্যস্ত। আর্যাবর্তে ব্যস্ততা প্রদর্শন করা ক্ষমতা-শৃঙ্গারের অংশ বটে। ধরা যাক, কোনো দাপ্তরিক কার্যোপলক্ষে আপনি মহাকরণে গিয়াছেন। কর্ম হয়তো অতি সামান্য, কোনো দ্বারবানের নিয়োগপত্রে সচিবের শ্রীহস্তের স্বাক্ষরমাত্র, তবুও আপনাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় বসাইয়া রাখিয়া, দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ আপন কার্যালয়ে আসিতে আপনাকে বাধ্য করিয়া সচিব মহোদয় ক্ষমতার স্বাদ তাড়িয়া তাড়িয়া উপভোগ করিবেন। অন্যদিকে সচিব, উপাধ্যক্ষ কিংবা সমজাতীয় অন্য কোনো ক্ষমতাবান নিজের প্রয়োজনে উপর্যুপরি আপনাকে ফোনাঘাত করিবেন, আপনি পড়ি কী মরি করিয়া ছুটিয়া গিয়া প্রভূর কাজ করিয়া ধন্য হইবেন। কিন্তু আপনার কিংবা তাহার প্রয়োজনে ফোন করিলে মহোদয়ের দূরালাপনী যন্ত্রটি ঘন্টার পর ঘণ্টা রুদ্ধ পাইবেন।

একদিন ভাষা-সংস্থানের হস্তীশালায় এক সামান্য মাহুত নিয়োগের নথি হস্তে অধ্যাপক শৈশরক উপাধ্যক্ষের কার্যালয়ে অসহায়ের মত বসিয়া আছেন। অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক জৈয়হর্মন হঠাৎ এক দল জর্মন গবেষক প্রতিনিধি লইয়া বিনা এত্তেলায় উপাধ্যক্ষের কক্ষে প্রবেশ করিলেন। তাহাদের সহিত আলোচনায় উপাধ্যক্ষের অর্ধঘন্টা কাটিয়া গেল। জর্মনগণ বিদায় হইলে শৈশরক যেই তাহার নথি উত্থাপনের চেষ্টা করিবেন, অমনি তক্ষশীলার একমাত্র নারী ডৈন চৈতকা হৈলম উপাধ্যক্ষের কার্যালয়ে প্রবেশ করিলেন। শৈশরককে প্রিয়সম্ভাষণ করিয়া তিনি উপবেশন করিলে উপাধ্যক্ষ চৈতকার প্রতি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাইলেন।

চৈতকা হৈলম: ভর্তিপরীক্ষা সমাগত। উপাধ্যক্ষের সহিত একান্তে কয়েকটি গোপন বিষয় আলোচনা করার ছিল।
শৈশরক: সেক্ষেত্রে আমি গাত্রোত্থান করি। একান্ত গোপন কাবাবে খামাখা আমি হাড্ডি হইব কেন? তবে কিনা অনেকক্ষণ বসিয়াছিলাম, উপাধ্যক্ষ মহোদয় মাহুতের নিয়োগ-নথিটিতে শ্রীহস্তের স্বাক্ষর করিলে বেচারার উপকার হইত, বিশেষত মাহুত যখন জন্মসূত্রে চন্দ্রদ্বীপনিবাসী।
আকৈত্রজম্মন: চন্দ্রদ্বীপনিবাসী, নবখালীনিবাসী, গৌপলগঞ্জনিবাসী… এইসব তথ্য আমার নিকট কোনো গুরুত্ব বহন করে না। আপনি অযথা ভাবিত হইবেন না, অধ্যাপক শৈশরক। নথি রাখিয়া যাউন। স্বাক্ষর হইয়া যাইবে।

স্বাক্ষর হইয়ছিল, তবে পরদিন, পরশ্বদিনও নহে, দ্বাদশ দিবস অতিবাহিত হইবার পর এবং বহু ধর্ণা প্রদানের পর। কোনো কোনো প্রশাসক বিশেষ একটি বৃক্ষ, এমনকি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গুল্মের প্রতি মনোযোগ দিতে এত ব্যস্ত থাকেন যে অন্যদিকে যে বন উজার হইয়া যায়, তাহা অবধান করিবার অবসর তাহাদের হয় না।

দশম অঙ্ক, ২য় দৃশ্য।
তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-বিশ্রম্ভাগারের উদ্যান। উপবিষ্ট অধ্যাপকবৃন্দ: মৈমনক, হৈকর্মব, শৈশরক, মৈসদক প্রমূখ নারাঙ্গির রস পান করিতে করিতে আলোচনায় মগ্ন। আলোচনার বিষয়, তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতি সাম্প্রতিক প্রশ্ন-ফাঁস কেলেঙ্কারি। সকলেই কমবেশি বক্তব্য রাখিতেছেন, তবে মুলুকনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ মৈজনহর্মণ এতটাই সরব যে অন্য শিক্ষকেরা নিরবতা হিরন্ময় বলিয়া মানিয়া লইতে কার্যত বাধ্য হইয়াছেন।

মৈজনহর্মণ: কী বলিলে? চৈতকা আবার পরীক্ষা নিবে? হায়! পুনরায় ফাঁসিবে, প্রশ্ন এবং সে নিজে। রবীন্দ্রনাথ কি সাধে লিখিয়াছেন: ‘তোমার গোপন কথাটি, সখি রবে না গোপনে!’ যতকাল ঐমচিকিউ কিংবা চামচিকাকিউ জাতীয় প্রশ্নের উপর আপনারা নির্ভর করিবেন, ততকাল প্রশ্ন ফাঁসিতেই থাকিবে। ‘পিতার নাম কি?’ প্রশ্নের নিচে চারিটি ঘর দেওয়া আছে। যেটিতে খুশি টিক চিহ্ন দিন। ইহা কোনো প্রশ্নের জাত হইল? মুলুকনাথের ভর্তিপরীক্ষায় আমি বর্ণনা ও চিন্তামূলক প্রশ্ন করি। চার সেট প্রশ্ন করিয়া উহার মধ্য হইতে পরীক্ষার অর্ধঘণ্টা পূর্বে একটি সেট প্রশ্ন লটারি করিয়া বাছিয়া লই। কই, আমার প্রশ্নতো ফাঁসে না!

সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ফাঁসিত প্রশ্ন হস্তলিখিত ছিল, যাহার অর্থ হইতেছে, চৈতকার অতি নিকটস্থ কোনো ব্যক্তি তাহাকে ফাঁসাইয়া দিয়াছে। দিবেইতো, চৈতকার পশ্চাতে শত্রু কি কম? ডৈন হইতে উপাপাধ্যক্ষ হইয়া অতঃপর উপাধ্যক্ষ হইতে চৈতকার কতক্ষণ লাগিবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের কত কত নেতার শ্বপতœীগণ কায়মনোবাক্যে নিজ নিজ ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিতেছে, চৈতকা যেন ক্ষমতার ইঁদুরদৌড়ে হারিয়া যায়, কারণ, চৈতকা উপাধ্যক্ষ হইলে ফ্রার্স্টলেডির পদটির খামাখা অপচয় হয়। হৈকর্মব কিয়ৎ পূর্বে কহিয়াছে: ‘উপাপাধ্যক্ষ কবিরাজ অসৈমদ কেন প্রশ্ন উদঘাটনের কথা স্বীকার করিতে গেলেন! প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ গত বৎসরের মত অস্বীকার করিলেইতো হইত!’ ইহা সত্য যে অভিজাত বংশে ব্যাভিচার-অজাচার যেমন স্বাভাবিক, তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশ্নফাঁসও তেমনি স্বাভাবিক! কিন্তু ‘ইয়ানে’ অন্য কাহিনি আংব! প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ আসৈমদ এই কারণে স্বীকার করেন নাই যে তিনি ঘোরতর সত্যবাদী, কলিযুগে মূর্তিমান ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠীর। আসল কথা হইতেছে, তক্ষশীলার উপাধ্যক্ষ হইবার ইঁদুর-দৌঁড়ে চৈতকা যদি পিছাইয়া পড়েন, তবে কবিরাজের একেবারেই যে লাভ নাই, তাহাতো বলা যায় না। এক জীবনে তক্ষশীলার উপাধ্যক্ষই যদি না হইতে পারিলাম, তবে খামাখা সকলে মিলিয়া ঐরাবিণের কিস্তিইবা ডুবাইলাম কেন, অথবা এই নশ্বর জীবনধারণেই বা কী লাভ!

(অধ্যাপক হৈকমর্ব কী যেন বলিতে চাহিতেই মুলুকনাথের উপাধ্যক্ষ মৈজহর্মণ তাঁহাকে অনতিবিলম্বে থামাইয়া দিলেন) ভো! তুমি আমার কথা শ্রবণ কর! পরীক্ষা ও পাঠদানের পদ্ধতি ইত্যাদি গত এক শ বছরে বিন্দুমাত্র বদলায় নাই। না বদলাইলে কি চলিবে? তুমি কুড়ি বছর আগে যাহা পড়িয়াছ, তাহাই যে এখন শিক্ষার্থীদিগকে পড়াইতে হইবে, এমন কি কেহ মস্তকের দিব্য দিয়াছে? আমিতো প্রতিদিন পূর্বাহ্নে (যদি কোনো সভায় আমাকে সভাপতিত্ব করিতে না হয়, তবে) মুলুকনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো শ্রেণীকক্ষে ঢুকিয়া পড়াইতে শুরু করি। (অধ্যাপক শৈশরকের প্রতি) আরে, কে কী বলিবে? আমিতো উপাধ্যক্ষ, আমারে বাধা দিবার ক্ষমতা কাহারও নাই। সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের নিকটে গিয়া যদি কেহ যদি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে, তবে সম্রাট বলিবেন, ভ্রাতঃ মৈজহর্মণ যাহা করিয়াছে, সঠিক করিয়াছে। শোন, পদার্থবিদ্যা, সাহিত্য, বাণিজ্য, অংক, যেকোনো বিষয় আমি পড়াইতে পারি। অসুবিধা কী? শিক্ষার্থীগণকে উদ্বুদ্ধ করিতে পারিলেইতো হইল। একবার তাহারা উদ্বুদ্ধ হইলে যাহা যাহা পড়িবার, নিজেরাই পড়িয়া লইবে।

তক্ষশীলার সহকারী প্রকটক রণসুহাইল বিনীতভাবে কহিলেন, প্রশ্ন যে ফাঁস হইয়াছে তাহার কোনো গ্রহণযোগ্য প্রমাণ কিন্তু নাই। সকাল দশ ঘটিকায় পরীক্ষা শুরু হইয়াছিল। সাড়ে দশ ঘটিকায় এক পত্রকার আসিয়া যদি তাহার মৌবইলে আমাকে হস্তলিখিত প্রশ্ন দেখায়, তাহা হইলেই প্রমাণ হয় না যে প্রশ্ন ফাঁস হইয়াছে। মৌবইলে সময় পরিবর্তন করিয়া দেওয়া অ-সম্ভব কোনো কার্য নহে। তদন্ত কমিটি সিদ্ধান্তে পৌঁছিবার আগেই উপাপাধ্যক্ষ মহোদয় ফস করিয়া কবুল করিলেন: ‘প্রশ্ন ফাঁস হইয়াছে!’ উপাধ্যক্ষ মহোদয়ও কমিটির সিদ্ধান্তের নিমিত্ত অপেক্ষা করিলেন না। তক্ষশীলা প্রশাসনে ‘সমন্বয়’ বলিয়া কোনো শব্দ নাই, যে যার মতো সিদ্ধান্ত লইয়া থাকে। ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে!’ ভাব দেখিয়া মনে হইতেছে, অন্ততপক্ষে শ্রীমতি চৈতকার ক্ষেত্রে প্রশাসনের একটি অংশ কায়মনোবাক্যে কামনা করে: ‘প্রশ্ন, তুই তাড়াতাড়ি ফাঁস হইয়া যা! নচেৎ এমন ব্যবস্থা নিব যে তুই বেটি বাংলা সিনেমার বলৎকারমানা নায়িকার মতো ছুঠিয়া আসিয়া বলিবি: ‘তোমাদিগের পায়ে পড়ি, আমাকে খামাখা ছাড়িয়া দিও না, ফাঁস করিয়া আমার সতীত্ব নষ্ট কর, পিলিজ!’ কিংবা পূর্ববঙ্গে মশহুর চলচ্চিত্র ‘রহিম বাদশা ও রূপবান’ ছবির নায়িকার মতো প্রশ্নসুন্দরী বিলাপ করিয়া গাহিয়া উঠিবে: ‘ফাঁস কর, ফাঁস কর, বন্ধুগো। ও সৈমদ, ও জৈমন, কীসের এত দেরীগো, আমার দাইমা’, ইত্যাদি।

অদূরে পায়চারীরত এক প্রৌঢ় অধ্যাপক নিকটে আসিয়া মন্তব্য করিলেন, প্রশ্ন ফাঁস হইয়াছে, কি হয় নাই, পরীক্ষা পুনরায় অনুষ্ঠিত হইবে কি হইবে না – এইসব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত কাহারা নিতে পারেন, তক্ষশীলার ৩৭ নং অধ্যাদেশে তাহার পরিষ্কার উল্লেখ রহিয়াছে। উপাধ্যক্ষ কিংবা উপাপাধ্যক্ষ এই সব সিদ্ধান্ত নিবার মালিক নহেন। তদুপরি, অধ্যাদেশ অনুসারে সৃষ্ট বিভিন্ন আইন-সঙ্গত কমিটির পরিবর্তে তক্ষশীলায় বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে ডৈন কমিটি কিংবা হলাধ্যক্ষ কমিটি সেই সব কমিটির বিন্দুমাত্র আইনী ভিত্তি নাই। একাধিক উপাধ্যক্ষ এইসব বেআইনী কমিটিকে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দিবার কারণে প্রশাসন ইহাদিগকেই বেশি গুরুত্ব দিতেছে। কেহ একবার কষ্ট করিয়া অধ্যাদেশ খুলিয়া দেখিতেছে না, তক্ষশীলায় কোন কমিটি আইনসঙ্গত, কোনটি নহে। আর্যাবর্তের মতোই তক্ষশীলা উপরে উপরে আইন মানিয়া ফিটফাট, কিন্তু ভিতরে ভিতরে দুর্নীতিচর্চার সদরঘাট।

আলোচনা ভিন্ন দিকে গড়াইতে শুরু করিল। শিক্ষক কিংবা জাতীয় নেতৃবৃন্দ কেন ক্ষমতার রাজনীতি করিতে গিয়ে বদলাইয়া যান, সেই প্রসঙ্গে মৈমনক কোঁদর্সে নামক এক ফরাসি দার্শনিক-চিন্তাবিদের বক্তব্য উত্থাপন করিলেন। রাজনীতিতে ঢুকিবার আগে কিংবা ব্যক্তিগত আলাপে যে নেতাকে চিন্তাশীল মানুষ বলিয়া মনে হয়, রাজনীতির মাঠে তাহাকে অনুরূপ মনে নাও হইতে পারে। ইহার কারণ কী? অধ্যাপক শৈশরক তাঁহার ‘রঙিন বোতলতত্ত্ব’ দিয়া মৈমনকের তথ্যের ব্যাখ্যা দিলেন: পানি যে বোতলে রাখা হইবে, সেই বোতলের আকার ও রঙ ধারণ করে। আর্যাবর্তের রাজনীতি যদ্রুপ, নেতাগণের স্বভাবও তদ্রুপ হইতে বাধ্য এবং তাহাদিগকে খামাখা বিদ্রুপ করিয়া লাভ নাই।

দশম অঙ্ক, ৩য় দৃশ্য।
তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈনটভবনে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের আলোচনা সভা। অদ্যকার আলোচনার বিষয় এম.ফিল ও পি.এইচ.ডি. গবেষণা-প্রকল্প অনুমোদন। সকল অধ্যাপকেরই এই সভায় উপস্থিত থাকিবার কথা থাকিলেও অতি অল্প সংখ্যক অধ্যাপক সশরীরে উপস্থিত রহিয়াছেন। গবেষণাতো দূরের কথা, গবেষণার শিরোনামের মধ্যে এত শত ত্রুটি এবং যুক্তিহীনতা রহিয়াছে যে তক্ষশীলার মত বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সকল ছাইপাশ কী করিয়া উৎপন্ন হইতে পারে তাহা (চর্যাপদের ভাষায়) ‘ভাবিয়া ভাবিয়া কাহ্ন বিমনা ভইলা’। উপাধ্যক্ষ এবং উপস্থিত অধ্যাপকবৃন্দের আলোচনা ও মন্তব্যে কী কারণে বিন্দুমাত্র মননের ছাপ নাই Ñ এই সব সপ্ত-পঞ্চ ভাবিতে ভাবিতে অধ্যপক শৈশরক অবষন্ন বোধ করিতে লাগিলেন। গবেষণার শিরোনামের মধ্যে কোনটি অর্বাচীন ইঙ্গরাজিতে, কোনটি বঙ্গভাষায়, কোনটি উভয় ভাষায় রচিত। উপাধ্যক্ষ ঘোষণা করিলেন, গবেষণার বিষয় বঙ্গভাষায় রচিত হইলে, ইঙ্গরাজি অনুবাদ দিতেই হইবে, কিন্তু ইঙ্গরাজিতে রচিত হইলে, বঙ্গভাষায় অনুবাদ দিবার প্রয়োজন নাই। এই জাতীয় অসমতা কি গবেষণায় আদৌ গ্রহণযোগ্য? এই সিদ্ধান্ত স্পষ্টত ঊনবিংশ সপ্তাশি সনের বঙ্গভাষা আইনের ব্যাতয়। বঙ্গভাষাকে কম গুরুত্ব প্রদান অবশ্য তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম অলিখিত নীতি এবং এই ফৌজদারি অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান থাকিলেও আর্যাবর্তে অপরাধের শাস্তি না হওয়া একটি অতি সাধারণ প্রবণতা।

সভা-সমাপ্তির পর করিডোরে উপবিষ্ট উপাধ্যক্ষ সহাস্যমুখে শৈশরককে ডাকিয়া পার্শ্বে উপবেশন করাইলেন এবং একটি দুঃসংবাদও দিলেন। বিমানপোতযোগে উপাধ্যক্ষ মহোদয়ের শাকদ্বীপ সফরে যাইবার কথা ছিল। সেই সফর তিনি বাতিল করিয়াছেন, কারণ সন্মুখে নির্বাচন মহাসমর, কখন কী হয় বলা যায় না। আর্যাবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের, বিশেষত তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ পদটির শিকা কোন বিশেষ মার্জারের ভাগ্যে ছিঁড়িবে, তাহা নির্ধারণ করেন স¤্রাট চন্দ্রগুপ্ত নিজে। প্রতি পঞ্চবর্ষ পর পর তথাকথিত গণতন্ত্র নামক রাষ্ট্রব্যবস্থায় নির্বাচন মহাসমর উপস্থিত হয়। সেই সময় উপাধ্যক্ষগণ এবং ক্ষমতাসীন অধ্যাপক নেতৃবর্গও নিজ নিজ ক্ষমতার দীর্ঘস্থায়িত্ব নিয়া সন্দেহের দোলাচলে দুলিতে থাকেন। চট্টগ্রামী প্রাকৃতে একটি প্রবাদ রহিয়াছে: ‘ছাগল নাচে খুঁটির জোরে!’ খুঁটিই যদি নড়বড়িয়া হয়, ছাগ কী প্রকারে তড়বড়িয়া হইবে?

এই সব ভাবিতে ভাবিতে অধ্যাপক শৈশরক মুহূর্তের জন্যে আনমনা হইয়া পড়িয়াছিলেন। হঠাৎ তিনি অনুভব করিলেন, উপাধ্যক্ষ মহোদয় পৃষ্ঠদেশে প্রথমে ক্ষীণ সুড়সুড়ি এবং অতঃপর পশ্চাতে বামহস্তের তর্জনি ও মধ্যমা দ্বারা মৃদু ধাক্কা প্রদান করিয়া তাঁহাকে আসনত্যাগ করিতে ইঙ্গিত করিতেছেন, কারণ বাণিজ্য অনুষদের ডৈন শৈবলক সন্মুখে দ-ায়মান এবং উপাধ্যক্ষ তাঁহাকে বসিতে আহ্বান করিতেছেন। যদিও তক্ষশীলার সংবিধান অনুসারে কোনো সংস্থানের পরিচালক ও অনুষদের ডৈন সমমর্যাদার অধিকারী, তবুও ক্ষমতার ইঁদুর-দৌঁড়ে নির্বাচিত ডৈনের সাহচর্য যে একজন উপাধ্যক্ষের নিকট অধিক হিতকারী বলিয়া বোধ হইতেই পারে, এবং সেই তাড়না হইতে তিনি যে একজন অধ্যাপকের সহিত (সম্ভবতঃ নিজের অজান্তে) অশালীন ব্যবহার করিতে ক্ষণমাত্র দ্বিধা করিবেন না, ইহাতে আশ্চর্য হইবার কিছু নাই। কারণ ইহা তক্ষশীলায় তাহার আকৈশোর রাজনৈতিক কোচিং, দীর্ঘকালব্যাপী আচরিত অভ্যাসের অংশ, শুধু তাহার নহে, তক্ষশীলার বেশির ভাগ শিক্ষকনেতাই এই গুন কিংবা দোষে দুষ্ট।

এদিকে নিপাট ভদ্রলোক অধ্যাপক শৈবলক উপবিষ্ট হইতে ইতস্তত করিতেছিলেন বটে, কিন্তু অধ্যাপক শৈশরকের যেহেতু নিজের কিছু আক্কেল তখনও পর্যন্ত অবশিষ্ট ছিল, উপাধ্যক্ষের মৃদু ধাক্কা প্রবলতর হইতে পারে এই আশঙ্কায়, এবং সর্বোপরি আত্মসম্মান বাঁচাইতে নিজেই তিনি আসনত্যাগ করিয়া উঠিয়া পড়িলেন এবং ধীর, ক্লান্ত পায়ে তক্ষশীলার বিশ্রম্ভাগার অভিমুখে গমন করিলেন।

মহান চাণক্য বলেন, গণতন্ত্র এমন এক অদ্ভূত রাষ্ট্রব্যবস্থা যাহাতে কিংমেকারের গুরুত্ব কিছুমাত্র নাই, সকল গুরুত্ব কিং-এর। যিনি বা যাঁহারা নিজের বা নিজদিগের প্রতিনিধি নির্বাচন করেন, নির্বাচনের পরে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য গুরুত্বের ব্যারোমিটারে সেই নির্বাচক ভোটারের অবস্থান শূন্যের বহু নিচে নামিয়া যায়। পক্ষান্তরে, যিনি নির্বাচিত হন, তাঁহার অবস্থান ব্যারোমিটারের সর্বোচ্চ দাগটিকেও ছাড়াইয়া যায় Ñ ইহাই গণতন্ত্র নামক রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম ট্র্যাজেডি। এই শাসন-ব্যবস্থায় সাধারণ জনগণ ভোট দিয়া মরণশীল সামান্যকে অসামান্যে পরিণত করিয়া নিজে কার্যত অসহায়, অকিঞ্চিৎকর, অতি সামান্যে পরিণত হয়।

দশম অঙ্ক, ৪র্থ দৃশ্য।
তক্ষশীলার বিশ্রম্ভাগারের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বৃহৎ কক্ষ। ক্লান্ত, অবসন্ন অধ্যাপক শৈশরক তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্রম্ভাগারে প্রবেশিয়া একটি আসনে ধপাসিত হইলে সন্নিকটে উপবিষ্ট অধ্যাপক হৈকর্মব অধ্যাপকের নিকটে আগাইয়া আসিলেন।

হৈকর্মব: ‘অধ্যাপক মহোদয়ের কুশলতো? এইবার শারদীয় দুর্গোৎসব কেমন কাটাইলেন? কোথাও গমন করিয়াছিলেন কি?’

শৈশরক: দুর্গোৎসবে কুত্রাপি যাইবার প্রয়োজন নাই। রক্তমাংসের দেবদেবী-অসুরাদি সমভিব্যাহারে তক্ষশীলা ক্যাম্পাসেই সাড়ম্বরে দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হইতে পারে। চৈতকা হৈলম দেবী দুর্গার ভূমিকায় নামিতে পারেন (যেকোনো ভূমিকায় আমরা নামি, হায়! কদাপি উঠিতে পারি না!)। অধ্যাপক হরৌনকে অসুরের পার্ট দিলে মেক-আপের সম্পূর্ণ খরচ বাঁচিয়া যাইবে। অনেকেই সিংহ হইতে পারেন, কিন্তু নাদুস-নুদুস, দীর্ঘানন জৈয়হর্মন খারাপ অভিনয় করিবেন না। রজতশুভ্রকেশ সুপুরুষ মৈকশুদ্ধ কমল কার্তিক, মেকাআপিতা, হাস্যমুখী, সুন্দরী সবিতা-রজনী ও লালিমা আকৈত্র যথাক্রমে লক্ষ্মী ও সরস্বতী। গনেশের ভূমিকায় অভিনয় করার মত স্থুলোদর অধ্যাপকের অভাব নাই, তবে কলা অনুষদের অধ্যাপক মহাকায়গৌসকে সর্বাপক্ষা ভালো মানাইবে, অবশ্য যদি তিনি প্রস্তাবে রাজি হন, কারণ চার চারটি দিন পশ্চাদদেশে বাঁশ ও সারা অঙ্গ ও পৃষ্ঠদেশে রঙ-মাটিলেপা খড়ের বোঝা লইয়া কাঠের কাঠামে দেবদেবী সাজিয়া ঠায় দাঁড়াইয়া থাকা সহজ কর্ম নহে। মানুষ হওয়া কঠিন, দেবতা হওয়া কঠিনতর এবং ইহার পর বিসর্জনকালে পিঞ্জরাবদ্ধ মুষিকের মত বেঘোরে জলে ডুবিয়া মরণ-যন্ত্রণাতো আছেই। হায়, তবুও মানুষ দেবতা হইতে চাহে, ‘মানুষ’ হইতে কেহ চাহে না।

প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ ঐরাবিণ কিংবা বর্তমান উপাধ্যক্ষ আকৈত্রজম্মন প্রায় অদৃশ্য শিবের ভূমিকায় পশ্চাৎপটের পশ্চাতে থাকিতে পারেন। রাজনীতিপ্রবণ শিক্ষকদিগের মধ্যে পেঁচক, মুষিক, হংস, ময়ূর ও কলাবৌয়ের ভূমিকায় অভিনয় করিবার মতো অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভাব হইবে না। আকৃতি, প্রকৃতি ও আগ্রহ অনুসারে এইসব চরিত্র তাহাদিগের মধ্যে বিধিমোতাবেক বণ্টন করিয়া দিলে ক্যাম্পাসের দুর্গাপূজা ভীষণ রকম জমিয়া উঠিবে Ñ নির্বাচনপূর্ব বঙ্গদেশে শচীনকর্তার ঢোল তাকডুম তাকডুম ধ্বনিতে এমন তারস্বরে বাজিয়া উঠিবে যে ক্লান্ত ও অবসন্ন আর্যাবর্তের ভোটারগণ মনে মনে (ভয়ে প্রকাশ্যে নহে) বলিবে: ‘এইবার থামিয়া গেলে উত্তম হয়!’

Comments (17)

ক্রমাগত তক্ষশীলার খবরগুলি এইভাবে প্রচারীত হইলে আমরা যারা ইহাদের বলি তাহারা জানিতে পারিয়া খুশি হইব।

মহাশয়ের লেখার হাত মন্দ নহে। ক্ষণেক্ষণে হস্তদ্বারা আপন মুখ চাপিয়া ধরিয়াও হাস্যরোধ করিতে পারিতেছিলাম না। ফিচফিচ করিয়া এক ধরণের শব্দ বাহির হইতেছিল।

Viagra Cialis Et Levitra

Discount Finasteride Online

Stendra Erectile Dysfunction Wirral

Irrardorlele Priligy And Cialis Together http://alevitrasp.com

Where To Buy Prevacid 30 Mg plaquenil for covid cialis promise program

My brother recommended I might like this blog.
He was totally right. This post actually made my day.

You can not imagine simply how much time I had spent for this
information! Thanks!

Leave a comment