Scroll Top
19th Ave New York, NY 95822, USA

যুদ্ধাপরাধীর শাস্তি ও মিডিয়ার রুচিবৈকল্য

কয়েক শতাব্দী তক্কে তক্কে থেকে অবশেষে ১৯৮০ সালে আফগানিস্থানে আগ্রাসন করেই ফেলে রাশিয়া। অনতিবিলম্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল সারা বিশ্বের মিডিয়া। রাশিয়ার মিডিয়ার চোখে অবশ্য রুশ বাহিনী ছিল বহিরাগত দুস্কৃতিদের কবল থেকে আফগানিস্থানকে রক্ষার প্রয়োজনে স্বল্প সময়ের জন্যে আসা এক মিত্রবাহিনী মাত্র।
কিছু দিনের মধ্যেই মার্কিন মদদে ও অর্থায়নে মুজাহিদ বাহিনী গঠিত হয়ে যায় পাকিস্তান-আফগানিস্তানে। মৌলবাদ ঝাড়ে-বংশে বাড়তে থাকে এবং এর ঢেউ এসে লাগে উপমহাদেশসহ পৃথিবীর সর্বত্র। উপমহাদেশে নারীর পোশাকে দর্শনীয় পরিবর্তন আসে, ফার্সি বিদায়-সম্ভাষণ ‘খোদা-হাফেজ’-এর ব্যবহার কমতে থাকে। ‘জঙ্গিবাদ’ নামক যে দানবের সম্মুখে থরহরি কম্পমান আজ সারা বিশ্ব, তার জন্ম ও বিকাশ হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঔরসে, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের গর্ভে, আশি ও নব্বইয়ের দশকে।
কাবুলে দিনে দুপুরে গোলাগুলি, এখানে ওখানে বোমা বিষ্ফোরণ শুরু হয়ে যায়। সারা বিশ্বের মার্কিনপন্থী মিডিয়া তখন সেসব খবর ফলাও করে প্রচার করে। সোভিয়েতপন্থী মিডিয়া, বলা বাহুল্য, সন্ত্রাসের সেই সব সংবাদ বেমালুম চেপে যায়। ১৯৮২ সালে রাশিয়া মিসাইল মেরে একটি দক্ষিণ কোরীয় যাত্রীবাহী বিমান উড়িয়ে দিয়েছিল। সারা পৃথিবীর ডানপন্থী মিডিয়ায় নিন্দার ঝড় উঠে। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় সাত সাতটি পৃষ্ঠা জুড়ে ছাপা হয়েছিল সেই কম্যুনিস্ট কুকীর্তির ছবি ও কাহিনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশোধ নিয়েছিল কদিন পরেই। সুনির্দিষ্ট রুট ধরে এগিয়ে যাওয়া একটি রুশ বেসামরিক বিমানকে ১২৬ জন যাত্রীসহ ভূপাতিত করেছিল এঙ্গোলার মার্কিন-সমর্থিত স্বাধীনতাকামী যোদ্ধারা। ঠান্ডা মাথায় ঘটানো এই হত্যাকা-ের খবর মাত্র ১০০ শব্দে ছাপা হয়েছিল নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ।
এই যখন অবস্থা তখন ১৯৮৩ সালের মে মাসে ভøাদিমির দানচেভ নামে মস্কো রেডিওর এক রুশ সাংবাদিক আফগানিস্থানে রাশিয়ান আগ্রাসনের সমালোচনা করে মুজাহিদ বাহিনীকে এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে আহ্বান করে। অনতিবিলম্বে দানচেভকে গ্রেপ্তার করা হয়। মস্কো রেডিও জানায়, অসুস্থ দানচেভকে হাওয়া বদলের জন্যে পাঠানো হয়েছে (সম্ভবত সাইবেরিয়ায়, রাশিয়ার সর্বোত্তম আবহাওয়া যেহেতু সেখানেই!)।
মার্কিন সমাজে ‘বাকস্বাধীনতা’ নামে একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি আছে বলে শোনা যায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যখন ভিয়েতনামে আগ্রাসন করে তখন কোনো মার্কিন দানচেভ তার সমালোচনা করেনি কেন? নোয়াম চমস্কির মতে, এটা একটা কূটাভাষ (Paradox)। রাশিয়ার মতো স্বৈরতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় একজন প্রতিবাদী দানচেভ সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব নয়, কিন্তু আমেরিকার মতো তথাকথিত উদারনৈতিক সমাজ ব্যবস্থায় কোনো দানচেভের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না।
স্বায়ুযুদ্ধের যুগে পূর্ব জার্মানির এক কুকুর বার্লিন প্রাচীর টপকে পশ্চিম জার্মানিতে পালিয়ে এসেছিল। জাতভাইকে বহুদিনের ভূখা মনে করে পশ্চিমের কুকুরেরা তার সামনে রাশি রাশি খাবার এনে রাখলে শরণার্থী কুকুরটি বলেছিল: ‘এসব খাবার ওদিকে ঢের সস্তায়, অঢেল পাওয়া যায়। খেতে নয়, আমি এখানে প্রাণভরে ঘেউ ঘেউ করতে এসেছি!’ কখন, কোথায়, কতটুকু ঘেউ ঘেউ করা যাবে সে ব্যাপারে পাশ্চাত্যে একটি অলিখিত নিয়ম আছে। প্যারিসের মতো শহরে জঙ্গি হামলা হলে মিডিয়া কিছু দিন খুব হৈচৈ করে। বৈরুত-বামাকোতে হামলা হলে, খবরটা কোনোমতে দিয়েই তারা খালাস, যেন ঐ শহরগুলো পৃথিবী নামক গ্রহের অংশই নয়।
আরব দেশগুলোতে মিডিয়া স্বাধীনভাবে কাজ করার প্রশ্নই আসে না। ঘাড়ে কটা মাথা! হিটলারের শাসনামলে জার্মান মিডিয়া, শীতল যুদ্ধের যুগে পূর্ব ইওরোপের মিডিয়া কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার বাইরে কিছুই প্রচার করতে পারতো না। কিন্তু সেখানকার সাধারণ মানুষ খবরের দুই পঙতির মাঝের (Between the lines) খবর পড়তে শিখে গিয়েছিল। অর্থাৎ মিডিয়া যাই খাবার দিক, তারা ধুয়ে খেতো। পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে সরকার যা প্রচার করতে চায়, সচেতন বা অবচেতনভাবে মিডিয়া তাই প্রচার করে, ভয়ে নাকি স্বভাবে কে জানে। মিডিয়া যা খাওয়ায় শতভাগ শিক্ষিত জনগণ চোখ-কান বুজে তাই গিলতে থাকে। হাতির দুটি মাত্র দাঁত বাইরে থেকে দেখা যায়। বাকি সব দাঁত ভিতরে থাকে এবং চিবানোর মূল কাজটা সেখানেই হয়। মিডিয়া আমাদের যা কিছু দেখায় সেগুলো সম্ভবত হাতির বাইরের দাঁত। এখন অবশ্য ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি সামাজিক মিডিয়ার বদৌলতে অবস্থা বদলাতে শুরু করেছে। মিডিয়াও আগে পরে নিজেকে বদলাতে বাধ্য হবে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে।
বাংলাদেশের জনগণের সাক্ষর অংশের সিংহভাগ শিক্ষাজীবনে গাইডবই এবং কর্মজীবনে পত্রিকা ছাড়া সাধারণত আর কিছু পড়ে না। সাক্ষর-নিরক্ষর নির্বিশেষে জনগণের বৃহত্তর অংশের চিন্তার খোরাক আসে শ্রেফ টেলিভিশনের খবর আর টক শো থেকে। সুতরাং বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে জাতির মানসিক কাঠামোটি হয়তো তৈরি হয় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককদের হাতে, কিন্তু সেটির রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের দায় সাংবাদিকদের উপরই বর্তায়, তারা না চাইলেও, শ্রেফ পেশাগত কারণে।
প্রাচীন রোমে মৃত্যুদ-াজ্ঞাপ্রাপ্ত আসামীদের যখন ছিঁড়ে খেতো হিংস্র পশুরা তখন গ্যালারিতে বসে নাগরিকেরা সেই দৃশ্য উপভোগ করতো। পাশ্চাত্যে এক সময় আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা ফাঁসিমঞ্চের চারপাশে ভিড় করে মজা দেখতো। যুদ্ধাপরাধের বিচার করে দেশনেত্রী শেখ হাসিনা একটি ঐতিহাসিক গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের মিডিয়া যেভাবে যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদ- কার্যকর হবার ঘটনা দেখাচ্ছে এবং দর্শক যেভাবে তা উপভোগ করছে, তার সাথে পাশ্চাত্যের জনগণের এক সময়ের রুচিবৈকল্যের খুব বেশি তফাৎ কি আছে?
‘ফাঁসির পর আপনার অনুভূতি কী?’ যদিও অতটা কান্ডজ্ঞানহীন ও অপেশাদার এখনও হয়নি কোনো খবরজীবী মুন্নাভাই। তবু একাধিক পাঠক ও দর্শকের মতে, বাংলাদেশের মিডিয়ার মৃত্যুদ–সংশ্লিষ্ট মুদ্রণ বা সম্প্রচার নীতিতে সুরুচির অভাব রয়েছে। দ- কার্যকর হবার আগে থেকেই দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হতে থাকে ফাঁস-লাগানো ম্যানিলা দড়ির রঙিন ছবি। জল্লাদের নাম, ফাঁসুরের সংখ্যা, আসামির পরিবারের কোন সদস্যটি ঠিক ক’টার সময় দেখা করতে এলো, তারা কে কী বললো, আসামি ক্ষমা চেয়েছে, নাকি চায়নি, শেষ সময়টুকু কার কীভাবে কেটেছে, লাশবাহী গাড়ি কখন বেড়িয়ে গেল, গাড়ির রঙ কি ছিল ইত্যাদি গুরুত্বের সঙ্গে বলা হতে থাকে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে। আমজনতা হয়তো এসবই জানতে চায়। ফাঁসির দৃশ্যও হয়তো তারা দেখতে চায়! ফাঁসি কার্যকর হওয়ার খবরটি মাত্র শুনে দর্শক-শ্রোতা উল্লাসে এমনভাবে চিৎকার দিয়ে উঠে, যেন তখনি ক্রিকেট ফাইনালে চুড়ান্ত উইকেটটি পড়েছে!
জনগণের রুচি গঠনে প্রধান ভূমিকা রাখার কথা ছিল মিডিয়ার। কিন্তু দেশে দেশে, যুগে যুগে ‘মিডিওকার’ (স্বর্ণ>স্বর্ণকার, চর্ম>চর্মকার, মিডিয়া>মিডিওকার) হওয়াই যদি মিডিয়ার ভবিতব্য হয়, তবে জনগণের রুচিবৈকল্য আরোগ্যের সম্ভাবনা ‘হনুজ দূর অস্ত!’

Comments (16)

Leave a comment