Scroll Top
19th Ave New York, NY 95822, USA

ব্যাকরণ-ভ্রমণ-স্মৃতিচারণ

05-01-rainbow-houses-in-vila-do-bospo-painting-portugal

ফরেনসিক লিঙ্গুইস্টিক্স। এর অনেক রকম কাজের মধ্যে অন্যতম একটি কাজ হচ্ছে কোনো লোকের ভাষা, অর্থাৎ তার ভাষার শব্দ ও বাক্যগঠন ও শব্দ ও বাক্য উচ্চারণ বিশ্লেষণ করে বলা লোকটি পৃথিবীর কোন অঞ্চলের লোক হতে পারে বা তার ছোটবেলা কোন কোন জায়গায় কেটেছে, কিভাবে কেটেছে। সে আদৌ লেখাপড়া করেছে নাকি করেনি, সে কোন পেশার লোক হতে পারে ইত্যাদি। বিষয়টি নতুন মনে হতে পারে, কিন্তু যদিও ওল্ড টেস্টামেন্টের ‘শিবোলেথ’ শব্দে এর প্রমাণ আছে। প্রাচীন প্যালেস্ট্যাইনে যারা ‘শিবোলেথ’ শব্দটি ঠিকঠাক মতো উচ্চারণ করতে পারতো তারা এক জায়গার লোক, যারা পারতো না তারা অন্য জায়গার।

অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের লোকেরা উন্নত দেশগুলোর দিকে ছুটে যাচ্ছে উন্নত জীবন পাবার আশায়। অনেকে যাচ্ছে বাধ্য হয়ে, যুদ্ধ বা দারিদ্রের কারণে। সেখানে গিয়ে তারা রাজনৈতিক আশ্রয় দাবি করছে। কিন্তু দাবি করলেইতো হবে না, প্রমাণ করতে হবে যে আপনি বিশেষ একটি ভৌগোলিক অঞ্চলের অধিবাসী। এর কাগুজে প্রমাণ অনেক সময় থাকে না, কারণ জীবন বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালানোর সময় কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে যাবার কথা মনে থাকে না, নেয়া সম্ভবও হয় না। আবার কাগুজে প্রমাণ থাকলেও স্বাগতিক দেশের কর্তৃপক্ষ এর অতিরিক্ত একটি ভাষাতাত্ত্বিক প্রমাণ চায়। বিচারকেরাও ভাষাতাত্ত্বিক প্রমাণকে গ্রাহ্য করে থাকেন। সুতরাং ইওরোপের বেশ কয়েকটি দেশে ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সংস্থা গড়ে উঠেছে। এ রকম একটি সংস্থার আমন্ত্রণে আমাকে সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে যেতে হয়েছিল ২০১৩ সালের জুলাই মাসে।

আমি ভ্রমণ-পিপাসু নই, প্রয়োজনে ভ্রমণ করি। ট্রেন বা বাসে করে যাবার সময় প্রথম দিকে এক আধটু জানালা দিয়ে তাকাই বাইরের দিকে। কিছুক্ষণ পরেই বইপড়া বা প্রুফ-রিডিঙে মনোযোগ দিই বা শ্রেফ ঘুমিয়ে পড়ি। আমার স্ত্রী ভ্রমণ-পাগল। তার উপর সুইজারল্যান্ড তার স্বপ্নের দেশ, বহু দিন ধরে সেখানে যাবার সখ তার। আমি যাবো শুনে তারও তল্পি-তল্পা বাঁধা শুরু হয়ে গেল। খরচ যতই বাড়–ক, রবীন্দ্রনাথের ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতার ‘পতির পূণ্যে সতীর পূণ্য’ জাতীয় আপ্তবাক্যে আমার গৃহিনীর আস্থা নেই।

সিদ্ধান্ত নিলাম,প্যারিসে উড়ে দিয়ে সেখানে দিন চারেক থেকে তারপর ট্রেনযোগে বার্ন যাবো। প্যারিসে আমার দশ দশটি বছরের বহু স্মৃতি আছে। মাত্র বিশ বছর বয়সে প্যারিসে গিয়ে আমি অনেকটা সেখানেই বড় হয়েছি এই অর্থে যে আমার মনোজগতের অনেকখানিই গড়ে উঠেছে প্যারিসে। এতই পছন্দের জায়গা ছিল আমার প্যারিস যে অন্য কোথাও গেলে প্যারিসে ফিরে আসার জন্যে মন কেমন করতো। ১৯৮৫ সালে একবার হুজোগে পড়ে স্পেনের বার্সিলোনা শহরে গিয়েছিলাম সেখানকার অভিবাসী হবার জন্যে। সপ্তাহ খানেক বাদে ফিরে আসার সময় ট্রেন যখন প্যারিসের গার দ্য লিওঁ স্টেশনে প্রবেশ করছিল, তখন মনে হচ্ছিল যেন মাতৃভূমিতে ফিরে এসেছি।

১৯৮৩ সালে আসার পথে লন্ডন এয়ারপোর্টে ট্রানজিট নিয়ে এই শার্ল দ্যগলের এক নম্বর টার্মিনালে নেমেছিলাম। চট্টগ্রামের কুমিরা গ্রাম থেকে আসা বিশ বছরের তরুণের চোখে খুব উন্নত মানের বিমানবন্দর মনে হয়েছিল হিথ্রো আর শার্ল দ্যগলকে। প্যারিসের শার্ল দ্যগল এয়ারপোর্ট দেখে আমরা হতাশ। ষাট-সত্তর দশকের বাংলা ছবিতে দেখা ঢাকার তেজগাঁ এয়ারপোর্টের মতো টিনের শেডে ইমিগ্রেশন, বাসে করে ফ্লাইটের কাছে যাওয়া… যত সব মান্ধাতার বাবার আমলের ব্যাপার-স্যাপার। কী ব্যাপার? জানা গেল, শার্ল দ্যগলের তিনটি টার্মিনাল রয়েছে। এক নম্বর টার্মিনাল উন্নত, দুই আর তিন নম্বর টার্মিনাল অতি সাদামাটা।

ইমিগ্রেশনের ঝামেলা শেষ করে বাইরে বেরিয়ে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি নিয়ে হাজির হলো আলতাফ হোসেন, যার ডাক নাম সানি। সানি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র, তবে ফরাসি ভাষা শেখার সুবাদে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে আমারও ছাত্র ছিল। সানি প্রায় এক যুগ ধরে প্যারিস-প্রবাসী। সানির গাড়িতে করে হোটেল ইবিসে পৌঁছালাম। উত্তর-পূর্ব প্যারিসের গালিয়েনি মেট্রো স্টেশনের লাগোয়া এক ছাপোষা হোটেল এই ইবিস। ভাড়া দিনে ৭০ ইওরো, প্রাতরাশ নিলে জনপ্রতি আরও ১০ ইওরো করে দিতে হবে। হোটেলটি সার্ভিস দেবার ভাতার নয়, ইওরো নেবার গোঁসাই!

চেক ইন করে মধ্যাহ্ন ভোজনের উদ্দেশ্যে বের হলাম সানিকে সাথে নিয়ে। গালিয়েনি এলাকাটি আরবি-প্রধান এবং রমজান মাস চলছিল বলে খুব বেশি খাবারের দোকান খোলা নেই।আরবি এলাকা বলেই বোধ হয় প্যারিসের অন্য সব এলাকার মতো যত্রতত্র কুকুরের মলমূত্র দেখা গেল না এখানে। তবে রাস্তাঘাট নোংরা এবং মানুষের মুত্রের দুর্গন্ধে ভরপুর। প্যারিসের দুরবস্থা দেখে বিসমিল্লায় মনটা খারাপ হয়ে গেল। অনেকক্ষণ এদিক ওদিক হাঁটার পর নির্মিয়মান একটা চত্বরের পাশে একটা ছোট রেস্টুরেন্ট খোলা পাওয়া গেল। খাবার ফরাসি, কিন্তু মালিক আরবি এবং পরিবেশন করছিল একটি আরবি ছেলে। ছেলেটি নিজের কাজ জানে এবং তার ব্যবহারও খুব ভালো মনো হলো।

খেতে খেতে সানির কাছ থেকে প্যারিস এবং ইওরোপের হাল-হকিকত জেনে নিলাম বা আগের জ্ঞান ঝালাই করে নিলাম। ইওরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ইওরোপীয় পাসপোর্টধারী বাঙালিরা, বিশেষত মুসলমান বাঙালিরা হন্যে হয়ে ছুটে যাচ্ছে লন্ডনে। সেখানে ছেলে মেয়ে ইসলামী এবং/বা বাঙালি তরিকায় মানুষ হবে, কাজ না করলেও সরকার থেকে ভাতা পাওয়া যাবে স্বামী-স্ত্রী ও প্রতি বাচ্চার জন্যে। বিদেশে থেকে বিদেশের টাকায় পাবেন দেশের মতো সুখ। ‘আপনি কেন যাচ্ছেন না?’ প্রশ্নের উত্তরে সানি যা বললো তা হচ্ছে এই: ‘কাজ করলে প্যারিস বলুন আর লন্ডন বলুন সব শহর সমান। হ্যাঁ, আপনি যদি কাজ না করে ‘মামুর হোটেলে’ খেতে চান অর্থাৎ সরকারি ভাতা নিতে চান আর ‘আন্ডার দ্য ট্যাবল’ অর্থাৎ ক্যাশে কাজ করতে চান তবে লন্ডন অবশ্যই প্যারিস বা ভিয়েনার চেয়ে ভালো।’

প্রসঙ্গত বলি, ইওরোপের ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানী, স্ইুজারল্যান্ড ও উত্তর আমেরিকার কানাডার মতো কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে কাজ না করলেও সরকারি ভাতা পাওয়া যায়, পাওয়া যায় প্রতি বাচ্চার জন্যে মাসিক অনুদান। ফলে অনেকেই কাজকর্ম বাদ দিয়ে লোকদেখানো ধর্মকর্মে রত হয় এবং অফুরন্ত অবসরে রতিচর্চা করে প্রতি বছর গড়ে একটি করে মানব সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখায়। ধরুন পাঁচটি বাচ্চা থাকলে কানাডায় পাওয়া যাবে কমবেশি ২৫০০ ডলার, স্বামী-স্ত্রীর বেকারভাতা কমবেশি ১০০০ ডলার। এর পর যদি সরকারকে না জানিয়ে আপনি কোন কাজ করেন এবং তা থেকে হাজার খানেক ডলার আসে তবে মাস শেষে আপনার নিট আয় ৪৫০০ ডলার। এ টাকার উপর কোনো আয়কর দিতে হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের পকেটেও মাস শেষে এত ডলার থাকে না। বছর বছর বাচ্চা হওয়া সম্পর্কে একটি গল্প এখানে প্রাসঙ্গিক। এক সন্তান-সম্ভবা পাকিস্তানি মহিলা (অবশ্যই পাাকিস্তানি, কারণ গল্পটা শুনেছি এক বাঙালির মুখে!) গাইনি ডাক্তারের কাছে গেছে। ডাক্তার ফাইল ঘেঁটে দেখলেন ১৯৯৫, ৯৬, ৯৭, ৯৭, ৯৯, ২০০০… প্রতি বছর কমপক্ষে একটি করে সন্তানের মা হয়েছেন তিনি। ডাক্তার কৌতুহলী হয়ে জিগ্যেস করলেন: ‘আচ্ছা, ১৯৯৮ সালটা বাদ গেল কেন বলুনতো?’ মহিলা লাজন¤্র মুখে জবাব দিলেন: ‘মাই হাজব্যান্ড হ্যাড এ ব্যাক পেইন।’
রেষ্টুরেন্টের বিল পরিশোধ করে সানিসহ ফিরে যাচ্ছিলাম হোটেলের দিকে। হঠাৎ পিছনে শব্দ শুনে দেখি রেস্টুরেন্টের ছেলেটি হাঁপাতে হাঁপাতে দৌঁড়ে আসছে। সানি একটি ব্যাগ ফেলে এসেছিল রেস্টুরেন্টের টেবিলের নিচে। সেটিই দিতে এসেছে সে। দৈত্যকূলে প্রহ্লাদ! প্যারিসে যাবতীয় চুরি-চামারি-ছিনতাইয়ের নায়ক মনে করা হয় আরবি কিশোর-যুবকদের। মনে পড়ছে, ১৯৯৪ সালে প্যারিসের মেট্রোতে কিছু আরবি ছোকরা ড. আনিসুজ্জমানের সব টাকাপয়সা কেড়ে নিয়েছিল।

হোটেলে ফিরে এসে টোনাটুনি ঘুম দিলাম এবং সেই ঘুম ভাঙলো রাত দশটায়। হায়! প্যারিসে প্রথম দিন অর্থাৎ পুরো উনিশ তারিখটা ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিলাম। অত রাতে আর প্যারিস দেখতে বেরিয়ে লাভ নেই। কিন্তু পেট জানান দিচ্ছে, দুপরের খাবার হজম হয়ে গেছে। হোটেল থেকে বের হয়ে মেট্রোর পাশে একটা ম্যাকডোনাল্ড পাওয়া গেল। সেখানে ফিসবার্গার, পটেটো চিপস আর কোক দিয়ে রাতের খাবার সারা হলো। তখন রাত প্রায় এগারোটা বাজে। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা ঘুরতে বেরিয়েছে উইক-এ্যান্ডের রাতে। বন্ধু বান্ধবীকে নিয়ে এসেছে ম্যাকডোনাল্ডে রাতের খাবারের দাওয়াত দিয়ে। হৈচৈ-হাহা-হিহি করছে প্যারিসের তরুণ প্রজন্ম। যে কোনো রকম উশৃঙ্খলতা সামাল দেবার জন্যে প্রতিটি ম্যাকডোনাল্ডে একটি গাট্টাগোট্টা দারোয়ান থাকে। এখানকার দারোয়ানটি সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল খদ্দেরদের দিকে। সকালে রেষ্টুরেন্টের সেই ওয়েটার ছেলেটিকেও দেখলাম তার সাদা বান্ধবীর সাথে। আমাদের দেখে চিনতে পারলো এবং বললো: ‘বঁসোয়া’ মানে ‘শুভসন্ধ্যা’। একটি মেয়ের কোলে দেখলাম বছর খানেকের বাচ্চা। সম্ভবত কুমারী মা, কারণ তা না হলে এত রাতে বাচ্চা নিয়ে বের হবার অন্য কারণ দেখি না। নতুন বন্ধু দরকার, আবার এত ছোট বাচ্চাকে ঘরে রেখে আসা আইনসঙ্গত নয়, মানবিকও নয়।

পরের দিন প্যারিস দেখতে বের হলাম বাস-ট্রেন-মেট্রোর সারা দিনের টিকেট কিনে নিয়ে। রিপাবলিক জংশনে ট্রেন বদল করতে গিয়ে টিকেট চেকারের হাতে পরলাম। টিকেট দেখাতে হলো। এ ব্যাপারটা সম্ভবত প্যারিসেই আছে। লোকজন টিকেট ছাড়া মেশিনের উপর দিয়ে লাফিয়ে বা অন্য এক যাত্রীর পিছন পিছন ঢুকে যায়। স্টেশন মাস্টার ঠায় তাকিয়ে দেখে, কিছু বলে না। এর পর চোরের দশ দিন একদিন গৃহস্থের। স্টেশন বা জংশনের ভিতরে ট্রেন বদল করার সময় বা ট্রেনের ভিতরে টিকেট চেকার এসে ধরলে মোটা টাকা জরিমানা দিতে হয়।
নামলাম রঁবুতু (Rambuteau) স্টেশনে যেখানে আছে পঁপিদু সেন্টার (Centre Pompidou)। আধুনিক আর্টের সমজদার ফরাসি প্রেসিডেন্ট জর্জ পঁপিদুর নামে এর নাম। ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্যারিসে এসে প্রথম বিকেলেই প্যারিস দেখতে বেরিয়েছিলাম। প্রথমে গিয়েছিলাম ত্রোকাদেরো এলাকায়। মেট্রো থেকে উপরে উঠে হাতের বাঁদিকে ঘুরতেই দেখেছিলাম আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সুবিখ্যাত ইফেল টাওয়ার। দেখে সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ আমি আবিভূত হয়েছিলাম। এর পরেও বহু বার ইফেল টাওয়ার দেখেছি, কিন্তু প্রথম দিনের মত আনন্দ আর পাইনি। ইফেল টাওয়ার দেখিয়ে বন্ধুরা নিয়ে এসেছিল পঁপিদু সেন্টার দেখাতে। মনে আছে, তখন পঁপিদুতে কাদিনস্কির আঁকা ছবির প্রদর্শনী চলছিল। ভবনের গায়ে ঝুলছিল কাদিনস্কির ছবির বিশাল এক প্রতিলিপি।

পঁপিদু সেন্টারে অনেক কিছুই আছে, তবে প্রধানত এটি লাইব্রেরি এবং মডার্ন আর্টের মিউজিয়ম। ছয়/সাত তলা ভবনটির পুরোটাই কাঁচ আর স্টিলের নল দিয়ে তৈরি। শুনেছি, পুরো ভবনটি নাকি পার্ট বাই পার্ট খুলে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া যাবে। বাংলাদেশের বহু ট্যুরিস্টকে এখানে নিয়ে এসেছি। মনে পড়ছে, ১৯৮৫/৮৬ সালে প্যারিসে বেড়াতে আসা বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল্লাহ আবু সাঈদের কথা। পঁপিদু সেন্টারের লাইব্রেরিতে বহু দিন, বহু সন্ধ্যা কেটে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যে কোনো ঝামেলা হলেই পঁপিদু সেন্টারে ব্যাগ চেক করা হতো, ভিতরে বিষ্ফোরক দ্রব্য আছে কিনা দেখার জন্যে। তখন লম্বা লাইন পড়ে যেতো প্রবেশপথে। শীতের দিনে তুষারপাত বা বৃষ্টিপাত উপেক্ষা করে লোকজন পঁপিদুতে ঢোকার জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতো লাইন দিয়ে। এদের মধ্যে লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করবে এমন ছাত্র যেমন ছিল তেমনি ছিল মিউজিয়ম বা নিছক ভবনটি দেখতে আসা ট্যুরিস্টরা।

গত কুড়ি-ত্রিশ বছরে রঁবুতু এলাকাটা অনেক বদলে গেছে। নতুন অনেক দোকান হয়েছে, আগের দোকানগুলো উঠে গেছে। পঁপিদু সেন্টারের সামনে ‘কুইক’ নামে একটি ফাস্টফুডের দোকান ছিল। এখন দোকানটি নেই। সেই দোকানে জীবনের প্রথম বার্গারে কামড় দিয়েছিলাম। কুইক তখন প্যারিসে একমাত্র ফাস্টফুড চেইন, খান তিনেক দোকান হয়তো ছিল পুরো শহরে। ম্যাকডোনাল্ড, বার্গার কিং… এসব দোকান তখনও প্যারিসে আসেনি। নিজেদের খাবারের রান্নার মান, সজ্জ্বা, স্বাদ, পরিবেশন আর পুষ্টির উচ্চ মান নিয়ে ফরাসিরা তখন গর্ব করতো এবং যেনতেন ভাবে বানিয়ে দুমদাম পরিবেশন করা ফাস্টফুড খুব একটা খেতে চাইতো না তারা। হায়! ফরাসি সাহেব আর বিবিদের সেই আভিজাত্য আর নাই। এখন অলিতে গলিতে ম্যাকডোনাল্ড। সব জায়গায় লোক গিজগিজ করছে এবং গণগোলামের দল তুরিয়ানন্দে সেই অখ্যাদ্য খাবার গপাগপ গিলছে।
পঁপিদু সেন্টারের ভিতরে ঢুকে টয়লেটে গেলাম। আগে সব সময় ঝকঝক করতো টয়লেট। এখন দূর থেকে গন্ধ এসে নাকে এসে লাগে, অন্ধও বুঝতে পারে আশেপাশে টয়লেট আছে। পঁপিদুর পাপেত্রি বা স্টেশনারী সেকশনে গিয়ে সুরঞ্জনা কিছু ভিউকার্ড কিনলো। ইওরো হয়ে এখন সব কিছু আগুন দাম এবং কোনো কিছুর মানই আগের মতো নেই। আগে পঁপিদুর এক তলায় হলুদ রঙের ঝুলন্ত নল দিয়ে বানানো মৌচাকের মতো একটি ভাস্কর্য ছিল। এবার সেটি দেখলাম না। আমরা দোতলা বা তিনতলার লাইব্রেরিতে বা আরও উপর তলায় যাদুঘরের দিকে গেলাম না ইচ্ছে করেই। আগের স্মৃতিটুকুই থাক। ভাবি না কেন সব আগের মতো আছে!

বাইরে এক জায়গায় দেখলাম, এক তরুণ শিল্পী তার তার কিছু ছবি টাঙিয়ে রেখেছে লোহার রেলিঙে। কালো রঙে আঁকা ছবি। দাম ২০ থেকে ৪০ ইওরোর মধ্যে। কয়েকটি ছবি সুরঞ্জনা ও আমার খুবই পছন্দ হলো। শিল্পী অনেক বোঝালো, ভালো ছবি, কিনলে আমরা জিতবো বই ঠকবো না। কিন্তু গুচ্ছের ইওরো খরচ না করার সিদ্ধান্ত নিলাম, কারণ আমরা এখানে এবার বেড়াতে এসেছি, থাকতে আসিনি। সামনে আরও কত খরচ আছে কে জানে! শিল্পী একটু মনক্ষুণœ হলো বলে মনে হলো।

ছবির প্রসঙ্গে বছর বিশেক আগে প্যারিস-বাসের সময়কার একটা কথা মনে পড়ে গেল। ১৯৯৪ সালের পহেলা বৈশাখ। প্যারিসের শহরতলীতে ‘সম্মিলনী’ নামে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। যাওয়ার আগে ঘরের নোংরা ফেলতে গেছি আমাদের ছ-তলা বাড়ির নিচ তলায় সিঁড়ির পাশে ডাস্টবিন রাখার জায়গাটাতে। হঠাৎ দেখি পাশে একটি ছবি পড়ে আছে। তেলরঙে আঁকা সূর্যাস্তের ছবি। ছবির নিচে শিল্পীর নাম স্বাক্ষর করা আছে: মিশিগঁ (Michigan)। খুব যে আহামরি ছবি, তা নয়, তবে উল্লেখ করার মতো ব্যাপার হচ্ছে, দিনের আলো বাড়া-কমার সাথে ছবিটিরও যেন রঙ বদলায়। গত বিশ বছর ধরে ছবিটি আমাদের সাথে ঘুড়ছে: প্যারিস-ঢাকা-মন্ট্রিয়ল।
কে এই শিল্পী মিশিগঁ? বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন? তখনও ইন্টারনেট দূর অস্ত। তবে আশির দশকের শেষ দিকে সরকারি টেলিফোন কোম্পানি ফ্রঁস টেলেকম থেকে বিনা পয়সায় ‘মিনিটেল’ নামে একটি যন্ত্র দিত। এখন বুঝতে পারি, সেটা ছিল একটা কম্পিউটার। সেই যন্ত্রে কি-বোর্ডের বোতাম টিপে নানা তথ্য পাওয়া যেতো, কারও ফোন নাম্বার, ট্রেনের টাইম-টেবল ইত্যাদি। ট্রেনের টিকেট বুকিংও করা যেতো। শুধু ফ্রান্সেই সম্ভবত এই যন্ত্র সর্বসাধারণ ব্যবহার করতো। মিনিটেলে টেলিফোন ডাইরেক্টরি খুঁজে মসিও মিশিগঁ-র ঠিকানা খুঁজে বের করলাম। তিনি থাকেন প্যারিসের শিল্পীদের অন্যতম আড্ডা মোমার্তে। পিকাসো, রুশো ইত্যাদি বড় বড় শিল্পীরা মোমার্তে থেকেছেন। মোমার্ত হচ্ছে একটি ছোটখাট পাহাড় যার চূড়ায় আছে প্যারিসের অন্যতম গীর্জা সাক্রে ক্যর (Sacré Coeur)। এর অর্থ: ‘পবিত্র হৃদয়’। অনেক অনেক দিন আগে জায়গাটি ছোট্ট একটি সাধারণ গ্রাম ছিল। এখনও মোমার্তে একটি ছোট আঙ্গুর বাগান আছে এবং সেই বাগানের আঙ্গুর থেকে দামি মদ তৈরি হয়। সাক্রে ক্যর গীর্জায় মা মেরির কোলে যীশুর একটি মূর্তির কথা মনে পড়ছে। শ্বেতপাথরের মূর্তিটিতে যীশুর একটি পায়ে কোন আঙ্গুল ছিল না, বহু যুগ ধরে ভক্তেরা প্রণাম করতে করতে আঙ্গুলগুলো ক্ষয়ে গিয়েছিল। অন্য যে পা-টি মেরি মায়ের শরীরের সাথে লেপটে ছিল সেটি অবশ্য অক্ষত ছিল। ভক্তির চোটে ঈশ্বরের বিকলাঙ্গ হবার অন্যতম উদাহরণ এটি।

একদিন মিশিগঁর স্টুডিয়োতে গিয়েছিলাম সস্ত্রীক নিছক কৌতুহলবশত, পুত্র ঋককে কাঁধে নিয়ে (পুত্র কাঁধ থেকে নামতে চাইতো না, কারণ কাঁধে না বসলে সে নাকি চারদিক ভালো দেখতে পায় না!)। ছোটখাট, সহৃদয় মানুষটি আমাদের সাগ্রহে তাঁর স্টুডিওতে নিয়ে গেলেন। লক্ষ্য করলাম, আমরা যে ছবিটি পেয়েছি সে রকম আরও একটি ছবি দেয়ালে টাঙানো আছে। মিশিগঁ জানালেন, বছর পাঁচেক আগে তিনি সূর্যাস্ত সিরিজের ঐ ছবিগুলো এঁকেছিলেন। একটি ছাড়া বাকি সবগুলো বিক্রি হয়ে গেছে। আমরা অবশ্য ভুলেও তাঁকে বলিনি যে তাঁর একটি ছবি আমরা ডাস্টবিনে কুড়িয়ে পেয়েছি। আমাদের তিন বছরের ছেলে ঋক তখন কম বেশি কথা বলতে পারে এবং খুব বকবক করে। একবার রাস্তায় ফরাসি পুলিশ পেপার চেয়েছিল আমাদের কাছে। ঋক পুলিশকে পালটা প্রশ্ন করেছিল: ‘টয়লেট পেপার?’ আমাদের ভাগ্য ভালো যে ছবিপ্রাপ্তির গোপন কথাটি ঋক মুখ ফসকে মিশিগঁকে বলে ফেলেনি।
কড়া রোদ, এবং বেশ গরম পড়ছিল। একটি কফিশপে বসে এক গ্লাস তাজা কমলার রস (আসলে মাল্টার রস। বাংলায় আমরা যে ফলটিকে ‘মাল্টা’ বলি ফরাসিরা তাকে বলে ‘ওরঁজ’ আর আমরা যাকে কমলা বলি তার নাম ‘ক্লেমন্তিন’) এবং একটি কফির অর্ডার দিলাম। অর্ডার দেবার সময় কানাডীয় অভ্যাসে বললাম: ‘অ্যাঁ কাফে রেগুলিয়ে সিল ভু প্লে’ (একটা রেগুলার কফি, প্লিজ)। ওয়েটার ‘কাফে রেগুলিয়ে’ বোঝে না। অবাক হয়ে জিগ্যেস করলো: ‘ক্যাসক্য সে অ্যাঁ কাফে রেগুলিয়ে, মসিও?’ আমি ঝামেলা এড়াবার জন্যে বললাম, ঠিক আছে একটি সাধারণ কফিই দিন। পরিবেশন করার পর দেখা গেল, কমলার রসের মধ্যে যতটা বরফকুচি আছে রস ততটা নেই। কফিও ঠা-া। ওয়েটার যে পরিমাণ ব্যস্ত তাতে তাকে গরম কফি দিতে বলার সাহস করলাম না। প্যারিস একটা অসভ্য শহরে পরিণত হয়েছে। সার্ভিস নেই, যদিও টিপস দিতে হবে গুনে গুনে। টোকিও-ওসাকার সঙ্গে তুলনা করলে প্যারিসকে নরক মনে হবে। জাপানে টিপস দেবার অপসংস্কৃতি নেই কিন্তু পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সেবা আপনি পাবেন সেখানে।

বিল মিটিয়ে, গুচ্ছের টিপস ওয়েটারের হাতে গুঁজে দিয়ে এগিয়ে গেলাম শাতলে লে আলের (Châtelet Les Halles) দিকে। উচ্চারণ ‘আল’ কিন্তু বানান ঐধষষবং, ফরাসি ভাষায় ঐ-এর উচ্চারণ হয় না চট্টগ্রামি বাংলার মতো। এক সময় লে আল ছিল প্যারিসের পাইকারী বাজার, ঢাকার কাওরান বাজার বা শ্যাম বাজারের মতো। রাতের বেলা পাইকারেরা তাদের মালামাল নিয়ে আসতো আর সকাল বেলা খুচরা ব্যবসায়ীরা সেখান থেকে তাদের মালপত্র কিনে নিয়ে যেতো। সম্ভবত ষাটের দশকে এটিকে একটি পার্কে রূপান্তরিত করা হয়। রকমারী দোকানপাট এখনও আছে এখানে, তবে আন্ডারগ্রাউন্ডে, মাটির নিচে। পাইকারি বাজার চলে গেছে অর্লি বিমানবন্দরের কাছে রানজিস এলাকায়। মধ্য প্যারিসে অবস্থিত লে আল প্যারিস মেট্রোর অন্যতম কেন্দ্রীয় জংশন। দেখলাম, পুরো এলাকাটির সংস্কার চলছে। সংস্কারের পর এলাকাটির কী চেহারা দাঁড়াবে কে জানে তবে আমাদের স্মৃতিবিজড়িত লে আলের সঙ্গে তার খুব একটা মিল থাকবে না তা বলাই বাহুল্য।

রঁবুতু থেকেই খুঁজতে খুঁজতে আসছিলাম জিল্লুর ভাইকে। আমি দ্বিতীয় কিস্তিতে অর্থাৎ ৯২-৯৫ সালে যখন প্যারিস ছিলাম তখন জিল্লুর ভাইয়ের সাথে পরিচয়। বাংলাদেশ বেতারের প্রাক্তন কর্মকর্তা জিল্লুর ভাই ভিউকার্ড-পোস্টার ইত্যাদির দোকানে কাজ করতেন এই লে আল এলাকায়। বিশ বছর পরেও তিনি একই কাজ করবেন সে আশা ক্ষীণ, কিন্তু মনে আশা ছিল, দেখা হলে এখানেই হবে। এবং পড়বি পড়, মালির ঘাড়ে, লে আলে ঢোকার মুখেই দেখা হয়ে গেল জিল্লুর ভাইয়ের সাথে। যখন পরিচয় হয়েছিল তখন জিল্লুর ভাই সদ্য বিয়ে করেছেন আর এখন তাঁর ছেলেমেয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আমি আর সুরঞ্জনার হেমন্তের পাতাঝরা চেহারা দেখে জিল্লুর ভাই হতাশ। জিল্লুর ভাইয়ের কথা শুনে সুরঞ্জনা ততোধিক হতাশ কারণ ‘সবাইতো ছুঁড়ি হতে চায়, তবু কেউ বুড়ি হয়, কেউ হয় না।’ জানি না, জিল্লুর ভাইয়ের মনে কেন এমন ধারণা হয়েছিল যে আমাদের শরীর ও চেহারায় চিরবসন্ত বিরাজ করবে। জিল্লুর ভাই জানালেন, পুরোনো বন্ধুবান্ধব একত্র হলেই কোনো না কোনো প্রসঙ্গে আমাদের কথা উঠে আসে আলোচনায়। শুনে ভালো লাগলো, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, স্মৃতিও প্রজন্ম-নির্ভর। এইতো আর কদিন পর আমাদের প্রজন্মের শেষ পাতাটি ঝরে গেলে আমাদের কথাও বিস্মৃতির তুষারে চাপা পড়বে।

লে আলের পাতালে অর্থাৎ আন্ডারগ্রাউন্ডে ফ্নাক (FNAC) নামে একটি খুব বড় বুকশপ ছিল। এই শব্দটি উচ্চারণ করতে আমার বন্ধুদের কী যে কষ্ট হতো, এফনাক, ফেনাক… ইত্যাদি কত রকম উচ্চারণই না করতো তারা! দোকানটি এখনও আছে এবং একেবারে আগের মতোই আছে। সেই বুকশপে গিয়ে এ্যারিস্টটলের ‘টপিক’ বইটির ফরাসি অনুবাদ কিনলাম। ২০০৫ সালে বইটা খুঁজেছিলাম, পাইনি। মন্ট্রিয়লে ডক্টরেট করার সময় এই বইটা পড়তে আমাকে বাধ্য করা হয়েছিল। টপিকে এ্যারিস্টটল লিখেছেন কিভাবে একটা বিষয়কে জানতে হবে, কীভাবে বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা করতে হবে। যে কোনো গবেষকের জন্য টপিক পড়া অপরিহার্য্য বলে মনে করা হয় ইওরোপ-আমেরিকার কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে।

লেআল থেকে মেট্রো ধরে নামলাম স্যাঁ মিশেল স্টেশনে। এখানে উপরে উঠলেই দেখা যাবে সবুজ জঙপড়া তামার তৈরি স্যাঁ (সেইন্ট) মিশেলের মূর্তি, তিনি লেজ-পাখাওয়ালা, মুখ-হাঁ-করা ড্রাগনের দিকে তরবারি উঁচিয়ে আছেন। নীচে ছোট একটা ঝর্ণা। মূর্তিটিকে পেছনে রেখে সামনে তাকালেই দেখা যাবে স্যেন নদীর উপরে একটি সেতু। এই সেতু ধরে সামনে এগিয়ে গেলে শাতলে লে আল, যেখান থেকে আমরা একটু আগেই এসেছি। মূর্তির পাশে অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট আছে। তার একটিতে বসে দুজনের জন্যে দুটি বীয়রের অর্ডার দিলাম। বীয়র দিল বটে, কিন্তু ঠান্ডা নয়। সার্ভিস যে ভয়ানক রকম খারাপ হয়ে গেছে প্যারিসে তার প্রমাণ আবারও পেলাম। চেয়ারে বসে সোজা তাকাতেই চোখে পড়ছিল নোত্রদামের গীর্জা। নব্বইয়ের দশকে বহুদিন সরবোন থেকে বাসায় ফেরার পথে এই গীর্জার পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়েছি। ভিক্টর হুগোর হাঞ্চব্যাক অব নটরড্যাম, জিপসী মেয়ে এ্যাসমেরাল্দার সেই বিখ্যাত গীর্জা। ত্রয়োদশ শতকের এই গীর্জাটির গথিক স্থাপত্য ইওরোপের বহু গীর্জায় মডেল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। গীর্জার সামনের দিকে দরজার উপরে আছে একটি বড়সড় চক্র। এই চক্রের উপর স্যেন নদীর দিক থেকে আসা পড়ন্ত সূর্যের আলো পড়ে চমৎকার দেখাচ্ছিল। হাতের ডান দিকে তাকাতে দেখলাম, মেট্রোর নির্গমন পথের পাশে ফোল্ডিং চেয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু অল্পবয়সী যুবতী। আপনি চেয়ারে বসলে তারা আপনার ঘাড়-মাথা মালিশ করে দেবে। বিনিময়ে আপনি যা দেন। বলা বাহুল্য, রাস্তায় এ কাজ করার অনুমতি নেই, পুলিশ এসে যখন তখন খেদিয়ে দিতে পারে, নিয়ে যেতে পারে থানায়। তবু (প্রধানত) তরুণীরা বাধ্য হচ্ছে এভাবে জীবিকা অর্জন করতে, কারণ চাকরির বাজার আক্রা।

চেয়ার ছেড়ে উঠতে হলো, কারণ এ শহরে আমরা ঘুরতে এসেছি। স্যেনের সেতুর ওপরে ফুটপাথের পাশে পুরোনো বইয়ের দোকানগুলো বাঁয়ে রেখে স¤্রাট শার্লমাঈনের মূর্তির ডান পাশ দিয়ে নোত্রদামের দিকে এগিয়ে গেলাম। কে এই সম্রাট শার্লমাঈন? শার্ল মাঈন মানে শার্ল ম্যাগনাম অর্থাৎ মহান শার্ল ৮ম শতকের ইওরোপে প্রবল প্রতাপান্বিত স¤্রাট। পুরো জার্মানী, ফ্রান্স, ইটালী জুড়ে তাঁর সাম্রাজ্য। শার্ল মাঈনের মৃত্যুর পর সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে শুরু হলো ঝগড়া। এক ছেলে নিয়ে গেল ফ্রান্স, আর এক ছেলের ভাগে পড়লো জার্মানী। এক দিক থেকে দেখলে এই দুই সহোদরের ঝগড়ার জের চলেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত।

১৯৮৩ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত যখন ছিলাম তখন দেখেছি, বহু যুগের কালো শ্যাওলার আস্তর পড়ে নত্রদামের দেয়ালের রঙ কালচে হয়ে গিয়েছিল। একই রঙ ছিল ল্যুভর মিউজিয়মেরও। প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া মিতেরাঁ যখন দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হন তখনপ্যারিসের পুরোনো স্থাপত্যগুলোর সংস্কার-ঘসামাজা শুরু হয়। ল্যুভর মিউজিয়ামের উঠানে বসানো হয় কাচের পিরামিড। নোত্রদামের গীর্জার সংস্কার শুরু হয়েছিল ১৯৯৪-৯৫ সালে, ২০০৫ সালে রঙের কাজ চলতে দেখেছি। কাজ এখনও চলছে। প্যারিসে সংস্কার কাজ শেষ হতে বহু দিন লাগে।
নোত্রদামের দরজা খোলা থাকলে ভিতরে ঢুকে মান্ধাতার ঠাকুরদার আমলের পুরোনো কাঠের চেয়ারে কিছুক্ষণ বসে বৈকালিক প্রার্থনা শোনা যেত। মোমবাতি কিনে জ্বালিয়ে বসিয়ে দেয়া যেত মা মেরীর মূর্তির সামনে। মানি বা না মানি, যে কোনো শহরে গেলে শহরের আধ্যাত্মিক অভিভাবকদের সাথে দেখা করে আসতে হয়। কলিকাতায় কালীঘাট, টোকিওতো আসাকুজা, দিল্লিতে নিজাম উদ্দীন আউলিয়া ইত্যাদি। কিন্তু নোত্রদাম গীর্জার দরজা বন্ধ, সম্ভবত ভিতরেও সংস্কার চলছে। স্যেনের উপর অন্য একটি সেতু পার হয়ে স্যাঁ মিশেলের দিকে এগুতে শুরু করলাম। এক মহিলা চারপাশে ঘিরে দাঁড়ানো ট্যুরিস্টের দলকে পুতুল নাচ দেখাচ্ছিল। অসুস্থ সুরঞ্জনা বেশিক্ষণ হাঁটতে পারে না। আমরা নোত্রদামের দিকে মুখ করে রাস্তার ধারে ছোট্ট একটা বাগানের রেলিঙে পিঠ দিয়ে বসলাম ওর পা-দুটোকে একটু বিশ্রাম দেবার জন্যে। সুরঞ্জনার পায়ের পাতা আর গোড়ালিতে একটু মালিশ করে দিচ্ছিলাম আমি যাতে আরও অনেকক্ষণ পা দুটো সচল থাকে। সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল টুরিস্টের দল। তাদেরই মধ্যে এক মহিলা তার স্বামীকে টানতে টানতে পিছনে আমাদের সামনে নিয়ে এলো। আমার দিকে ইঙ্গিত করে বললো: ‘দেখো, আর দেখে শেখো কেমন করে বউয়ের যত্ন নিতে হয়!’ তাদের দলের এক অল্পবয়সী মেয়ে আমার দিকে প্রশংসাসূচক বুড়ো আঙ্গুল উঁচিয়ে বললো: ‘গুদ আজবেন্দ’। ‘গুদ’ কারণ, ফরাসি ভাষায় ‘ড’ নেই, আর ‘আজবেন্দ’ কারণ ফরাসি ভাষায় ‘হ’ নেই। কথাগুলো ওরা কষ্ট করে ইংরেজিতে বলছিল, কারণ আমাদের রঙের লোকেরা ইংরেজি বলতে-বুঝতে পারবে ‒ ফরাসিদের কাছে এটাই বেশি স্বাভাবিক।

পার্কটির পাশেই সেক্সপিয়র লাইব্রেরি। দোকানটি ছোট, নতুন আর পুরোনো বইয়ে মাটি থেকে ছাদ পর্যন্ত ঠাসা, পাশাপাশি দুজন হাঁটার জায়গা নেই। বহু যুগ আগের বইয়ের দোকান, কত কত বিখ্যাত লোক এই দোকানে এসে গেছেন তার ইয়ত্বা নেই। এদের অনেকের, যেমন হেমিংওয়ের ছবি ঝোলানো আছে দোকানে। দোকানের সামনে একটি পানীয় জলের ঝর্ণা। প্যারিস মিউনিসিপ্যালিটি পানীয় জল সরবরাহের জন্যে কত যুগ আগে এসব ঝর্ণা বসিয়েছিল জানি না। এ ধরনের ঝর্ণা খুব বেশি আর অবশিষ্ট নেই, এখন জল কিনে খাওয়াই দুস্তর। এক বোতল জলের দাম কমপক্ষে দেড় ইওরো। কানাডায় অবশ্য প্রায় সব জায়গাতেই বিনা পয়সায় পানীয় জল সংগ্রহের ব্যবস্থা রয়েছে। পেটভরে জল খেয়ে অন্য আরও অনেক টুরিস্টের মতো আমরাও খালি বোতল ভরে নিলাম।

প্যারিস শহরের মাঝখানে একটি দ্বীপের মতো জায়গা আছে, দুই পাশ দিয়ে দুটি ক্ষীণ শাখানদীর মতো স্যেন চলে গেছে। সম্ভবত এই দ্বীপেই পত্তন হয়েছি প্যারিস শহরের এবং সম্ভবত এ কারনেই প্যারিসের নাম ‘ফরাসি দ্বীপ’ (ইল দ্য ফ্রঁস)। আশির দশকে পুলিশের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছিল এখানে। ছিল অন্য অনেক সরকারি কার্যালয়। ভিসা নবায়ন করতে আমরা বিদেশিরা এখানেই আসতাম। এর এক পাশে লে আল, আর এক পাশে স্যাঁ মিশেল। আমরা সেই বিকাল থেকেই আছি স্যাঁ মিশেল এলাকায়। এলাকাটার অন্য নাম ল্যাটিন কোয়ার্টার। ১৩শ শতকে এখানেই গড়ে উঠেছিল সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়। এক সময় প্যারিসও ঢাকার মতো ঘিঞ্জি হয়ে গিয়েছিল। স্যেন নদী বুড়িগঙ্গার মতোই পরিত্যক্ত হবার অবস্থায় পৌঁছেছিল। গত শতকে সরকার অধিবাসীদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে এক একটি এলাকার দখল নেয়। তারপর পুরোনো সব ইমারত ভেঙে, প্রথমে প্রশস্ত ব্যুলভার্ড বানিয়ে তার পর দুই পাশে নতুন করে ইমারত তৈরি করা হয়। স্যেনের দূষণ বিংশ শতকের শেষ দশক পর্যন্ত গড়িয়েছিল। আশির দশকেও স্যেনের জলে নামতে নিষেধ করা হতো। বুলভার স্যাঁ মিশেলের দুপাশে এমন কয়েকটি জায়গা আছে যেগুলো সম্ভবত নগর-সংস্কারের আওতার বাইরে রাখা হয়েছিল। সেই রাস্তাগুলো দেখলে বোঝা যায় ঘোড়ার গাড়ির যুগে প্যারিসের অবস্থা কেমন ছিল। খুবই সরু রাস্তা, অনেকটা পুরোনো ঢাকার মতো।

প্রায় ছটা বেজে আসছিল। রাতের খাওয়া সেরে ফেলা দরকার। তুর্কি স্যান্ডউইচের (যাকে জার্মানীতে বলে ডোনাট কাবাব ঢাকায় যার নাম ‘শর্মা’) একটা দোকানে ঢুকলাম। দোকানের মালিক এবং ওয়েটার শ্রীলঙ্কার। বেশ যতœ করে খাওয়ালো। মাংসটা ভালো ছিল, কিন্তু সালাদটা ছিল বাসি। ছেলেটাকে বললাম, অন্য কাস্টমারদের সালাদটা না দিতে। খুব একটা গা করলো না। কানাডা বা জাপানে এ ধরণের আচরণ অকল্পনীয়। খদ্দেরের কথাকে পাত্তা না দেয়া কোনো অর্থনীতির পতন শুরু হবার অন্যতম লক্ষণ।
খাওয়ার পর ল্যাটিন কোয়ার্টারের রাস্তায় উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছিলাম দুজন। হঠাৎ কেমিক্যালের তীব্র গন্ধে নাক বন্ধ হয়ে এলো। রাস্তায় শিল্পীরা স্প্রে কালার দিয়ে ছবি আঁকছে। রঙের যেমন চেকনাই, তেমনই বিশ্রী গন্ধ। ট্যুরিস্টরা তাই কিনছে। কাজটা বেআইনী হলেও পুলিশও কিছু বলছে না। প্রথমত শিল্পীপাড়া, তার উপর বেকারত্ব চরমে।
বুলবার স্যাঁ মিশেলে বহু যুগ আগের হোটেল দ্য ক্লিউনির ধ্বংসাবশেষ পার হয়ে ওদেঅঁর দিকে এগিয়ে গেলাম। রাস্তাঘাটে কোনো টয়লেট চোখে পড়লো না। প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারার জন্যে ম্যাকডোনাল্ডে ঢুকতে গেলে বাধা দিল দশাসই আরবি দারোয়ান। জল বা অন্য কিছু বিয়োগ করতে হলে পেটে কিছু যোগ করতে হবে, অর্থাৎ পয়সা খরচ করে কিছু খাবার কিনতে হবে। আমি লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম কেনার জন্যে, যদিও একটু আগে রাতের খাবার খেয়ে নেয়ার কারণে ক্ষুধা মোটেও ছিল না। কিন্তু টয়লেটে যেতে হলে দারোয়ানকে খাবার কেনার রশিদ দেখাতেই হবে। অগত্যা একটা আইসক্রিম কিনে তার রশিদ দারোয়ানকে দেখিয়ে তবে সুরঞ্জনা টয়লেটে যাবার অনুমতি পেল।

প্যারিসের সর্বত্র এই নীচতা, এই হীনতার ছাপ, যার প্রমাণ এর পরেও আমরা অনেকবার পাবো। বড়লোক যখন গরীব হতে শুরু করে তখন তার ছোটখাট আচরণেও দারিদ্র প্রকাশ পায়। সকালে লে আলে যে ম্যাকডোনাল্ডে গিয়েছিলাম সেখানে টয়লেট ছিল নোংরা, তার উপর মেয়েদের টয়লেটে কোনো টয়লেট পেপার ছিল না। আমি এক গাদা ন্যাপকিন এনে দিয়েছিলাম সুরঞ্জনাকে এবং লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য কয়েকজন মহিলাকে। একজন বাদামী রঙের পুরুষের এই সৌজন্য দেখে মহিলারা একটু অবাক হয়েছিলেন অবশ্যই, কিন্তু তাঁদের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, ন্যাপকিন নয়, হাতে যেন চাঁদ পেয়েছেন তাঁরা। সুরঞ্জনাও জানালো, মহিলাদের একজন নাকি আমার অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। মহিলারা অবশ্য জানতেন না যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টয়লেট ব্যবহার করতে গিয়ে ‘হাতে পানি না পাওয়া’ একজন ভুক্তভোগী শিক্ষকের কাছে ওটুকু সহমর্মীতা তাঁরা আশা করতেই পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের জমজমাট সান্ধ্য আড্ডায় সহকর্মী জহিরুল হক মজুমদার রগড় করে বলেছিলেন: ‘যে বিশ্ববিদ্যালয়ে হেগে পানি পাওয়া যায় না সেখানে আপনি কী আশা করেন?’। প্যারিস একবার ঘুরে গেলে জহির হয়তো তার মত বদলাতেন।

সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বসেছিলাম। মনে পড়ছিল, ১৯৮৩ সালে এখানে ফরাসি ভাষা শিখতে আসার কথা। কোর্স শেষ হবার দিন সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে মোটাসোটা এক ডাচ সহপাঠিনী এখানেই আমার গালে চকাশ করে বিদায়-চুম্বন দিয়ে বলেছিল: ‘আর হয়তো দেখা হবে না!’ হয়ওনি। সামনে ডান দিকের রেষ্টুরেন্টগুলো আগের মতোই আছে। সন্ধ্যা নামছে তখন। সরবোনের দেয়ালের মূর্তিগুলো অস্পষ্ট হয়ে আসছে। বন্ধু প্রশান্তকে সকাল থেকে অনেকবার ফোন করেছিলাম। এবার সে কলব্যাক করলো। ‘গাড়ি নিয়ে আসছি, প্যারিসটা তোমাদের ঘুরিয়ে দেখাবো’। সঁজেলিজে, কনকর্ড, নেপোলিয়নের সমাধি, ল্যুভর মিউজিয়ম, ইফেল টাওয়ার… সব ঘন্টাখানেকের মধ্যে দেখা হয়ে গেল। আমরা গাড়ি থেকে কোথাও নামিনি, কারণ আমাদের দুজনের কারোই এসব জায়গায় কিছু দেখার ছিল না।

পরদিন বাইরে বের হতে হতে এগারোটা বেজে গেলো। ইবিস হোটেলের কাছেই সুরঞ্জনা একটা কম্বোডিয়ান ব্যুফে রেষ্টুরেন্ট আবিষ্কার করলো। জনপ্রতি ১৪ ইওরো করে। রেষ্টুরেন্ট মাত্র খুলেছে, দুই একজন কাস্টমার মাত্র এসেছে। সদ্য রান্না করা খাবারগুলো ভালোই লাগলো। দুপুরের দিকে অনেক খদ্দের এসে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু হলে নিশ্চয়ই আর এই স্বাদ থাকবে না। খাওয়া শেষ করে রেষ্টুরেন্টের উল্টা দিকে উধৎঃু নামে একটা ইলেক্ট্রনিক্সের দোকানে গেলাম। জিনিষপত্রের দাম আমেরিকার তুলনায় বেশি। আশি ও নব্বইয়ের দশকেও এই ডার্টিতে আসতাম আমরা তুলনামূলক কম দামে ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী দেখতে। তখন প্রধানত ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য দেখতাম, কেনার সামর্থ্য ছিল না। ডার্টি তখন দাবি করতো যে তাদের চেয়ে কম দামে কেউ পণ্য বিক্রি করে না ফ্রান্সে। ডার্টির চেয়ে কম দামে বিক্রির প্রমাণ যদি কেউ দেখাতে পারতো তবে ডার্টি তাকে দামের পার্থক্যটা পরিশোধ করতো বা একটা শ্যাম্পেনের বোতলই হয়তো ধরিয়ে দিতো হাতে উপহার হিসেবে।

ডার্টি দেখে আমরা গেলাম Auchan নামক এক সুপার মার্কেটে। নব্বইয়ের দশকে যখন প্যারিসে ছিলাম তখন এই মার্কেটে আমরা বাজার করতে আসতাম। তখন বাংলাদেশ থেকে আসা চোখে মনে হতো সুপার মার্কেটটা খুব বড়, এর পণ্যগুলো খুবই উন্নত মানের এবং দামও কম। এবার আমেরিকা আর জাপান-বাসের অভিজ্ঞতার পর একই দোকানের পণ্যকে খুবই নিম্নমানের মনে হলো, দোকানটিকে খুব একটা বড় মনে হলো না, দামও বেশি মনে হলো। অন্য যত সুপার মার্কেটে গেছি সব জায়গাতেই একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। এমনকি হোটেল দ্য ভিল এলাকার বে-আশ-বে (বাজার দ্য হোটেল দ্য ভিল)-কেও খুব ছোট দোকান বলে মনে হলো। দোষ প্যারিসের নয়, দোষ আমাদের চোখের, আমরা অনেক বেশি দেখে ফেলেছি।এ কারনেই সম্ভবত কমিউনিস্ট সরকারগুলো তাদের দেশের নাগরিকদের ইওরোপ-আমেরিকায় আসতে দিত না।

সেদিন ২১শে জুলাই সুরঞ্জনার এক বান্ধবীর বাসায় যাবার কথা সন্ধ্যায়। বিকেলেই রওয়ানা হলাম। মেট্রোতে কিছুদূর গিয়ে এক জংশনে শহরতলীর ট্রেন RER ধরবো ঠিক করলাম। এক সময় ট্রেন মাটির উপরে উঠে আসলো। বামদিকে বিকেলের মিষ্টি রোদে দেখা দিল স্যেন নদী আর মহিমাময় ইফেল টাওয়ার। এই প্রথম বারের মতো উৎফুল্ল হয়ে ওঠার কারণ ঘটলো প্যারিসে। কিন্তু সে কিছুক্ষণের জন্যে। কতদূর গিয়ে জানা গেল ট্রেন আর যাবে না। মাঝখানের কিছু স্টেশনে কাজ চলছে। সে পথটুকু বাসে যেতে হবে অথবা পেছনে অন্য জংশনে ফিরে গিয়ে ট্রেন ধরতে হবে। বাসে যাওয়া মানেই প্যারিসের ট্রাফিক জ্যামের ঝুঁকি নেয়া। সুতরাং ট্রেনে পশ্চাদপসরণের সিদ্ধান্ত নিলাম। প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের জন্য যখন দাঁড়িয়ে আছি তখন দেখি একটি পঙ্গু কবুতর খুব কষ্টে এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে মাটিতে লেগে থাকা নোংরা চুইংগাম খুঁটছে। দুই দুইটা জলজ্যান্ত মানুষ সামনে দেখেও কপোতবাবাজি এতটুকুও ভয় পাচ্ছেন না। ভয় পাবার উপায়ও হয়তো নেই, পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। কোন খাবার ছিল না আমাদের সঙ্গে, না কোনো চিপস না কোনো বিস্কিট। এভাবে কবুতরকে খাবার দেয়াও অবশ্য বেআইনী। প্যারিসের মেট্রো স্টেশনগুলোতে প্রচুর (জালালী) কবুতর আছে। কিভাবে এই পাতালে খাবার জোগাড় করে ওরা বেঁচে থাকে তা আমার বুদ্ধির অগম্য।

ট্রেন এসে থামলো মফস্বলের এক স্টেশনে। নাম নোয়াজি স্যুর স্যেন অর্থাৎ ‘স্যেন নদীর পারে নোয়াজি’)। এ জায়গার নাম মোঁপাসঁর একাধিক ছোটগল্পে পাবেন। এখানে থাকে সুরঞ্জনার বান্ধবী নাজমা, তার স্বামী শরিফ এবং তাদের দুই ছেলে-মেয়ে। স্টেশনের পাশেই স্যেন নদী। শরীফের কথামতো স্যেন নদীর দিকেই স্টেশন থেকে বের হয়েছিলাম। একটু পরেই শরীফ আর নাজমা গাড়ি নিয়ে আসলো। ওদের বাড়িটা দোতলা, উপর তলার বাড়িওয়ালা থাকে, ওরা নিচ তলায়। বাড়ির সামনে উঠান আছে, পেছনেও জায়গা আছে। মোঁপাসঁর একাধিক ছোটগল্পে প্যারিসের শহরতলীর এ ধরনের বাড়ির বর্ণনা আছে।

তখন রোজার দিন। বিপুল পরিমাণ ইফতারি টেবিলে দেয়া হলো। ইফতারির পর চলে আসলো বহুবিধ খাবার, কয়েক রকম মাছ, মাংস… ভুরিভোজের খান্দানি আয়োজন। খাওয়া শেষ করতে করতেই রাত দশটা বেজে গেল। খাওয়ার পর কফি খেতে খেতে সাড়ে দশটা। শরিফ আর নাজু বললো রাতে থেকে যেতে, সবাই মিলে আড্ডা দেওয়া যাবে। হোটেলের ভাড়া চলছে বলে আমরা রাজি হলাম না। কিন্তু স্টেশনে যেতে যেতে রাত এগারোটা বেজে গেল। রিটার্ন টিকেট পাঞ্চ করে প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দেখি সর্বশেষ ট্রেন সাড়ে দশটায় ছেড়ে গেছে। পরদিন সকালের আগে আর কোনো ট্রেন নেই। বাস সার্ভিস অবশ্য তখনও আছে কিন্তু প্যারিসের বাস কোথা থেকে ছাড়ে তা কেউ ঠিকভাবে বলতে পারলো না। কী করি? অগত্যা শরিফকেই ফোন করা হলো। সে বেচারা মাত্র বাড়ি পৌঁছেছে। আবার তাকে আসতে হলো, নাজু আর তার মেয়েও সাথে আসলো। আমরা সবাই গাড়িতে করে রওয়ানা হলাম বাড়ির দিকে।
শরীফের গাড়িটার গীয়ারে আগে থেকেই সমস্যা ছিল। হঠাৎ গাড়িটার স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। পড়বি পর মালির ঘাড়ে! পাশেই ছিল পুলিশ স্টেশন। গাড়ি আবার চালু করে মোড় ঘুরতেই শোনা গেল পুলিশের গাড়ির হর্ন এবং দেখা গেল লাল-নীল আলোর ঝলকানি। গাড়ি থামাতে হলো। শরিফকে যেতে হলো পুলিশের সাথে। আমরা বাকি চার জন বসে আছি কমিসারিয়েট অর্থাৎ থানার ওয়েটিং রুমে। অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও বুলেট-প্রুফ জ্যাকেট-পরা নারী ও পুরুষ পুলিশ সদস্যেরা ঢুকছেন, বের হচ্ছেন। এই অস্বস্তিকর অবস্থা চললো ঘণ্টা দেড়েক। শরীফ-নাজুর মেয়ের বয়স বছর দুই-আড়াই, বাপ-অন্ত প্রাণ। সে ভয় পাচ্ছিল খুব এবং বার বার বাবার কি হলো জানতে চাইছিল। আমরা এক আধটু প্রার্থনাও শুরু করলাম মনে মনে যে যার মতো। আমাদের করুণ অবস্থা দেখে দয়াপরবশ হয়েই যেন পাশ দিয়ে যাবার সময় এক পুলিশ সদস্য নির্লিপ্তভাবে বলে গেল: ‘তোমাদের যন্ত্রণার অবসান হবে শীঘ্রই।’ শুনে খুব একটা ভরসা পাবার মতো অবস্থায় আমরা কেউ ছিলাম না। পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা! কিছুক্ষণ পর শরিফ ফিরে আসলো। গাড়ির ফিটনেস নেই, সুতরাং গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফেরা যাবে না। আমাদের হেঁটে বাড়ি ফিরতে হলো। এর চেয়ে অনেক বেশি বিপদের আশঙ্কা করেছিলাম আমরা। দয়াময় ঈশ্বর যে আমাদের মতো দ্বিধাগ্রস্ত ভক্তের প্রার্থনা শুনেছেন তাতে আর সন্দেহ কি!

বাসায় ফিরে জামাকাপড় ছেড়ে সুরঞ্জনা তার বন্ধুদের সাথে আড্ডা শুরু করলো। আড্ডার বিষয়বস্তু দাম্পত্যজীবনের নানা সমস্যা, স্বামী-স্ত্রীর পারসোনালিটি ক্ল্যাশ ইত্যাদি। প্রেম কেন উপন্যাস বা সিনেমার মতো বসন্তের বাতাসে নদীর জলের মতো কুল কুল রবে বয়ে চলে না? স্বামী বা স্ত্রী কেন একে অপরের উপর তাদের মতামত চাপিয়ে দেয়? কেন বাড়ির নেমপ্লেটে স্বামীর নাম স্ত্রীর নামের আগে থাকবে? কেন নদীর ধারে বেড়াতে গেলে স্বামী তার স্ত্রীর হাত ধরে হাঁটবে না, অথচ বান্ধবী হলে ঠিকই হাঁটবে এবং ঘনঘন জড়িয়ে ধরে চুমু খাবে? কোথাও বেড়াতে গেলে শুধু স্ত্রীই বা কেন বাচ্চা কোলে নেবে? এত সব কঠিন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ভার অন্যদের উপর ছেড়ে দিয়ে আমি শুয়ে পড়লাম এবং বরাবরের মতোই অনতিবিলম্বে ঘুমিয়ে পড়লাম। বাকিরা সম্ভবত সে রাতে ঘন্টাখানেকের বেশি ঘুমাতে পারেনি। সকালে নাস্তার টেবিলেও উক্ত বিষয়ক তর্ক অব্যাহত ছিল যদিও কেউ কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি।
পরদিন সকালে শরিফ বাসে তুলে দিল। শহরতলীর দীর্ঘ রাস্তা পারি দিয়ে প্লাস দিতালিতে নেমে মেট্রো ধরলাম। এমন সময় সানি ফোন করে একজনের সাথে কথা বলতে বললো। কণ্ঠ শুনেই চিনলাম: জলি আপা! ২৪ বছর আগে বিয়ের অব্যবহিত পরে আমরা যখন ঢাকার রাজাবাজারে আজিজ মঞ্জিলে থাকতাম তখন জলি আপা ও তার পরিবার আমাদের প্রতিবেশি ছিল। আজিজ মঞ্জিল ছিল পূর্ব রাজাবাজারের প্রথম বাড়িগুলোর একটি। প্রায় বিশ কাঠা জায়গার উপর বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। খান চারেক রুম, সামনে পেছনে বারান্দা, বাগান, আলাদা রান্না ঘর। বাড়িটিতে নাকি ষাটের দশকে কবরি-শবনমকে নিয়ে বাংলা ছবির শুটিংও হয়েছে। আমি তখন গ্রামীণ ব্যাঙ্কের উপর এক সিনেমা প্রজেক্টে কাজ করতাম। আজিজ মঞ্জিল ছিল সেই প্রজেক্টের অফিস। আমরা থাকতামও সেখানে। প্রজেক্ট-প্রধান কানাডীয় নাগরিক গ্যারি বেলকিন বাড়িটিকে বেশ নবাবি ঢঙে সাজিয়েছিলেন, বড় বড় তাকিয়া ইত্যাদি দিয়ে। বাগানটাকেও ঢেলে সাজিয়েছিলেন। অনেক আম-নারিকেল বাতাবি লেবু-কাঁঠালের গাছ ছিল সেই বাড়ির সামনে ও পেছনে। এই গাছের আম-কাঁঠাল গ্রামীণ ব্যাঙ্কের ডক্টর ইউনুসকেও খাইয়ে এসেছি কয়েক বার। ১৯৯২ সালে দ্বিতীয়বার প্যারিস যাবার প্রাক্কালে বাড়িটি আমরা ছেড়ে দিয়েছিলাম।

কেমন করে জলি আপা খুঁজে পেলেন আমাদের? সানিকে প্রথম দিনই আমার বই ‘কথাকলি’ উপহার দিয়েছিলাম। সেই বইয়ের প্রচ্ছদে শিল্পী সৈয়দ ইকবাল আমার আপত্তি সত্বেও আমার ছবি ব্যবহার করেছিলেন। সানির সঙ্গে জলি আপার প্যারিসেই পরিচয় হয়েছিল। কীভাবে যেন সেদিনই আপার সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায় রাস্তায় বা কোনো অফিসে। সানির হাতে থাকা কথাকলির প্রচ্ছদে আমার ছবি দেখে জলি আপা সানিকে বলে তৎক্ষণাৎ আমাকে ফোন করতে। কাকতালীয় ব্যাপার! জলি আপার হুকুম, তাঁর বাসায় আসতেই হবে আমাদের সন্ধ্যায়, যদি না আসি তবে নাকি সানির বিপদ আছে! গেলাম এবং গিয়ে দেখলাম, আপা আগের মতোই আছেন। আমাদের জন্যে শুটকি, মাছ, মাংস ইত্যাদি আরও কত কত পদ রান্না করে রেখেছেন। মেয়ে কারিশমা চমৎকার ফরাসি বলে, প্যারিসের একসেন্টে। ৯৩ সালের আড়াই বছর বয়সী মেয়েটি চব্বিশ বছর পর আমাদের চিনতে পারলো না, বলাই বাহুল্য। জলি আপার ফরাসি স্বামীও বাংলা শিখেছেন। প্রচূর ঝাল দিয়ে রান্না করা শুটকিও আনন্দ সহকারে খেতে দেখলাম তাঁকে। পুরোনো দিনের স্মৃতি চারণের পর সর্বশেষ মেট্রো এবং ট্রাম ধরে গভীর রাতে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম।

পরদিন ট্রেনে করে আমাদের সুইজ্যারল্যান্ড যাবার কথা। দুপরে খাবার পর পাশের সুপারমার্কেট ওশঁ-তে গেলাম। উদ্দেশ্য কিছু স্যান্ডউইচ, পানির বোতল ইত্যাদি কিনে নিয়ে ট্রেনে উঠবো, কারণ স্টেশনে বা ট্রেনে খাবারের আগুনদাম হবে। ঢোকার মুখেই লাগলো ঝামেলা। দারোয়ানা ব্যাটা আমাদের কোনো ব্যাগ নিয়ে মার্কেটের ভিতরে ঢুকতে দেবে না, যদি ব্যাগে ঢুকিয়ে কিছু নিয়ে আসি দাম না দিয়ে! ব্যগের মুখটা তারা বন্ধ করে দেবে প্ল্যাস্টিকের দড়ি দিয়ে। বেরুবার সময় আবার কাস্টমারকেয়ারে এসে সেই দড়ি কাটিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ভিতরে কোনো মাল কিনলে, সেই মাল বহনের জন্যে ওদের ব্যাগ কিনতে হবে। সুরঞ্জনা ব্যাগ কিনতে রাজি নয়, কারণ শুধু শুধু ইওরোর শ্রাদ্ধ। এদিকে আমাদের ব্যাগও আমরা খুলতে পারছি না। সব মিলিয়ে ছোটলোকির চূড়ান্ত। রাগে ফেটে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু রাগ করার ফুসরৎ ছিল না। মনে মনে ফরাসিদের বাপ-মা তুলে গালাগালি দিতে দিতে হোটেলে ফিরলাম।
ট্যাক্সি করে যাবার সময় এমন ট্র্যাফিক জ্যাম ছিল যে দশ মিনিটের রাস্তা যেতে চল্লিশ মিনিটের উপর লাগলো। ভয় হচ্ছিল, ট্রেন না ফেল করি। পড়ি কি মরি করে গার দ্য লিওঁর প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দেখি, আমাদের ট্রেন ত্রিশ মিনিট লেট আছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এই স্টেশন থেকে ৮৭-৮৮ সালে বহুবার বার্গান্ডির ট্রেন ধরেছি। এখন অবশ্য এই স্টেশনটি অনেক আধুনিক হয়ে গেছে। এক জায়গায় মালপত্র রেখে দাঁড়িয়ে আছি। ট্র্যাডিশনাল পোষাক পড়া এক আফ্রিকান মহিলা দাঁড়িয়ে ছিল সামনে আমাদের দিকে পিঠ দিয়ে। চিকনের কাজ করা লাল কাপড়ের ভিতর দিয়ে দৃশ্যমান আবলুস কালো পিঠ থেকে কলসের কাঁদার মতো উঠে যাওয়া লম্বা ঘাড়টি অপরূপ লাগছিল দেখতে। আলফ্রেড নোবেলের ‘নেমেসিস’ নাটকে নায়িকা বিয়াত্রিচকে শয়তান বলেছিল, ‘ঈশ্বরের শিল্পীসত্ত্বা ঈর্শনীয়। কী দারুণ সব জিনিষ তিনি বানিয়েছেন!’ অলক্ষ্যে পরনারীর সৌন্দর্য্য আস্বাদনে বাধ সাধলো শয়তানেরই এক চেলা, এক আরব ছোকরা, যে কিনা স্যুটকেসের ওপরে রাখা আমার কোটটা স্কন্ধস্থ করে নীরবে চম্পট দিচ্ছিল। সেই কোটের পকেটেই ছিল আমার পাসপোর্ট-টাকাপয়সা। কী বিপদেই না পড়তে যাচ্ছিলাম! সুরঞ্জনা সময়মতো সতর্ক হওয়াতে রক্ষা। ভাগ্যিস পরনারীর গ্রীবাদর্শনে সুরঞ্জনা মোটেও উদগ্রীব নয়! ‘আমারও এ রকম একটা কোট আছে। ভুল যে কারও হতে পারে!’ হাতসাফাইয়ে ব্যর্থকাম চোর নিজের সাফাই দিয়ে সুড় সুড় করে যাত্রীর ভিড়ে মিশে গেল।

ঘন্টায় তিন শ কিলোমিটার বেগে ছুটে চলছিল TGV (Train à Grande Vitesse) নামক ট্রেন বুরগঈন (Bourgogne) বা বার্গান্ডির ছবির মতো ল্যান্ডস্কেপের বুক চিরে। উঁচু-নিচু গমের ক্ষেত, মাঝেমাঝে সর্ষেক্ষেত আর বনভূমির হলুদে-সবুজে মেশানো চৌকোনা দাবার ছকের ট্যাপিস্ট্রি। এখানে ওখানে চরছে স্বাস্থ্যবান গরু। বহু স্মৃতি মনে পড়ছিল। আশির দশকের শেষে প্রায় দুই বছর ছিলাম আমি বার্গান্ডির জোয়াইনি নামক এলাকায়। এক ডক্যুমেন্টারি সিনেমা-কোম্পানিতে ভিডিও ক্যামেরায় শব্দ ও চিত্রগ্রহণের কাজ শিখছিলাম। এই কোম্পানির প্রেসিডেন্ট ছিলেন মাদাম পল দ্যুফ্রতে। মারা গেছেন নব্বইয়ের দশকের শেষে। ওঁর স্বামী তথ্যচলচ্চিত্রকার গ্যারি বেলকিনও দেহ রেখেছেন ২০১৩ সালে। পলের বাবা মসিয় দ্যুফ্রতে ছিলেন কাছের এক গ্রামের জমিদার। ১৯৮৭ সালের ক্রিসমাসে সেই জমিদার বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়েছিলাম। পলের মা জমিদার-গিন্নী তখনও বেঁচে। উনি বিশেষভাবে বলে দিয়েছিলেন, আমাকে নিয়ে যেতে, কারণ যীশুর জন্মের খবর শুনে প্রাচ্যদেশ থেকে মেজাই বা জ্ঞানী ব্যক্তিরা উপহার নিয়ে এসেছিলেন। সুতরাং প্রাচ্য দেশের একজন অধিবাসী ক্রিসমাসে অতিথি হয়ে আসবে এটাতো কোনো খ্রিস্টান পরিবারের জন্য পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার! সুস্বাদু ক্রিসমাস টার্কি কেটে প্রথমে আমার প্লেটেই দেয়া হয়েছিল। চীনামাটির খানদানি প্লেট। ছুরি আর চামচ ছিল রূপার। খানদানি আচার-ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলাম না। প্লেটের সাথে কাঁটা চামচের টংকারে বিব্রত হয়ে ‘পারদোঁ’ (Pardon) অর্থাৎ ‘মাফ করবেন’ বলতে যাবো, এমন সময় দেখি, টিকেট চেকার আশে পাশের যাত্রীদের টিকেট পাঞ্চ করছে। পাঞ্চমেশিনের খটাংখট শব্দই স্বপ্নে কাঁটা চামচের শব্দে পরিণত হয়েছিল। স্মৃতিচারণ করতে করতে প্রাচ্যদেশীয় জ্ঞানী ব্যক্তি ধ্যানস্থ হয়ে পড়েছিলেন।

বার্ন শহরে পৌঁছতে রাত প্রায় এগারোটা বেজে গেল। সাদামাটা, পুরোনো স্টেশন। সুরঞ্জনার নাকি তখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না সে অবশেষে সুইজারল্যান্ডে এসেই পড়েছে। দিনটা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে ঘন্টাখানেক পর ইওরোপীয় মতে ২৩শে জুলাই অর্থাৎ সুরঞ্জনার জন্মদিন শুরু হয়ে যাবে। কোনো উপহার কেনার কথা আমার মনে থাকে না। বললাম, ‘এই সুইজারল্যান্ড ভ্রমণটাকেই জন্মদিনের উপহার বিবেচনা করো।’ স্টেশনের নির্গম পথের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে চোখে পড়লো দক্ষিণ এশীয় জাতভাইরা এদিকে ওদিকে সাফাইয়ের কাজে ব্যস্ত। ভাবলাম হায়, এই চাকুরিও আমার জোটেনি এক সময় প্যারিসে। স্টেশনের এক কোনে দাঁড়িয়ে থাকা দুই পুলিশের একজনকে হোটেলের ঠিকানা দেখাতেই সে ইংরেজিতে অতি সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিল কীভাবে যেতে হবে। সুইস উচ্চারণের ইংরেজির কিছুটা বুঝলাম, কিন্তু পুরোটা নয়। জায়গাটা কাছেই, কিন্তু ভাবলাম, এত রাতে তিন তিনটি লাগেজ নিয়ে পদব্রজে হোটেলে যাওয়া সমীচীন হবে না।

স্টেশন থেকে বের হয়ে হাতের বামদিকে ট্যাক্সিস্ট্যান্ড দেখা গেল। সেখানে দাঁড়ানো প্রথম ট্যাক্সি-ওয়ালাটি সব মালপত্র যতœ করে ট্যাক্সিতে তুলে নিল এবং মিনিট দুয়েকের মধ্যেই পৌঁছে দিল লা প্যারগোলা (La Pergola) নামক হোটেলে। ট্যক্সিওয়ালা আসলাম পাকিস্তানি। যেতে যেতে আসলাম বলছিল যে সুইজারল্যান্ডে আর আগের মতো সুখ নেই। চারদিক থেকে লোকজন এসে ভরে গেছে। দুনিয়ার সব জায়গায় যুদ্ধ লেগেই রয়েছে আর উদ্বাস্তুদের আসারও বিরাম নেই। পর দিন এক রাশিয়ান ইমিগ্র্যান্টও সুরঞ্জনাকে বলেছিল, সদ্য-আসা বিদেশিরা নাকি এতই অপরাধপ্রবণ যে সুইসরা অতিষ্ট হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, তারা নাকি কুবুদ্ধি দিয়ে দিয়ে (ধরুন, কীভাবে ট্যাক্স ফাঁকি দিতে হবে, অপরাধ করে তা লুকাতে হবে…) সুইসদেরও অপরাধপ্রবণ করে তুলছে। অসৎসঙ্গে সর্বনাশ!

প্যারগোলায় ল্যাপটপ চালু করতেই দেখলাম ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের পরিচালক অলিভিয়ে লিতভিনের এক ই-মেল এসে হাজির হয়েছে। ফরাসি বুদ্ধিজীবী ব্যার্নার অঁরি লেভি ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের উপর একটি বই লিখেছিলেন: লেজেন্দ রুজ। বইটি অনুবাদ করতে হবে বাংলায়। আমি রাজি হলাম এবং অ্যামাজোনে বইটি অর্ডার দিলাম। বইটি ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হচ্ছিল’ শিরোনামে। প্রকাশক ঢাকা আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ।

প্যারগোলায় ব্রেকফাস্টের সময় সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত। উদরপূর্তির উদার আয়োজন। কয়েক রকম পনির, মাংসের মধ্যে সসিজ, বেকন ছিল। ছিল দুধ, দই, কয়েক রকম কর্নফ্লেক্স, কয়েক রকম রুটি, সুপ, কয়েক রকম তাজা ফলের রস, একাধিক রকম ফল, আরও কত কি। আমেরিকান এবং কন্টিনেন্টাল —ব্রেকফাস্টের এই দুই ধরনের ব্যবস্থাই ছিল। ছিল সুইস কফি। আগে ভাবতাম, প্যারিসের কফি সবচেয়ে ভালো। এবার দেখলাম, সুইস কফি কোনো অংশে কম যায় না। ওয়েটার স্পেনিশ দেশীয়, কিন্তু তিনি জার্মান, ফরাসি, ইংরেজি, স্পেনিশ — এই চারটি ইওরোপীয় ভাষা প্রায় মাতৃভাষার মতোই বলতে পারেন। খুবই সহৃদয় ছিলেন ভদ্রলোক। একটা দেশ সভ্যতার একটা বিশেষ পর্যায়ে না গেলে একজন ওয়েটারের শিক্ষা ও সহবৎ এই পর্যায়ে যেতে পারে না।

পেট-কিস্তি খেয়ে নিয়ে অফিসের দিকে রওয়ানা হলাম। হোটেলের পাশে একটি পার্ক। পার্কের এক কোনায় গিয়ে রাস্তায় ৯ নম্বর ট্রাম ধরতে হবে। ট্রামে টিকেট কেনার ব্যবস্থা নেই জানতাম না। টিকেট নাকি কিনতে হবে ট্রাম স্টপেজে। টিকেট ছাড়া যাই কী করে? পরের স্টপেজে নেমে ক্রেডিটকার্ড ব্যবহার করে টিকেট কিনলাম। কয়েক মিনিট পরেই আবার ট্রাম এলো। ট্রাম এক সময় শহরের সীমা পার হয়ে শহরতলীতে ঢুকে পড়লো। হাতের ডানে আর বাঁয়ে ফসলের ক্ষেত এবং ছোট ছোট পাহাড়ের ঢালে ছবির মতো সব বাড়িঘর। এক জায়গায় বাঘ-সিংহ জাতীয় পশুর উৎকট গন্ধ এসে নাকে লাগলো। পরে শুনেছিলাম, বার্নের চিড়িয়াখানা নাকি পাশেই কোথাও ছিল।

যে অফিসে আমাকে যেতে হবে সেটা ট্রামের শেষ স্টপেজে। রিসেপশানে রিপোর্ট করতেই অফিস থেকে একজন কর্মচারি এসে আমাকে ভিতরে নিয়ে গেল। অফিসের কর্তাব্যক্তিরা একে একে এসে পরিচিত হয়ে গেলেন। ড্রেস-কোড আছে মনে করে আমি কোট, জুতা ইত্যাদি পড়ে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখলাম, অহেতুক আমি এত সাজগোজ করেছি। কর্মচারিরা সবাই অতি সাধারণ পোষাকেই ছিলেন। কিছুক্ষণ কাজ করার পর তাঁরা বললেন, আমাদের এই বিশ্রী দালানে বসে কাজ করতে আপনি বাধ্য নন। আপনি ইচ্ছে করলে হোটেলে ফিরে যেতে পারেন আপনার স্ত্রীর কাছে। ওখানে গিয়েও কাজ করতে পারেন আপনার ল্যাপটপে। উত্তম প্রস্তাব। হোটেলে ফোন করে জানা গেল, ম্যাডাম বেরিয়েছেন। ভাবলাম, এই সুযোগে শহরটায় একটা চক্কর দিয়ে আসা যাক। স্টেশনের সামনের রাস্তাটাই আসলে ডাউন টাউন বা মূল শহর, যা সাকুল্যে এক বর্গ কিলোমিটার হবে কিনা সন্দেহ। স্টেশনের উল্টো দিকে একটা বড় সুপারমার্কেট আর একটা বড় রাস্তার দুপাশে শ খানেক দোকান। জিনিষপত্রের দাম আমার নাগালের এতটাই বাইরে যে কোনো কিছু কেনার দুঃসাহস করলাম না।

ঐদিন রাতেই ভিয়েনা থেকে গাড়িতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে দুই ছেলে নিসর্গ ও শব্দকে নিয়ে সুরঞ্জনার ছোট বোন সুপর্ণা আর প্রতাপ এসে পৌঁছে গিয়েছিল বার্নে। ওদের হোটেল আমার অফিস থেকে ফেরার পথেই পড়ে। পরদিন ওদের সাথে আবারও ডাউনটাউনে বেড়াতে গিয়েছিলাম। যেতে যেতে অবশ্য বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। সাতটার দিকেই সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় বার্ন শহরে। তারপর সব সুনসান। এমনিতেও অবশ্য লোকজন খুব একটা দেখা যায় না রাস্তাঘাটে। ছোট্ট, খুব ছোট শহর বার্ন। ডাউন টাউনটা পায়ে হেঁটে দেখতে ঘণ্টাখানেকের বেশি লাগার কথা নয়। এদিকে ওদিকে বিভিন্ন দেশের দূতাবাস, সব কাছাকাছি। পরদিন আমি অফিসে যাবার পর পরিবারের বাকি সদস্যেরা সুইজারল্যান্ডের পার্লামেন্ট ভবন দেখতে গিয়েছিল। আমি গাড়ি থেকে নিচের উপত্যকায় পার্লামেন্ট ভবনটি দেখেছিলাম। বিহগদৃষ্টিতে ভবনটা মোটামুটি সুন্দরই লেগেছিল।

বিকেলে বার্ন শহরের রাস্তায় ঘোরার সময় দেখা গেল, এক গাছের নিচে একটা রোলার স্কেট পড়ে আছে, রোলারের রোমান অক্ষরে ‘সুইস’ কথাটি লেখা। হয় কোনো বাচ্চা ভুলে রেখে গেছে বা ফেলেই দিয়েছে পুরোনো হয়ে গেছে বলে। নিসর্গ আর শব্দ রোলারটা চালালো রাস্তায় এবং আমরা দ্বিধাগ্রস্ত মনে রোলারটা তুলে নিলাম আমাদের গাড়িতে সুইজারল্যান্ডের স্মৃতি হিসেবে। সন্ধ্যায় আমরা খেতে গিয়েছিলাম আমাদের হোটেলের পাশে এক কম্বোডিয়ান-চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। মা আর ছেলে মিলে রেস্টুরেন্ট চালায়। খাবার যে খুব একটা ভালো তা নয় তবে ওয়েটারের ব্যবহার ভালো ছিল। ওয়েটার জার্মান, ফরাসি, ভিয়েতনামি, চাইনিজ বলতে পারে। মনে আছে, একটা তরকারিতে একটু ঝাল দিতে বলাতে সে তরকারিটা শ্রেফ মরিচবাটা দিয়ে ঘেঁটে এনেছিল। উঃ সে কী ঝাল, এবং বিল হাতে পাবার পর দেখলাম, সে কী দাম! বার্নে তৃতীয় রাতে আমরা একটা ইটালিয়ান রেস্টুরেন্টে পিজ্জা খেয়েছিলাম। পিজ্জার স্বাদ ভালো ছিল, আমেরিকান পিজ্জার চেয়ে আলাদা স্বাদ, কিন্তু সে স্বাদ ইটালির পিজ্জার আসল স্বাদ কিনা জানি না।

আমার মনে হয়, পৃথিবীতে রান্নার দুটো উল্লেখযোগ্য ঘরানা আছে: ফরাসি আর ভারতীয় (বাঙালি রান্নাসহ)। একটি ঘরানায় হাজার হাজার রান্না থাকা উচিত, একটি আরেকটির চাইতে আলাদা। আমি মনে করি, ফরাসি আর ভারতীয় ছাড়া বাকি সব কমবেশি শুধু ‘ঘাঁটা’, ‘রান্না’ পদবাচ্য নয়। আগে চাইনিজ রান্নাকেও একটা ঘরানা বলে মনে করতাম। চীন-থাই-ভিয়েতনামি-কম্বোজ রান্না দক্ষিণ-পূর্ব বা পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে গিয়ে খাইনি কখনও। জাপানে গিয়ে জাপানি রান্না অবশ্য খেয়েছি। সব মিলিয়ে চাইনিজ রান্নাটাকে ঘাঁটার উর্ধ্বে কিছু ভাবতে পারছি না আপাতত। তবে যদি কোনো একদিন আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয় তবে একেবারে অখুশি হবো না এটাও বলে রাখলাম।

বার্নে শেষ দুপুরে অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজন করেছিলাম। সেখানে এক কর্মকর্তার মুখে শুনলাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্নে কোনো বোমাহামলা হয়নি। সুতরাং পুরোনো সব ভবন অটুট রয়ে গেছে এবং সমস্যা সৃষ্টি করছে? কী রকম সমস্যা? এই ভবনগুলো এখন হেরিটেজ বলে ভাঙা যাচ্ছে না, অথচ এগুলো দিয়ে কাজও চলছে না। যেমন ধরুন, বার্নের প্রাচীন থিয়েটারের সিটগুলো পরস্পরের এত কাছাকাছি যে বসতে গেলে দর্শকের হাঁটু আটকে যায়। গত পঞ্চাশ বছরে খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার পরিবর্তনের কারনে মানুষের গড় উচ্চতা বেড়েছে, হাঁটুর দৈর্ঘও বেড়েছে। অথচ দুই সিটের মধ্যকার দূরত্ব বাড়ানোর কোনো উপায় নেই। ঐতিহ্য বলে কথা!
চতুর্থ দিন দুপুরে প্রতাপ আমাদের সবাইকে নিয়ে জুরিখ রওয়ানা হলো। যেতে লাগলো ঘন্টা চারেক। একটা বড়সড় লেকের দুই ধারে গড়ে উঠেছে জুরিখ শহর। লেকে ঘণ্টাখানেক লঞ্চ-ভ্রমণে দুই পাশের বাড়িঘর দেখা গেল। বাড়িঘর দেখে মনে হলো এক সময় লেকের একদিকে গরীব আর অন্যদিকে বড়লোকেরা বসবাস করতো। এখন সে পার্থক্য যে ততটা নেই তা বাড়িঘর দেখেই বোঝা গেল। জুরিখে লেকের ধারে পশ্চিমবঙ্গের একটি পরিবারের সাথে দেখা হয়েছিল। ওঁরা ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্ট খুঁজছিলেন রাতের ডিনারের জন্য। বার্নেও একটি ভারতীয় পরিবারের সাথে দেখা হয়েছিল যারা ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্ট খুঁজছিলেন। কেন যে বিদেশে গিয়েও দেশি খাবার খেতে হবে তা আমার মাথায় ঢোকে না। যে দেশে গেলাম সে দেশের খাবার যদি চেখে না দেখি তবে সে দেশটাকে জানা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

রাতে আমরা আবার বার্ন শহরে ফেরৎ গিয়েছিলাম। পরদিন জার্মানি হয়ে আমরা ভিয়েনা গিয়েছিলাম। যাত্রাপথে লেগোল্যান্ড বলে একটা বিনোদন পার্ক আছে। বাচ্চাদের খেলার জন্যে প্ল্যাস্টিকের যে লেগো পাওয়া যায় বাজারে সেই লেগো দিয়ে তৈরি: সুপারম্যান, আয়রনম্যান ইত্যাদি সুপারহিরো থেকে শুরু দশাশই আকারের ফারাওঁয়ের মূর্তি, সাপ, শয়তান, বায়্যান-মুনশেন স্টেডিয়াম, রেলওয়ে স্টেশন, জার্মানির গ্রাম… কী নেই লেগোল্যান্ডে। সব মূর্তি ছোট ছোট লেগো একটার উপর একটা বসিয়ে তৈরি। লেগোল্যান্ড ডিজনিল্যান্ডের মতো বড় নয় কিন্তু ডিজনিল্যান্ডের বেশ কিছু আইটেম এখানে আছে। তাছাড়া পরিসর যেভাবে বাড়ানো হচ্ছে অচিরেই এর আয়তন ডিজনিল্যান্ডের মতো হয়ে যাবে। দুপুরে আমরা পাম বা সুপারিগাছের খোলের তৈরি থালায় ইন্ডিয়ান কারি দিয়ে ভাত খেয়েছিলাম। রাত নয়টায় লেগোল্যান্ড বন্ধ হবার আগে প্রায় আধঘণ্টা ধরে আকাশে আতশবাজির অপূর্ব ফুলঝুরি দেখার সৌভাগ্য হলো। সৌভাগ্য, কারণ এই আইটেমটি নাকি সব দিন থাকে না।

রাত এগারোটায় প্রতাপের গাড়ি থামলো মিউনিখের শেরাটন হোটেলের সামনে। কী ব্যাপার? না ভুল হয়নি, আজ রাতটা আমরা শেরাটনেই কাটাবো। বেলকিনদের সঙ্গে তথ্যচিত্রের কাজ করার সময় ১৯৮৭-৮৮ সালে ঢাকার শেরাটন হোটেলে অনেক ‘দিন’ কাটিয়েছি, কিন্তু ‘রাত’ কাটানোর অভিজ্ঞতা এই প্রথম এবং অভিজ্ঞতাটি হলো প্রতাপের বদান্যতায়। প্রতাপ সব সময় বন্ধু বা আত্মীয়-স্বজনদের সারপ্রাইজ দিতে পছন্দ করে। আমরা অবাক হলাম, একটু বেশিই হলাম। ‘দাম?’ ‘একটি রাতইতো, দাম যাই নিক।’ প্রতাপের জবাবে আমরা লা-জওয়াব।
বহুদিন আগে স্কুলে পড়ার সময় অদ্রীশ বর্ধনের লেখা এক গোয়েন্দা উপন্যাসে পড়েছিলাম জার্মানরা মিউনিখ শহরকে আদর করে ‘মুনশেন’ নামে ডাকে। পরদিন হোটেলে নাস্তা সেরে প্রতাপ আমাদের নিয়ে গেলো মুনশেন টাওয়ারে। অলিম্পিক উপলক্ষে নির্মিত হয়েছিল এই টাওয়ার। টাওয়ারের সর্বোচ্চ স্তরে উঠে মিউনিক শহর দেখলাম। দেখলাম বি.এম.ডব্লিউ. (জার্মান ভাষায় বে.এম. ভে.) গাড়ি কোম্পানির মূল অফিস। বিহগ দৃষ্টিতে অপরিচিত শহর দেখে মজা নেই, কারণ যে জায়গাটা সমতলেই চিনি না সে জায়গাকে উপর থেকে দেখে মনে পুলক জাগার কথা নয়। এই টাওয়ারে একটা ঘুর্ণায়মান রেস্টুরেন্ট আছে। একই ধরনের রেস্টুরেন্ট ভিয়েনার দানিউব টাওয়ারেও আছে। প্রতাপ সেই রেস্টুরেন্টে খেতে নিয়ে গেল। বাদামি রঙের ক্ষুদ্রকায় খদ্দেরকে খাবার পরিবেশন করতে গিয়ে দীর্ঘকায় জার্মান ওয়েটার খুব একটা খুশি হয়েছে বলে মনে হলো না। প্রতাপের মুখে চোস্ত জার্মান শুনেও পালটালো না তার মুখের ভাব। কিন্তু কিছু বলারও উপায় নেই তার, কারণ সেই সে কবে কেটে গেছে হিটলারের কাল। খেতে খেতে ভাবছিলাম, মানবজাতি এখনও বর্ণবাদ থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারলো না। বাঁদরের দল নিছর বাঁদরই থেকে গেল।

খাওয়া শেষ করে টাওয়ার থেকে নিচে নামলাম। সামনেই লেক ছিল। লেকে রাবারের তৈরি বড় বেলুনে ঢুকে খেলছে বাচ্চারা। নিসর্গও লেকের পানিতে খেললো কিছুক্ষণ। আসার পথে দেখলাম সবুজ জঙপরা তামার তৈরি এক ভাস্কর্য: অতি মেদবতী এক উলঙ্গ নারী দুই পা উপরে তুলে দুই হাতের উপর ভর দিয়ে আছে। অনতিদূরে দিগম্বর হয়ে সূর্য¯œান করছিল এক প্রৌঢ় দম্পতি। ভদ্রমহিলা আমাদের দেখে একটু বিব্রত হচ্ছিলেন বলে মনে হলো। আমরা তাকাতে চাইছিলাম না, তবুও দক্ষিণ এশীয় অসভ্য চোখ মনের মানা শুনবে কেন! জোর করে চোখ সরিয়ে সোজা নিজেদের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। মিউনিখ শহরে কয়েকটি এলাকা দেখা হলো। ছুটির দিন ছিল বলে রাস্তাঘাটে লোক নেইই বলতে গেলে। বেশ পরিপাটি, গোছানো শহর, গড়পড়তা জার্মান শহর যেমন হয়।

প্রতাপ আর নিসর্গ ব্যায়ান-মুনশেন ফুটবল দলের সমর্থক। সুতরাং আমাদের ব্যায়ান-মুনশেন স্টেডিয়াম দেখতে যেতেই হলো। বেচারাদের ভাগ্য খারাপ, কারণ সেদিন কোন খেলা নেই বলে স্টেডিয়াম বন্ধ। দূরে একটি ভবনের উপরে উঠে আমরা স্টেডিয়াম দেখলাম। এর পর ঘরে ফেরার পালা। অস্তায়মান সূর্যের লালচে-হলুদ আলোতে জার্মানির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে অস্ট্রিয়ার দিকে যাচ্ছিলাম। পাহাড়ের ঢালে লালচে টালির সাজানো বাড়িঘর, গমের ক্ষেত, সবুজ বন, মাঝে মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সাদা পাথরের গথিক শৈলীর গীর্জা। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।

অস্ট্রিয়ার সুপর্ণা-প্রতাপের বাসায় পৌঁছে দেখা গেল ‘লেজেন্দ রুজ’ বইটি ইতিমধ্যে এসে পৌঁছেছে। পর দিন থেকে ওদের বাসার ডাইনিং টেবিলে অনুবাদ শুরু করে দিলাম। ভিয়েনায় বেড়ানোও অবশ্য থেমে ছিল না। বাপ্পি আমাদের নিয়ে গেল ভিয়েনার গোলাপ বাগানে, যেখানে নাকি শ খানেক রকমের ও রঙের গোলাপ আছে। পাশেই খোলা আকাশের নিচে দশাশই পর্দায় বিখ্যাত সব কনসার্টের ছবি দেখানো হচ্ছিল। সেখানেও বসলাম আমরা কিছুক্ষণ কালো রঙের কাঠের গ্যালারিতে। এই গ্যালারি সাময়িকভাবে বসানো হয়েছে। অনুষ্ঠান শেষে আবার খুলে ফেলা হবে। একদিন গেলাম, ভিয়েনার বিখ্যাত চত্বর স্টিফেন্স প্লাজায়। বহু পুরনো এক গীর্জাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এই চত্বর। বেশ প্রশ্রস্ত চত্বরের দুই পাশে বিখ্যাত সব কোম্পানির দোকান। চত্বরের এক জায়গায় গান গাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল এক মহিলা। উদ্দেশ্য গান গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করে তাদের কাছ থেকে কিছু পয়সা নেবে। কিন্তু বাধ সাধলো পুলিশ, কাছে এসে মহিলার কানে কানে বললো, অনুমতি ছাড়া চত্বরে গান গাওয়া যাবে না। আর এক জায়গায় দেখা গেল, সিরিয়ার কিছু লোক পেছনে ব্যানার টাঙিয়ে চাঁদা তুলছে যুদ্ধকবলিত সিরিয়ান শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্যে। পুলিশ অবশ্য ওদের কিছু বললো না।

২০০০ সালে যেবার প্রথম অস্ট্রিয়া যাই সেবার এই স্টিফেন্স প্লাজায় এক মজার ঘটনা ঘটেছিল। শীতের দিন ছিল। ভায়রা প্রতাপকে বাসা থেকে বের হবার সময় বলেছিলাম গরম জামাকাপড় নিতে। আমার কথা না শুনে সাধারণ সুয়েটার নিয়েই ‘বাবু’ বের হয়ে পড়লেন। স্টিফেন্স প্লাজায় গিয়ে দেখা গেল হাঁড়কাঁপানো ঠা-ায় বাইরে হাঁটা মুশকিল। কী করা যায়? গরম জ্যাকেট সে কিনবে না, কারণ কয়েক ঘণ্টার জন্যে চড়া দাম দিয়ে একটি জ্যাকেট কিনে কী লাভ? ঠা-া থেকে আপাতত গলাটা বাঁচানোর জন্যে প্রায় ৫০ ডলারের সমমূল্যের শিলিং (তখনও ইওরোর যুগ শুরু হয়নি) দিয়ে একটা বেশ দামি মাফলার কেনা হলো এক অভিজাত দোকান থেকে। মাফলার গলায় জড়িয়ে দোকান থেকে বের হয়ে আসতে না আসতেই দেখা গেল আমাদের সামনে দিয়ে এক লোক তার কুকুর নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কুকুরের গলায় সেই একই মাফলার!

একদিন বিকেলে ভিয়েনার অদূরে এক কাউন্টের স্টেটে ঘুড়তে নিয়ে গেল প্রতাপ। যাওয়ার পথে দেখলাম, অনেকখানি জায়গায় গ্ল্যাডিওলা ফুলের চাষ হচ্ছে। অনেকটা কলাবতীর মতো এই ফুলটি বাংলাদেশে এখন বেশ জনপ্রিয়। প্রতাপ জানালো, কেউ ইচ্ছে করলে নিজেই প্রয়োজনমতো গ্ল্যাডিওলা কেটে নিয়ে ক্ষেতের নির্দিষ্ট জায়গায় দাম রেখে যেতে পারে। পরে কৃষক এসে টাকা নিয়ে যাবে। কাউন্টের স্টেটের প্রবেশপথে সিংহদরজার পাশে গাড়ি রেখে নুড়ি-ফেলা পথে হেঁটে আমারা এগিয়ে গেলাম রাজপ্রাসাদের দিকে। নিসর্গ চললো বার্নের স্মৃতিবিজরিত সেই সুইস রোলার স্কেটে চড়ে। কাউন্টের সম্পত্তি বিশাল, একটা লেক আছে, আছে অনেকখানি বন। এলাকাটা এত বড় যে পায়ে হেঁটে পুরোটা ঘুড়ে দেখতে দিনখানেক লেগে যাবে। মূল প্রাসাদ লেকের ধারে। বাড়ির স্থাপত্য ইওরোপীয় রূপকথার বইয়ে ছাপা ছবির রাজবাড়ির মতো। সন্ধ্যা নেমে আসছিল বনের দিকে, লেকের দিকটায় অবশ্য তখনও কিছু আলো ছিল অস্তগামী সূর্যের। লেকের উপর নুয়ে থাকা উইলো গাছের ছায়া বারে বারে ভেঙে যাচ্ছিল হাল্কা বাতাসের ধাক্কায় সৃষ্টি হওয়া জলতরঙ্গে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, কেমন যেন রূপকথার জগতে এসে পড়েছি… এখনি সিন্ডারেলা ক্যাসল থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে থাকা দুই রাজপুত্তুরের কোনো একজনের কাছে এসে বলবে: ‘দেখতো তোমার হাতের জুতোটি আমার পায়ে লাগে কিনা!’

অস্ট্রিয়ায় আরও কয়েকদিন কাটানোর পর প্রতাপ গাড়িতে করে নিয়ে গেল বুদাপেস্ট। পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে গিয়েছিল বলে তখনই শহরে না ঢুকে মধ্যাহ্নভোজনের জন্যে আমরা গেলাম শহরতলীর দিকে। এক রেষ্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামানো হলো। সামনে দিয়ে ট্রাম লাইন চলে গেছে। আশে পাশে কমিউনিস্ট যুগের কেজো স্থাপত্যের বাড়ি। ভিয়েনা বা প্যারিসের সাথে তুলনা করলে এলাকাটিতে দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট দেখা যাবে। তবে বড়লোকী যে ঢুকতে শুরু করেছে জীবনে ও সমাজে এবং লোকজনের ক্রয়ক্ষমতা যে বাড়তে শুরু করেছে তার প্রমাণ পাওয়া গেল এদিকে ওদিকে ঢ্যাঙার মতো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা বিলবোর্ডে বিভিন্ন পণ্যের ছবিতে।
যে রেস্টুরেন্টে আমরা বসেছিলাম তার নাম তিন চার শব্দজুড়ে যার মধ্যে একটি হলো রোমান অক্ষরে লেখা: ‘মানুষ’। আমি বুঝে গেলাম, রেস্টুরেন্টের মালিক জিপসি, কারণ শব্দটি জিপসি ভাষার। জিপসিরা ভারত থেকে ইওরোপে গিয়েছিল বলে এখনও তাদের ভাষায় প্রচূর ভারতীয় ভাষার শব্দ রয়ে গেছে। পিজ্জা দিয়ে মধ্যাহ্নভোজন শেষ করে যখন কফি খাচ্ছিলাম তখন পাশে বসা এক মেয়েকে ইংরেজিতে জিগ্যেস করলাম: হাঙ্গেরিয়ান ভাষায় ‘মানুষ’ শব্দের অর্থ কী? মেয়েটি বললো, ‘মানুষ’ হাঙ্গেরিয়ান ভাষায় ব্যবহৃত হয় বটে, কিন্তু শব্দটি হাঙ্গেরিয়ান নয়, হলেও খুব খারাপ হাঙ্গেরিয়ান হবে। এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করার সময় খুব সাবধান, কারণ সব হাঙ্গেরিয়ান এ শব্দগুলো পছন্দ করে না। বোঝা গেল, ইওরোপে অন্য অনেক জায়গার মতো বুদাপেস্টেও সাদা ককেশিয়রা আমাদের জাতভাই জিপসিদের খুব ভালো চোখে দেখা না।
দানিউব নদীর তীরে মূল শহরে ঢুকে ট্যুরিস্ট বাসে উঠে বসলাম। রাস্তা দিয়ে যাবার সময় গাইড একাধিক সুন্দর ভবন দেখিয়ে বলছিলেন যে ভবনগুলো এক সময় বড়লোকের বাড়ি ছিল, কিন্তু কমিউনিস্ট আমলে সাধারণ লোকদের থাকতে দেয়া হয়েছিল এগুলোতে। একটা বড় ভবন দেখিয়ে গাইড বললো এটি একটি কুখ্যাত ভবন, কমিউনিস্ট আমলে পার্টির হেড অফিস ছিল। বুদাপেস্ট খুব সুন্দর শহর। সব চেয়ে যেটা ভালো লাগলো সেটা হচ্ছে শহরের এখানে ওখানে মর্মর পাথর বা তামার মূর্তি। মূর্তিগুলোর বিষয়বস্তু সাধারণ মানুষ: হকার, মুচি, স্তন্যপানরত শিশু ইত্যাদি।

উভচর বাসটি এক সময় দানিউব নদীতে নেমে লঞ্চের মতো চলতে শুরু করলো। আমরা যাত্রীরা আগের মতোই যে যার যায়গায় বসে আছি। পানি ছলকে উঠে এক আধটু জানালা ভেজানো ছাড়া আর কোনো ভাবেই টের পেলাম না যে স্থলপথ ছেড়ে আমরা ‘পানিপথে’ নেমে গেছি। অভিভূত যাত্রীরা হাততালি দিয়ে বাস/লঞ্চ চালককে ধন্যবাদ দিল। দানিউব নদীর উপরে বেশ কয়েকটি সেতু বুদা আর পেস্ট – এই শহর দুটিকে যুক্ত করেছে। এর মধ্যে একটি সেতু বহু ভাস্কর্যম-িত, প্রশস্ত; ঢোকার পথে দুই দিকে আছে সিংহের বড় বড় দুই প্রস্তরমূর্তি। সেতুটি আগে কি কোথাও দেখেছি? সুপর্ণা জানালো, এই সেতুর উপর দিয়েই নাকি ঐশ্বরিয়া রাই ‘ম্যায় দিল দে চুকে সনম’ ছবিতে সালমান খানকে ছেড়ে অজয় দেবগণের দিকে ছুটে এসেছিল। এই সেতু যেখানে শেষ সেখান থেকে একটি পুরোনো আমলের লিফট উঠে গেছে পাহাড়ের উপরে, রাজবাড়ি আর গীর্জার চত্বরে। সেখান থেকে অস্তগামী সূর্যের আলোয় দানিউবের অপর পাড়ে শহর (জানি না, বুদা নাকি পেস্ট) দেখতে চমৎকার লাগলো।

ভিয়েনা থেকে দেশে ফিরে আসার আগের দিন প্রতাপ নিয়ে গেল মাউতহাউজেন (‘হাউজ’ শব্দের বহুবচন ‘হাউজেন’ নামক নাৎসি নির্যাতন কেন্দ্রে। ভিয়েনার অদূরে লিনয শহর থেকে কিলোমিটার বিশেক দূরে এক পাহাড়ের উপর এই কেন্দ্র। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত লাখ চারেক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে এখানে। ভিন্ন মতাবলম্বী, কমিউনিস্ট, ইহুদী, জিপসি, কিছু কিছু খ্রিস্টান ধর্মীয় গোষ্ঠী (যেমন জিহোবার সাক্ষী) যারা হিটলারের পক্ষে যুদ্ধ করতে রাজি হয়নি, সোভিয়েত সৈন্য, পোল্যান্ড ও অন্যান্য দেশ থেকে ধরে নিয়ে আসা অ-নাৎসি বুদ্ধিজীবীদের রাখা হতো এখানে। খেতে না দেয়া, অতি পরিশ্রম করানো, আমৃত্যু পেটানো, শূন্য ডিগ্রির নিচে তাপমাত্রায় খালি গায়ে বাইরে ফেলে রাখা, হিমশীতল জলে ¯œান, বেড়ার বাইরে ছুঁড়ে ফেলা এবং অতঃপর পালিয়ে যাবার মিথ্যা অজুহাতে গুলি করা, গ্যাস-চেম্বারে পুড়িয়ে মারা, বিদ্যুতায়িত বেড়ার উপর ছুঁড়ে ফেলা, ডাক্তারী গবেষণার গিনিপিগ বানানো, সুড়ঙ্গে ঢুকিয়ে ডিনামাইটের বিষ্ফোরণ ঘটানো ইত্যাদি ষাটটিরও বেশি পদ্ধতিতে বন্দিদের হত্যা করা হয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই কঠিন ছিল যে মাউতহাউজে বন্দিদের গড় আয়ু ছিল মাত্র ছয় মাস। এখানে আসার আগেই অবশ্য মারা যেতো হাজার হাজার বন্দী। রেলের ওয়াগনে পশুর মতো গাদাগাদি করে বন্দিদের ঢুকিয়ে তীব্র শীতের মধ্যে ট্রেনগুলো অপেক্ষা করতো পাহাড়ের পাদদেশে, অনেক সময় কয়েক দিন। অন্য সব ট্রেন যাওয়ার পর বন্দিবাহী ট্রেনকে গ্রিন সিগনাল দেয়া হতো।

সামান্য বেয়াদবির (যেমন ধরুন, পাশ দিয়ে যাওয়া কোনো জার্মান সৈন্যকে সালাম না দেয়া) জন্যে বন্দিদের পাঠানো হতো পাহাড়ের নিচে, সেখান থেকে গ্রানাইটের ব্লক উপরে তুলে আনতে। বন্দিরা অনাহারে-রোগে ভুগে অস্থিচর্মসার আর এদিকে প্রতিটি ব্লকের ওজন প্রায় পঞ্চাশ কিলোগ্রাম। উুঁচু সিঁড়ি (যার নাম ছিল ‘মৃত্যু-সোপান’) দিয়ে উঠতে গিয়ে অনেকেই মুখ থুবরে পড়ে যেতো। অনেক সময় উপরের কোনো বন্দীকে তার পরবর্তি বন্দির উপর পড়ে যেতে বাধ্য করা হতো বন্দুকের মুখে। একজনের ধাক্কায়, আরেক জন, তার ধাক্কায় তার পরের জন পড়ে গিয়ে বহু বন্দি আহত-নিহত হতো আর নাৎসি সৈন্যরা দাঁড়িয়ে মজা দেখতো, যেন তাসের ঘর ভেঙে পড়ছে! ভাবতে অবাক লাগে, ইওরোপীয়দের মতো সুসভ্য জাতি এই একদল মানুষের সাথে পশুর অধম আচরণ করেছে আধুনিক যুগে, গত শতকের মাঝামাঝি। এরাই আবার মানবাধিকারের ধুয়া তোলে, অন্যদের জঙ্গী বলে!

১৯৪৫ সালের মে মাসে মার্কিন সৈন্যেরা মাউথ হাউজেনের বন্দিদের মুক্ত করে। ১৯৪৯ সাল থেকে মাউত হাউজ (মউত হাউজ?) স্মৃতিরক্ষা যাদুঘর। কী আছে সেখানে? জার্মানরা পলায়নের আগে যতটা পারে আলামত নষ্ট করে গিয়েছিল। এক জায়গায় দেখলাম, কয়েকটি টয়লেটের প্যান পর্যন্ত তারা সিমেন্ট দিয়ে বন্ধ করে গিয়েছে, কী উদ্দেশ্যে কে জানে। এখন ব্যারাকগুলো আছে, কিছু কিছু দোতলা-তিনতলা বিছানা আছে। মৃতদেহ পোড়ানোর দুই কক্ষবিশিষ্ট একটা মেশিন এখনও আছে। দেয়ালে দেয়ালে সাঁটা আছে সে সময়কার ছবি: গুলি খাওয়া বন্দি, হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকা অস্থিচর্মসার মানুষের মুখ, পালাতে গিয়ে ধরা পড়া এক বন্দিকে নিয়ে আসছে নাৎসি সৈন্যেরা, সফররত হিমলার, ইত্যাদি। আছে বন্দীদের ব্যবহৃত জিনিষপত্র, খাবারের কৌটা, বাইবেল, চামচ… দেখলাম একটা সাইকেল যেটাতে করে এক সৌভাগ্যবাদ বন্দি মাউতহাউজেন থেকে পালিয়ে গিয়ে পোল্যান্ডে নিজের বাড়িতে পৌঁছাতে পেরেছিল!

মাউত হাউজের তোরণ পার হয়ে বাইরের চত্বরে এসে দাঁড়ালে সামনে দেখা যায় পাহাড়ের সারি। ডানদিকে আঁকাবাঁকা পথ গিয়ে মিশেছে পাহাড়ের নিচে মৃত্যু-সোপানে। চত্বরের এখানে ওখানে, ফ্রান্স, জাপান, পোল্যান্ড ইত্যাদি দেশ স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করেছে। জার্মানির একটি স্মৃতিস্তম্ভও আছে। কৌতুহল হলো জানতে যে কী লেখা আছে সেই স্মৃতিস্তম্ভের পাদদেশে। প্রতাপ অনুবাদ করে দিল: ‘আমরা জানি আমাদের অপরাধ বিশাল, কিন্তু ধরিত্রী-মাতা ক্ষমা করতে জানেন!’ সব অপরাধের কি ক্ষমা আছে? কোনো উত্তর না দিয়ে গ্রানাইটের পাহাড়ের পেছনে সূর্যদেব ডুবতে থাকলেন চুপচাপ। বহু যুগ ধরে পৃথিবীতে শক্তিহীনের উপর শক্তিমানের অত্যাচার দেখছেন তিনি, কোনো দিন কিছু বলেননি, যখন দেবতা ছিলেন তখনও না, আর এখনতো তিনি সাধারণ একটি নক্ষত্র মাত্র!

ফেরার পথে প্যারিস থেকে সুরঞ্জনা ফিরে গেল মন্ট্রিয়ল, আমি প্যারিসে এক রাত কাটিয়ে ফিরে যাবো ঢাকায়। প্যারিসে শেষ সন্ধ্যায় সানির সাথে খেতে গেলাম মোটামুটি এক দামি রেস্টুরেন্টে। আবার something wrong with our গায়ের রঙ! আমি আর সানিকে দেখে রেষ্টুরেন্টের লোকেরা ভাবলো, আমরা বুঝি কোনো ঝামেলা পাকাতে এসেছি। এই ধরা যাক, খেয়ে হয়তো বিল না দিয়ে দৌঁড়ে পালাবো, অথবা এসেছি কাজ খুঁজতে। কেমন কেমন যেন ভাব ম্যানাজার আর ওয়েটারদের। খাওয়ার পর যখন ইওরোতে মোটা টিপস দিলাম ওয়েট্রেসকে তখনও তাদের মুখম-ল থেকে অবাক ভাবটা যেন যায় না। আমার জীবৎকালেই প্রিয় শহর প্যারিসের এই অধঃপতন দেখতে হলো বলে মনে খুব দুঃখ পেলাম।
খাওয়ার পর রাস্তায় হাঁটছিলাম সানির সঙ্গে। সামনে বেশ বড় একটা রেস্টুরেন্ট দেখিয়ে সানি বললো, রেস্টুরেন্টটি বাংলাদেশের কাজী এনায়েত উল্লাহর। বহু দিন আগে, আশির দশকের প্রথম দিকে আমি যখন বিদেশ যাবার জন্যে তড়পাচ্ছি, তখন তিনি বিচিত্রায় প্যারিস নিয়ে লিখতেন ‘উল্লাহ কাজী এনায়েত’ নামে। আমি তাঁকে একটা চিঠি লিখেছিলাম প্যারিসে লেখাপড়া করার সুযোগ-সুবিধা নিয়ে প্রশ্ন করে। তিনি দীর্ঘ উত্তর দিয়েছিলেন। পরে এনায়েত ভাই ‘বনানী’ নামে একটি ‘ইন্ডিয়ান’ রেস্টুরেন্ট খোলেন প্যারিসে যেটি তিনি আর তাঁর বিদেশি বউ দুজনে মিলে চালাতেন। ভালোই চলতো। এখন প্যারিসে নাকি ওঁর বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট। উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি নাকি এতই সুপরিচিত যে কোনো ব্যাঙ্কই তাঁকে ঋণ দিতে দ্বিধা করে না।
খুব ভোরে সানি আমাকে পৌঁছে দিল শার্ল দ্যগল বিমানবন্দরে। আমার হাতে ছিল তিনটা ব্যাগ। সানি বার বার বলেছিল, ‘তিনটা লাগেজ নিয়ে আপনাকে স্যার ঢুকতে দেবে না।’ আমি বলেছিলাম, দেখা যাবে। ঠিকই দিল না ঢুকতে অতি করিৎকর্মা ফরাসি দারোয়ান। সানিকে ফোন করে যে তার হাতে একটা লাগেজ দিয়ে দেবো তারও উপায় নেই। সে অনেক আগেই ফিরে গেছে। আবার ফিরে এলাম তুর্কি এয়ারলাইন্সের বুথে। অতিরিক্ত একটি ব্যাগের জন্যে শ তিনেক ইওরো মাশুল দিয়ে তার পর ছাড়া পেলাম। সেই ব্যাগে যা মাল ছিল তার মূল্য চল্লিশ ইওরো হবে কিনা সন্দেহ। শুধু কি এই ? জুরিখ থেকে একটা উপহার কিনেছিলাম, চামচ-কাঁটা চামচ একসাথে লাগানো, ভাঁজ করা। খাওয়ার সময় প্রয়োজন মতো চামচ আর কাঁটা চামচ দুটোই ব্যবহার করা যায়। এমন দারুন একটা জিনিষ, দাম যার বিশ ইওরো, সেটাও কিনা সিকিউরিটি অফিসার ফেলে দিল সোজা ডাস্টবিনে। এই কাঁটাচামচও নাকি বিমানে বহন করা বৈধ নয়! ফেরার ‘পথে পথে পাথর ছড়ানো!’

ইওরোপ-ভ্রমণে যাবার আগে সস্ত্রীক ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে মামাতো শ্যালক আমাকে একটা ফড়িং উপহার দিয়েছিল। বেড়াতে যাবার আগে ফড়িংটিকে ঢাকায় নিউমার্কেটের বাসার ফ্রিজের উপর বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখি, ফড়িঙের ধরটা ফ্রিজের পাশে মেঝেতে মাথা গুঁজে পড়ে আছে, পাখা দুটো কোথায় উড়ে গেছে জানি না। জ্যান্ত ফড়িঙ হলে কথা ছিল না, কারণ ফড়িঙেরা সাধারণত দীর্ঘ জীবনের অধিকারী হয় না। কিন্তু প্ল্যাস্টিকের ফড়িঙেরই যখন দশাপ্রাপ্তি ঘটে গেল, তখন বুঝলাম, বেড়ানোটা এবার একটু লম্বাই হয়ে গেছে।

২২শে জানুয়ারি, ২০১৫

Art by Miki

Comments (5)

buy cialis online india Unperturbed mice lacking Ip are normotensive and do not develop spontaneous thrombosis, although they are sensitive to thrombogenic and hypertensive stimuli

Leave a comment