Scroll Top
19th Ave New York, NY 95822, USA

ব্যাকরণ ও বৃষ্টিসিক্ত দুই বার্লিনদিন

Alexanderplatz, Berlin, at night

‘বহুদিন হতে বহু দেশ ঘুরে, বহু ব্যয় করি বহু পথ ঘুরে’ পর্বতমালা বা সিন্ধুদর্শন আমার নেশা নয়। ‘ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু’ দেখলেও আমার বেশ চলে যায়। কিন্তু আমি চাই বা না চাই, কপালগুনে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গৌরী সেনের টাকায় আমারও পর্বতমালা বা সিন্ধুদর্শন হয়ে যায়। পেশায় আমি ভাষাশিক্ষক আর নেশায় ভাষাবিজ্ঞানের ছাত্র। ব্যাকরণ-বিষয়ক বই পড়া, আলোচনায় অংশ নেয়া, বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করা আমার সবচেয়ে প্রিয় কাজ। বছরে একাধিক বার পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ভাষাবিজ্ঞানের বিভিন্ন কনফারেন্সে প্রবন্ধ পাঠাই। প্রবন্ধ গৃহীত হলে এবং অন্তত যাতায়াত খরচ পাওয়া গেলে ব্যাকরণের রথদেখা আর দেশদেখার কলাবেচা দুইই আমার হয়ে যায়।

ভাষাবিজ্ঞানের জগতে গত কয়েক দশক যাবৎ পোল্যান্ডের পোযনান সম্মেলন বেশ নাম করেছে। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরের ২৩ থেকে ২৬ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য ৪১তম পোযনান সম্মেলনে একটি প্রবন্ধ পাঠিয়েছিলাম। কর্তৃপক্ষ জানালো যে প্রবন্ধটি গৃহীত হয়েছে। সম্মেলনের ওয়েবসাইট পড়ে জানলাম যে এবার সম্মেলন হবে পোযনানে নয়, পোযনান থেকে মাইল পঞ্চাশ দূরে পোলান্ডের প্রথম রাজধানী গ্নিয়েজনোতে। এদিকে গত দুই বছর যাবৎ এক পোষ্টডক গবেষণার সুবাদে আমি আমি আছি জাপানের টোকিওতে। ঠিক করলাম, বার্লিন হয়ে যাবো কারণ ইন্টারনেটে সার্চ করে দেখলাম, বার্লিন থেকে ট্রেনে করে চার-পাঁচ ঘন্টায় গ্নিয়েজনোতে যাওয়া যায়। বার্লিনে যাবার আর একটি কারণ হচ্ছে বার্লিনে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহকর্মী ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাকিম আরিফ। তিনি সেখানে পি.এইচ.ডি. করছেন ভাষাবিজ্ঞানে। আমি যাবো শুনে ডেনমার্কের আলবুর্গে পোষ্টডক্টরেট গবেষণারত ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সিকদার মনোয়ার মুর্শেদ যিনি সৌরভ শিকদার নামে পরিচিত তিনিও বার্লিনের টিকেট কাটলেন। ঠিক হলো, আমি বার্লিন গিয়ে পৌঁছাবো ২৩ তারিখ। পরদিন ২৪ তারিখ চলে যাবো পোল্যান্ডে, ফিরে আসবো ২৬ তারিখে। সৌরভ ২৬ তারিখেই এসে পৌঁছাবেন, ২৭ আর ২৮ তারিখ দুই দিন চুটিয়ে বার্লিনদর্শন করে ২৯ তারিখ আমরা ফিরে আসবো যে যার ডেরায়, আমি টোকিওতে, সৌরভ ডেনমার্কে।

২৩ তারিখ দুপুর ১২টায় নারিতা বিমানবন্দরে লুফথানসার বিমানে চাপলাম মিউনিখের উদ্দেশ্যে। আমরা যারা ইকোনোমি ক্লাসের যাত্রি তাদের জন্যে বিমানভ্রমণ আর আনন্দের বিষয় নেই। শরৎচন্দ্রের যুগে বার্মাগামী জাহাজে ডেকের যাত্রীদের মতো দুরবস্থা না হলেও যে কোন এয়ারলাইন্সের বিমানেই ইকোনোমি বা সাশ্রয়ী সিটগুলো এত চাপাচাপি করে বসানো হয় যে হাতপা ছড়িয়ে বসা যায় না। হিংটিংছটের ‘একটু নড়িতে গেলে গালে মারে চড়, নাকে-মুখে লাগে তার নখের আঁচড়’ এর মতো অবস্থা না হলেও পাশাপাশি দুই সিটে এত ঘেঁসাঘেঁসি যে নড়াচড়া করতে গেলেই পাশের যাত্রির কাঁধে কাঁধ লেগে যায়। খুব মোটা আর লম্বা লোকেরা কিভাবে ম্যানেজ করে কে জানে! তার উপর একঘেঁয়ে, দীর্ঘ যাত্রায়, একটানা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা। জাহাজে, ট্রেনে বা বাসে অন্তত বাইরে তাকানো যায়, এবং তাতে কিছুটা হলেও একঘেয়েমি কাটে। বিমানভ্রমণে একমাত্র বৈচিত্র্য, দুবেলা যে খাবার দেয় তা খাওয়া। আভ্যন্তরীণ রুটে খাবার দেয়া ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে, আন্তর্জাতিক রুটেও কবে বন্ধ হয় কে জানে। তখন হয়তো শুধু পানি দেয়া হবে চিড়ে ভিজিয়ে খাবার জন্যে।

আমাকে অবশ্য বিমানযাত্রার একঘেয়েমী কদাচিৎ স্পর্শ করে। আমি হয় এক দুই গ্লাস শ্বেত বা লোহিত মদিরা গলাধঃকরণ করে একটানা ঘুমাই। তা না হলে সারাক্ষণই বই পড়ি, ল্যাপটপে কাজ করি অথবা কদাচিৎ দুই একটা ছবি দেখি। এবার পড়ে শেষ করলাম হাকিম আরিফের পি.এইচ.ডি. অভিসন্ধর্ভের একাংশ। এর বিষয়বস্তু বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হাতের বিভিন্ন মুদ্রা। হাকিম আরিফের অভিসন্ধর্ভ পড়ার প্রস্তুতি হিসেবে আর একটি বইয়ে চোখ বুলিয়ে নিলাম এই বিমানেই। বইটি হচ্ছে দেসমন্ড মরিস প্রমূখ সম্পাদিত ‘মুদ্রা’ বা ‘জেসচার’। এই বইটিতে প্রধানত ইওরোপের মোট বিশটি হস্তমুদ্রার ইতিহাস ও বর্তমান ব্যবহার বিশ্লেষণ করা হয়েছে। লক্ষ্য করলাম, এই মুদ্রাগুলোর একটিও আমাদের অঞ্চলে ব্যবহৃত হয় না যদিও ইংরেজি ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে পরিচয় থাকার কারণে আমরা অনেকেই এ মুদ্রাগুলোর কয়েকটির সাথে কমবেশি পরিচিত। বাংলা তথা ভারতবর্ষে ব্যবহৃত মুদ্রা নিয়ে এ ধরণের কাজ করা গেলে আমাদের ভাষা-জ্ঞান সমৃদ্ধ হতো। আশা করি একদিন হাকিম আরিফ বা অন্য কোন ভাষাপ্রেমী এ গবেষণায় ব্রতী হবেন। প্রসঙ্গত বলি, মুখের ভাষা নিয়ে গত হাজার দুই বছরে অনেক গবেষণা হয়েছে, মূক বধিরদের ইশারাভাষা নিয়েও বেশ কিছু কাজ হয়েছে। কিন্তু আমরা যারা বাগযন্ত্র ব্যবহার করতে পারি আমরাও কথা বলার সময় বিভিন্ন ভাবে হাত নাড়ি, বিভিন্ন মুখ ও চোখভঙ্গি করি। এই (হস্ত)মুদ্রা, মুখ ও চোখ-ভঙ্গীর বিচার-বিশ্লেষণ খুব একটা হয়নি, বাংলায়তো নয়ই, অন্য ভাষাতেও এ ধরণের কাজ বিরল। যদিও জানতাম যে উপমহাদেশের বিভিন্ন নৃত্যের অন্যতম একটি অঙ্গ হচ্ছে মুদ্রা, হিন্দুদের পূজায় মন্ত্রোচ্চারণের সাথে হাত দিয়ে বিভিন্ন মুদ্রা করতে হয় এবং মুসলমানদের নামাজ পড়ার সময়ও মুদ্রার ব্যবহার রয়েছে, তবুও এ বিষয়ে বিশ্লেষণ-নির্ভর কোন রচনা আমার পড়া ছিল না। পড়তে পড়তে মনে হলো, এই মুদ্রাগুলো বিভিন্ন শব্দের মতো আমাদের ভাষাবোধের অংশ। এগুলোকে বাদ দিয়ে ভাষার কথা ভাবা যায় না এবং এগুলোরও ব্যাকরণ আছে।

দীর্ঘ ১২ ঘন্টার উড়াল শেষে বিকেল ছয়টার দিকে আমাদের বোয়িং বিমান মিউনিখে অবতরণ করলো। মিউনিখেই আমার ইমিগ্রেশন হবে। কোথায় যাবো, কেন যাবো, কদিন থাকবো, ফেরার টিকেট আছে কিনা ইত্যাকার প্রশ্নের পর ইমিগ্রেশনের মহিলা অফিসার পাসপোর্টে সিল মেরে আমাকে কৃতার্থ করলো। এর পর ধরতে হবে বার্লিনের বিমান ঘন্টা দুয়েক পরে। মিউনিখ এয়ারপোর্টে পুরোনো দিনের মতো বাসে করে গিয়ে বিমানে উঠতে হয়। অনেক জায়গাতেই লিফটের জায়গায় সনাতনী সিঁড়ি, হ্যান্ডলাগেজ নিয়ে উঠতে নামতে নাকালের একশেষ। যাই হোক, লাইন ধরে উঠে পড়লাম বার্লিনগামী বিমানে। এবারের বিমানটি আরও ছোট এবং সিটগুলো আরও ঠাসাঠাসি। অবশ্য মাত্র ঘন্টাখানেকের যাত্রা এবং সন্ধ্যা সাড়ে আটটার দিকে বার্লিনে পৌঁছে গেলাম। এই প্রথম আমার জার্মানি আসা। ১৯৮৫ সালে যখন প্যারিসে থাকতাম তখন এক বার জার্মানির ভিসা নিয়েছিলাম কিন্তু অর্থসঙ্কটের কারণে (আসলে নি¤œ মধ্যবিত্ত সুলভ কিপটেমির কারণে) জার্মানি আসা হয়নি। এবার যে আসা হলো তার জন্যে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হবে হাকিম আরিফকে। আমি দোটানায় ছিলাম, আসবো কি আসবো না। হাকিম আরিফ বলেছিল, ‘এসে যান। আমি আছি, সৌরভদাও আসবে। আবার কবে আসবেন তার কি ঠিক আছে কিছু!’ সৌরভ রগড় করে বলেছিল, ‘আমরা বাংলাদেশের তিন ভবিষ্যৎ ভাষাবিজ্ঞানী বার্লিনে একত্রিত হবো  এই ‘ঐতিহাসিক সুবর্ণসুযোগ’ হেলায় নষ্ট করবেন না।’ কথামতো এয়ারপোর্টে হাজির ছিল সহাস্যমুখ হাকিম আরিফ। দুজনে বাইরে বেরিয়ে এলাম বাসস্ট্যান্ডে, অনতিবিলম্বে বাসও এসে গেল।

আমি টিকেট হাতে নিয়ে বাসের সিটে বসে পড়েছিলাম। দাড়িগোঁফওয়ালা দীর্ঘদেহ এক জার্মান এগিয়ে এসে আমাদের জানালেন যে আমার টিকেটটা পাঞ্চ করতে হবে। বার্লিনে মাসিক, সাপ্তাহিক, দৈনিক বাসটিকেট আছে। এছাড়া প্রতিবারের জন্যে খুচরো টিকেটও কেনা যায়। পুরো বার্লিন শহরকে এ, বি, সি এই তিনটি জোনে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি টিকেট দুই ঘন্টা পর্যন্ত নির্দিষ্ট জোনে ব্যবহার করা যায় বাস, ট্রেন, ট্রাম, উড়াল ট্রেন বা মেট্রো যেখানেই হোক না কেন। সাপ্তাহিক বা দৈনিক টিকেট ড্রাইভারকে দেখালেই চলে কিন্তু খুচরো টিকেট প্রথমবার ব্যবহারের সময় নির্দিষ্ট মেশিনে পাঞ্চ করে নিতে হয়। আমি সঙ্গে সঙ্গে ভুল সংশোধন করলাম এবং ভদ্রলোককে ‘ডাঙ্কে শ্যোন’ বলে প্রায় কুড়ি বছর আগে শেখা এবং ইতিমধ্যে প্রায় সবটাই ভুলে যাওয়া জার্মান ভাষা জার্মানির মাটিতে প্রথম ব্যবহার করলাম। হাকিম আরিফ জানালো, দৈনিক টিকেটে পাঞ্চ না করাটা বে-আইনী এবং কখনও টিকেটচেকার বাসে উঠলে চল্লিশ ইওরো আক্কেলসেলামী দিতে হয়। হাকিম আরিফের টিকেট লাগে না বলে ব্যাপারটা তার খেয়াল ছিল না। বার্লিনে ছাত্ররা যখন টিউশন ফি দেয় তখন তার মধ্যেই যৎসামান্য পরিবহণ খরচ ধরে দেয়া হয়, সুতরাং কোন ছাত্রেরই পৃথক কোন যাতায়াত খরচ নেই। এই ব্যবস্থা পৃথিবীতে সম্ভবত শুধু জার্মানীতেই আছে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই মেট্রোতে ঢোকার সময় ও বের হবার সময় মেশিনে টিকেট ঢোকাতে হয়, বার্লিনে সে ঝামেলাও নেই।

বাস এসে থামলো হপ্টবানহোপ সেন্ট্রাল স্টেশনে এবং সেখান থেকে আরেকটা বাস নিয়ে এলাম ‘চিড়িয়াখানার মোড়ে’ বা জার্মান ভাষায় জুওলোজিশে গার্টেন স্টেশনে। তখন রাত প্রায় নটা বাজে বলেই বোধহয় লোকজন তেমন নেই। বাসেও তেমন ভিড় ছিল না। হাকিম বললো, এখানে আমরা প্রায়ই আসবো, জায়গাটা খেয়াল করে রাখেন। আমি ভূগোলে খুবই দুর্বল। যে জায়গায় জীবনেও কখনও যাইনি সেখানে চলাফেরা করতে কোন অসুবিধা হয় না আমার, কিন্তু যেখানে এক বার গিয়েছি সেখানে রাস্তা চিনতে ভুল করি বার বার। চিড়িয়াখানার প্রবেশপথে একটা সুউচ্চ ভবনের গায়ে জিরাফের খয়েরি রঙের একটি ছবি মার্ক করে রাখলাম। ভাবলাম, অত উঁচুতে যেহেতু কোন গাছ নেই, সেহেতু জিরাফ ব্যাটা খিদে লাগলেও এদিক ওদিক যেতে পারবে না, আমিও পথ হারাবো না।

জুওলোজিশে গার্টেন থেকে তৃতীয় বাস নিয়ে পৌঁছলাম হাকিম আরিফের ডরমিটরি এলাকায়। বার্লিনের বড়লোক পাড়া। লোকজন তেমন নেই বললেই চলে। হাকিম আরিফের কাছে জানলাম তার প্রতিবেশীদের বেশিরভাগই খাঁটি জার্মান, বিদেশিদের বাড়ি খুব একটা নেই এখানে। আমরা যে স্টেশনে নামার কথা, কথা বলতে বলতে ভুলে তার আগের স্টেশনে নেমে পড়েছি, সুতরাং একটু হাঁটতে হবে। রাস্তার দুই দিক গাছে গাছে ভরা। হেমন্তের শুরু বলে অনেক গাছেই কোন কোন পাতায় হলুদ-লাল রঙ ধরেছে। মাটিতেও এদিক ওদিক পড়ে আছে রঙিন পাতা। এ রকম বর্ণিল নির্জন রাস্তা দিয়ে রাতের বেলায় হেঁটে যেতে ভালোই লাগছিল। পরদিন হাকিম আরিফ বলেছিল, এত গাছ এই শহরে যে বার্লিনকে সবুজ রাজধানী বলা হয়।

কিছুদূর গিয়ে রাস্তার এক পাশে পর পর অনেকগুলো ছ’তলা বাড়ি। এগুলোই ছাত্রনিবাস। এ রকম একটি হোস্টেলের ছয় তলায় থাকে হাকিম। বোতাম টিপে লিফটে উঠলাম। ষাটের দশকের লিফট কিন্তু এখনও চমৎকার কাজ করে চলেছে। লিফট থেকে বেরিয়ে দরজা খুলে ঢুকতে হয় একটা করিডোরে যার দুপাশে ছাত্রদের রুম, একটি টয়লেট, একটি টয়লেট কাম বাথরুম আর একটি কিচেন কাম ডাইনিং রুম। হাকিমের রুমটি এক জনের জন্যে যথেষ্ট। জানালা দিয়ে বার্লিন শহর অনেকটা দেখা যায়, এমনকি পরিষ্কার দিন হলে বার্লিন টাওয়ারও চোখে পড়ে। হাকিম জানালো, ভাড়া অনুসারে রুম বড়-ছোট হতে পারে। রুমে ঢুকেই আমি চাইলাম মন্ট্রিয়লে স্ত্রী ও পুত্রের কাছে ফোন করতে। ভাগ্য ভালো, ছেলেকে পাওয়া গেল ইয়াহু মেসেঞ্জারে। বললাম, ‘ঠিকঠাকমতো এসে পৌঁছেছি, মাকে আর সবাইকে জানিয়ে দিও।’ ছেলে বললো: ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে।’ আসলে কিছুই ঠিক নেই। সে আমার পৌঁছসংবাদ সেদিনতো দেয়ইনি, দু’দিন পরেও দেয়নি। পরিবারের সদস্যরা চিন্তায় অস্থির। ইতিমধ্যে নাকি টেলিভিশনে দেখিয়েছে, জার্মানী থেকে স্পেনগামী একটি বাস দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। যদিও আমি সে বাসে থাকার কথা নয় তবুও যেহেতু জার্মানী গিয়েছি সেহেতু পরিবারের সদস্যদের স্বাভাবিক দুশ্চিন্তার আগুনে এই দুঃসংবাদ ঘি ঢালতেই পারে। লেখাপড়া নিয়ে আমার ছেলে এমনই ব্যতিব্যস্ত যে বাপের খবর জানার জন্যে সবার এই যে অস্থিরতা সে তা খেয়ালও করেনি। আপনি বাঁচলেতো বাপের নাম।

জামাকাপড় বদলে হাকিমের রান্না করা মুরগির মাংস আর ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে (রান্না হাকিম খারাপ করে না) রুমের পাশে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। বেলকনি থেকে গাছে গাছে ভরা বার্লিন শহরের অনেকটাই চোখে পড়ছিল চাঁদের আলোতে। হাকিম দেখে বললো: ‘এখান থেকে যে চাঁদ দেখা যায় জানতামই না!’ আকাশে ঘোলাটে বৃত্তের মধ্যে বেশ বড়সড় চাঁদ। লোকজ্যোতিষে এই বৃত্তটিকে বলে চন্দ্রসভা। বচন (খনার কিনা জানি না) আছে :‘চন্দ্রসভার মধ্যে তারা, তবেই হবে মুষলধারা’। মনে মনে বললাম, বৃষ্টিটা যদি হয়ই তবে যেন আমি পোল্যান্ড থেকে ফিরে আসার আগে আগেই শেষ হয়। আমার প্রার্থনা পূরণ হয়নি, খনার বচনই সত্যি হয়েছিল।

পরদিন সকালে রওয়ানা হলাম গ্নিয়েজনোর উদ্দেশ্যে। বাসে উঠে প্রথমে যেতে হবে সেই জিরাফের মার্কামারা জুলোজিশে গার্টেন। সেখান থেকেই ফ্রাঙ্কফুর্ট অন ওডেরের ট্রেন। সকালের রোদে গাছের ফাঁকে ফাঁকে বার্লিনের গেরুয়া-সাদা-হলুদ-লাল বাড়িগুলো দেখতে ভালোই লাগছিল। কোন কোন বাড়ির জানালা গথিক ধারার, কোনটি বা বারোক ধারায় তৈরি। কিছু কিছু বাড়ি নতুন, সম্ভবত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তৈরি। কিছু কিছু তার আগের। এর মধ্যে একটি হচ্ছে বার্লিনের প্রথম মেডিকেল কলেজ। হাকিমের মুখে বাড়িগুলোর ইতিহাস শুনতে শুনতে রাস্তার সাইনবোর্ডের লেখাগুলো পড়ে আমার টুটাফাটা জার্মানজ্ঞান ঝালাই করে নেবার চেষ্টা করছিলাম । পথে পড়লো ইট-লাল রঙের ছোটখাটো একটি গথিক স্থাপত্যের গীর্জা। হাকিম জানালো, জার্মানিতে গীর্জায় নাকি লোক একদমই হয় না, এমনকি রবিবারেও না। লোক না হওয়ার মানে হচ্ছে গীর্জার খরচ চলবে না, কারণ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে গীর্জা চালানোর খরচ সরকার দেবে না। অর্থাভাবে অনেক গীর্জা বন্ধ ও পরিত্যক্ত হচ্ছে। এ রকম একটি গীর্জা কিনে নেবার জন্যে আবেদন করেছিল এক ব্যক্তি এবং একটি মসজিদ কমিটি। ব্যক্তিটির উদ্দেশ্য, গীর্জাটিতে সে একটি পানশালা খুলবে, আর মসজিদ কমিটির উদ্দেশ্য, গীর্জাটিকে তারা মসজিদ বানাবে। জার্মান কর্তৃপক্ষের জন্যে পরিস্থিতি শাঁখের করাত। পানশালা খুলতে দেবার মানে হচ্ছে গীর্জাকে অধার্মিক (খ্রীষ্টানধর্মে মদ্যপান নিষিদ্ধ না হলেও পাবে মদ খেয়ে নাচানাচি অবশ্যই সিদ্ধ নয়) কার্যকলাপের জন্যে ব্যবহার করতে দেয়া, আর মসজিদ বানাতে দেয়ার মানে হচ্ছে অনেকটা নিজেদের ধর্মস্থান বিধর্মীদের হাতে তুলে দেওয়া। শেষ পর্যন্ত অধর্মের কাছে বিধর্মের জয় হলো। কর্তৃপক্ষ মসজিদ বানানোর পক্ষে রায় দিয়েছেন এই ভেবে যে যে ধর্মেরই হোক না কেন, গীর্জাটিকে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার কাজেইতো ব্যবহার করা হবে। হাকিম আরিফ বললো, এ ঘটনা সবাইকে বলি না, কারণ মৌলবাদীরা এটাকে খ্রীষ্টান ধর্মের উপর ইসলামের বিজয় হিসেবে দেখবে, জার্মান জাতির উদারতাটা তাদের চোখে পড়বে না। আমাদের অঞ্চলে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা এখনও ভাবা যায় না। আমরা দখল করতে অভ্যস্ত, দখল ছাড়তে নয়। নিজের ভাইদের যিনি বলেছিলেন: ‘বিনাযুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যাগ্র মেদিনী!’ মহাভারতের সেই খলনায়ক দুর্যোধনই ‘আধুনিক’ ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমানের আদর্শ। এক বাবরি মসজিদ নিয়ে দাঙ্গাতেই উপমহাদেশে কত লোক মারা পড়ল। পাকিস্তানের সাংবাদিক হামিদ মীর সম্প্রতি পাকিস্তান-আফগানিস্তানে মন্দির-গুরুদ্বারের জমি দখল হওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে একটি সুপারিশ করেছেন: পাকিস্তানের উচিত একটি বিশাল হিন্দুমন্দির নির্মাণ করে দেখিয়ে দেয়া যে পাকিস্তান বদলাচ্ছে। আমি বলি, যদি মন্দিরটির নাম দেয়া যায় ‘বাবরি-মন্দির’ তবে আরও ভালো হয়, পাকিস্তানের জন্যেতো বটেই, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে উপমহাদেশের সব অধিবাসীর জন্যেও।

কাঁটায় কাঁটায় এগারোটা বিশ মিনিটে ফ্রাঙ্কফুর্টের ট্রেন এসে লাগলো স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। দোতলায় উঠে বসলাম, যাতে ভালো করে চারদিক দেখার সুযোগ পাই। বেশি দেখার সুযোগ পাইনি, কারণ আমার প্রবন্ধের পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনার সংশোধনের কাজ শেষ করতে হচ্ছিল। তার পরেও এদিক ওদিক তাকিয়ে যা দেখলাম, তাতে মনে হলো বার্লিন অনেকটা আমার দেখা আর একটি ‘জার্মান’ শহর ভিয়েনার মতোই। ট্রেন চলছিল পূর্ববার্লিন দিয়ে। পুনরেকত্রিকরণের দুই দশক পূর্তি হয়ে গেছে, কিন্তু রাস্তা ও ভবন নির্মাণের কাজ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। অঙ্কশায়িনী ল্যাপটপে আমার নিজের কাজও থেমে ছিল না। ইতিমধ্যে চেকার এসে টিকেট চাইলো। টিকেট চেক করে মহিলা ‘ডাঙ্কে শ্যোন’ বলে চলে গেলে আমি আবার কাজে মন দিলাম। একটু পরেই ঘোষণা শুনলাম, ফ্রাঙ্কফুর্ট অন ওডের স্টেশন নিকটবর্তি। এই স্টেশনটি জার্মানী আর পোল্যান্ডের সীমান্তে অবস্থিত। একসময় অবশ্য পোল্যান্ডের পোযনান এলাকা জার্মানীর অংশ ছিল। বাড়িঘরগুলো জার্মান শৈলীতে নির্মিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোল্যা-ের উপর জার্মানীর আক্রমণ ও অত্যাচারের ক্ষতিপূরণস্বরূপ জার্মানীকে পোল্যান্ডের হাতে পোযনান তুলে দিতে হয়। যাই হোক এখন ওডের নদী জার্মানী আর পোল্যান্ডের সীমানা। আজ থেকে বছর বিশেক আগে ফ্রাঙ্কফুর্ট অন ওডের শহরে নিশ্চয়ই চেকপোস্ট ছিল এবং আমাকে পাসপোর্ট হাতে কাচুমাচু মুখে সেখানে গিয়ে ইমিগ্রেশন অফিসারের হাজার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে পাসপোর্টে সিল মারাতে হতো। তার পর শুরু হতো আমার ব্যাগতল্লাসী। এখন এসবের চিহ্ন মাত্র নেই। সার্ক দেশগুলোর নাগরিকেরা কবে এসব ‘পাপ’ থেকে মুক্ত হবে কে জানে। ডগ শিশির বা মুর্গি মিলনেরা যখন ভিসার তোয়াক্কা না করে বা জাল পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে দিব্বি সীমান্তের এপার ওপার করছে তখন ভদ্রলোকদের এত কষ্ট দেয়া কেন! পাসপোর্ট-ভিসা দিয়ে সন্ত্রাস বা চোরাকারবার এ দু’টির একটিও যে নিবারণ করা যায় না তা বোঝার মতো সুবুদ্ধি আমাদের নীতিনির্ধারকদের কখনই হয়তো হবে না।

ব্যাগ গুছিয়ে নেমে পড়লাম। স্টেশনটি বার্লিনের স্টেশনগুলোর তুলনায় একটু গরিবী হালের। পোযনানের ট্রেন কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেন ছাড়বে তা টিকেটে লেখা থাকলেও বলা আছে যে প্ল্যাটফর্ম বদলাতে পারে এবং সঠিক প্ল্যাটফর্ম কোনটি তা জানার জন্যে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্টেশনে খোঁজ নিতে হবে। সামনেই ট্রেনের সেই মহিলা টিকেটচেকারকে দেখে আমার টিকেটটা তাকে দেখালাম। ‘ভাইস নিক্সট’ (মানে, ‘জানি না’) বলে শ্রাগ করে মহিলা প্ল্যাটফর্মের ওপারে অন্য কারো সাথে আলাপ শুরু করলো। হয়তো তার ব্যস্ততা ছিল, বা উটকো ঝামেলা ঘাড়ে নিতে চায়নি। বিদেশি বা রঙিন চামড়ার লোক বলে অবজ্ঞা করলো এমনটা অবশ্য মনে হলো না। মানুষকে সামান্য অজুহাতেই খারাপ ভাবা ঠিক নয়। ভাবলাম, ট্রেনেরতো এখনও ঘন্টাখানেক দেরি আছে, স্টেশনটা একটু ঘুরে দেখি। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতেই দেখি সুরঙ্গপথের দুপাশে সারি সারি দোকান। ম্যাকডোনাল্ড আছে, আছে তুর্কি ডোনাট কাবাবের দোকান। আমার এ কাবাব খুব পছন্দ। সস্তায় খুব ভালো খাবার। দেখেই আমার খিদে পেয়ে গেল। দোকানে ঢুকে একটি গ্রোসে (অর্থাৎ বড়) কাবাব আর মাঝারি সাইজের একটা বিয়ারের অর্ডার দিলাম। বিল আসলো মাত্র চার ইওরো। বেশ সস্তাই বলতে হবে। খেতে খেতে মনে পড়লো নব্বইয়ের দশকে প্যারিসে থাকাকালে আমি ও আমার স্ত্রী প্রায়ই এ ডোনাট কাবাব (প্যারিসে যার নাম ‘সন্দ্যুইচ গ্রেক’ বা গ্রীক স্যান্ডউইচ) দিয়ে রাতের খাবার সারতাম। আমাদের ছেলে ঋকের বয়স তখন তিন। সেও এই স্যান্ডউইচ খুব পছন্দ করতো (অবশ্য শুধু মাংস খেতো সে, রুটি আর আলুভাজা মা-বাবার দিকে ঠেলে দিত)। টোকিওতেও আকিহাবারা এলাকায় যেখানে সব ইলেক্ট্রনিক্সের দোকান সেখানে ডোনাট কাবাবের পাশাপাশি দুটি দোকান আছে। মাস খানেক আগে সপরিবারে সেখানেও স্যান্ডউইচ খেয়েছি। খাওয়া শেষ হলো। দোকান থেকে বের হবার সময় তুর্কি দোকানদার বললো: ‘খোদা হাফেজ।’ শুনে আমি থমকে দাঁড়ালাম, মনে হলো, যেন মুহূর্তের জন্যে ঢাকায় ফিরে গেছি। নিশ্চয়ই বাংলাদেশি বা পাকিস্তানীদের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে লোকটার এবং ঠিকই ধরেছে যে আমি সে এলাকারই লোক।

পোল্যান্ডের ট্রেনে উঠে বসলাম। পুরো ট্রেন চীনা আর জাপানি টুরিস্টে ভরা। আমার পাশের সিটে বসেছিল এক জাপানি মেয়ে। জাপানি না চীনা প্রথমে তা বুঝতে পারছিলাম না। পরে তার জলের বোতলে ফুজি পাহাড়ের ছবি আর জাপানি বর্ণমালা হিরাগানা-কাতাকানা দেখে তার জাতিয়তা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হলাম। তারা বেশ কয়েকজন বান্ধবি ইওরোপ ভ্রমণে বের হয়েছে। আমি পোযনানে নেমে যাবো কিন্তু এই একই ট্রেনে করে ওর চলে যাবে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ার্শতে। আজ রাতে তারা সেখানেই থাকবে এক ইয়ুথ হোস্টেলে। ইতিমধ্যেই এই মেয়েরা জার্মানি ভ্রমণ করেছে এবং এর পরে তারা যাবে প্যারিসে। ল্যাপটপে আমার কম্পিউটারে কাজ করতে কারতে জাপানি মেয়েটির সাথে আমার একান্তই প্রাথমিক স্তরের জাপানি জ্ঞান একটু ঝালাই করে নিচ্ছিলাম। আলাপের এক পর্যায়ে মেয়েটি মার্কার-কলমে জড়ানো একটি জাপানি পতাকা বের করে আমাকে তার উপর কিছু লিখতে বললো। সেখানে অনেকেই ইংরেজিতে ‘হোয়াট ইজ লাভ’ প্রশ্নের উত্তর লিখেছেন। আমি লিখলাম : ‘লাভ = ডিজায়ার + কেয়ার’। ‘আরিগাতো’ (ধন্যবাদ) বলে মেয়েটি তার মন্তব্য-পতাকা মার্কার-কলমে জড়িয়ে নিল।

পোযনান এসে গেল এবং জাপানি মেয়েকে ‘সাইয়োনারা’ (বিদায়) বলে ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। এতক্ষণ আন্তদেশীয় ট্রেনে ভ্রমণ করছিলাম। এবার উঠতে হবে লোকাল ট্রেনে। চারদিকে সবাই পোলিশ ভাষা বলছে। আমি আমার টিকেটটা কন্ট্রোলরুমের এক মহিলাকে দেখালাম। মহিলা এক নজর দেখেই বললো: ‘গ্নিয়েজনঅ। প্ল্যাটফর্ম থ্রি।’ মহিলার মুখে ইংরেজি শুনে আশ্বস্ত হলাম, এবং এও বুঝলাম যে যে শহরে আমি যাবো তার উচ্চারণ ‘ও’-অন্ত নয়, ‘অ’-অন্ত। আমি তিন নং প্ল্যাটফর্মেই ছিলাম সুতরাং কোথাও আর যেতে হলো না। ইতিমধ্যে একটি আন্তজেলা ট্রেন স্টেশন ছেড়ে যাচ্ছিল। ট্রেনের অবস্থা জার্মানি, জাপান বা ফ্রান্সের আধুনিক ট্রেনের মতো নয়, এখানে ওখানে এক আধটু মরিচা পড়েছে কিন্তু সার্বিক ভাবে অবস্থা খুব একটা খারাপ বলা যাবে না। এ রকম মানের ট্রেন আশির দশকে ফ্রান্সে ব্যবহৃত হতো, এখনও হয়তো হয়।

আমি যে লোকাল ট্রেনে ওঠার কথা সেটি প্ল্যাটফর্মে এসে লাগলো। যাত্রিরা জাপানের মতো লাইন ধরছে না, সবাই এক সাথে উঠতে চাইছে। এগুলো কি কোন সমাজের আপাত অনুন্নতির লক্ষণ? উঠে বসলাম বগিতে। আমার সামনে এক একটি পোলিশ জুটি বসে ছিল। তাদের ঘনিষ্টতার পরিমাণ দেখে বুঝলাম, একেবারে নতুন প্রেম। ছেলেটা ক্ষণে ক্ষণে উপচে পড়ছে, মেয়েটি অপেক্ষাকৃত শীতল। পাশের এক সিট থেকে রোগা-মরকুটে এক লোক, সম্ভবত জিপসী, আমার দিকেই কেন জানি বার বার তাকাচ্ছিল। দেখে একটু ভয় ভয় লাগছিল, আমার লাগেজটা নিয়ে না আবার দৌঁড় দেয়। বার বার কোমরের বেল্টে আটকানো পাসপোর্ট আর টাকাপয়সার ব্যাগটিকে কোট দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করছিলাম। একটু পরে টিকেট চেকারকে আসতে দেখেই কিনা জানি না, লোকটি উঠে চলে গেল। আমি আমার টিকেট বের করে দিলাম। জার্মান ভাষায় লেখা টিকেট পড়তে মহিলা চেকার একটু সময় নিল। তবে একটু পরেই, স্ট্যাপলারের মতো একটা মেশিন দিয়ে আমার টিকেটটা পাঞ্চ করে (এ মেশিনে টিকেটে ছিদ্র হওয়ার সাথে সাথে তারিখ আর সময়ও মুদ্রিত হয়ে যায়) ‘থ্যাঙ্কু’ বলে বিদায় নিল। ইংরেজি ভাষার সর্বব্যাপীতা দেখে আবারও অবাক ও আশ্বস্ত হলাম।

তাকিয়ে ছিলাম বাইরের দিকে। একটির পর একটি স্টেশন আসছিল। টিনের সাইনবোর্ডের উপর স্টেশনের নাম লেখা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, অনেকদিন সংস্কার নেই, প্রায় সবগুলো সাইনবোর্ডেই জং ধরেছে। দুই স্টেশনের মাঝের জায়গায় রেললাইন ঘেঁসে দিগন্ত-বিস্তৃত জমি, মাঝে মাঝে বাড়ি-ঘর, বাড়ির সামনে দুই একটি আপেল গাছ। বাড়িঘরের অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে ভালো ছিল না কমিউনিস্ট আমলে। তবে এখন ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে পোল্যান্ডে। নতুন নতুন বাড়িঘর উঠছে। আগামি বছর পাঁচেকের মধ্যেই দৃশ্যপট পুরোপুরি বদলে যাবে। একটি ফ্লাইং ক্লাবও দেখলাম যেখানে রাখা আছে বিভিন্ন রঙের অনেকগুলো ছোট ছোট প্রশিক্ষণ বিমান। লক্ষ্য করলাম, জার্মানি বা ফ্রান্সের মতোই পোল্যান্ডের জমিগুলোতে কোন আইল নেই। জাপানে বা বাংলাদেশে চাষের জমিগুলো আইল দিয়ে ঘেরা ছোট বর্গ বা আয়তক্ষেত্রে। হয়তো অধিক জনসংখ্যা ও সম্পত্তি বন্টন ব্যবস্থার কারণে, বা সেচ দিতে সুবিধা হবে বলে। আরও দেখলাম, মানুষ সমান ব্যাসের খড়ের গোল চাকা পড়ে আছে ক্ষেতের এদিকে ওদিকে যা ফ্রান্সের নর্মান্ডি বা বার্গান্ডি অঞ্চলের পরিচিত দৃশ্য। খড় দিয়ে চাকা বানানোর এই রীতি আমেরিকায়ও দেখেছি, ইদানিং জাপানেও শুরু হয়েছে যদিও ভারতবর্ষে দেখিনি কখনও।

কিছু একটা ঘোষণা হলো। সব না বুঝলেও এটুকু বুঝলাম যে গ্নিয়েযনো এসে গেছে। আমার সামনে বসা তরুণ-তরুণীও গ্নিয়েজনোতেই নামবে। তরুণীটিকে কনফারেন্সের ঠিকানাটা দেখালাম। শ্লাভ একসেন্টে পরিষ্কার ইংরেজিতে তরুণী বললো, ‘ট্যাক্সি নিতে হবে, দশ বা পনেরো যেøাতিসের মতো নিতে পারে।’ আমি একটি মহা বোকামি করেছি, পোল্যান্ডের টাকা যেøাতিস সাথে নিয়ে আসিনি। অবশ্য সময়ও পাইনি। এয়ারপোর্টে ভাঙিয়ে নিতে পারতাম কিন্তু মনে ছিল না। আমি জানতে চাইলাম, গ্নিয়েযনোতে ইওরো ভাঙানো যাবে কিনা। শুনে তরুণী এমনভাবে মাথা নাড়লো যে আমি বুঝে গেলাম ধাদ্ধারা গোবিন্দপুরে এসে গেছি, কিছুক্ষণ পরই সন্ধ্যা নামবে এবং এই ভরসন্ধ্যায় ‘অর্থহীন’ (ইওরো আছে কিন্তু যেøাতিস যে নেই!) অবস্থায় আমি মহাবিপদের সম্মুখীন হতে যাচ্ছি।

খুবই সাদামাটা স্টেশন গ্নিয়েযনো। বাইরে বেরিয়েই দেখলাম, অনেকগুলো ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম ট্যাক্সিওয়ালাকে কনফারেন্সের ঠিকানাটি দেখালাম। সে খুব একটা পড়তে পারে বলে মনে হলো না। পাশে দাঁড়িয়ে ছিল তারই এক সহকর্মী। সে এক নজর দেখেই উচ্ছসিত হয়ে বললো: ‘কলিজ, কলিজ’। বুঝলাম, যেখানে কনফারেন্স হচ্ছে সেই ‘কলেজিউম ইওরোপিয়ায়েউম’ (ল্যাটিন নাম রাখা হয়েছে হয়তো প্রেস্টিজের জন্যে) বেশ পরিচিত প্রতিষ্ঠান এখানে। ড্রাইভার আমার হ্যান্ডলাগেজটি গাড়ির পেছনে রেখে ইঙ্গিত করলো গাড়িতে উঠে বসতে, অন্য অনেক দেশের মতো ট্যাক্সির পেছনের সিটে নয়, সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে। আমি ইংরেজিতে বললাম, ‘আমার কাছে যেøাতিস নেই, ইওরো আছে। কত দিতে হবে?’ ড্রাইভার বুঝতে পারলো না দেখে আমি ভাঙা ইংরেজিতে বললাম: ‘নো যেøাতিস, ইওরো, হাউ মাচ?’ এবার ড্রাইভার সাহেব বুঝতে পারলেন এবং এক গাল হেসে বললেন: ‘পিঞ্চ’। আমি বুঝলাম, পোলিশ ‘পিঞ্চ’ আর বাংলা ‘পাঁচ’ একই বস্তু, অর্থাৎ আমাকে পাঁচ ইওরো দিতে হবে। পোলিশ আর বাংলা উভয়েই ইন্দো (বা হিন্দ)-ইয়োরোপীয় ভাষা হওয়ার সুবাদে ‘পিঞ্চ’ এর মানে বুঝতে পেরে খুশি হলাম, আবার একই সাথে আমার (পাশের বাড়ি বিয়োলো গাই সেই সুবাদে) ‘ইওরোপীয় ভাই’ আমি ‘হিন্দু’র কাছ থেকে সাধারণ ভাড়ার দ্বিগুন (কারণ পাঁচ ইওরো সমান প্রায় বাইশ যেøাতিস) নিচ্ছে জেনে মনটা একটু খচখচও করছিল। যাই হোক, মনকে বোঝালাম, সে যে যেতে রাজি হয়েছে এই আমার সাত পুরুষের ভাগ্য।

স্টেশন থেকে বেরিয়েই দীর্ঘ যানজট ঢাকার কথা মনে করিয়ে দিল। শহরের বাড়িঘর পুরোনো ধাঁচের। এখানে ওখানে বিল্ডিঙের কোনায় যীশু বা মা মেরীর মূর্তি রয়েছে। প্রায় পঞ্চাশ বছরের কমিউনিজম তাহলে সব মুছে দিতে পারেনি। কলেজিউম ইওরোপিয়াউমের সামনে যখন গিয়ে পৌঁছালাম, তখনও সূর্য ডোবেনি। ড্রাইভারকে পাঁচ ইওরো হাতে দিতেই সে খুশীতে ডগমগ হয়ে পোলিশ ভাষায় ধন্যবাদ দিয়ে মুহূর্তে বিদায় নিল। কলেজভবনটি অত্যাধুনিক এবং স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকেও দৃষ্টিনন্দন। কলেজ-ভবনের সামনের দিকে একটি উঠানের মতো আছে এবং উঠানের চারপাশে খিলান দিয়ে ঘেরা। খিলানগুলোর উপর একটি কাঁচের অপরিসর চাল এবং দুই খিলানের মাঝখানে বসার জন্যে পাথরের বেঞ্চ। প্রতিটি খিলানকে জড়িয়ে আছে লাল পাতার লতা যা উঠে গেছে কাঁচের চালে। অস্তায়মান সূর্যের আলো কলেজের দেয়াল আর লাল পাতার উপর পড়ে দেখার মতো একটি দৃশ্য হয়েছে। দূর থেকে লক্ষ্য করলাম, একটি বেঞ্চে অষ্ট্রিয়ার বিখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী উলফাঙ ড্রেসলার বসে গল্প করছেন অন্য এক জনের সাথে। ড্রেসলারের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে ২০০৮ সালে ভিয়েনার রূপতাত্ত্বিক সম্মেলনে। তিনি আমাকে দেখেও যেন দেখলেন না, হয়তো চিনতে পারেননি বা চিনতে চাইছেন না। আমিও উপযাচক হয়ে গিয়ে পরিচয় দেবার চেষ্টা করলাম না কারণ ২০০৮ সালে আমি একবার তা করেছিলাম।

কলেজের ভিতরে ঢুকে শ’ তিনেক ইওরো কনফারেন্স ফি মিটিয়ে দিয়ে কনফারেন্স পুস্তিকা আর হোস্টেল রুমের চাবি নিয়ে নিলাম। কলেজের পাশেই হোস্টেল। রুমে গিয়ে দেখলাম অত্যন্ত সাধারণ কিন্তু বেশ ভালো ব্যবস্থা। একটি খাট, আলমারি, বইয়ের তাক আর একটি টেবিল আছে। এছাড়া ইন্টারকম আছে, ইন্টারনেট-সংযোগও রয়েছে। রুমে ঢুকতেই বামদিকে টয়লেট ও বাথরুম। তিন তলায় আমার রুম থেকে দেখা যাচ্ছিল কলেজের ডাইনিং হল। ডাইনিং হলটি আসলে একটি রেস্টুরেন্ট। বাইরের লোকেরাও এখানে খেতে পারে। ডাইনিং হলে আলাপ হলো ডাচ ভাষাবিজ্ঞানী পিটার সুরেনের সাথে। তিনি আছেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটে। দেখা হলো অন্য এক ডাচ ভাষাবিজ্ঞানী হামানস ক্যামিয়েলের সাথে যার সাথে ২০০৮ সালে ভিয়েনায় পরিচয় হয়েছিল। ক্যামিয়েল কাজ করেন ইওরোপিয়ান পার্লামেন্টে। আমার দিকে ইঙ্গিত করে সুরেন বললেন, ‘আমার দুটি নাতি-নাতনি আছে যাদের গায়ের রঙ তোমার মতো।’ সুরেনের একটি দত্তক নেয়া ছেলে আছে। ছেলেটি মরিসাসের ভারতীয় বংশদ্ভূত। সেই ছেলের ঘরের নাতি-নাতনি। সুরেন বাংলাদেশের রাজধানীর নাম মনে করতে পারছিলেন না দেখে তাঁর ত্রিশ বছরের পুরোনো বন্ধু হামানস ক্যামিয়েল উত্তেজিত হয়ে তোতলাতে তোতলাতে বললেন: ‘আরে কী বলো তুমি। এখন আর ঢাকা শহরকে না চেনার কোন কারণ নেই, প্রায়ই হল্যান্ডের মিডিয়ায় আসে।’

রাতের খাবার দেয়া হলো সন্ধ্যে ছটায়। বাঁধাকপি দিয়ে মাংসের একটি পদ ছিল। ক্যাপশিকামের ভিতর মাংস দিয়ে বেক করা পদ ছিল একটি। ভিতরে চিজ দেয়া পিঠার পদ ছিল একটি। আরও অনেক পদ ছিল, সব মনে নেই, তবে এটার মনে আছে যে সসেজ, বেকন, ইত্যাদিও প্রচূর পরিমাণে ছিল। সবই পোলিশ খাবার এবং তাতে পনির ও মাংসের আধিক্য লক্ষ্য করার মতো। পোল্যান্ডের যে কোন পার্টিতে খাবার ও পানিয়ের ছড়াছড়ি। পোলিশরা বেশির ভাগই যেমন লম্বাচওড়া তেমনি পানভোজনেও তারা কম যায় না। দেখলাম ওরা মগে নয়, গ্লাসে করে বিয়ার খায় এবং গ্লাসগুলোর উচ্চতা জার্মানির সবচেয়ে বড় গ্লাসগুলোর দ্বিগুন। খাবারপর্ব শেষ হবার পর কলেজের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রেরা ডাইনিং হলের মধ্যেই টেবিল চেয়ার সরাতে শুরু করলো। আমাদের চারপাশে বসিয়ে মাঝখানের খালি জায়গায় শেক্সপিয়রের টেমিং অব দি শ্রু (‘মুখরা রমণী বশিকরণ’) অভিনয় করে দেখালো তারা। দর্শকদের মধ্যে লক্ষ্য করলাম ইংল্যান্ডের বিখ্যাত সমাজ-ভাষাবিজ্ঞানী পিটার ট্রাডগিলও আছেন। নাটক চলছিল ডাইনিং রুমের বিভিন্ন জায়গায় এবং একসাথে, অর্থাৎ সব দিকে চোখ না রাখলে নাটকের পুরোটা দেখা যাবে না। নাটকের চাকর শ্রেণীর দুটি চরিত্র (আসলে মেয়ে কিন্তু ছেলের অভিনয় করছে) দর্শকদের জুতো সাফ করে দিচ্ছিল নিজেদের অভিনয়ের ফাঁকে। একজন এসে আমার কেডসে হাত লাগালো। আমি যতই বলি দরকার নেই তবুও সে মানতে চায় না। কাজ শেষে মুচি আমার কাছে পয়সা চাইল। যতটা সম্ভব ব্রিটিশ উচ্চারণে (কারণ নাটকের ভিতরেই রয়েছি এবং পাশে বসে আছেন ট্র্যাডগিল) বললাম, ‘দুঃখিত, আমার কাছে যেøাতিস নেই।’ আসলেও ছিল না। মেয়েটি একটু রাগ দেখিয়ে বললো ‘আমার প্রথম থেকেই আপনাকে কেন জানি একটু অদ্ভুত আর জটিল লোক বলে মনে হচ্ছিল!’ বলা বাহুল্য, সবই অভিনয়। অনেকটা প্যারিসের তেয়াত্র দ্য সোলেইয়ের আরিয়ান মুশকিনের স্ট্যাইল এটি। ছাত্রদের অভিনয় ও বাচনভঙ্গী এক কথায় অপূর্ব যদিও শেক্সপিয়রের ইংরেজি আমি সবটা বুঝেছি এমন দাবি করবো না। গত বছর এই একই ছাত্রেরা নাকি বলিউড স্ট্যাইলে অন্য কোন একটা নাটক মঞ্চস্থ করেছিল। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিভাগগুলোতে (এবং আমাদের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটটে) এ ধরণের নাটক মঞ্চস্থ করার কথা ভাবা যেতে পারে। নাটককে ব্যবহার করা যেতে পারে ভাষাশিক্ষাদানের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে। দশটার দিকে শেষ হলো নাটক। আমি আমার রুমে ফিরে গিয়ে প্রবন্ধের পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনাটি আবার বার বার পড়ে দেখলাম, কোন বানান ভুলটুল আছে কিনা। রাত বারোটায় শুতে যাবার আগে জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখি ভাষাতাত্ত্বিকেরা তখনও ডাইনিংহলের সামনে বসে স-বিয়ার আড্ডা দিচ্ছেন অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সাথে।

যে প্রবন্ধটি আমি এই পোযনান সম্মেলনে উপস্থাপন করতে এসেছি সেটি আমি গত ছয় বছর ধরে লিখছি বা বলা যেতে পারে লিখতে অনেকটা বাধ্য হচ্ছি। প্রবন্ধটির নাম ‘বিজুতরি’ যার মানে ‘অলঙ্কারের দোকান/কারখানা’ বা ‘জুয়েলারি’। এই ‘বিজুতরি’ শব্দে প্রাতিপাদিক/শব্দ ‘বিজু’ (মানে অলঙ্কার) আর প্রত্যয় অরি’র মাঝখানে কেন ‘ত’ ধ্বনিটি আসলো সেটার কারণ বের করার সূত্র ধরেই আমার প্রবন্ধটি বিকশিত হয়েছে। প্রবন্ধটির ভাষা ইংরেজি কিন্তু তথ্য-উপাত্ত ফরাসি। ফরাসি ভাষার গত শ পাঁচেক বছরের ইতিহাসে এর শব্দগঠন পদ্ধতি কিভাবে বদলেছে তাই আমি বলতে চেষ্টা করছি এই প্রবন্ধে। প্রবন্ধটি আমি একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থাপন করেছি। এটি গৃহীত হয়েছে ভিয়েনা, সিউল ও সাইপ্রাসের রূপতত্ত্ব ও ভাষাবিজ্ঞান সম্মেলনে। আমার শিক্ষক রাজেন্দ্র সিংহ মনে করেন, প্রবন্ধটি ভাষাবিজ্ঞানের জগতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। কিন্তু তিনি আমাকে কখনই এ কাজে বিন্দুমাত্র সাহায্য করবেন না বা হ্যাঁ না কিছু বলবেন না, কারণ কাজটি আমার এবং আমাকেই খেটেখুটে তা করতে হবে। খাটাখাটি চলছে গত ছয় বছর ধরে এবং প্রবন্ধটি কালানুক্রমিক রূপতত্ত্বেও নতুন নতুন সব দিক উন্মোচন করছে আমার কাছে।

পোযনান সম্মেলনে আমি যখন প্রবন্ধটি পাঠিয়েছিলাম তখন ধরেই নিয়েছিলাম যে এটি প্রত্যাখ্যাত হবে। কিন্তু আয়োজকেরা সেটি গ্রহণতো করেছেই, তার উপর তারা জানিয়েছে যে প্রবন্ধটি নাকি ৮০% নম্বর পেয়েছে (কোন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রবন্ধে যে নম্বর দেয়া হয় তা এই প্রথম দেখলাম)। মধ্যম মানের ছাত্র বলে ভালো নম্বর পেয়ে এই প্রাগযৌবনেও উচ্ছসিত হলাম (ভুখা মানুষ হটাৎ রসগোল্লা পেলে যেমনটা আহ্লাদে আটখানা হয়!)। এর আগে আমি এই প্রবন্ধটি বহু পত্রিকায় পাঠিয়েছি, কিন্তু কোথাও মুদ্রণের জন্যে বিবেচিত হয়নি। নিরীক্ষকেরা বিভিন্ন মন্তব্য লিখে পাঠিয়েছেন এবং তার আলোকে আমার যুক্তিজাল পরিবর্তন করেছি, যদিও মূল দাবি মোটামুটি একই আছে। কোন নিরীক্ষক বিন্দুমাত্রও আপত্তি করতে পারেন এমন সব অংশই বাদ দিতে দিতে ২০০৪ সালে যে প্রবন্ধটি ছিল প্রায় ৫০ পৃষ্ঠা, আজ এই ১০১০ সালে এসে সেটি দাড়িয়েছে ১১ পৃষ্ঠায়। ছয় বছর ধরে কিছুদিন বিরতি (প্রতিটি বিরতির কারণ কোনও না কোন পত্রিকার প্রত্যাখ্যান) দিয়ে ক্রমাগত রচনা ও সংশোধন করে যাওয়ার কারণে প্রবন্ধের প্রতিটি শব্দ যেন এখন আমার চেনা হয়ে গেছে। প্রবন্ধটির পূর্বতন ভার্সানগুলোর সাথে আজকের ভার্সানটির যখন তুলনা করি তখন অজ্ঞাত নিরীক্ষকদের মনে মনে ধন্যবাদ না দিয়ে পারি না। ভাবি, যত অস্বচ্ছ ছিল আমার চিন্তা তার চেয়েও জড়োসড়ো ছিল সেই চিন্তার প্রকাশ। ভাগ্যিস ছাপা হয়নি, হলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না।

পরদিন সকাল সাড়ে এগারোটায় প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে গিয়ে দেখি কনফারেন্স রুম দর্শক-শ্রোতায় মোটামুটি ভরা (‘কানায় কানায়’ বললাম না কারণ ভাষাবিজ্ঞানীরা সবাই চক্ষুস্মান!)। সুরেন হাত তুলে বললো: ‘এসে গেলাম তোমাকে সাহস আর সমর্থন দিতে।’ হামানস ক্যামিয়েলও ছিলেন। বক্তব্য শুরু করার আগে আমি একটি গল্প বললাম। এক রাজা আর এক রাণীর মধ্যে রাতের বেলায় লেগেছে ঝগড়া। রাণীর দাবি: পৃথিবীর সব পুরুষ বৌয়ের কথামতো চলে। রাজা মানতে রাজি নয়। পরদিন ডাকা হলো রাজধানীর সব পুরুষদের রাজবাড়ির সামনে। চত্বরের মাঝ বরাবর খড়ির গুড়ো দিয়ে দাগ কেটে বলা হলো, আপনাদের মধ্যে যারা বৌয়ের কথামতো চলেন তাঁরা বামদিকে যান আর যারা বৌয়ের কথাকে পাত্তাও দেন না তারা যান ডানদিকে। একজন ছাড়া সব পুরুষ বামদিকে চলে গেলেন। রাজা আশ্বস্ত হলেন এই দেখে যে অন্তত একজন ব্যতিক্রমধর্মী পুরুষ আছেন। কিন্তু যখন তাকে জিগ্যেস করা হলো সে কেন বামদিকে যায়নি তখন লোকটি জানালো যে আসার সময় তার বৌ বলে দিয়েছে: ‘ভিড়ের মধ্যে কক্ষনো যাবে না!’ আমি বললাম, এই গল্পটি আমি আগেই বলে নিলাম কারণ আমার প্রবন্ধ উপস্থাপনের পর যেসব প্রশ্ন করা হবে তার অনেকগুলোর উত্তর এই গল্পে রয়েছে।

প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় বিশ মিনিট আর প্রশ্নের জন্যে দশ মিনিট। উপস্থাপনের আগে আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আমি কি বিশ/দশ চাই নাকি পনেরো/পনেরো (অর্থাৎ বিশ মিনিট উপস্থাপন, দশ মিনিট প্রশ্ন, নাকি পনেরো মিনিট উপস্থাপন আর পনেরো মিনিট প্রশ্ন)। আমি বললাম, ‘আমি পনেরো/পনেরো চাই কারণ আমি প্রশ্নের উত্তর দিতে বেশি আগ্রহী।’ প্রশ্নগুলো আমি যেরকম ভেবেছিলাম, সে রকমই হলো। ফরাসি ভাষায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তো প্রাতিপাদিক আর প্রত্যয়ের মধ্যকার ফাঁক ভরবার জন্যে ‘ত’ ধ্বনিটি ব্যবহার করা হয়। এ নিয়ে তাহলে এতো কথা বলার দরকার কি? আমি বললাম, ‘ঠিক এ জন্যেই প্রবন্ধ উপস্থাপনের আগে আমি রাজারাণীর গল্পটি বলেছিলাম। এটা ঠিক যে বেশিরভাগ সময়েই ‘ত’ ধ্বনির ব্যবহার হয় কিন্তু অনেক শব্দে যে ‘ল’, ‘ক’, ‘ব’ ইত্যাদি ধ্বনির দেখা মেলে তার কি ব্যাখ্যা দেয়া যাবে? কিন্তু ব্যাখ্যা যে নেই তাতো নয়। আমি যে তত্ত্বটি ব্যবহার করেছি সেটি এ সবগুলো ধ্বনির উপস্থিতি ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। প্রশ্নোত্তরের এক পর্যায়ে কিম নামে এক অল্পবয়সী কোরিয়ান (সব কোরিয়ানের নামেই বোধ হয় ‘কিম’ আছে: কিম ইল সুং, আমার এক কোরিয়ান বন্ধুর নামও কিম) ভাষাবিজ্ঞানী মনে হলো খুব রেগে গেল। খুব চড়া গলায় সে বল্লো জর্জ বার্নাড শ এর অনুসারীদের ইংরেজিতে যে ‘শেভিয়ান’ বলা হয় সেই ‘ভ’ কোথা থেকে আসে?’ আমি বললাম, ‘শুধু ‘শ/শেভিয়ান’ দিয়ে প্রমাণ করা যাবে না যে ইংরেজিতে শব্দ গঠনের এ রকম কোন নিয়ম আছে। যদি ‘ল/লেভিয়ান’, ‘র/রেভিয়ান’ ইত্যাদি শব্দজোড় থাকে ইংরেজিতে তবে একটি নিয়মের প্রস্তাব করা গেলেও যেতে পারে।’ প্রবন্ধ উপস্থাপনের পরে আমি কিমকে জিগ্যেস করলাম: ‘তুমি আমার উপর এত রেগে গেলে কেন বলোতো?’ ও বললো: ‘কে বললো, আমি তোমার উপর রেগে গেছি? আমিতো তোমার কথাকে সমর্থন করছিলাম! আমি একটু জোরে কথা বলি বলে লোকে প্রায়ই আমার কথা শুনে ভয় পায়! তাছাড়া, আমি তোমার উপর রাগ করবো কেন? সান ফ্রান্সিসকোর যে এলাকায় আমি বড় হয়েছি সেখানে আমার অনেক বাংলাদেশী বন্ধু ছিল।’

আমার প্রবন্ধের এক জায়গায় একটি হিব্রু শব্দ ছিল: ‘হাগদালা’। শব্দটির মানে ‘টাওয়ার’। যীশুর মা মেরী মাগদোলেনের নামেও ‘হ-গ-দÑল’ ধাতুটি আছে। ভাষাবিদ পিটার হুক এক ই-মেইলে জানিয়েছেন, সম্ভবত মেরীর পূর্বপুরুষ প্যালেস্টাইনে এমন এক গ্রামে বাস করতো যেখানে একটি টাওয়ার বা বুরুজ ছিল। ইজরাইল থেকে আসা এক ভাষাবিজ্ঞানী জানালেন এ ধরণের সব শব্দ ‘হ’ দিয়ে শুরু হয় এবং ‘ল’ দিয়ে শেষ হয়। আমি তাঁর মন্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা বিন্দুমাত্রও বুঝতে না পেরে জিগ্যেস করলাম: ‘হোয়াই ইজ ইট এ্যা প্রবলেম ফর মি?’ উনি হেসে বললেন, ‘আই ডোন্ট ওয়ন্ট টু গিভ ইউ এনি প্রবলেম। প্রবলেমস, ইউ হ্যাভ এনাফ!’। হাসির রোল উঠলো কনফারেন্স রুমে। আমি বললাম, ‘সমস্যা সম্ভবত আপনাদেরকে আমার বোঝাতে না পারার।’ ততক্ষণে সময় শেষ হয়ে গেছে। আয়োজকেরা উপস্থাপনা ও উষ্ণ আলোচনাপর্বের জন্যে আমাকে ধন্যবাদ দিলেন। হামানস ক্যামিয়েল উচ্ছসিত প্রশংসা করলেন। আমি হেসে বললাম, ‘আমি আমার পণ্যের (অর্থাৎ যে তত্ত্বটি আমি ব্যবহার করছি) বিজ্ঞাপন যথাসাধ্য দিচ্ছি। ক্রেতারা যদি কিনতে না চায় তবে তার দোষ তাদের উপরই বর্তাবে।’ হামানস ক্যামিয়েল হেসে জবাব দিলেন, ‘না, বিজ্ঞাপন তুমি ভালোই করেছো।’

আমার প্রবন্ধ উপস্থাপনের পরেই চা-বিরতি। সেখানে দেখলাম উইলিয়াম লাবোভকে। জগৎ-বিখ্যাত সমাজ-ভাষাবিজ্ঞানী। ভাবলাম, একটু কথা বলি। কিন্তু তিনি সর্বক্ষণ হয় ট্রাডগিলের সাথে নয়তো কোন সুন্দরী ছাত্রীর সাথে আলাপে ব্যস্ত। হয়তো সুন্দরীরাই তাঁকে ঘিরে থাকতে চায়, তারকা অধ্যাপক/গবেষক বলে কথা! ট্র্যাডগিলও সর্বদা সুন্দরী-পরিবৃত। এঁদের দুজনেরই অনেক বয়স হয়েছে। ট্র্যাডগিল ছোটখাটো, শ্মশ্রুম-িত। লাবোভ হয়তো এতটা খর্বখায় ছিলেন না যৌবনে কিন্তু এখন বার্ধক্যের কারণে ছোটখাটোটি হয়ে গেছেন। খুব আস্তে কথা বলেন লাবোভ। কিন্তু এখনও ভাষা বিষয়ে কী আগ্রহ। খুঁটে খুঁটে সব তথ্য জিগ্যেস করেন। প্রশ্ন জিগ্যেস করার সময় দাঁড়িয়ে যান। যে দু’দিন ছিলাম সম্মেলনে আমার সঙ্গে লাবোভের কথা হয়নি। অবশ্য আমার মতো সামান্য লোকের কীইবা বলার ছিল তাঁকে। তাছাড়া আমাদের কাজের ক্ষেত্রও এক নয়। ট্র্যাডগিলের সাথে অবশ্য পরদিন সকালে মুহূর্তের জন্যে সৌজন্যবিনিময় হয়েছিল। আমি জিগ্যেস করেছিলাম: ‘ভালো আছেন, স্যার!’ তিনি বলেছিলেন, ‘এতক্ষণ ছিলাম না। কিন্তু সকালের নাস্তাটা খেয়ে শরীরটা চনমনে লাগছে।’

আমার পরেই ছিল হল্যান্ডের রোলঁ নসকের উপস্থাপনা এবং তার পর মধ্যাহ্নভোজনের বিরতি। মধ্যাহ্নভোজনে দেখা হলো আগের দিন আলাপ হওয়া অক্সফোর্ডের রঞ্জন সেন, ইওরোপিয়ান পার্লামেন্টের হামানস ক্যামিয়েল আর ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটের পিটার সুরেনের সঙ্গে। রঞ্জন সেন ল্যাটিন ভাষায় পি.এইচ.ডি. করেছে সম্ভবত অক্সফোর্ড থেকে। বাঙালি ছেলে কিন্তু বাংলা তেমন বলতে পারে না বা বলতে চায় না। রঞ্জন বলছিল যে কিছু অর্থের সংস্থান হলে সে বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের উপর কিছু গবেষণা করতো। আমি বললাম, ‘আজকাল ভাষাবিজ্ঞানের গবেষণা হচ্ছে হর্স-চিকেন সুপ।’ সবাই উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো, সেটা আবার কি জিনিষ। গল্পটা রাজীব গান্ধীর কোন একটি সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম। এক রেষ্টুরেন্টের মেনুতে হর্স-চিকেন সুপ দেখে এক কাস্টমার সেই সুপ অর্ডার করলো। সুপ আসার পর এক চামচ মুখে দিয়ে কাস্টমার দেখলো সুপটি শুধুই ঘোড়ার মাংসের, ওতে চিকেনের নামগন্ধও নেই। ওয়েটারকে জিগ্যেস করা হলো, সুপে ঘোড়ার মাংস আর মুর্গির মাংসের অনুপাত কত। ওয়েটার বললো : ‘স্যার ফিফটি ফিফটি।’ ঘোড়ার ফিফটি আর মুরগির ফিফটি মেশালে সুপে মুরগির মাংসের অস্তিত্ব অনুভব করা সহজসাধ্য নয়। আমি বললাম, ‘আজকাল ফান্ডিঙের দিকে লোকের যতটা আগ্রহ সত্যিকার গবেষণার দিকে ততটা আগ্রহ নেই। অথচ ঊনবিংশ শতকে জন বীমসের মতো ম্যাজিস্ট্রেট বারো ঘন্টা সরকারি চাকুরি করেও ঢাউস সাইজের (পৃষ্ঠাসংখ্যা হাজারের উপরে) ইন্দো-আর্য ভাষার ব্যাকরণ লিখেছিলেন এবং কোন ফান্ডিং ছাড়াই।’

কথা উঠলো আমার প্রবন্ধ নিয়ে। আমি বললাম, ‘যে মডেলটি আমি ব্যবহার করেছি সেটি নতুন কিছু নয়, আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের জনক সস্যুরও এই মডেলের কথা উল্লেখ করেছেন।’ সুরেন বললেন: ‘আমি সস্যুরকে ভাষাবিজ্ঞানে অথরিটি মনে করি না।’ আমি বললাম, ‘সস্যুর যদি অথরিটি না হয় তবে ভাষাবিজ্ঞানে কাকে অথরিটি মানবো?’ হামানস ক্যামিয়েল সুরেনের নিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে উচ্চকন্ঠে বলে উঠলেন: ‘হি হিমসেল্ফ ইজ দি অথরিটি!’ খাবার টেবিলে হাসির রোল উঠলো। সুরেন বিচলিত হলেন না। তিনি বুঝিয়ে বললেন, ‘সস্যুর নিজেতো তাঁর বিখ্যাত বইটি লেখেননি, ক্লাসে তিনি যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তাই তাঁর মৃত্যুর পর ছাত্রেরা একসাথে করে ছাপিয়েছে। সুতরাং কোনটা সস্যুরের কথা কোনটা নয় তা সঠিকভাবে বলা মুষ্কিল।’ সস্যুর কেন লিখে যাননি? স্যসুর সংস্কৃতভাষায় প-িত ছিলেন। হয়তো তিনি এই সংস্কৃত প্রবাদবাক্যটি জানতেন: ‘শতম বদ, মা লিখ’ অর্থাৎ যত পারো বকবক করো কিন্তু ভুলেও কিছু লিখতে যেওনা। যদি লেখো, তবে তোমার দায়িত্ব দাড়িয়ে যাবে ভুল কিছু না লিখার। খাবার টেবিলে বেশিরভাগের মত ছিল এই যে লিখতে হবে কারণ তা না হলে পরবর্তি প্রজন্ম দিকনির্দেশনা পাবে কেমন করে। কেমন করে তারা জানবে কোথা থেকে তারা শুরু করবে? আমি বললাম, ‘আমার লেখার কোন ভুলের কারণে পরবর্তি প্রজন্ম বিভ্রান্তও হতে পারে।’ কামিয়েল অবশ্য বললেন যে পরবর্তি প্রজন্মের লোকদের ঘিলুতে যথেষ্ট বুদ্ধি থাকবে, তারা ছাই ঘেঁটে মুক্তা ঠিকই বের করে নেবে।

এ প্রসঙ্গে মনে পড়লো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক প্রায় কিছুই লেখেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃটিশ উপাচার্য যখন তাঁকে ডেকে পাবলিকেশন না থাকার কারণ জিগ্যেস করেছিলেন তখন তিনি উত্তর দিয়েছিলেন: ‘আমার নিয়োগপত্রের কোথাও কি লেখা আছে যে আমার পাবলিকেশন থাকতেই হবে?’ সুতরাং তাঁর প্রমোশন হচ্ছিল না। তিনি নাকি প্রমোশনের জন্যে দরখাস্তও করতেন না। তাঁর মত ছিল এই যে বিশ্ববিদ্যালয় যদি আমাকে প্রমোশনের যোগ্য মনে করে তবে এমনিই প্রমোশন দেবে, আমাকে আবার দরখাস্ত করতে হবে কেন! হামানস কামিয়েল জানালেন যে তাঁর এক অধ্যাপকও জীবনে কিছু লেখেননি। একটি প্রবন্ধ কোথাও ছাপা হয়েছিল যেটি নাকি কামিয়েলই লিখে দিয়েছিলেন। মধ্যাহ্নভোজনের শেষ প্রান্তে এসে আমরা সবাই এ উপসংহারে উপনীত হলাম যে অবশ্যই লেখা উচিত, কিন্তু হাজার বার ভেবে লেখা উচিত। আজ একটা কিছু লিখলাম, আবার দুদিন পরেই বললাম, ‘দুঃখিত, আমি তখন ভুল লিখেছিলাম’, এতে কাগজ-কালির অপচয়তো হয়ই, পাঠকেরাও বিভ্রান্ত হয়। ঔমর খৈয়ামের একটি উক্তি এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়: ‘এমনভাবে কাজ করো যাতে তোমার উত্তরপুরুষ তোমাকে দোষ না দিতে পারে।’

রঞ্জন সেনকে কারও উপস্থাপনায় যেতে দেখিনি। কারণ জিগ্যেস করাতে রঞ্জন জানালো সে ভীষণ ব্যস্ত, তাকে অক্সফোর্ডের খাতা কাটতে হচ্ছে, থিসিস দেখতে হচ্ছে, সিলেবাস তৈরি করতে হচ্ছে! কামিয়েল শুনে বললেন, ‘আমার অত সময় নেই। আমি পাঁচ মিনিট চোখ বুলিয়েই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই, কাকে কত নম্বার দেবো। ছাত্ররা অবশ্য ভাবে আমি মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি থিসিস বা খাতা দেখি। একটা থিসিস দেখতে আমি যদি দুই দিন কাটিয়ে দিই তাহলে বাকি কাজ কখন করবো?’ আমি বললাম, ‘তাতে আপনার হয়তো সময় বাঁচছে কিন্তু আবেদনকারী ছাত্রদের প্রতি সুবিচার করা হচ্ছে না। আমার শিক্ষক প্রবাল দাশগুপ্ত কারো চেয়ে কম ব্যস্ত নন। কিন্তু তিনি আমার থিসিস কমপক্ষে তিন বার পড়েছেন এবং এমন সব মন্তব্য করেছেন যাতে আমি অত্যন্ত উপকৃত হয়েছি। এ প্রসঙ্গে বলি, খাতা দেখার বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে বাংলাদেশে শিক্ষকদেও মধ্যে একটি কৌতুক প্রচলিত আছে (ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষক মাইনুদ্দীন খালেদের মুখে শোনা)। প্রথমে তৌলন পদ্ধতি। পরীক্ষকের কাছে একটি দাড়িপাল্লা থাকবে। যে খাতার ওজন বেশি হবে সেই খাতা বেশি নম্বর পাবে। এছাড়া আছে বিঘৎ পদ্ধতি, কে কত লম্বা লিখেছে মাপতে হবে। আছে পান পদ্ধতি অর্থাৎ পানের বিড়ার মতোই পৃষ্টা সংখ্যা দিয়ে বিচার করা হবে কাকে বেশি নম্বর দেয়া হবে। লোড-শেডিঙের সময় এ পদ্ধতিতে খাতা দেখা যেতে পারে। এছাড়া, আপনি খাতাগুলোকে ছুঁড়ে মারতে পারেন একটি একটি করে, যেটি যত দূরে যাবে সেটি তত বেশি নম্বর পাবে।’ ডাইনিং রুমে আবার হাসির হল্লা উঠলো।

মধ্যাহ্নভোজনের পর অত্যাধুনিক হলরুমে লাবোভের প্লেনারি বক্তৃতা। এ ধরণের বক্তৃতায় বক্তাকে উপস্থাপনের একটা ব্যাপার থাকে, যদিও লাবোভের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিকে পরিচয় করিয়ে দেবার কিছু নেই তবু নিয়মরক্ষার জন্যে লাবোভকে পরিচয় করিয়ে দিলেন সমাজ-ভাষাবিজ্ঞানের অন্য এক দিকপাল পিটার ট্রাডগিল। আয়োজকদের মধ্যে একজন মঞ্চে এসে বললেন: ‘বন্ধুগন এটি একটি ঐতিহাসিক ও বিরল মুহূর্ত। এক দিকপালকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে অন্য এক দিকপাল। মুহূর্তটি উপভোগ করুন!’ লাবোভ নতুন কিছু বললেন না। গত পঞ্চাশ বছর ধরে যা বলে আসছেন তিনি তারই পুনরাবৃত্তি করলেন। তাঁর মূল দাবি এই যে ভাষা প্রধানত একটি সামাজিক সংশ্রয় (সিস্টেম)। এর পরিবর্তন সামাজিক পরিবর্তনের সাথে যুক্ত। দর্শক-শ্রোতাকে আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে একই ইংরেজি শব্দের ভিন্ন ভিন্ন উচ্চারণ শুনিয়ে তিনি তিনি দেখালেন, কিভাবে নতুন প্রজন্মের উচ্চারণ/ব্যাকরণ পূর্ববর্তি প্রজন্মের উচ্চারণ ও ব্যাকরণ থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ভাষার পরিবর্তন হয়।

লাবোভের বক্তব্যের পরে ছিল সুরেনের সেশন। সুরেন ভাষাদর্শন নিয়ে কাজ করেন। সুরেনের মত এই যে ফরমাল লজিক দিয়ে ভাষাকাঠামো ব্যাখ্যা করার কিছু সমস্যা আছে। তিনি দাবি করেন, তাঁর নিজের উদ্ভাবিত লেক্সিকাল/আভিধানিক লজিক দিয়ে যে কোন ভাষাকাঠামো বর্ণনা করা সম্ভব। ভাষায় ফরমাল লজিকের ব্যবহার প্রসঙ্গে বাট্রান্ড রাসেলসহ আরও অনেক দার্শনিকের কথা উল্লেখ করলেন তিনি। রাসেল প্রসঙ্গে তাঁর একটি মন্তব্য শুনে দর্শক-শ্রোতারা খুব মজা পেয়েছে: ‘দীর্ঘজীবন শেষে অতিবৃদ্ধ রাসেল যখন অবশেষে মরবার সিদ্ধান্ত নিলেন…’ আমি বয়োবৃদ্ধ লাবোভ আর ট্র্যাডগিলের দিকে তাকালাম। তাদের দু’জনের কারো মুখে হাসি নেই। সুরেনের বয়সও অবশ্য পঁচাত্তরের কম নয়। তিনি অবসর নিয়েছেন বছর দশেক আগে। ভদ্রলোকের মনে প্রাচ্যদেশসুলভ ‘কৃষ্ণ রসবোধ’ (ব্ল্যাক হিউমার) আছে। দত্তক নেয়া ভারতীয় বংশোদ্ভূত ছেলের কাছ থেকেই এ গুনটি পেয়েছেন কি? পশ্চিম ইওরোপ বা আমেরিকায় লোকজন কারও মৃত্যু নিয়ে সাধারণত কৌতুক করে না।

বিকেলবেলা সম্মেলন কর্তৃপক্ষ আমাদের বাসে করে নিয়ে গেল পোযনান শহর দেখাতে। অত্যাধুনিক বাসের সামনের দিকেই জায়গা নিলাম দেখার সুবিধা হবে বলে। পোল্যান্ডে সবুজের সমারোহ চোখে পড়ার মতো। এদিকটাতেও নতুন নতুন সব বাড়িঘর উঠছে। আগামি বছর পাঁচেকের মধ্যেই হয়তো পোল্যান্ড অনেকটাই পশ্চিম ইওরোপীয় দেশ হয়ে উঠবে। পাশের সিটে যে মহিলাটি বসে ছিলেন তাঁর সাথে আলাপ করে জানা গেল তিনি ইতালির এক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপিকা। যা দস্তুর, প্রথমে আবহাওয়া দিয়ে আলাপ শুরু হলো। তিনি জানালেন, জার্মানি আর ইতালিতে বৃষ্টি হচ্ছে। আমরা মহা ভাগ্যবান বলতে হবে কারণ গ্নিয়েজনোতে এখনও রোদ আছে। মনে পড়লো খনার বচনের কথা। এখন আগামি তিন দিন বার্লিনে বৃষ্টি না হলেই হয়। মহিলার সঙ্গে আলাপ করে জানলাম ইতালীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা সম্পর্কে। ছাত্ররা পাস করে বের হচ্ছে এবং বেকার হচ্ছে। সার্টিফিকেটের সাথে কাজের জগতের কোন সম্পর্ক নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বিভাগে ভর্তিপরীক্ষা আছে এবং তা বেশ কঠিন। তবুও বেকার না থাকার জন্যে বা পাশ করলে চাকুরি মিলতেও পারে এই আশায় অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়।

ইতালীর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের তিনটি শ্রেণী আছে: গবেষক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক। প্রতিটি পর্যায়ে চাকুরি ও প্রমোশন পেতে হলে নিরীক্ষাধর্মী (পিয়ার রিভিউড) পত্রিকায় গবেষণামূলক প্রবন্ধ থাকতে হবে যত বেশি সম্ভব। এর পর প্রতিযোগিতামূলক লিখিত পরীক্ষা আছে, আছে মৌখিক পরীক্ষাও। অনেকে ফেল করে, সারা জীবনে কয়েকবার এবং অবশেষে লজ্জ্বায় ক্ষ্যান্ত দেয়। অধ্যাপক পদে নিয়োগ পেতে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় পাশতো করতে হবেই, এর পর রাজনৈতিক বিবেচনারও প্রয়োজন হয়। অনেকেই ত্রিশ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েও অধ্যাপক না হয়েই অবসরে চলে যান। ভাবলাম, বাংলাদেশে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা কত সুখেই না আছি। অধ্যাপক হওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার। অনেক সময় দশ বছরেই ‘অধ্যাপক’ হওয়া সম্ভব তেমন কোন গবেষণা না করেই। আমাদের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের সংখ্যা হয়তো প্রভাষকের চেয়ে বেশি, অনেকটা বানানা রিপাবলিকের সেনাবাহিনীর মতো যেখানে সৈনিকের চেয়ে জেনারেল বেশি। এ সুযোগ ক’দিন পরে আমিও পাবো, কিন্তু ‘অধ্যাপক’ হবার মতো জ্ঞান ও গবেষণার অভিজ্ঞতার অভাব প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি বলে অধ্যাপক হবার সম্ভাবনাতে কখনই উৎফুল্ল বোধ করি না, বরং অজানা অপরাধবোধে ভুগি, কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আসল ‘অধ্যাপক’দের দেখার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে।

মহিলার সাথে আলাপ হলো ইতালির জিপসি বা রোমাদের নিয়ে। জিপসিরা হাজার বছরের বেশি সময় আগে ভারতবর্ষ থেকে ইরাণ, তুরস্ক ও মধ্য এশিয়া হয়ে ইওরোপে পৌঁছে। কখনও এক জায়গায় স্থায়ি হয় না তারা, ক্যারাভান নিয়ে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে ঘুড়ে বেড়ায়। সম্প্রতি রুমানিয়া আর বুলগেরিয়া থেকে আসা জিপসিদের ফ্রান্স থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে। মহিলা বললেন, ‘আগে ইতালীর রোমারা কাজকর্ম করতো। অনেককে জুতা সেলাইয়ের কাজ করতে দেখেছি। এখন রোমা মহিলারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করে, গাড়ি থামলেই দৌঁড়ে গিয়ে হাত পাতে। সাথে ছোট বাচ্চারাও থাকে। পুরুষেরা কিছুই করে না, ঘরে বসে বীয়র টানে।’ প্যারিসে এক জিপসি মেয়ের সাথে আলাপ হয়েছিল আশির দশকের শেষ দিকে। মেয়েটি গর্ব করে বলেছিল, ‘আমিতো ফরাসি নই আমি জিতান’ (অর্থাৎ জিপসি)। তার সঙ্গে আলাপ করে দেখেছিলাম, জিপসি ভাষার অনেক শব্দের সাথে বাংলা বা হিন্দি শব্দের মিল আছে।

আমি দেখেছি, ইওরোপীয়রা সাধারণত জিপসিদের পছন্দ করে না। হিটলারের নাৎসি বাহিনী কয়েক লক্ষ জিপসিকে হত্যা করেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। মুজতবা আলী লিখেছেন, হিটলার প্রথমে মেরেছে পাগলা গারদের সব পাগলদের, তারপর কমিউনিস্টদের, তারপর জিপসিদের এবং সবার শেষে ইহুদিদের। মিডিয়ার পক্ষপাতিত্ত্বের কারণে ইহুদি হোলোকাস্টের কথা আমরা যত শুনি, জিপসি হোলোকাস্টের কথা তত শুনি না। জিপসিদের মধ্যে অনেক বড় বড় সঙ্গীত-শিল্পী আছেন, ধনীও আছেন অনেকে, কিন্তু অধিকাংশ জিপসিই গরীব। অবশ্য ইওরোপিয়রা বলে ওরা গরীব থাকতে চায়। এই জিপসিদের আমি শ্লোভাকিয়ার কশিচে শহরেও দেখেছি। রাস্তার ধারের রেষ্টুরেন্টে খেতে বসেছিলাম। জিপসি বাচ্চারা এসে হাত পাতছিল। জামাকাপড় নোংরা, নাক দিয়ে সিকনি গড়িয়ে পড়ছে। এক বাচ্চাকে ডাস্টবিন থেকে বীয়রের বোতল খুঁজে নিয়ে মুখে উপুড় করে দিতেও দেখেছি। কশিচে স্টেশনের আশেপাশে অল্পবয়সী জিপসি ছেলেমেয়েরা আড্ডা দিচ্ছে ভর দুপুরে। কারও কোন কাজকর্ম নেই, সেকি তারা কাজ করতে চায় না বলে নাকি কাজ তাদের কেউ দেয় না বলে তা জানা সম্ভব হয়নি। বার্লিনেও জিপসি মহিলাদের ভিক্ষা করতে দেখেছি। বিদেশি দেখলেই একটা হাতে লেখা কাগজ ধরিয়ে দেবে আর জিগ্যেস করবে: স্পিক ইংলিশ? লম্বা কালো চুল, কালো ডাগর চোখ আর তামাটে রঙ দেখে এই জিপসি মেয়েরা যে আমাদেরই ‘জাতবোন’ তাতে কোন সন্দেহ থাকে না।

ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই পোজনান শহরে পৌঁছে গেলাম। বাস থেকে নেমে দেখলাম, এক মহিলা গাইড এসেছেন, তিনি আমাদের মূল শহর ঘুড়িয়ে দেখাবেন। পোযনান শহরের সাথে আমি গত বছর দেখা শ্লোভাকিয়ার কশিচে শহরের অনেক মিল খুঁজে পেলাম। মূল শহরে একটি চত্বর, চত্বরের চার পাশে তিন/চার তলা বাড়ি। জানালাগুলো ছোট ছোট, বারোক শৈলীর। চারপাশের বাড়িগুলোর এক তলায় রেস্টুরেন্ট বা দোকান, উপরের তলাগুলোতে দেখলাম লোক থাকে। গাইড জানালেন, আগেকার দিনে নাকি জানালার আকার দেখে কর নির্ধারণ করা হতো। যার জানালা যত বড়, ভাবা হতো সে তত বড়লোক সুতরাং তাকে তত বেশি আয়কর দিতে হবে। কর কমানোর জন্যে অনেকেই জানালা ছোট রাখতে বাধ্য হতো। জিগ্যেস করলাম, ‘এখন এখানে কারা থাকে?; গাইড জানালো, সাধারণ লোকেরাই থাকে। তবে তাদের অভিযোগ আছে অনেক। এই চত্বরে প্রায়ই উৎসব হয়। উৎসবে এত হৈচৈ হয় যে কান ঝালাপালা হয়ে শহরের মূল কেন্দ্রে থাকার আনন্দ সামান্যই অবশিষ্ট থাকে।

চত্বরের এক কোনে একটি গীর্জায় ঢুকলাম আমরা। গীর্জার ভিতরে এদিক ওদিক লাল, সবুজ আর সাদা রঙের মার্বেল পাথরের উপর সোনালি কারুকাজ চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এর সাথে ফ্রান্স বা অস্ট্রিয়ার গীর্জার ভিতরের যে কারুকাজ তার কোন তুলনাই হয় না। প্রার্থনা চলছিল। প্রার্থনারত ভক্তের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। আরও একটি গীর্জায় গেলাম আমরা। সেখানেও একই ব্যাপার। পোল্যান্ডের গীর্জাগুলোর ভবিষ্যৎ পশ্চিম ইওরোপের গীর্জাগুলোর তুলনায় উজ্জ্বলতর বলেই মনে হলো। গীর্জা থেকে বেরিয়ে একটি পুরোনো আমলের পাথর-আঁটা রাস্তা পার হয়ে পাওয়া গেল অন্য একটি চত্বর। চত্বরের এক পাশে পিতলের দুটি যুধ্যমান দাড়িওয়ালা রামছাগলের মুর্তি প্রমান সাইজের। গ্নিয়েজনো শহরে কবে কোন এক উৎসবের দিনে এক ছোট ছেলে রান্নাঘরে খাবার পায়নি বলে দুটি বুনো ছাগল মেরে রান্না করে সবাইকে খাইয়েছিল। এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আজ এই দুই ছাগলের মূর্তি পোযনান শহরের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। জানি না শীতল যুদ্ধের যুগে কোন পোলিশ কবি বা সাহিত্যিক দুই পরাশক্তির সাথে এই দুই ছাগলের তুলনা করেছিলেন কিনা। চত্বরের এক জায়গায় এক যাজকের মূর্তি। এক সময় নাকি পোযনান শহরে প্রায়ই বন্যা হতো। এই বন্যার অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে এই মূর্তি স্থাপন করা হয় এবং সে থেকে পোযনান আজ পর্যন্ত আর বন্যাকবলিত হয়নি।

শহর দেখার দলে ছিলেন লাবোভ, গুটি গুটি হাঁটছেন সবার সাথে। বোঝা যাচ্ছে, বয়স তাঁর ঔৎসুক্যকে দমাতে পারেনি। ট্র্যাডগিলকে দেখলাম না আমাদের দলে। হাঁটতে হাঁটতে আলাপ হলো এক ইজরাইলী অধ্যাপকের সাথে। নাম গিলান (আরবিতে হয়তে জিলান হবে) জুকারমান (মানে সুগারম্যান। হয়তো পিতৃপুরুষের কারো চিনির কারখানা বা দোকান ছিল জার্মান অঞ্চলে)। অস্ট্রেলিয়ায় কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। আমি যে ইনস্টিটিউটে পোষ্টডক করছি জাপানে তিনিও সেই ইনস্টিটিউটে পোস্টডক করেছেন। গিলান ভাষার পুনরুজ্জীবন নিয়ে কাজ করেন। ভাষামৃত্যুর ব্যাপারটা আজকাল খুব প্রচার পাচ্ছে। প্রতি বছরই কোন না কোন ভাষা মরে যাচ্ছে। অন্যদিকে বহুকাল আগে মৃত হিব্রুভাষাকে ঊনবিংশ-বিংশ শতকে আবার পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। এর পর আলাপ হলো জঁ ক্লদ নামে এক ফরাসির সাথে। জঁ ক্লদ কাজ করেন ব্রোতোঁ ভাষা নিয়ে। এ ভাষাটিও মুমূর্ষু তবে ইদানিং বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থা গ্রহণের কারণে অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। আমি জঁ ক্লদকে জিগ্যেস করলাম: ‘ব্রোতোঁ কি আদৌ বাঁচবে?’ জঁ ক্লদ জবাব দিল ‘স্বাস্থ্য যে আগের চেয়ে ভালো তাতে কোন সন্দেহ নেই, তা না হলে আমি কি আর এ সম্মেলনে আসতে পারতাম?’ জঁ ক্লদ ছিল সরকারী আমলা, স্কুলের শিক্ষক, কিন্তু এসব পেশার কোনটাই তার ভালো লাগছিল না বলে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে সে এক পুতুলনাচের দলে যোগ দেয়। কাজটা শেখা নাকি মোটেও সহজ নয়। আট দশ বছর ফ্রান্সের বিভিন্ন অঞ্চলে স্কুলের বাচ্চাদের পুতুলনাচ দেখানোর পর সে কাজ ছেড়ে দিয়ে জঁ ক্লদ এখন ব্রোতোঁ ভাষা নিয়ে গবেষণা করছে।

সাতটার দিকে আমরা রেষ্টুরেন্টে গেলাম। বেশ বড় রেস্টুরেন্ট। একসময় বোধ হয় বিয়র তৈরির কারখানা ছিল। শষ্য গেঁজানোর দুটি পিতলের ঝকঝকে বয়লার এখনও পাশাপাশি রাখা আছে যার সামনে গাইয়ে-বাজিয়েরা অপেক্ষা করছেন, গীটার হাতে, ড্রাম সামনে নিয়ে। দেখে অবশ্য আমি প্রমাদ গুনলাম কারণ টিউনিঙের শব্দেই বোঝা যাচ্ছিল, রেস্টুরেন্টের অ্যাকুস্টিক ভালো নয়, অর্থাৎ গানবাজনা শুরু হলে কানের দফাগয়া। লাবোভ আর ট্র্যাডগিল ভুল করে একেবারে সামনেই বসেছেন, বুড়ো কানে সইলে হয়। খাবার ব্যবস্থা বুফে অর্থাৎ যে যার পছন্দমতো এবং ইচ্ছেমতো নিয়ে খাও। হলরুমের একদিকে রান্নার বিভিন্ন পদ সারে সারে সাজানো। বেশির ভাগই মাংস। বিয়ারের ঢাউস সাইজের গ্লাস একটি শেষ হতে না হতেই সুদর্শনা পরিচারিকারা একাধিক গ্লাস এনে রাখছে আমাদের সামনে। জঁ ক্লদ বললো, ‘পোলিশরা খুব টানতে পারে তো!’, যদিও টানায় কেউই কম যাচ্ছিল না। ঘন্টাখানেক পরে শুরু হলো মিউজিক। সুরেনসহ আরো অনেকে নাচতে শুরু করলেন মহিলাদের নিয়ে। জঁ ক্লদও আমাদের টেবিলের এক মেয়েকে ডেকে নিয়ে এক চক্কর নেচে এসে বললো, ‘খাবারটা একটু হজমের ব্যবস্থা করলাম।’ আমি নাচতে পারি না বলে নাচ দেখলাম কিছুক্ষণ। কিন্তু সঙ্গীতের তীব্র শব্দে কান ঝালাপালা হচ্ছিল বলে মাঝে মাঝেই বাইরের চত্বরে ঘুড়ে আসছিলাম। চত্বরের রেস্টুরেন্টগুলোতেও সমানে পানভোজন চলছে। শনিবারের রাত বলেই বোধ হয় এত লোক চারিদিকে।

কথা ছিল রাত সাড়ে এগারোটায় আমরা ফিরে আসবো। ভালুকের নেশায় বাসে উঠেই ঘুমিয়ে পড়লাম এবং ঘুম ভাঙতেই দেখি গ্নিয়েজনো এসে গেছে। ২৬ তারিখ সকালে ঘুম থেকে উঠে ভাবলাম পোল্যান্ডের প্রাচীন রাজধানী দেখার সময়তো হবে না, শহরের গীর্জাটা অন্তত দেখে আসি। কলেজিয়ুমের পেছনে আছে একটি পার্ক, পার্কের ভিতর দিয়ে বয়ে চলেছে একটি নদী (বাঁকানো হ্রদও হতে পারে রমনা পার্কের সার্পেন্টাইন লেকের মতো) যার ওপারে গীর্জা। পার্কের এখানে ওখানে কাঠ দিয়ে তৈরি বিমূর্ত ভাষ্কর্য দেখতে দেখতে গীর্জার দিকে হাঁটা শুরু করলাম। একটু শীত শীত লাগছিল। কত দূর গিয়ে ভাবলাম, ফিরে যাই, ঠান্ডা লেগে অসুখ করলে বার্লিন-ভ্রমণের বারোটা বাজবে। গ্নিয়েজনোর শহর-বিবরণীতে কয়েকটি যাদুঘর, পুরোনো বাজার এলাকা ইত্যাদি অনেক কিছুর কথা বলে হলেও স্থানীয় লোকেরা অবশ্য বলেছিল, দেখার মতো কিছুই নেই এই শহরে।

প্রাতরাশ শেষ হবার পর সকালে প্রথম উপস্থাপনা ছিল গিলান জুকারমানের। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, যদিও দাবি করা হয় যে হিব্রু ভাষা পুনরুজ্জীবিত হয়েছে ব্যাপারটা কিন্তু অত সরল নয়। হিব্রু ভাষার জন্ম মোটামুটিভাবে ১৪০০ খ্রীষ্টপূর্বে এবং ভাষাটির মৃত্যু হয় খ্রীষ্টিয় ১৩২-১৩৫ সালে যখন রোমান সা¤্রাজ্যের জুডা এলাকায় ইহুদিদের বিদ্রোহ পর্যুদস্ত হয়। এর পর প্রায় ১৭৫০ বছর ধরে হিব্রু ছিল ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’, মৃত ভাষা। ১৮৮০ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত সময়ে রুশ, পোলিশ, আরব, লাদিনো (ইহুদি স্পেনিশ), ইদ্দিশ (ইহুদি জার্মান), তুর্কি, জার্মান, ফরাসি, ইংরেজি, ভারতীয় এবং বিভিন্ন আফ্রিকান ভাষাভাষী ইহুদিরা দলে দলে ইসরাইলে আসতে শুরু করে। গিলানের দাবি, প্রধানত ইদ্দিশের বাক্যকাঠামোর উপর হিব্রু ও অন্যান্য ভাষার শব্দ বসিয়ে আধুনিক হিব্রু ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং আধুনিক হিব্রু সেমিটিক ভাষা নয়, ইন্দোইওরোপীয় ভাষা। গিলানের পরামর্শ: কোন ভাষাকে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে সব কৃতঋণ শব্দকেই স্বাগত জানাতে হবে, শব্দঋণের ব্যাপারে রক্ষণশীল হওয়া চলবে না। গিলানের শ্লোগান: ‘আপনার ভাষা যদি মৃতপ্রায় হয় তবে তাকে মরতে দেবেন না (ডোন্ট লেট ইট ডাই!)। যদি আপনার ভাষা মরে গিয়ে থাকে তবে তার মৃত্যু থামান, আপনার ভাষাকে পুনরুজ্জীবিত করুন, নিজেও টিকে থাকুন (স্টপ, রিভাইব এন্ড সারভাইব)’, ইত্যাদি, ইত্যাদি।

গিলানের কথা শুনতে ভালোই লাগছিল। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই দেখা যাবে, গিলান নতুন কিছু বলছে না। সব ভাষাই হিব্রুর মতো খিচুরি। ইংরেজি ভাষার বাক্যকাঠামো ইংরেজি কিন্তু বেশির ভাগ শব্দ ফরাসি। বাংলা ভাষার বাক্যকাঠামো বাংলা কিন্তু বেশির ভাগ শব্দ সংস্কৃত থেকে ঋণ করা। এ ছাড়া আরবি, ফার্সি শব্দ প্রচূর আছে বাংলায় আর ইদানিং ইংরেজি শব্দও ঢুকছে এন্তার। তাহলে হিব্রু, বাংলা আর ইংরেজির মধ্যে তফাৎটা রইলো কোথায়? হিব্রুর বাক্যকাঠামো যে ইদ্দিশ হবে তা ইহুদিরা মিটিং করে ঠিক করেনি। আপনা থেকেই তা হয়ে গেছে যেহেতু প্রথম দিকের হিব্রুভাষীদের সিংহভাগ ছিল জার্মানি-পোল্যান্ড থেকে আসা ইহুদি যারা বাইরে জার্মান আর ঘরে ইদ্দিশ বলতেন। এটা ঠিক যে তারা ঠিক করেছিল যত বেশি সম্ভব হিব্রু শব্দ ব্যবহার করা হবে নতুন ভাষাটিতে। অনেক বাংলাপ্রেমীওতো মনে করেন, যত বেশি সম্ভব বাংলা শব্দ ব্যবহার করতে হবে বাংলা বলার সময়। এটি একটি অতি সাধারণ প্রবণতা। আদি হিব্রু ভাষায় বিভিন্ন শব্দের যে অর্থ ছিল, যে উচ্চারণ ছিল সেই অর্থ আর উচ্চারণের সামান্যই অবশিষ্ট আছে আধুনিক হিব্রুতে। বাংলায়ও এমনটা হয়েছে অনেক সংস্কৃত শব্দের ক্ষেত্রে। সংস্কৃতে ‘অভিমান’ বলতে বোঝাতো ভীমের মতো বীরের ‘প্রচ- রাগ’। বাংলায় এই শব্দটির অর্থ ‘কোন প্রিয় ব্যক্তির উপর সামান্য রাগ’। গিলান আমার মন্তব্যের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেনি যদিও আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে একটি ই-মেইল পাঠিয়েছিল।

গিলানের পর জঁ ক্লদ বললেন ব্রোতোঁ ভাষা নিয়ে। বাংলা উদাহরণ দিয়ে তার সমস্যাটি বোঝাই। বাংলায় ‘বাক’ এর ‘ক’ ‘বাগদান’ শব্দে ‘গ’ হয়ে যায়। ‘গোলাপ’ এর ‘প’ ‘গোলাবজল’ শব্দে হয়ে যায় ‘ব’। এটিকে সন্ধির একটি নিয়ম বলতে পারেন। কিন্তু ‘হাতঘড়ি’ যদিও ‘হাদঘড়ি’ হিসেবে উচ্চারিত হয় লেখার সময় আমরা কিন্তু ‘হাতঘড়ি’ লিখি। অর্থাৎ কোন কোন শব্দে সন্ধির নিয়মটি শব্দের বানানে প্রতিফলিত হয় (সাধারণত তৎসম শব্দে), কোন কোন শব্দে প্রতিফলিত হয় না। ত্রিশের দশকে ব্রোতোঁ ভাষার পুনরুজ্জীবনের সময় বৈয়াকরণেরা সন্ধির নিয়মটিকে বানানে প্রতিফলিত না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। জঁ ক্লদের মতে এ সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি। তাকে আমি জিগ্যেস করলাম সন্ধির এ নিয়ম (ফরাসিতে বলে ‘লিয়াজোঁ’) সবসময় কার্যকর হয় কিনা। জঁ ক্লদ জানালো, দুই একটি ব্যতিক্রম আছে তবে বেশির ভাগ সময়ে সন্ধি কার্যকর হয়। আমি বললাম, ‘সেক্ষেত্রে আগের প্রজন্মের বৈয়াকরণেরা ভুল কোন সিদ্ধান্ত নেননি। ব্রোতোঁভাষীরা যেহেতু জানে কখন লিয়াজোঁ হবে তখন তা বানানে প্রতিফলিত করতেই হবে এমন কোন কথা নেই। বাংলায় আমরা ‘হাতঘড়ি’, ‘কাকডাকা’ লিখলেও সবাই নিজের অজান্তেই ‘হাদঘড়ি’, ‘কাগডাকা’ উচ্চারণ করে থাকি। এর একটি বাড়তি সুবিধা হচ্ছে এই যে কোন শব্দে সন্ধি বা লিয়াজোঁর নিয়ম কার্যকর না হলে তখন কিছুই করার প্রয়োজন হবে না।

এর পর চা-বিরতি। চা-বিরতির সময় গিলানকে জিগ্যেস করলাম, আরবি ভাষা থেকে আধুনিক হিব্রুতে ঋণগ্রহণের পরিমাণ কেমন। গিলান জানালো, ‘ইসরাইলীরা আরবি গালিগালাজগুলো ব্যবহার করে।’ ইহুদিদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার: গালিটা যেহেতু ইহুদিরা প্রধানত আরবদেরই দেয় সেহেতু তাদের বোঝার একটা ব্যাপার আছে। ইংরেজ প্রভুরা প্রধানত স্থানীয় ভাষাতেই গাল পাড়তো কারণ ‘সান অফ এ্যা বিচ’ এর তুলনায় ‘কুট্টার বাশ্শা’ শুনতে বাঙালির মনোকষ্ট বেশি হবার কথা। গিলান আরও বললো, ‘অনেক ইহুদি মুহম্মদকে ‘রাসুল’ বলে না, বলে ‘ফাজুল’ অথাৎ ‘যে কিছু জানে না, শুধু ভুল বকে!’ সুতরাং ইসরাইলিরা অবশ্যই আরবি শব্দ ‘ব্যবহার’ করে তবে সব সময় ‘সদ্ব্যবহার’ করে সে দাবি করা যাবে না।’ প্রসঙ্গক্রমে বলি, যদিও ইসলামী ধর্মগ্রন্থে ইহুদিদের সম্পর্কে সব সময় ভালো মন্তব্য করা হয়নি এবং মুসলমানেরাও সাধারণত ইহুদিদেরও সম্মানের চোখে দেখে না, তবুও বলবো, মুসলমানেরা মুসা বা যীশুকে তাদের অন্যতম নবী হিসেবে সব সময়েই সম্মান করে এসেছে এবং কোরানেও এঁদের সম্পর্কে সম্মানজনক উক্তি আছে। অন্যদিকে দান্তের মতো কবিও মুহম্মদ সম্পর্কে কটুক্তি করেছেন (কথাটা এডওয়ার্ড সাঈদ লিখেছেন, সম্ভবত ‘ওরিয়েন্টালিজম’ বা ‘অন ইসলাম’ বইতে)।

তখন দুপুর প্রায় বারোটা বাজে। আমার ট্রেন সন্ধ্যা ছ’টায়। ভাবলাম, এখন যদি বেরিয়ে পড়ি তবে দিনে দিনে বার্লিন পৌঁছে যেতে পারবো। যদিও এ সময়ে ট্রেন আছে কিনা জানি না তবুও রিটার্ন টিকেট যেহেতু আছে সেহেতু স্টেশনে গেলে একটা কিছু ব্যবস্থা হবেই। বিকেলে ট্রেন না থাকলে পোযনান শহরটা আবার ঘুরে দেখে সন্ধ্যায় ট্রেনে চাপবো। সাতপাঁচ ভাবছি, ট্যাক্সি ডাকবো, নাকি মাইল দুয়েক রাস্তা ঁেহটে গিয়ে পিঞ্চ ইওরো বাঁচাবো। এমন সময় আমার মুস্কিল আসান হয়ে হাজির হলো হল্যান্ডের ধ্বনিবিজ্ঞানী রোলঁ নসকে। কলেজিউম থেকে বেরুতে বেরুতে রোলঁ আমাকে জিগ্যেস করলো আমি কোথায় যেতে চাই। আমি বললাম, ‘স্টেশনে যাবো। ট্যাক্সি ডাকবো ভাবছি।’ নসকে বললো, ‘তার দরকার হবে না। আমি তোমাকে নামিয়ে দেবো। আমার গাড়ি আছে।’ এর পর রোলঁকে যখন বললাম আমি বার্লিন যাবো তখন রোলঁ বললো, ‘আমিওতো বার্লিন যাচ্ছি, একা একা চার ঘন্টা গাড়ি চালানোর চেয়ে তুমি আমার সাথে গেলে আলাপ করে করে যাওয়া যেতো। তুমিও ট্রেনের চেয়ে অনেক আগে পৌঁছাবে।’ কথা সত্যি। তবে আমি রোলঁকে বার বার জিগ্যেস করলাম, ওর কোন অসুবিধে হবে কিনা। রোলঁ বললো, ‘বিন্দুমাত্র না, বরং আমার ভ্রমণটা আনন্দময় হবে। তবে মনে রেখো, রাস্তাঘাটের অবস্থা খুব একটা ভালো নয় পোল্যান্ডে।’

আমরা পোল্যান্ডের ভিতর দিয়ে পুর্ববালিনে ঢুকবো। রাস্তায় দেখলাম, পোলিশরা গাড়ি চালানোর আইনকানুন মানতে চায় না। কার আগে কে যাবে এই প্রতিযোগিতা দেখা গেল বার বার অনেকটা বাংলাদেশেরই মতো। রাস্তাঘাটে এ্যাক্সিডেন্টও প্রচূর হচ্ছে এবং কিছুক্ষণ পর পরই পুলিশের গাড়ি দৌঁড়ে যাচ্ছে, তবে ভেঁপু না বাজিয়ে। একটু ভয়ই করছিল আমার। কমিউনিস্ট আমলে নিশ্চয়ই এত এত লোক গাড়ি কিনতে পারতো না। কমিউনিস্ট আমলের রাস্তাঘাটও বাংলাদেশের চেয়ে ভালো ছিল বলা যাবে না। তবে এখন নতুন নতুন সব হাইওয়ে তৈরি হচ্ছে। প্রতিটি হাইওয়ে ব্যবহার করতে পয়সা দিতে হয়। রোলঁ জানালো, পোল্যান্ড ইওরোপীয় ইউনিয়নের অঙ্গীভূত হবার জন্যে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। যে কোন মূল্যে উন্নয়ন চাই। প্রায় সর্বত্রই রাস্তা সংস্কার ও নতুন রাস্তা নির্মাণের মহাযজ্ঞ চলছে। রোলঁ অবশ্য এক বনের ভেতর দিয়ে এমন একটা রাস্তা খুঁজে বের করলো যেখানে কোন গাড়িই নেই। কদাচিৎ কোন বনের ধারে একটি ছোট টেবিলে আশে পাশের গ্রামের কারও তৈরি জেম-জেলি ইত্যাদি রাখা। যদিও এ বনপথে গাড়ির সংখ্যা হাতে গোনা, তবু আশা, কেউ যদি কেনে। বনের পাতা হেমন্তের হলুদে-সবুজে মেশানো, মাঝে মাঝে লালের ছোঁয়া। কতক্ষণ পর পর বনাঞ্চল শেষ হলে রাস্তায় পড়ছিল ছোট ছোট গ্রাম বা মফস্বলের শহর। রোলঁ জানালো এ অঞ্চলটা আগে জার্মানির অংশ ছিল বলে বাড়িঘরে জার্মানশৈলী লক্ষ্য করা যাবে। রোলঁ দেখাচ্ছিল, কোন বাড়িগুলো নতুন করা আর কোনগুলো কমিউনিস্ট আমলের। সে যুগে বড় বড় বিল্ডিঙে ছোট ছোট এপার্টমেন্টে লোকজন থাকতো। বাড়িগুলো ছিল হয় সাদা বা ধূষর রঙের। এখন সবাই নিজের আলাদা বাড়ি চায়, বাড়ির রঙেও স্বাতন্ত্র্যের ছাপ আনতে আগ্রহী অনেকে। রঙের ব্যাপারে জনগণ ও সরকারের মানসিকতার এই পরিবর্তনটা জাপানেও লক্ষ্য করেছি। নব্বইয়ের দশকে সব ছিল সাদা,এখন প্রায় সবই রঙিন। টোকিওতো আমার বাসার পাশেই একটি কড়া কাঠালি হলুদ ও একটি কড়া লাল রঙের বাড়ি আছে।

রোলঁ ধ্বনিতত্ত্বে পি.এইচ.ডি. করেছে আশির দশকে। বহু দিন অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, হল্যান্ডে পড়িয়েছে এবং অবশেষে বছর কয়েক আগে ফ্রান্সের লিল বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপকের একটি স্থায়ী পদ পেয়েছে। রোলঁ ডাচ ব্যাকরণ পড়ায় যদিও তার পড়ানোর কথা ধ্বনিতত্ত্ব বা নিদেনপক্ষে ভাষাবিজ্ঞানের কোন কোর্স। ‘কি পড়াই তা নিয়ে আমি আর ভাবি না বরং একটা স্থায়ী পদ যে মিলেছে এতেই এ বয়সে আমি খুশি। আমি আমার মতো গবেষণা করি। যদিও আমি অধ্যাপক নই, জানি না কোনদিন হবো কিনা, তবু আমি খুশি যে ফরাসিরা আমাকে আমার মতো কাজ করতে দেয়। এই যে এই সম্মেলনে এলাম আমার সব খরচ বিশ্ববিদ্যালয় বহণ করেছে। এটুকু পেলেই আমার চলবে।’ রোলঁর সাথে আলাপ হলো ফরাসি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে। এখানেও ইতালীর মতো সহকারী অধ্যাপক বা অধ্যাপক হতে হলে যথেষ্ট সংখ্যক গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখতে হয় এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় পাশ করতে হয়। আমার ফরাসি উচ্চারণ শুনে কিনা জানি না, রোলঁ বার বার বলছিল, ওর ফরাসি ভালো নয়, আমি যদি কিছু মনে না করি তবে সে ইংরেজিতে কথা বলতে চায়। আমি বললাম, ‘তোমার ফরাসি যথেষ্ট ভালো (আসলে সামান্য ওলন্দাজ/জার্মান একসেন্ট ছাড়া আর কোন সমস্যা নেই ওর ফরাসির) তবে তুমি চাইলে ইংরেজিতেও কথা বলতে পারো। জার্মানও বলতে পারতে যদি গত বিশ বছরে আমি ভাষাটা ভুলে না যেতাম।’ ‘ও তাই নাকি?’ বলে সে জার্মান ভাষায় আলাপ শুরু করলো। অনতিবিলম্বেই তাকে থামাতে হলো আমার কারণ আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

খনার বচন ফলতে শুরু করলো অর্থাৎ বৃষ্টি নামলো মুষলধারে। আমরা যখন ওডের নদীর পারে তখন বৃষ্টি ধরে এসেছে। এই নদীর ওপর যে সেতু, সেটির এদিকে আর ওদিকে পোল্যান্ড আর পূর্ব জার্মানীর সীমান্ত চেকপোস্ট ছিল বছর বিশেক আগে। এখন কিসসু নেই, সব এক্কেবারে সাফ। আমরা এমন ভাবে পোল্যান্ড থেকে জার্মানিতে ঢুকে গেলাম যেন সীতাকু- থেকে পাহাড়তলী পার হয়ে চট্টগ্রামে ঢুকছি। সাবেক পূর্ব জার্মানীর ঘরবাড়ি পশ্চিম জার্মানির মতো উন্নত না হলেও পোল্যান্ডের চেয়ে ভালো। রোলঁ বললো, ‘কমিউনিস্ট হলেও এরাতো জার্মানই ছিল। জাতিগত স্বকীয়তা ফুটে উঠবেই। পুরো কমিউনিস্ট ব্লকের মধ্যে পূর্ব জামানি সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্র ছিল। তাদের মাথাপিছু আয়ও আশেপাশের অন্য কমিউনিস্ট দেশগুলোর চাইতে অনেক বেশি ছিল।’

বার্লিনে যখন ঢুকলাম আমরা তখনও টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছিল। রোলঁ আমাকে এক উ-বান বা মেট্রোর সামনে নামিয়ে দিল। রোলঁ বার বার জিগ্যেস করছিল আমি চিনে যেতে পারবো কিনা। আমি বললাম, ‘তুমি চিন্তা করো না। যেটুকু জার্মান জানি তা দিয়ে আমি কাউকে জিগ্যেস করে পথ চিনে আমার বন্ধুর হোস্টেলে ঠিক পৌঁছতে পারবো।’ জুলোজিশে গার্টেনের উপরে উঠে ফোন করার চেষ্টা করলাম। অনেকগুলো বুথই কাজ করে না। পঞ্চাশ সেন্ট খেয়ে নিল একটি বুথ। আজকাল মোবাইল টেলিফোনের যুগে কেউ ফোনবুথ ব্যবহার করে না বলে কর্তৃপক্ষ বোধ হয় খারাপ বুথগুলো সারাইও করে না। আবার ফোন করলাম এবং হাকিমকে পাওয়া গেল। আমার আসার কথা রাত বারোটায়। বিকাল পাঁচটাতেই পৌঁছে গেছি দেখে একটু অবাকই হলো হাকিম আরিফ। জানলাম, সৌরভ শিকদারও ইতিমধ্যে এসে গেছে। আমি যেখান থেকে ফোন করছিলাম তার উল্টোদিকে একটি লাল বিল্ডিং ছিল। হাকিম বললো, ‘লাল বিল্ডিঙের সামনে থেকে বাসে উঠুন।’ বাস এলো এবং উঠলাম। কতদূর যাওয়ার পর মনে হলো ঠিক পথে যাচ্ছিতো? ড্রাইভারের সাথে কথা বলে জানা গেল ঠিক বাসেই উঠেছি তবে ঠিক দিক থেকে নয়। লাল বিল্ডিঙের ‘সামনের’ ফুটপাথ থেকে উঠলে হবে না, উঠতে হবে লাল বিল্ডিঙের ‘লাগোয়া’ ফুটপাথ থেকে। অবশেষে ঠিক দিক থেকে একই নম্বরের বাসে উঠে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই হাকিমের হোষ্টেল এলাকায় পৌঁছে বাস থেকে নামার আগেই দেখি বাসস্টপেজের অনতিদূরে বৃষ্টির মধ্যে মাথায় তোয়ালে দিয়ে কাকভেজা হাকিম আরিফ আর সৌরভ শিকদার হাসিমুখে হাত নাড়ছে। ছাতা নেই কেন জিগ্যেস করাতে জানা গেল যে একটি মাত্র ছাতা ছিল হাকিম আরিফের সেটি তিনি কদিন আগে কোন এক মসজিদে ইফতার খেতে গিয়ে ভুলে ফেলে এসেছেন (সম্ভবত সেদিন রোজা না রাখার শাস্তি)। নতুন ছাতা এখনও কেনা হয়নি, কারণ কোন প্রকার স্কলারশিপ ছাড়া জার্মানির মতো দেশে পি.এইচ.ডি. করার দুঃসাহস করেছেন হাকিম আরিফ এবং সে কারণে তাকে একটু হিসেব করে চলতে হয়।

আমার স্থির বিশ্বাস ছিল বার্লিনের মতো শহর দুই দিনে দেখা সম্ভব নয়। তাই আমি প্রস্তাব করলাম, তখনই বেরিয়ে পড়া যাক, রাতের বার্লিন যতটা পারি দেখে নিই অন্তত বাসে করে হলেও। ছাতার অভাবে এবং অপর পর্যটক সৌরভ শিকদারের আগ্রহের অভাবে আমার বহির্গমনের অদম্য ইচ্ছার লাগাম টানতে হলো। ঠিক হলো, মুরগি ও ডাল রান্না করে ভরপেট খেয়ে, অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে, সকাল বেলায় আমরা বার্লিন ভ্রমণে বের হবো বৃষ্টির তোয়াক্কা না করেই। রান্না সৌরভই করলেন। পাচক হিসেবে তাঁর পারঙ্গমতার পরিচয় আমি মাস কয়েক আগে টোকিওতে আমার বাসায় পেয়েছিলাম। জার্মানিতে এসেও ভালুকের ব্যবস্থা হয়নি। হাকিম আরিফ একটি পানীয় সংগ্রহ করে রেখেছিল আমাদের দুজনের জন্যে। মুখে দিয়ে দেখা গেল, সেটি আঙ্গুরের রস থেকে সামান্য প্রমোশন পেয়েছে বটে কিন্তু মদিরা পর্যায়ে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। আমার বোর্দো-বার্গান্ডি সুরার স্বাদলাগা জিহ্বায় এর স্বাদ অনেকটা শক্তি বা মোতাহার ঔষধালয়ের দ্রাক্ষারিষ্ট বা হেকিমি (হাকিমি) সালসার মতো মনে হচ্ছিল। ইতিমধ্যে এক সিনিয়র অধ্যাপকের ফোন এলো ঢাকা থেকে। তিনি বললেন, ‘তোমাদের যা দরকার তা হেকিমের দাওয়াখানায় পাওয়া যাবে না। ঢাকায় এসো, ব্যবস্থা হবে।’ আরও জানা গেল, রামচন্দ্রকে তিনি প্রায় শেষ করে ফেলেছেন আর সেই অযোধ্যাতো কবে থেকেই নেই।

পরদিন সকালে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই হাকিমের সাথে গেলাম বার্লিন ফ্রি ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে। লাইব্রেরিটির নাম মস্তিষ্ক বা ব্রেন। গোলাকার, ফুটবলের মতো একটি ইমারত, মস্তিস্কের আকারের সাথে যার স্থাপত্যের মিল আছে। ভিতরে বইয়ের তাক, সুপরিসর পড়ার জায়গা। কখন স্থাপিত হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়? এই প্রশ্নের জবাবে হাকিম জানালেন, বার্লিন ভাগের পর দেখা গেল পশ্চিম বার্লিনের ভাগে পড়েছে শুধু একটি টেকনিকাল বিশ্ববিদ্যালয়। ভালো এবং নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সব পড়েছে পূর্ব বার্লিনের। পশ্চিম বার্লিনবাসীদের এই বিশ্ববিদ্যালয়-দারিদ্র্য দূর করার জন্যেই নাকি আমেরিকানরা এই ফ্রি ইউনিভার্সিটি স্থাপন করেন। আমরা ভাষাবিজ্ঞানের বই যেখানে আছে সেখানটাতেই শুধু দেখতে গেলাম। ভাষাবিজ্ঞান অংশটি যে রকম সমৃদ্ধ দেখলাম তাতে অন্য সেকশনগুলোতেও যে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রয়োজনীয় বইয়ের কমতি থাকবে না তাতে সন্দেহ করার কোন কারণ নেই। এই লাইব্রেরি থেকে আমরা অন্য একটি লাইব্রেরিতে গেলাম যেখানে হাকিম আরিফ তার ধার নেয়া বইগুলো নবায়ন করে নিয়ে এলো। হাকিম বললো, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হলে জার্মানির যে কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বই ধার নেয়া যায়।

তখন বৃষ্টি ধরে এসেছে। আমরা এগোচ্ছিলাম উ-বান বা মেট্রোর দিকে। কয়েকটি চীনা মেয়ে পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। শুনলাম, কি সুন্দর জার্মান বলছে। শুধু বার্লিন শহরেই নাকি আছে ছয় হাজারের মতো চীনা ছাত্রছাত্রী আছে। পড়াশোনার জন্যে বার্লিন আদর্শ জায়গা। খুবই কম টিউশন ফি। থাকা খাওয়ায় খুব বেশি হলে আড়াই শ ইওরো খরচ হবে। এর সঙ্গে আমেরিকা বা ইংল্যান্ডের খরচের তুলনাই করা যায় না। সমস্যা একটাই। জার্মানটা শিখতে হবে। বাংলাদেশের ছাত্রেরা ইংল্যান্ড-আমেরিকায় গিয়ে বাপের গুচ্ছের টাকা নষ্ট না করে বার্লিন আসলেই পারে। তবে অনেক ছেলে বার্লিনে এসেও লেখাপড়া শেষ করতে পারে না। প্রতিদিন আট ঘন্টা কাজ করে শুধু টাকা কামাতে চায়। এতে টাকাও হয় না লেখাপড়াও হয় না। প্যারিস আর মন্ট্রিয়লেও লক্ষ্মী আর সরস্বতীর এই দ্বন্দ্বে ভুগতে দেখেছি ছাত্রদের। লেখাপড়া শেষ করতে হলে শুধু গ্রীস্মের ছুটিতে তিন মাস একটানা কাজ করতে হবে এবং বাকি নয় মাস শুধু লেখাপড়া করতে হবে।

এর পর আমরা গেলাম বার্লিনের কেন্দ্রে যেখানে কাইজার ভিলহেম মেমোরিয়াল চার্চ। কাইজার দ্বিতীয় ভিলহেম (ইংরেজিতে ‘উইলিয়াম’) নিউ রোমানেস্ক শৈলীর এই চার্চটি নির্মাণ করান ১৮৯১-১৯৯৫ সালে ঐক্যবন্ধ প্রুশিয়ার প্রতীক হিসেবে এবং দাদু প্রথম ভিলহেমের স্মরণে। এর গায়ে মোজাইক দিয়ে প্রুশিয়ার ইতিহাস বর্ণনা করা ছিল। প্রটেস্ট্যান্ট গীর্জায় সাধারণত বেশি কারুকাজ থাকে না। কিন্তু এই গীর্জাটি ছিল তার ব্যতিক্রম। ১৯৪৩ সালের ১৮ই নভেম্বর তারিখে বোমায় একটি ছাড়া গীর্জার বাকি চূড়াগুলো ভেঙে যায়। আরেকটি অত্যাধুনিক গীর্জা পাশে তৈরি করা হলেও বোমা থেকে রক্ষা পাওয়া আধভাঙা চূড়াটি মেরামত না করে রেখে দেওয়া হয়েছে (হাকিম আরিফের মতে) এটা দেখাতে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীও কিছু বর্বরতা করেছে। গীর্জার সামনে মেট্রো থেকে বের হতেই এক জিপসি মেয়ে এসে জিগ্যেস করলো ‘স্পিক ইংলিশ?’ আমরা ‘হ্যাঁ’ বললেই হয়তো ইংরেজিতে ভিক্ষা চাইতো। আমরা ‘নো, নো’ বলে বাস ধরার জন্যে এগিয়ে গেলাম।

বাসটি বার্লিনের দর্শনীয় স্থানগুলোর আশপাশ দিয়েই চক্কর দেয়। সকাল বেলাতেই সারা দিনের জন্যে ডে পাস কিনে নিয়েছিলাম। রাইখসটাগ ভবন বা প্রাক্তন প্রুশিয়ার পালামেন্ট ভবনের সামনে নেমে পড়লাম আমরা। ১৮৮৪ সালে এই পার্লামেন্ট ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন কাইজার প্রথম ভিলহেম। নির্মাণকাজ শেষ হবার আগেই ১৮৮৮ সালে কাইজার পরলোকগত হন এবং সিংহাসনে বসেন তার পুত্র তৃতীয় ফ্রেডেরিক। এঁর বিয়ে হয়েছিল মহারাণী ভিক্টোরিয়ার কন্যার সাথে যার নামও ভিক্টোরিয়া। তৃতীয় ফ্রেডেরিক যখন সিংহাসনে বসেন তখন তাঁর বয়স ছাপ্পান্ন কারণ বাবা প্রথম ভিলহেম ‘বেশ দেরি করে মরেছিলেন’ বা ‘দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন’ (অনেকটা স¤্রাট আকবর বা বাট্রান্ড রাসেলের মতো)। বয়স অবশ্য কোন সমস্যা ছিল না, সমস্যা ছিল তাঁর স্বাস্থ্য। তাঁকে সা¤্রাজ্য চালাতে হতো হাতে লিখে, কারণ গলনালির ক্যান্সারের জন্যে তিনি কথা বলতে পারতেন না। মাত্র ৯৯ দিন রাজত্ব করার পর তৃতীয় ফ্রেডেরিকের মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র দ্বিতীয় ভিলহেম জার্মানির সিংহাসনে আরোহণ করেন। দ্বিতীয় ভিলহেমের রাজত্বকালে ১৮৯৪ সালে রাইখসটাগের নির্মাণকাজ শেষ হয়। রাইখসটাগের ডোমটি ছিল কাঁচ আর ইস্পাতের পাত দিয়ে তৈরি। ঊনবিংশ শতকের স্থাপত্যকলার উৎকর্ষের অন্যতম নিদর্শন ছিল এই ইমারতটি।

পার্লামেন্ট ব্যাপারটাকে দ্বিতীয় ভিলহেম দুচোখে দেখতে পারতেন না। ১৯১৬ সালে পালামেন্টের প্রবেশপথের উপর খোদাই করে লেখা হয় ‘ডেম ডয়েচ্চেন ফোলকে’ অর্থাৎ ‘জার্মান জনগনের উদ্দেশ্যে নিবেদিত’। দ্বিতীয় ভিলহেম যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন যাতে এই কথাগুলো লেখা না হয়। ১৯৩৩ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি এই রাইখসটাগ ভবনে আগুন লাগে। কোন ‘বীর হনুমান’ রাইখসটাগের লঙ্কায় আগুন দিয়েছিল তা আজ পর্যন্ত জানা যায়নি কিন্তু নাৎসীরা এই ঘটনার সুযোগ নিয়ে গুজব ছড়িয়ে দিল যে কমিউনিস্টরাই এই দুষ্কর্মের হোতা এবং তারা অনতিবিলম্বে জামানির শাসনক্ষমতা দখল করবে। অনতিবিলম্বে হিটলারের নাৎসি পার্টি এমন একটি আইন পাশ করিয়ে নেয় যাতে ভিন্ন মত প্রকাশের যাবতীয় অধিকার রহিত করা হয়। এই আইনটি ‘রাইখসটাগ অগ্নিকা- আইন’ নামে পরিচিত। এর পর যাবতীয় ক্ষমতা হিটলারের হাতে কেন্দ্রীভূত হয় এবং শুরু হয় কমিউনিষ্টদের উপর নির্যাতন। ১৯৩৩ সাল থেকে শুরু হওয়া এই কমিউনিস্ট নির্যাতন বার্লিনদেয়াল বা জার্মানভাগের একমাত্র কারণ না হলেও অন্যতম কারণতো বটেই। ১৯৪৫ সালে রাশিয়ার লালফৌজ রাইখসটাগের উপর বোমাবর্ষণ করলে এর ডোমটি ভেঙে যায়। সঙ্গত কারণেই কমিউনিস্টদের রাগ ছিল এই রাইখসটাগের উপর। রাইখসটাগ পশ্চিম জার্মানির ভাগেই পড়েছিল কিন্তু যেহেতু শীতল যুদ্ধের যুগে পশ্চিম জার্মানীর রাজধানী ছিল বন সেহেতু বার্লিনের রাইখসটাগের কোন ব্যবহার ছিল না। অনেকটা পরিত্যক্তই ছিল এই প্রাসাদটি। পুনরেকত্রিকরণের পর রাইখসটাগকে আবার সংস্কার করে ধুয়েমুছে সাফ করা হচ্ছে।

রাইখসটাগকে পেছনে রেখে সামনে হাতের ডানদিকে চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের অফিস যার স্থাপত্যশৈলী কেমন যেন পরিচিত মনে হচ্ছিল। হাকিম আরিফ জানলো, এই ভবনের স্থপতি নাকি বলেছেন তিনি বাংলাদেশের সংসদভবনের স্থপতি লুই কানের কাজ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। ঠিকই, ডানদিকে যতই এগোতে থাকি, ভবনগুলোর অর্ধবৃত্তাকার বহিগাত্র দিয়ে আলোপ্রবেশের ব্যবস্থা আর ভবনের সামনে লেক দেখলে আমাদের সংসদভবন আর এর পেছনের লাল ইটের ভবনগুলোর কথা মনে না পড়ে পারে না। সবই দেখলাম, কিন্তু ‘কোথায় বার্লিন প্রাচীর হাকিম আরিফ? যা দেখতে বার্লিন আসা সেই প্রাচীরটাই এখনো দেখালেন না!’ আমরা আসলে বার্লিন প্রাচীরের উপরেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। প্রাচীর এখন আর নেই কিন্তু যেখানে ছিল সেখানে রাস্তার উপর প্রাচীরের চিহ্ন দেয়া আছে। ঐ চিহ্নের উপর দিয়েই গাড়ি চলছে। প্রাচীরের ভাঙা তিন চারটি অংশ রেখে দেওয়া হয়েছে এক জায়গায়। প্রাচীরের পশ্চিমদিকের অংশে রঙিন গ্র্যাফিটি আঁকা ছিল। ভাঙা অংশগুলোতেও সেই গ্র্যাফিটিগুলোর অংশবিশেষ রয়েছে। ট্যুরিস্টরা অনেকেই প্রাচীরের ভগ্নাংশের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন। কাছেই এক যুবক পূর্ব জার্মানীর সেনা অফিসারের পোষাক পরে কাগজে সিল দিচ্ছে। শীতলযুদ্ধের যুগে পূর্ব-পশ্চিমে যাতায়াত করতে হলে পাসপোর্ট বা ট্র্যাভেল ডকুমেন্টে সিল দেয়ার যে নিয়ম ছিল তাই দেখানো হচ্ছে ট্যুরিস্টদের।

একটু এগিয়ে গিয়েই বিখ্যাত ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণ। ১৭৯১ সালে নির্মিত এই তোরণ ছিল শান্তির প্রতীক। নির্মাণকাল থেকে এ পর্যন্ত তোরণটির স্থাপত্যে খ্বু একটা পরিবর্তন হয়নি। তোরণের উপরে আছে কোয়াড্রিগা বা চতুরাশ্ব রথ। চার ঘোড়ায় টানা এই রথ গ্রীক ও রোমান স্থাপত্যশৈলীতে বিজয়ের প্রতীক। এই রথের উপরে হাতে বর্শা বা ক্রুশ নিয়ে বসে থাকেন বিজয়ের দেবী ভিক্টোরিয়া। এ রকম কোয়াড্রিগা অন্যান্য ইওরোপীয় দেশেও বিভিন্ন প্রাসাদ বা তোরণের উপরে রয়েছে। ১৮০৬ সালে জার্মানদের এক যুদ্ধে পরাজিত করে নেপোলিয়ন ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণের কোয়াড্রিগাটি প্যারিসে নিয়ে যান। ১৮১৪ সালে নেপোলিয়নের পরাজয়ের পর কোয়াড্রিগাটি বার্লিনে ফেরৎ আনা হয়। ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণ পূর্ব বার্লিনে পড়েছিল। ১৯৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট কেনেডি যখন বার্লিন ভ্রমণে গিয়ে ‘ইখ বিন আইন বার্লিনার’ (অথাৎ ‘আমিও একজন বার্লিনবাসী’) বলেছিলেন তখন পূর্বজার্মান কর্তৃপক্ষ ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণের আশেপাশে লাল পর্দা ঝুলিয়ে দেয় যাতে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট পূর্ববার্লিন একেবারেই দেখতে না পান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বোমায় এই তোরণ কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ২০০০-২০০২ সালে যাবতীয় সংস্কার কাজ শেষ হবার পর তোরণটি আবার তার পূর্বরূপ ফিরে পেয়েছে।

মূলত বুদ্ধিজীবি, শ্রমিক নির্বিশেষে কমিউনিস্ট ব্লকের সব শ্রেণীর অধিবাসীর দেশত্যাগ ঠেকাতেই (শুধু ১৯৬১ সালেই ২০%ভাগ পূর্ব জার্মান দেশত্যাগ করেছে) রাশিয়ার ক্রুশ্চেভের পরামর্শে পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট নেতা ওয়ালটার উলব্রাইখট এই দেয়াল তৈরির অনুমতি দেন ১৯৬১ সালের ১২ই আগস্ট তারিখে। পরদিন থেকেই বার্লিন প্রাচীর নির্মাণ শুরু হয় এবং এ প্রাচীর ভাঙা হয় ১৯৮৯ সালের ৯ই নভেম্বর। মাঝখানে ২৮ বছরে প্রায় পাঁচ হাজার পূর্ব জার্মান এই প্রাচীর টপকে পশ্চিম বার্লিনে আসার চেষ্টা করে এবং এর মধ্যে ১০০ থেকে ২০০ লোক মৃত্যুবরণ করে রক্ষিদের গুলিতে বা অন্য কোনভাবে। মৃতের সংখ্যা বড় কথা নয়, বহু পরিবার কয়েক দশক ধরে আলাদা হয়ে যায় এই প্রাচীরের কারণে। বার্লিন শহরের বুকের উপর দুর্বহ এক বোঝা হয়ে চেপে ছিল প্রাচীরের এই দুষ্ট অজগর। যদিও এই প্রাচীর ইতিহাসের ফলশ্রুতি তবুও বলবো অজ্ঞান ও ধান্দাবাজ রাজনীতিকেরা নিজেদের হীন উচ্চাকাঙ্খা চরিতার্থ করার জন্যে দেশ ও শহর ভাগ করে, নিজেরাও ভাগ হয়ে যায়। শুধু রাজনীতিবিদদের গোঁড়ামির কারণে মানুষকে কয়েক দশক ধরে অনর্থক কষ্ট দেবার অন্যতম এক নিদর্শন হচ্ছে এই বার্লিন প্রাচীর।

আমরা তোরণের সামনে ছবি তুলছি এমন সময় পাঁচ-ছটি অল্পবয়সী মেয়ে এসে আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে গেল। স্কুল-কলেজের ছাত্রী। সারাদিন হৈহৈ করতে বেরিয়েছে আমাদের সাথে ছবি তোলাটাও সেই দিনভর আনন্দেরই একটা অংশ। ছবি তোলা শেষ হলে আমরা গেলাম সোনি বিল্ডিঙে। সেখানে বিভিন্ন সময়ে তোলা বার্লিন প্রাচীরের কিছু ছবি দেখলাম। সোনি বিল্ডিঙে এদিক ওদিক তাকিয়ে কোন টয়লেট দেখা গেল না। একটি দোকানে ফিলিপিনো (সম্ভবত) দুটি সেলসগার্ল ছিল। তাদের জিগ্যেস করলাম আশে পাশে কোন টয়লেট আছে কিনা। এক মেয়ে খুব রুঢ়ভাবে বললো, ‘জানি না।’ আমাদের গায়ের রঙই যে তার স্বভাবের এই রুঢ়তার কারণ তাতে কোন সন্দেহই থাকতে পারে না। অবশেষে এক জার্মান মহিলা আমাদের দেখিয়ে দিলেন টয়লেট আছে সেই ফিলিপিনো মেয়ে যেখানে কাজ করে তার একেবারে কাছেই। দেখা গেল, সেই মেয়েও সেখানেই ঢুকছে। আমাদের দেখে মেয়ে একটু থতমত খেয়ে গেল। আমি রাগ সামলাতে না পেরে বললাম, ‘তুমি যে বললে জানো না কোথায় টয়লেট?’ মেয়েটি বললো ‘তো’। আমি বললাম, ‘তো প্রমাণ হলো যে ইউ আর এ গ্রেট লায়ার।’ আমি এটা প্রায়ই লক্ষ্য করেছি, রঙিন চামড়ার লোক সামান্য অজুহাতেই জাতভাইদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে। এক ধরণের হীনম্মন্যতা কাজ করে এই কালা সাহেব-মেমদের মনে যার ফলশ্রুতিতে এরা হয়ে যায় ‘মোর ক্যাথলিক দেন পোপ’। কোন বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন বা কাস্টমস করানোর সময় আমি পারতপক্ষে কোন (দক্ষিণ বা পূর্ব এশীয়, আফ্রিকান) ইমিগ্র্যান্ট অফিসারের হাতে পড়তে চাই না।

সোনি ভবন থেকে হাকিম নিয়ে গেল তুর্কি এলাকায়। জায়গাটা দেখে বার্লিন বলে মনেই হয় না, মনে হলো যেন ইস্তাম্বুলের কোন এলাকায় আছি। এক তুর্কি রেস্টুরেন্টে জার্মান ভালুক সহযোগে পেটভরে তুর্কি ডোনাট কাবাব আর রোস্টেড মুরগী খাওয়া হলো। এর পর আমরা গেলাম বার্লিন টাওয়ারের কাছে। শীতলযুদ্ধের যুগে পূর্ব জার্মানীর কারিগরী ও স্থাপত্যজ্ঞানের অন্যতম নিদর্শন এটি। আমি পশ্চিম বার্লিন অধিবাসীদের কথা কল্পনা করলাম যারা প্রতিদিনই এই টাওয়ারটিকে দেখতো কিন্তু কাছে যাবার উপায় ছিল না আটাশ বছর ধরে যদিও তাদের আর টাওয়ারের মাঝে একটি দেয়ালেরই ব্যবধানই ছিল শুধু। এর পর আমরা এগিয়ে গেলাম হুমবোল্ড বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দিকে। হুমবোল্ডরা দুই ভাই। এক ভাই বিজ্ঞানী আর অন্য ভাই ভাষাবিজ্ঞানী। এ এলাকাটা পূর্ব বার্লিনের ভাগে পড়েছিল। রাস্তার দুপাশে পুরোনো আমলের বিল্ডিং, গীর্জা, মিউজিয়ম ইত্যাদি মিলে বেশ একটা রোমান আবহ তৈরি হয়েছে এই এলাকায়। এক ভবনের উপর লেখা ছিল: ‘এখানে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক গবেষণা করেছেন ওমুক সাল থেকে ওমুক সাল পর্যন্ত’। একদিকে দেখলাম একটি খালি জায়গা। হাকিম আরিফ জানালো, ‘এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে একটি রাজপ্রাসাদ ছিল। কমিউনিস্টরা সেটিকে ভেঙে ফেলে সে জায়গায় নিজেদের পলিটব্যুরো নির্মাণ করে। পুনরেকত্রিকরণের পর প্রথমেই পলিটব্যুরো ভেঙে গুড়িয়ে দেয়া হয়। এখন আবার পুরোনো রাজপ্রাসাদের ছবি দেখে সেটি পুননির্মাণের পরিকল্পনা চলছে।’ হুমবোল্ড বিশ্ববিদ্যায়টি বাইরে ও ভিতরে অনেকটা প্যারিসের সরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। ইওরোপের সব পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় ভবনগুলোই বোধহয় এক রকম। ভিতরে ঢুকে এক সিঁড়ির মাথায় দেখলাম বাদামী মার্বেল পাথরের উপর বড় বড় সোনালী অক্ষরে লেখা আছে মূল জার্মান ভাষায় কার্ল মার্র্কসের সেই বিখ্যাত উক্তি: দার্শনিকেরা পৃথিবীকে এতদিন শুধু ব্যাখ্যাই করে গেছেন। এখন সময় এসেছে পৃথিবীকে বদলাবার।’

বৃষ্টি হচ্ছিল কিন্তু এমন একটা দোকান দেখা যাচ্ছিল না যেখান থেকে সস্তায় ছাতা কিনতে পারি। অবশেষে এক সুপারমার্কেট থেকে দুটি ছাতা কেনা গেল। এর পর হাঁটতে হাঁটতে আমরা গেলাম এক ইলেক্ট্রনিক্সের দোকানে। বার্লিনে দেখলাম, কম্পিউটার সামগ্রীর দাম টোকিওর চাইতেও বেশি। সৌরভ একটি প্যানট্যাক্স ক্যামেরা কিনলেন মোটামুটি সস্তায়। এর পর হপটবানহোপের মূল স্টেশন হয়ে ঘরে ফেরার পালা। এই স্টেশনটি পাঁচ/ছয় তলা হবে। যত দূর মনে পড়ে প্রতি তলায় তিনটা করে প্ল্যাটফর্ম এবং ছটা করে লাইন। লাইনে দেখলাম কোন পাথর নেই। হয়তো রেল লাইনগুলোকে সমান্তরাল রাখতে নতুন কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। ইওরোপের প্রায় সব শহর থেকেই নাকি ট্রেন আসে এখানে। চারপাশটা ইস্পাতের পাতের উপর কাচ দিয়ে ঢাকা । স্থাপত্যশৈলী ও অঙ্গসজ্জ¦ায় স্বচ্ছতা আর সারল্যের ছাপ আছে। এত আয়োজন কিন্তু এই বিকেল বেলায়ও লোকজন তেমন নেই। অথচ টোকিও-ওসাকাতে রাত একটায়ও লোকে গিজগিজ করে। স্টেশনে কোন এক ছবির শ্যুটিং হচ্ছিল। অভিনেতাদের দেখে মনে হচ্ছিল খুবই স্বাভাবিক, সাধারণ ট্রেনের যাত্রি তারা। শ্যুটিং এলাকা ঘিরে রাখার কোন ব্যাপার নেই, মাইক নিয়ে হৈচৈ নেই, উটকো লোকের ফালতু ভিড় নেই। যে যার মতো কাজ করে চলেছে। একেই কি বলে ‘সভ্যতা’? অন্য এক স্টেশনে দেখলাম, কিছু ভবঘুরে আকণ্ঠ মদ গিলে সিঁড়িতে বসে ঝিমাচ্ছে। প্যারিসে এদের ‘ক্লোশা’ বলা হয়। মেট্রোতে কেøাশারা এদিক ওদিক বসে থাকে। কেউ জোর করে না করালে তারা কখনই স্œান করে না এবং অন্তত একটি প্রাকৃতিক প্রয়োজন নি¤œাঙ্গের কাপড় না খুলেই সেরে নেয় বলে তাদের ‘গায়ের গন্ধে ভূত পালায়।’ হাকিম দেখালো, আশেপাশে বার্লিনের গৃহহীনদের স্œান করার ব্যবস্থা আছে, আছে টয়লেট। দেখলাম, ভদ্রস্থ পোষাক পরা অন্য কিছু গৃহহীন লোক লাইন ধরে একটি ঘরে ঢুকছে রাতের খাবারের জন্যে। সরকার বা কোন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থেকে বিনামূল্যে এদের খাবার দেয়া হয়। ফ্রান্স বা জার্মানী খুবই ধনী দেশ, কিন্তু এখানেও দারিদ্র্য আছে যদিও সে দারিদ্র্য আমাদের দেশের মতো সর্বব্যাপী নয়।

ট্রেন থেকে নেমে বাসের জন্যে অপেক্ষা করছি এমন সময় হাকিমের খেয়াল হলো তার সখের পামটপ মোবাইলটি পকেটে নেই। বছর দুই আগে মোবাইলটি প্রায় পাঁচশ ইওরো দিয়ে কেনা। তবে সেটা বড় কথা নয়। ওর ব্যাঙ্ক একাউন্টের বিভিন্ন তথ্য নাকি সেই মোবাইলে রাখা আছে যা দুষ্ট লোকের হাতে পড়লে সমূহ ক্ষতি হবার সম্ভাবনা। তাছাড়া মোবাইটি পেয়ে যদি কেউ সেটা দিয়ে একের পর এক ফোন করা শুরু করে দেশে বিদেশে তবে তার বিল হাকিমকেই গুনতে হবে। হাকিমেরতো বটেই আমার আর সৌরভেরও মন খারাপ হয়ে গেল। পরের দিন বার্লিন দেখার উৎসাহটাই যেন আর রইল না। হাকিমের পাশেই থাকে ইয়েমেনের এক ছাত্র। বাসায় ফিরে তার ফোন থেকে ফোন করা হলো বার বার কিন্ত কেউ ফোন ধরে না। আমরা অবশ্য বার বার বলছিলাম এখনই হতাশ হবার কিছু নেই, মোবাইলটা পেয়ে কেউ যোগাযোগ করতেও পারে। হাকিম বল্লো, কোন জার্মানের হাতে পড়লে দিয়ে দেবে, কিন্তু কোন তুর্কির হাতে পড়লে পাবার সম্ভাবনা কম। পামটপ হারিয়ে হাকিমের কাতরতা দেখে সৌরভের নাকি শ্রীকান্তের নতুনদা’র মতো বলতে ইচ্ছে হয়েছিল: ‘আমার আর এক পাটি পাম্প!’ ভাগ্যিস বলেনি। ঠিক হলো, পরদিন টেলিফোন অফিস আর ব্যাঙ্কে গিয়ে মোবাইল হারানোর খবর রিপোর্ট করতে হবে। মনে দুঃখ নিয়েই ঘুমাতে গেলাম। সকালে উঠে জানলাম, রাতেই এক জার্মান যুবক হাকিমের কাছে ই-মেইল করেছে পামটপটি খুঁজে পেয়ে। হাকিম জাঙ্ক মেইল ভেবে ঐ মেইলটি প্রায় মুছে ফেলতে গিয়েছিল আরকি! মোবাইল প্রাপ্তির সুসংবাদ শুনে বার্লিনভ্রমণের উৎসাহ আবার পুর্ণোদ্যমে ফিরে এলো।

প্রথমেই সন্ধানদাতার ঠিকানায় গিয়ে মোবাইলটি সংগ্রহ করা হলো। এর পর ট্রেনে করে আমরা গেলাম পোটসডাম এলাকায় যেখানে প্রুশিয়ান রাজারা থাকতেন। পোটসডাম স্টেশনে নেমে বাস নিলাম। হাকিম আরিফ এই শহরটি (ফরাসিতে যেমন বলে) ‘নিজের পকেটের ভেতরটার মতো চেনেন’। ইরাসমাস মুন্ডাস বৃত্তি নিয়ে জার্মানী, হল্যান্ড ও ডেনমার্কে ক্লিনিক্যাল লিঙ্গুইস্টিকসে এম. এ. করার সময় তিনি প্রায় ছয় মাস ছিলেন এই শহরে। স্টেশন থেকে বের হতেই বড় বড় প্রাচীন ভবন এদিক ওদিক। একটা সিনেমা তৈরির স্টুডিও দেখলাম হাতের ডান দিকে। এক সময় বাস ঢুকে পড়লো এমন একটা এলাকায় যেখানে রাস্তার দুই পাশে বন। বনের ভিতরে এখানে ওখানে প্রাচীন প্রাসাদ। দুই পাশের বন সবুজ রঙ করা লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা। এই পোটসডাম এলাকাটা পূর্ব বার্লিনে পড়েছিল। কমিউনিস্টরা যেহেতু রাজাদের উপর বিরূপ মনোভাবাপন্ন ছিলেন সেহেতু রাজবাড়ির পুরো এলাকাটা অনেকটা পরিত্যক্তই ছিল বলা চলে কমিউনিস্ট আমলে। পুনরেকত্রিকরণের পর এই এলাকায় সংস্কার কাজ শুরু হয়। অনেকগুলো প্রাসাদ। প্রত্যেকটির চারপাশে বিভিন্ন ভঙ্গিতে নারীপুরুষের অনিন্দসুন্দর সব মূর্তি মার্বেল পাথরের। কিছু কিছ মূর্তিতে শ্যাওলা পড়ে কালো হয়ে গেছে, হয়তো শীঘ্রই সাফ করা হবে। রাজবাড়ির একটি ভবনে পোটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল অফিস। একটিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমা পড়ে মাঝখানটা ভেঙে গেছে যদিও দুই পাশ অটুট আছে। এখন মেরামতের কাজ চলছে। কার্নিশের মূর্তিগুলো পুনর্নির্মাণ করা হচ্ছে আগের ছবি দেখে। আজ থেকে বছর পাঁচেক পরে হয়তো বোঝাই যাবে না যে একসময় এই ভবনটির এমন দুর্দশা হয়েছিল।

রাজবাড়ির পুরো এলাকার পরিকল্পনার সঙ্গে ভার্সাই রাজপ্রাসাদের মিল খুঁজে পেলাম যদিও ভার্সাই অনেক বড় ও অনেক বেশি সমৃদ্ধ। ভার্সাইয়ের মতোই রাজবাড়ীর পেছন দিকে একটি লম্বা রাস্তা কিছু দূর গিয়ে একটি ফোয়ারার সাথে যুক্ত হয়েছে। রাস্তার দুই পাশে বন ও এদিকে ওদিকে মার্বেল পাথরের মুর্তি। ফোয়ারার চারপাশেও অনেক মূর্তি। ফোয়ারা থেকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি উঠে গেছে ‘সঁ সুসি’ নামে একটি ভবনে। ফরাসি ভাষায় ‘সঁ সুসি’ কথাটার মানে হচ্ছে ‘দুশ্চিন্তাহীন’। সিঁড়ির দুই পাশে আঙ্গুরবাগান। এই আঙ্গুরবাগানে বসেই নাকি চার্চিল, স্ট্যালিন আর রুজভেল্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করে বার্লিনকে বানরের পিঠেভাগ করেছিলেন। উপরে উঠতে উঠতে হাকিম আরিফ একটা আঙ্গুর মুখে দিয়ে বললো: ‘বাহ, কী মিষ্টি!’ শুনে আমি আর সৌরভও দুটি ছিঁড়ে মুখে দিলাম। কোথায় মিষ্টি, এ যে মহা টক। হাকিম হেসে বললো, ‘মিষ্টি না বললে কি আপনারা মুখে দিতেন?’

দুপুরে খাওয়া হলো পোটসডাম স্টেশনে। সৌরভ অবশ্য ম্যাকডোনাল্ডস খেতে চাচ্ছিল। ওর আবার নতুন কোন জায়গায় গিয়ে সেখানকার ম্যাকডোনাল্ডসের বার্গার খাওয়া চাই। আমি ডোনাট কাবাবের মতো ভালো খাবার থাকতে ম্যাকডোনাল্ডের হামবার্গার খেতে রাজি নই। এক তুর্কি দোকানে ডোনাট কাবাব আর ফালাফেল (এক ধরনের ডালের বড়া) খাওয়া হলো ভালুক সহযোগে। এর পর ট্রেনে করে বার্লিন ফিরে আমরা প্রথমে গেলাম টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে হাকিম আরিফ পি.এইচ.ডি. করছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির সামনের দিকটি তেমন আহামরি নয় কিন্তু পিছনের দিকটি খুব সুন্দর। হাঁটতে হাঁটতে গেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ায়। বেশ পরিপাটি ও আধুনিক। আগে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়গুলো পড়ানো হতো। এখন সরকার নিয়ম করে দিয়েছে যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়েই কমপক্ষে ৪০%ভাগ কোর্স আর্টস বা মানববিদ্যা সংক্রান্ত হতে হবে। কৃষিবিদ্যা, ডাক্তারি ইত্যাকার সব বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ানো হয়। আমাদের দেশের মতো মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ প্রতিটি বিষয়ের জন্যে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার ফ্যাশন আর এখানে নেই।

সৌরভকে দুপুরে ম্যাকডোনাল্ড খেতে দিইনি মনে ছিল। সামনে একটা কে.এফ.সি. দেখে প্রস্তাব দিলাম, ‘চল মুরগিভাজা খাওয়া যাক।’ এই কে.এফ.সি.তে দেখলাম, টমেটো সস বা কেচাপ বিনে পয়সায় দেয়া হয় না। পয়সা দিয়ে কিনতে হয়। এতে করে অবশ্য কেচাপের অপচয় কমে। যার দরকার সে কিনে নেবে। খাওয়ার পর হাঁটতে হাঁটতেই এলাম এমন এক এলাকায় যেখানে বড় বড় সব দোকানপাট আছে। আমি একটি ইস্টপ্যাক পিঠব্যাগ কিনলাম। সৌরভ একটি গেঞ্জি আর একটি রেইনকোট কিনলো সি.এন্ড. এ. শপ থেকে। বাসায় ফেরার পথে দুই কেস ভালুকের বাচ্চা কেনা হলো। মুরগির মাংস তখনও অবশিষ্ট ছিল কিছু। সেই মাংস আর ডাল সহযোগে সারা হলো রাতের খাবার। ভালুক শিকার করতে করতে আলাপ হচ্ছিল ভাষাবিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ নিয়ে। আমি আর হাকিম আলাপ শুরু করলেই হয় ভাষাবিজ্ঞান নয়তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের কথা চলে আসে। কানু বিনে গীত নাই। হাকিম আরিফের প্রশ্ন: ‘এই বিষয় পড়ে ছেলেরা কি করবে?’ বাংলাদেশের স্কুল-কলেজে বাংলা ও ইংরেজিতে ব্যাকরণের একটি করে পেপার আছে। ভাষাবিজ্ঞান থেকে পাশ করা ছেলেদেরই ব্যাকরণ পড়ানো উচিত – এ কথা আমি এক যুগ আগে আমার ‘সঞ্জননী ব্যাকরণ’ বইয়ের ভূমিকায় বলেছি। কিন্তু ঐতিহ্য ভাঙা সহজ নয় বলে ভাষাবিজ্ঞান থেকে পাস করা ছাত্রেরা নয়, ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্য থেকে পাস করা ছাত্রেরাই সরকারি ও বেসরকারি কলেজগুলোতে ব্যাকরণ পড়ানোর দায়িত্ব পায়।

আমরা ভুলে যাই ‘স্কুল’ শব্দটি এসেছে গ্রীক ‘স্কোলা’ থেকে যার অর্থ হচ্ছে ‘অবসর’। যার অবসর আছে, যে জীবনের ঘানি টানতে টানতে অতিষ্ট নয়, সেই স্কুলে যাবে জ্ঞান চর্চা করতে। জ্ঞানচর্চার অন্যতম উদ্দেশ্য শুধুই জ্ঞানচর্চার আনন্দ। জ্ঞানের প্রয়োগ থাকতে পারে কিন্তু প্রয়োগই জ্ঞানের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। কাউকে চাকুরি দেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য হতে পারে না যদিও সারা পৃথিবী জুড়ে প্রধানত চাকুরি পাওয়ার উদ্দেশ্যেই মানুষ মুক্তকচ্ছ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটছে। এদিক থেকে দেখলে বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির উদ্দেশ্য অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে বলতে হবে। সুতরাং ভাষাবিজ্ঞান থেকে পাশ করা ছাত্রেরা (এবং শিক্ষকেরাও) ভাষাবিজ্ঞান চর্চা করছে কিনা সেটাই আগে দেখা উচিত, তারা চাকুরি পাচ্ছে কিনা সেটা পরের ব্যাপার। বিশ্ববিদ্যালয় শেখাবে, কিভাবে নৈব্যক্তিক জ্ঞান অর্জন করতে হয়, কিভাবে জ্ঞানের চর্চা করতে হয়। এ জ্ঞান দিয়ে যদি কেউ করে খেতে পারে তবে তা তার উপরি লাভ। কুমড়াফুল ভেজে খাওয়া যায়, কিন্তু গোলাপফুলের সৌন্দর্যই শুধু উপভোগ করতে হয়। কোন প্রকার জৈবিক প্রয়োজন মেটায় না বলেই গোলাপ ফুল আরও বেশি সুন্দর।

শেষ হলো আমাদের বৃষ্টিসিক্ত দুই বার্লিন দিন। দেখা হয়নি অনেক কিছুই। ইহুদিদের হলোকাস্ট মিউজিয়াম দেখা হয়নি। সালভাদর দালির স্থায়ি প্রদর্শনী চলছিল বার্লিনে, তাও দেখা হয়নি। দুই দিনে এর চেয়ে বেশি দেখা হয়তো সম্ভবও ছিল না। ২৯ তারিখ সকালে সৌরভ শিকদার ফিরে গেলেন ডেনমার্কের আলসবুর্গে, আর আমি ফিরে এলাম টোকিওতে। মাত্র এক সপ্তাহ গ্নিয়েজনো-পোযনান-বার্লিন ভ্রমণ করে এতখানি লিখে উঠে মনে পড়লো প্রায় দশ বছর ফ্রান্সে, সাত বছর কানাডায় ও দুই বছর জাপানে থেকেও দুই লাইন ভ্রমণকাহিনী লিখতে পারিনি। যে কোন জায়গায় যত বেশিদিন থাকা হয় সেই জায়গাটি তত ভালো করে চেনা হয়ে যায়, আর যতই চেনা হয়, ততই দেখা যায় স্থান, কাল আর পাত্রের মধ্যে তফাৎ শুধু উপরিতলের, অন্তর্লীন স্তরে সব মানুষ, সব সমাজ, সব দেশ এক। তখন মনে হয়, কিইবা লেখার আছে! শেষ করার আগে ধন্যবাদ জানাই হাকিম আরিফকে তার আন্তরিক আতিথেয়তার জন্যে। ভালো থেকো বার্লিন। কোন দেয়াল যেন তোমাকে আর কখনো বিভক্ত না করে। দেশে দেশে, মনে মনে যত দেয়াল আছে তাও যেন উঠে যায় একে একে। পুনরেকত্রিকরণে যে কী সুখ তা বার্লিনবাসীদের চেয়ে ভালো আর কে জানে? তাইওয়ানবাসীরা এ সুখ চায় না বলে পায় না, কোরিয়ানেরা এ সুখ এখনও পায়নি, বাঙালিরাও যে অদূরভবিষ্যতে পাবে সে সম্ভাবনাও দেখি না।

Comments (16)

Leave a comment