Scroll Top
19th Ave New York, NY 95822, USA

মন্ট্রিয়ল পরিক্রমা

montreal-canada-1050x6991

যদি বলি, ভারতবর্ষের কোলকাতা আর উত্তর আমেরিকার মন্ট্রিয়ল – এই দুই শহরের মধ্যে মিল আছে তবে আপনারা হয়তো একটু অবাকই হতে চাইবেন। মিল কিন্তু আছে। এই দু’টি শহরই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সামাজ্যবাদের প্রয়োজনে। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে স্বর্ণ-মণিমাণিক্য-মশলার খোঁজে নিজ নিজ দেশের রাজারাণীর পৃষ্ঠপোষকতার বদৌলতে স্পেন্শি-ফরাসী-ইংরেজী-ওলন্দাজ-পর্তুগীজ নাবিকেরা দলে দলে ছড়িয়ে পড়ছিল সারা পৃথিবীতে। তাদের পেছন পেছন ক্রশ হাতে ধর্মযাজকেরা। উদ্দেশ্য? সোনাদানা পাওয়া গেলেতো ভালোই, না হলে সাম্রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি হলো বা প্রসার হলো খ্রীষ্টধর্মের, এই বা কম কি!
এদেরই একজন, জ্যাক কার্তিয়ে ১৫৩৫ সালে এসে পোঁছালেন মন্ট্রিয়লে এবং আরও সোয়া শ বছর পরে সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে কোলকাতায় পা রাখেন জব চার্ণক। অনতিবিলম্বে মন্ট্্িরয়লে ব্যবসা শুরু করে হাডসনস বে কোম্পানী আর কোলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কবে মরে হেজে গেছে ভারতবর্ষে কিন্তু বে কোম্পানী এখনও চুটিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছে মন্ট্রিয়লে। এছাড়া মন্ট্রিয়লের সাথে কোলকাতার আরও কোন সম্পর্কের কথা যদি তোলেন তো তবে বলবো, মন্ট্রিয়ল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী’ নামে একটি ভারতীয় রেষ্টুরেন্ট আছে যার বেশীর ভাগ কর্মচারী বাঙালী। হতেই হবে, কারণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীতেও বেশীর ভাগ কর্মচারী ছিলেন বাঙালী। বাচাল ইতিহাস কথা না কয়ে পারে?।
কার্তিয়ের পালের জাহাজ এসে ভিড়েছিল আজকের কুইবেক প্রদেশের রাজধানী কুইবেক সিটিতে। সেখানে এক ইরোকোয়া গোষ্ঠী প্রধান কার্তিয়েকে জানালেন, কুইবেক থেকে শ দুয়েক কিলোমিটার উজানে গেলে ‘হোসেলাগা’ নামে এক গ্রাম পড়বে যেখানে পাহাড়ের উপর একটি বিশাল চকচকে পাথর রয়েছে। পাথরটা স্বর্ণ না হয়ে যায়ই না! ভাবলেন কার্তিয়ে এবং হাল ঘোরালেন হোশেলাগার দিকে। কিন্তু হায়! ইরোকোয়া গাইডদের পিছু পিছু হোসেলাগা পাহাড়ের উপরে উঠতে না উঠতেই কার্তিকবাবুর আকাশ-কুসুম কল্পনার পালে হুঁসের বাতাস লাগলো। পাথর একটা আছে ঠিকই তবে সেটা বহুমূল্য স্বর্ণ নয়, নিতান্তই নিুমানের কোয়ার্টজ (কোয়ার্টজকে বলা হয় ’গোল্ড অব ফুলস’ বা ’বোকার স্বর্ণ’)। যাই হোক, সোনা মিলুক বা না মিলুক রাজকার্য সম্পাদনে কার্তিয়ে দেরী করলেন না। তাঁর পৃষ্ঠপোষক ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের সম্মানে হোসেলাগা পাহাড়ের চূড়ায় পুঁতে দিলেন বিশাল একটি ক্রস। সেদিন থেকে হোসেলাগা ফরাসীদের দখলে চলে গেল। ইরোকোয়ারা অবশ্য বেশ কিছুদিন আক্রমণ চালিয়ে গিয়েছিল তাদের মাতৃভূমি রক্ষার জন্যে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফরাসীদের সাথে পেরে উঠেনি তারা, আর এখনতো ওদের চিহ্নমাত্র নেই। যাই হোক, এক সময় পাহাড়টির নাম দাঁড়িয়ে গেল ‘মোঁ রোয়াইয়াল’ বা রাজকীয় পাহাড়। পাহাড়ের নাম থেকেই সম্ভবতঃ মোঁরেয়াল শহরের নাম।
এখনও রাতের বেলা অন্ততঃ একটি ক্রশ মন্ট্রিয়ল পাহাড়ে জ্বলজ্বল করে খ্রীস্টধর্মের মহিমা ছড়ায়। ঈশ্বরে বিশ্বাস করুক আর নাই করুক, মন্ট্রিয়লের ডাউন টাউনে পথ হারিয়ে গেলে এই জাজ্বল্যমান ক্রস দেখে দেখে অনেকেই গভীর রাতে তাদের ঢুলুঢুলু চোখ আর টলোমলো শরীর নিয়ে ঠিকঠাক মতো নিজের ডেরায় পৌঁছে যেতে পারে। মন্ট্রিয়লের রাস্তায় খোলাখুলি মদ খাওয়া বারণ। খেতে হলে বোতল বা ক্যানটিকে খয়েরী কাগজের ঠোঙায় ঢুকিয়ে নিতে হবে! কিন্তু বারের অভাব নেই এখানে এবং অনেকগুলোই ন্যুড বার। ত্রিশের দশকের মন্দার পর সারা আমেরিকা থেকে দলে দলে লোক চলে আসতো কানাডার এই শহরে মদ-নারী আর জুয়ার আকর্ষণে। তখন এই শহরের ডাকনাম ছিল ‘সিটি অব সিন’ বা পাপের নগরী। লাসভেগাসের রমরমায় মন্ট্রিয়লের ‘সেই সুদিন গিয়াছে’। তবে ‘দেবী যাহা ছিলেন’ এক কালে তার দেখা পেতে চাইলে আপনাকে ডাউন আসতে হবে।
ডাউন টাউনের সেন্ট ক্যাথরিন রোড মন্ট্রিয়লের কামরূপ কামাখ্যা। এত বেশী ন্যুড বার নাকি পৃথিবীতে আর কোন রাস্তায় নেই। এ দাবী সত্য কি মিথ্যা তা যাচাই করার মতো বিশ্ববীক্ষা আমার খুপরিতে নেই। সৈয়দ মুজতবা আলী বেঁচে থাকলে জিগ্যেস করে নিতাম। বেশী দর্শনীও লাগে না এসব বারে ঢুকতে। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা গোব্দাগাব্দা মাফিয়ামার্কা দারোয়ানের পেতে রাখা হাতে জনপ্রতি কমবেশী দুই ডলার গুঁজে দিলেই হলো। এরপর আধো অন্ধকারে আপনি বীয়র বা মদের গ্লাসটি সামনে নিয়ে বসে থাকবেন আর আপনার প্রায় পটল তোলা চোখ আর ডবল হা করা মুখের সামনে মাটির পৃথিবীর অপ্সরারা একের পর এক নিরাভরণ, নিরাবরণ হবে পশ্চিমা সঙ্গীতের তালে তালে। পৃথিবীতে সারাজীবন ভালো ছেলে হয়ে থেকে স্বর্গে গিয়ে যা পেলেও পেতে পারেন তাইই নিশ্চিত পাবেন আপনি মন্ট্রিয়লে,তাও মাত্র দুই ডলারের বিনিময়ে, ভাবা যায়? পরিবেশটা কল্পনা করুন একবার: এ্যালকহলের গন্ধে আর সিগারেটের ধোঁয়ায় নরক গুলজার। ফুলের জলসায় নীরব হয়ে কবি ভাবে, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো নটী। অপূর্ব সুন্দরী সব অপসরারা স্টেজে উঠছে, বিভিন্ন কসরতে অঙ্গ-বরাঙ্গ প্রদর্শন করছে, তারপর নেমে এসে হয়তো টুপ করে বসে পড়ছে আপনারই পাশে… সাদা, হলুদ, বাদামী , কালো… পাঁচমেশালী অপ্সরার ঘাটতি নেই কোন। এদের অনেকেই শুনেছি আবার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। এটা নাকি এদের পার্টটাইম কাজ। ধরুন, দেখছেন, কোন সভ্যভব্য পোষাকের ভদ্র মেয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আপনি ভাবতেও পারবেন না আপনার চোখের সামনে দিয়ে কখন সে মা লক্ষèী ন্যুড বারে ঢুকে মা কালী হয়ে শরীর দেখাতে শুরু করেছে। পরদিন সেই তাকেই হয়তো দেখলেন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীতে মা সরস্বতী হয়ে বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকতে। একই অঙ্গে এত রূপ! বল মা ট্যারা দাঁড়াই কোথা?
কামরূপ বারের খদ্দেররা সবাই যে বখ্যমান নেশারু পুরুষ তা কিন্তু নয়। অনেক সতীসাধ্বী স্ত্রী স্বামীর অনুগামিনী হয়ে এসব বারে এসে থাকেন এবং স্ব্ামী-স্ত্রী দু’জনে আয়েশ করে বসে উপভোগ করে যান কামরূপ সার্কাস কোম্পানীর ইন্দ্রিয়তাতানো সব শো। তবে আঠারো বছরের কমবয়সী ছেলেমেয়েদের এখানে আসা বারণ। কিন্তু ‘সে যে মানে না মানা!’ দারোয়ান আঁখি ফিরাইলেই তার হাতে ডলার গুঁজে দিয়ে কোন এক ফাঁকে ঢুকে পড়ে নাবালকেরা এবং অতঃপর, বারের কোন এক কোনে ঘাপটি মেরে বসে দৃষ্টিমৈথুনে মগ্ন হয়।
ডাউনটাউনের বারগুলোতে কামসূত্রপাত হয় সন্ধ্যে আটটার দিকে আর চলে রাত তিনটা অব্দি। এখানে রাস্তায় লোক থাকে সারা রাত। সপ্তাহান্তের দুই রাতেতো বটেই, সপ্তাহের দিনগুলোতেও রাত তিনটা-চারটায় লোকের অভাব হয় না ডাউন টাউনে। মন্ট্রিয়লের লোক রাত জাগতে খুব পছন্দ করে। আরেকটি জিনিষ আছে এ শহরে যা আমি অন্ততঃ ইওরোপে বা এশিয়ায় দেখিনি। এখানকার বেশীর ভাগ ফরাসী মেয়ের মধ্যে মেয়েলী হাবভাব বা সাজগোজের বাহুল্য নেই। তবে আমাকে যা সবচেয়ে বেশী অবাক করে তা হচ্ছে এই যে বেশীর ভাগ ফরাসী পুরুষ রাস্তাঘাটে মেয়েদের দিকে দৃষ্টিকটুভাবে (অর্থাৎ অতিপ্রকট কামনার চোখে) তাকায় না।
ডাউন টাউনের পাশেই মন্ট্রিয়ল পাহাড়। এ পাহাড়টি একটি ঋতুঘড়ি। মন্ট্রিয়লে কখন কোন ঋতু চলছে, পাহাড়টির দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। যখন দেখবেন, পাহাড়ের সব গাছ বরফে সাদা তখন শীতকাল। হালকা সবুজ যখন, তখন বসন্ত; আর যখন ঘন সবুজ তখন গ্রীষ্মকাল। পাহাড়টি যখন লাল-হলুদ-খয়েরী-সাদা ইত্যাদি নানা রঙে রঙিন তখন বুঝতে কষ্ট হয় না যে মন্ট্রিয়লে চলছে শরৎকাল আর সব পাতা ঝড়ে গিয়ে ধূষর দাঁড়িয়ে থাকে যখন ঢ্যাঙা গাছগুলো, তখন ভাববেন, হেমন্তকাল শেষ এবং এদের খ্যাংরাকাঠি শরীর বরফের সাদা কাফনে ঢেকে যেতে আর বেশী দেরী নেই।
সবচেয়ে বেশী শীত পড়ে জানুয়ারী মাসে। তখন গড় তাপমাত্রা শুন্যের দশ ডিগ্রী নীচে। হিমেল হাওয়ার কারণে তাপমাত্রা মাঝেমাঝেই নেমে যায় শুন্যের ত্রিশ ডিগ্রী নীচে পর্যন্ত। সে যে কী ঠাণ্ডা! ঙয শীত! বছরে কমবেশী দেড় মানুষ সমান (২.৪ মিটার) বরফ পড়ে। এই বরফ সাফ করতেই সিটি গভর্ণনেন্টের খরচ হয় বছরে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার। মাঝে মাঝে রাস্তা এত পিচিছল থাকে যে মনে হবে যেন সাবান মাখা আয়নার উপর দিয়ে হাঁটছেন। অনেকেই টাল সামলাতে না পেরে পা পিছলে আলুর দম। আছাড় খেয়ে কোমড় ভাঙা রোগীতে মন্ট্রিয়লের হাসপাতালগুলো ভরে যায় শীতকালে।
মন্ট্রিয়লের আবহাওয়ার ঠিক ঠিকানা নেই কোন। অনেক সময় এক ঘন্টার মধ্যেই রোদ, বৃষ্টি, বরফ সব একের পর এক দেখা দিয়ে যায়। সুতরাং মন্ট্রিয়লবাসীদের অনেকেরই পিঠে থাকে একটি ব্যাগ যাতে থাকে অতিরিক্ত কাপড়, ছাতা, জুতা, খাবার… হেমন্তে প্রকৃতি দেবী যখন পাতা ঝরিয়ে ঝরিয়ে নিজের অঙ্গবস্ত্র সব খুলতে শুরু করে তখন মন্ট্রিয়লবাসীরা পরতের পর পরত কাপড় জড়িয়ে চলে নিজেদের গায়ে; আবার, বসন্তে প্রকৃতি যখন সবুজ-হলুদ কাপড় পড়তে শুরু করে ধীরে ধীরে, তখন এরা খুলতে থাকে নিজের গায়ের ’বাসাংসি বাহুল্যানী’। বছরে সাকুল্যে খান ষাটেক পাওয়া যায় রোদেলা দিন। তখন মন্ট্রিয়লবাসীদের কাউকে আর ছাদের নীচে পাবেন না। প্রতি বিকেলে এদের অনেককে দেখা যায় মন্ট্রিয়ল পাহাড়ের নীচে, যেখানটায় কার্তিয়ের মূর্তি রয়েছে অনেকগুলো পাথুরে সিংহের মাঝখানে, তার আশেপাশে। সেখানে নানা দল নানা জায়গায় জড়ো হয়ে নাচছে, গাইছে, হাসছে, খেলছে বা স্রেফ শুয়ে আছে রোদে সূর্যকে নিতম্ব দেখিয়ে, সামান্য কটিবস্ত্রখানি সম্বল করে। সে কটিবস্ত্র এতই ক্ষিণ যে মুজতবা আলীর ‘টাইয়ের কাপড়ে পাঁচটি মেয়ের বিকিনি হয়ে যায়!’
মন্ট্রিয়ল একটি বিশ্ববিদ্যালয় নগরী। মোঁ রোয়াইয়াল পাহাড়ের তিনপাশে চারটা বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়: ম্যাকগিল, ইউকাম, কনকর্ডিয়া আর মন্ট্রিয়ল বিশ্ববিদ্যালয়।এছাড়া কলেজ আর ইনস্টিটিউট যে এখানে কত আছে তার ইয়ত্বা নেই। হাজার হাজার বিদেশী ছাত্র পড়াশোনা করে মন্ট্রিয়লে। কুইবেকে পড়াশোনার খরচ কানাডার অন্য যে কোন প্রদেশের তুলনায় কম, যুক্তরাষ্টের যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে কমতো বটেই। এখানকার শত শত পাঠাগারে রয়েছে সবার প্রবেশাধিকার – ছাত্র-অছাত্র যাইই আপ্িন হোন না কেন। সম্প্রতি আবার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নূতন ‘বিবলিওতেক নাসিওনাল’ বা ন্যাশনাল লাইব্রেরী। তবে বাড়ী বা লাইব্রেরীর চাইতে এখানকার ছাত্রছাত্রীরা কফি হাউজে পড়াশোনা করতে বেশী পছন্দ করে। ডাউন টাউনের সেকন্ড কাপ বা টিম হর্টনগুলো খোলা থাকে প্রায় সারা রাত এবং রাত দু’টায়ও দেখা যায় ছাত্ররা বসে আছে এসব কফি হাউজে বইখাতা সামনে নিয়ে। লক্ষ্য করলে দেখবেন, শুধু কফির কাপে চুমুক দেয়ার বিরতিটুকু ছাড়া বাকী সময়ে হাতের দশ আঙ্গুল তাদের সমানে নেচে চলেছে ’অঙ্কশায়িনীর’ (ল্যাপটপ) অক্ষরদানীতে।
‘এমন শহরটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’ যেখানে ফরাসী আর ইংরেজী ভাষা সমানে চলে। চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দু’টি ফরাসীভাষী (ইউনিভার্সিটি অব মন্ট্রিয়ল আর ইউকাম) আর অন্য দু’টিতে (ম্যাকগিল আর কনকর্ডিয়া) চলে ইংরেজী। থিসিস ইংরেজী আর ফরাসী – এই দুই ভাষাতেই লেখা যেতে পারে। টিভিতে ইংরেজী চ্যানেল যেমন আছে, তেমনি আছে ফরাসী চ্যানেল। হাট-বাজার যেখানেই যাবেন আপনি, এ দুই ভাষার যে কোন একটি ব্যবহার করতে পারেন। ফ্রান্সের যে কোন শহরের সাথে মন্ট্রিয়লের তফাৎটা এখানেই। ফ্রান্সে ফরাসী না বলে চলা যায় না, মন্ট্রিয়লে কিন্তু যায়। ঠিক এ কারণেই অনেক অভিবাসী ত্রিশ বছর মন্ট্রিয়লে থাকা সত্বেও ফরাসী ভাষা বলতে বা বুঝতে পারে না। তবে উৎসনির্বিশেষে মন্ট্রিয়লের নূতন প্রজন্ম ইংরেজী আর ফরাসী উভয় ভাষাতেই সমান পারদর্শী হয়ে উঠছে।
সারা উত্তর আমেরিকার ইংরেজী ভাষার সাগরে কুইবেক যেন পদ্মপত্রে একটুখানি ফরাসী নীর। টলমল করছে। ভয়, এই বুঝি ডুবে যায়। এই অবস্থার পেছনে আছে ইওরোপের ইতিহাস। ফরাসী আর ইংরেজদের মধ্যে যুদ্ধ চলছিল অষ্টাদশ শতকে। ১৭৬৩ সালের প্যারিসে স্বাক্ষরিত এক চুক্তি অনুসারে কানাডার মালিকানা ইংরেজদের হাতে তুলে দেয় ফ্রান্স। এর পর দলে দলে ইংরেজীভাষীরা এই নূতন ব্রিটিশ কলোনীতে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভের পর রাণীর অনুগত বহু ইংরেজ পরিবার যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে চলে আসে কানাডায় এবং তাদের অনেকেই থাকার জন্য মন্ট্রিয়লকেই বেছে নেয়। কিন্তু তারপরও মন্ট্রিয়লে ফরাসীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল সব সময়। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে মন্ট্রিয়ল ছিল ফরাসী-সংখ্যাগরিষ্ঠ এক ইংরেজী-ভাষী শহর। অফিস-আদালত আর ব্যবসা-বানিজ্যের ভাষা ছিল ইংরেজী। অদ্ভূত এই ভাষিক পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন কুইবেকোয়ারা তাদের ফরাসী ভাষা আর সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তার ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠে। এ সময়ে পার্টি কুইবেকোয়া নির্বাচনে জিতে একের পর এক ভাষাআইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করে কুইবেককে একটি একভাষী প্রদেশে পরিণত করে। বর্তমানে কানাডা দ্বিভাষি বা বাইলিঙ্গুয়াল দেশ হলেও কুইবেকের অফিসিয়্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ বা প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা ফরাসী। আদালতে ফরাসীই এখানে প্রধান ভাষা। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড ফরাসীভাষায় না লেখা থাকলে মোটা টাকা জরিমানা করা হয় এখানে। ফরাসী ভাষার প্রতি কুইবেকোয়াদের প্রাণের টান এত বেশী যে এ ভাষাকে রক্ষার জন্য তারা কানাডা থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন হয়ে যেতেও রাজী। ‘বিনা ফরাসী ভাষা মিটে কি আশা!’ তবে ফরাসী ভাষা-সংস্কৃতির অস্তিত্বসঙ্কট কেটে যাওয়াতে কুইবেকের স্বাধীনতার দাবী ইদানিং কিছুটা হলেও স্থিমিত হয়ে পড়েছে।
২০০৪ সালের এক পরিসংখ্যান মতে মন্ট্রিয়লের অধিবাসীদের ৫৩% ভাগ ইংরেজী আর ফরাসী এই উভয় ভাষা সমান যোগ্যতায় বলতে পারে। ৬৮% ভাগ মন্ট্রিয়লবাসীর মাতৃভাষা ফরাসী আর ১৪% ভাগের মাতৃভাষা ইংরেজী। তবে জনসংখ্যার একটি বিশেষ অংশের (প্রায় ১৯%ভাগ) মাতৃভাষা ইংরেজীও নয়, ফরাসীও নয়। এরা সবাই বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভিবাসী যাদের মধ্যে চীনাদের সংখ্যাই বেশী। তারপর ভিয়েতনামী, আরবী, তামিল, পাঞ্জাবী…। মন্ট্রিয়ল একটি বিশাল মেল্টিং পট যেখানে ‘শক-হুণদল-পাঠান-মোগল’ সুচি্িন্তত সরকারী পরিকল্পনা অনুসারে এক ফরাসী দেহে লীন হচ্ছে কিন্তু নিজেদের স্বকীয়তাও হারিয়ে ফেলছে না। ফ্রান্সের অভিবাসন নীতির সাথে কুইবেকের অভিবাসন নীতির একটি বড় পার্থক্য এই যে কুইবেক সরকার চায়, প্রতিটি জনগোষ্ঠী তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় যতœবান হোক, কারণ যে নিজের ভাষা-সংস্কৃতিকে সম্মান বা রক্ষা করতে পারে না, সে অন্যের ভাষা-সংস্কৃতিকে সম্মান করবে না বা গ্রহণও করতে পারবে না।
মন্ট্রিয়লে আগে থেকেই প্রচূর গীর্জা ছিল। এখনও প্রায় প্রতিটি এলাকায় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর গীর্জা রয়েছে। মন্ট্রিয়ল সম্পর্কে মার্ক টোয়েনের বিখ্যাত বক্তব্যটি ছিল এরকম: ‘জীবনে প্রথমবারের মতো আমি এমন একটি শহরে এলাম যেখানে ঢিল ছোঁড়া মাত্রই কোন না কোন গীর্জার জানালার কাঁচ ভাঙবে।’ ফরাসীরা জন্মগতভাবে রোমান ক্যাথলিক হলেও জনগণের ওপর ধর্মের প্রভাব অনেক কমে গেছে গত ত্রিশ বছরে। এমন এক সময় ছিল যখন পরিবারের সব সদস্যকেই রবিবারে বাধ্যতামূলকভাবে গীর্জায় যেতে হতো। পাদ্রীসাহেব না করলে সিনেমায় পর্যন্ত যাওয়া যেত না। বর্তমানে যুবসম্প্রদায়ের বেশীরভাগ ধর্মের ব্যাপারে অনাগ্রহী, সরকারী নীতি অসাম্প্রদায়িক। তবে জনগন এখানে ‘অতিসাম্প্রদায়িক’ অর্থাৎ কবি নজরুলের মতো (এটা অবশ্য আমার ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা!) সব সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি সম্পর্কেই তারা সমান আগ্রহী। শিয়া মুসলমানদের আসুরার তাজিয়া আর ইসকনের কৃষ্ণ ভক্তদের রথযাত্রা, আইরিশ ক্যাথলিকদের সেন্ট প্যাট্রিক ডে-র মিছিলে মন্ট্রিয়লবাসীরা সমান উৎসাহের সাথে অংশগ্রহণ করে থাকে।
মন্ট্রিয়লের অধিবাসীরা রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে অত্যন্ত সচেতন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রশ্নে নিজেদের মতামত জানাতে মন্ট্রিয়লবাসীরা প্রায়ই রাস্তায় নেমে পড়ে। যুদ্ধবিরোধী মিছিলে প্রচূর জনসমাগম হয় এ শহরে। নিজের ও অন্যের অধিকার রক্ষায় এরা সবসময়েই অতি সচেতন ও সোচ্চার। এমন প্রতিবাদী মনোভাব কানাডার অন্যত্র দুর্লভ, যুক্তরাষ্ট্রে সম্ভবতঃ বিরল।
সংখ্যার দিক থেকে বাংলাভাষীরা মন্ট্রিয়লে এখনও নগন্য। সরকারী হিসাব মতে, ষাটের দশকে কুইবেকে বাংলাভাষী ছিলেন মাত্র ২০ জন, সত্তরের দশকে ১৪৫ জন আর আশির দশকে ৭৭৫ জন। বাঙালীরা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় কুইবেকে আসা শুরু করেছেন নব্বইয়ের দশকের প্রথম ভাগে। সারা কুইবেকে বাংলাভাষীর সংখ্যা ২০০১ সালের আদমসুমারী অনুসারে ৫,২২৫ জন। এখন হয়তো আরও কিছু বেড়েছে, হয়তো হাজার সাতেক বাঙালী আছেন মন্ট্রিয়ল শহরে। বাঙালীরা বেশীর ভাগ থাকেন পার্ক এক্সটেনশন (মেট্রো: পার্ক) আর কোত দ্য ন্যাজ (মেট্রো: প্লামন্দো বা বাঙালী উচ্চারণে ‘প্লামন্ডন’) -এই দুই এলাকায়। এখানে আছে বাঙালীদের নিজস্ব মুদি দোকান, কাপড়ের বুটিক। আছে বিভিন্ন আঞ্চলিক ও জাতীয় সমিতি। নিয়মিত আয়োজিত হয় মিলাদ মহফিল বা হরিনাম সংকীর্তন সভা। নিজস্ব মসজিদ-মন্দির এখনও তেমনভাবে গড়ে উঠেনি সংখ্যাস্বল্পতার কারণে। পার্কের বাঙালী মুসলমানেরা আরবীদের মসজিদে নামাজ পড়েন আর বাঙালী হিন্দুরা যান বেলসাশ রোডে পাঞ্জাবীদের মন্দিরে। দূর্গাপূজা, সরস্বতী পূজা, কালীপূজা ইত্যাদিরও আয়োজন হয় তবে তিথী অনুসারে পূজা করা হয় না মন্ট্রিয়লে। নির্দিষ্ট তিথীর পরবর্তী কোন শনি বা রবিবার পূজার আয়োজন হয়। পহেলা বৈশাখ, ২১ ফেব্র“য়ারী, ১৬ই ডিসেম্বর ইত্যাদি বাঙালী উৎসব বা বাচ্চাদের জন্মদিনও বেশীরভাগ ক্ষেত্রে পরবর্তী সপ্তাহান্তে পালন করার রেওয়াজ এখানে।
বিভিন্ন জাতীয় উৎসবে বাংলাদেশ ও ভারতের বাঙালী শিল্পীরা আমন্ত্রিত হন। দর্শনীর বিনিময়ে এসব অনুষ্ঠান দেখতে আসেন মন্ট্রিয়লবাসীরা সপরিবারে। এক্ষেত্রেও অবশ্য প্রতিযোগিতার ব্যাপারটা এসে যায়। এক দল যদি কণকচাঁপাকে আনলোতো অন্য দলের আমন্ত্রণে আসবেন আঁখি আলমগীর। তবে সুন্দর অনুষ্ঠানের কথা উঠলেই উল্লেখ করতে হবে মন্ট্রিয়ল উদিচীর কথা। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি চমৎকার সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছে তারা যার একটিতে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের অনুপ ঘোষাল আর অন্যটিতে বাংলাদেশের কাদেরী কিবরিয়া। মন্ট্রিয়লে এক সময় নাটকের কয়েকটি দল ছিল যদিও গত কয়েক বছরে নাটক খুব একটা মঞ্চস্থ হয়নি। ২০০৪ সালে দুই দিন ব্যাপী নিখিল উত্তর আমেরিকা নজরুল সম্মেলনের আয়োজন করেছিল বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সংস্থা (আই এস বি)। এতে ইউসুফ খায়েরের পরিচালনায় নজরুলের ‘শিল্পী’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল।
নব্বইয়ের দশক থেকেই মন্ট্রিয়লের বাঙলা সাহিত্যের চর্চা হচ্ছে। সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হয়েছে অনেকগুলো: দেশদিগন্ত, বাংলাবার্তা, সাতদিন, প্রবাসবাংলা… তবে মন্ট্রিয়লে বাংলা সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে এক অভিনব সংযোজন ছিল সুলতানার স্বপ্নের মাসিক সাহিত্য সভা। প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা ছিলেন আলম খোরশেদ ও মাহিয়া আবরার। এঁরা দু’জন বাংলাদেশে ফিরে যাবার পর সুলতানার স্বপ্নের দায়িত্বে ছিলেন অপরাহ্ন সুসমিতো ও সকাল অনন্ত। সাহিত্যসভায় কোন লেখা পড়ার পর বিশদ আলোচনা হত। এরপর জলযোগ এবং তারপর মধ্যরাত পর্যন্ত চলতো তুমুল আড্ডা। প্রায় ত্রিশটির মতো সাহিত্যসভার পর বিভিন্ন কারণে সুলতানার স্বপ্ন বন্ধ হয়ে যায়।
২০০২ সালে টরোন্টো থেকে প্রকাশিত বাংলা কাগজে সাইফুল ওয়াদুদ হেলালের উদ্যোগে মন্ট্রিয়লের পাতা সংযোজিত হয়। মামুনর রশীদ, সৈয়দ ইকবাল, কামাল আহমেদ, রেজাউল করিম, অপরাহ্ন সুসমিতো, নাহার মণিকা, রাকীব হাসান, আলম খোরশেদ, মাহিয়া আবরার, মুফতি ফারুক, শিশির ভট্টাচার্য্য, আবদুর রাজ্জাকসহ অনেকেই লিখতেন এতে। সারা কানাডায় চমৎকার এই চারটি মন্ট্রিয়ল পাতার প্রচূর পাঠক ছিল। এর পর আরও যত বাংলা সাপ্তাহিক প্রকাশিত হয়েছে টরোন্টো থেকে তার সবগুলোতেই মন্ট্রিয়লের পাতা সংযোজিত হয়েছে।
মন্ট্রিয়লে চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা উঠলেই উল্লেখ করতে হয় সাইফুল ওয়াদুদ হেলালের কথা। অšততঃ দু‘টি কাহিনীচিত্র নির্মাণ করেছেন তিনি: ’সুপ্রভাত মন্ট্রিয়ল’ আর ’কবি’ (লেখক-শিল্পী সৈয়দ ইকবালের কাহিনী অবলম্বনে)। ২০০৫ সালে সাইফুল নির্মান করেছেন বাংলাদেশের এক অলি লেঙটাবাবার ওরসের উপর এক তথ্যচিত্র: ’বিশ্বাসের রঙ’। ছবিটি মন্ট্রিয়ল চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছিল।
শুনেছি, ১৯৯৩ সালে মুরাদ হোসেন প্রথম বাংলা টেলিভিশন চালু করেন। অনুষ্ঠানটি ১৯৯৮ পর্যন্ত চলেছিল। হেলাল, কাজী মীরা আর দিলীপ চৌধুরী মিলে প্রায় বছরখানেক ধরে একটি বাংলা টেলিভিশন অনুষ্ঠান চালিয়েছেন মন্ট্রিয়লে ২০০৪-২০০৫ সালে। বেশ জনপ্রিয় ছিল অনুষ্ঠানটি। দিলীপ চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে এখনও চলছে প্রোগ্রামটি। বছর খানেক ধরে মুরাদ হোসেনের পরিচালনায় প্রতি শুক্রবার রাত ১১টায় ১২৮০ (এ.এম.) ব্যাণ্ডে বাঙালীরা শুনতে পাচ্ছেন ভয়েস অব বাংলার রেডিও অনুষ্ঠান।
বর্তমানে টরোন্টোবাসী শিল্পী সৈয়দ ইকবাল বেশ কিছু দিন মন্ট্রিয়লে ছিলেন। এখন মন্ট্রিয়লের একমাত্র বাঙালী শিল্পী রাকীব হাসান। আফ্রিকার কেনিয়ায় থাকার সুবাদে তার চিত্রকলা এশিয়া-ইওরোপ-আফ্রিকার অঙ্কনশৈলীর অপূর্ব এক মিশ্রণ হয়ে উঠেছে। বছর খানেক আগে ডাউন টাউনের গোরা গ্যালারীতে রাকীবের একটি চিত্রপ্রদর্শনী হয়েছিল।
(মন্ট্রিয়লের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উপরোক্ত বিবরণটি অবশ্যই খন্ডিত তবে ইচ্ছাকৃতভাবে একপেশে নয়। পাঠকদের সবিনয়ে জানাচ্ছি, এ শহরের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দেবার মতো যোগ্যতা আমার নেই। যা যা আমার চোখে পড়েছে বা কানে এসেছে গত চার বছরে শুধু তারই উল্লেখ করলাম এখানে।)
বাঙালীরা মন্ট্রিয়লের স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নেয়া শুরু করেছেন। তবে দেশীয় রাজনীতির ব্যাপারে বাঙালীরা এখানে দেশের মতোই দ্বিধাবিভক্ত। আছে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ দল, আওয়ামী লীগ, বি এন পি, জামায়াতে ইসলামী। কিছুদিন আগে দেলওয়ার হোসেন সাঈদীর মন্ট্রিয়ল আগমনের প্রতিবাদে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের বাঙালীরা শহরে মিছিল করেছেন সকাল বেলায়। এর পর বিকাল বেলায় পার্ক মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে সাঈদীর কুশপুত্তলিকার ‘দুই গালে জুতা মেরেছেন তারা তালে তালে’। মৃদু ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া আর পরস্পর জুতা ছোঁড়াছুঁড়ির ঘটনাও ঘটেছে। পার্কের তিনটি বাঙালী মুদি দোকানের একটির মালিক সাঈদীর পক্ষে থাকায় তার দোকানে বাজার করতে পর্যন্ত যায় না স্বাধীনতার পক্ষের অনেক বাঙালী। রাজাকারের দোকানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কেউ গেল কি না তা খেয়াল করার জন্যেও লোকের অভাব নেই।
বাঙালীদের ছেলেমেয়েরা বেশীর ভাগই ফরাসী স্কুলে যায়। তারা ফরাসী-ইংরেজী দুইই সমানে বলতে পারে। এদিকে শতকরা ৯৯ জন বাবা-মাই ফরাসী ভাষায় ব-কলম, কারণ আগেই বলেছি, মন্ট্রিয়লে ফরাসী জানা বাধ্যতামূলক নয়। সুতরাং বাবা-মায়েরা বুঝতে পারেন না ছেলেমেয়েরা কি পড়ছে, কি শিখছে, কতটুকু শিখছে। এ ছাড়া অনেক পরিবারে বাবা-মা দু’জনেই কাজ করেন এবং সন্তানদের নিয়মিত সময় দিতে পারেন না। এভাবে দুই প্রজন্মের মধ্যে ভাষাগত ও অন্যান্য ব্যবধান তৈরী হচ্ছে ধীরে ধীরে। অনেক বাবা-মা ছেলেমেয়েদের নামাজ-রোজা করিয়ে, নিয়মিত মন্দিরে বা পূজায় নিয়ে গিয়ে, ছড়া-কবিতা-গান শিখিয়ে অন্ততঃ কিছুটা হলেও বাঙালী করে তুলতে চান কিন্তু সেন্ট লরেন্ট নদীর হিমজলে পদ্মার ইলিশ মাছের চাষ করা সহজ নয়।
কোলকাতা যেমন ভারতের, নিউইয়র্ক যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, মন্ট্রিয়লও তেমনি কানাডার সাংস্কৃতিক রাজধানী। সিনেমা, তথ্যচিত্র, নাটক, সঙ্গীত, চিত্রকলা, গল্পবলা, সাহিত্য, আলো, শব্দ ইত্যাদি কত বিচিত্র বিষয়ের উৎসব যে আয়োজিত হয় এ শহরে তা বলে শেষ করা যাবে না। শুধু আর্ট ফিল্মের জন্যেই কয়েকটি সিনেমাহল আছে। জুলাই মাসে এখানে ১০ দিন ব্যাপী চলে জাজ উৎসব। নামে ‘জাজ ফেস্টিভাল’ হলেও এটা আসলে সঙ্গীত উৎসব। সব দেশের সঙ্গীতকারের উপস্থিতিতে এ রকম মানের উৎসব আমি অন্ততঃ অন্য কোথাও দেখিনি। ডাউন টাউনের অনেকগুলো রাস্তা বন্ধ করে এখানে স্টেজ, ওখানে স্টেজ। ঠিক যেন দূর্গাপূজার প্যান্ডেল। এরই ফাঁকে ফাঁকে চলছে ট্যাঙ্গো নাচ, এ্যাক্রোব্যাসী, মিনি সার্কাস। লোকে লোকারণ্য কিন্তু এতটুকু অব্যবস্থা নেই কোথাও। বিভিন্ন উৎসবে মন্ট্রিয়লের সাংগঠনিক মুন্সিয়ানা প্রশংসার দাবীদার। দুঃখের বিষয়, মন্ট্রিয়লের বাঙালীদের সাথে মূলধারার এসব উৎসবের সম্পর্ক তেমন নেই বললেই চলে।
মন্ট্রিয়লের আয়তন ১৪৮২ বর্গমাইল আর ২০০২ সালের আদমসুমারী অনুসারে এর লোকসংখ্যা সাড়ে ৩৪ লক্ষের মতো। অনেকের মতে, মন্ট্রিয়ল টরোন্টোর চেয়ে বড় শহর এবং কানাডার সবচেয়ে বড় শহর। মন্ট্রিয়লের রাস্তাগুলো নিউইয়র্কের মতোই একটি অন্যটিকে সমকোণে কেটে ছুটে চলেছে। সুতরাং খুব বুদ্ধিমান না হলে রাস্তা হারানোর ভয় নেই। বুলভার্ড স্যাঁ লোরঁ (সেন্ট লরেন্ট) কে বলা হয় মন্ট্রিয়লের মেরুদণ্ড। এ সড়কটি পুরো মন্ট্রিয়লকে পূর্ব আর পশ্চিম – এই দুই ভাগে ভাগ করেছে। এখানে অনেক রাস্তাতেই একই নম্বর দু’বার থাকতে পারে, যেমন ২২১ জঁ তালোঁ ইস্ট আর ২২১ জঁ তালোঁ ওয়েস্ট। সুতরাং বাড়ীর নম্বর আর রাস্তার নাম জানলেই চলবে না, জানতে হবে নম্বরটি ইস্ট না ওয়েস্টের। স্যাঁ লোরঁ সড়কের পূর্বদিকে থাকে প্রধানতঃ ইংরেজীভাষীরা আর পশ্চিমদিকে ফরাসীভাষীরা।
মন্ট্রিয়লের মেট্রোর কথা না বলে মন্ট্রিয়ল পরিক্রমা শেষ করা অসম্ভব। ষাটের দশকে তৈরী এই মেট্রো আরাম, শিল্প আর রূচির এক অনন্য সমাহার। এর স্টেশনগুলো একটি অন্যটির চেয়ে একেবারে আলাদা। আলাদা তাদের স্থাপত্য, আলাদা বসার সিট, আলাদা আলোকসম্পাতের ব্যবস্থা, আলাদা তাদের শিল্পসৌকর্র্য। ৬৫ জন শিল্পী আলাদা আলাদা ভাবে মন্ট্রিয়ল মেট্রোর ৬৫ টি ষ্টেশনের পরিকল্পনা করেছেন। এঁদের মধ্যে অভিবাসী শিল্পীও আছেন অনেকে। মেট্রোটি ছোট কিন্তু খুবই পরিচ্ছন্ন।
মন্ট্রিয়লে সামাজিক নিরাপত্তা অন্য অনেক শহরের তুলনায় অবশ্যই বেশী তবে এখানেও চাকুরীর ক্ষেত্রে বর্ণবাদ আছে। কুইবেকের ভালো ভালো সব চাকুরী কুইবেকোয়ারাই করবে – এমন কথা মুখে আনা যায় না আইনের ভয়ে, কিন্তু এমনতরো মনোভাব রয়েছে অনেক কুইবেকোয়ার মধ্যেই। না থাকাটাই অবশ্য অস্বাভাবিক ছিল। এখানেও স্ট্রিট গ্যাং আছে, সন্ত্রাস আছে, ড্রাগ আছে। সন্ত্রাসীর গুলিতে মারা যাওয়া অসম্ভব কিছু নয় মন্ট্রিয়লে। এ ছাড়া আছে আত্মহত্যা। প্রায়ই কেউ না কেউ মেট্রোরেলের অয়োময় চাকার নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে মনের দুঃখের কঠিন পাথরকে আচ্ছা করে পিষে ফেলতে চায়। ব্যস, অমনি বন্ধ হয়ে যায় মেট্রোর চারটি লাইনের কোন একটি। আত্মহত্যাকারী যেখানে যাবার ঠিক সময়েই চলে যায় সেখানে কিন্তু বাকী যাত্রীদের আটকে দিয়ে যায় বেশ কয়েক ঘন্টার জন্যে। কাজের জায়গায় ব্যক্তিগত নথিতে দেরীতে উপস্থিতির লাল দাগ পড়ে যায় যা কোন কর্মচারীকে দাগা দিতে পারে সারাটি কর্মজীবন ধরে।
অবশ্য মেট্রোতে মৃত্যুই শুধু নয়, আছে কবিতাও। ট্রেনের সিটে বসে পাশের দেয়ালের ডিজিটাল পর্দার দিকে তাকালে দেখবেন, প্রথমে ভেসে উঠেছে পরবর্তী স্টেশনের নাম। তার পর সামান্য বিজ্ঞাপন এবং তারপর ছোট্ট কবিতা। কিছুদিন আগে একটি কবিতা পড়েছিলাম যার বাংলা অনুবাদ হবে এ রকম: ‘প্রেম যদি অন্ধই হবে তবে দয়িতা তোমার দ’ুচোখ উপড়ে নেবো, তবু যদি এতটুকু ভালোবাসা পাই।’ কি সাংঘাতিক! দুরমুশ-ঠাসঠুস-নাই হুঁশ-জর্জ বুশ। প্রেমিক আর কবিদেরও মনের দখল নিয়েছে সন্ত্রাস। মনোহরণ পাতাল রেলে চিন্তাহরণ প্রেমিকের এমন সব শান্তিহরণ প্রেমালাপ মনে করিয়ে দেয় বাংলাদেশের কথা। ঢাকা-কোলকাতা-মন্ট্রিয়ল তখন মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।

Comments (15)

Leave a comment