Scroll Top
19th Ave New York, NY 95822, USA

দুর্গতিনাশিনীর ভ্রমণদুর্গতি

goddess_durga_cartoon-t3

বর্ষাকাল তখন শেষ। আকাশে জমে থাকা কালো মেঘের সর্বশেষ স্তুপটিও গলে বৃষ্টি হয়ে গড়িয়ে পড়েছে মাটিতে। কংক্রিটের আগ্রাসনের ফাঁক গলে বঙ্গদেশে যেটুকু প্রান্তর এখনও অবশিষ্ট আছে সেখানে কোথাও কোথাও কাশফুলের কলিরা সভয়ে উঁকি দিতে শুরু করেছে। সুনীল আকাশে হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো ফুরফুরে মেজাজে উড়ে বেড়াচ্ছে ধবধবে সাদা মেঘের বাচ্চারা। শহরের পথকলিরা রাতে ঝরে পড়া শিশিরভেজা শিউলি আর বকুল ফুল দিয়ে মালা গাঁথছে। মূর্তিশিল্পি আর বাজনদারেরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে সার্বজনীন পূজোকমিটির কর্তাদের সঙ্গে বায়নার টাকা নিয়ে দরকষাকষি করছে। পুরুত ঠাকুরকে খবর দেয়া হয়ে গেছে। দোকানে দোকানে পূজোর সেল শুরু হবে কয়েক দিনের মধ্যেই…
কৈলাসপুরে শিবালয় হাউজিং কমপ্লেক্সের স্বর্গচুম্বী ভবনের অত্যাধুনিক ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে সুদূর বঙ্গদেশের দিকে থাকিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত কণ্ঠে মহালয়ার চন্ডীপাঠ শুনতে শুনতে উপরের দৃশ্যগুলো দেখছিলেন দুর্গাদেবী আর ভাবছিলেন, কত দিন আগে, সেই বঙ্গভঙ্গেরও কত আগে থেকে তিনি বঙ্গভ্রমণে আসছেন দিন পাঁচেকের জন্যে। কত কত সুখস্মৃতি… মহারাজ নন্দকুমারের নাটম-পে তিন দিনব্যাপী যাত্রাপালা, উত্তর ভারত থেকে আসা ওস্তাদদের কালোয়াতি গান, নিকি বাইয়ের অনিন্দসুন্দর নাচে আমন্ত্রিত সাহেবসুবোর দল… আর এখন? বারোয়ারি পূজাম-পে চার চারটি দিন মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কোমড় ধরে যায়, ধূপের ধোঁয়ায় চোখে জ্বালা ধরে। কোথায় শানাই-বাঁশি-তাকঢুম ঢোল? সাউন্ডবক্সের তীব্র আওয়াজে হিন্দি-ইংরেজি গান শুনতে শুনতে মাটির কান থেকেও পোকা বেরিয়ে আসে। ভক্তির নেশমাত্র নেই নারী-পুরুষ কারও মনে। পুরুষ ভক্তেরা তাদের যত সব সাড়ে তিন নম্বরী ধান্দা নিয়ে মহা ব্যতিব্যস্ত। নারী ভক্তেরা শাড়ি-গয়না-হিন্দি সিরিয়ালে (ডিপফ্রিজে রাখা আইসক্রিমের মতো) এমন জমে আছেন যে স্বয়ং যম এলেও তারা ভ্রুক্ষেপ করবে কিনা সন্দেহ!
দুর্গাদেবী ভাবছিলেন, দেবতা হবার হাজারো ঝক্কির কথা। তিন দিন বাঙালিরা পূজো করে, সে ভালোই, কিন্তু সাড়ে তিন দিনের মাথায় দশমীর রাতে আক্ষরিক অর্থেই দেবতাকে তারা ‘ভাতে মারে, পানিতে মারে’ (নিজেদের রাষ্ট্রপিতাকেও ‘সাড়ে তিন বছরের’ মাথায় সপরিবারে হত্যা করেছে, এমনই অকৃতজ্ঞ-বদমাস এই জাত!) থাক্ এসব পুরনো কাসুন্দি। হেমন্তের কনকনে ঠা-া জলে বিসর্জনটা খুব একটা উপাদেয় মনে হয় না দুর্গাদেবীর। দেবতাদের মাটির শরীর, তাই বলে মাটির মানুষ তাঁরা নন যে মুখ বুজে সব সহ্য করবেন। কার্তিক-গণেশ, লক্ষèী-সরস্বতী ইদানিং আর আসতেই চায় না। দুর্গাদেবীর না হয় বয়সের গাছপাথর নেই, কিন্তু ওদেরতো কচি শরীর! এত কষ্ট তারা সইবেই বা কেন। নিছক মায়ের কথা ফেলতে পারে না বলে আর বহুকালের ঐতিহ্য রক্ষার কথা ভেবে নিমরাজি হয়।
জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দুর্গাদেবীর মাথায় অভিনব একটা আইডিয়া এসে গেলো। আচ্ছা, পূজোর দিন কয়েক আগে বঙ্গদেশে গেলে কেমন হয়? বঙ্গদেশীয়দের হাতে আজকাল কাঁচা পয়সা হয়েছে। শরতে পূজার ছুটিতে অনেকেই দেশে-বিদেশে বেড়াতে যায়। আমরা দেবতারাইবা যাবো না কেন, স্বয়ং মা লক্ষèী আমাদের সাথে, আমাদের কি পয়সার অভাব আছে কোনো? ষষ্টীর আগে আগে দিন কয়েক বঙ্গদেশের আনাচে কানাচে বেড়িয়ে নিজের চোখে দেখে নেয়া যেতো, ভক্তরা কে কোথায় কেমন আছে। লক্ষ্মী-সরস্বতী নাচুনে বুড়ি। শোনার সঙ্গে সঙ্গেই প্রস্তাবটা লুফে নিল তারা। কার্তিক সেনাবাহিনীর লোক, স্বর্গে শান্তিরক্ষা বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। দেশভ্রমণে তাঁরও অনীহা নেই। গণেশ মোটাসোটা বুদ্ধিজীবীÑ এক জায়গায় শিকড় গেড়ে বসে পুঁথি লিখতে আর পড়তে পারলে আর কিছুই চান না তিনি। তবুও বাড়ির অন্য সদস্যরা যখন চাইছে তখন একা তাদের সাধে বাধ সাধবেন, এতটা বেরসিক তিনি নন।
বাকি রইলেন বাড়ির কর্তা শিব। শুনেই তিনি মনে মনে ভাবলেন: স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী! মুখে বললেন: ‘প্রাচীন কালে ভুলক্রমেও বঙ্গদেশে গমন করলে আর্যাবর্তে ফিরে এসে গোবর-গোচনা ভক্ষণ করে প্রায়শ্চিত্তের বিধান ছিল। এখন বঙ্গদেশে প্রবেশ করা মাত্রই স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রায়শ্চিত্ত শুরু হয়। বঙ্গদেশের খবর আমি রাখি, কারণ আমি ও দেশের চ্যানেলগুলো নিয়মিত দেখি। কেন দেখি? দেখি, নেশার খরচ বাঁচানোর জন্যে। বাংলা চ্যানেল দেখলে আমার আর গাঁজা-ভাঙ-চরস খেতে হয় না। যাই হোক, আমার মনে হয়, মানুষ বা দেবতার জন্যেতো বটেই, আমাদের বাহন অর্থাৎ পশুপাখীর জন্যেও বঙ্গদেশ নিরাপদ নয়। অবশ্য মানুষরূপী পশুদের কথা আলাদা। আমি আমার বলদকেও ওখানে পাঠাতে রাজি নই, বিশেষ করে পূজোর আশেপাশেই যখন কোরবানির তারিখ পড়েছে!’
কিন্তু মেয়েরা একবার যা সিদ্ধান্ত নেয় পৃথিবী উল্টে গেলেও তা তারা করে ছাড়বেই। দুর্গাদেবী গোসাঘরে ঢুকে খিল দিলেন। ছেলেমেয়েরাও কথা বলা বন্ধ করে দিল। অগত্যা শিব অনুমতি দিতে বাধ্য হলেন বটে, কিন্তু একটা কঠিন শর্তও তিনি জুড়ে দিলেন: বঙ্গদেশে বেড়াতে হলে মানুষের মতো বেড়াতে হবে। যত সমস্যাতেই তোমরা পড় না কেন কোনো দৈবী ক্ষমতা-টমতা দেখানো চলবে না।
মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীদের থাকে লাল পাসপোর্ট। দেবতাদের পাসপোর্টের রঙ সোনালি। পৃথিবীর তাবৎ দেশে তাদের এন্ট্রি ভিসা। চোরাকারবারী আর সন্ত্রাসীদের মতো দেবতাদের বাহন অর্থাৎ পশুপাখিদের পাসপোর্ট-ভিসার কোনো বালাই নেই। সুতরাং হাঁস-পেঁচা-ইঁদুর-ময়ূর বিনা পাসপোর্টেই বাংলাদেশে ঢুকে গেল। সিংহমামা সীমান্ত অতিক্রম করতে গেলে আর্যাবর্তের বন বা পশুসম্পদ মন্ত্রণালয় আপত্তি জানাতে পারে। সুতরাং পশুরাজ ঠিক করলেন, কাঁধের কেশর শেভ করে বাঘের মেকআপ নিয়ে সুন্দরবন হয়ে তিনি বঙ্গদেশে ঢুকবেন।
কোথায় যাবেন, কদিন থাকবেন ইত্যাকার সব প্রশ্ন করার পর গণেশের হাতির মাথার দিকে অবাক হয়ে তাকালেন ইমিগ্রেশন কর্মকতা। সানগ্লাসের ফাঁক দিয়ে ব্যাপারটা লক্ষ্য করে কার্তিক বললেন: ‘আমরা বঙ্গদেশে গিয়ে বহুরূপীর খেলা দেখাবো বিভিন্ন পূজাম-পে। দেবতার রূপ ধরে জনগণের সঙ্গে মিশে তাদের আনন্দ দেবো।’ ইমিগ্রেশন অফিসার কী বুঝলো কে জানে, আর কথা না বাড়িয়ে পাসপোর্টে সিল-ছাপ্পর মেরে ছেড়ে দিল। মূল সমস্যাটা হলো কাস্টম্সে গিয়ে। সরস্বতী আর গণেশের বইপত্র, বীণা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠলো না। কিন্তু স্ক্যানে ধরা পড়লো, দুর্গাদেবীর লাগেজে রয়েছে খরগ-চক্র-গদা-ত্রিশুল ইত্যাদি মারাত্মক সব অস্ত্র; কার্তিকের লাগেজেও পাওয়া গেল তীর-ধনু-তরবারি। লক্ষ্মীর লাগেজে মণিমুক্তা-অলঙ্কার-সোনার বিস্কিট-ডলার-ইওরো-পাউন্ড-ইয়েন। লাগেজে এ ধরনের মালামাল দেখে কাস্টমস কর্মকর্তার চক্ষু ছানাবড়া। যতই সোনালি পাসপোর্টধারী হোন দুর্গাদেবী আর তাঁর সঙ্গীরা, অফিসার কোন অবস্থাতেই এ ধরণের মারাত্মক মালামাল নিয়ে তাঁদের বঙ্গদেশে ঢুকতে দেবেন না। কার্তিক যতই বলেন, এসব তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিষ, বহু যুগ ধরে, এমনকি বঙ্গদেশের জন্মেরও হাজার, দু হাজার বছর আগে থেকে তাঁরা এগুলো ব্যবহার করছেন, ভবী কোনো মতেই ভোলে না। দুর্গাদেবী ব্যাপার-স্যাপার দেখে ভেতরে ভেতরে এমন রেগে যাচ্ছিলেন, কার্তিক খানিকটা ভয়ই পেতে শুরু করলেন যে মায়ের তৃতীয় নয়ন উন্মিলিত হয়ে মহাবিশ্ব না ধ্বংস হবার উপক্রম হয়!
এক ফাঁকে এক দালাল এসে কার্তিককে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বললো, ‘কিছু খরচপাতি করতে হবে দাদা। শুধু কথায় চিড়ে ভিজতে পারে, কাস্টমস অফিসারের মন ভিজবে না। ম্যাডামকে একটু বুঝিয়ে বলুন।’ ‘বলে কী বেটা! তারকাসুরের মতো ভয়ঙ্কর দৈত্যকে সাইজ করেছি আমি এই কার্তিক, আর এই কায়েতের বেটা কিনা আমার কাছে ঘুষ চায়!’ মায়ের কাছে এ কথা বললেই বাবার দেয়া শর্ত ভুলে রাগের মাথায় ঘ্যাচাং করে অফিসুরের মাথাটাই মা নামিয়ে দেবে নতুন গজিয়ে ওঠা কোনো অসুর ভেবে। কি করা? অনেক ভেবেচিন্তে গণেশের কাছেই ব্যাপারটা খুলে বললো কার্তিক। মনস্বী গণেশের মাথাটা হাতির বটে, কিন্তু (শিবরামের ভাষায়) ‘লেজস্বী’ নন বলে বুদ্ধিটা মোটেই হাতির মতো নয়। তিনি বল্লেন: ‘যস্মিন দেশে যদাচার। পুরাণে লেখা আছে, বঙ্গদেশে ঘুসি বা ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না। ঘুসি দিয়ে কাজ নেই, লক্ষèীর পার্স থেকে কিছু ডলার ওর হাতে গুঁজে দাও।’
কাস্টমস পার হয়ে বাইরে আসতেই দেবদেবীরা দেখলেন, ভয়ঙ্করদর্শন সব চেলাচামু-া নিয়ে তাঁদের রিসিভ করতে এসেছে মহিষাসুর। সেই গোঁফ, সেই জুলফি, সিল্কের পাঞ্জাবির আধখোলা সোনার বোতামের ভিতর দিয়ে উপচে পড়ছে চেতানো বুকের লোম। সোনা-রূপা-প্ল্যাটিনাম দিয়ে বাঁধানো দাঁত বের করে আকর্ণ-বিস্তৃত হাসি হেসে মহিষাসুর বললো, ‘জানি অবাক হচ্ছেন। কিন্তু আপনাদের সাথে যুগযুগান্তরের সম্পর্ক আমার। সত্যযুগে আমার গলাটা কাটতে গিয়েও আপনি কাটেন নি। অধমের বুকে বল্লম দিয়ে সামান্য একটু খোঁচা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এ জন্যে আপনার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেই আমার আসা। আপনারা হয়তো জানেন না যে বহুদিন যাবৎ আমি এ দেশেই থাকি। আমরা অসুর, বদমায়েসীই আমাদের জন্মান্তরের ধর্ম, তবুও লোকচক্ষুকে ফাঁকি দিতে আমি ও আমার স্যাঙাৎরা দলে দলে সংখ্যাগুরুর ধর্ম গ্রহণ করেছি। আমার বর্তমান নাম মহিসুর খান। মহিষ আর অসুর মিলে ‘মহিষাসুর’ এবং সেটা থেকে অপভ্রংশ হয়ে ‘মহিসুর’। বঙ্গদেশকে আপনারা এক রকম মহিষ আর অসুরের দেশই বলতে পারেন। কিছু লোক এখানে মহিষের মতো গোঁয়ার, আর কিছু আছে অসুরের মতো ভয়ঙ্কর, এবং এদের ‘অদ্ভুত বুটের তলে চলেছে স্বদেশ’! আসলে আমার অসুর সৈন্যেরাই আপনার হাতে নিহত হয়ে লীগ-দল-পার্টির ক্যাডার হিসেব পুনর্জন্ম নিয়েছে কিনা। এই দেখুন, নিজের ঢোল নিজেই পেটাচ্ছি, ম্যাডাম হয়তো বিরক্ত হচ্ছেন। আর কথা বাড়াবো না। রাজধানীর বাসস্ট্যান্ডে একটা গাড়ি স্ট্যান্ডিং থাকবে আপনাদের সার্বক্ষণিক ব্যবহারের জন্যে। আমার ভিজিটিং কার্ডটা রাখুন, কার্তিকবাবুকে একটা স্মার্ট ফোনসেটও দিয়ে গেলাম। কোনো সমস্যা হলে একবার শুধু একটা মিসকল দেবেন। বান্দা সঙ্গে সঙ্গে হাজির হয়ে মুসকিল আসান করবে।’
দেবতাদের ‘ষাঁড়দীয়’ (কারণ পূজোর আগেপরে বকরিদ) শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিলেন মহিসুর খান। দুর্গাদেবী ছেলেমেয়েদের নিয়ে রাজধানীগামী বাসে উঠে বসলেন। পথে মলম পার্টি, ছিনতাই পার্টি, গুমখুন পার্টি কেউই এঁদের বিরক্ত করতে সাহস করলো না, কারণ ইতিমধ্যে মোবাইল ফোন মারফৎ খবর চলে এসেছে যে তাদের বসের বস, তস্য বস মহিসুর খানের খাস অতিথি এই পাঁচ জন।
বাসে উঠে গণেশ একটা লম্বা ঘুম দিতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু বকর বকর করে কিছুতেই তাঁকে ঘুমাতে দিল না পাশের সিটে বসা সংখ্যালঘু কল্যাণ সমিতির এক নেতা। হিন্দু আইনে পিতার বা স্বামীর সম্পত্তি থেকে মেয়েদের বঞ্চিত করার যে বিধান আছে তা যে কতটা যুক্তিযুক্ত তা তিনি গণেশকে বুঝিয়েই ছাড়বেন। গণেশ তাঁকে যতই বলেন, সম্পত্তি প্রদানের ক্ষেত্রে মহাভারতের অনুশাসনপর্বে কন্যাকে পুত্রবৎ বিবেচনা করতে বলা হয়েছে, সনাতন ধর্মে কোনো আইনই চিরস্থায়ী নয়, সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আইনেরও পরিবর্তন হওয়া উচিত… নেতাজি বিচার মানলেও তালগাছ ছাড়তে রাজি নন। গণেশ নিজেকে মহাভারতের লেখক পরিচয় দিলে হয়তো কিছুটা কাজ হতো।
কার্তিক আলাপী লোক। পাশের সিটে বসা এক অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলের সাথে গল্প জুড়ে দিলেন তিনি। গল্প থেকে তর্ক। সেনাপরিচালিত বা সেনাসমর্থিত সরকার যে গণতান্ত্রিক সরকারের চেয়ে হাজার গুন ভালো সে কথা কার্তিককে বুঝিয়ে ছাড়লেন জেনারেল। ‘প্রায় এক যুগ সেনাবাহিনী ক্ষমতায় থাকা সত্তেও বঙ্গদেশ কেন সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়ায় পরিণত হলো না?’ এই প্রশ্ন কার্তিক করতে পারতেন, কিন্তু করলেন না, কারণ তিনি ততক্ষণে বুঝে গেছেন, কোনো এবহবৎধষ-কে ঝঢ়বপরভরপ প্রশ্ন করে লাভ নেই।
সরস্বতীর পাশে সিট পড়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপিকার। তিনি দক্ষিণাপথে এক সেমিনারে অংশ নিয়ে ফিরছেন। তাঁর সঙ্গে আলাপ করে বীণাপাণি জানলেন, বঙ্গদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন লেখাপড়ার চাইতে রাজনীতি আর দলবাজিই বেশি হয়। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের সংখ্যা এত বেশি যে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেছে আফ্রিকার সেনাবাহিনীর মতো, জওয়ানের চেয়ে জেনারেল বেশি। এঁদের মধ্যে অনেকে আবার মধ্যরাতের টকসওয়ারÑ এঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেয়ে বিভিন্ন টিভি-চ্যানালে (‘চ’ উচ্চারণে মহাপ্রাণতা কাম্য) দেশি-বিদেশি প্রভুদের মোষ তাড়িয়ে বেড়ান।
লক্ষ্মীর পাশে বসেছিলেন যে লোকটি তিনি এক জন ব্যবসায়ী। শিশু ও বয়স্কখাদ্যে ভেজাল দেবার জন্যে ভারত ও চীন থেকে বিভিন্ন ক্যামিকেল আমদানি করেন তিনি যার মধ্যে রয়েছে ফর্মালিন। আজকাল এই ফর্মালিনের ব্যাপক চাহিদা, সুতরাং রমা অর্থাৎ লক্ষèীর কল্যাণে ব্যবসা তার রমরমা। ‘বুঝলে মা, বঙ্গদেশে আমরা ব্যবসায়ীরা যা খুশি করতে পারি। সংসদে আমরা, মন্ত্রিপরিষদে আমরা, উপদেষ্টাও আমরাই। রাজনীতিবিদ, আমলা, সাংবাদিক, শিক্ষক, Show-শীল সমাজ… মা লক্ষèীর আশীর্বাদে সব আমাদের কেনা গোলাম।’

এদিকে পাশে বসা এক মহিলার জেরায় জেরবার হচ্ছিলেন দুর্গাদেবী। মহিলা একের পর এক পান গুঁজে মুখগহ্বর ওভারলোড করছিলেন আর যখন তখন জানালা ঈষৎ ফাঁক করে পিচিক পিচিক করে পিচকি ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন শূন্যে। লক্ষèীর স্বামী বিষ্ণুবাবু কেন সাথে আসেননি? কার্তিক-গণেশ কেন বিয়ে করতে চায় না? পরের মেয়ে লক্ষèী-সরস্বতী দুর্গাদেবীর সাথে ঘোরে কেন? এত বয়স হয়ে গেছে, তবুও সরস্বতীর বিয়ে হয়নি কেন?… অবিরাম প্রশ্নবাণে দেবী দিশেহারা। মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করার সময় দেবী নিজেও সম্ভবত এত বাণ নিঃক্ষেপ করেননি!
তূণে প্রশ্নবাণ শেষ হবার পর শুরু হলো উপদেশবাণ। বাঙালির ছেলে-মেয়ে ঝিঙ্গা-পটল-চিচিঙ্গার মতো, পেকে গেলে কেউ কিনবে না। দুর্গাদেবী যদি বলেন তো সরস্বতীর জন্যে সুপাত্র তার হাতে আছে। তাদের মধ্যে প্রথম জন এক শিক্ষাগুরু। লেখাপড়ার ধার তেমন ধারেন না, তবে একাধিক বার সিন্ডিকেট ইলেকশন জিতেছে। দ্বিতীয় পাত্র মহাকায়স্থ। সর্বশেষ পে-স্কেলের সর্বোচ্চ স্থানে এদের অবস্থান, আর উপরিতো আছেই। এদের ক্ষমতার কাছে কোথায় লাগে ইন্দ্রের বজ্র বা বরুণের পাশ! তৃতীয় পাত্র ভর্তিবিশেষজ্ঞ। বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে সে লালে লাল হয়ে গেল! চতুর্থ পাত্র নগরপিতার সহকারী। ফুটপাতের যত বেআইনী হকার আছে সবাই তাকে ঘুস দেয়। সেই লুণ্ঠিত ঘুসের টাকা তারই হাতে বিলিবণ্টিত হয়ে চলে যায় একেবারে উপর মহল পর্যন্ত। পঞ্চম পাত্র এক জজ মিয়া। তার এত ক্ষমতা যে (মহিলা আশেপাশে দেখে নিয়ে ফিসফিসিতে বলে) তার বিরুদ্ধে যে কোনো সমালোচনাই আদালত অবমাননা বলে গণ্য হয়। সুতরাং সে যা খুশি করতে পারে, অর্থের বিনিময়ে অথবা অনর্থক। আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলে, কারণ চালানোর কেউ নাই (ফিসফিস শেষ)।
উফ্! বাজখাই গলায় রাজ্যের অপাত্র-কুপাত্র-দুষ্পাত্রের বর্ণনা শুনতে শুনতে দেবীর কান ঝালাপালা। এত বকতেও পারে এই মহিলা, যেন একেবারে বক্তিয়ার খিলজি! মহিলা যখন দেবীকে প্রশ্ন আর উপদেশবাণে জর্জরিত করছিল তখন তার মুখগহ্বরে জমা পিচকির ছিটা ক্ষণে ক্ষণে দেবীর মুখে-নাকে এসে পড়ছিল। রক্তবীজ অসুর পর্জন্যাস্ত্র বা বৃষ্টিবাণ মেরেও দেবীকে এমন নাকাল করতে পারেনি। কোনো এক ফাঁকে দেবীর পার্সের ভিতরে শিবের পাসপোর্ট সাইজ ছবি দেখে পানাসক্তা মহিলা জিগ্যেস করলেন ছবিটি তাঁর বাবার বা ঠাকুরদার কিনা। মহাদেবী জিব কেটে জানালেন যে ছবিটি তাঁর স্বামীর। ‘বলেন কী, এমন বুড়ো হাবড়া বিচ্ছিরি লোকের সাথে বিয়ে দিল আপনার বাবা! আপনি সতীর মতো আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন না কেন? আপনাদের কৈলাসপুরে বুঝি মেয়েদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো দাম নেই? আমাদের বঙ্গদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া মেয়েরাতো বিয়ের কয়েক দশক আগেই ছেলে পছন্দ করে রেখে দেয়। আর একটা কথা দিদি, বুড়ো স্বামীরা শুনেছি বৌয়ের খুব ন্যাওটা হয়, কিন্তু ভোলানাথবাবু আপনার মতো সুন্দরি বৌকে একা ছেড়ে দিল?’
ঢাকায় বাস থেকে নামতেই মহিসুর খানের পাঠানো গাড়ির ড্রাইভার এগিয়ে এসে মাটির দিকে ঝুঁকে বাম হাত কানের উপর রেখে ডান হাত হাতির শুঁড়ের মতো দুলিয়ে ইয়া লম্বা এক মোগলাই সালাম দিল। সালামের জবাব দেবে কি, ড্রাইভারের ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে লক্ষèী-সরস্বতীর মুর্ছা যাবার উপক্রম। ইয়া বড় গোঁফ, কানের লতি থেকে থুথনি পর্যন্ত লম্বা কাটা দাগ। দুর্গাদেবী চিনতে পারলেন রক্তবীজ অসুরকে। কাটা দাগটার জন্যে যে তিনি নিজেই দায়ি সে কথাও মনে পড়লো। শিব পায়ের কাছে শুয়ে না পড়লে একে তিনি সত্যযুগেই ঝাড়েবংশে শেষ করে দিতেন। সেদিন তাঁকে বাধা দিয়ে অবশিষ্ট অসুরদের হেফাজত করেছিল শিব এবং সেদিনের বেঁচে যাওয়া হেফাজতী অসুরদের বংশধরেরাই আজ সারা পৃথিবীতে অনর্থ করে বেড়াচ্ছে: এখানে ওখানে খ-যুদ্ধ লাগাচ্ছে, রাজধানী জবরদখল করে ক্ষমতার পালাবদলের দুঃসাহস করছে, সুকুমার ভাস্কর্যে হাতুড়ির বাড়ি মারছে। কখনও মেয়েদের তারা তেঁতুল ভেবে চুষতে চাইছে, কখনওবা এ্যাসিড দিয়ে ঝলসে নিচ্ছে। অসুরমতি কিশোরদের ইভটিজিঙের শিকার হয়ে হুরমতি কিশোরীরা আত্মহত্যা করছে। হরতালের সময় কিছু অসুর বাসে নিরীহ যাত্রীদের উপর পেট্রোলবোমা মারছে, ট্রেন ডাকাতি করছে, খাবারে ভেজাল মেশাচ্ছে, সৎ মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকা অসম্ভব করে তুলছে। রাঢ়বঙ্গের দৈত্যরাণী মোহমত্তা বানরজায়া নাকি কিছু দিন আগে স্থানীয় অসুরদের খুশ রাখতে বৃহৎ বঙ্গের যাবতীয় আসুরিক কর্মকা-ে প্ররোচনা ও প্রণোদনা দিতে চা-মুড়ি খেয়ে উঠে পড়ে লেগেছিলেন।
মহিসুর খান পাঁচতারা হোটেলে সবার জন্যে রুম বুক করে রেখেছিল। সেখানে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে দেবতারা ঠিক করলেন, শহরে পূজোর প্রস্তুতি কোথায় কেমন হচ্ছে দেখতে বেরুবেন তাঁরা। বেরুলেন বটে, কিন্তু যেতে পারলেন না কোথাও। শহরের রাস্তায় গাড়ি বেশিরভাগ সময় থেমে থাকে, মাঝে মাঝে ধুঁকে ধুঁকে চলে। যেখানে গেলেন, সেখানেই জ্যাম, জ্যাম এবং জ্যাম, শুরুতে জ্যাম, মাঝে জ্যাম এবং অবশেষেও জ্যাম (বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ট্র্যাফিক জ্যাম ছাড়াও ছিল শিক্ষক-ছাত্রদের জ্ঞান-জ্যাম বা গ্যাঞ্জাম)। প্রত্যেক গাড়িতে মানুষজন মূর্তির মতো বসে আছে নিরুপায় হয়ে। লক্ষèী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশ ত্যক্তবিরক্ত। পূজোর সময় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, আর জ্যামের মধ্যে ঠায় বসে থাকতে হচ্ছে। পূজোম-পে ধূপের ধোঁয়া, এখানে মবিলপোড়া ধোঁয়া। অপরিকল্পিত নগরে মূর্খ চালবাজ নেতারা ভোটারদের অসহায় মূর্তি বানিয়ে মজা দেখছে। জ্যাম থেকে মনুষ্যরূপী দেবতাদের পর্যন্ত রেহাই নেই। প্রধান-উপ-প্রতি-পাতি… কোনো মন্ত্রী বা তাঁদের So cheap মহোদয়, (বদ)Mass media… জ্যাম নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। মহানন্দে Jam রুটিতে মেখে তারা নিজেরা খাচ্ছেন, অন্যদেরও খাওয়াচ্ছেন। সব হজম হয়ে ড্রেনের ক্ষুদ্রান্ত্র ও বুড়িগঙ্গার বৃহদন্ত্র দিয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যাচ্ছে এবং অনতিবিলম্বে ইলিশ বা চিংড়ির শরীরের অংশ হয়ে ফিরে এসে বাঙাল-ঘটির রসনাকে চমৎকৃত করছে।
কয়েক দিনেই দেবতাদের বেড়ানোর শখ মাথায় উঠল। একদিন সিংহমামার কাছ থেকে একটা ম্যাসেজ পেয়ে গণেশের হাতির মাথা থেকে বের হলো দারুণ একটা বুদ্ধি। আচ্ছা, মফস্বলে চলে গেলে কেমন হয়? সেখানে এখনও হয়তো আছে অবারিত মাঠে কাশের গুচ্ছ, হাওড়-ঝিলের জলে বাতাসে দুলতে থাকা রাশি রাশি সাদা-লাল শাপলাফুলের নয়নাভিরাম দৃশ্য। মহিসুর খান শুনে সায় দিলেন না দেবতাদের প্রস্তাবে। গ্রাম আর আগের মতো ‘ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড়’ নেই। সেখানেও নিরিবিলিতে বদমাসেরা কিলিবিলি করছে। প্রধান সমস্যা হচ্ছে, গ্রামীণ বদমাসেরা মহিসুর খানের নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত নয়। তারা তার প্রতিদ্বন্দ্বী নববলাসুর ইউনুস খানের কথামতো চলে। ইউনুস খানের অনেক ক্ষমতা, প্রতিটি গ্রামীণ ব্যাঙ্কে (অর্থাৎ গ্রামের ‘নদীতীরে’) তারা চেলাচামু-ারা বসে আছে। মিডিয়ার একাংশ তার পক্ষে, বিশেষ করে ‘প্রথম হুলো’ নামক বিজাতীয় দৈনিকটি তাকে লাই (খরব) দিয়ে একেবারে মাথায় তুলেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হেলারি ক্লিনটন তার দিকে হেলে আছে বলে নগরে-গ্রামে বহু অর্থসংক্রান্ত অশান্তির কারক হওয়া সত্ত্বেও ইউনুস খানকে বছর কয়েক আগে শান্তিতে ‘নববল’ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।
অ-সুরের উপদেশে কান না দিয়ে সুর অর্থাৎ দেবতারা damn sure হয়ে, ‘যা থাকে কুলকপালে’ বলে একদিন খুব ভোরে গুলিস্তানে উপস্থিত হলেন। বি.আর.টি.সি.-র বাসে চড়ে দেবী দুর্গা রওয়ানা হলেন দূর গাঁয়ে। কিন্তু আন্তজেলা রাস্তাতেও এমন জ্যাম যে সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে বিকাল পেরিয়ে তাদের সন্ধ্যা হয়ে গেল। গ্রামে কোনো জ্যাম নেই, তবে মহিষাসুরের কথামতো গ্যাঞ্জাম যে প্রচূর আছে সেটা তারা টের পেলেন সেদিন রাতেই। সেটা অবশ্য আরও পরের কথা, আপাতত রাতটা কোথায় কাটানো যায়? মুস্কিল আসান করলো পেঁচা-ইঁদুর-হাঁস-ময়ূর-সিংহ। আগেই বলেছি, তারা বঙ্গদেশ ঢুকে পড়েছিল, কিন্তু পাঁচতারা হোটেলে ঢুকতে সাহস করেনি বা ট্রাফিক জ্যামে ঢুকে আতঙ্কও সৃষ্টি করতে চায়নি তারা। বাহনেরা আগেভাগে গ্রামে চলে এসে একটা দুর্গাম-পে আশ্রয় নিয়েছিল। সেখান থেকেই মূর্তিশিল্পির ফোন থেকে সিংহমামা গণেশকে এস.এম.এস. করেছিল।
দেবতারা যার যার বাহনে করে দুর্গাম-পে চলে এলেন। মূর্তি তৈরির কাজ শেষ, রঙ শুরু হয়েছে। কারিগরেরা তাদের কাজকর্ম সেরে পাশের এক বাড়িতে শুতে চলে গেছে। দেবতারাও ক্লান্ত ছিলেন। দেরি না করে প্রত্যেকে নিজের মূর্তিতে অধিষ্ঠিত হলেন। সিন্ধান্ত হলো, রাতটা এই বারোয়ারি দুর্গাম-পে কাটিয়ে পরদিন একটা বাসস্থান খুুঁজে বের করা যাবে। কিন্তু God proposes, man disposes। রাতের বেলা একদল দুষ্কৃতি রড-হকিস্টিক-লাঠিসোটা নিয়ে দরজা ভেঙে হুড়মুড় করে ম-পে ঢুকে পড়লো এবং মূর্তিগুলোর উপর এলোপাথারি বাড়ি মেড়ে কারও মাথা ভেঙে দিল, কারও বা হাত-পা দিল গুড়িয়ে। ভাঙা হাতের ব্যাথায় জ্ঞান হারালেন লবঙ্গ-লতিকা দেবী সরস্বতী। লক্ষèীর মাথাটা শরীর থেকে ছুটে যাওয়াতে তিনি জ্ঞান হারানোর শক্তিটুকুও হারিয়েছিলেন। গণেশের আগে একটা দাঁত ভাঙা ছিল, এবার ভাঙলো অন্যটাও। ভাগ্য ভালো, লেজে কারও পায়ের চাপ পড়াতে যন্ত্রণায় সিংহ গর্জন করে উঠেছিল এবং তাতেই ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল বদমাসের দল। এটা ঠিক যে দেবতারা দৈবী শক্তি প্রয়োগ করে দুস্কৃতকারীদের বাধা দিতে পারতেন, কিন্তু তাতে শিবের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হতো। সুতরাং দেবতারা সংখ্যালঘুদের মতো ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থেকে চ্যাংরাদের বেধরক পিটুনি সহ্য করলেন। চুন থেকে পান খসলেই মানুষ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে পারে, দেবতারা হয়তো পারেন না।
এই দুঃসময়ে কার্তিকের ভূমিকাটা কী ছিল? না, পনেরোই আগস্টের মতো তিনি বিপদগ্রস্থ মা-বোনদের কোনোমতে দেয়াল টপকে ম-পের বাইরে আসতে অনুরোধ করেননি। মহিসুর খানের সেই স্মার্ট ফোনটি হাতে নিয়ে উপযুক্ত সেনাপ্রধানের মতেই তিনি তাকে ফোর্স মুভ করাতে নির্দেশ দিলেন। খবর পাওয়া মাত্রই মহিসুর ছুটে এলেন এবং নতুন কোনো ঝুঁকি না নিয়ে নিজস্ব পুষ্পকরথ বা হেলিকপ্টারে দেবতাদের তুলে নিয়ে সোজা রওয়ানা হলেন কৈলাসপুরে।
ফ্লাইটে আকাশবুয়ারা সেবার ত্রুটি করেনি, কিন্তু মারের চোটে সব ‘দেবোতা’-র অনুভূতি একেবারে ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল: দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হওয়ায় লক্ষèী কিছুই ‘লক্ষ্য’ করতে পারছিলেন না; সরস্বতী পারছিলেন না ইঞ্চি পরিমাণ ‘সরতে’; গণপতি ঘন ঘন ভুলে যাচ্ছিলেন, তিনি আসলে কার ‘পতি’। ল্যান্ড করার সাথে সাথেই লক্ষèী, সরস্বতী আর গণেশকে এ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালের স্পেশাল কেয়ার ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হলো। সিংহ-ইঁদুর-ময়ুরকে অবশ্য পশু হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েই ছেড়ে দেয়া হয়েছিল।
শিবালয় হাউজিং এর নিরাপদ ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেবী জানতে পারলেন আসল ঘটনা। তাঁকে কোনো মতেই বঙ্গভ্রমণে নিরস্ত করতে না পেরে সুপারসনিক বলদ নন্দীর পৃষ্ঠে আরোহণ করে শিব অনতিবিলম্বে ছুটে যান চট্টগ্রামে, তাঁর কলিযুগীয় হেডঅফিস সীতাকু-ের চন্দ্রনাথ-বিরুপাক্ষধামে। অফিসে ঢুকেই আপন জটা থেকে এক গাছি চুল উৎপাটন করে বিরুপাক্ষ শিখর থেকে নিচে ঝুলিয়ে দেন শিব। ঝুলন্ত কুন্তলগুচ্ছ চন্দ্রনাথ পর্বতের পূর্বপার্শ্বে অবস্থিত হাটহাজারি এলাকায় পতিত হয়ে তেঁতুল গাছের নিচে কুলুপরত এক ধর্মগুরুর দাড়ির সাথে কানেক্টেড হয়। সঙ্গে সঙ্গে ব্রডব্যান্ডে শিবের মনের খবর পেয়ে যান সেই তেঁতুল বাবা। তাড়াতাড়ি রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে বিদেশ থেকে আনা নায়াগ্রা বটিকা সেবনপূর্বক শরীরের মধ্যপ্রদেশে অবস্থিত রাউটারের এ্যান্টেনা কমবেশি দাঁড় করিয়ে তিনি কোনোমতে ওয়াইফাই চালু করেন এবং ফেসবুকের মাধ্যমে মহিসুর খানের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন।
তেঁতুলবাবা বা মহিসুর খান অবশ্য দেবতাদের মুফতে হেফাজত করেননি। তাদের অনুরোধে শৈবশক্তি প্রয়োগ করে দৈলহসন সায়দীয় নামে এক বকাসুরের (‘বকাসুর’ কারণ তিনি গত তিন দশক যাবৎ সত্য-মিথ্যা বকে চলেছেন!) মৃত্যুদ-াদেশ রহিত করাতে হয়েছে শিবকে। এটা অবশ্য শিবের জন্য নতুন কিছু নয়। সত্যযুগে তিনি দুর্গতিনাশিনীর কবল থেকে এক (মতান্তরে বহু) অসুরকে হেফাজত করেছিলেন, কলিযুগে না হয় সুখহাসিনির কবল থেকে অন্য এক অসুরকে হেফাজত করলেন। এখানেই শেষ নয়, গৌলমজম্ম, মৌতনিজম্মি, শ্যালকদ্রচৌধর ইত্যাদি আরও যেসব বাঘা বাঘা অসুরেরা কশ্মিপুর কারাগারে বন্দী আছেন বা ভবিষ্যতে থাকবেন, শিবের মাধ্যমে সুখহাসিনির কাছ থেকে তাদের সবাইকে ‘রক্ষা’ (ইহলোকে নাকি পরলোকে সে ফয়সালা হয়তো হয়নি!) করার আগাম প্রতিশ্রুতি নিয়ে রেখেছিল মহিসুর খান। তবে দেবতা হোক বা সাধারণ জনগণ হোক, কারও কাছে প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করাটাই যে বঙ্গদেশের রাজনীতিবিদদের স্বভাবধর্ম সেটাও শিবের অজানা নয়।
বেডরুমে দুর্গাদেবীকে একা পেয়ে শিব রগড় করে বললেন: ‘দুর্গতিনাশিনীর ভ্রমণদুর্গতি দেখে সরস্বতীর হাঁস পর্যন্ত হাসতে হাসতে হাঁসফাঁস করছে। এখনওতো পূজোর সপ্তাহখানেক বাকি আছে। ফিরে যাবে নাকি বঙ্গদেশে প্রতি বছরের মতো?’ দুর্গাদেবী উত্তর দিলেন: ‘এ জীবনে আর দ্বিতীয়বার না। বাব্বা, জব্বর বাঁচা বেঁচে এসেছি। বেজন্মাদের হকিস্টিকের বাড়িতে কোমড়ে যে ব্যথা পেয়েছি… ও মাগো, গেলুম গো! দেখছো না, বাঁ পা-টা কেমন টেনে টেনে হাঁটছি বঙ্গদেশের আফসোসহীন নেত্রী খৈলদাজায়ার মতো। ফিজিওথেরাপি না নিলে বুড়ো বয়সে খুব ভোগাবে! আচ্ছা, তুমিই বা কেমন স্বামী বলোতো! ঠিকই বলেছিল বাসের সেই বক্তিয়ার মহিলা, সত্যিকারের ভালোবাসলে আমার মতো সুন্দরী বৌকে কেউ এমন ভয়ানক বিপদের মুখে একা ঠেলে দেয়?’
শিব বললেন: ‘বহু যুগ ধরে বাঙালিরা কোনো উৎসবে তাদের মেয়েকে শুধু কাছে পেতে চায়, জামাইকে নয়। জামাইকে যদি আসতেই হয়, তবে তাকে হয় প্রচ্ছন্ন থাকতে হবে (দুর্গাপূজা), অথবা থাকতে হবে মেয়ের পায়ের নিচে (কালীপূজা)। সে যাকগে, তুমি অন্তত এটাতো স্বীকার করবে যে অসুরদের হেফাজত করার যে সিদ্ধান্ত আমি নিয়েছিলাম সত্যযুগে, এই কলিযুগে এসে সেটা সঠিক প্রমাণিত হয়েছে! আমার যুগান্তরের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সুখহাসিনী সরকার রমনার পাদদেশে (কাগুজে) শাহবাঘের হুহুঙ্কার উপেক্ষা করে কিছু মহাসুরকে বাঁচিয়ে রাখার মহাসিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে!’
স্বামীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে গিয়ে দশ হাতে দুই কান ছুঁয়ে আরও একবার জিব কাটলেন দুর্গাদেবী। মৃদু হেসে কালিকারূপিনী মহাশক্তির দিকে দু হাত বাড়িয়ে দিলেন ভোলানাথ। অনতিবিলম্বে কণ্ঠলগ্না শক্তির লোলজিহ্বা শ্রীদন্তের অর্গলমুক্ত হয়ে রুদ্রের মুখগহ্বরে বন্দী হলো।

——————————————————
পুনশ্চ: সুখহাসিনী সরকার জরুরি ভিত্তিতে উপরোক্ত পূজাম-পে মূর্তি পুনর্নিমাণের ব্যবস্থা করেছিলেন, র‌্যাব-পুলিশ-আনসার-Question সব নিয়ে এসে নিরাপত্তার ঘন চাদরে ঢেকে দেয়া হয়েছিল ছোট গ্রামটিকে। সুতরাং পূজা নির্ঝঞ্ঝাটে সম্পন্ন হয়েছে। মূর্তিভাঙচুরজনিত অপরাধের প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিল লক্ষèীর বাহন পেঁচা আর গণেশের বাহন ইঁদুর, কারণ এই দুই প্রাণী রাতের অন্ধকারে পরিষ্কার দেখতে পায়। এদের জবানবন্দীর ভিত্তিতে বঙ্গদেশের রাজপুরুষেরা প্রায় সব দুষ্কৃতকারীকেই গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হয়েছিল।
শাসনবিভাগ চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি, কিন্তু বিচার বিভাগ চলে তার নিজস্ব গতিতে। মূর্তি মানুষ নয়, সুতরাং মূর্তির উপর আঘাত ফৌজদারী ও দেওয়ানী এই উভয় আদালতের এক্তিয়ার বহির্ভূত। তবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট ও অন্যের ধর্মাচরণে বাধা দেবার অপরাধে দেবীর সেই বেজন্মাদের বিরুদ্ধে কোর্ট সরকারবাদী মামলা গ্রহণ করেছে, যদিও অনেক টালবাহানার পর। কিন্তু কোর্টে তোলার সঙ্গে সঙ্গেই জামিন পেয়ে গেছে অপরাধীরা, কারণ বিজ্ঞ আদালত কখনই পেঁচা আর ইঁদুরের মতো তির্যগযোনীর সাক্ষ্য আমলে নিতে পারেন না। জামিনে মুক্ত হয়ে জেলহাজতের বাইরে বেরিয়ে আসার পর সমর্থকেরা মুহুর্মুহু স্লোগান ও ফুলের মালা দিয়ে দুষ্কৃতকারীদের বরণ করেছে।
অপরাধীরা এখন বুক ফুলিয়ে সহাস্যবদনে গ্রামের রাস্তায় ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। এক কান কাটা শহরের বাইরে দিয়ে যায়, দু কান কাটা নাকি যায় ভিতর দিয়ে। দুর্মুখেরা বলে, ওরা নাকি সরকারী দলের সদস্য। ওদের গ্রেপ্তার হওয়া, জামিন পাওয়া… সব নাকি নাটক। সরকার নাটক করতে পারে, কিন্তু জনগণের নাটক দেখার সময় নেই। তাদের শিয়রে সংক্রান্তি! বি.বি.সি.র খবরে নাকি বলেছে, নিরাপত্তার অভাবজনিত কারণে দেবতারা আর বঙ্গদেশে আসবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। লক্ষèী, সরস্বতী আর গণেশের আসারতো প্রশ্নই আসে না, কারণ চিরতরে চলৎশক্তি হারিয়েছেন তারা, বাকি জীবন তাদের হুইলচেয়ারে চলতে হবে। এমন হওয়া অসম্ভব নয় যে লক্ষèীর অভাবে বঙ্গদেশে ব্যবসাবাণিজ্য লাটে উঠবে, সরস্বতীর অভাবে জ্ঞান ও কলাচর্চা বন্ধ হয়ে যাবে, সিদ্ধিদাতা গণেশের অনুপস্থিতিতে সরকারী বা বেসরকারী কোনো উদ্যোগেই সাফল্য আসবে না। এখন একটাই আশা, স্বর্গ থেকে রিমোট কন্ট্রোল ব্যবহার করে দেবতারা যদি কিছু করতে পারেন, অথবা বারাক ওবামাকে অনুরোধ করে আমেরিকার কোনো হাসপাতালে যদি এই তিন দেবতার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায় জনপ্রিয় লেখক Whom you know Ah! Mad! এর মতো! কিন্তু হায়, আমেরিকার চিকিৎসাতেও মানুষ বাঁচে না। দেবতারা হয়তো বাঁচতে পারেন।
আমরা যারা মানুষ এবং যাদের বঙ্গদেশেই থাকতে হবে আজীবন তাদের কী হবে? যে দেশে দেবতাদেরই নিরাপত্তা নেই, সেখানে সাধারণ মানুষের দুরবস্থা কল্পনা করতেও (গীতার ভাষায়) ‘রোমহর্ষশ্চ জায়তে’ অর্থাৎ (উত্তেজনায়) গায়ের লোম (চিরতরে) দাড়িয়ে যাচ্ছে!

Comments (14)

https://buyneurontine.com/ – neurontine for depression

Viagra W Overnight Shipping

Where Can I Buy Cialis Cheap

Order Doxycycline Online From Canada

carcinoma of the prostate prostate cancer Malignant tumor adenocarcinoma of the prostate gland. plaquenil rash

Good info. Lucky me I discovered your site by chance (stumbleupon).
I have book marked it for later!

Leave a comment