Scroll Top
19th Ave New York, NY 95822, USA

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিপরীক্ষার তোতাকাহিনি

OLYMPUS DIGITAL CAMERA

বিশ্ববিদ্যালয় কেন ভর্তিপরীক্ষা নেয়? ঠোঁট দিয়ে সৌভাগ্যনির্দেশক খাম খুঁজে বের করতে পারে বা শেখানো বুলি গরগর করে বলতে পারে এমন এক ঝাঁক তোতাপাখি খুঁজে বের করতে, নাকি নিজের বিচার-বুদ্ধি ব্যবহার করে পেশাগত ও ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধান করতে পারে এমন আশরাফুল মখলুকাতদের উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ দিতে? ভর্তিপরীক্ষার উদ্দেশ্য কি ভর্তিচ্ছুদের যেনতেনপ্রকারেন ছাটাই করা, নাকি ¯œাতক পর্যায়ে লেখাপড়া করার উপযুক্ত ভাষাজ্ঞান এবং সাধারণ জ্ঞান আছে এমন শিক্ষার্থী নির্বাচন করা?

‘ভাষাজ্ঞান’ বলতে আমরা নিশ্চয়ই বুঝবো এমন জ্ঞান যা দিয়ে শিক্ষার্থী সঠিকভাবে বাংলা এবং ইংরেজি শব্দ গঠন করতে পারবে, শব্দের প্রয়োগ সম্বন্ধে তার ধারনা থাকবে এবং সে গ্রহণযোগ্য বাক্যরচনা করতে পারবে। বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৫ সালের ভর্তিপরীক্ষার বাংলা অংশে যে ২৫টি প্রশ্ন আছে তার অধিকাংশই পরীক্ষার্থীর ভাষাজ্ঞান বিচার করার জন্যে উপযুক্ত নয়। সন্ধি ও সমাসের নাম জানা বাংলা শব্দ ও বাক্য গঠনে অপরিহার্য নয়। ‘গবাদি’ শব্দের সঠিক সন্ধিবিচ্ছেদ কোনটি, সংস্কৃত শব্দ ‘কাদম্বিনী’ বা আঞ্চলিক শব্দ (চৌচালা টিনের ঘরের) ‘টুয়া’-র অর্থ কী, ‘করপল্লব’ কোন সমাস, ‘প্রতিকৃতি’ শব্দে উপসর্গ কোন অর্থে ব্যবহৃত ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর জানলেই যে পরীক্ষার্থী বাংলা ভাষা ‘শুদ্ধ করিয়া লিখিতে, পড়িতে ও বলিতে পারিবে’ সেই নিশ্চয়তা দেয়া মুস্কিল।

বাংলা অংশের প্রশ্ন দেখে মনে হয়, ভাষা ও ব্যাকরণ বিষয়ে গত এক শ বছরের গবেষণাকে প্রশ্নকর্তারা আমলে নেননি। তাঁরা হয়তো বাংলা ব্যাকরণের ত্রিমুনি সুনীতি-শহীদুল্লাহ-সুকুমারের অনুসরণে পাণিনির সংস্কৃত ব্যাকরণকেই বাংলা ব্যাকরণ মনে করেন, সে ব্যাকরণের সঙ্গে বাংলা শব্দ ও বাক্যগঠনের কোনো সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক। ইংরেজি, ফরাসি বা স্পেনিশ ভাষায়ও সন্ধি, সমাস, কারক, প্রত্যয় আছে, কিন্তু সেসব বিষয় স্কুল-কলেজে পড়ানো হয় না, কারণ ঐ পর্যায়ে বিষয়গুলো অত্যাবশ্যক নয়। জার্মান বা বাংলা ভাষায় মাধ্যমিক পর্যায়ে কারক পড়াতে হবে হবে, কারণ জার্মান বা বাংলা ভাষার একেবারে প্রাথমিক স্তরের ব্যবহারের জন্যেও কারকের জ্ঞান অপরিহার্য। ভাষা ও ব্যাকরণের কিছু বিষয় ছাত্রদের জানতে হয়, আর কিছু বিষয় ভাষাতাত্ত্বিকেরা জানলেই চলে। বাংলা অঞ্চলের ব্যাকরণ-শিক্ষণ সংস্কৃতিতে এই দুইটি বিষয়ের পার্থক্যকে ধর্তব্যের মধ্যে নেওয়াকে কখনই কর্তব্য বলে মনে করা হয়নি। ভর্তিপরীক্ষাসহ নানা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার বাংলা প্রশ্নপত্রে এই ক্ষতিকর ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটেছে।

বাংলা অংশে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন আছে যেগুলোর সঠিক উত্তর শতভাগ স্মৃতিনির্ভর। Reflections on the Revolution in France গ্রন্থটি কে লিখেছিল তা জানার সঙ্গে বাংলা ভাষাজ্ঞানের কী সম্পর্ক? ‘সনেট পঞ্চাশৎ’ কার রচনা তা জানাটা কি বাংলা লিখতে জানার জন্যে অপরিহার্য? কোনো একটি বিশেষ গল্পে কোনো একটি বিশেষ উক্তি কোন বিশেষ চরিত্র করেছিল, কোনো একটি গল্পে কোনো একটি বাক্যের শূন্যস্থানে কী আছে কোনো একটি গল্পে বিশেষ একটি মন্তব্য কার সম্পর্কে করা হয়েছে… এসব জানা বা না জানার উপর শুদ্ধ বাংলা বাক্য লেখার ক্ষমতা আদৌ কি নির্ভর করে? এই প্রশ্নপত্রে সবচেয়ে অদ্ভুত প্রশ্নটি হচ্ছে: ‘শাস্ত্রকারেরা গার্হস্থ্য ব্যাপারটিকে কী হিসেবে কল্পনা করেছেন: হস্ত, মস্তক, পদ, চক্ষু।’ সুনির্দিষ্ট প্রতিবেশ (Context) ছাড়া প্রশ্নটি বোঝা মুস্কিল। এ ধরনের প্রশ্ন দিয়ে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পড়া কোনো গল্প-কবিতা পড়ার স্মৃতি যাচাই করা যেতে পারে, কিন্তু পরীক্ষার্থীর বাংলা ভাষাজ্ঞান যাচাই করা সম্ভব নয়।

সাধারণ জ্ঞান অংশের প্রশ্নগুলো কী কারণে ‘সাধারণ’ হবে তা বোঝা মুস্কিল। আমরা বয়োপ্রাপ্তরাই যেখানে এই প্রশ্নগুলোর বেশিরভাগের উত্তর জানি না, সেখানে পরীক্ষকেরা কীভাবে ধরে নেন যে বাংলাদেশে বসবাসরত অষ্টাদশবর্ষীয় শিক্ষার্থীরা তাদের ‘সাধারণ জ্ঞানের’ উপর ভিত্তি করে বলতে পারবে: মান্ধাতা কোন যুগের শাসক ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরটি কেন বিখ্যাত, কোন অর্থনীতিবিদ ‘অদৃশ্য হাত’ শব্দ দুটি ব্যবহার করেন, জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয় কোথায়, ব্যাডমিন্টন কোন দেশের জাতীয় খেলা… প্রশ্নকর্তা কি ধরেই নিচ্ছেন যে পরীক্ষার্থীরা এক বা একাধিক গাইডবুক পড়ে ভর্তিপরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নগুলোর উত্তর মুখস্ত করবে? নাকি বাজারে চালু আছে এমন কোনো গাইডবই থেকেই প্রশ্ন নির্বাচন করা হয়? অবস্থা দাঁড়াচ্ছে এই যে গাইডবই পড়ে যারা শত শত প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত রাখতে পারে শুধু তারাই ভর্তিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় (এবং অনতিবিলম্বে সেই তথ্যগুলো ভুলে যায়!)। সুতরাং এ ধরনের ভর্তিপরীক্ষায় মানব সন্তানের বিশ্লেষণী শক্তি নয়, মুখস্তবাজ শিক্ষার্থীদের স্বল্পমেয়াদী স্মৃতিশক্তি যাচাই করা হচ্ছে।

প্রশ্ন কীভাবে করতে হবে তা নিয়ে রীতিমত গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। কার্যকর এম.সি.কিউ. প্রশ্ন করার জন্যে প্রয়োজন প্রশিক্ষণ ও চিন্তাভাবনার। প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্যে যে পরিমাণ সময় বরাদ্দ হয়েছে সেই পরিমাণ সময় যথেষ্ট কিনা তাও যাচাই করে দেখতে হবে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে কোনো শিক্ষক প্রশ্নপত্র তৈরি করে নিয়ে আসলে তিনি নাকি সেই শিক্ষককে একটি উত্তরপত্র ধরিয়ে দিয়ে উল্লেখিত সময়ে সেই প্রশ্নের সমাধান করতে বলতেন। শিক্ষকই যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উত্তর দিতে অসমর্থ হয়, তবে শিক্ষার্থীর পক্ষেই বা কিভাবে সেটা করা সম্ভব হবে Ñ এই ছিল তাঁর যুক্তি।

এম.সি.কিউ. (MCQ) প্রশ্ন করার কিছু অপরিহার্য নিয়মের মধ্যে একটি হচ্ছে, প্রশ্ন হতে হবে প্রধানত বিশ্লেষণমূলক, একান্তভাবে স্মৃতিনির্ভর নয়। জ্ঞানের যদি দুটি অংশ থাকে: স্মৃতি এবং বিশ্লেষণ ক্ষমতা, তবে তার মধ্যে স্মৃতিশক্তির অনেকটাই সম্ভবত জন্মসূত্রে প্রাপ্ত। বিশ্লেষণের ক্ষমতাটা মানুষ শিক্ষা ও অভ্যাসের মাধ্যমে অর্জন করতে পারে। শিক্ষার্থী সেটা আদৌ অর্জন করতে পেরেছে কিনা, বা কতটুকু পেরেছে, সেটাই বিচার করতে হবে যে কোনো পরীক্ষায়। কোনো বিশেষ বিষয়ে এমন ভাবে প্রশ্ন করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীর মনোযোগ ও জ্ঞান সেই বিষয়ে কেন্দ্রাভিমুখি (Centripetal) হয়, অন্য দশটা বিষয়ে অনর্থক চিন্তা করতে গিয়ে তার মনোযোগ যেন কেন্দ্রাতীগ (Centrifugal) হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে না পড়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৫ সালের খ ইউনিটের General English এবং Elective English প্রশ্নের ধরন লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে ভর্তিপরীক্ষার প্রশ্ন কেমন হওয়া উচিত। প্রশ্নপত্রের এই দুই অংশে স্মৃতিনির্ভর প্রশ্ন নেই বললেই চলে। বেশির ভাগ প্রশ্ন ইংরেজি ভাষাজ্ঞান যাচাই করার লক্ষ্যে রচিত হয়েছে। টোফেল, আই.এল.টি.এস. ইত্যাদি পরীক্ষার আলোকে বাংলা ভাষাজ্ঞান এবং সাধারণ জ্ঞান যাচাইয়ের প্রশ্নের ধরনে কার্যকর পরিবর্তন আনা এখন সময়ের দাবি। যদি বি.সি.এস. ইত্যাদি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা বা মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নের ধরনও এ রকম হয়ে থাকে তবে সেখানেও পরিবর্তন বাঞ্ছনীয়।

সর্বোত্তম তোতাপাখিটি বাছাই করা নয়, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত তথ্যের যৌক্তিক বিশ্লেষণে সক্ষম শ্রেষ্ঠ চৌকশ শিক্ষার্থীটিকে খুঁজে বের করা। ভাবতে শেখেনি, শুধু মুখস্ত করে উগরে দিতে শিখেছে চোখকান বন্ধ করে এমন প্রার্থীদের নির্বাচিত করা হলে শিক্ষা, বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও দেশরক্ষা রাষ্ট্রের এই চতুরঙ্গের কোথাও গুনগত কোনো পরিবর্তন আসবে না আরও বহু প্রজন্মে। হয়তো এই ভুলটাই আমরা প্রজন্মান্তরে করে আসছি সুদক্ষ, মননশীল আশরাফুল মখলুকাতের বদলে অকার্যকর পরীক্ষার জাল পেতে ধরে আনছি ঝাঁকে ঝাঁকে ময়না-তোতা। ক্ষমতার দম্ভ, অবিচার, বৈষম্য, শ্রেণীবিদ্বেষ, সীমাহীন ও লজ্জাস্কর দুর্নীতি, অন্য পেশা বা অধস্তনদের প্রতি উদ্ধত তাচ্ছিল্য এবং জবাবদিহির অভাবসহ আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের যাবতীয় দুরারোগ্য ব্যাধির মূূলেও হয়তো আছে এই করুণ তোতাকাহিনি।

শিশির ভট্টাচার্য্য, অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Comments (5)

acheter cialis original en france kamagra for sale in us buy cialis online in us

Solid dosage forms of potassium supplements are contraindicated in any patient in whom there is cause for arrest or delay in tablet passage throughout the GI tract including patients who are also taking drugs with anticholinergic properties propecia reviews Never miss your medication or your regular checkups

Leave a comment