Scroll Top
19th Ave New York, NY 95822, USA

কানাডীয় পরিব্রাজকের চোখে সেকালের বাংলা থিয়েটার

A_jatra_actor_prepares_before_the_performance,_Sunderbans

[কানাডীয় পরিব্রাজক ওগুস্ত ফর্তিয়ে (Auguste Fortier) এশিয়া ও আফ্রিকা ভ্রমণে এসেছিলেন বিংশ শতকের প্রথম দশকে। দেশে ফিরে গিয়ে তিনি রভ্যু পপুল্যার (Revue Populaire) বা ‘পপুলার রিভিউ’ নামক মাসিক পত্রিকায় ১৯১০ সালের জুন, অক্টোবর ও ডিসেম্বর মাসে কমপক্ষে তিনটি ভ্রমণ-বৃত্তান্ত লেখেন। কানাডার কুইবেক প্রদেশের অন্যতম শহর মন্ট্রিয়ল থেকে প্রকাশিত এই পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় দাবি করা হয়েছে যে এটি উত্তর আমেরিকায় ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত একমাত্র পত্রিকা। ১৯০৭ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫৬ বছর ধরে পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯১০ সালে এই পত্রিকাটির মুদ্রণসংখ্যা ছিল ৫০০০ যা ১৯৬৩ সালে বন্ধ হওয়ার আগে ১ লক্ষ ২৭ হাজারে উন্নীত হয়।
ফর্তিয়ের অক্টোবর মাসের লেখাটিতে মরিশাস ভ্রমণের বর্ণনা আছে। ডিসেম্বর মাসের লেখাটিতে আছে মাদাগাস্কার ভ্রমণের বর্ণনা। জুন মাসের লেখাটির (পৃষ্ঠা: ৭৩-৭৪) শিরোনাম: ‘ল্য তেয়াত্র্ দঁ ল্যান্দ’ (Le théâtre de l’Inde) বা ‘ভারতবর্ষের থিয়েটার’। এক বিদেশির দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিংশ শতকের প্রথম দশকে বাংলাদেশের সংস্কৃতি-ইতিহাস-রাজনীতির এক মনোজ্ঞ বর্ণনা আছে ফর্তিয়ের এই রচনাটিতে। নিচে লেখাটির বঙ্গানুবাদ দেয়া হলো। অনুবাদকের ব্যাখ্যা বা টীকা তৃতীয় বন্ধনীতে দেয়া হয়েছে।]

ভারতীয় জীবনের সত্যিকারের রূপ সম্পর্কে কানাডীয় সাধারণ পাঠকের ধারণা খুবই কম, এতটাই কম যে ভারতীয় থিয়েটারের উল্লেখমাত্রই তাদের কল্পনায় ভেসে উঠবে এরকম একটি ছবি: থিয়েটার হলে ঢুকতেই দেখা যাবে উগ্র আর হাস্যকর পোষাকপরা একদল নাচনেওয়ালীর অদ্ভুত অশৈল্পিক সব অঙ্গভঙ্গী; শোনা যাবে বত্রিশ পয়ারের একঘেয়ে গান আর শরীর-মন কাহিল করা ঘুমপাড়ানী সুরে ঢোলমাদলের তাক্ডুমাডুম্। না, ভারতীয় থিয়েটারের সত্যিকারের চিত্রটি একেবারেই এর বিপরীত, কারণ কথায় আছে–

“.. ভারতবাসী এমন গপ্পো বড়ই মন্দ বাসে;
একঘেয়ে, যার দোদুল দোলে দাঁড়িয়ে ঘুম আসে”১

[১. লেখক যেহেতু উদ্ধরণ চিহ্ন ব্যবহার করেছেন সেহেতু ভেবে নেয়া যেতেই পারে যে উপরের লাইন দুটি কোনো কবিতা বা গানের চরণ। চরণদুটির বঙ্গানুবাদ পুরোপুরি আক্ষরিক করিনি, তবে মূলের ভাব ও ছন্দ ষোল আনা অক্ষুণœ রাখার চেষ্টা করেছি]

গঙ্গাতীরের ভারতবাসী২ আর [কানাডার কুইবেক প্রদেশের অন্যতম নগরী মন্ট্রিয়লের] সেন্ট লরেন্ট নদীতীরের কানাডীয়দের মধ্যে একটি মিল আছে। তারা উভয়েই অত্যন্ত দেশপ্রেমিক।

[২. ভারতবাসী: লেখক ‘ভারতবর্ষের অধিবাসী’ অর্থে ‘হিন্দু’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সে যুগের ফরাসি পরিব্রাজকরা মুসলমানদের বলতেন ‘মুর’ আর হিন্দুদের ‘হিন্দু’। ফরতিয়ে যদিও কোলকাতার থিয়েটারের বর্ণনাই দিয়েছেন, তবু তিনি ‘বাঙালি’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। আমি ইচ্ছা করেই ‘ভারতীয়’ শব্দটি ব্যবহার করেছি, কারণ আমার বাংলা ভাষাবোধ অনুসারে ‘ভারতীয়’ বলতে ভারতবর্ষের যে কোনো অধিবাসীকেই বোঝায়। অনেকে আমার শব্দপ্রয়োগের সাথে একমত না হতে পারেন, তবে ১৯১০ সালের প্রতিবেশ বা কনটেক্সটে হিন্দু মুসলমান সবাইকে ‘ভারতীয়’ বলা যেতেই পারে, কারণ তখনও দেশভাগ হয়নি এবং ‘ভারতীয়’ শব্দটি শুধু ভারতের (যা খুবই দুঃখজনক) নাগরিকদের জাতীয়তার দ্যোতক হয়ে উঠেনি।]

নাটক ভারতীয়দের খুবই পছন্দ, তবে নাটকের পটভূমিটি অবশ্যই হতে হবে ভারতের ইতিহাসের সুন্দর সুন্দর সব কাহিনিগুলোর একটি। কাহিনি এগিয়ে যাবার সাথে সাথে দর্শক কখনও উদ্বুদ্ধ হবে দেশপ্রেমে, কখনও বা ভাসবে চোখের জলে। আর, পুরো নাটকটি ডোবানো থাকবে একের পর এক নাচ আর গানের মসলাদার ঘন ঝোলে। ভারতীয় দর্শকের নাট্যরূচি খুব ভালোভাবেই ধরতে পেরেছেন কোলকাতার হরনাথ বসু। পেশায় তিনি ডাক্তার কিন্তু নেশা তাঁর থিয়েটার। ফরাসিরা সারদুকে৩ যে চোখে দেখেন কোলকাতার ভারতীয়রা হরনাথ বসুকে অনেকটা সে চোখেই দেখে থাকেন।

[৩. সারদু: ফরাসি নাট্যকার ভিক্টোরিয়্যাঁ সারদু (১৮৩১-১৯০৮) অনেকগুলো ঐতিহাসিক নাটকের রচয়িতা।]

হরনাথ বসু জানেন, ভারতীয় দর্শক আসলে কি চায়। এমন একটি নাট্যদল তিনি গড়ে তুলতে পেরেছেন যেখানে প্রতিভাবান সব অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সমাবেশ ঘটেছে। এঁরা প্রত্যেকেই শ্রী বসুর লেখা নাটকের চরিত্রগুলো নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে জানেন। অভিনেতাদের মধ্যে অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, কারণ অভিনয় ছাড়া অন্য একটি গুরুদায়িত্বও তিনি পালন করছেন। শ্রী মুখোপাধ্যায় কোলকাতার অন্যতম থিয়েটার হল কোহিনূরের৪ পরিচালক-কর্মাধ্যক্ষ। আট থেকে নয় শত দর্শকের স্থান সঙ্কুলান হয় কোহিনূরে। এই থিয়েটার হলে দুটি গ্যালারি রয়েছে। উপরের গ্যালারিটি মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট।

[৪. কোহিনূর: ১৮৮৩ সালে বিডন স্ট্রীটে এই থিয়েটার হলটির প্রতিষ্ঠা করেন গুরুমুখ রায় মুৎসুদ্দী (নটী বিনোদিনীর স্বামী)। প্রথমে এর নাম ছিল স্টার থিয়েটার। ১৮৮৭ সালে রসরাজ অমৃতলাল বসু ও অন্যান্যরা এটি কিনে নেন। হলটির বহুবার হাতবদল ও নামবদল হয়: এমেরাল্ড (১৮৮৭-৯৬), ক্লাসিক (১৮৯৭-১৯০৭), কোহিনূর (১৯০৭-১৯১২), মনমোহন থিয়েটার (১৯১৫-১৯২৪), শিশির কুমার ভাদুরীর নাট্যমন্দির (১৯২৪-২৫), মিত্রা (১৯২৫-২৬) এবং আর্ট (১৯২৮-৩১)। সেন্ট্রাল এ্যভেনিউ তৈরি করার সময় হলটি ভেঙে ফেলা হয়।]

প্রাচ্যের লোকজন জাঁকজমক খুব পছন্দ করেন। নাটকের প্রতিটি অঙ্কেই কয়েকবার পশ্চাৎদৃশ্য বা সিনারি না বদলালে দর্শকদের মন ভরে না। কোহিনূরে এরকম অনেকগুলো সিনারি আছে। স্থানীয় শিল্পীরাই এগুলো এঁকেছেন এবং এসব সিনারির মধ্যে এমন অন্তত কয়েকটি আছে যেগুলোর প্রশংসা না করে পারা যায় না। সিনারিগুলো এত ভালো করে আঁকা যে মন্ট্রিয়লের থিয়েটারে যেসব সিনারি ব্যবহার করা হয় সেগুলোর পাশে কোহিনূরের সিনারিগুলোকে নির্দ্বিধায় রাখা যেতে পারে। কস্টিউমের কথা যদি উঠে তবে বলতে হবে আমেরিকার থিয়েটারে সাধারণত যে রকম কস্টিউম ব্যবহার করা হয় সেগুলোর তুলনায় কোলকাতার থিয়েটারের কস্টিউম অনেক উন্নতমানের। কস্টিউম এদেশে ভালো করে তৈরি করতেই হয়, কারণ ভারতীয় থিয়েটারের নায়কেরা বেশির ভাগই ক্ষেত্রেই হয়ে থাকেন পুরোনো দিনের রাজা বা নবাব। ভারতীয় রাজা বা নবাবেরা সোনারূপো বসানো চকচকে পোষাক পরে জনসমক্ষে আত্মগৌরব প্রদর্শন করতেন।
ভারতীয় অভিনেত্রীরা প্রত্যেকে নজরকাড়া সুন্দরী। তাদের বয়স কম, চামড়া তাজা শব্জীর মতো সতেজ, টানটান। বয়স্ক কোনো চরিত্রে অভিনয় করার প্রয়োজনে মুখে বলিরেখা টানা হলেও বয়স তাদের খুব একটা বাড়ানো যায় না। এই অভিনেত্রীদের চেহারায় প্রাচ্যের বিশেষ এক মহিমার আলো ছড়িয়ে থাকে। আমেরিকার পেশাদার সুন্দরীদের মধ্যে সৌন্দর্যচর্চায় সবচেয়ে দক্ষ যাঁরা তাঁরাও হাজার চেষ্টা করে নিজেদের মুখম-লে অনুরূপ মহিমা ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হবেন না।
কোহিনূরের অভিনেত্রীদের কস্টিউম এককথায় দারুন। ভারতীয় মহিলাদের পোষাক এমনিতেই খুব আভিজাত্যপূর্ণ। এসব পোষাক যারা পরেন পোষাকের কারণেই তাদের মধ্যে আভিজাত্য ফুটে উঠে, অর্থাৎ অন্যের দৃষ্টিনন্দন হওয়ার জন্য নিজের সাথে মানানসই পোষাক পরার প্রয়োজন হয় না কোনো ভারতীয় মহিলার, পোষাকই পড়নেওয়ালীকে নিজের সাথে মানিয়ে নেয়। এশিয়ার এই দেশে গরম খুব বেশি বলে মহিলারা বড় সাদা একটি কাপড় গায়ে জড়ান। এই পোষাকটির নাম ’চাদর’৫।

[৫. চাদর: কিছু কিছু দেশে মুসলিম মহিলারা পাতলা একটি চাদর দিয়ে শরীর, মাথা আর মুখম-লের একাংশ ঢেকে রাখেন। ভারতবর্ষে অনেক মুসলিম মহিলা আব্রু রক্ষার প্রয়োজনে ‘বোরখা’ নামক একটি পোষাক পরে থাকেন। দু’টি পোষাককেই ফরাসি ভাষায় ‘চাদের’ (বাংলায় ‘চাদর’) বলা হয়। লেখক বলছেন, ভারতীয় মহিলারা সাদা চাদরে শরীর-মুখ ঢেকে রাখেন এবং অভিনেত্রীদের পরনেও একই পোষাক। ভারতীয় হিন্দু মহিলারা শাড়ি দিয়েও শরীর মুখ ঢেকে রাখেন, তবে ময়ূর সিংহাসনের মুসলমান মহিলা-চরিত্রে শাড়ি পড়ার কথা নয়। ময়ূর সিংহাসনের অভিনেত্রীরা বোরখা পরে মুসলমান নারী চরিত্র অভিনয় করতেন – এটাও হতে পারে না। মোগল হেরেমে বোরখা পরার প্রচলন ছিল কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন। ধরে নেয়া যাক, চরিত্রানুগ হওয়ার জন্য অভিনেত্রীরা গায়ে পাতলা একটি ওড়না জড়িয়ে নিতেন।]

চাদর দিয়ে পুরো শরীরতো তারা ঢাকেনই, মুখের বড় একটি অংশও তাঁরা ঢেকে রাখেন। এমন পোষাকে কোহিনূরের অভিনেত্রীদের দেখে মনে হয়, ছোটোখাটো সব মা ম্যাডোনা বা সিস্টার ঘুড়ে বেড়াচ্ছেন স্টেজে। মসলিনের পোষাক পড়া এই অভিনেত্রীরা যখন স্টেজে নাচতে থাকেন তখন মনে হয়, এর চেয়ে দৃষ্টিনন্দন আর কিছুই হতে পারে না।
কলকাতায় থিয়েটারী গানের সুর মোটামুটিভাবে করুণ, কখনওবা ক্ষীণ শীৎকারের মতো ধ্বনি মিশে থাকে তাতে। মনে হয়, যেন কোনো মন্দির বা গীর্জার গর্ভগৃহে বসে কেউ গাইছে সে গান। হটাৎ হটাৎ গীতরস ভঙ্গ করে কানঝালাপালা করা চিৎকার৬ যেমনটি শোনা যায় আমাদের মন্ট্রিয়লের কিছু দশ পয়সার থিয়েটার হলে।

[৬. ‘কানঝালাপালা করা চিৎকার’ বলতে লেখক কি বোঝাতে চেয়েছেন তা পরিষ্কার নয়। হতে পারে এগুলো দর্শকদের সন্তুষ্টি-নির্দেশক সিটি, অথবা এমনও হতে পারে, গানের তারসপ্তকের কোনো কোনো স্বরকে লেখকের কাছে শীৎকার বা চিৎকার বলে মনে হয়েছে। লেখক আরও বলেছেন, মন্ট্রিয়লে দশ পয়সার থিয়েটার হলেও একই রকম চিৎকার শোনা যায়। এতে মনে হয়, দর্শকদের সিটির কথাই বলছেন লেখক। ‘দশ পয়সার থিয়েটার হল’ বলতে লেখক সম্ভবত সেকালের মন্ট্রিয়লের এমন কিছু থিয়েটার হলের প্রতি ইঙ্গিত করছেন যেখানে নি¤œ আয়ের লোকেরাই শুধু যেতে পারতো এবং সামান্য উত্তেজনাতেই তারা সিটি বাজাতো।]

ভারতীয় থিয়েটারে শো হয় সপ্তাহে তিনটি। এখন কোহিনূরে মঞ্চস্থ হচ্ছে ‘ময়ূর সিংহাসন’। নাটকের ভাষা বাংলা, নাট্যকার ডাক্তার হরনাথ বসু। ১৭৫৭ সালে মোগল যুগে ভারতের অবস্থা কেমন ছিল তার একটি পরিচয় পাওয়া যায় এ নাটকে। চারটি নারীচরিত্র নিয়ে ‘ময়ূর সিংহাসন’ নাটকে মোট এগারোটি চরিত্র রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছেন বারো জন নর্তকী। নাটকের কিছু কিছু দৃশ্যে যখনই ঘটনাপ্রবাহ জটিল হয়ে উঠে দর্শকের মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে, তখনই, হ্যাঁ ঠিক সেই মুহূর্তেই নর্তকীরা দৃশ্যান্তরে ছুটে এসে দর্শকদের মনে আনন্দের রশ্মি ছড়িয়ে দিয়ে যান।
গত দুই মাস ধরে কোহিনূরে মঞ্চস্থ হচ্ছে ময়ূর সিংহাসন। আরো মাস তিনেক চলবে এই নাটক এবং সব মিলিয়ে নাটকাটির প্রায় ষাটটি প্রদর্শনী হবে। নাটকটি আমার দারুন লেগেছে। আমার মনে হয় না, মন্ট্রিয়লে কখনও কোনো নাটকের এতগুলো প্রদর্শনী হয়েছে।
কোলকাতার থিয়েটারের অভিনেতারা সবাই পেশাদার অর্থাৎ অভিনয়ই তাদের আয়ের একমাত্র উৎস। এখানে আমার সাথে আলাপ হয়েছে শ্রী শিশির কুমার রায়ের সাথে। কয়েকটি থিয়েটার হলের মালিক তিনি। কথাপ্রসঙ্গে শ্রী রায় আমাকে জানিয়েছেন যে কোলকাতায় ভালো একজন অভিনেতা মাসে ১৫০ টাকা আয় করেন (কানাডীয় ডলারে ৫০ ডলার)। প্রতিভাবান কোনো অভিনেত্রী যদি সুন্দরী হন, তবে প্রতি মাসে তিনি আয় করেন ১০০ টাকা (৩৩ কানাডীয় ডলার)। নর্তকীরা প্রত্যেকে গানও গেয়ে থাকেন৭ এবং তাদের মাসিক আয় গড়ে ৮ কানাডীয় ডলার। মন্ট্রিয়লে এ ধরণের বেতন খুবই অকিঞ্চিৎকর মনে হতে পারে, কিন্তু কোলকাতার বাজারে অনেকেই এ বেতনে নিজেকে ধন্য মনে করেন, কারণ জীবনযাত্রার ব্যয় এখানে খুবই কম।

[৭. ফরতিয়ে লিখেছেন: “নর্তকীদের অবশ্যই ‘কোরিস্ট’ বা কোরাস-গায়িকা হতে হয়”। জানি না, কোন অর্থে লেখক তাদের কোরিস্ট বলেছেন: নর্তকীরা কোরাস গানে অংশ নিত বলে, নাকি আসলেই তার সুকন্ঠের অধিকারিণী ছিল বলে। বাংলাদেশের কোনো কোনো যাত্রাদল, যেমন বাবুল বা ভাগ্যলক্ষèী অপেরার যাত্রাপালা যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা অবশ্যই দেখে থাকবেন যে পালা শুরুর আগে সব অভিনেত্রী আর নর্তকীরা স্টেজে এসে একটি কোরাস গান গেয়ে থাকে। এদের সবাই মোটামুটি গাইতে পারলেও এদের প্রত্যেকে কখনই ভালো গায়িকা নয়। আমি জানি না, গত শতাব্দীর প্রথম দশকের থিয়েটারেও নাটক শুরুর আগে এরকম কোরাস গান গাওয়ার ব্যাপার ছিল কিনা, এবং লেখক সে দৃষ্টিকোণ থেকে নর্তকীদের কোরাস-গায়িকা বলেছেন কিনা।]

ভারতীয়দের সামাজিক রীতিনীতি, মনন আর চরিত্রের উপর থিয়েটারের বিশাল প্রভাব রয়েছে। ইংরেজ সরকারও ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছেন। ১৯০৮ সালে সরকার-বিরোধী আন্দোলনের সময় নৈরাজ্যবাদী বিপ্লবীরা যখন গঙ্গাতীরের এই শহরে সন্ত্রাসের বীজ বপন করছিলেন৮ তখন এক ক্ষমতাবান উচ্চপদস্থ [ইংরেজ] কর্মকর্তা নাকি এক গোপনসভায় মন্তব্য করেছিলেন: ‘হরনাথ বসুকে বললেই হয় নৈরাজ্যবাদী ধ্যানধারণার সমালোচনা করে একটি নাটক লিখতে!’

[৮. ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ আইনের প্রতিবাদে ভারতবর্ষে স্বদেশী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। শ্রী অরবিন্দ (১৮৭২-১৯৫০), বারীন্দ্রকুমার ঘোষ (১৮৮০-১৯৫৯) ও অন্যান্যরা গড়ে তোলেন সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন ‘যুগান্তর’। এদের সংস্পর্শে আসেন কানাইলাল দত্ত (১৮৮৮-১৯০৮), ক্ষুদিরাম বসু (১৮৮৯-১৯০৮) ও প্রফুল্ল চাকী (১৮৮৮-১৯০৮)-র মতো বিপ্লবীরা। ১৯০৮ সালের ৩০শে এপ্রিল ক্ষুদিরাম বসু আর প্রফুল্ল চাকী কুখ্যাত প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে গিয়ে ভুল করে বোমা মেরে বসে অন্য এক গাড়িতে। এতে মিসেস কেনেডি নামে এক ইংরেজ মহিলা আর তার কন্যার মৃত্যু হয়। প্রফুল্ল চাকী আত্মহত্যা করেন আর ১১ই আগস্ট ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়। ৩১শে আগস্ট কানাইলাল দত্ত আলীপুর সেন্ট্রাল জেলের ভেতরেই কাঁঠালের ভিতরে করে পাচার করে নিয়ে আসা রিভলভার দিয়ে খুন করেন রাজসাক্ষী নরেন্দ্রনাথ গোস্বামীকে। বিচারে কানাইলালের ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। কানাইয়ের বয়স আঠারো বছরের কম থাকায় ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেলের বরাবরে মৃত্যুদ- মওকুফ করার জন্যে আপীল করার সুযোগ ছিল। কানাইয়ের উকিল এ ব্যাপারে কানাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কানাই বলেছিলেন: There shall be no appeal! যা শুনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন মন্তব্য করেছিলেন, ‘কানাই শিখিয়ে গেল হে, এখন থেকে shall আর will এর ব্যবহারে কেউ আর ভুল করবে না!’ ১০ই নভেম্বর কানাইলাল দত্তের ফাঁসী হয়। এই কয়েকটি ঘটনা থেকে ১৯০৮ সালের নৈরাজ্যবাদী আন্দোলন সম্পর্কে কমবেশি ধারণা করা যেতে পারে। ‘সন্ত্রাসের বীজ বপন করছিলেন’ কথাটির অনুবাদ আমি আক্ষরিক করেছি ইচ্ছে করেই, কারণ সন্ত্রাসের সেই বীজ বাংলাদেশের উর্বর মাটিতে উপযুক্ত জল-হাওয়া পেয়ে গত ১০০ বছরে মহিরূহে পরিণত হয়েছে।]

ভারতীয় ধনকুবেরদের মধ্যে কেউ কেউ, যেমন ধরুন, কোনো রাজা বা নবাব থিয়েটারের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রতি নিজের বদান্যতার পরিচয় দিয়ে থাকেন। এদেরই একজন খৈরাতের রাজা।৯

[৯. ‘খৈরাত’ সম্ভবত ‘খয়রা’ এবং খৈরাতের এই রাজা সম্ভবত খয়রার রাজা কুমার গুরুপ্রসাদ সিংহ যিনি ১৯২০-২১ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় ছয় লক্ষ টাকা দান করেছিলেন। এই টাকা থেকে চারুকলা, ভাষাতত্ত্ব, কৃষিবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে পাঁচটি খয়রা অধ্যাপকের পদ (চেয়ার) সৃষ্টি করা হয়েছিল। ১৯২২ সালে ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং ১৯৪৫ সালে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু খয়রা অধ্যাপকের পদ অলঙ্কৃত করেন। ]

এই রাজাবাহাদুর খুবই হৃদয়বান এবং প্রাণবন্ত। হৈ-হুল্লুর-আনন্দের মধ্যে বাঁচতে ভালোবাসেন তিনি। কোলকাতার সাংস্কৃতিক পরিম-লে সবাই তাঁকে এক নামে চেনে। কিছুদিন আগে এই রাজাবাহাদুর ময়ূর সিংহাসন দেখতে গিয়েছিলেন। নাটকের ছত্রে ছত্রে দেশপ্রেমের পরিচয় পেয়ে, শিল্পীদের অভিনয় এবং বিশেষ করে অভিনেত্রীদের রূপে (সন্দেহ নেই, এতেও কিছুটা কাজ হয়েছে!) মুগ্ধ হয়ে তিনি মোটা টাকা পুরস্কার দিয়েছেন কোহিনূর থিয়েটারের কর্মাধ্যক্ষ আর প্রধান অভিনেতা অপরেশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়সহ সব শিল্পীকে। ডাক্তার হরনাথ বসুকেও দিয়েছেন তিনি বেশ বড় অঙ্কের একটি টাকা। তবে সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য যে কাজটি তিনি করেছেন সেটা হচ্ছে এই যে, ময়ূর সিংহাসনের পা-ুলিপি মুদ্রণ করে দারুন সুন্দর একটি ভল্যুমে বাঁধাই করানোর পর পাঠকদের হাতে হাতে বিনামূল্যে নাটকটি পৌঁছে দেবার যাবতীয় ব্যয়ভার তিনিই বহন করেছেন।

আশা করি, কানাডার বড়লোকদের মধ্যেও দুই এক জন কুইবেক প্রদেশের লেখকদের প্রতি এমন বদান্যতার পরিচয় দেবেন। আমেরিকার মাটিতে ফরাসি-কানাডীয়দেরও অনেক গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। আশাকরি মন্ট্রিয়লের মঞ্চে নীরস সব নাটকের পরিবর্তে এমন সব নাটকের মঞ্চায়ন হবে যেগুলো আমাদের ইতিহাসকে বিম্মৃতির হাত থেকে উদ্ধার করবে।

Comments (17)

Leave a comment