Scroll Top
19th Ave New York, NY 95822, USA

‘বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হচ্ছিল’

levy120102_3_560

পৃথিবীর কোনো যুদ্ধই সরলরৈখিক ঘটনাপরম্পরা বা একশৈলিক কোনো ভাষ্কর্য নয়। যুদ্ধের ভিতরে যারা থাকে তারা এর সবটা দেখে না, যুদ্ধ যাঁরা পরিচালনা করেন তাদের চোখেও যুদ্ধের সবটা ধরা পড়ে না; যুদ্ধ শেষ হবার বহুদিন পরে যারা কোনো যুদ্ধের ইতিহাস রচনা করতে যান তাদের কাছেতো যুদ্ধের অনেকখানিই অধরা থেকে যায়। হাতির দুই ধরনের দাঁত থাকে, দুটি মাত্র বাইরে বেরিয়ে থাকে, বাকি সবগুলো দাঁত মুখের ভিতরে যেখানে চিবানোর মূল কাজটা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের যেটুকু রঙ্গমঞ্চে দৃশ্যমান ছিল সেটুকুর ভিত্তিতেই ভূমিস্তরের ইতিহাস লেখা হয়েছে। অন্তর্লীন স্তরে, উইংসের আড়ালে এমন অনেক কিছু ঘটেছে যা সাধারণ্যে দৃশ্যমান হয়নি, অথচ সেই ঘটনাগুলোই হাতির অদৃশ্য দাঁতের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামের গতি নিয়ন্ত্রণ করেছে।

১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে এ পর্যন্ত যত বই, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা লেখা হয়েছে, যত নাটক-চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে তার মধ্যে খ- খ- সত্য নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান কুশীলব: রাষ্ট্রপিতা শেখ মুজিবুর রহমান, ইন্দিরা গান্ধী, লিওনিদ ব্রেজনেভ, তাজউদ্দীন আহমেদ, রিচার্ড নিক্সন, হেনরি কিসিঞ্জার, চৌ এন লাই, আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মোহাম্মাদ তোহা… এঁদের কোনো স্মৃতিকথা যদি থাকে, তবে তাতেও কিছু সত্য পাওয়া যাবে। এছাড়া বহু নাম না জানা মুক্তিযোদ্ধা যারা মাঠে-ঘাটে-বাটে সত্যিকারের গেরিলাযুদ্ধ করেছেন তাদের স্মৃতিতেও কিছু সত্য লুকিয়ে আছে… রাজারাজরা (সাম্প্রতিক উদাহরণ: মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেনাপতি এ. কে. খন্দকারের স্মৃতিকথা ‘১৯৭১ এর ভেতরে বাইরে’) থেকে উলুখাগড়া (যেমন, চট্টগ্রামের কুমিরা গ্রামের অধিবাসী কানাইলাল চক্রবর্তীর ১৯৭১ সালে লেখা ‘শরণার্থীর দিনলিপি’) পর্যন্ত সবার দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখা মুক্তিযুদ্ধকে যদি কখনও মেলানো যায় তবেই এই যুদ্ধের একটি প্রাথমিক আপাত-সত্য ইতিহাস পাওয়া যেতে পারে।

অঁদ্রে মালরোর আহ্বানে সাড়া দিয়ে Bernard Henri-Lévy (ফরাসি উচ্চারণে: ব্যারনার অঁরি লেভি) ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে পূর্ব বাংলায় এসেছিলেন সংবাদদাতা হিসেবে, মাত্র ২৩ বছর বয়সে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনে কিছু দিন কাজ করে লেভি প্যারিসে ফিরে যান। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় Les Indes Rouges, লেভির জীবনের প্রথম প্রকাশিত পুস্তক। ৪০ বছর পর বইটির বাংলা অনুবাদ ‘বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হচ্ছিল’ প্রকাশিত হয়েছে ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ ও লেভির নিজের উদ্যোগে। বইটির প্রকাশনা উৎসবে লেভি বলেছেন: ‘বাংলাদেশের যুদ্ধই আমার জীবনকে গঠন করেছে, বদলে দিয়েছে। আমি আমার জীবনের জন্যে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ঋণী।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং এত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে যে অদূর ভবিষ্যতে এই দেশটি দক্ষিণ এশিয়া ও ইসলামী বিশ্বের একটি নেতৃস্থানীয় দেশে পরিণত হবে। সুতরাং বাংলাদেশকে অতি দ্রুত অতীতের সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে। যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে হবে, প্রতিটি শহীদের নামধামসহ একটি তালিকা প্রণয়ন করতে হবে কারণ অতীতের হিসাব না চুকিয়ে কোনো জাতি ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হতে পারে না।’

নতুন কী আছে লেভির বইতে? বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে বহুচর্চিত, সবজনগৃহীত thesis-টি হচ্ছে এই: বৃহৎ শক্তি রাশিয়ার সমর্থনপুষ্ট আঞ্চলিক শক্তি ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল আর অন্য দুই বৃহৎ শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে। লেভি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে একটি antithesis দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের ৯ মাসের স্বাধীনতা সংগ্রামকে (২৬শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর) দুটি আলাদা পর্যায়ে ভাগ করেছেন। মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম পর্যায় এবং অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্যায়। প্রথম পর্যায়ে সবগুলো পরাশক্তি: যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত রাশিয়া, চীন পাকিস্তানের স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে ছিল। ভারতও প্রথম পর্যায়ে পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষার বিপক্ষে ছিল না। এই অবস্থা চলেছে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্যায়ে কমিউনিজম ঠেকানোর প্রয়োজনে যখনি ভারত এবং সবগুলো পরাশক্তি পাকিস্তান ভাঙার পক্ষে রায় দিল, তখন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ছিল শুধু সময়ের ব্যাপার।

লেভি লিখেছেন, ‘সবার ধারণা: সোভিয়েত রাশিয়া স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশকে সমর্থন করেছে আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল। ভুল সবই ভুল। সোভিয়েত রাশিয়া প্রকৃতপক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি সাহায্য করেনি বাংলাদেশকে। ইয়াহিয়া আর মুজিব – এই দুই জনের মধ্যে কোনো এক জনকে নির্বাচনের ব্যাপারে সিদ্ধান্তগ্রহণের ব্যাপারটা রাশিয়া যত বেশিদিন ধরে সম্ভব এড়াতে চেয়েছে। ‘১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসেও রুশরা মস্কো সফরে আসা শ্রীমতি গান্ধীকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে যে তিনি অনর্থক পাকিস্তানী আগ্রাসনের আশঙ্কা করছেন এবং মুক্তিবাহিনীকে সাহায়্য করে তিনি ঠিক কাজ করছেন না, কারণ এর ফলেতো ইয়াহিয়া খান রেগে যাবার একটা অজুহাত পেয়ে যাবে!…১৯৭১ সালের অক্টোবর, এমনকি নভেম্বর মাসেও পাকিস্তান ভেঙে পূর্ব বাংলার বের হয়ে যাওয়াকে সমর্থন করতে রাজি হয়নি রাশিয়া। রাশিয়া বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছে অনেক অনেক পরে, যখন ব্যাপারটা দিনের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে যে রাশিয়া সমর্থন দিক বা না দিক বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই, কারণ ততদিনে ইসলামাবাদের সামরিক জান্তা অপরিহার্যভাবে অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে গেছে।’

১৯৭১ সালে ভারতে মার্কিন সাহায্য বেড়ে গিয়েছিল, কারণ পাকিস্তানী শরণার্থীদের জন্যেও সাহায্য আসছিল।… বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় আমেরিকা খুব যে খুশি হয়েছিল তা নয়, তবে মার্কিনিরা পাকিস্তানের বিপক্ষে গিয়ে বাংলাদেশে স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছিল… সি.আই.এ. মুজিব বাহিনীকে অস্ত্রসজ্জিত করেছিল… সত্যিকারভাবে বলতে গেলে, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশ সঙ্কটে পরাজিত হয়নি। তারা জানতো, অল্প কিছু দিন পরেই, যখনই ডলারের প্রয়োজন হবে, মুজিবুর রহমান মার্কিনীদের কথামতোই চলবে।’

যুদ্ধের নয় মাস ধরে চীন কোনো সাহায্যই করেনি কাউকে, না পাকিস্তানকে, না মাওবাদী গেরিলাদেরকে। ‘অস্ত্রের চালান পাঠানোর কথা ছিল, বিদ্রোহ দমনের দ্রুত প্রশিক্ষণ দেবার কথা ছিল, কিন্তু হায়! চীন যত গর্জেছে, তত বর্ষেনি।… পাকিস্তানের হাত-পা যখন কেটে নেয়া হচ্ছিল, তখন চীন বাধা দিতে এগিয়ে আসেনি, এখন (১৬ই ডিসেম্বরের পর!) অঙ্গহীন এক পাকিস্তানকে চীন সাহায্য করতে প্রস্তুত, যাতে সে আরও অনেকদিন প্রতিবন্ধী হয়ে ভিক্ষা করার জন্যে বেঁচে থাকতে পারে…’

‘গ্রীষ্মের আগে ভারত বাঙালিদের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করেনি। ডিসেম্বরের আগে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি পর্যন্ত দেয়নি ভারত। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্পগুলো সত্যিকার অর্থে আগস্টের আগে কাজই শুরু করেনি। … ভারতীয় ও পাকিস্তানী সৈন্যদের মধ্যে দর্শনীয় যুদ্ধ সংঘঠিত হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। দুই দেশের মধ্যে ২১শে নভেম্বর আকাশযুদ্ধ হয়েছিল কিন্তু এই খবর ২৪ শে নভেম্বরের আগে সংবাদমাধ্যমে আসেনি। ভাবখানা যেন এই যে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ সঙ্কটের সমাধান হচ্ছে বলে কেউ খুশি নয়।… ’

ষাটের দশকের সময়ের অন্য অনেকের মতো লেভিও কমিউনিজমে বিশ্বাস করতেন। ১৯৭১ সালে বামপন্থীদের একটি অংশ ভেবেছিলেন যে বাংলায় অচিরেই একটি কমিউনিস্ট বিপ্লব সম্পন্ন হতে যাচ্ছে। পরাশক্তিদের ইচ্ছায় সেই বিপ্লব ‘অঙ্কুরে বিনষ্ট’ হয়েছিল। লেভির বলেছেন: চীন এবং সোভিয়েত রাশিয়া- এই দুই সমাজতন্ত্রী দেশ, ভারত এবং পাকিস্তান কেউই চায়নি, উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চল ‘লাল’ হয়ে যাক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলা বাহুল্য। লেভি দাবি করেছেন, লাল ঝা-াকে ঠেকাতেই বাংলাদেশের জন্ম ত্বরান্বিত করা হয়েছিল। লেভিসহ অনেক বামপন্থীর মতে, বাংলাদেশ যা হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। যা হয়েছে, বামপন্থীদের একটা অংশ তা চাননি।

যুক্তরাষ্ট্র বা ভারত কমিউনিজম ঠেকাতে চেয়েছিল, বুঝলাম, কিন্তু চীন বা রাশিয়া কোন উদ্দেশ্যে বাংলায় লালঝা-ার বিরুদ্ধাচরণ করছিল? তৎকালীন বিশ্বে কমিউনিজমের উপযুক্ত মডেল কী হওয়া উচিত, এবং মূলত, কমিউনিস্ট বিশ্বের মোড়ল কে হবে—এই দুই প্রশ্নে চীন আর রাশিয়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল ষাট ও সত্তরের দশকে। রাশিয়া চাইছিল না মাওবাদী বামপন্থীরা বাংলাকে নিয়ন্ত্রণ করুক; সোভিয়েতপন্থী বামপন্থীদের হাতে বাংলার নিয়ন্ত্রণ চলে যাক, তা আবার চীনের পছন্দ ছিল না। বাঙালি নক্সালপন্থীদের মধ্যে এমন কয়েকটি উপদল ছিল যাদের কাছে চীন বা রাশিয়ার স্বার্থের চাইতে বাংলাদেশের স্বার্থ বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাংলাদেশ যদি এমন একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হয় যেটি রুশ বা চীন, কারোরই ধামাধরা নয়, তবে সেটা এই দুজনের এক জনেরও পছন্দ হবার কথা নয়। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রতো আগাগোড়া কমিউনিজমবিরোধী ছিলই। ভারতের উপরও প্রায় এক কোটি শরণার্থীর চাপ ছিল। পাকিস্তানকে দুর্বল করে দেবার প্রবল ইচ্ছাও ভারতের ছিল। বাংলাদেশের জন্ম হলে এই সবগুলো সমস্যার সমাধান একসাথে হয়ে যায়। তাছাড়া পরাশক্তিরা যখন দেখলো যে তারা যতই বাধা দিক না কেন, বাংলাদেশ আগে পরে স্বাধীন হবেই, কিন্তু সে স্বাধীন দেশটি তাদের নিয়ন্ত্রণে নাও থাকতে পারে, তখন তারা শ্রীমতি গান্ধীকে ‘দাইমার’ দায়িত্বটা তাড়াতাড়ি শেষ করার সবুজ সঙ্কেত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

লেভির তাঁর পুস্তকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুদীর্ঘ পটভূমি বর্ণনা করেছেন। স্বাধীনতার প্রক্রিয়ার শুরু ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি, এর পর পাকিস্তানের জন্ম, বাঙালিদের উপর চালানো তীব্র শোষণের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হওয়া অসন্তোষ, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ এবং অবশেষে গণআন্দোলন, মুক্তিসংগ্রাম পার হয়ে একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বরে এসে শেষ হয়েছে লেভির বই। কেন পাকিস্তান ভেঙে গেল? লেভি মনে করেন, পাকিস্তান আগে পরে ভাঙতোই এবং ভবিষ্যতে আবারও ভাঙবে। পাকিস্তানে জাতীয়তাবাদের বিকাশই হয়নি। ইওরোপে প্রথমে জাতীয়তাবাদের বিকাশ হয়েছে এবং তারপর গঠিত হয়েছে রাষ্ট্র। পাকিস্তানে কী হয়েছে? ঘোড়ার আগে গাড়ি জোতার মতো পাকিস্তানে আগে রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে, পরে হয়েছে জাতি গঠনের প-শ্রম।

শেখ মুজিবুর রহমান কি পাকিস্তান ভাঙতে চেয়েছিলেন? লেভি মনে করেন, শেখ মুজিব চাইতেন ‘পাকিস্তানের মূল ধারণায় ফিরে যেতে, লাহোর প্রস্তাবের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে প্রস্তাবে উল্লেখিত ধারাগুলো প্রয়োগ করতে। পাকিস্তানের স্রষ্টারা একাধিক পাকিস্তান-সম্বলিত যে একটি ফেডারেল রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন শেখ মুজিব চেয়েছিলেন ২০ বছর ধরে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া সেই স্বপ্নকে রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত করতে।’ কিন্তু জনগণ চাইছিল পূর্ণ স্বাধীনতা। লেভির বই পড়ে মনে হয় স্বাধীনতার সার্বক্ষণিক পক্ষশক্তি ছিল একটাই: বাংলাদেশের জনগণ। লেভি তাঁর ফরাসি ভাষায় লেখা মূল বইয়ে লিখেছেন (পৃষ্ঠা নং ১৮৬-১৮৭): ৭ই মার্চ তারিখে ‘কয়েক শত হাজার নারী-পুরুষের কান যেন বঙ্গবন্ধুর দুই ঠোঁটের উপর পাতা আছে… কিন্তু না, আবার ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, আবার সেই স্বায়ত্বশাসনের ধুয়া। শেখ মুজিব জেনেশুনে এবং বুঝে শুনে স্রোতের বিরুদ্ধে গেছেন।… মহাবিপর্যয়ের পূর্বদিন পর্যন্ত শেখ মুজিব পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সাথে আপোসরফা করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। পূর্ব বাংলায় যখন বিক্ষোভ ফুঁসে উঠছে তখনও ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনা করছেন তিনি।’
‘বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হচ্ছিল’ পুস্তকে লেভির মৌখিক অনুমতিক্রমে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ অংশটুকু বাদ দেয়া হয়েছে অনর্থক বিতর্ক এড়ানোর জন্যে (পৃষ্ঠা ২০৭)। এ সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কারণ সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের কথা লিখে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এক সংগঠক প্রচ- সমালোচনার শিকার হয়েছেন। এছাড়া লেভি ৭ই মার্চ তারিখে ঢাকায় ছিলেন না। সুতরাং যে তথ্যগুলো উনি দিচ্ছেন সেগুলো পরের মুখে শোনা, হয়তো এমন কারও মুখে শোনা যিনি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকাকে ছোট করে দেখাতে চান। অনেক নেতা-বুদ্ধিজীবীর মনে বঙ্গবন্ধুর প্রতি এক ধরনের প্রকাশ্য বা গোপন জাতক্রোধ ছিল এবং আছে (ভাবখানা যেন এই: আমরা যা পারিনি, উনি কেন তা পারলেন!)। এছাড়া মহিউদ্দীন আহমদ ‘জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ (পৃষ্ঠা ২৭) বইয়ে লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালের ৭ই জুন তারিখে রেসকোর্স ময়দানে তাঁর বক্তৃতার শেষে ‘জয় সিন্ধু’, ‘জয় পাঞ্জাব’, ‘জয় বেলুচিস্তান’, ‘জয় পাকিস্তান’ বলে তারপর ‘জয় বাংলা’ বলেছিলেন। ১৯৭০ সালের ৭ই জুনকে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তারিখের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে না তো?

লেভির ব্যাখ্যাও সব ক্ষেত্রে নির্ভুল নয়। বঙ্গবন্ধু যদি স্বায়ত্বশাসনই চাইবেন তবে কেন তিনি ৭ই মার্চের ভাষণে ‘এ বারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ কথাগুলো বলতে যাবেন? বঙ্গবন্ধু যে এখানে স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন তা নিয়ে কি সন্দেহের কোনো অবকাশ আছে? ৭১এর সেই সব উত্তাল দিনে বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কোন নেতা স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারতেন? লেভি লিখেছেন, সব পরাশক্তি আর ভারত মিলে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। তাই যদি হয়, তবে ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের বিপুল নির্বাচনী বিজয়ের কী ব্যাখ্যা দেয়া যাবে?

লেভির জন্ম আলজেরিয়ায়, ১৯৪৮ সালে। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে মরক্কো ও প্যারিসে। তুখোর ছাত্র ছিলেন। ফ্রান্সে ভবিষ্যৎ আমলা তৈরির কারখানা Ecole Normale Supérieure  নামক বিশ্ববিদ্যালয়-স্কুলের সেরা ছাত্রদের একজন তিনি। এই স্কুলে তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক Jacques Derrida (১৯৩০-২০০৪) এবং Louis Althusser (১৯১৮-১৯৯০)। লেভি একজন সফল বুদ্ধিজীবী, সফল সাংবাদিক, সফল শিক্ষক, সফল তথ্যচিত্রনির্মাতা, সফল গবেষক, সফল কূটনীতিক, বহু পুস্তকের রচয়িতা (যার মধ্যে একাধিক বহুবিক্রিত, ইওরোপ এবং আমেরিকায়), সফল ব্যবসায়ী, ফ্রান্সের অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি, সুপুরুষ (সর্বার্থে) এবং (লেভির সঙ্গে বাংলাদেশ ভ্রমণে আসা এক সাংবাদিকের মতে) একজন হৃদয়বান মানুষ। প্রাগ যৌবনে লেভি কমিউনিস্ট ছিলেন, কিন্তু উত্তরযৌবনে তিনি কমিউনিজমের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন। সুতরাং ১৯৭৩ সালে ২৫ বছর বয়সের লেভি যা লিখেছিলেন বর্তমান পুস্তকে, দীর্ঘ চার দশক পর আজকের পরিণত লেভি সম্ভবত তার সবটুকুর সঙ্গে নিজেও আর একমত হবেন না।

লেভি ফ্রান্সের একজন প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবী। দীর্ঘদিন তিনি মিতেরঁ সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। প্রাক্তন ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোযির অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন তিনি। লেভি কখনো গাড়ি চালাতে শেখেননি, তবে বেশির ভাগ সময় তিনি লিমুজিনে চলাফেরা করেন। আরাম পছন্দ করেন লেভি, যদি পাওয়া যায়। আফগানিস্তানে একবার নাকি তাঁকে দুটি হোটেলের মধ্যে যেকোনো একটি বাছাই করতে বলা হয়েছিল, একটিতে গরম পানি আছে, কিন্তু হোটেলটি নিরাপদ নয়, আর অন্যটি নিরাপদ হলেও গরম পানি নেই। লেভি গরম পানিসহ অনিরাপদ হোটেলটিই বেছে নিয়েছিলেন। এই স্বনামধন্য মানুষটি জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন বাংলাদেশ, বসনিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তান, সিরিয়া… নিজের উদ্যোগে চাঁদা তুলে উন্নত দুটি রেডিও ট্রান্সমিটার কিনে সেই আশির দশকে আফগানিস্তানে নিয়ে গিয়ে কমান্ডার মাসুদের হাতে সেই ট্রান্সমিটার দুটি তুলে দিয়েছিলেন। বসনিয়ায় মুসলমানদের উপর সার্বদের অত্যাচারের উপর তাঁর তৈরি তথ্যচিত্র দেখেই ইওরোপ আর আমেরিকা নড়েচড়ে বসে, বসনীয় মুসলমাদের রক্ষায় এগিয়ে আসে।

একজন তরুণ লেখকের রচনা হিসেবে ‘বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হচ্ছিল’ বইটির আলোচ্যসূচি, বর্ণনা ও ব্যাখ্যার শৈলী ও মান এতটাই উৎকৃষ্ট যে কেউ বইটি পড়ে তেইশ-চব্বিশ বছরের ছোকরাটির প্রতি ইষৎ ইর্ষান্বিত বোধ করতে পারেন। এই বইয়ে এমন অনেক বিশ্লেষণ আছে যা দেখে বোঝা যাবে উপমহাদেশে, বিশেষত বাংলাদেশে হাল আমলেও যেসব ঘটনা ঘটছে, যেভাবে ঘটছে, সেগুলো কেন ঘটছে, কেন এভাবে ঘটছে। আমাদের বর্তমানের যে অনেকগুলো শিকড় সুদূর অতীতের মাটিতে প্রোথিত সেই শিকড়গুলোর হদিশ নিতে হলে লেভির বইটি আমাদের পড়া উচিত। লেভি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের যে antithesis দিয়েছেন তার আলোকে প্রচলিত thesis গুলোকে পূনর্বিবেচনা করে একটি synthesis বের করা গেলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাবে।

Comments (12)

But combining coenzyme Q10 with conventional steroid treatments doesn t improve hearing in people with sudden deafness propecia ireland

Routine consolidation not recommended Grade C; Level IV viagra prescription name Several strategies exist to bring about the recruitment and growth of multiple follicles

Leave a comment