Scroll Top
19th Ave New York, NY 95822, USA

দুই কুড়ি বছর পর ফিরে দেখা

কুমিরা-জেল-স্কুল-১-768x427

১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসের এক সকাল বেলা। আমাকে কুমিরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে নিয়ে যাচ্ছিলেন আমার ছোটো মামা প্রয়াত হিরন্ময় চক্রবর্তী। সাথে ছিল উত্তর বাড়ির সুজয় চৌধুরী (বাবুন) আর পাশের বড় বাড়ির রতন চৌধুরী। তখন কুমিরা প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল কুমিরা উচ্চবিদ্যালয়ের দক্ষিণ পার্শ্বে, হজরত ডাইল-চাউল মিয়া মসজিদের লাগোয়া। মামা আগে আগে যাচ্ছিলেন। আমরা তিন বন্ধু পিছনে পিছনে। উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠের মাঝখানে এসে আমি বাকিদের ছেড়ে উচ্চবিদ্যালয়ের দিকে রওয়ানা হতে গেলে রতন তাড়াতাড়ি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে বলেছিল: ‘আগে ছোড স্কুল শেষ র্ক। পরে বড় স্কুলত যাইছ্!’

আইসক্রিমওয়ালা রফিকের কাছে বাকিতে অনেক আইসক্রিম ও নিমক সোলেমানী খেয়ে, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার কারণে তার কাছে চিরঋণী থেকে, মুক্তিযুদ্ধের রোগ-শোক-অনাহার সামলে, অবশেষে উচ্চবিদ্যালয়ে প্রবেশের সুযোগ পেলাম ১৯৭৩ সালে। কুমিরা গ্রামের আরও অনেক অধিবাসীর মতো এই স্কুলের সঙ্গে আমারও প্রজন্মান্তরের সম্পর্ক। আমার দুই মামা ডাক্তার কানাই লাল চক্রবর্তী ও অধ্যাপক হিরন্ময় চক্রবর্তী এই স্কুলের ছাত্র। আমার দাদু ঈশ্বর চক্রবর্তী কিছু দিন এই স্কুলের (অস্থায়ী) প্রধান শিক্ষক ছিলেন।

আমি যখন ভর্তি হই তখন কুমিরা বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় ছিল ইংরেজি এল প্যাটার্নের। ক্লাস সেভেনের শ্রেণীকক্ষের পর ছিল দোতলায় ওঠার সিঁড়ি, তার পর ছিল সায়েন্স ল্যাবোরেটরি এবং তার পর ক্লাস সিক্সের শ্রেণীকক্ষ। শ্রেণীকক্ষটি মিলনায়তন হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। এখানে একদিন ঈদে মিলাদুন্নবীর ওয়াজ মেহফিলে যোগ দিয়েছিলাম। মাথায় টুপি নেই দেখে বহিরাগত আলেম আমাদের হুজুর স্যারকে (তাঁর নাম ভুলে গেছি) জিগ্যেস করেছিলেন, শ্রোতাদের মধ্যে অন্য ধর্মের ছাত্র আছে কিনা। হুজুর সম্মতিসূচক মাথা নাড়লে, তিনি আর কিছু না বলে বক্তৃতা শুরু করেছিলেন।

ষষ্ঠ শ্রেণীতে যে শিক্ষকেরা পড়াতেন তাঁদের সবার নাম মনে নেই। একজন ছিলেন সাজাহান স্যার। খুব ভালো মানুষ ছিলেন। হুজুর স্যার ইসলামিয়াত ও আরবি পড়াতেন। মাঝে মাঝে বাংলা, সংস্কৃত ও হিন্দুধর্মও পড়াতেন শিক্ষক-সঙ্কট হলে। তিনি অনেক দিন, কুমিরা উচ্চবিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। খুব ভালো মানুষ ছিলেন তিনি। শুনেছি, আশির দশকের শেষ দিকে নামাজরত অবস্থায় স্কুলেই তিনি পরলোক গমন করেন।

সপ্তম-অষ্টম শ্রেণীতে আমাদের পাড়ার খালেদা ম্যাডামকে পেয়েছি। মনে পড়ছে বি. এ. (ডিগ্রির নাম) সিদ্দিকী স্যারের কথা। সপ্তম শ্রেণীতে তিনি আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। একবার গ্রীস্মের ছুটির পড়া হিসেবে তিনি ইংরেজি ক্রিয়ার প্রেজেন্ট-পাস্ট-পাস্ট পার্টিসিপল রূপ মুখস্ত করতে বলেছিলেন। আমি কিছুই মুখস্ত করিনি, কারণ আমার ধারণা ছিল, ক্রিয়ার বর্তমান রূপের সঙ্গে ইড/ড যোগ করলেই বেশ কাজ হয়ে যায়। ছুটির পর ক্লাসে এসে তিনি আমার পড়া ধরলেন: ‘ফ্লাই ক্রিয়ার অতীত রূপ কী হবে?’ আমি বললাম: ‘এতো খুব সোজা। ফ্লাইড!’। আর যায় কোথা? ক্লাস-ক্যাপ্টেন তাজুলকে দিয়ে বেত আনানো হলো এবং আমার পিঠের উপর স্যার ইচ্ছেমতো হাতের সুখ করে নিলেন।

১৯৭৩ সালে দুজন প্রধান শিক্ষক বদল হয়ে অবশেষে ১৯৭৪ সালে প্রায় তিন দশকের জন্যে প্রধান শিক্ষক হয়ে আসলেন নজির আহমদ চৌধুরী। মৃতপ্রায় কুমিরা উচ্চবিদ্যালয়কে তিনি যেন পুনরুজ্জীবিত করলেন। বিভিন্ন স্কুল থেকে ভালো ছাত্রেরা এসে কুমিরা উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হতে শুরু করলো। হেডস্যারের ছেলে (প্রয়াত) ইউছুফ ফারুক চৌধুরীও পড়তো আমাদের সঙ্গে। আগেও কুমিরা স্কুলে হোস্টেল ছিল, কিন্তু নজির স্যার এসে কুমিরা উচ্চবিদ্যালয়কে প্রায় আবাসিক বিদ্যালয়ে পরিণত করলেন। এস.এস.সি. ও বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফল ভালো হতে শুরু করলো। ১৯৭৫ সালে আমি ও ইলা চৌধুরী মাসে ৩০ টাকা করে সিনিয়র বৃত্তি পেয়েছিলাম। আমাদের বৃত্তি পাওয়ার প্রধান কারণ অবশ্য ছিল অধ্যাপক হিরন্ময় চক্রবর্তীর কঠিন পরিশ্রম।

১৯৭৩ সালের যে শিক্ষকদের কথা মনে পড়ে তাঁরা হচ্ছেন, সুভাস বাবু (পদবী বিস্মৃত), মৃণাল কান্তি বড়–য়া, খোরশেদ আলম। স্কুলের পরও আমি, মিসবাউল্লাহ নিজামী, ইলা চৌধুরীসহ বিভিন্ন ক্লাসের আরও কয়েকজনকে খোরশেদ স্যার অঙ্ক করাতেন, বিনা পারিশ্রমিকে। একবার তিনি বাংলাদেশের ভূগোল পড়ানোর জন্যে সিঁড়ির পাশের শ্যাওলাপড়া দেওয়ালে রঙিন খড়িমাটি দিয়ে বাংলাদেশের অদ্ভুত সুন্দর এক মানচিত্র এঁকেছিলেন। যতটুকু মনে পড়ে, তখন শিক্ষকেরা মাসে ২০০ টাকার বেশি বেতন পেতেন না। এই সামান্য টাকায় কীভাবে তাঁদের সংসার চলতো Ñ তা ভেবে আমরা সেই কিশোর বয়সেই বিস্ময়বোধ করতাম।

১৯৭৪ সালে নতুন কয়েক জন শিক্ষক যোগ দিয়েছিলেন স্কুলে। সামসুল আলম (বাণিজ্য), রবীন্দ্রলাল চক্রবর্তী (বাণিজ্য/অর্থনীতি), রবীন্দ্রলাল দে (বাংলা), ফোরক আহমেদ (ইংরেজি), অধীর কান্তি দাশ (বাংলা), দীপক দাশ (ইংরেজি/অংক)। নজির আহমেদ চৌধুরী স্যারের বোনও (নাম ভুলে গেছি) আমাদের শিক্ষিকা ছিলেন। রবীন্দ্রলাল দে-স্যারের হস্তাক্ষর ছিল অত্যন্ত সুন্দর। শুধু তাই নয়, কয়েক রকম সুন্দর হস্তাক্ষরে তিনি লিখতে পারতেন। স্কুলের প্রায় সব বিজ্ঞপ্তি তিনি নিজের হাতে লিখতেন। ব্যাকরণ ও সাহিত্য পড়াতেন চমৎকার। খেলাধুলার দায়িত্বে ছিলেন ইছাক স্যার। আমার সময়ের শিক্ষকদের মধ্যে বেশির ভাগই দক্ষ ও আন্তরিক ছিলেন। নবম শ্রেণীতে আমার ইচ্ছা ছিল বিজ্ঞান বিভাগে যাবার। পারিবারিক চাপে আমাকে বাণিজ্য বিভাগে যেতে হয়। বাণিজ্য বিভাগে সাধারণ বিজ্ঞান পড়াতেন সুভাস স্যার। মনে আছে, ১৯৭৬ সালে তিনি পুরো জানুয়ারি মাস জুড়ে বিশ্বের খ্যাতনামা বিজ্ঞানীদের জীবনকাহিনি শুনিয়েছিলেন।

নজির স্যার আসার আগে কুমিরা স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। নাটকও হতো। ১৯৭২ সালে মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল, যাতে মৃণাল স্যার পাগলের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। নজির স্যার আসার পর প্রতি শনিবার (যতদূর মনে পড়ে তখনও রবিবার ছুটি ছিল) বিকেলে উপস্থিত বক্তৃতা, নির্ধারিত বক্তৃতা, গান ইত্যাদি হতো। এমনি এক অনুষ্ঠানে মৃণাল স্যারের মুখে শুনেছিলাম রজনীকান্তের ‘তুমি মঙ্গল কর, নির্মল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’ গানটি। অনুষ্ঠানটি সম্ভবত মাহমুদুল হক স্যারের এম. এ. পাশ করা উপলক্ষে আয়োজিত হয়েছিল। মাহমুদুল হক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে যোগ দেবার আগে কিছুদিন কুমিরা উচ্চবিদ্যালয়ে আমাদের ক্লাস নিয়েছিলেন।

১৯৭৬ ও ১৯৭৭ সালে আমরা দুই দুটি নাটক করেছিলাম। ততদিনে নজির আহমেদ স্যার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর পছন্দ করতেন না। স্কুল থেকে কোনো টাকাও দিতেন না নাটক করার জন্যে। আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলে নাটকের খরচ জোগাড় করতাম। যা টাকা বাঁচতো স্কুল ফান্ডে জমা দিতাম। দুই দুটি দেয়াল পত্রিকা বের হয়েছিল আমার হাতে: ‘কচিকদম’ ও ‘সবুজ কদম’। নাটক ও দেয়াল পত্রিকায় আন্তরিকভাবে সহায়তা করতেন খোরশেদ স্যার। নাটকও তিনিই পরিচালনা করতেন। হোস্টেলের কলেবর যত বাড়ছিল, দিন দিন সাংস্কৃতিক কর্মকা-ও তত কমছিল। আমি জানি না, ১৯৭৭ সালের পর কুমিরা উচ্চবিদ্যালয়ে আর কোনো নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল কিনা।

প্রধান শিক্ষক নজির আহমেদ চৌধুরী আমাদের ক্লাস নেবার সময় খুব একটা পেতেন না। তবে বৃত্তি পরীক্ষা ও এস.এস.সি. পরীক্ষার প্রস্তুতির সময় সকাল বেলা তিনি আমাদের পড়িয়েছেন। খুব ভালো ইংরেজি ও অংক পড়াতেন। একবার বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করার সম ফার্সি ভাষার ইংরেজি প্রতিশব্দ লিখেছিলাম ‘ফ্রেঞ্চ’। তিনি লাল কালির অফিস পেন দিয়ে কেটে ইংরেজিতে লিখেছিলেন ‘পার্সিয়ান’। লেখাটা এখনও চোখে ভাসছে। আর একবার ‘বিগ এমাউন্ট অব মানি’ না লিখে কেরদানি করে লিখেছিলাম: ‘ম্যামথ এমাউন্ট অব মানি’। চেয়ারে বসা হেডস্যার আমার মাথার দিকে হাত বাড়াতেই আমি আমার কানটা এগিয়ে দিয়েছিলাম। কান ধরে তিনি বলেছিলেন: ‘শব্দ একটা শিখছস বলেই সেটা যেখানে সেখানে ব্যবহার করতে হবে!’ ১৯৭৬ সালে হেডস্যারের এক বন্ধু নবম শ্রেণীতে আমাদের জগদীশ চন্দ্র বসুর ‘কবিতা ও বিজ্ঞান’ পড়িয়েছিলেন। একটিই ক্লাস নিয়েছিলেন তিনি, মাত্র ৪৫ মিনিট। তিনি বলেছিলেন: একট মড়া, শুকনো গাছ দেখলে বৈয়াকরণ বলবেন: ‘শুষ্কং কাষ্ঠং তিষ্ঠতি অগ্রে’, আর কবি বলবেন: ‘নীরস তরুবর পূরব ভাগে!’ সেই শিক্ষকের নাম ভুলে গেছি, কিন্তু তাঁর অদ্ভুত সুন্দর পড়ানোর ধরন এখনও মনে আছে।

সহকারী প্রধান শিক্ষক ফোরক আহমদ সাহেব সব সময় সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পড়তেন। মুখে দাড়ি ছিল। কখনই তাঁকে রাগতে দেখিনি। আমাদের যখন বেত দিয়ে শাস্তি দিতেন তখন মুখে একটা হাসি লেগেই থাকতো। তিনি অফিসে বসে হাঁচি দিলে পুরো স্কুল যেন কেঁপে উঠতো। পিঠ সোজা করে বুক চিতিয়ে হাঁটতেন তিনি। নবম শ্রেণীর ইংরেজি প্রথমপত্র ক্লাসে একদিন শিক্ষকের মর্যাদা প্রসঙ্গে বলেছিলেন: ‘শিশির যদি কোনো একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়, সেদিন এই স্কুল-শিক্ষককে সম্মান করতে সে ভুলবে না আশা করি।’ স্যারের আশীর্বাদ সত্য হয়েছে, কিন্তু সাক্ষাতে সম্মান করার সুযোগ জীবনে কোনোদিন পাইনি।

প্রধান শিক্ষক নজির আহমেদ চৌধুরি দক্ষ প্রশাসক ছিলেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্থ সংগ্রহ করে তিনি কুমিরা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রভূত কাঠামোগত উন্নতি সাধন করেন। সারা বাংলাদেশ থেকে বাপে তাড়ানো, মায়ে খেদানো ছাত্রেরা এসে কুমিরা উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হতে শুরু করে। কুমিরা স্কুলের নাম হয়ে যায় ‘জেলস্কুল’। স্কুলে কড়া শাসন ছিল। অনেকে সে শাসন সহ্য করতে না পেরে হোস্টেল ছেড়ে পালাতো। একবার এক আবাসিক ছাত্র পায়ে শিকল তালাবন্ধ অবস্থায় হোস্টেলের দোতলা থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে। তার পর পাশ্ববর্তী রেললাইনে গিয়ে পাথরের আঘাতে তালাটি ভেঙে, পনেরো টাকায় শিকলটি বিক্রি করে, ট্রেনের টিকেট কিনে নিজের বাড়ি ফিরে যায়। তখনও আগের দিন কেনা শিকলটির দাম পরিশোধ করা হয়নি। আরেকবার এক ছাত্র ক্যান্টিনের ছুরি নিয়ে শঙ্কর দিঘীর পাড়ে পোস্টাফিস ডাকাতি করতে গিয়েছিল। এগুলো অবশ্য ব্যতিক্রমী ঘটনা। বাধ্য হয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে উঠেছিল Ñ এমন দুষ্ট ছাত্রও কম ছিল না।

১৯৭৬ সাল থেকে নজির আহমেদ স্যারের সাথে মনোমালিন্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সময়ের দক্ষ শিক্ষকেরা একে একে বিদ্যালয় থেকে বিদায় নিতে শুরু করলেন। এঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলেন নজির স্যারের প্রাক্তন ছাত্র। কয়েক বন্ধুকে নিয়ে হেড স্যারের অফিসে গিয়ে আমি এই ঘটনার প্রতিবাদ করেছিলাম। স্যার খুব একটা রাগ করেননি। শুধু বলেছিলেন, ‘কেন তাঁরা চলে যাচ্ছেন, সেটা তোমাদের আমি বলতে পারবো না। আর, শিক্ষার মান ঠিক রাখার দায়িত্ব প্রধান শিক্ষকের, ছাত্রদের নয়।’ শিক্ষকেরাও অবশ্য সবাই ধোয়া তুলসীপাতা ছিলেন না। যাই হোক, ১৯৭৮ সালে আমি এস.এস.সি. পাস করার পর আমার সময়ের প্রায় সব শিক্ষকই ভিন্ন পেশায় চলে গেছেন। চলে গিয়ে শিক্ষকদের অবশ্য উপকারই হয়েছিল। কিন্তু ক্ষতি হয়েছিল স্কুলের। স্কুলের ব্যাংকব্যালেন্স বাড়ছিল, শিক্ষার ব্যালেন্স (আমার মতে) তলানিতে গিয়ে ঠেকছিল। রবীন্দ্রলাল দে বা খোরশেদ আলমের মতো ভালো শিক্ষককে দিয়ে ব্যাঙ্কে কাজ করানো জাতির জন্যে বিশাল এক অপচয়!

চার বছর পর, ১৯৮২ সালে এক সকালবেলা স্কুলের নবম শ্রেণীতে এক তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে হোস্টেলের ছাত্রেরা হকিস্টিক ইত্যাদি হাতে বেরিয়ে এসে আমাদের পাড়ায় স্থানীয় ছাত্রদের বাড়িতে ঢুকে তাদের মারধোর করে। মারধোর করে পথচারীদেরও, আমার চোখের সামনে। সেদিন বিকালে এই ঘটনার তদন্ত করার জন্যে এক সভা আহুত হয়। সভার সভাপতি ইউ.এন.ও. সবার কাছে কী ঘটেছিল তা জানতে চাইছিলেন। আমি তাঁকে ঘটনা সম্পর্কে প্রধান শিক্ষকের বক্তব্য কী তা জানাতে অনুরোধ করি। আমার নাম-ঠিকানা লিখে নেওয়া হয়। কদিন পরেই আমিসহ প্রায় জনাবিশেক লোককে আসামি করে ছিনতাই, মারপিটের মতো অপরাধের উল্লেখ করে একাধিক মিথ্যা ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয় কুমিরা উচ্চবিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে।

এই ঘটনার প্রেক্ষাপট ছিল মূলত ইউনিয়ন-পলিটিক্স। সে সময়ে কুমিরার চেয়ারম্যান ছিলেন নূরউদ্দীন চৌধুরী যাঁর প্রতিপক্ষ ছিলেন প্রাক্তন চেয়ারম্যান জহুর আহমেদ চৌধুরী। এই দুইজনের পরিবারের মধ্যে বহু যুগ ধরে দ্বন্দ্ব চলছিল, হয়তো এখনও চলছে। কুমিরার গ্রামীণ রাজনীতিতে এই দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে, হেডস্যার যে কোনো কারণেই হোক, জহুর আহমেদ চৌধুরীর পক্ষাবলম্বন করেছিলেন, যদিও এই ইউনিয়ন-পলিটিক্সে যোগ দেয়া তাঁর জন্যে অপরিহার্য ছিল না। মামলাগুলোতে তাদেরই আসামী করা হয় যারা কোনো না কোনোভাবে নজির আহমেদ চৌধুরীর সিন্ধান্তের সাথে একমত নন। ঘটনাক্রমে তারা সবাই আবার নূরউদ্দীন চৌধুরীর পক্ষের লোক ছিল। আমরা কয়েকজন ছিলাম পরিস্থিতির শিকার। আমরা বহু রাত গ্রেপ্তার এড়াতে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম। ফোরক সাহেব ও হুজুর স্যার একবার আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে গিয়েছিলেন আদালতে। আমি দুই স্যারকেই সালাম দিয়েছিলাম। স্যারেরা লজ্জায় আমার দিকে তাকাতে পারেননি।

১৯৮৩ সালে আমি উচ্চশিক্ষার্থে প্যারিস চলে যাই। কয়েক মাস পর হেড স্যার খবর পেয়ে বাজারে সবার সামনে বলেছিলেন: ‘আমি শিশিরকে দেশে ফিরিয়ে এনে জেলের ভাত খাওয়াবো!’ নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে কী উচ্চ ধারণা এক প্রধান শিক্ষকের! লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরে আসার পর হেডস্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছে কুমিরা পোস্টাফিসে। স্যার তখন অবসর নিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই কথা বলেছিলেন আমার সঙ্গে। পুরোনো প্রসঙ্গ আর তোলেননি। হয়তো বয়স হওয়াতে তিনি সব ভুলে গিয়েছিলেন। বিনা দোষে আমার প্রিয় শিক্ষক কর্তৃক আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা সেই মামলার কথা আমি এই পঞ্চাশোর্ধ বয়সেও ভুলতে পারিনি।
তেত্রিশ বছর আগের এই তিক্ত স্মৃতির কথা আমি লিখলাম এজন্য নয় যে হেডস্যারের প্রতি এখনো আমি রাগ পুষে রেখেছি। প্রয়াত নজির আহমদ চৌধুরী আমার নমস্য, তিনি আমাকে অনেক ¯েœহ করেছেন ততদিন, যতদিন পর্যন্ত না আমি তাঁর স্বার্থে বিন্দুমাত্র আঘাত দিয়েছি। কিন্তু একজন ছাত্র যদি শিক্ষকের সব কাজ চোখ বুজে সমর্থন করে তাতেই কি সমাজের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল হবে? শিক্ষকের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার অর্থ তাঁকে অসম্মান করা নয়। আমার এই কথাগুলো লিখে রাখার দুটো কারণ রয়েছে। প্রথমত, এই ঘটনা কুমিরা উচ্চবিদ্যালয়ের ইতিহাসের অংশ। দ্বিতীয়ত, এই ঘটনা প্রসঙ্গে আমি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান একটি বিশেষ সমস্যা প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

বাংলাদেশে বহু হেডমাস্টার, প্রিন্সিপাল, চেয়ারম্যান, ডীন, উপাচার্য রয়েছেন যাঁরা প্রতিভাবান, দক্ষ, ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই হয়তো সৎ। কিন্তু মানসিকতায় এঁরা স্বৈরাচারী। কোনো বিরোধিতা, ভিন্ন মত এঁরা সহ্য করতে পারেন না। অন্য কোনো কাছাকাছি মানের প্রতিভাবানের উপস্থিতি এঁরা মেনে নেন না। নিজের ক্ষমতা বজায় রাখতে যে কোনো উপায় অবলম্বন করতে এঁদের বাধে না। এ ধরনের শিক্ষকেরা সহকর্মী শিক্ষকদের সঙ্গে প্রায় কাজের লোকের মতো ব্যবহার করে থাকেন। আবার উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা, ক্ষমতাসীন দলের জননেতা ও ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের সামনে এঁরা বিনয়ে বিগলিত হন। এরা শক্তের ভক্ত, নরমের যম (জিয়াউর রহমান যখন ঢাকা ট্রাঙ্করোড দিয়ে যেতেন তখন আমরা ছাত্রছাত্রীদের রোদের মধ্যে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে হাততালি দেওয়ানো হতো, যাতে জিয়াউর রহমান মুগ্ধ হয়ে স্কুলের ফান্ডে দু চার পয়সা খয়রাত করে যান!)। স্থানীয় রাজনীতিবাজদের একটি অংশ এ ধরনের শিক্ষককে সমর্থন দিয়ে যায়। তাতে নিজেদের সুবিধা হলেও শিক্ষার সাড়ে বারোটা বেজে যায়।

বিন্দুমাত্র আত্মসম্মানবোধ আছে এমন কারও পক্ষে এ ধরনের শিক্ষকের অধীনে কাজ করা সম্ভব? যে শিক্ষকের আত্মসম্মান নেই তাঁর কাছে শিক্ষার্থীরা কী শিখবে? আমার শিক্ষকদের আত্মসম্মান ছিল বলেই তাঁরা একে একে মনোবেদনা নিয়ে কুমিরা উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিদায় হয়েছিলেন।

কোনো প্রতিষ্ঠান আর দেশের প্রশাসনের মধ্যে খুব একট তফাৎ নেই। শাসক যখন স্বৈরাচারী হয়, তখন দেশের কিছু উন্নতি হয় বটে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি, টেকসই উন্নতি প্রায় কখনই হয় না। যে কোনো স্বৈরাচারী প্রশাসক ফরাসি স¤্রাট নেপোলিয়ন বা হিটলারের মতো। নেপোলিয়নের নেতৃত্বে ফ্রান্স উনবিংশ শতকে কয়েক দশক ইওরোপের সেরা রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু নেপোলিয়নের মারাত্মক কিছু ভুলের কারণেই ফ্রান্স কয়েক শতাব্দী ধরে পিছিয়ে আছে, সামনেও কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে থাকবে। যেকোনো স্বৈরাচারী ভুল করতে বাধ্য। আমার সময়ের তুলনায় কুমিরা উচ্চবিদ্যালয়ে দালান এখন কিছু বেশিই আছে। শিক্ষাদানের মানের দিক থেকে বিদ্যালয়টি আমার সময়ের তুলনায় এগিয়েছে, নাকি পিছিয়েছে? এগিয়ে থাকলে আমার খুশির সীমা থাকবে না।

আরও যে একটি কারণে এ কথাগুলো লিখলাম সেটি হচ্ছে এই যে স্বৈরাচারী শিক্ষক ও তাঁদের সমর্থক-তাঁবেদারেরা ভুলে যান যে শিক্ষাদান একটি টিমওয়ার্ক। একজন মাত্র শিক্ষক দারুণ ভালো পড়ালেই ছাত্রেরা সুশিক্ষিত হয়ে উঠবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য সুউচ্চ ভবন, সুপুষ্ট ব্যাংকব্যালেন্স অপরিহার্য নয়। শিক্ষাদানের জন্যে দুটি জিনিষ দরকার: আগ্রহী ছাত্র আর সুযোগ্য শিক্ষক। এ দুটি শর্ত পূরণ হলে গাছতলাতেই উচ্চ-মহা-বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠতে পারে। কুমিরা, সীতাকু-, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে জড়িত সকলেই আশাকরি একদিন এ বিষয়ে একমত হবেন যে: ১. শিক্ষাঙ্গন রাজনীতি-ধান্দাবাজীর জায়গা নয়; ২. স্বৈরাচারী মানসিকতা শিক্ষার দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি করে থাকে; ৩. গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছাড়া সুশিক্ষা সম্ভব নয়; ৪. সুশিক্ষা ছাড়া উন্নত জাতি গঠনের স্বপ্ন কখনই পূরণ হবে না।

ড. শিশির ভট্টাচার্য্য
প্রাক্তন ছাত্র (১৯৭৮), কুমিরা বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়
অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Comments (13)

Lasix Without Prescriptions

Dental Prophylaxis Amoxicillin

buy cialis with paypal Some drugs, such as anti infectives, immunosuppressants, and chemotherapy, are prescribed to maximize the effect of the initial dose, although the full therapeutic benefit may not be observed for days, weeks, or even months

Leave a comment