Scroll Top
19th Ave New York, NY 95822, USA

মন্ট্রিয়লের তিন কন্যা ও শিবঠাকুরের গল্প

Painting by Dipankar Ganguly

“বিষটি পড়ে টাপুর টাপুর নদে এলো বান;
শিবঠাকুরের বিয়ে হবে তিন কন্যে দান।
এক কন্যে রাঁধে বাড়ে এক কন্যে খায়
আর এক কন্যে রাগ করে বাপের বাড়ি যায়।”
(প্রচলিত ছড়া)

১. প্রথম কন্যা: যশকিরণ

পাঞ্জাবের জলন্ধরের মেয়ে যশকিরণ (হিন্দি বা পাঞ্জাবিতে ‘য়্যাশকিরণ’)। হিন্দু পাঞ্জাবি জোতদার বাপের একমাত্র মেয়ে। ভাই নেই। বাপ ছিলেন অতি রক্ষণশীল। তাই যশকিরণের স্কুলে যাওয়া হয়নি। মাতৃভাষা পাঞ্জাবি ছাড়া আর কোন ভাষাই সে ঠিকমত বলতে পারে না। তবে হিন্দি ছবি দেখার সুবাদে কাজ চালানোর মতো হিন্দি বলাটা আসে। বাপ বেঁচে থাকতেই সুখদেব নামে দেখতে-শুনতে ভালো, লেখাপড়া-জানা এক গরীব ছেলের সাথে বিয়ে হয় যশকিরণের। বাপ দেখেশুনেই বিয়ে দিয়েছিলেন। সুখদেবের যেহেতু কোন চালচুলো ছিল না সেহেতু বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতেই তার স্থান হলো। শিক্ষিত স্বামীকে দেবতার তুল্য মনে করে সেবা করতো যশকিরণ। স্বামীর কথা তার কাছে বেদবাক্য। স্বামী, বুড়ো বাপ, প্রচুর ভূ-সম্পত্তি, সর্সে-গাজর-মেথি-বাঁধাকপির ক্ষেত আর এক দঙ্গল চাকরবাকর নিয়ে যশকিরণের দিন ভালোই কেটে যাচ্ছিল। ছেলে-মেয়েও হলো দু’টি: জাহ্নবী আর ব্যাসদেব।
কিন্তু সংসারে অন্য অনেকের মতো যশকিরণের কপালেও সুখ সইলো না। পট করে বুড়ো বাপটা একদিন পটল তুললো। বাপের মৃত্যুতে সাধারণত যেমন হয়ে থাকে, যশকিরণ কিন্তু চোখে অন্ধকার দেখলো না, কারণ মাথার উপর স্বামী ছিলেন। শ্রাদ্ধ-শান্তির ঝক্কি-ঝামেলা কেটে যাবার পর একদিন রাতে অন্তরঙ্গ মুহুর্তে সুযোগ বুঝে সুখদেব যশকিরণকে জানালো, সে বিদেশে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সপ্তাহখানেক পরেই কানাডা নামে এক দেশে চলে যাবে সে। রামকিষণ নামে তার এক দালাল বন্ধু (যাকে যশকিরণও ভালোভাবে চেনে) পাসপোর্টের ব্যবস্থা করেছে। এখন যশকিরণ তার জমি বিক্রি করে দালালের টাকাটা দিয়ে দিলেই হয় (যশকিরণের বাপ বুদ্ধিমান ছিলেন। তিনি মৃত্যুর আগে সব জায়গাজমি যশকিরণের নামে লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন)।
যশকিরণের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও সে কোনমতে সামলে নিয়ে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে জিগ্যেস করলো:‘ওউর হাম?’ সুখদেব মিষ্টি হেসে বললো ‘তোমরাও যাবে। আগেতো আমি যাই। কাগজপত্রের ব্যবস্থা করি। তারপর তোমাদের নিয়ে যাবো। কি করবে এখানে পড়ে থেকে? এই জায়গা-জিরাত-চাকর-বাকর অনেকতো হলো। এই দেখো, কেমন সুন্দর জায়গা এই মন্ট্রিয়ল।’ বলে সুখদেব পকেট থেকে বিদেশের ছবিওয়ালা একটা সুন্দর ভিউকার্ড বের করে দেখালো। ‘ভালো করে দেখো! কোথায় তোমার জলন্ধর আর কোথায় কানাডার মন্ট্রিয়ল! এখানে একবার গিয়ে পড়তে পারলে মানবজীবন সার্থক! রামকিষণ বলেছে, সেখানে সরকার মাসে মাসে অমনি অমনি হাজার ডলার দেয়। প্রতি বাচ্চার জন্য ৩০০ করে ৬০০ ডলার। ঘরে বসে তুমি ১৬০০ ডলার পাচ্ছো। এর পরও তুমি যদি কাজ করতে চাওতো সে তোমার ব্যাপার। রামকিষণের দুই ভাই থাকে মন্ট্রিয়লে। ওরাতো লালে লাল হয়ে গেল। নতুন বাড়ি উঠছে ওদের দেখনি?’ যশকিরণ কিছু বলতে পারে না। নিজের চোখেই তো সে দেখেছে এক সময় নুন আনতে পান্তা ফুরাতো যে রামকিষণদের তারা এখন নতুন বাড়ি করছে। আর তাছাড়া স্বামী সুখদেবের উপর যশকিরণের অগাধ বিশ্বাস।
তড়িঘড়ি করে জমি বিক্রি করে দিল সুখদেব। ভালো দাম পাওয়া গেল না বলে একটু অনুযোগ করছিল যশকিরণ। কিন্তু সুখদেব তাকে বোঝালো, এক মাস আগে মন্ট্রিয়ল পোঁছাতে পারলে যে একটি হাজার ডলার সরকারের কাছ থেকে পাওয়া যাবে তাতে জমির এই কম দাম পুষিয়ে যাবে। আর আপত্তি করলো না যশকিরণ। সপ্তাহখানেক পরেই ঠাকুরঘরে পেন্নাম ঠুকে, বউ-ছেলে-মেয়েকে অশ্রুসাগরে ভাসিয়ে সুখদেব কানাডার উদ্দেশে রওয়ানা হলো। ঈশ্বরের ইচ্ছায় কেউ ধরতে পারলো না রামকিষণের বানানো গলাকাটা পাসপোর্ট। সুখদেব মন্ট্রিয়লে গিয়ে পৌঁছালো এবং যশকিরণকে পাড়ার ফোন দোকানে ফোন করে বললো: ‘সব ঠিকঠাক হ্যায়।’
দিন যায়। সুখদেবের ফোনের সংখ্যা কমতে লাগলো। এক সময় এমন হলো যে মাস দুই তিন কোন ফোনই আসে না তার। অনন্যোপায় হয়ে যশকিরণ দেখা করলো একদিন রামকিষণের সাথে। রামকিষণ তাকে একটা ফোন নাম্বার দিল এবং সেই নাম্বারে ফোন করাতে ধরলো সুখদেবই। অপর প্রান্তের ‘হ্যালো’ শুনে যশকিরণ বুঝতে পারলো সুখদেবই কথা বলছে। কিন্তু সুখদেব ‘হ্যালো, হ্যালো’ করে চললো এবং এক সময় সে লাইন কেটে দিল বা লাইনটা নিজে থেকেই কেটে গেল। আরও কয়েকবার ফোন করলো যশকিরণ। একবার সুখদেব ‘রঙ নাম্বার’ বলে লাইন কেটে দিল। স্বামীর পরিচিত গলা। এতদিনের চেনা। ভুল হবার কথা নয় যশকিরণের। ব্যাপার বুঝতে পেরে যশকিরণের বুকের ভিতরটা যেন (রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ছোটগল্প হৈমন্তী দ্রষ্টব্য) ‘হু হু করিয়া উঠিল’। কি হলো? মানুষটা দু’দিনে এমন করে বদলে গেল! কি করা যায়?
এবারও বুদ্ধিটা রামকিষণই দিল: ‘তুমিও বাচ্চাদের নিয়ে সোজা মন্ট্রিয়ল চলে যাও না কেন? আমি ব্যবস্থা করে দেবো।’ ‘কিন্তু টাকা?’ ‘টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’ রামকিষণ বললো। ‘তোমাদের বসতবাড়ীটা আমার কাছে বন্ধক দিয়ে যাও। ফিরে এসে টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নেবে। ফিরে আসার অবশ্য কোন দরকার হবে না। গেলে দেখবে, কানাডার মাটিতে হেমন্তে ঝরা (ম্যাপল) পাতার মতো ডলার ছড়িয়ে আছে। কুড়াবে আর জমাবে। তাছাড়া, একবার ভেবে তো দেখো, ‘বাড়ি গেলে বাড়ি আবার পাইবে কিন্তু স্বামী গেলে…’ ইত্যাদি, ইত্যাদি।
আরও তিনটি সভিসা গলাকাটা পাসপোর্ট এবং যশকিরণের সপুত্রকন্যা মন্ট্রিয়লে আগমন। রামকিষণ সুখদেবের যে ঠিকানা দিয়েছিল সেখানে গিয়ে দেখা গেল পাখি উড়ে গেছে। রামকিষণের ভাইয়েরা জানালো, সুখদেব মন্ট্রিয়লেই নেই। বছরখানেক ধরে সে এক কুইবেকোয়া সাদা মেয়ের সঙ্গে থাকছিল। যশকিরণের আগমনসংবাদ পেয়ে ক’দিন আগে সে মেয়েকে বগলদাবা করে কানাডার অন্য কোন প্রদেশে চলে গেছে সুখদেব নতুন সুখের সন্ধানে। কানাডা জলন্ধর নয়। এই বিশাল দেশে শিবঠাকুরকে খুঁজে বের করা খড়ের গাদায় হারিয়ে যাওয়া সুঁচ খুঁজে বের করার মতোই কঠিন।
এখন উপায়? দেশে ফেরাতো সম্ভব নয়, কারণ জায়গা-জমি-বাড়িঘর সব গেছে। ভাগ্য ভালো যে জাহ্নবী আর ব্যাসদেবকে কাকাদের বাড়িতে রেখে আসেনি, বুদ্ধি করে সাথে নিয়ে এসেছে! তা নাহলে পরের বাড়িতে ঝি আর জন খেটে মরতে হতো দুধের বাচ্চা দুটোকে। এখন যশকিরণকে এই মন্ট্রিয়লেই কাটাতে হবে বাকি জীবন। কিন্তু কিভাবে? যশকিরণ না জানে ইংরেজি, না জানে ফরাসি। দেশে থাকতে যশকিরণ শুধু ‘ঘর’ সামলাতো, ‘বাইরে’’র সব ব্যাপার বাপ দেখতো, বাপ গত হবার পর স্বামী। এই প্রথম জীবনের বাস্তবতার মুখোমুখি হলো যশকিরণ এবং তাও বিদেশের কঠিন মাটিতে। স্বাভাবিকভাবেই চোখে অন্ধকার দেখলো যশকিরণ।

২. দ্বিতীয় কন্যা: ন্যান্সি

ন্যান্সি হাইতির মেয়ে। গাত্রবর্ণে আফ্রিকান, ধর্মে খ্রিস্টান। অল্প বয়সে হাইতি থেকে এসেছিল আমেরিকায়, সেখানে ‘কাগজ’ না পেয়ে কানাডায়। এখানে কাগজ আর কাজ দুইই জুটলো। টিম হর্টনের সেলসগার্ল। কাজ করতে করতে সহকর্মী গাব্রিয়েলের সাথে ঘনিষ্টতা হলো। বেশ সুন্দর ছেলে, স্মার্ট। ঘনিষ্টতা থেকে প্রেম এবং প্রেম থেকে ন্যান্সির প্র্যাগন্যান্সি। ন্যান্সি মনে মনে ভয় পাচ্ছিল, কিন্তু খবর শুনে অন্য অনেক ছেলের মতো গ্যাব্রিয়েল কেটে পড়লো না। তারা দু’জনে মিলে কোর্টে গেল এবং বিয়ে করলো। যথাসময়ে একটি সুস্থ-সবল কন্যাশিশুর জন্ম দিল ন্যান্সি। নাম রাখা হলো এমিলি। বেশ সুখেই দিন কাটছিল তাদের। দু’জনের আয় থেকে কিছু কিছু জমিয়ে মন্ট্রিয়লের পার্ক এক্সটেনশন এলাকায় একটা বাড়ি কেনারও চিন্তাভাবনা করছিল তারা। চারতলা বাড়ি হবে। দোতলায় নিজেরা থাকবে, বেসমেন্ট আর অন্য তিনটি তলা ভাড়া দেওয়া হবে।
কিন্তু সুখে থাকতে গাব্রিয়েলকে ব্যবসার ভুতে কিলালো। সে একদিন ন্যান্সিকে বললো অন্য তিন হাইসিয়ান বন্ধুর সাথে সে একটি ক্যারিবিয়ান রেস্টুরেন্ট খুলবে এবং বাড়ির জন্য যে টাকা জমেছে সে টাকাটা সে আপাতত রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় খাটাবে। গ্যাব্রিয়েল এক কথায় বিয়েতে রাজি হয়ে গিয়েছিল বলে তার কোন প্রস্তাবেই ন্যান্সি না করে না। খুবই ভালোবাসে তাকে ন্যান্সি। ‘তুমি যা ভালো বোঝ তাই করবে। কিন্তু রেস্টুরেন্ট ব্যবসার কোন অভিজ্ঞতাই তো তোমার নেই। অসুবিধা হবে না?’ গ্যাব্রিয়েল উত্তর দিল: ‘অভিজ্ঞতা কাজ করতে করতেই হয়। টিম হর্টনে কফি বিক্রি করছি, এখানে অন্য খাবার বিক্রি করবো – পার্থক্যতো মাত্র এটুকুই! কত আর পরের জন্য খাটবো? রেস্টুরেন্ট ঠিকমতো চললে দেখবে বছর দুয়েকের মাথায় আমাদের বাড়ি হয়ে গেছে।’
যে কথা সেই কাজ। টিম হর্টনের চাকরি ছেড়ে গাব্রিয়েল এক ক্যারিবিয়ান রেস্টুরেন্টের সহমালিক বনে গেল। দুঃখের বিষয়, মাত্র তিন মাস মাত্র স্থায়ী হলো গাব্রিয়েলের দিবাস্বপ্ন। গাব্রিয়েল বুঝলো, টিম হর্টনের সাথে অন্য রেস্টুরেন্টের পার্থক্য অনেকখানিই। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আরও কিছু দিন পর সঞ্চয়ের সবগুলো টাকা জলাঞ্জলি দিয়ে গাব্রিয়েল ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন হলো।
ন্যান্সি এখনও টিম হর্টনে কাজ করে। গাব্রিয়েল কিছু করে না। সরকারের দেওয়া কল্যাণ-ভাতাও নিতে পারে না গ্যাব্রিয়েল কারণ তাহলে ন্যান্সিকেও চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। ন্যান্সি তা করতে রাজি নয় কারণ প্রথমত কল্যাণভাতা নিতে তার আত্মসম্মানে বাধে আর দ্বিতীয়ত পরিবারের মাসিক মোট আয় তাতে কমবে বই বাড়বে না। বউ চাকরে, গৃহস্বামী বেকার – ব্যাপারটা পৃথিবীর সব সমাজেই এখনও কেন জানি একটু অদ্ভুত, হয়তো ব্যাপারটা এখনও নতুন বলেই (খেয়াল করুন, ‘গৃহস্বামী’ বেকার হতে পারে, কিন্তু ‘গৃহবধু‘ বেকার হয় না)। ন্যান্সি আর গাব্রিয়েলের মানসিক দ্বন্দ্ব শুরু হতে দেরি হয় না। রান্না করা, বাচ্চাকে স্কুলে আনা-নেওয়া, বাচ্চাকে খাওয়ানো, ইত্যাদি তথাকথিত মেয়েলি কাজ করতে গাব্রিয়েলের আত্মসম্মানে বাধে। ন্যান্সিও সারাদিন বাইরে কাজ করে এসে ঘরের কাজ একা সামলাতে পারে না। এদিকে তেমন কিছু করার নেই বলে গ্যাব্রিয়েল সারাদিন ঘরে বসে টিভি দেখে আর বীয়র খায়। ন্যান্সি ঘরে ফেরার পর শুরু হয় তার সাথে খিটিমিটি।
এক সময় গ্যাব্রিয়েল ন্যান্সির গায়ে হাত তুলতে শুরু করে। এমিলির মুখের দিকে তাকিয়ে ন্যান্সি প্রথম প্রথম সহ্য করে। কিন্তু সারাদিন হাঁড়ভাঙা খাটুনি খেটে এসে কাহিল শরীরে শক্ত হাতের মারধোর সহ্য করার জন্য হৃদয়ে যে পরিমাণ প্রেম এবং শরীরে যে পরিমাণ তাকত থাকা দরকার তা প্রায়ই জোগাড় করে উঠতে পারে না ন্যান্সি। (মার খেতেও যে যথেষ্ট শক্তির দরকার হয় তা আমরা অনেকেই খেয়াল করি না, কারণ আমরা সাধারণত মার খাই না, পারলে মার দিই!) ন্যান্সির মন বিষিয়ে উঠে এবং একসময় বিয়ের পাট গুছিয়ে বিচ্ছেদের আয়োজন শুরু করে।
গ্যাব্রিয়েল চলে যায় বাড়ি ছেড়ে। ক’দিন ন্যান্সি একা থাকে মেয়েকে নিয়ে। তারপর একদিন গিয়ে গ্যাব্রিয়েলকে খুঁজে পেতে নিয়ে আসে। শিবঠাকুর ফিরে আসেন। কিন্তু আবার যে কে সেই। আবার মারধোর, হৈচৈ, প্রতিবেশির ঘুম হারাম। মানসিক চাপ পড়ে পড়ে এমিলির কচি মনটা চিড়ে চ্যাপটা। গ্যাব্রিয়েল আবার চলে যায় এবং ন্যান্সি তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে, আরও এক বার নয়, বার বার। গ্যাব্রিয়েলকে ছাড়া ন্যান্সি থাকতে পারে না। কারণটা মানসিক, হয়তো কিছুটা শারিরীকও।

৩. তৃতীয় কন্যা: এসমেরাল্দা

এসমেরালদা হাঙ্গেরির মেয়ে। জাতিতে জিপসী। ধর্মে কি কে জানে। বুদাপেস্টে সরকারি চাকরি করতো। সরকারি বৃত্তি নিয়েই কানাডায় এসেছিল। এক বছর বাদে বৃত্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেল। কিন্তু এসমেরাল্দা সিদ্ধান্ত নিল, মন্ট্রিয়লেই থেকে যাবে। শুভানুধ্যায়ী বন্ধুরাও বোঝালো, কি হবে হাঙ্গেরিতে ফিরে গিয়ে? অনর্থক হাঙ্গারে মরবে! তার চেয়ে বরং মন্ট্রিয়লের স্বর্গেই থেকে যাও। কিন্তু থাকবো বললেইতো থাকা যায় না স্বর্গে। তার জন্য বহু পূণ্য করার দরকার হয়, এ জন্মে, নয়তো পূর্ব জন্মে। ফরাসি কোর্স করার সময় মরিস নামে এক কুইবেকোয়া শিক্ষকের সাথে সামান্য ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল এসমেরেলদার। এসমেরালদার আগ্রহে ঘনিষ্ঠতার সে ছোট্ট কুঁড়ি প্রেমের শতদলে প্রষ্ফুটিত হলো।
মরিস ছেলেটা ভালোই। কিন্তু ভালো দিয়ে কী ছাই হবে, এসমেরাল্দার দরকার কানাডায় থাকার কাগজ! বন্ধুরা এসমেরেলদাকে বুদ্ধি দিল: কানাডায় পাকাপাকি ভাবে থাকতে গেল মরিসের সাথে সম্পর্কটাকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া দরকার। কিন্তু মরিস কিছুতেই প্রাতিষ্ঠানিক কোন সম্পর্কে জড়াতে রাজি নয় এসমেরালদার সাথে। মরিসকে বুঝিয়ে রাজি করাতে না পেরে এসমেরাল্দা অনন্যোপায় হয়ে এক দুষ্টবুদ্ধির আশ্রয় নিল। কানাডিয়ান সন্তানের মা- কে কর্তৃপক্ষ কানাডায় থাকতে দিতে বাধ্য হবে – এ ধরণের কোন ধারণার বশবর্তী হয়ে মাস দুয়েক জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল খাওয়া বন্ধ করে দিল সে। ফলে যা হবার তাই হলো। এসমেরাল্দা গর্ভবতী হলো এবং মরিস তা জানতে পেরে গর্ভমোচনের জন্য চাপ দিতে লাগলো। যদিও আসল উদ্দেশ্য কানাডায় থাকা, তবুও ধর্ম আর মানবতার দোহাই দিয়ে এসমেরাল্দা গর্ভমোচনে রাজি হলো না। উপায়ান্তর না দেখে বা কিছুটা অনুভূতিপ্রবণ হয়েও মরিস এসমেরালদাকে বিয়ে করতে রাজি হলো।
বিয়ে হলো। কিন্তু কুইবেকের অভিবাসন কর্তৃপক্ষ এসমেরালদাকে কানাডায় থাকার অনুমতি দিতে রাজি হলো না। তারা শর্ত দিল, এসমেরালদাকে হাঙ্গেরিতে ফিরে গিয়ে আবার ভিসা নিয়ে আসতে হবে। এটাই নাকি নিয়ম। এসমেরালদা আগে জানত না। এসমেরালদা হাঙ্গেরিতে যেতে রাজি নয়। একবার দেশে ফিরে গেলে কতদিনে ভিসার কাগজপত্র আসবে তার কি ঠিক আছে কিছু? ততদিন শিবঠাকুর যে তার জন্যে অপেক্ষা করে বসে থাকবে তারই বা কি এমন নিশ্চয়তা আছে ? এছাড়া কোন কাগজপত্র ছাড়া গর্ভবতী এসমেরালদা কোন মুখেই বা দেশে গিয়ে দাঁড়াবে মা-বাবার সামনে? আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবেরাই বা কি বলবে? সরকারি বৃত্তি নিয়ে কানাডায় গিয়ে ফিরে এসে কাজে যোগ না দেওয়ার কারণে বুদাপেস্টের সরকারি কর্তৃপক্ষই কি তাকে ছেড়ে কথা কইবে?
আমার কথাটি ফুরোলো কিন্তু তাই বলে নটে গাছটি একেবারে মুড়োলো না। যে ধান ভানতে কল্পনা আর বাস্তবের মিশাল দিয়ে শিবঠাকুর আর তিন কন্যার গীত গাইলাম উপরে তা হচ্ছে এই যে এ রকম অজস্র কন্যা ও শিবঠাকুর রয়েছে মন্ট্রিয়লে (হয়তো পৃথিবীর অন্য সব শহরেও) এবং তাদের কারও কারও অবস্থা যশকিরণ, ন্যান্সি বা এসমেরাল্দার চেয়ে অনেক, অনেক বেশি করুণ (হ্যাঁ, রাগ করে বয়ফ্রেন্ডের বাড়ি চলে যাওয়া গাট্টাগোট্টা কন্যাদের হাতে শিবঠাকুরেরও দুরবস্থা হতে পারে, যদিও এ রকম ঘটনার সংখ্যা এখনও কম)। যাই হোক, এ তিনটি দুর্ভাগা মেয়ের কাহিনী আপনাদের শোনালাম এটা বলার জন্যে যে দূর থেকে বিদেশকে চকচকে মনে হতেই পারে, কিন্তু ‘চক চক করিলেই যে সোনা হয় না’ – তা সরেজমিনে যাবার আগে কানে শোনা গেলেও, ঠিক বোঝা যায় না, বিশ্বাসও হয় না।

রচনাকাল: ২০০৬

Comments (9)

Very well writren! সুখপাঠ্য। বাস্তব ঘটনা??

Pxavws Propecia Cigartec Prednisone Xliifw BELIEFS AND TRADITIONS TO Surgery in Ancient Egypt The priestphysicians of Ancient Egypt were held in great esteem.

Leave a comment