প্রথম দিন, ২২শে মে, ২০১৮
দুপুর বারোটার দিকে সস্ত্রীক ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে নামলাম। হুইলচেয়ার-চালক যুবকটিই মুদ্রাপরিবর্তন এবং ভিসার ব্যবস্থা করে দিল কয়েক মিনিটের মধ্যে। ইমিগ্রেশন অফিসার পাসপোর্ট হাতে নিল এবং একটা সিল মারলো। কোনো প্রকার ফর্ম ফিলআপ করা নেই, কিচ্ছু নেই। সব কিছু কী সহজ! হুইলচেয়ার চালক ইংরেজি জানে না বললেই চলে। বার বার তার মোবাইলটা আমার মুখের কাছে এনে আমাকে ইংরেজিতে বলতে বলছিল আমি কী চাই। অনুবাদ অ্যাপস তুর্কি ভাষায় অনুবাদ করে দিচ্ছিল। আমাদের লাগেজ বেশি ছিল বলে বড় একটা ট্রলি জোগাড় করে নিয়ে এল। এয়ারপোর্ট ট্যাক্সি সার্ভিস কাউন্টারে নিয়ে গিয়ে হোটেলে যাবার এবং দুই দিন পর হোটেল থেকে বিমানবন্দরে ফেরার জন্যে ট্যাক্সি ভাড়া করে দিল। কাউন্টারের রিসেপশনিস্ট ইংরেজি বলতে পারে। সবার ব্যবহার এত ভালো যে মনে একটা ভরসার ভাব জাগে।
ট্রলি চালক তুর্কি ভাষায় কী যেন একটা বললো। আমি একটা শব্দ বুঝলাম: ‘এমেনেত’। বুঝলাম, বিমানবন্দরে আমাদের লাগেজগুলো আমানত বা জমা রেখে যাবো কিনা। লাগেজপ্রতি প্রতিদিন যে টাকা লাগবে সেটা যদিও খুব বেশি নয়, তবু ভাবলাম, নিজের লাগেজ নিজের সঙ্গে থাকাই ভালো। ট্রলি এবং হুইলচেয়ার চালকের পেছন পেছন পার্কিঙে পৌঁছেই দেখি আমাদের জন্যে গাড়ি এসে হাজির। ট্রলিচালক এবং হুইলচেয়ার চালককে জিগ্যেস করলাম, কত দিতে হবে। দুজনেই বললো, কিছুই দেবার নিয়ম নেই, তবে বকশিশে দোষ নেই। সামান্য মুদ্রা হাতে তুলে দিলাম। দুজনেই খুশিমনে হাসিমুখে বিদায় নিল।
গাড়ি থেকে তাকিয়ে দেখলাম, ছবির মতো সাজানো বিমানবন্দরের আশপাশ। এখানে-ওখানে গোলাপ বাগান। বিমানবন্দরের কাছেই আমাদের হোটেল। হোটেলের সামনে লাগেজ নামিয়ে লিমুজিনের ড্রাইভার তুর্কিতে যা বললো তাতে একটা শব্দ বুঝলাম : ‘তামাম’, ‘টিপস তামাম’। বুঝলাম টিপসসহই আমি গাড়িভাড়া সম্পূর্ণ পরিশোধ করেছি কিনা। আমি মুখে বললাম, তামাম, তবে হাতে সামান্য মুদ্রাও গুঁজে দিলাম। ড্রাইভারও খুশি হলো বলে মনে হলো। পরে জেনেছিলাম, ‘তামাম’ মানে ইংরেজি ‘ওকে’ বা ‘সব ঠিক আছে’ ধরনের কিছু।
হোটেলে লাগেজ রেখে আশেপাশের এলাকা দেখতে বের হলাম। পেটে ক্ষুধা টের পাচ্ছিলাম। রাস্তায় একটা মুদি দোকানে ঢুকলাম। দোকানের বাইরে এবং ভিতরে বিভিন্ন ধরনের ফল রাখা আছে। ফল কিনতে গেলাম। লোকজন টপাটপ মুখে দিয়ে ফল চেখে নিচ্ছে। আমরাও দেখাদেখি দুই একটা মুখে দিলাম। বেশির ভাগ ফল টক, চেরি পর্যন্ত মিস্টি নয়। দোকানে যে জিনিষটা নতুন লাগলো সেটা হচ্ছে, মরিচ আর বেগুনের শুটকি। শুকানো মরিচ এবং বেগুন দড়ি দিয়ে গেঁথে মালার মতো ঝোলানো রয়েছে। আমরা অল্প চেরি, কলা এবং তুর্কি দই কিনলাম।
প্যারিসে, জার্মার্নিতে তুর্কি কাবাব খেয়েছি, এখন ইস্তাম্বুলে এসে আসল তুর্কি কাবাব খাবো না, তা কি হতে পারে? এক কাবাবের দোকানে ঢুকে কাবাব এবং তুর্কি ঘোল অর্ডার করলাম। আমি না বুঝি তুর্কি, ওরা না বুঝে ইংরেজি, কিন্তু তাতে তুর্কি কাবাবের স্বাদে কোনো হেরফের হলো না। রোজার দিন, কিন্তু লক্ষ্য করলাম, সব খাবার দোকান খোলা। দোকানে কাস্টমার আছে, তবে সম্ভবত অন্য সময়ের তুলনায় কম। অন্তত দুইবার দুই শিশুকে দেখলাম, চিৎকার করে কেঁদে হিজাব-পরা মা-কে খাবার দোকানে নিয়ে গিয়ে খাবার কিনে দিতে বাধ্য করছে। আমরা যে দোকানে কাবাব খেলাম, সেখানে ইফতারের ম্যেনুও রয়েছে। ইফতারের সময় লোক বেশি হয় কিনা জানি না, তবে আমাদের হোটেলের পাশের এক ক্যাফেতে দেখলাম সকালের তুলনায় ইফতারের পরে খদ্দেরের সংখ্যা অনেক বেশি। চা-কফি খেতে খেতে লোকজন চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে, যেমনটা পড়েছিলাম মুজতবা আলীর লেখায়। সিগারেটের ধোঁয়ায় নরক গুলজার।
দোকানে সব প্রায় সব পণ্য মেড ইন টার্কি। চীনারা বোধ হয় তুর্কি বাজারে এখনও ঢুকতে পারেনি। পণ্যের মান ভালো, দাম কম। রাস্তায় বেশির ভাগ লোক পাশ্চাত্য পোষাক পরা। বয়স্ক মহিলারা হিজাব পরেন, কিন্তু নিকাব-পরা কাউকে দেখলাম না। অল্পবয়সীদের মধ্যে বেশির ভাগ পাশ্চাত্য পোষাক পরা। কিছু কিছু কিশোরী-যুবতী হিজাব পড়ে আছে, কিছু শুধু ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকেছে। তবে সবাই যাকে বলে ‘ড্যাম স্মার্ট’, এক বর্ণ ইংরেজি বলতে পারে না, তবু তারা ড্যাম স্মার্ট, যার মানে হচ্ছে, স্মার্ট হবার সঙ্গে ইংরেজি জানার কোনো সম্পর্ক নেই।
মাগরেবের নামাজের আজান দিল। একটা ছাড়া আমাদের এলাকায় দ্বিতীয় কোনো আজান শুনলাম না। খুবই সুরেলা কণ্ঠ। ঘড়ি ধরে দেখলাম এবং এশার আজানে আবার নিশ্চিত হলাম, আজানের স্থায়িত্ব দুই মিনিটের বেশি নয়।
দ্বিতীয় দিন, ২৩শে শে ২০১৮
সকালে প্রাতরাশের টেবিলে গিয়ে দেখা গেল কয়েক ধরনের রুটি, জলপাই, জৈতুন, কয়েক প্রকারের মধু, কয়েক ধরনের পনির, কাটা টমেটো, শশা সাজানো রয়েছে। পানীয়ের মধ্যে রয়েছে দুধ, চা, কফি কিন্তু কোনো প্রকার ফলের রস নেই। পুরো হোটেলের দায়িত্বে আছেন এক দুই মধ্যবয়স্ক মহিলা যাদের মধ্যে একজন হিজাব করেন, অন্যজন করেন না। দুই জনই সহৃদয়, সদাহাস্যময়, কিন্তু একবর্ণ ইংরেজি বলতে পারেন না দুজনের কেউই।
হোটেল থেকে বের হয়ে মেট্রোবাস স্টেশনে গেলাম। মেট্রোবাস ধরে যাবো নিকটবর্তী ট্রাম স্টেশনে এবং সেই ট্রাম আমাদের নিয়ে যাবে হাজিয়া সোফিয়ায়। যাবার পথে ফুটপাথে দেখলাম এক ছেলে মুরগি আর হাঁসের বাচ্চা বিক্রি করছে। দুটি আলাদা কার্টুন পাশাপাশি সাজানো। এটুকুই তার দোকান। ছোটো ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা-মাকে টেনে নিয়ে আসছে হাঁস-মুরগির বাচ্চা কিনে দেবার জন্যে। ফুটপাতে এখানে অনেকেই বিভিন্ন পণ্যের দোকান নিয়ে বসে, তবে এই দোকানের সংখ্যা এত বেশি নয় যে ঢাকা শহরের মতো পথ চলতে কষ্ট হবে।
মেট্রোবাস স্টেশনে টিকেট কিনতে হবে, কিন্তু কীভাবে কিনতে হবে তা বুঝতে পারছিলাম না, কারণ সব কিছুই তুর্কি ভাষায় লেখা। সৌভাগ্যবশত এক ইংরেজি-জানা মহিলা মেশিনে বোতাম টিটে একটি মেট্রোকার্ড করে দিলেন এবং কার্ডে কিছু টাকাও ভরে দিলেন। কার্ডের দাম ছয় বা আট লিরা, প্রতি ভ্রমণ সম্ভবত পাঁচ লিরার মতো। মেট্রোবাসের প্ল্যাটফর্মে কয়েকটি ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েকে ভিক্ষা করতে দেখা গেল। ভিক্ষার ধরণটা অভিনব। আপনার কাছে এসে বলবে, টিস্যুপেপার চাই কিনা। আপনি যা ইচ্ছা দেবেন। আগের দিন রাতেও হোটেলের পাশের রাস্তায় বাচ্চা মেয়েদের ভিক্ষা চাইতে দেখেছি। পরে জেনেছিলাম, এরা সব সিরীয় শরণার্থী। একটি ভিখিরি মেয়েকে আমাদের বিরক্ত করতে দেখে এক তুর্কি যুবক এগিয়ে এসে চমৎকার ইংরেজিতে জিগ্যেস করলেন আমাদের কোনো সাহায্য লাগবে কিনা। ভাগ্যক্রমে আমরা যেদিকে যাচ্ছিলাম, যুবকও সেদিকেই যাবেন মেট্রোবাস এবং ট্রাম সহযোগে। হাজিয়া সোফিয়ার আগের স্টেশনেই নামবেন তিনি।
মেট্রোরেল এবং ট্রাম থেকে যতটা চোখে পড়লো, তাতে প্যারিস বা ভিয়েনার সঙ্গে ইস্তাম্বুলের তফাৎ করার মতো কিছু পেলাম না। বরং অনেক ক্ষেত্রে ইস্তাম্বুল উন্নততর। হাইওয়ে এবং ফ্লাইওভারের পাশের লোকালয়কে শব্দদূষণ থেকে রক্ষা করার জন্যে দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে এবং দেয়ালের গায়ে গুল্ম এবং লতার চাষ করা হয়েছে। চীনেও দেখেছিলাম ফ্লাইওভারের নিচে এমন সবুজায়ন হয়েছে যে কংক্রিটের কুৎসিত ভাবটা অনেকটাই ঢেকে দেয়া গেছে। শুনেছি, ব্রাজিলে ফ্লাইওভারগুলোতে এত এত লতানো সবজির চাষ করা হচ্ছে যে সেগুলো এক একটি ঝুলন্ত ক্ষেত্র বা উদ্যানে পরিণত হয়েছে। ঢাকায় ফ্লাইওভার গুলোর গায়ে বিভিন্ন বিশ্রী পোস্টার লাগিয়ে সেগুলোকে এমন বিশ্রী করে তোলা হয়েছে যে তাকাতে ইচ্ছে করে না। ফ্লাইওভারের নিচে রাখা থাকে মুরগির খাঁচাসহ অন্য আরও হাজারো জঞ্জাল যার মধ্যে শুয়ে হিরোইন কিংবা ইয়াবার মৌতাতে মাতে নেশারুর দল।
ত্রিশের দশকে তুর্কি মেয়েদের সৌন্দর্য্য নিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে এক লেখকের বাহাস হয়েছিল। নজরুল তুর্কি মেয়েদের সুন্দরী বলাতে আপত্তি করেছিলেন সেই লেখক। নজরুল তখন বলেছিলেন: ‘আপনি কটা তুর্কি মেয়ে দেখেছেন মশাই?’ প্রকৃতপক্ষে মধ্য এশিয়ায় বহু জাতির মিশ্রণ হয়েছে বলে সুন্দর নারীপুরুষের সংখ্যা এই এলাকায় বেশি হবারই কথা। তুর্ক নারীপুরুষের শরীর ফিট, গঠন চমৎকার। প্রায় প্রতিটি রাস্তায় মেয়েদের একটি পার্লার, ছেলেদের একটি সেলুন থাকবেই। অনেক পার্লারে ট্যাটু করার ব্যবস্থাও আছে যদিও মুসলিম সমাজে সাধারণত ট্যাটু করাকে নিরুৎসাহিত করা হয়। এর মানে হচ্ছে, তুর্কি নারীপুরুষ, অন্ততপক্ষে নতুন প্রজন্ম, সৌন্দর্য-সচেতন। লোকজন প্যারিস বা লন্ডনের তুলনায় রুচিশীল পোশাক পরে। নারীপুরুষ সবার গায়ে বিখ্যাত সব মার্কের কাপড়। ইস্ত্রির ভাঁজটি মেট্রোবাস বা ট্রামের ভিড়ের মধ্যেও অটুট রয়েছে। পুরুষেরা সবাই পাশ্চাত্য পোষাক পড়ে। আরবি (মূলত এটা প্রাচীন রোমান পোষাক) ধাঁচের জেল্লাবা পরা কাউকেই চোখে পড়েনি। হিজাবপড়া নারী রাস্তায় দেখেছি, কিন্তু বাস বা ট্রামে তাদের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো মনে হয়নি। লক্ষ্য করেছি, অল্পবয়সী যে মেয়েরা হিজাব করে তাদের কেউ কেউ মুখের একাংশ ঢেকে রাখে। বয়স্ক মহিলারা মুখ ঢাকেন না।
‘এখানে লোকজনতো ইংরেজি জানেই না বলতে গেলে। আপনি কীভাবে এত ভালো ইংরেজি বলছেন?’ ইংরেজি-ভাষী তুর্কি যুবক উত্তর দিল: ‘এখানে ক্লাস থ্রি বা বছর দশেক বয়স থেকে স্কুলে ইংরেজি বিষয়টি বাধ্যতামূলক। যারা ইংরেজি বলতে পারে না তারা অল্প বয়সে স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। আমি মাস্টার্স শেষ করেছি। আমার মতো যাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি আছে, তাদের ইংরেজি না জানার কোনো কারণ নেই।’ এই সপ্রতিভ যুবক, তার নাম ধরা যাক এহেমেত, নিজেদের পারিবারিক জুতার ব্যবসা দেখে। ইতিমধ্যে সে ইতালি ও লন্ডন ভ্রমণ করেছে ব্যবসা উপলক্ষে। তার স্ত্রী কাজ করে, তাদের একটিমাত্র বাচ্চা, একটি মেয়ে। ‘একটিমাত্র বাচ্চা কেন আপনার? সবাইতো বলে মুসলমানেরা অন্যদের তুলনায় বাচ্চা বেশি নেয়!’ এহেমেত জবাব দিল: ‘আমাদের এক প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট চাইতেন, সব তুর্কি দম্পতি কমপক্ষে তিনটি করে বাচ্চা নিক। কিন্তু একটি বাচ্চাই মানুষের মতো মানুষ করা অনেক কঠিন। এই দেখুন না, আমাদের মেয়েটিকেই স্কুলের পর আমার শাশুড়ির কাছে রাখতে হয়। ওকে ভালো স্কুলে পড়াতে গেলে অনেক লিরার দরকার। তিনটি বাচ্চাকে সুশিক্ষা দেবার আর্থিক ক্ষমতা আমাদের নেই, বেশির ভাগ তুর্কি পরিবারেরই যে নেই, ইস্তাম্বুলের রাস্তায় হাজার হাজার স্কুল ছেড়ে দেওয়া, ইংরেজি না জানা তরুণ-তরুণী তার প্রমাণ। হাজার হাজার মূর্খ পয়দা হলে (আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে) মোল্লাদের লাভ হতে পারে, কিন্তু তাতে পরিবার বা দেশের কী লাভ বলুন?’ এহেমেতের কাছ থেকেই জানলাম, তুরস্কে শিক্ষার মাধ্যম বাধ্যতামূলকভাবে তুর্কি, যদিও অল্প বয়স থেকে শিশুদের ইংরেজি শেখানোর চেষ্টা থাকে। তুরস্কেও বাংলাদেশের মতো কিন্ডারগার্টেন আছে, তবে সেখানে শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি নয়, তুর্কি।
বাসের মান ইওরোপ-আমেরিকার চেয়ে এক কাঠি সরেস। সিটের রঙ দেখে সন্দেহ হলো বাসটি ফ্রান্সে তৈরি, কারণ একই রঙের সিট ফ্রান্স এবং (ফ্রান্সে নির্মিত) মনট্রিয়লের বাসেও দেখেছি। বাসের মধ্যে টিভিতে বিজ্ঞাপন চলছে। হঠাৎ এক বিজ্ঞাপনে ‘বাবা’ শব্দটি শুনে এহেমেতকে জিগ্যেস করলাম তুর্কি ভাষায় শব্দটির মানে কি। ‘শব্দটির অর্থ ‘জন্মদাতা পিতা’, তবে বড় কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক নেতাকেও অনেক সময় ‘বাবা’ বলা হয়, অনেকটা আমাদের ‘দয়াল বাবা কলা খাবা’-র মতো আর কি। এই তুর্কি ‘বাবা’ এবং ফার্সি ‘দাদা’ বাংলাদেশে হিন্দুয়ানি শব্দ মনে করে মুসলমানেরা সাধারণত ব্যবহার করতে চান না। আয়রনি বা কূটাভাষ হচ্ছে এই যে আগাপাশতলা মুসলমানী এই শব্দগুলো বাঙালি হিন্দুরাই প্রধানত ব্যবহার করে।
সুলতান এহেমেতের আগের স্টেশন গ্র্যান্ড বাজার। এহেমেত বুদ্ধি দিল, আমরা ইচ্ছে করলে ওর সঙ্গে নেমে যেতে পারি এবং পায়ে হেঁটে হাজিয়া সোফিয়ার দিকে এগোতে পারি। তাই করলাম আমরা। এহেমেতকে বিদায় জানিয়ে ঢুকে পড়লাম ইস্তাম্বুলের বড় বাজারে। পঞ্চদশ শতকে তুর্কি সুলতানের উদ্যোগে স্থাপিত এই বাজারে যাকে বলে ‘বায়ান্ন রাস্তা তিপ্পান্ন গলি’-র সমাহার।’ যারা মধ্যযুগ বা এর আগের আরব বাজার সম্পর্কে ধারণা পেতে চায়, তাদের এই বাজারে আসতেই হবে। এত পুরনো বাজার কি পৃথিবীতে আর আছে? এটি এক সময় আসল বাজারই ছিল, এখনও বাজারের খাঁচাটি আছে, তবে বিক্রি হচ্ছে, প্রধানত ভ্রমণকারীদের জন্যে বিভিন্ন জিনিষপত্র: তুর্কি তৈজস, মশলা, চা, তলোয়ার, অলঙ্কার, হাতে তৈরি চামড়ার জিনিষপত্র, ঝাড়বাতি, ফ্রিজে আটকানোর চুম্বক লাগানো স্যুভেনির ফলক। বিক্রেতাদের ব্যবহার চমৎকার। ক্রেতাদের ঠকানোর কোনো মতলব নেই, দামেরও খুব একটা হেরফের হয় না। ক্রেতাদের তারা দোকানে আসার আহ্বান করছে, কোথাকার লোক জিগ্যেস করছে, বিশেষত তরুণ বিক্রেতারা, অনেক সময় ক্রেতাদের ভাষায়। আমরা বাংলাদেশের লোক বলাতে জানতে চাইল, আমরা ঢাকার গ্রীনরোডে থাকি কিনা।
ঘোরাঘুরি এবং টুকটাক কেনাকাটা শেষ করে বড় বাজারের প্রাচীন গেট দিয়ে বের হতেই সামনে পড়লো ইস্তাম্বুলের গ্র্যান্ড মুফতির কার্যালয়, যেটি মূলত একটি মসজিদ। পানির দরকার হলো বলে ওজু করার জায়গা থেকে পানি নিতে গেলাম। ওজু করার সময় পানি পড়ে স্বেতপাথরের ক্ষয়ের পরিমাণ দেখে বোঝা যায় মসজিদটি কত প্রাচীন। এ রকম ক্ষয় হয়ে যাওয়া অজুর জায়গা হাজিয়া সোফিয়াতেও দেখবো তবে আরও ঘণ্টা দুয়েক পর। মসজিদের উল্টোদিকে, বড় বাজরের গেটের ঠিক পাশের টয়লেটে গিয়ে দেখলাম, শৌচকর্মের ব্যবস্থা অতি সাধারণ, কিন্তু খুবই পরিচ্ছন্ন। টয়লেট করতে কোনো টাকা-পয়সা দিতে হয় না দেখে অনেক দেশের ট্যুরিস্টই অবাক হচ্ছিল। বোঝা গেল, প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারতে হলে বেশির ভাগ দেশে ফেলো কড়ি মাখো তেল। প্যারিসের মতো সভ্যতার ধ্বজাধারী দেশেও ‘মলত্যাগ ১০, মুত্রত্যাগ ৫ এবং বায়ুত্যাগ ফ্রি’ লিখে রাখার মতো অবস্থা। রেস্টুরেন্টে আগে খাবারের বিল দিয়ে সেই বিল দেখিয়ে তবে আপনি টয়লেটে প্রবেশাধিকার পাবেন। সভ্যতার ধ্বজাধারী ফরাসিরা যখন এমন ছোটলোকী চর্চা করছে, তখন ইস্তাম্বুলের তুর্কি কেয়ারটেকার বড় গলায় বলতেই পারে: ‘ফ্রি, ফ্রি, নারী পুরুষ সবার জন্যেই ফ্রি!’
এগিয়ে যাচ্ছিলাম হাজিয়া সোফিয়ার দিকে। চমৎকার ঝামা ইটের রাস্তা, কংক্রিটের প্রশস্ত ফুটপাত। পথে দেখলাম এক জায়গায় কমলা আর ডালিমের রস বিক্রি হচ্ছে। ডালিম-কমলা পাশেই রাখা আছে। জুস-মেশিনে জায়গামত বসিয়ে হাতলে চাপ দিলে রস বের হয়ে গ্লাস ভরে যাচ্ছে। রস খেতে খেতে চোখে পড়লো সামনের মসজিদের পেছন দিকে একটা গাছ এমনভাবে ছাঁটা হয়েছে যে দেখে মনে হচ্ছে এক সুফি সাধক দুই হাত তুলে নাচছে। নৃত্যরত সুফি তুরস্কের অন্যতম একটি আইকন। ঘুরে ঘুরে নাচতে নাচতে কৈবল্য বা ফানার কাছাকাছি কোনো মানসিক অবস্থায় চলে যাওয়া সুফিধর্মের একটি প্রধান আচার। এই আচার তুর্ক-ইরান থেকে রওয়ানা হয়ে উত্তর ভারত হয়ে চট্টগ্রামের মাইজভা-ার কিংবা ঢাকার অদূরে ল্যাংটা বাবার মাজারে গিয়ে পৌঁছেছে।
হাজিয়া সোফিয়া পৃথিবীর বিখ্যাত একটি ভবন যার নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে। প্রথমে এটি ছিল কোনো অখ্রিস্টান প্যাগান সম্প্রদায়ের ধর্মস্থান। বৌদ্ধদের ধর্মস্থানও হতে পারে, কারণ আফগানিস্তান-পাকিস্তান-ইরান-তুর্কিস্থানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ সে সময়ে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিল। রোমান স¤্রাট খ্রিস্টধর্মের মহিমা দেখানোর জন্যে সেই ধর্মস্থানে একটি ক্যাথেড্রাল নির্মাণ করান। ক্যাথেড্রালটি একাধিক বার ধ্বংস হয় বিভিন্ন দাঙ্গা ও অগ্নিকাণ্ডে। অবশেষে পঞ্চম শতকে রোমান সম্রাট কনস্ট্যানটিন নতুন করে বর্তমান যুগের ছয় তলা ভবনের সমান উঁচু এই ক্যাথেড্রাল পুননির্মাণ করান। গম্বুজ-সম্বলিত এত বৃহৎ ভবন সম্ভবত পৃথিবীতে আর নেই। ১২০৪ সালে ভেনিসীয়রা এবং চতুর্থ ক্রুসেড করতে আসা ইওরোপীয় যোদ্ধারা এই ক্যাথেড্রাল লুট করে।
১৪৫৩ সালে তুর্কি সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ কনস্ট্যান্টিনোপল জয় করার নগরীটির নাম বদলে রাখেন ‘ইস্তাম্বুল’। ‘ইস্তাম্বুল’ (বা ‘ইস্তাম্বুর’) নামটি অবশ্য আগেও চালু ছিল। এই গ্রীক শব্দটির অর্থ ‘শহরের দিকে’। সুতরাং এমনও হতে পারে যে কনস্ট্যান্টিনোপল নামটি বাতিল হয়ে যাওয়াতে ‘ইস্তাম্বুল’ নামটি চালু হয়। হাজিয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়। তুর্কি শাসনকালে একাধিক বার হাজিয়া সোফিয়ার সংস্কার করা হয়, বিভিন্ন আমলে একাধিক মিনার যোগ করা হয়। গীর্জার অভ্যন্তরে শ্বেতপাথরের সিঁড়িসহ মিম্বর যোগ করা হয় যেখানে দাঁড়িয়ে প্রধান মাওলানা বক্তৃতা দিতেন। মাওলানারা আলাপ-আলোচনা করার জন্যে একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয় শ্বেতপাথরের। এইসব সংযোজনের ফলে গীর্জার ভিতরের পরিসর যে কমে গেছে এবং অবারিত দৃষ্টি যে বাধাগ্রস্থ হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রোমান রীতিতে নির্মিত ভবনের সঙ্গে মিনার আদৌ যায় কিনা সে প্রশ্নও করা যেতে পারে। তবে দখলকৃত একটা ভবনে জয়ীপক্ষ নিজের ক্ষমতার কোনো প্রমাণই রাখবে না – এটাতো হতে পারে না।
দেয়ালের যে ফ্রেস্কোগুলোতে মাতা মেরী কিংবা যীশুর প্রতিমূর্তি ছিল সেগুলো মুছে ফেলা হয়েছিল, যদিও কোনো অজ্ঞাত কারনে সবগুলো মোছা যায়নি বা মোছা হয়নি। না মোছার কারণ নিশ্চয়ই উচ্চতা নয়, কারণ ৭০ হাত উচু গম্বুজের সিলিঙে খ্রিস্টান কাহিনির ছবি কোরানের আয়াত দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে, জানি না ইতিহাসের কোন সন্ধিক্ষণে। কাজটা শিল্পীকে শুয়ে শুয়ে করতে হয়েছে এবং অত উচুতে কাজটা করা সহজ ছিল না অবশ্যই। স্বেতপাথরের কারুকাজের মধ্যে যেখানে ফুল কিংবা ফলের রিলিফ মূর্তি ছিল সেগুলো অটুট আছে, কিন্তু পাশের অনেকগুলো চতুষ্কোণ জায়গা ঘসে সমতল করে দেওয়া হয়েছে। ধারণা করা যেতেই পারে যে সেসব জায়গায় কোনো মানুষের বা প্রাণীর রিলিফ মূর্তি ছিল। শ্বেতপাথরের কিছু বীমে খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসীর প্রতীক ভেড়ার মূর্তি ছিল। এই বীমগুলো সাম্প্রতিক খননকাজে আবিষ্কৃত হয়েছে।
১৯৩৫ সালে কামাল আতাতুর্ক হাজিয়া সোফিয়াকে যাদুঘর ঘোষণা করে সর্ব সাধারণের জন্যে উন্মুক্ত করে দেন। বর্তমানে এই যাদুঘরে সংস্কার চলছে। মুছে যাওয়া খ্রিস্টান চিত্রগুলো নতুন করে আঁকা হচ্ছে। এর পরেও তুরস্কের শাসকমহল এবং জনগণের একটি অংশ নিশ্চয়ই ভুলতে পারে না যে হাজিয়া সোফিয়ার মূল ভবনটি খ্রিস্টানদের হাতে গড়া। এর প্রমাণ, গম্বুজের সিলিঙের আশেপাশে গোলাকার বোর্ডে বড় বড় অক্ষরে কোরানের আয়াত লিখে দেয়ালের কোনো খ্রিস্টান চিত্র বা অলঙ্করণ এখনও ঢেকে রাখা হয়েছে। নিচতলার দেয়ালে দেয়ালে কোরানের আয়াতের চমৎকার সব ক্যালিগ্র্যাফি বাঁধাই করে টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে।
প্রায় পাঁচ হাত প্রশস্ত সুরঙ্গ-আকারের পাথুরে চড়াই পথ বেয়ে হাজিয়া সোফিয়ার দোতলায় (আসলে চার-পাঁচ তলা ভবনের সমান উচু) উঠে এলাম। এ জায়গাটা গম্বুজের অনেকটা কাছাকাছি। সেখান থেকে জানালাপথে দেখা যায় নীল মসজিদ। এই মসজিদটি নির্মাণ করে তুর্কি স¤্রাটেরা নাকি দেখাতে চেয়েছিলেন যে তাঁরাও হাজিয়া সোফিয়ার মতো ভবন নির্মাণ করতে সক্ষম। উপরে উঠে দেয়ালের একটা ছিদ্র ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম, হাজিয়ার দেয়াল পুরোপুরি প্রস্তরনির্মিত নয়। ভিতরে ইট-সুড়কির দেয়ালের উপর পাথরের টালিগুলো লাগিয়ে দেয়া হয়েছে সেযুগের উন্নত কোনো মশলা দিয়ে। দোতলার দেয়ালে অনেকগুলো খ্রিস্টান কাহিনি-চিত্র অনেকখানি অটুট আছে।
তিন-চার মানুষ সমান দরজাগুলোর প্রস্থ দুই বিঘতের মতো। দরজাগুলো কাঠের তৈরি, তবে কাঠের উপর কালো পাথরের বড় টালি লাগিয়ে দেওয়াতে পুরোটাই পাথরের তৈরি বলে ভ্রম হয়। দরজার উপরের দিকে বিঘৎখানেক পর পর লোহার গজাল মারা, কাঠের সঙ্গে পাথরের টালিগুলোকে আটকানোর জন্যে অথবা কিছু ঝোলানোর জন্যে সম্ভবত। ঢোকার সময়ে দেখেছিলাম, বের হবার সময় আবার খেয়াল করলাম, প্রবেশপথের উপরে এক জায়গায় যীশু ও মা মেরির একটি ফ্রেস্কো প্রায় বারো শ বছর পরও এখনও প্রায় অটুট আছে। কোনো কোনো খ্রিস্টান ভক্তকে প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে বুকে-কপালে আঙ্গুল ছুঁইয়ে পিতা-পুত্র-পবিত্র আত্মাকে স্মরণ করতে দেখলাম। মুসলামানেরা হাজিয়া সোফিয়াকে আর মসজিদ হিসেবে ব্যবহার করছে না, যদিও খ্রিস্টানদের কাছে ভবনটি এখনও পবিত্র ক্যাথেড্রালই রয়ে গেছে।
সোফিয়ার চত্বরে একটি বইমেলা হচ্ছিল। দারুন পরিচ্ছন্ন আয়োজন, বইয়ের মুদ্রণ ও বাঁধাই পাশ্চাত্য মানের। শতকরা পঁচানব্বই ভাগের বেশি স্টল এবং বই ইসলাম-বিষয়ক। কোনো কোনো স্টলে তসবিহ এবং আতরও বিক্রি হতে দেখলাম। একটি বা দুটি স্টলে বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ দেখলাম, স্যাঁত একজুপেরির ছোট্ট রাজপুত্র, দস্তয়েভস্কি, সোফোক্লিসের অনুবাদ দেখলাম। একটা তুর্কি উপন্যাসের নাম দেখলাম: সতরঞ্চ। প্রচ্ছদে দাবার ছক ও ঘুঁটির ছবি আঁকা। বোঝা গেল শব্দটি তুর্কি ভাষাতেও ব্যবহৃত হয়। প্রদর্শনীতে শ খানেক স্টল, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, একজন ক্রেতাকেও বই উলটে দেখতে দেখলাম না। হতে পারে, আমরা অসময়ে এসে পড়েছি। কিন্তু সব কিছু দেখেশুনে সন্দেহ হয়, তুরস্কের যুবসমাজ চলছে একদিকে, মিডিয়া আর সরকার চলছে অন্যদিকে। সোফিয়া-চত্বরের বইমেলাটি অবশ্যই একটি সরকারি বইমেলা। এ ধরনের আয়োজন হয়তো পাশ্চাত্যপন্থী যুবসমাজ যথাসাধ্য এড়িয়ে চলে। একই কথা বলা যেতে পারে মিডিয়ায় ধর্মবিষয়ক আলোচনা সম্পর্কে যাতে প্রশ্ন হচ্ছে এমন: ‘আচ্ছা হুজ্জা (হুজুর) বলুন দেখি, কী কারণে বায়তুল মুকাদ্দাসের পরিবর্তে কাবা শরীফকে কেবলা ঘোষণা করা হলো?’ ‘তুরস্কের যুবসমাজের এসব প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত! হুজ্জাদের না আছে নতুন কোন প্রশ্ন, না আছে নতুন কোনো উত্তর!’ বলেছিল এহেমেত। আমি নিজেও ইস্তাম্বুল রওয়ানা হবার দিন সন্ধ্যায় ঢাকা নিউমার্কেটে ব্যাগ কিনতে গিয়ে একটি রেকর্ডকরা ওয়াজ শুনেছিলাম, যেখানে হুজুর সুর করে বলছিলেন: ‘আপনার বাবা-মাকে কেউ অপমান করলে আপনি সহ্য করতে পারেন না, কিন্তু ইহুদি-নাস্তিক-নাসারারা আপনার ধর্মের অপমান করলে আপনি চুপ থাকেন কেন?’ শুনে এক ব্যাগবিক্রেতা ছোকরা তার বন্ধুকে বলছিল: ‘আগে ওয়াজে শিক্ষণীয় অনেক কিছু থাকতো। এখন উষ্কানি ছাড়া আর কিছু পাই না!’ হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সব ধর্মের গুরুরাই অবশ্য উষ্কানী দিতে ওস্তাদ। রাজনীতিবিদদের সংকেত কিংবা আশকারা পেয়ে ধর্মগুরুরা যুগে যুগে অসহিষ্ণুদের উস্কানী দিয়ে আসছে। এসব উস্কানীতে মানুষ মরছে, অস্ত্রের বিক্রি বাড়ছে, সংখ্যালঘুর জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠছে, ভারতে, বাংলাদেশে, কোথায় নয়?
বইমেলা থেকে বের হয়ে হাজিয়া সোফিয়ার চত্বরে যেখানে বেশ কয়েকটি তীরন্দাজের মূর্তি রাখা আছে সেখানে একটি বেঞ্চে শুয়েছিলাম। তুর্ক-মোঙ্গলদের পৃথিবী জয়ের অন্যতম নিয়ামক এই তীরন্দাজেরা। মোঙ্গল ধনুক আকারে ছোট কিন্তু অত্যন্ত কার্যকর। স্থিতিস্থাপকতা আছে এমন একাধিক গাছের ডালকে প্রাণীর টেন্ডন দিয়ে বেঁধে এই ধনুক তৈরি করা হতো। একটি ফুটবল মাঠের গোলপোস্ট থেকে এই ধনুক থেকে তীর ছুঁড়লে অন্য গোলপোষ্টে রাখা এ্যালুমিনিয়ামের বাসন এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায়। মনুষ্যশরীরে এই তীর লাগলে অবস্থা কী হতে পারে সহজেই অনুমেয়। তীরের ফলায় মাখানো বিষের কথা না হয় বাদই দিলামা। চিন্তাসূত্র ছিন্ন হলো কোনো মোঙ্গল যোদ্ধার তীরে নয়, একটি দ্বিবর্ণ বা বাই কালার কাকের কর্কশ ডাকে। বড়সড় এই কাকের শরীর ধূষর, পাখাগুলো কালো। আড়মোড়া ভেঙে নীল মসজিদের দিকে এগিয়ে গেলাম। যাবার পথে তুর্কি হস্তশিল্পের দোকানের সারি। কোন দোকানে সিল্কগুটি থেকে সূতা তৈরি করা হচ্ছে, কোথাও অগ্নিশিখায় কাচ গলিয়ে তৈরি হচ্ছে অলঙ্কার, কোথাওবা ঐতিহ্যবাহী পনির, দই কিংবা অন্যান্য দুগ্ধজাত খাদ্য বিক্রি হচ্ছে।
নীল মসজিদে বিধর্মীদের প্রবেশে নিষেধ নেই, তবে দর্শনার্থীদের মাথা-কাঁধ-পা ঢাকা থাকতে হবে। অর্থাৎ হাফপ্যান্ট বা মিনি স্কার্ট পড়ে মসজিদে ঢোকা নিষেধ। আছরের আজান শুরু হলো। সুলতান এহেমেত এলাকায় একাধিক মসজিদ, সুতরাং একাধিক আজান শুনলাম, তবে সবগুলো আজানই কমবেশি দুই মিনিটের মধ্যে শেষ হলো। প্রতিটি আজান যেন (কোমল রে এবং নি-যুক্ত) আহীর ভৈরব রাগের এক একটি বন্দিশ। মুয়াজ্জিনদের গলাও অত্যন্ত সুরেলা। আমি জানি না, তুর্কি মুয়াজ্জিনদের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় কিনা। যাই হোক, নামাজের সময় বলে আমি মসজিদে প্রবেশ করাটা সমীচীন মনে করলাম না। কোন মসজিদকে তুর্কিরা সবার জন্যে উন্মুক্ত করে দিয়েছে বলেই আমি তাদের ভদ্রতার সুযোগ নিয়ে সেই মসজিদে ঢুকে তাদের প্রার্থনায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারি না।
কাবাব খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে আমরা মাছের খোঁজ করছিলাম। ট্রামলাইনের পাশেই একটা রেস্টুরেন্টে একটা স্যালমন আর একটা ট্রাউট ভাজা অর্ডার করলাম, সাথে টমেটো আর শশার সালাদ। অস্তগামী সূর্যের শেষ রশ্মিটুকু এসে পড়ছিল আমাদের গায়ে। সাগরের ঠাণ্ডা হাওয়ায় শীত অনুভব করছিলাম। ভিতরে বসা যাবে কিনা জিগ্যেস করাতে জানা গেল, ভিতরটা এক বিয়ে-পার্টি বুক করেছে। কথা সত্য। একটু পরেই বর কনেকে দেখা গেল। ইওরোপীয় স্ট্যাইলে কনের পরনে গোড়ালির নিচ অবধি সাদা স্কার্ট, বরের গায়ে কালো কোট। স্কার্টের শেষ প্রান্ত পায়ে পেঁচিয়ে আছাড় খাওয়া এড়াতে সুন্দরী কনে তার স্কার্টটা এতটাই তুলে হাঁটছে যে রক্ষণশীল কারও চোখে ব্যাপারটা শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
ট্রামস্টপেজে ঢুকতে গিয়ে দেখা গেল বৈদ্যুতিন প্রবেশপথে সকালে কেনা কার্ড কাজ করছে না। যাই হোক, সংশ্লিষ্ট ট্রাম কর্মকর্তা দয়াপরবশ হয়ে আমাদের ট্রেনে উঠতে দিলেন। ইস্তাম্বুলে ভ্রমণকারীদের যথাসাধ্য সহায়তা করার চেষ্টা করে সবাই। বর্ণবাদ একেবারেই চোখে পড়েনি। তবে আমাদের ভাগ্যও ভালো ছিল বলতে হবে, কারণ কর্মকর্তা মহোদয় কমবেশি ইংরেজি জানেন। ট্রাম থেকে নেমে মেট্রোবাস নিতে হয়। সেখানেও কাজ করলো না কার্ড। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা সাহায্যের জন্যে এগিয়ে এলেন। কিন্তু তিনি এক বর্ণ ইংরেজি জানেন না। আমাদের তুর্কি ভাষায় বুঝিয়ে বললেন, কীভাবে কার্ডে টাকা ভরতে হবে। আমরা পারলাম না। অন্য এক পথচারীও পারলেন না। আমাদের আনাড়িপনায় বিরক্ত কর্মকর্তা এগিয়ে এসে নিজে চেষ্টা করে দেখলেন যে আমাদের কার্ডটাই আসলে নষ্ট। নতুন করে কার্ড করে, কার্ডে লিরা ভরে ইফতারের আগে আগে হোটেলে ফিরলাম।
তৃতীয় দিন, ২৪শে মে ২০১৮
ইস্তাম্বুলে তৃতীয় দিনটা ঢিলেঢালাভাবে কাটাবো বলে মনস্থ করলাম। ‘ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’ হোটেলের আশপাশের ‘শিশিরবিন্দু’ অর্থাৎ দোকানপাটগুলো শুধু ঘুরে দেখবো। হোটেল থেকে বের হতেই বিপরীত দিকে পড়ে এক সেলুন। নাপিতের দোকান নয়, কেশপ্রসাধনের ক্ষেত্রে ইস্তাম্বুল ‘নাপিতপর্ব’ অতিক্রম করেছে এই অর্থে যে প্রতিটি সেলুনে আছে পাশ করা হেয়ারড্রেসার এবং আগেই বলেছি, সেলুন আছে অলিতে গলিতে। যাই হোক, সেলুনের হেয়ারড্রেসার যুবক আমাকে সালাম দিল প্রতিদিনের মতো আমি ওর দোকানে চুল কাটাবো না জেনেই। ইস্তাম্বুলের দোকানদারের অত্যন্ত ভদ্র। আপনাকে দোকানে ঢোকার আহ্বান জানায়, কিন্তু কিছু না কিনলেও মন খারাপ করে না। বেশির ভাগ দোকানদারের মুখে হাসি লেগেই থাকে, আপনি কিনুন বা না কিনুন এবং সে হাসি অন্য অনেক দেশের ব্যবসায়ীদের মতো আটপৌরে বা স্বয়ংক্রিয় বলে মনে হয় না।
হোটেলের সামনের রাস্তার ফুটপাথে লাগানো গাছে ফোটা নাম না জানা এক ফুলের গন্ধে পুরো রাস্তা মম করছে। তবে ইস্তাম্বুলে সব রাস্তায় এ রকম ফুলের গাছ নেই। গাছও খুব একটা নেই। রাস্তায় কোনো ফুলের দোকান দেখিনি, ফুলও দেখিনি কারও হাতে। বইয়ের দোকানও খুব একটা চোখে পড়েনি। তুর্কি সঙ্গীত? একাধিক দোকানে গান বাজতে শুনেছি বটে। কিছু সুর আরবি ধাঁচের, কিছু সুর ভারতীয়। সব মিলিয়ে তুর্কি সঙ্গীতে বৈচিত্র্য আছে এবং শুনতে ভালোই লাগে। আর আজানের সুরেলা আওয়াজের কথাতো আগেই বলেছি।
বড় রাস্তার দুই দিকে বিচিত্র সব পণ্যের দোকান। প্রায় প্রতিটি রাস্তায় আছে তুর্কি মিস্টির দোকান। প্রায় সব মিস্টিই ময়দা অথবা ডাল এবং চিনি দিয়ে তৈরি। দুধ-ভিত্তিক মিস্টি তুর্কিরা সম্ভবত বানায় না। এর অবশ্য প্রয়োজনও নেই, কারণ ওরা প্রচূর ঘোল ও পনির খায়। তুর্কি মিস্টি বারাক্লাভা অসম্ভব মিষ্টি, পর পর দুটি খেলে মুখ মেরে আনে। এই মিস্টি ছড়িয়ে আছে সারা আরব অঞ্চলে, হয়তো অটোমান সাম্রাজ্যের কারণেই ছড়িয়ে গেছে। দোকানে বিভিন্ন ধরনের মোরব্বাও দেখেছি।
চামড়ার তৈরি পণ্যের এক দোকানে ঢুকে দরদাম করতে শুরু করলাম। দোকানদার আমাকে পণ্যের দাম লিখে দেয় তার মোবাইলে কিংবা ক্যালকুলেটরে। আমি একই ক্যালকুলেটরে বা আমার মোবাইলে আমার দামটা লিখি। ও একটু কমায়, আমি আর একটু কমাই। এভাবে দর কষাকষি চলে ইস্তাম্বুলে। ভাষার পার্থক্য দেয়াল হয়ে যোগাযোগকে ব্যহত করতে পারে না মোবাইল থাকার কারনে। কেনাকাটা শেষ হবার পর দোকানদার জিগ্যেস করলো, আমরা কোন দেশ থেকে এসেছি। উত্তর দেবার পর দোকানদার বললো : ‘আন্না কুর্দ’। অর্থাৎ সে সংখ্যালঘু কুর্দি সম্পদ্রায়ের লোক, সংখ্যাগুরু তুর্কি নয়। ‘কোনো অসুবিধা হয় না?’ প্রশ্ন করাতে বেচারা এমন স্থির করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো যে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আমিও এক বোকা! সংখ্যালঘুর অসুবিধা হবে না, এও কখনও হয়, অন্ততপক্ষে শ দুয়েক বছর আগে সারা পৃথিবীতে জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক ফ্যাশন চালু হবার পর থেকে।
এক মশলার দোকানে ঢুকলাম। পরিপাটি করে সাজানো দোকান। গরম পানিতে সিদ্ধ করে চা-এর মতো উষ্ণ পানীয় বানিয়ে খাবার পাতা এবং ফুল আছে প্রায় চল্লিশ রকমের। জেসমিন, বেলী, গোলাপকুঁড়ি কত রকমের উষ্ণপানীয়ের কত রকম উপাদান যে হতে পারে! চীনেও এসব দেখেছি, কিন্তু ইস্তাম্বুলে এ ধরনের পণ্যের সংখ্যা অনেক বেশি। যত রকম মশলা আমরা চিনি বাংলাদেশে সেগুলো তো আছেই, আমরা চিনি না এমন মশলাও শ খানেক আছে। জিরা কিংবা হলুদের গুড়া, কী তার রঙ, কী তার গন্ধ। দেখে এবং শুঁকে মনে হলো, আমাদের দেশের মশলাগুলো হয় সব ভেজাল, নয়তো আদতেই নি¤œমানের। কমলা রঙের একটা মশলা দেখে জাফরান বলে মনে হলো। ৫ লিরায় (১৪০ টাকা) ছটাকখানেক মেপে দিল। দাম এত কম দেখে অবাক হওয়াতে দোকানদার জানালো যে ওগুলো তুর্কি জাফরান। ক্যাশবাক্সের কাছে নিয়ে গিয়ে বেগনি রঙের আসল ইরানি জাফরানও দেখালো। মাত্র কয়েক গ্রাম ইরানি জাফরান কিনলাম ২৫ লিরায়।
মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, তুরস্ক কিংবা চীন-জাপানে চা-পানের সংস্কৃতি এবং বিচিত্র জাতের উষ্ণ পানীয় পানের এই সংস্কৃতির উৎস কী। ইস্তাম্বুলের মশলার দোকানে কিছু চায়ের নাম ‘জেন’ চা। এই ‘জেন’ শব্দটি হচ্ছে সংস্কৃত ‘ধ্যান’ শব্দের অপভ্রংশ। ভারত-আফগানিস্তান-তুরস্ক-ইরান অঞ্চল এক সময় বৌদ্ধ অধ্যুষিত ছিল। সপ্তম শতকে হিউ এন সাং যখন ভারতভ্রমণে আসেন তখন আফগানিস্তানের জনসাধারণের অর্ধেক হিন্দু আর অর্ধেক বৌদ্ধ। বৌদ্ধ ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ অনেক পাণ্ডুলিপি, অনেক বৌদ্ধমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে তুর্কিস্তানে। ইরান-তুর্কিস্থান অঞ্চলে ‘বখশ’ বা ‘বকশি’ উপাধি (সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে) সংস্কৃত ‘ভিক্ষু’ শব্দের অপভ্রংশ। বৌদ্ধধর্মে ধ্যান করাটা অপরিহার্য এবং সচেতনভাবে (অর্থাৎ ঘুমিয়ে না পড়ে) ধ্যান করতে চা-পান সহায়ক হতে পারে। এই অঞ্চলে বিচিত্র ধরনের চা-পানের সংস্কৃতির উৎস অঞ্চলটির বৌদ্ধ অতীতে খোঁজা যেতে পারে।
কাবাব খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল না বলে সামনে এক বার্গার কিং দেখে সেখানে ঢুকলাম ফিসবার্গার খেতে। বার্গার খাচ্ছি, এমন সময় সাত/আট বছরের তিনটি বাচ্চা আমাদের টেবিলের কাছে এসে আরবিতে কী যেন বললো। আমরা কিছু বলার আগেই তারা চলে গেল পাশের টেবিলে যেখানে বসেছিল দুটি মেয়ে। ছেলেগুলো ওদের অর্ধভুক্ত বার্গার আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাইগুলো খাবে। একটা মেয়ে ভয় পেয়ে টেবিলে রাখা ওর মোবাইলটা হাতে তুলে নিল। বলাতো যায় না, যদি মোবাইল নিয়ে দৌঁড় দেয়। এর পর আরও একটি টেবিলে গেল ছেলেগুলো। সবাই যখন বিরক্ত তখন এক খদ্দের এসে ‘চিক’, ‘চিক’ (তুর্কি ভাষায় ‘চিকিশ’ মানে যেহেতু ‘প্রস্থান’, ‘চিক’ মানে ‘দূর হ!’ ধরনের কিছু একটা হবে) বলে ছেলেগুলোকে দোকান থেকে বের করে দিল। ছেলেগুলো বের হয়ে গেলে অন্য এক খদ্দের পিছন পিছন গিয়ে ছেলেগুলোকে আবার ডেকে নিয়ে এল। কাউন্টারে নিয়ে গিয়ে ছেলেগুলো যা যা খেতে চায় অর্ডার নিতে বললো। পয়সা যা লাগে উনি দেবেন। তাড়িয়ে দিয়েছিল যে খদ্দের তাকে আর দেখা গেল না। কাউন্টারের ছেলেমেয়েগুলোও বিনা বাক্যব্যয়ে ছেলেগুলোর হাতে খাবারের ট্রে তুলে দিল। বার্গার কিংটা দোতলা। ছেলেগুলো নিচে বসে খাবে না। তারা দোতলায় গিয়ে খাবে। হয়তো ওদের কাছে দোতলাটা দারুন কোনো জায়গা বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু খাবারসহ ট্রেগুলো এমন ভারি যে ওদের কচি হাতে সেগুলো তারা বহন করতে পারছিল না। দোকানে কিউতে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি মেয়ে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বাচ্চাদের ট্রেগুলো দোতলায় দিয়ে এলো।
যে খদ্দেরটি ছেলেগুলোকে খাওয়ালো ওর সঙ্গে আছে ওর অপরূপ সুন্দরী বৌ ও (সম্ভবত) শ্যালিকা এবং ওদের দুই-তিন বছরের একটি ফুটফুটে মেয়ে। ছোট্ট মেয়েটি এই ঘটনায় এমন ভয় পেয়েছে যে পুরো সময়টা শক্ত করে বাপের আঙ্গুল ধরে ছিল। খাওয়া শেষ করে পরিবারটি যখন বাইরে বেরিয়ে আসলো তখন পুরো ঘটনাটা জানার জন্যে আমি লোকটার দিকে এগিয়ে গেলাম (আমার স্ত্রী অবশ্য বারবার বাধা দিচ্ছিল আমাকে)। যা ভেবেছি তাই, বাচ্চাগুলো সিরীয় শরণার্থী এবং ওদের কুকুরের মতো তাড়িয়ে দেওয়াতে লোকটার খুবই খারাপ লাগছিল। ‘আপনিতো এখানকার, তুর্কি আপনি, তাই না?’ আমাকে অবাক করে দিয়ে লোকটা জবাব দিল: ‘না, আমি ফিলিস্তিনী। মাত্র চার দিনের জন্যে এখানে সপরিবারে বেড়াতে এসেছি। আমার বাড়ি নাজারেথে।’ উত্তর দিয়ে লোকটা রওয়ানা হবার পর আমি পিছন পিছন গিয়ে ওকে আবার জিগ্যেস করলাম: ‘নাজারেথ এখন ইসরাইলে না?’ লোকটির জবাব: ‘হ্যাঁ, আমি ইসরাইলী ফিলিস্তিনী!’
শুনে আমি থ হয়ে গেলাম এবং বেশ কয়েকটি ভাবনা আমার মাথায় এলো। এক. এই সেই নাজারেথ যেখানে জন্ম নিয়েছিলেন যীশুখ্রিস্ট। মুসলমানেরা এখনও খ্রিস্টানদের ‘নাসারা’ বলে গাল দেয়। আজ চোখের সামনে দেখলাম, মুসলমানও আক্ষরিক অর্থে নাসারা হতে পারে। বাচ্চাগুলো আরবিতে কথা বলছিল বলে আমাদের ফিলিস্তিনী নাসারা যুবক ওদের কথা বুঝতে পেরেছিলেন এবং তাদের আরবি এ্যাকসেন্ট শুনে তিনি এও বুঝতে পেরেছিলেন যে ওরা সিরীয় শরণার্থী। একাধিক সিরীয় বাচ্চাকে আমরা গত দুদিন রাস্তায় ভিক্ষা করতে দেখেছি। বাপ-মা হয়তো শহরের কোথাও মানবেতর জীবন যাপন করছে আর বাচ্চাগুলো শহরের রাস্তায় ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছে। হায়! কদিন আগেও সিরিয়া ছিল একটি ধনী দেশ এবং যুদ্ধ না হলে এই ছেলেগুলো হয়তো নিয়মিত স্কুলে যেতো এবং বাপ-মার আদরেই অন্য সব বাচ্চার মতো বড় হয়ে উঠতে পারতো।
দুই. ১৯৭১ সালে আমি ওদের বয়সী ছিলাম এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে আমাকেও ত্রিপুরা কিংবা আসামের রাস্তায় ভিক্ষা করতে গিয়ে এভাবে কুকুর-ধাওয়া খেতে হতো। তিন. ইসরাইলীরা একদিকে ফিলিস্তিনীদের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে, তাদের জায়গা দখল করছে, আবার অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ইসরাইলে লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনী মুসলমান নাগরিক আছেন যাদের মধ্যে কেউ কেউ ইসরাইলী পাসপোর্ট নিয়ে সপরিবারে দেশের বাইরে বেড়াতেও যেতে পারেন।
চার. গত রাতে তুরস্কের ইংরেজি চ্যানেলে ইতালির প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলতে শুনেছিলাম, ইতালির ধনী অধিবাসীরা দিন দিন যে কোনো গরীবের প্রতি অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে, বিদেশি, জিপসি বা কালো রঙের গরীবতো বটেই, এমনকি ইতালীয় গরীবদেরও তারা সহ্য করতে পারছে না। তুরস্কের লোকেরা সুখে আছে, তারাই বা কেন ইস্তাম্বুলের রাস্তায় সিরীয় ভিখিরিদের সহ্য করবে? ছেলেগুলো হঠাৎ রেস্টুরেন্টে ঢুকে যখন অর্ধভুক্ত বার্গার খেতে চাইল, তখন আমিও কি কমবেশি বিরক্ত হইনি? পরশু এবং গতকাল ইস্তাম্বুলের রাস্তায় সিরিয়ান শিশুদের দেখে আমার রীতিমত ভয় হচ্ছিল, আমার পাসপোর্ট বা মানিব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে না তারা দৌঁড় দেয়।
পাঁচ. ইসরাইলে বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত সংখ্যালঘু ফিলিস্তিনী যুবকটি একটি মুসলিম দেশে কিছু মুসলিম শিশুকে কুকুরের মতো তাড়া খেতে দেখে তাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়েছে। ওর মানবিকতা নিঃসন্দেহে আমার চেয়ে বেশি, যদিও এটাও সত্য যে শ্রেফ ব্যক্তিবিশেষের মানবিকতা দিয়ে এই জটিল সমস্যার সমাধান করা যাবে না। সমস্যার সমাধান হতে হবে রাজনৈতিক এবং আন্তর্জাতিকভাবে। কিন্তু তা কি কখনো হবে? যে কোনো সভ্যতা: রোমান, আরব, তুর্ক, মোঙ্গল প্রধানত লুট-নির্ভর। যে কোনো জাতি দুই এক শতক ধরে লুট করার পর সভ্যতা গড়ে তোলার অবকাশ পায়। হাজিয়া সোফিয়ার প্রবেশপথে একটি হাদিসের কথা লেখা আছে, যাতে বলা হয়েছে, নবী করিম (সঃ) বলেছেন: ‘যে সেনাবাহিনী কনস্ট্যান্টিনোপল দখল করবে, সেই সেনাবাহিনী হবে সর্বোত্তম আর যিনি সেই বিজয়ে নেতৃত্ব দেবেন, তিনি হবেন সর্বোত্তম সেনাপতি।’ এই হাদিস সহি কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে, কিন্তু হাজিয়া সোফিয়ার প্রবেশপথে এই হাদিস লিপিবদ্ধ করার অর্থ এও হওয়া অসম্ভব নয় যে তুরস্কের একটি মহল মনে করে, ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে অটোমান স¤্রাট দ্বিতীয় সুলতান মেহমুদের হাতে কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয় মহান সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছারই প্রতিফলন।
‘সুসভ্য’ পাশ্চাত্যের লক্ষ্য, বিশ্বের যেখানেই সম্পদ আছে, যেমন ধরা যাক আরববিশ্বে, কীভাবে সেখানে আপদ সৃষ্টি করে সম্পদ লুটের মাধ্যমে নিজেদের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করা যায়। এই লুটকর্মে কি সৃষ্টিকর্তার সায় আছে? নিশ্চয়ই আছে, কারণ সৃষ্টিকর্তা মানুষের মতো যুগে যুগে মত পরিবর্তন করার কথা নয়। তবে আজ যে জাতি বা পরিবার লুট করছে, কাল সে জাতি বা পরিবার লুট হতে পারে। আগেকার দিনে লুটের উপায় ছিল ধনী অথচ সামরিকভাবে দুর্বল কোনো দেশকে আক্রমণ করা, রোমক-আরব-তুর্কীরা যা করতো, তুর্কিরা যেমন করেছে ভারতবর্ষে, বাংলাদেশে। মানুষ দিন দিন উন্নত হচ্ছে এবং লুটের প্রক্রিয়া বদলে যাচ্ছে। এখন লুট করার উপায় হচ্ছে, সম্পদশালী দেশে কিংবা আশেপাশের এলাকায় কদিন পর পর যুদ্ধ লাগিয়ে দেয়া এবং তালেবান কিংবা আই এস-এর মতো জঙ্গীবাদী সংগঠন সৃষ্টি করা। কইয়ের তেলে কই ভাজা কিংবা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা হয়তো একেই বলে। আই এস সিরিয়া বা ইরাকের তৈলকূপগুলো থেকে ইচ্ছেমতো তেল উত্তোলন করে সস্তায় পাশ্চাত্যের হাতে তুলে দিয়েছিল বলেই তেলের দাম এই কদিন আগেও কম ছিল। এখন আই এস নেই, সুতরাং তেলের দামও বেড়ে হয়েছে দুই বছর আগের তুলনায় প্রায় তিনগুন।
আরব বিশ্বের রাজা বাদশারা নিজেদের তখত টিকিয়ে রাখার জন্যে পাশ্চাত্যের অমানবিক কর্মকাণ্ডে সমর্থন জানাতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের ভয়, কখন না আবার আরব-বসন্ত শুরু হয়ে যায় এবং কে না জানে, বসন্ত রোগটা সংক্রামক। সুতরাং কাতার কিংবা সৌদি আরব নিজেদের সম্পদ পাশ্চাত্যের হাতে তুলে দিয়ে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্র কিনতে বাধ্য হচ্ছে। সম্প্রতি কাতারকে এমনভাবে লুট করা হয়েছে যে কাতার এয়ার ওয়েজ পৃথিবীর একাধিক দেশে নিজেদের অফিস বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে। একই সময়ে পাশ্চাত্যের অস্ত্রকারখানাগুলো সচল হচ্ছে, বেকারত্ব কমছে (এর ফলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের রপ্তানীও অবশ্য বাড়ছে, যার মানে হচ্ছে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে আমরাও এই পরিস্থিতির সুবিধা নিচ্ছি)। আরব দেশগুলোতে যেহেতু ন্যূনতম গণতন্ত্রটুকুও নেই, সেহেতু তেলাপিয়া বাদশাদের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করার কোনো উপায়ও সেখানে নেই। প্রতিবাদের কোনো অভ্যাস বা সংস্কৃতিই হয়তো আরব অঞ্চলে এখনও গড়ে উঠেনি।
ফিরে আসি ইস্তাম্বুলে। এ শহরের রাস্তাঘাত নিয়মিত এবং সব সময় পরিষ্কার করার লোক আছে। পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের গায়ে যে কমলা রঙের ইউনিফর্ম সেটিও অত্যন্ত পরিষ্কার। মেয়রসহ ইস্তাম্বুলের নগর পরিচালকেরা শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে সদা সচেতন – বলেছিল এহেমেত। ইস্তাম্বুল শহরের মোড়ে মোড়ে মসজিদ নেই, কিন্তু যে মসজিদগুলো আছে সেগুলো দেখার মতো। শহরের রাস্তায় গাড়ি খুব ধীর গতিতে চলে। হর্ন প্রায় শোনাই যায় না। লোকজন ইচ্ছামতো হাত তুলে রাস্তা পার হয়। পথচারীদের দাবিই অগ্রগণ্য। দুই এক জায়গায় জেব্রা ক্রসিং আছে, লাল-সবুজ আলোও আছে, কিন্তু পথচারীরা লাল আলোতেও হাত তুলে রাস্তা পার হয়। তবে সবুজ আলোতে অন্ধদের রাস্তা পার হবার জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা আছে। ফুটপাতগুলো প্রতিবন্ধীবান্ধব। ফুটপাতে এমনভাবে খাঁজ কেটে দেয়া হয়েছে যে হুইলচেয়ারে বসা কোনো প্রতিবন্ধী সহজেই শহর ঘুরে বেড়াতে পারবো। ফুটপাতে অন্ধদের চলার জন্যেও বিশেষ ব্যবস্থা আছে ঠিক যেমনটা জাপানের শহরগুলোতে দেখেছি।
ইস্তাম্বুল শহরে কোন ফুটওভারব্রিজ দেখিনি। মিনিটখানেক পর পরই বিভিন্ন সাইজের উন্নতমানের বাস এসে দাঁড়াচ্ছে বাসস্ট্যান্ডে এবং যাত্রীদের নিয়ে ছুটে যাচ্ছে বিভিন্ন গন্তব্যে। এর মধ্যে যেগুলো মেট্রোবাস সেগুলোর সঙ্গে কোন না কোনো ট্রামস্টেশনে অবশ্যই থামছে। এ ছাড়া হলুদ রঙের ট্যাক্সিক্যাবতো রয়েছেই। রিকশা বা সিএনজির-টাইপ বাহনের কোনো নামগন্ধ নেই ইস্তাম্বুলে। তিন দিনে তিন মিনিটের জন্যেও ট্র্যাফিক জ্যাম দেখিনি। এখানে ওখানে পোশাক পরে এবং সাদা পোশাকে সশস্ত্র পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার পুলিশের গাড়ি দাঁড় করিয়ে সাহায্য চাইতে দেখেছি পথচারীদের। পুলিশের শরীর ফিট, পোষাক স্মার্ট, ব্যবহার ততোধিক স্মার্ট। এহেমেত অবশ্য বলেছিল, এই সব উন্নয়ন নাকি গত পাঁচ-দশ বছরেই হয়েছে।
আজ ইস্তাম্বুলে বিদায়-রজনী। রাত সাড়ে আটটার দিকে ইফতারের আজান দেয়। আটটার দিকে বেরোলাম সবার সঙ্গে ইফতার করবো বলে। যে কাবাব-হাউজে প্রথম দিন মধ্যাহ্নভোজন করেছিলাম সেখানেই ফিরে গেলাম। দেখলাম, তুর্কিরা সাধারণত যা যা খায়, মাংস, বেগুন, আলু, দই সেগুলো দিয়েই ইফতার করছে, আমাদের ছোলা-মুড়ি-পেঁয়াজু-বেগুনির মতো ইফতারের আলাদা কোনো ম্যেনু নেই। আরবেরা ইফতারে জিলিপি খায়, তুরস্কে জিলিপি চোখে পড়েনি। দোকানে মালিক আর কর্মচারীরা বাড়ি থেকে আসা খাবার দিয়ে ইফতার করছিল। আজান হবার সঙ্গে সঙ্গে কাউন্টারে বয়টা জলের বোতল থেকে এক ঢোক পানি মুখে দিয়ে রোজা ভাঙলো। ইফতারের অজুহাতে রেস্টুরেন্টের সার্ভিস কিন্তু বন্ধ হয়নি। কোনো কর্মচারী রোজা আছে কি নেই, সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। ধর্ম পালনের অজুহাতে ইস্তাম্বুলে কোনো কাস্টমারকে অবহেলা করতে দেখিনি। একজন বা দুজন বয় অপেক্ষমান সব কাস্টমারকে খাবার পরিবেশন শেষ করে বাকিদের সঙ্গে গিয়ে ইফতারে যোগ দিল। অন্য দুই জন ততক্ষণে ইফতার শেষ করে আবার কাউন্টারে এসে দাঁড়িয়ে গেছে। না, ইফতারের সময় রেস্টুরেন্টের কাস্টমারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে দেখলাম না। হতে পারে তুর্কিরা নিজের বাসায় পরিবারের সবার সঙ্গে ইফতার করে, অথবা এমনও হতে পারে যে রোজদারের সংখ্যা বেশি নয় যেহেতু দিনের বেলায়ও কোনো রেস্টুরেন্ট খালি দেখিনি।
চতুর্থ দিন, ২৫শে মে ২০১৮
আসার দিন এয়ারপোর্ট ট্যাক্সি সার্ভিসে ফিরতি ট্যাক্সিভাড়া দিয়ে রেখেছিলাম। সন্দেহ হচ্ছিল, ড্রাইভার ব্যাটা আসবেতো ঠিক সময়ে, নাকি ফোন করে ঝগড়া করতে হবে! ৩৫টি ডলার গচ্ছাই গেল বুঝি। এগারোটায় ট্যাক্সি আসার কথা, পৌনে এগারোটায় হোটেলের লবি থেকে ফোন করে জানালো, বান্দা হাজির। হোটেলের এ্যাটেন্ডেন্ট লাগেজ নিচে নামালো, বিদায় দিল হাসিমুখে। ট্যাক্সিড্রাইভার সবগুলো লাগেজ গাড়িতে তুললো, বিমানবন্দরে নিয়ে গিয়ে ট্রলিতে সুন্দর করে লাগেজগুলো সাজিয়ে দিয়ে বললো: ‘এর পর আপনাকে আমি আর সাহায্য করতে পারবো না, স্যার।’। আজ বকশিশ চাইলো না, তবু দিলাম এবং ভাবলাম, এমন চমৎকার সেবা জীবনে আর কোথাও পাইনি। বিমানবন্দরেও প্রয়োজনীয় সেবার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। টার্কিস এয়ারলাইন্সের ফিরতি ফ্লাইটে বিমানবালা এবং স্টুয়ার্টদের চমৎকার, সহাস্য, আন্তরিক ব্যবহারে আমরা মুগ্ধ। নিজেদের বিরক্তকর কাজটা কী আনন্দের সঙ্গে করছে এই ছেলেমেয়েগুলো। এক সময় টয়লেটে ঢুকে দেখি, আয়নার পাশে একটা তাজা গোলাপ আটকানো আছে। তুর্কিমন যে রূচিশীলতার একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে সন্দেহ করার আর কোনো অবকাশ রইল না।
পরিশিষ্ট
ফরাসি প্রবাদ শুনেছি: ‘ফর কম অ্যাঁ তুর্ক’ অর্থাৎ ‘তুর্কিদের মতো শক্তিশালী’। শক্তিশালী না হলে সেই দ্বাদশ শতকে তুর্কি সেনাপতি বখতিয়ার খিলজি তেরো নদী সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ দখল করতে পারে, তাও মাত্র আঠারো জন্য সৈন্য নিয়ে? শ পাঁচেক বছর আমাদের দেশে রাজত্ব করেছে এই তুর্কিরা, ভাবা যায়? তুর্কি ভাষা থেকে আসা বেশ কিছু শব্দ এখনও বাংলা ভাষায় আছে। এই তুরস্কের খিলাফত রক্ষার জন্য বিংশ শতকের শুরুতে এক আন্দোলন হয়েছিল বাংলাদেশে, ভারতবর্ষে, যখন কিনা তুরস্কের জনগণই এই খিলাফতের বিপক্ষে ছিল। কামাল আতাতুর্ক খিলাফতের সমাপ্তি ঘোষণা করলে ভারতবর্ষে হাস্যকর খিলাফত আন্দোলন নিজে থেকেই থেমে যায়। এহেমেত এইসব কাহিনি শুনে বেশ অবাক হয়েছিল।
গত আড়াই দিনে তুর্কি জাতির ক্ষমতার প্রমাণ যথেষ্ট পেয়েছি। সাত-আটশো বছর ধরে যে জাতি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অংশে রাজত্ব করেছে তাদের শরীরে ও চরিত্রে কিছু শক্তিতো থাকতেই হবে। এটা ঠিক গ্রীক, রোমান বা ভারতীয়দের মতো তুর্কিরা কখনই জ্ঞানচর্চায় খুব একটা মনোনিবেশ করেনি। রাস্তাঘাটে বই বা পত্রপত্রিকার দোকান খুব একটা চোখে পড়েনি। বাংলা-বিহার অঞ্চলের হিন্দু-মুসলমানের পূর্বপুরুষদের বেশির ভাগ বৌদ্ধ ছিলেন, এক সময় বৌদ্ধ ছিলেন তুর্কিরাও। কিন্তু ইতিহাসের ফেলে নালন্দাসহ বহু বৌদ্ধ বিদ্যাপীঠ তুর্কিরা ধ্বংস করেছিল। কিছু অধ্যাপক ও বিদ্যার্থী তুর্কি তীর বা তলোয়ারের আঘাত এড়িয়ে নেপাল বা তিব্বতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই প্রাচীন বাংলার নিদর্শন চর্যাপদ কোনমতে রক্ষা পেয়েছে। তবু জ্ঞানের প্রতি তুর্কিদের আগ্রহ যে ছিল তার প্রমাণ, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বিকাশে তুর্কি স¤্রাটদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এছাড়া হাজিয়া সোফিয়ার ভিতরে অটোমান আমলে স্থাপিত একটি মাদ্রাসা-ভবনও দেখেছি। কিন্তু শিক্ষায় অন্য ইওরোপীয় দেশগুলোর তুলনায় তুরস্ক কিছুটা পিছিয়েই আছে বলতে হবে। কিছুদিন আগেও তুরস্কে স্কুলে যাওয়া বাধ্যতামূলক ছিল না। এখন স্কুলে যাওয়াটা বাধ্যতামূলক, কিন্তু কত বছর পর্যন্ত স্কুলে পড়তেই হবে, সে ব্যাপারে বাঁধাধরা কোনো নিয়ম নেই।
মিডিয়ার উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ আছে তুরষ্কে, যার প্রমাণ, উইকিপিডিয়ার মতো নিরীহ সাইটেও আমি ঢুকতে পারিনি। আর্মেনিয়ানদের উপর তুরস্ক যে অত্যাচার করেছে গত শতকে সে বিষয়ে তথ্য থাকার কারণেই হয়তো বা। অত্যাচার করে বিচারের সম্মুখীন হওয়া দূরে থাক, ক্ষমা চাওয়ার কথাও না হয় ভুলে গেলাম, স্বীকার পর্যন্ত করতে চায় না পাকিস্তানের মতো অসভ্য এবং তুরস্কের মতো অর্ধসভ্য জাতি। জাপানের মতো সুসভ্য জাতিও কি চীন বা কোরিয়ার উপর অত্যাচারের কথা স্বীকার করে? ইয়েমেনের নিরীহ জনগণের উপর সৌদি আরবের অকথ্য অত্যাচারের কথা বাংলাদেশের সামাজিক মিডিয়াতে পর্যন্ত শোনা যায় না, অথচ প্যালেস্ট্যাইনিদের উপর ইসরাইলের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সবাই সরব। প্রতিবাদেরও রাজনীতিকরণ হয়ে গেছে, রাষ্ট্রপর্যায়ে তো বটেই এমনকি ব্যাক্তি ও গোষ্ঠীপর্যায়েও। কে মরছে এবং কে মারছে তার উপর নির্ভর করবে প্রতিবাদ আদৌ হবে কি হবে না। অথচ নজরুল সেই কবেই লিখেছিলেন: ‘কাণ্ডারী বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার!’
‘অ্যালকোহল’ শব্দটি আরবি, কিন্তু ইসলাম ধর্মবিশ্বাস অনুসারে আরবদেশের মতো তুরস্কেও সুরাপান নিষিদ্ধ ছিল, যদিও অটোমান শাসকগোষ্ঠীর লোকজন দেদার মদ্যপান করতেন। সুলতান চতুর্থ মুরাদ (১৬১২-১৬৪০) আইন করে সুরাপান নিষিদ্ধ করেছিলেন, যদিও তিনি নিজেই ছিলেন পাঁড় মদ্যপ, অনেকটা মোঘল স¤্রাট জাহাঙ্গীরের মত, যিনি পিতা আকবরের চোখ এড়াতে বন্দুকের ভিতরে করেও নাকি মদ আনাতেন (এই বাদশার নামে ঢাকার নাম ‘জাহাঙ্গীর নগর’, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়’ আর মদ স্পর্শ না করা আকবরের নামে মোহাম্মদপুরেও একটি রাস্তা নেই। মোহাম্মদপুরের পূর্ব নাম রামচন্দ্রপুর (নামটি এখনো দলিলপত্রে বহাল আছে) যেখানে মুঘল ও পাঠান বাদশাদের নামে রাস্তা রয়েছে)।
মৌরির গন্ধযুক্ত ‘রাক’ বা ‘রাকি’ সুরা পান করা তুর্কি খাদ্যসংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ যদিও ইওরোপের মধ্যে তুরস্কে মদ্যপানের পরিমাণ সর্বনিম্ন। এ্যালকোহলযুক্ত পানীয় বিক্রি করতে লাইসেন্স লাগে এবং ১১ বছরে কম বয়সী কারও কাছে এ্যালকোহল বিক্রি করা নিষেধ। কোনো কোনো উৎসবের সময় এই বয়সসীমা ১৫ বছর হয়ে যায়। দোকানের বাইরের টেরাসে এ্যালকোহল বিক্রি করা যায় না, স্কুল বা মসজিদের একশ গজের মধ্যে কোনো দোকানকে এ্যালকোহল বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয় না। মিডিয়ায় এ্যালকোহলের বিজ্ঞাপনের উপর নিয়ন্ত্রণ আছে। মদ খেয়ে গাড়ি চালালে ৬ মাসের জন্যে লাইসেন্স বাতিল হয়।
গত আড়াই দিনে ইস্তাম্বুলের রাস্তায় কাউকে মদ্যপান করে মাতলামী করতে দেখিনি, যেমনটা অনেক সময় দেখেছি প্যারিস, ভিয়েনা, মন্ট্রিয়ল কিংবা টোকিওতে। ২০১৩ সালে কোনো এক রাষ্ট্রনায়ক যখন প্রতিটি তুর্কি পরিবারকে তিনটি করে সন্তান নিতে বলেছিল, তখন ইস্তাম্বুলের রাস্তায় গ্র্যাফিটি শিল্পীরা লিখে দিয়েছিল: ‘তার চেয়ে তিনটি করে বিয়ার খেতে বলো না কেন?’ তুর্কি বিয়ার সুস্বাদু। লাল ও সফেদ মদিরার মান ফরাসি দেশের মতো না হলেও খারাপ নয়। রমজানের কারণে ইস্তাম্বুলে খেতে পারিনি, কিন্তু বিমানে স্বাদ নেবার সুযোগ হয়েছে। স্বর্গে গিয়ে যেহেতু এসবই খেতে হবে, সেহেতু তুর্কি বা মোঘল সম্রাটদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমি মর্ত্যলোকেও এক আধটু চেখে দেখার পক্ষপাতী, যদিও সীমা লঙ্ঘন না করাই শ্রেয়।
ইস্তাম্বুলের রাস্তায় রাস্তায় জুতা পালিশ করার মুচি আছে, যা অন্য ইওরোপীয় শহরে খুব একটা চোখে পড়ে না। মুচির পাশে বসে লোকজন খুব আড্ডা দিতে দেখেছি, অবশ্য বয়স্ক লোকদেরই দেখেছি মুচির পাশে বসে থাকতে। তুর্কিরা মহা আড্ডাবাজ। সন্ধ্যার পর থেকেই কাফেগুলো জমজমাট। সেই কাফেতে এরদোয়ান বা তাঁর মন্ত্রীদের কর্মকা-ের সমালোচনা কি হয় না? এরদোয়ান কেমন দেশ চালাচ্ছেন শোনা হয়নি কোনো তুর্কির মুখে, সে ভাষার কারনেই হোক কিংবা অন্য কোনো কারনেই হোক। আহা, তুর্কিদের ভাষা বুঝি বা না বুঝি, একটা কাফেতে গিয়ে দু দণ্ড বসলেওতো পারতাম! যেখানে মিলেছে দুই মহাদেশ: এশিয়া আর ইওরো, সেই বসফরাস প্রণালী দেখা হয়নি। ইস্তাম্বুলে অবশ্য-দ্রষ্টব্য সুলতান সুলাইমানের প্রাসাদ আর হেরেম দেখা হয়নি। যাদুঘরে গিয়ে দেখা হয়নি নবী মুহম্মদ (সঃ) ও চার খলিফার ব্যবহৃত জিনিষপত্র এবং আরও কত কী (ফ্রান্সের নেপোলেয়িন যেমন মিশর থেকে শত শত টন ওজনের হায়েরোগ্লিফিক লিপিখচিত পাথরের স্থম্ভ নিয়ে এসেছিল লুট করে, তেমনি তুর্কিরাও আরব অঞ্চল থেকে ইসলামের বিভিন্ন নিদর্শন লুটে আনতে ভুল করেনি!)। তবে যা দেখেছি, যা শুনেছি, তাও কি কম? এছাড়া হাজার দুয়েক বছর ধরে গড়ে তোলা একটি শহর আর দোর্দ-প্রতাপ কয়েকটি জাতির শত শত বৎসরের রাজধানী, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের চমৎকার এক মিশ্রণ এই ইস্তাম্বুল নগরী মাত্র আড়াই দিনে দেখে শেষ করার অসম্ভব চেষ্টাই বা আমরা করবো কেন?
অসাধারন স্যার
ভাল লাগল☺
http://buysildenshop.com/ – viagra walgreens price
Real Viagra Without A Script
http://buyplaquenilcv.com/ – buy hydroxychloroquine sulfate
Lasix
https://buylasixshop.com/ – Lasix
http://buylasixshop.com/ – furosemide 40mg tablet
https://buyzithromaxinf.com/ – buy zithromax in stores
Plaquenil
Acquistare Kamagra In Spagna
Neurontine
https://buyneurontine.com/ – Neurontine
215 yellow capsule
http://prednisonebuyon.com/ – Prednisone
Cialis
viagra price at costco
Levitra Viagra
Get Legally Clobetasol Best Website Overseas Pharmacy
Viagra
Langzeitstudie Levitra
buy viagra cialis online
Propecia Without A Prescription
Misoprostol Prix
Amoxicillin Potassium Clavu Tab 500mg
accutane online canada no prescription
levitra prix en bretagne cialis super active
cialis en farmacia buying cialis online reviews
zithromax dosage for chlamydia
buy hydroxychloroquine sulfate
lyrica vs gabapentin
online cialis
cialis for sale
cialis ojos
does propecia really work
Levitra Modalita Di Assunzione
buy zithromax overnight shipping
Cheap Viagra Us Companies Only
Propecia Offerta
lowest prices for cialis
Suhagra 100
Four Corners Pharmacy New Zealand
kamagra st fro sale buy kamagra from india compro kamagra
Many other treatments are available. Ailjfb ordering hydroxychloroquine online in vitro
Ycingk Prices Publix Viagra cheap generic prednisone :: buy prednisone dose pack
Jnpbio Para Que Sirve Levitra 20 Mg prednisone canada
Prednisone If have had high SES as you go through young adulthood through middle age into older adulthood is that like putting money in the bank or is age the great levelerregardless of your socioeconomic status It depends on the disease actually.
buy cialis online Requests for reprints Beth Overmoyer, Dana Farber Cancer Institute, Boston, MA 02115
Very good article. I will be experiencing
many of these issues as well..